সম্পাদকীয়





ষড়ঋতুর বাংলায় শরৎ মানেই উৎসব। আকাশে বাতাসে সবুজে সবুজে সেই উৎসবের কানাকানি ও পদধ্বনি। কাশে কাশে উৎসবের আগমনী। সেই উৎসবের আলাদা কোন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম নাই। সেই উৎসব বাঙালির হৃদয়ে হৃদয়ে মিলনের আর্তিতে সত্য হয়ে আত্মপ্রকাশ করে। কারণ মিলন ছাড়া উৎসব সম্ভব নয়। আর মিলনের ভিতর দিয়েই আমরা আমাদের সমস্ত ক্ষুদ্রতা, সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে এই জগৎ ও চরাচরের সাথে আত্মমগ্ন হয়ে উঠতে পারি। উৎসব সেই মিলনের সম্ভাবনাকেই সত্য করে তোলে। উৎসব সেই মিলনের আর্তিকেই বাঙময় করে তোলে। উৎসব সেই মিলনের অভিমুখেই আমাদের হৃদয়কে পূর্ণ করে তোলে। উৎসবের মানুষ তাই আর একা থাকতে পারে না। উৎসবের মানুষ তাই তার প্রতিদিনের প্রয়োজনের ভিতর আটকা থাকতে পারে না। উৎসবের মানুষ তাই দৈনন্দিন আত্মসুখের ঘেরাটোপ ছেড়ে মুক্ত হতে চায়। সেই মুক্তির লক্ষ্যেই উৎসবের মানুষ তাই তার যাবতীয় ঐশ্বর্য্য নিয়ে সকলকে আহ্বান করে মিলনের আনন্দে উদ্বোধিত হওয়ার ব্যাকুলতায়। এই যে ব্যাকুলতা, সেই ব্যকুলতাই মনুষত্ব। সেই ব্যকুলতাই এই জগৎ চরাচরের সাথে আমাদের সম্পর্কের অমোঘ সূত্র। সেই ব্যকুলতার দিগন্তেই আমাদের উৎসবের আত্মপ্রকাশ। তাই উৎসবেরও কোন সাম্প্রদায়িক ধর্ম বা রঙ হয় না। উৎসব কোন একটি নির্দিষ্ট আচার বিচারকে উপলক্ষ্য করে অঙ্কুরিত হলেও, তার প্রাণভোমরা কোন সুনির্দিষ্ট আচার বিচারের ঘেরাটোপে আবদ্ধ থাকে না। উৎসবের প্রাণভমরা কেবল সীমাকে অতিক্রমের ভিতর দিয়ে সজীব থাকে। আর সেই সীমাকে ডিঙিয়ে যাওয়ার একটিই মাত্র পথ। সে পথ মিলনের। সে পথ ভালোবাসার। সে পথ অপরকে আপন করে নেওয়ার। আর তখনই গোষ্ঠীবদ্ধ চেতনার বাইরে মুক্তি পায় মানুষের মন মনন ও মানসিকতা। উৎসব সেই আমোঘ সত্যকেই সার্থক করে তোলে। উৎসব তাই মানুষকে পরিপূর্ণতা দেয়। উৎসব আমাদেরকে প্রকৃত সুন্দর করে দিয়ে যায়। উৎসব তাই সৌন্দর্য্যের প্রকাশও বটে। যে সৌন্দর্য্য ছড়িয়ে থাকে আমাদের আনন্দের নানান অভিব্যক্তির পরতে পরতে। উৎসবের আয়োজনে আমরা আমাদের অন্তর সৌন্দর্য্যের আত্মপ্রকাশ ঘটাই আমাদের আনন্দের দিগন্তে। যে দিগন্তের উদ্বোধন হয় সেই মিলনের অভিসারেই। তাই উৎসবের ভিতর দিয়েই মনুষত্বের সর্বৎকৃষ্ট প্রকাশ। উৎসবের দিগন্তেই মানুষের মুক্তি। উৎসবের অভিসারেই প্রকৃত মিলন।

বাংলার আকাশে বাতাসে শরৎ যেন সেই উৎসবের দূত হয়ে এসে পৌঁছায় আমাদের কাছে। আমরা বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাসে সেই উৎসবকে বরণ করে আমাদের ভিতর দিয়েই সার্থক করে তোলার জন্য অপেক্ষা করে থাকি সারা বছর। শরতের আগমনে আমাদের সেই অপেক্ষার সার্থকতা। তাই আমাদের অন্তরের সমস্ত ভালোবাসা সৌন্দর্য্য ও শ্রেষ্ঠত্ব দিয়ে এই শরতের অভ্যর্থনার আয়োজন। জগতের আনন্দযজ্ঞে আমাদের শারদীয়া অঞ্জলি।

মাসিক কবিতাউৎসবের আয়োজনে শারদীয়া কবিতাউৎসবের প্রকাশও সেই শারদ অঞ্জলি। উৎসবের ধর্মই হলো আতিশয্য। উৎসবের ধর্মই হলো প্রাচুর্য্য। উৎসবের ধর্মই হলো মিলনের অভিসারে আনন্দের উদ্বোধন। শারদীয়া কবিতাউৎসবে আমরা উৎসবের এই ধর্মকেই ধারণ করার প্রয়াসী হয়েছি। দুই বাংলার একশ আটত্রিশ জন লেখক শিল্পীর সমাবেশে দেড়শতাধিক লেখায় ও চিত্রে সেজে উঠেছে শারদীয়া কবিতাউৎসব ১৪২৬ এর সম্ভার। আমাদের জানা নাই, ওয়েব ম্যাগাজিনের দুনিয়ায় এমন বিপুল কলেবরে শাদর সম্ভারের প্রকাশ এই প্রথম কিনা। কিন্তু আমরা জানি, উৎসবের ধর্মকে ধারণ করেই শারদীয়া কবিতাউৎসব ১৪২৬ এর আত্মপ্রকাশ। কি আছে সেই সম্ভারে। একবার বরং দেখে নেওয়া যাক। নানা স্বাদের ৩০টি গল্প। লিখে পাঠিয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। একটি সংখ্যায় এতগুলি গল্প সম্ভবত এই প্রথম। আমাদের আশা গল্পগুলি পাঠকদের পাঠতৃষ্ণা পরিতৃপ্তিতে সমর্থ হবে। না শুধু গল্পই নয়। বিভিন্ন স্বাদের এগারোটি রম্যরচনায় সাজানো হয়েছে শারদসম্ভার। বাঙালির গল্প পাঠের সাথেই ভ্রমণকাহিনী পাঠের আগ্রহের কথা মাথায় রেখেই পনেরোটি ভ্রমণকাহিনী সন্নিবেশ করা হয়েছে এই সংকলনে। যাঁরা বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য সমৃদ্ধ সত্যনিষ্ঠ প্রবন্ধপাঠে আগ্রহী, তাঁদের জন্য রয়েছে নানাবিধ বিষয়ের উপর অত্যন্ত সমৃদ্ধ সতেরোটি প্রবন্ধ। সাথে একডজন প্রতিবেদন মূলক নিবন্ধও শারদসম্ভারকে সমৃদ্ধ করেছে। এছাড়াও পাঠকের জন্য রয়েছে বিবিধ বিষয়ে আরও দশটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের বিশেষ রচনা। অভিনয়যোগ্য দুটি চমৎকার নাটক শারদ সংখ্যার বিশেষ সংযোজন। এবং কবিতাউৎসবের একান্ত নিজস্ব ভুবনের কাব্যসম্ভারের দিগন্তে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে অংশগ্রহণ করেছে, পঞ্চান্ন জন কবি। না এখনেই শেষ নয়। ডিজিটাল চিত্রাঙ্কন ও ফটোগ্রাফিতেও সাজানো হয়েছে আমাদের এই শারদ অর্ঘ্য। হ্যাঁ শারদীয়া কবিতাউৎসবে প্রচলিত শারদ সংকলনগুলির মতো কোন উপন্যাস রাখতে পারি নি আমরা। সে দায় আমাদের। কিন্তু এটিও সত্য, ছাপা পত্রিকার পাতা উল্টিয়ে উপন্যাস পড়ার আনন্দ ওয়েবপত্র স্ক্রল করতে করতে পাঠকের পক্ষে পাওয়া সম্ভব কিনা আদৌ, সে বিষয়ে আমরাও নিঃসন্দেহ নই। পরবর্তীতে পাঠকের আগ্রহের ভিত্তিতে সেই বিষয়েও ভাবনা চিন্তা করার সম্ভাবনা রইল।

আমাদের অভ্যস্ত পরিসরে ছাপা পত্রিকার পাশাপাশি ওয়েবপত্রিকার প্রচলন অত্যন্ত সাম্প্রতিক একটি ঘটনা। অনেকেই এর সাথে অভ্যস্থ নন এখনো। শারদীয়া পত্রিকা মানেই দ্বিপ্রাহরিক অবসরে স্বহস্তে পৃষ্ঠা উল্টিয়ে মনের মতো লেখা খুঁজে নেওয়ার আনন্দ। এটাই আমাদের অভ্যাস। এই নিয়ে কোন দ্বিমত নাই। কিন্তু নেট জগতের আবির্ভাবে যে নতুন বিপুল একটি সম্ভাবনার দরজা খুলে গিয়েছে, সেকথাও অনস্বীকার্য্য। প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও তার প্রয়োগের সাথে সাথেই সভ্যতার এগিয়ে চলা। কেউই আমরা এর বিপরীতে এগোতে পারি না। তাই সময় এসেছে আমাদের অভ্যাসের পরিসরটিকে আরও একটু প্রশস্ত করে নেওয়ার। হ্যাঁ ছাপা পত্রিকার পাশাপাশি ওয়েব পত্রিকাতেও অনেক ভালো ভালো কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। প্রকাশিত হচ্ছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ লেখা। সৃষ্টির নতুন নতুন মাধ্যমের সংযোজনের সাথেই পা ফেলে এগিয়ে চলতে হবে আমাদের। মাসিক কবিতাউৎসবের আত্মপ্রকাশও হয়েছিল এই কথাই মাথায় রেখে। লক্ষাধিক পাঠকের সমাবেশে মাসিক কবিতাউৎসব এখন অনেকের কাছেই একটি পরিচিত নাম। তাই তাদের উৎসাহ ও উদ্দীপনাকে সম্মান জানাতেই আমাদের এই প্রথম শারদ অর্ঘ্য।

আমরা চেষ্টা করেছি, ছাপা পত্রিকার মত সূচিপত্র দেখে মনের মতো বিষয়ের লেখা খুঁজে নেওয়ার আনন্দটুকু পাঠকের কাছে পৌঁছিয়ে দিতে। তাই অন্যান্য ওয়েবপত্রিকার থেকে একটু অন্যরকম করে বিন্যস্ত করা হয়েছে শারদীয়া কবিতাউৎসব। পাঠক শারদীয়া কবিতাউৎসবের লিংকে মাউস ক্লিক করে প্রথম পাতায় উপস্থিত হয়ে সামান্য স্ক্রল করে একটু তলার দিকেই সূচীপত্রের লিংক দেখতে পাবেন। সেই লিংকে মাউস ক্লিক করে পৌঁছিয়ে যাবেন বিষয়ভিত্তিক সূচীপত্রে। মনোমতো বিষয়ের লিংকে মাউস ক্লিক করে খুঁজে নিতে পারবেন সেই বিষয়ে প্রকাশিত সকল লেখকের সচিত্র নাম ও লেখার শিরোনাম। পছন্দের শিরোনামে মাউস ক্লিক করলেই খুলে যাবে মূল লেখার পাতা। মনে রাখবেন, মাউস ক্লিক করতে হবে লেখার শিরোনামে। লেখকের নামে নয়। এছাড়াও ওয়েবপত্রের উপরেরদিকে প্রতিটি বিষয়ের নির্দিষ্ট ট্যাবে মাউস ক্লিক করে পৌঁছিয়ে যাওয়া যাবে নির্দিষ্ট বিভাগের সূচীপত্রে। এবং ওয়েবপেজের একেবারে তলায় প্রত্যেক লেখকের নামের লিংকে মাউস ক্লিক করলে সরাসরি সেই লেখকের লেখার শিরোনাম খুঁজে পাওয়ারও সুবন্দোবস্ত রয়েছে শারদীয়া কবিতাউৎসবে।

সকলের শেষে এই সংকলনে অংশগ্রহণকারী সকল লেখক লেখিকাকে আমাদের আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। কবিতাউৎসবের পক্ষ থেকে সকল পাঠক ও শুভান্যুধ্যায়ীকেও জানাই শারদ শুভেচ্ছা। সম্পাদকমণ্ডলীর প্রত্যেকের নিরন্তর আন্তরিক প্রয়াসেই সম্ভব হয়েছে এত বড়ো কলেবরে একটি শারদসংখ্যা প্রকাশ। এই প্রসঙ্গে কানাডানিবাসী মৌ মধুবন্তী দক্ষিণভারত নিবাসী কবি রত্নদীপা কলিকাতা নিবাসী কবি শীলা বিশ্বাস ঢাকা নিবাসী কবি ও লেখক হাসিদা মুন পুরুলিয়া নিবাসী বিশিষ্ট সাহিত্যকর্মী ও সুসাহিত্যিক বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়ের নাম উল্লেখযোগ্য। এঁরা সকলেই কবিতাউৎসবের সম্পাদকমণ্ডলীর মাননীয় সদস্য। এছাড়াও এই শারদসংখ্যা যাঁর বিশেষ উদ্যোগ উৎসাহ উদ্দীপনা ও অক্লান্ত প্রয়াস ছাড়া সম্ভবই হতো না, তিনি কলিকাতা নিবাসী কবি কাকলি দাশ ব্যনার্জী। তাঁর ঐকান্তিক উদ্যোগেই এই বিশেষ সংকলনের আত্মপ্রকাশ। অতি সম্প্রতি তিনি  আমাদের সম্পাদকমণ্ডলীতে যোগদান করেছেন। আমাদের আশা তাঁর যোগদান কবিতাউৎসবকে আরও শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ করে তুলবে।

২১শে আশ্বিন ১৪২৬