সুখী



গল্প

এখন লোডশেডিং। ইনভার্টারে ফ্যানটা চলছে কিন্তু জুন মাসের ভ্যাপসা গরমে তা পর্যাপ্ত নয়। এসি বন্ধ হতেই ঘুম ভেঙ্গে গেল। সিগারেট ধরিয়ে জানলায় এলো ব্রতীন। আট তলার ওপর থেকে শহরের বেশ খানিকটা দেখা যায়। স্ট্রিট লাইট না জ্বলায় আলো আঁধারীতে বেশ মোহময় লাগছে চারপাশটা। চাঁদটা দেখা যাচ্ছে না। আছে কোথাও,আড়ালে লুকিয়ে। রুপোলি আলোয় নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। ঠিক তার আর নয়নিকার সম্পর্কের মতো। দেখা যায় না কিন্তু প্রবল ভাবে আছে। নয়নিকার কথা মনে পড়লেই বুকে একটা চোরা স্রোত বয়ে যায়। মনে হয় সব বাঁধা পেরিয়ে এক্ষুনি ছুটে চলে যাই। অযাচিত একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে। লাইট এলো। জানলা বন্ধ করে এসি চালায় ব্রতীন। বিছানার দিকে মুখ ফেরায়। অঘোরে ঘুমাচ্ছে মোহনা। তাপমাত্রার অদল বদল বা পাশের মানুষটার পাশে না থাকা কিছুই টের পায়নি। কোনদিনই পায়না। বড়ই নিশ্চিন্ত ওর জীবন। আগে চাকরি করতো কনসিভ করার পর সেই যে ছুটি নিলো সে ছুটি আজ দশ বছরেও শেষ হলো না। ছেলে ছেলে করে পাগল। ছেলের স্কুল, ছেলের পড়া, ছেলের সাঁতার, ছেলের ক্রিকেট, রান্না খাওয়া এই নিয়েই মেতে আছে। দু বন্ধু মিলে একটা বুটিক খুলেছে কিছুদিন হলো। দেশপ্রিয় পার্কের কাছে। তাতে খুব একটা কিছু লাভ হয় বলে তো মনে হয় না। ব্রতীন জানতেও চায়না। এসব করে কিছু হবে না। অ্যামবিশন জিনিষটাই নেই ওর। আজকাল মেয়েরা নিজেকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে আর মোহনা, দিনরাত শুধু ব্রেকফাস্ট এ কি খাবে রাতে কি খাবে দুপুরে অফিসে ফোন করেও সেই এক কথা খেয়েছো? ভালোবাসাটা বুঝতে পারলেও আজকাল বিরক্ত লাগে। কোথায় নয়নিকা আর কোথায় মোহনা। এসির নীলচে আলো মোহনার অনাবৃত পায়ের ওপর এসে পড়ছে। ধবধবে ফর্সা মোমের মতো ...কিন্তু কোনো আকর্ষণ অনুভব করে না ব্রতীন। দিন দিন ওজন বাড়ছে মোহনার কিন্তু কোনো হেলদোল নেই। এত নিশ্চিন্ত যে কোনো মহিলা হতে পারে ওকে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। মুখ ফিরিয়ে নেয় ব্রতীন। শুয়ে পড়ে।

স্নান সেরে বেরিয়ে এলো মোহনা। খাটের ওপর তিনটে শাড়ি রেখে গেছিল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে এক এক করে গায়ে ফেলে দেখলো। হলুদ জামদানিটাই পরবে ঠিক করলো। আজ পিয়ার সাধ। পিয়া ব্রতীনের খুড়তুতো ভাইয়ের বউ। বাবুইকে স্কুল থেকে নিয়ে মোহনা একাই যাবে। এইসব অনুষ্ঠানে ব্রতীন যেতে চায় না। দুপুরের খাওয়া তাই ছিমছাম সাজবে মোহনা। একটা স্লিক নেকলেস সাথে ম্যাচিং অল্প ঝুলের কানের দুল। হালকা প্রসাধন। কোনদিনই খুব সাজেনা ও। পারফিউমটা গায়ে মেখে ব্যাগ টা তুলে নিলো । বাবুইকে পিক আপ করে গাড়িতেই ফ্রুট জুসটা খাইয়ে দিলো। অনুষ্ঠান বাড়ির ব্যাপার খেতে খেতে হয়তো দেরি হয়ে যাবে। কাকুমনির বাড়ি ঢুকতেই সবাই ঘিরে ধরলো ওকে।

"ওমা কি মিষ্টি লাগছে রে তোকে! "  বলে জড়িয়ে ধরলো কাকিমনি।

তারপর আরো ননদ জায়েরা।

"উফফফ বৌদি তুমি তো পুরো রসগোল্লার হাঁড়ি। দাদা কি তোমায় শো কেসে রাখে ! এতো ফর্সা কি করে তুমি বলতো।"

হেসে ফেলে মোহনা। ওর গায়ের রং ভীষণ ফর্সা। মুখশ্রীও খুব সুন্দর। শুধু একটু মোটা হয়ে গেছে ইদানিং ।

ফুলপিসি আদর করে বললো..

" ওকে দেখেই বোঝা যায় ও খুব সুখী। আমাদের ছেলে তোমায় বড্ড যত্নে রেখেছে কি তাই তো?"

লজ্জায় মুখ নামিয়ে নেয়।

"আজ সারাটা দিন দারুণ আনন্দে কাটলো",নাইট ক্রীমটা মুখে লাগাতে  লাগাতে বলল  মোহনা।

"তাতো হবেই, আদরের বৌদিকে পেয়ে তার ননদেরা নিশ্চয়ই খুব খুশি ?"

"হ্যাঁ খুব।" ... ড্রেসিং টেবিল থেকে সরে এসে ব্রতীনের গা ঘেঁষে বসে মোহনা।

"জানো সবাই বলছিল আমাকে আজ নাকি খুব ভালো দেখাচ্ছিল। আমাকে দেখেই নাকি বোঝা যায় আমি খুব সুখী। সত্যি ব্রতীন তোমার ভালোবাসায় আমি পরিপূর্ণ। সেটাই হয়তো সবার চোখে পড়ে।"

বলেই ব্রতীনের কাঁধে মাথা রাখে মোহনা।

কি বলবে বুঝতে পারে না ব্রতীন। আলতো হাতে মোহনার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় । ভেতরে কাঁটাটা খচ খচ করে ওঠে।

শনিবারের সকালটা যেন খুশির বার্তা নিয়ে আসে। অফিস ফেরত ক্লাবে যাবার নাম করে গত দু মাস ধরে নিয়মিত নয়নিকার ফ্ল্যাটে আসে ব্রতীন। স্বপ্নের মতো কাটে সন্ধ্যেটা। কিন্তু আজ লাস্ট মোমেন্টে একটা মিটিং এসে যাওয়ায় বেরোতে বেশ দেরি হয়ে গেল। একটা নামী বেসরকারী সংস্থায় ডেপুটি জি এম ব্রতীন। স্যালারি প্রচুর কিন্তু খাটনিও ততটাই। এবারের প্রমোশনে হয়তো জি এম হয়ে যাবে তাই কোথাও কোনো ফাঁক রাখতে চায়না ও। ট্যুর, মিটিং, প্রেজেন্টেশন নিয়ে একে বারে জর্জরিত জীবন। এর মধ্যে একটুকরো দমকা হাওয়া নয়নিকা। ছ মাস আগে মুম্বাই থেকে ট্রান্সফার হয়ে এলো। লম্বা, স্লিম অসম্ভব ব্যক্তিত্বময়ী। মেয়ে হিসেবে কালোই বলা যায়। শান্ত ধীর চোখ দুটোই যেন চুম্বকের আকর্ষণ। চশমার কাঁচেও সেটা ঢাকা পড়েনি। লম্বা চুল। অসম্ভব সফিস্টিকেটেড। প্রথম আলাপেই ব্রতীন বুঝতে পারে এই মেয়ের দুর্নিবার আকর্ষণকে উপেক্ষা করার সাধ্য তার নেই। আর্কিটেক্ট নয়নিকা মিত্রের হাতে কখন যেন নিজেকে সমর্পণ করে ফেললো সে। প্রথমে হোয়াটস অ্যাপে কথা তারপর কফিসপ তারপর ওর বাড়ি। ফ্ল্যাটে একাই থাকে। রোজ যেতে ইচ্ছে করে কিন্তু শুধু শনিবার...এই নিয়মটা নয়নিকারই করা। ওর বক্তব্য রোজ গেলে ব্যাপারটা ডাল ভাত হয়ে যাবে । কোনো এক ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে নয়নিকাকে জড়িয়ে ধরে আবদার করেছিল ব্রতীন

"প্লিজ এতো নির্মম হয়ো না। মাঝে অন্তত আর একটা দিন আসতে দাও। দেখো শক্তি বাবুর মতো আমারও আজকাল মনে হয় 'ভালোবাসা পেলে আমি কেন পায়েসান্ন খাবো

যা খায় গরিবে, তাই খাবো বহুদিন যত্ন করে'....

তাই তোমার কাছে আসাটা ডাল ভাত কখনোই হবে না আর হলেও সেটাই আমি পরম তৃপ্তিতে খাবো।"

কিন্তু নিজের সিদ্ধান্তে অনড় নয়নিকা। মাঝে মাঝে রাগ হয় আবার ভাবে এই দৃঢ়তাই ওকে অন্যন্য করে তুলেছে।

মোহনা একজন শিক্ষিতা নারী হয়েও কোনো নিজস্বতা নেই। সমস্ত সিদ্ধান্তে ব্রতীনের ওপর নির্ভরশীল। শাড়ি কিনতে গিয়েও ভিডিও কল করে জিজ্ঞেস করে বেগুনি টা নেবো নাকি পেঁয়াজিটা ?

বিয়ের পর পর খুব ভালো লাগতো এগুলো। একটা পুতুলের মতো বউ। সময়ের সাথে সাথে একঘেয়ে লাগতে শুরু করে আর নয়নিকা জীবনে আসার পর দুজনের যত তুলনা করে ততই বিরক্ত লাগে। ওর কলিগদের কারো বউ হাউস ওয়াইফ নয়। একমাত্র মোহনাই ছেলে ,বর, আত্মীয় বন্ধু বিয়ে বাড়ি, সাধ, পিকনিক হৈ হৈ খাওয়া দাওয়া নিয়ে থাকে। বড্ড সুখী ও। ক্লান্ত লাগে ব্রতীনের।

মাসে একদিন স্কুলের বন্ধুদের একটা গেট টুগেদার হয়। পাঁচ বান্ধবী যেন অভিন্ন আত্মা। ঝড় জল যাই আসুক এই নিয়মের নড়চড় হয় না। হৈ চৈ,হাসি, ঠাট্টা, গল্পে দারুণ কাটে একটা দিন । যেন স্কুলের টিফিনবেলা। নিজেদের সুখ দুঃখের ঝাঁপি খুলে বসে ওরা। বাবুইকে স্কুল থেকে নিয়ে মায়ের কাছে রেখে বেরিয়ে পড়ল মোহনা। আজকের দিনটা একটু অন্যরকমদেখা করার যে আনন্দ আজ সেটা নেই। তার জায়গায় আছে উৎকণ্ঠা। বেশ কিছু দিন ধরে পামেলার সাথে ওর বরের একটা গন্ডগোল চলছিল এখন সেটা চরম পর্যায়ে গেছে। ওর বরের কলেজ জীবনের বান্ধবী ফেসবুকের হাত ধরে আবার ফিরে এসেছে। প্রথম প্রথম ব্যাপার টা আমল দেয়নি ও। কিন্তু একদিন বরের মোবাইলে মেয়েটির মেসেজ দেখে সন্দেহ হয়। বুঝতে না দিয়ে কিছুদিন নজরদারি করে হাতেনাতে ধরে ফেলে। তারপর থেকেই শুরু অশান্তি ঝগড়া। এখন তো ডিভোর্স অব্দি গড়িয়েছে ব্যাপারটা। খুব ভেঙে পড়েছে পামেলা। তাই দেখা করাটা খুব জরুরি।

স্কুল পড়াকালীন মাঝে মাঝে টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে ওরা হাজরা মোড়ের এই হোটেলটায় আসতো। এখন সবার জীবনে স্বাচ্ছন্দ। চাইলেই যেকোনো বড় রেস্টুরেন্টে যেতেই পারে কিন্তু এই জায়গাটার সাথে ওদের একটা নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। তাই মাসকাবারী আড্ডাটা এখানেই হয়।  মোহনা ছাড়া বাকি চার জনই চাকরি করে। কিন্তু সবচেয়ে ভালো বিয়ে মোহনার হয়েছে। ব্রতীন খুব উচ্চ শিক্ষিত , চাকরিও করে খুবই উঁচু পজিশনে। কত দেশ যে ওদের ঘোরা তার হিসেব নেই। ব্রতীন মোহনাকে রানীর হালে রাখে। খুব সুখী ওরা। মোহনার আসতে একটু দেরি হয়ে গেল। ওরা নির্দিষ্ট টেবিলে বসে আছে। বেশ থমথমে ভাব। মোহনা ভীষণ হাসিখুশি মেয়ে যেকোনো সিচুয়েশনেই মন ভালো করার ম্যাজিক জানে। মোহনা ধপ করে চেয়ারে বসেই শুরু করলো

"এতো ভাবলে কি চলে রে। চল সবাই মিলে গিয়ে ওই পেত্নীটাকে পেটাই। তারপর জিজুকেও আচ্ছা করে বকা লাগবো। দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।" .. বলেই হাসতে থাকে।

"তোর পক্ষে বলাটা খুব সোজা রে। কারণ বড়লোকের অদূরে বউ তুই। কেয়ারিং হাজব্যান্ড,টাকা, স্ট্যাটাস সব কিছু তোর আছে। আমার মতো যদি হঠাৎ করে পায়ের নীচ থেকে মাটি সরে যেত,  যদি হঠাৎ কোনোদিন বুঝতি যাকে এতদিন ভালোবেসেছিস, ভরসা করেছিস সে আদ্যোপান্ত তোকে ঠকিয়েছে সেদিন বুঝতে পারবি আমার কষ্টটা।"

পামেলার কথা গুলো খুব খারাপ লাগে কিন্তু প্রতিবাদ করে না মোহনা। ওর মনের অবস্থা ভালো নেই এই ভেবে।

সমাধান কিছুই বেরোয় না। আসলে সম্পর্কের ফাটল মেরামত খুব কঠিন। কফি শেষ করে উঠে পড়ে ওরা। মন খারাপ নিয়ে বাড়ি ফিরে যায় সবাই।

"আজ প্রবুদ্ধর বাড়ি পার্টি মনে আছে তো ?" টাই বাঁধতে বাঁধতে বলে ব্রতীন। পামেলার ব্যাপারটা নিয়ে কদিন ধরে আপসেট ছিল মোহনা তাই ব্রতীনের কলিগের বাড়ির পার্টির কথা ভুলেই গেছিল। অপ্রস্তুত মোহনা বলে

"ওহো একদম ভুলে গিয়েছিলাম।"

"অন্য কোনো প্ল্যান আছে কি? যদি না যেতে চাও তো.."

"তুমি কি চাইছো না আমি যাই?"গম্ভীর মুখে বলে মোহনা।

থতমত খেয়ে যায় ব্রতীন। "তা কেন...প্রবুদ্ধ আর ওর বউ তো তোমায় খুব ভালোবাসে।"

হেসে ফেলে মোহনা।

"আরে বাবা মজা করছিলাম। আমি তৈরি থাকব।"

নিশ্চিন্ত হয় ব্রতীন। মোহনা খুবই ফাজিল মেয়ে। যখন তখন ভয় পাইয়ে দেয়। তবে আজকের পার্টিতে নয়নিকাও আসবে তাই পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হতে পারছে না.

পার্টি জমে উঠেছে। প্রবুদ্ধর অনসাইট প্রজেক্টের পার্টি। এবার বড় প্রজেক্টে আমেরিকা যাচ্ছে। বছর তিনেক তো বটেই । তাই যাবার আগে বন্ধুদের আড্ডা। অবশ্যই পরিবার নিয়ে।

মদের ফোয়ারা চলছে। প্লেট প্লেট কাবাব নিমেষে শেষ হয়ে যাচ্ছে। হাসির রোল মহিলা মহলে। ছেলেদের মধ্যে ট্রাম্প নীতি, পদ্মফুল,ঘাস ফুল,সবই আছে । পেটে রঙিন জল পড়লে সবাই রাজা উজীর মারে এখানেও তাই। মেয়ে মহলে মোহনাকে নিয়ে পড়লো সবাই। আজ সত্যিই মোহনাকে ভীষণ সুন্দর দেখাচ্ছে। চন্দন কালারের সিল্ক পরেছে । গায়ের রঙের সাথে যেন মিশে গেছে শাড়িটা। নয়নিকা বাদে সবাই মোহনার গায়ের রং,রূপের তারিফ করছিল। লজ্জা পাচ্ছিল মোহনা। প্রবুদ্ধদার বউ সংগীতা বৌদি খুব ভালো গান করে,প্রসঙ্গ পাল্টাতে ওনাকে গান করার অনুরোধ করলো মোহনা। সবাই সায় দিলো। সবার জোরাজুরিতে গান গাইলেন বৌদি । একে একে অনেকেই গাইলো। এবার এলো ব্রতীনের পালা। ব্রতীন খুব ভালো রবীন্দ্র সংগীত গায়। প্রথমে গাইতে চায়নি কারণ খুব একটা প্রকৃতস্থ নয় ব্রতীন। কিন্তু সবার অনুরোধের গাইলো।

"তা সে যতই কালো হোক দেখেছি তার কালো হরিণ চোখ/ কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি /কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক.."

গাইতে গাইতে টলতে টলতে নয়নিকার কাছে চলে যায় ব্রতীন। হাঁটু মুড়ে পায়ের কাছে বসতে গিয়ে টাল সামলাতে না পেরে পড়ে যায়। বন্ধুরা পরিস্থিতি সামাল দেয়। কিন্তু অনেক কিছু বেআব্রু হয়ে পড়ে। পার্টির মজা নিমেষে মিলিয়ে যায়। কানাঘুষো চলতে থাকে ব্রতীনের আচরণ নিয়ে । মোহনা উঠে পড়ে।

আজ একমাস হলো নয়নিকার ফ্ল্যাটে আছে ব্রতীন। সেই রাতে প্রবুদ্ধর বাড়ি থেকে কিভাবে নিজের বাড়ি ফিরেছিল মনে নেই। পরদিন তুমুল অশান্তি সম্মুখীন হতে হয় ব্রতীনকে। অজস্র প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় যার কোনো উত্তর হয় না। কেন মোহনা থাকতেও নয়নিকা এর কি উত্তর দেবে সে। স্বীকার করে নিয়েছিল নয়নিকাকে ভালোবাসে। মোহনা বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছিল। বাবা বাধা দিলেন, বললেন যে অন্যায় করেছে সে বাড়ি ছাড়বে। যার কাছে নিজের পরিবারের চেয়ে বাইরের লোক বেশি সে বাইরে গিয়েই থাক। অপমানে কান লাল হয়ে গেছিল। বাবা এই কথাটা বলতে পারল? কেরিয়ারের যেখানে এখন ব্রতীন দাঁড়িয়ে আছে সেখানে অর্থ,প্রতিপত্তি,নাম যশ সব আছে। অফিসে ওর চারধারে অগুনতি চাটুকার। মিথ্যে জেনেও এতেই আজ অভ্যস্থ ব্রতীন। বাবার কথা গুলো ভীষণ গায়ে লাগলো। সে না থাকলে যদি বাড়িতে শান্তি থাকে তবে  তাই হোক। ঘন্টা খানেকের মধ্যে কিছু জামাপ্যান্ট, সেভিং কিট ব্যাগে ভরে বাড়ি ছাড়লো ব্রতীন। সেই দিন থেকেই জীবনটা কেমন যেন বদলে গেল। আগে সপ্তাহে একদিন নয়নিকার ফ্ল্যাটে আসার অনুমতি ছিল। সেই একটা দিনের জন্য দুতরফেই প্রবল অপেক্ষা থাকতো। অন্তত ব্রতীনের তো থাকতই। নয়নিকার প্রকাশ কম কিন্তু ব্রতীনের সান্নিধ্য যে ভীষণ রকম উপভোগ করে বোঝাই যেত। কিন্তু বাড়ি ছেড়ে যেদিন এখানে এসে উঠলো নয়নিকার চোখে কোনো খুশি ছিল না। উল্টে কিছুটা হয়তো বিরক্ত। এই একমাসে একবারের  জন্যেও  ওরা কাছে আসে নি। নয়নিকা  হাবে ভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে সে ব্রতীনের বউ নয় যে ওর জন্য ভাত বেড়ে বসে থাকবে বা জামাপ্যান্ট ইস্ত্রি করে দেবে অথবা অফিস টাইমে হাতের কাছে প্রয়োজনীয় জিনিষ গুলো এগিয়ে দেবে। এই বাড়িতে বাসন মাজার লোক রান্নার লোক আছে বাকি সব টাই সেল্ফ সার্ভিসের মতো। নয়নিকা সব কাজে একটা পেশাদারিত্বের ছাপ আছে। অফিসে সেটা প্রশংসনীয় হলেও বাড়িতে কেমন যেন প্রাণহীন লাগে। ওর মি টাইমটাও প্রচুর। অফিস থেকে ফিরে জিম, লাইট মিউজিক, গল্পের বই। ঘুম থেকে উঠেও যোগা,মর্নিং ওয়াক। ওর ফিগারে মুগ্ধ হয়ে যেত ব্রতীন। সৌন্দর্যের রহস্য আজ উন্মোচিত কিন্তু এই একমাসে আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেছে ব্রতীন। কাছ থেকে দেখার পর বড্ড যান্ত্রিক লাগে ওকে। সেই জায়গায় মোহনা ওজনে হয়তো নয়নিকার চেয়ে কুড়ি কেজি বেশি কিন্তু বিন্দাস থাকে। সিঙ্গাড়া থেকে পিৎজা কিছুই বাদ দেয় না। সব সময় হৈ হৈ করে। চোখেমুখে দুষ্টুমি। বয়স যে মধ্য চল্লিশ  সেটা বোঝার উপায় নেই। সবসময় হাসি খুশি প্রাণবন্ত। যেটা একসময় ব্রতীনের মনে হতো বড্ড বেশি লাউড, ডিগনিটি নেই সেটাই আজ বড়ো মিস করে ব্রতীন।  প্রচুর মাইনে, পজিশন সব আছে কিন্তু তার সাথে আছে মানসিক চাপ। সেই জায়গায় মোহনার বোকামি গুলো জীবনে একটা রিফ্রেশমেন্ট ছিল যেটা আজ হারিয়ে গেছে। বড্ড মিক্যানিক্যাল লাইফ। এই কদিনেই প্রাণ হাঁপিয়ে গেছে ব্রতীনের। মন ঠিক করে নিল ব্রতীন। এভাবে আর না।

বেড টি খাওয়ার অভ্যাস বহুদিনের। ঘুম ভেঙে প্রথমেই সাইড টেবিলটার দিকে হাত বাড়ালো ব্রতীন। কাপটা তুলে নিলো। চুমুকেই বিকৃত হয়ে উঠলো মুখ। ঠান্ডা হয়ে জল হয়ে গেছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল এগারোটা। বাড়িটা নিস্তব্ধ। মোহনা মনে হয় বাবুইকে নিয়ে আঁকার স্কুলে গেছে। বাইরের ঘরে এলো। বাবা বসে আছেন রকিং চেয়ারে।

"বাবা , বাবুই কি আঁকার ক্লাসে গেছে ?"

স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষন চেয়ে বাবা বললেন

"তোমার কি লজ্জা সরম সব চলে গেছে? এত কান্ড করার পরে এখন জিজ্ঞেস করছ ওরা কোথায় ? এমন ভাব করছ যেন কিছুই হয়নি?এত অপমানের পরেও কেউ এই বাড়িতে থাকে?আমি চেয়েছিলাম যাই হয়ে যাক না কেন মোহনা আর দাদুভাই এবাড়িতে থাকুক কিন্তু যখন ওর বাবা ওদের নিয়ে যেতে এলো তখন আটকাব কোন অধিকারে...সে মুখ ও তো তুমি রাখোনি। দেখো তুমি যদি বুঝিয়ে ফেরাতে পারো।"... বাবা উঠে গেলেন।

মাথাটা এবার একদম ফাঁকা হয়ে যায় ব্রতীনের। কাল নয়নিকার বাড়ি থেকে বেরিয়ে অফিস,মিটিং শেষ করে বাড়ি আসতে অনেক রাত হয়ে গেছিল। অত রাতে আর কারুকে বিরক্ত না করে নিজের ঘরে এসে শুয়ে পড়েছিল সে। ঘুম ভেঙে এই ধাক্কা। এই বাড়িটা বাবুই মোহনা ছাড়া কেমন হবে ভাবলেই বুকটা খালি লাগে। নাহ এটা হতে দেয়া যায়না। চট করে ওয়ালেটটা পকেটে পুরতে পুরতে  গাড়িতে উঠে ব্রতীন। কসবায় মোহনাদের বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থামল। কলিং বেল দিয়ে অপেক্ষা করছে ব্রতীন। কাজের মেয়ে দরজা খুলতেই ভেতরে ঢুকে পড়ে ডাকতে থাকে

"মোহনা, মোহনা কোথায় তুমি ? "

"এভাবে চেঁচামেচি করছ কেন?" চোখে মুখে বিরক্তি স্পষ্ট।

ব্রতীন এগিয়ে যায় , মোহনার হাতটা ধরে

"প্লিজ মোহনা, ফিরে চলো তোমরা ছাড়া ঐ বাড়িটা ইনকমপ্লিট। মানছি আমি চরম অন্যায় করেছি কিন্তু তুমি তো তেমন মেয়ে নও যে রাগ পুষে রাখবে। একবার ক্ষমা করে দেখো আর কখনো অভিযোগ করার সুযোগ দেব না...প্লিজ মোহনা ফর গড সেক "

হাত ছাড়িয়ে নেয় মোহনা

"দেখো ব্রতীন যখন তুমি দিনের পর দিন ঐ মহিলার সাথে সময় কাটিয়েছ তখন কি ভেবেছিল যে এই ভাবেই প্যারালালি সব কিছু চালাবে? তখন ভাবো নি জানাজানি হলে কি হবে? আমি তো তোমার ওপর অন্ধের মতো ভরসা করতাম। তার এই প্রতিদান? সবটা সামনে আসার পরেও তুমি ওর সাথেই  এই একমাস ছিলে। তখন মনে হয়নি আমার কথা, বাবুই এর কথা ? হঠাৎ আজ মনে হলো বাড়িটা ইনকমপ্লিট লাগছে ?"

"তোমার একটা কথাও ভুল নয় মোহনা, সবটা আমি মেনে নিচ্ছি। যা শাস্তি দেবে আমি মাথা পেতে নেব কিন্তু প্লিজ তুমি ফিরে চলো। অন্তত বাবুই এর মুখ চেয়ে ফিরে চলো। ও তো শিশু...এখন বাবা মা দুজনকেই ওর প্রয়োজন।"

"ভুল বলছো ব্রতীন। আমি বাবুই এর জন্যই আরও ফিরবো না। আজ যদি তোমায় ক্ষমা করে দি তাহলে ও শিখবে চরম অন্যায় করেও পার পাওয়া যায় শুধু মাত্র সম্পর্কের জোরে। ভবিষ্যতে ও হয়তো তোমার মতোই চরিত্রহীন তৈরি হবে।"

"মোহনা !"

"তুমি ফিরে যাও ব্রতীন...আমি আর কোনদিন তোমার কাছে ফিরতে পারবো না। আজ থেকে তুমি ফ্রি , যা মন চায় তাই করো শুধু আমার আর বাবুই এর থেকে দূরে থাকো"

ঘরের ভেতর চলে যায় মোহনা।

বোকার মতো কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে ধীর পায়ে বেরিয়ে আসে ব্রতীন।

মোহনার কথা গুলো মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে...এত কঠিন কথা গুলো মোহনা বললো ! নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না ব্রতীন। মানুষ হয়তো ভুল করে মনের মধ্যে এই বিশ্বাস রেখে যে সে যাই করুক না কেন তার কাছের লোকেরা তাকে ক্ষমা করবেই। এই আত্ম প্রত্যয়ের জায়গা থেকেই হয়তো এত বড় ভুলটা করে ফেলেছিল ব্রতীন। মোহনা ছাড়া, বাবুই ছাড়া জীবনটা কেমন হবে ভাবতে পারছে না ব্রতীন। উদ্দেশ্যহীন ভাবে গাড়ি চলতে থাকে। সম্বিৎ ফেরে ফোনের আওয়াজে। অচেনা নম্বর। প্রবল অনীহা নিয়েও ফোনটা ধরলো ব্রতীন। অপর প্রান্ত থেকে বলে উঠলো

"ব্রতীন, আমি তন্ময় বলছি। সরি ভাই তোকে বারবার ডিস্টার্ব করছি। আমাদের কোম্পানির টেন্ডারের ব্যাপারে। ভাই তোর হাতেই সব। এই টেন্ডারটা না পেলে আমার চাকরিটা থাকবে না। এই বয়সে নতুন চাকরি কোথায় পাবো? বউ বাচ্চা নিয়ে পথে বসতে হবে। তুই একটু দেখ ভাই। ছোটবেলার বন্ধুর এইটুকু উপকার করবিনা ?"

"হম্ম মনে আছে...দেখছি কি করা যায়।"

"বড্ডো উপকার করলি ভাই। আমার তো আর তোর মত লাইফ না রে। ছোট প্রাইভেট ফার্ম এ জব সিকিউরিটি বলে কিচ্ছু নেই জানিসই তো। তোকে দেখে ভাবি ছোটোবেলায় যদি ঠিক করে পড়াশোনাটা করতাম তবে আজ আর এই হাল হতো না। তোর মত বাড়ি, গাড়ি, টাকা, পজিশন, স্টেটাস, সুন্দরী বউ, সুখী জীবন সব থাকতো"

বুকের মধ্যে পিনটা আবার ফুটে উঠছে"সুখী !!"

"ভাই শুনেছিস তো ? হ্যালো হ্যালো"

ফোনটা কেটে দেয় ব্রতীন।

ঘরে দরজা বন্ধ করে অঝোরে কাঁদতে থাকে মোহনা। ব্রতীনকে ছাড়া বাঁচবে কি করে জানে না। কিন্তু এই সিদ্ধান্তটা নিতেই হতো। সব অন্যায়ের একটা শাস্তি হওয়া উচিত। মোহনার বিশ্বাসের খুন করে ব্রতীন যে অপরাধ করেছে সেটার ফল ওকে ভুগতেই হবে। আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায় মোহনা। এই কদিনে চোখের নীচে কালি ছাড়া আর তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি চেহারার। ওর রক্তাক্ত হৃদয় আয়নায় দেখা যাচ্ছে না। সব হারিয়ে ও আজ নিঃস্ব। আত্মীয় বন্ধুদের কথা গুলো মাথার মধ্যে হাতুড়ি পেটাচ্ছে। "মোহনা তোকে দেখলেই বোঝা যায় তুই খুব সুখী "

"সুখী !".... এর চেয়ে বড় বিদ্রুপ আজ আর ওর জীবনে কিছু নেই।

সমাপ্ত

শতরূপা চক্রবর্তী: কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন