আতঙ্কিত স্বপ্ন



গল্প


একটা বিকট সোঁ সোঁ শব্দ, সবাই ছুটছে কেউ ছোট বাচ্চা কোলে নিয়ে, কেউ মায়ের হাত ধরে, যে যেদিকে পারছে ছুটছে। একটা গর্ত -একটা পাঁচিল - কোন বাড়ি বা কোন ভাঙা বাড়ির কোণে একটা নিরাপদ আশ্রয় ... যেখানে শরীরটাকে দুমড়ে মুচড়ে একটু আড়াল করা যায়! শব্দটা আরও বিকট হচ্ছে আরও এগিয়ে আসছে ..আকাশ থেকে ...একটা ভাঙা বাড়ির দুটো আধভাঙা পাঁচিলের মধ্যে নিজেকে কোন রকমে আড়াল করে রেখেছে ছোট্ট মেয়েটা, দূরে আকাশ থেকে বোমার গোলা পড়ছে দেখতে পায় মেয়েটা...একটা গোলা ঠিক ওর দিকে এগিয়ে আসছে..মেয়েটা ছুটছে ...দুহাতে কান বন্ধ করে ছুটছে ....

চোখ খুলল সুফিয়া, সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে ... পাশে রফিকুল ...ওর স্বামী ঘুমোচ্চেন, দু বছরের সন্তান বুকের কাছে মায়ের হাতের উপরই মাথা রেখে ঘুমোচ্ছে। ছেলের মাথায় একবার হাত রেখে দুটো কলেমা পাঠ করে ফুঁ দিলো সুফিয়া। আবার সেই স্বপ্ন ...ছোট বেলা থেকে একই স্বপ্ন বারে বারে কেন আসে বুঝতে পারে না সুফিয়া গতকাল টিভির পর্দায় সন্ত্রাসবাদী হামলায় নিহত সৈনিকদের মৃত্যু মিছিল দেখে কেটেছে। তারই ধারাবাহিকতায় হয়তো এই দুঃস্বপ্ন, উফ! ঢকঢক করে টেবিলে রাখা জলের গ্লাসে চুমুক দিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে আবার ঘুমিয়ে পড়ল সুফিয়া। সুফিয়া সাফরীন কলকাতার মেয়ে, বয়স পঁচিশ ছুঁয়েছে সবেমাত্র। রফিকুল  ইসলাম পেশায়  শিক্ষক।  সুখের সংসার ওদের। ছোট বেলায় চোখ বুজলেই একটা ভয় ওকে তাড়া করে বেড়াত, কোথাও একটা যুদ্ধ হচ্ছে, আকাশ থেকে কিছু ভেঙে পড়ছে ...সবাই ছুটছে ... একটা বাচ্চা মেয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে ... বিকট শব্দ সুফিয়া ছোট বেলায় মাকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞাসা করত আচ্ছা মা, যুদ্ধ কী? মা ছোট্ট মেয়েটির মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বলতেন ... যুদ্ধ মানে ধ্বংস, কিছু মানুষের মৃত্যু ... কতো মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে ...  কতো মানুষ আপন জনকে হারায়, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতেন...যুদ্ধ করে কার কি লাভ হয় জানিনা!

মা তুমি যুদ্ধ দেখেছো?

যুদ্ধ সামনে থেকে দেখিনি ...আমরা যখন ছোট ছিলাম পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের  যুদ্ধ হয়েছিল তখন রাত্রে আলো জ্বালানো বারণ ছিল ব্লাক আউট করা হয়েছিল  ....চাল, ডাল  কিনতে পাওয়া যেত না মানুষের খাওয়ার খুব কষ্ট হয়ে ছিল তখন;তোর দাদুরা শুনেছি সেনা বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন

মা তুমি কখনো আকাশ থেকে প্লেন ভেঙে পড়তে দেখেছো?

উত্তরে মা বলেন ...না!

ছোট্ট সুফিয়া আর কিছু বলত না  ....

আজ  ও বড়ো হয়েছে ... সরাসরি যুদ্ধ  দেখেনি সেও। ওই যুদ্ধের  দুঃস্বপ্ন কারো চোখে আসে না, সুফিয়ার চোখে আসে বারেবারে...কেনো...? কি দেখায় সেই দুঃস্বপ্ন? ভবিষ্যৎ নাকি...ফেলে আসা অতীত! ...কিন্তু কোন অতীত? পঁচিশ  বছর? নাকি তারও পূর্বে  ... আরও পূর্বে  ... কোন দেশ ... কোন যুদ্ধ? .. তবে কি পূর্বজন্ম নাকি তারও পূর্বে ঘটে যাওয়া কোনো যুদ্ধ ..? মৃত্যুর আতঙ্কে, যুদ্ধের আতঙ্কে, আকাশ থেকে নেমে আসা গোলার আতঙ্কে ছুটে চলেছে একটি শিশু জন্ম জন্মান্তর ধরে! চোখ বন্ধ করলেই ভেসে ওঠে সেই দুঃস্বপ্নের প্রতিচ্ছবি।

রফিকের আজ ফিরতে দেরি হবে, স্কুলের কাজে জেলার বাইরে যেতে হবে বলে গেছে চিন্তা হচ্ছে সুফিয়ার ...  চারিধারে যুদ্ধ যুদ্ধ পরিস্থিতি ...খবরের চ্যানেল গুলিতে মৃত্যুর খবর দেখতে দেখতে ভয়ে বুক কেঁপে ওঠে ওর মানুষ মানুষকে  সন্দেহের বসে পিটিয়ে মেরে ফেলে দেয় নিমেষে  এসব চিন্তায়  বুক শুকিয়ে যায় পঁচিশ বছরের গৃহবধূর;রফিক বাড়ির বাইরে গেলেই চিন্তা আরও গভীরতর হয় সন্ধ্যা নামতেই দু বছরের শিশু পুত্রকে বুকে জড়িয়ে  ওর ছোট্ট সুখ নিবাসের বারান্দায় আকুল দৃষ্টিতে পথের দিকে চেয়ে থাকে  রফিকুল ইসলামের ঘরে ফেরার অপেক্ষায়। সন্ধ্যা সাতটা বাজে রফিকের ফোনে বার বার ফোন করছে সুফিয়া, একবার রফিক ফোন তুলেছিল কিন্তু কথা কিছুই বোঝা যায়নি ফোন কেটে যায়, কিছুক্ষণ পর ফোন সুইচ অফ্ আসতে থাকে দুপুর থেকেই আকাশ মেঘলা করে রয়েছে, সন্ধ্যার দিকে হঠাৎ ঝড় বৃষ্টি শুরু হয়েছে, ফেব্রুয়ারী মাসেই কালবৈশাখির আগমন এদিকে ঘড়িতে রাত নটা বাজে রফিক এখনো বাড়ি ফেরেনি কি করবে সুফিয়া ভেবে পায়না রফিকের সহকর্মী অনিরুদ্ধ দাসকে ফোন করে সুফিয়া ...

হ্যালো আমি রফিকুলের স্ত্রী বলছি

হ্যাঁ বৌদি বলুন,  

আচ্ছা আপনি কি বলতে পারবেন ওর ফিরতে
এত দেরি হচ্ছে কেন?

রফিক এখনো ফেরেনি?

না ...

ওকে স্কুলের কাজে বসিরহাটের একটা স্কুলে পাঠানো হয়েছিল কিন্তু সেতো সকাল এগারোটায়, কাজ শেষ করে বিকেলের মধ্যে তো ওর পৌঁছে যাওয়ার কথা ছিল! ঝড় বৃষ্টিতে আঁটকে গেছে বোধহয়,  আপনি চিন্তা করবেন না ও ঠিক ফিরে আসবে

রাত দশটা পেরিয়ে এগারোটা হয়েছে, এত রাত কোনোদিন করে না রফিক ঘড়ির কাঁটা ধীরে ধীরে বারোটার ঘরে পৌঁছিয়ে গেলো সুফিয়া এবার ওর দাদার কাছে ফোন করল,  

এতো রাতে ফোন করেছিস কেনো বোন? সব ঠিক আছে তো?

না দাদা কিচ্ছু ঠিক নেই, রফিক এখনো বাড়ি ফেরেনি ওর ফোনও সুইচ অফ্ কি করব কিচ্ছু ভেবে পারছিনা!

এখনো ফেরেনি, ওর দেশের বাড়ি খোঁজ নিয়ে দেখেছিস?

ও বর্ধমানে যাইনি, বর্ধমান আর কে আছে ওর, মা বাবার মৃত্যুর পর কাকাদের সম্পত্তি নিয়ে বিবাদ ওর মন ভেঙে দেয় ...তাই মেমারি ও যাবে না   ...আর গেলে আমায় বলে যেত, স্কুলের একজন বলেছে ও  বসিরহাট গিয়েছিল,  

আচ্ছা তুই রাখ আমি আসছি

সুফিয়ার দাদা সুফিয়ার বাড়ি এসে সুফিয়াকে বললেন...মেমারি ফোন  করেছিলাম রফিক ওখানে যায়নি। আমার সাথে একবার থানায় চল,
 
থানা?

বসিরহাটে আজ খুব গন্ডগোল হয়েছে দুটো রাজনৈতিক দলের সাথে বোমাবাজিও  হয়েছে

দাদা কি হবে?

কিছু হবেনা বোন মনে সাহস রাখ
সারা রাত সুফিয়া ও তার দাদা থানায় বসে থাকে, কিন্তু রফিকের কোন খোঁজ পায় না

এভাবেই কেটে যায় দুদিন,  থানা থেকে সুফিয়ার কাছে ফোন আসে, ম্যাডাম আপনাদের একবার থানায় আসতে হবে সুফিয়া দাদার সাথে থানায় পৌঁছায়, অফিসারকে জিজ্ঞেস করে ..খোঁজ পেয়েছেন আমার রফিকের? অফিসার কোন উত্তর না দিয়ে একটা ব্যাগ আর কিছু কাগজপত্র বার করে সুফিয়াকে জিজ্ঞেস করেন এই জিনিস গুলি কি রফিকুল ইসলামের? সুফিয়া কাঁদতে কাঁদতে বলে হ্যাঁ এগুলো আমার স্বামীর কিন্তু ও কোথায়..  ও কোথায়? অফিসার বলেন এই ব্যাগটা বসিরহাট স্টেশনের কাছে একটা ঝোপ থেকে পাওয়া গেছে কিন্তু আপনার  স্বামীর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি, আর ওর মোবাইল ফোনটিও পাওয়া যায়নি তদন্ত চলছে কোন খবর পেলে আমরা জানাবো। থানার কাঠের চেয়ারে স্তম্ভিত হয়ে বসে থাকে সুফিয়া ...

দিন চলে যায়- রাত চলে যায় প্রতিদিন একবার করে থানায় আসে সুফিয়া, সন্ধ্যা হলে বারান্দায় তাকিয়ে থাকে রফিকের ফেরার অপেক্ষায়.....বর্ধমান মেমারির ছেলে রফিক, ছোট বেলা থেকেই  মেধাবী ছাত্র বিজ্ঞান বিষয় পড়াশোনা করে কলেজ শিক্ষকের  চাকুরি পায় সুফিয়ার সাথে রফিকের প্রথম আলাপ কলেজস্ট্রিটের এক বইয়ের দোকানে রফিক বই কিনবে বলে দোকানে দাঁড়িয়ে ছিলো, ওকে দোকানদার মনে করে সুফিয়া কেমিস্ট্রির জন্য কোন বইটা ভালো ...এমন হাজার প্রশ্ন করতে থাকে, বিজ্ঞানের ছাত্র হওয়ার দরুণ রফিক সুফিয়ার সব প্রশ্নের গুছিয়ে গুছিয়ে উত্তর দিতে থাকে ..কিন্তু যখন  আসল দোকানদার এসে পড়ে,  দোকানদার মনে করে রফিককে বোকা বোকা প্রশ্ন গুলি করায় .. লজ্জায় পড়ে যায় সুফিয়া..সবশেষে ব্যাপারটা হাসাহাসিতে পরিনত হয় এভাবেই পরিচয় এগিয়ে যায় প্রেম ও শেষ পর্যন্ত বিয়ে সুফিয়া কে রফিক বারে বারে বলার শর্তেও সুফিয়া এম .এস. সি করেনি, পড়াশোনা ছেড়ে সংসারে মন দেয়। রফিক কলকাতায় একটি ছোট্ট ফ্ল্যাট কেনে, সেখানেই থাকত ওঁরা তারপর ওঁদের জীবনে আসে রেহান, ওদের পুত্র সন্তান শান্ত শিষ্ট ছেলে রফিক নম্র ব্যবহারের জন্য সকলের প্রিয় পাত্র শিক্ষা কর্মী হিসেবে  যথেষ্ট সুনাম ছিলো ওর

রফিক নিরুদ্দেশ হয়েছে প্রায় ছয় মাস হয়ে গেছে কয়েকদিন দাদার বাড়িতে থাকার পর, বৌদির অশান্তিতে নিজের বাড়ি ফিরে আসে সুফিয়া। ছোট্ট দু বছরের সন্তানকে নিয়ে কিভাবে চলবে ওর সংসার? জমানো টাকা পয়সা শেষ হয় গেছে, একটা কাজের খুব প্রয়োজন সুফিয়ার কিন্তু কে দেবে কাজ ওকে? সামান্য বি এস সি পাশ করে কোথাও চাকুরি নেই, অনেক স্কুলে আবেদন করেছে কিন্তু বি এড নেই বলে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে ওকে, অনেক চেষ্টা করেও কোন সম্মানীয় কাজ পায় না সুফিয়া ছেলেটার জন্য দুধ টুকু জোগাড় করতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে সুফিয়া পাশের ফ্ল্যাটেই থাকেন সৌমেন দত্ত  ও তাঁর স্ত্রী সুখের দাম্পত্যে সবই আছে নেই শুধু একটি সন্তান। তার উপর দত্ত বাবুর কিডনিতে পাথর জনিত সমস্যার কারণে ওঁরা আর চেষ্টা করেননি। সৌমেন দত্তের অসুস্থতার সময় রফিক সব সময় ওদের পাশে থেকেছে, তাঁকে সুস্থ করে তোলার পেছনে রফিকের অবদান কম নয় আজ সুফিয়ার এই দুর্দিনে দত্ত বাবু ও তাঁর স্ত্রী ব্যতীত আর কেউ পাশে নেই তবুও প্রতিবেশীদের সাহায্যে কতদিন চলবে ওর, কারো কাছে হাত পেতে সংসার চালানো আত্মসম্মানে আঘাত করে সুফিয়ার।

অনেক চেষ্টার পর দত্তবাবুর সুপারিশে একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে তিন হাজার টাকা বেতনের চাকরি জোগাড় হয় সুফিয়ার। বাচ্চাকে দত্ত বাবুর স্ত্রীর কাছে রেখে কাজে যোগ দেয় সে নিঃসন্তান দত্ত গিন্নিও রেহান কে কাছে পেয়ে খুব খুশি, আদর যত্নে রাখেন রেহানকেসুফিয়া লক্ষ্য করে রেহান ও ধীরে ধীরে দত্ত গিন্নির জোড় হয়ে উঠছে তবুও যখনই সুফিয়া স্কুল থেকে বাড়ি ফেরে রেহান ছুটে এসে জিজ্ঞেস করে .....মাম্মাম পাপ্পা কই? তুমি পাপ্পা  আনোনি? ছোট্ট রেহানের প্রশ্নের কোনো উত্তর পায় না সুফিয়া...শুধু বুকের ভিতরটা হু হু করে মুচড়ে ওঠে। রফিক নিঁখোজ হওয়ার পর, বহুবার বসিরহাট গিয়ে রফিকের ছবি দেখিয়ে খোঁজ করেছে সুফিয়া কিন্তু কেউ কোনো খোঁজ দিতে পারেনি

অনির্বাণ রায় নিউরোলজিস্ট, কলকাতার বিখ্যাত ডাক্তার হাসনাবাদের ছেলে কাজের বেশিরভাগ সময়টাই কলকাতায় ব্যায় করেন, তবু মাসে তিনদিন সময় বার করে চলে যান ওঁর গ্রামেসেখানে বিনা পয়সায় গ্রামের মানুষদের চিকিৎসা করেন এলাকায় ওঁ মাথার ডাক্তার হিসেবে খুব পরিচিত, তবে গ্রামের মানুষদের জ্বর জ্বালা এমনকি হাত পা ভেঙে গেলেও লোকে তাঁর কাছে ছুটে আসে

টাকি থেকে এসেছেন এক জেলে, সকাল থেকে তাঁর এক আত্মীয়কে নিয়ে  বসে আছেন, মাথার ডাক্তারকে দেখানোর জন্য দু বার এসে ফিরে গেছেন তাই আজ ভোর বেলাই চলে এসেছেন এদিকে আরও জনা পঞ্চাশ লোক রয়েছেন লাইনে, কে আগে ডাক্তারকে দেখাবেন সেই নিয়ে চলেছে জোড় ঝগড়া, চিৎকার চেঁচামেচি।

ছেলের দুধ শেষ হয়ে গেছে তার উপর দুদিন ধরে জ্বর, ডাক্তার দেখাতে গিয়ে পাঁচশো টাকা শেষ হয়ে গেছে, মাসের শেষ সপ্তাহ সুফিয়ার কাছে আর মাত্র পাঁচশ টাকা অবশিষ্ট আছে, ওষুধ কিনবে না ছেলের খাবার? শেষ পর্যন্ত ওষুধ কিনে আর কুড়ি টাকার এক প্যাকেট দুধ কিনে বাড়ি ফিরল সুফিয়া সন্ধ্যা নামতেই প্রতিদিনের মতো বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে রফিকের পথ চেয়ে যদি একবার ফিরে আসে রফিক! ঘরে একমুঠো চাল ছাড়া আর কিছুই নেই, ছেলেটার জন্য একটু ভাত রেঁধে দুধ দিয়ে খাইয়ে দেয় আর নিজে জল খেয়ে শুয়ে পড়ে রাতে ঘুম আসে না .... রফিকের কথা মনে পড়লে শুধু কান্না পায়, কেনো রফিক ওদের ফেলে রেখে লুকিয়ে গেলো? কোনো উত্তর পায়না সুফিয়া...নিজের মনে নানা রকম প্রশ্ন আসে...এই ভাবে কি ছেলেটাকে মানুষ করতে পারবে সুফিয়া? ছোট্ট রেহানকে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখেছিল ওরা দুজনে সুফিয়ার মাঝে মাঝে মনে হয় রেহান কে দত্তবাবুদের দিয়ে রফিকের মতো হারিয়ে যাবে, কী হবে বেঁচে থেকে! কিন্তু যখনই মনে হয় ছোট্ট রেহান অনাথ হয়ে যাবে আর রফিক যদি কখনও ফিরে আসে, তখন কি উত্তর দেবে রফিকের কাছে? ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে  আবার জীবন যুদ্ধে লড়াই করার শক্তি ফিরে আসে। ভোরের দিকে দুটি চোখের পাতা এক হতেই সুফিয়া দেখতে পায় .....

সবাই ছুটছে সাথে সুফিয়া ছুটছে ছেলের হাত ধরে, দুম দুম বোমার শব্দ, আকাশ থেকে নেমে আসছে আগুনের গোলা, একটা গোলা যেন উঁড়ে এসে পড়েছে ঠিক সুফিয়ার ফ্ল্যাটের দরজার সামনে, কে যেন দুম দুম করে দরজা ঠুঁকছে। অনেকক্ষণ ধরে, হৈ চৈ হচ্ছে দরজার ওপার থেকে সাথে খুব জোরে দত্তদার কন্ঠস্বর, সুফিয়া ভাবী দরজাটা খুলুন ...ঘুমের ঘোরে দরজা খুলে সুফিয়া দেখে রফিক দাঁড়িয়ে আছে, সুফিয়া বুঝতে পারে না স্বপ্ন দেখছে... না সত্যি ঘটছে রফিক সুফিয়াকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে এবার সুফিয়া বুঝতে পারে স্বপ্ন নয় রফিক ফিরে এসেছে রাগে- অভিমানে -অনুরাগে ফেটে পড়ে সুফিয়া, চিৎকার করে রফিককে জিজ্ঞেস করে ..এতোদিন কোথায় ছিলে তুমি?একবারও আমাদের কথা মনে পড়েনি? চুপ করে কেন? উত্তর দাও .....

পাশ থেকে অনির্বাণ বলে ওঠে বউদি প্লিজ ওকে কোনো দোষ দেবেন না, আমি সবটা বলছি ...আমি ডাক্তার অনির্বাণ রায়, রফিক আমার কলেজের বন্ধু আমি মেডিকেলে চান্স পেয়ে চলে যাই হাসনাবাদে একদিন এক জেলে ওকে আমার কাছে নিয়ে আসে, মাস ছয়েক আগে ইছামতীর পাড় থেকে ওকে পেয়েছিল মাথায় চোট অবস্থায় গ্রামীন চিকিৎসায় ওর জ্ঞান ফিরলেও নিজের পরিচয় ঠিক মতো বলতে পারে না, আমি ওকে দেখে চিনতে পারি ...কিন্তু সম্পূর্ণ শিয়র ছিলাম না ও আমার কলেজের রফিকুল ইসলাম কিনা;আমি ওর  চিকিৎসা করি গতকাল ও স্মৃতি ফিরে পায়ওর থেকে জানতে পারি বসিরহাটের দাঙ্গার মাঝে ও পড়ে যায় প্রাণপণে স্টেশনের দিকে ছুটতে থাকে তারপর আর কিছু মনে ছিলো না ওর

সুফিয়া আর কিছু বলে না, প্রতি মূহুর্তে যে আতঙ্কের কালো মেঘ ওর শয়নে স্বপনে তাড়া করে বেড়াত আজ তা বাঁধ ভেঙে সুফিয়ার দুচোখ বেয়ে বয়ে আসতে থাকে

রেশমা লস্করকপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন