বিবিধ রচনা
আমাদের
ধারণা আমরা যখন ইংলিশ বুঝতে পারি না,তখন আমরা 'ইয়েস অথবা নো'করে কাটিয়ে দি বা না শোনার ভাণ করি। এই “ইয়েস নো”সব দেশেই সব যায়গায় একই
ভাবে প্রযোজ্য। “ইয়েস
অর নো”নিয়ে আমরা অনেক গালগল্প
বা সিনেমাও দেখেছি। কীসের যে কী অর্থ,কিছুই বোঝা যেত না। অগত্যা 'ইয়েস' -'নো'-ই সবেধন নীলমণি। কিন্তু নিজের অভিজ্ঞতায় একটা সাংঘাতিক অবস্থার
সম্মুখীন হতে হয়েছিল এই আমাকেই। আমি থাকি একেবারে মেক্সিকোর বর্ডার,টেক্সাসে। উপরি পাওনা
হিসেবে,বেশ কিছু মেক্সিকান আর
স্প্যানিশ আমার বান্ধবী হয়ে উঠেছে। আমরা যারা প্রথম দেশ থেকে আসি আমাদেরও খুব
খারাপ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়। কারণ,একে তো আনকোরা নতুন দেশ,আচার ব্যবহার,ভাষা সব নতুন। যেখানে
ইলেকট্রিকের সুইচ পর্যন্ত উলটো দিকে চলে সেখানে তো হবেই। যদিও আমি এই ব্যাপারে
ঠাকুরের অনেক কৃপা পেয়েছি। কারণ আমার নিজের বাড়ির মানুষজন আগেই এখানকার পুরোপুরি
বাসিন্দা। আমি স্প্যানিশ ভাষা বুঝি,তবে গড়গড় করে বলতে গেলেই কুপোকাত । এখানকার কলেজ ছাড়ার
সাথে সাথেই স্প্যানিশ শেখার “ইতি গজ”হয়েছিল যে! ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজ ছাড়া এখানে ডিগ্রী পাওয়া
যায় না। কাজেই এই স্প্যানিশ নিয়েছিলাম মাথায় চট করে ঢুকে যাবে ভেবে। আর নিয়েছিলাম
এই কারণে,এই ভাষার সঙ্গে আমাদের
ভাষার কোথায় যেন একটা বেশ মিলমিশ আছে। কি করব? এত ভাষা তো আর ছোট্ট মাথার
হার্ড ডিস্কে রাখতে পারি না... মেমোরি খুবই কম। এক্কেবারেই উদ্ভট এই আমার আমি। যাক
শুরু করি গল্প এবার।
নভেম্বর-
এর এক সুন্দর গোধূলি বেলায় কলিং বেল শুনে দরজা খুললাম। খুলেই দেখি আমার অফিসের এক
স্প্যানিশ বান্ধবীর সাথে অন্য আর একজন এসেছে। দরজা খোলার সাথে সাথেই “ওলা” বলে দুজনেই গাল-এ গাল রেখে কুশল বিনিময় করলাম। আলাপ
করিয়ে দিল ওর সাথে আসা লুপিতার সাথে। আনকোরা নতুন লুপিতা একটু যেন জড়সড়। নতুন
এসেছে পুয়ের্তো রিকো থেকে। তারপরেই আমার
আর সিয়েরার কথার ফুলঝুরি জ্বলতে শুরু হয়ে গেল অবশ্য-ই ইংলিশ-এ। ওদের নিয়ে আমাদের
বাইরের প্যাটিও-তে গিয়ে বসলাম। দিক ছায়া প্যাটিও-টা সবার খুব পছন্দ। আমার যত সুখ
দুঃখের সাথি এই প্যাটিও। এখানেই বসে হাবজিগাবজি আমার লেখালিখি। তিনজনে বসলাম তিনটে
গার্ডেন চেয়ারে। আমরা যে কি গল্প করছি কিছুই বুঝছে না নতুন দেশ থেকে আসা বেচারি
লুপিতা। আমাদের হাসতে দেখে সে -ও হাসছে । খুব মজা লাগছিল ওকে দেখে। এক মাথা লম্বা
সোজা কালো চুল সমান করে কাটা। ছোটখাটো গোলগাল লুপিতাকে কিন্তু দেখতে খুব মিষ্টি
লাগছিল। গায়ের রং ও বেশ গোলাপি গোলাপি ফর্সা। ইঁদুরের মতন খুদি খুদি সাদা দাঁত। Mexican
বা Spanish দের দেখতে অনেকটা
ভারতীয়দের মত হয়। আমি যে কতবার এই ধন্ধতে পড়েছি তা অগুনতি। দু একটা কথার মুখস্থ
জবাব দেবার শেষে 'ছেড়ে
দে মা কেঁদে বাঁচি-র'মত
বলতে হয়েছে,-আমি কিন্তু পুরোপুরি
ভারতীয়!
আমি
খুব খুউব ভালবাসি নানা দেশের লোকের সাথে মিশতে। দুবার খুব বললাম কেন? মানে আমার মনের কথা
তাই। বই পড়ে বা সিনেমা দেখে সব দেশের মানুষের সম্বন্ধে জানা যায় না বলেই আমার দৃঢ়
বিশ্বাস । ওদের সাথে না মিশলে ওদের ভালভাবে জানা যায় না। মেক্সিকো বা স্পেন থেকে
যারা প্রথম আসে তারা কিন্তু একদম-ই ইংলিশ বলতে বা বুঝতে পারে না। লুপিতাকে দেখে
মনে হল,
ও বোধ হয়
কিছু কিছু বুঝতে পারে। কারণ,আমি আর সিয়েরা যখন কথা বলছিলাম- ও আমাদের সাথে সমান তালে
'Yes/No' করছিল। আর ঠিক ঠিক
যায়গাতেই করছিল কিন্তু। এ নয় যে ইয়েস এর জায়গায় নো বা নো এর যায়গায় ইয়েস করছে। আমি
যেমন প্রথম প্রথম তাই করতাম,তারপর ওদের অবাক চোখে আমাকে দেখতে দেখে বুঝতাম ভুল
জায়গায় 'ইয়েস বা নো “বলে ফেলেছি। হেসে আবার
ম্যানেজ করেছি। লুইজিয়ানার ইংলিশ ভাষা যে খুব অদ্ভুত। বেশ নাকে নাকে কথা বলে ওরা।
এখানকার অন্য স্টেটের মানুষরাই বুঝতে পারে না অনেক সময়। কথা বলতে বলতে ভাবলাম এবার
ওদের কিছু স্ন্যাক্স দেওয়া উচিত। তাই ওদের hot না cold
কফি
খাবে কিনা জিগ্যেস করাতে সিয়েরা বলল, -'cold কফি'খাবে । লুপিতাকে জিগ্যেস করলাম,'Hot
অর Cold'
কফি? লুপিতা হেসে বলে, - “Okkay
!”
আবার
জিগ্যেস করলাম,
আবার ও
ঘাড় নেড়ে বলে,
-“Okkkayy”!
ইতিমধ্যে
সিয়েরা ঠাণ্ডা কফি করতে বলে আমাদের জন্য ফ্রাই চিকেন উইংস আনতে চলে গেছে। কারণ ওরা
না জানিয়ে দুম করে বেড়াতে এসেছিল,তাই আমি যাতে কোন অসুবিধায় না পড়ি। এদিকে আমি পড়লাম মহা ফ্যাসাদে। মন বলল: “মাথা খাটাও হে মাথা।
নেসেসিটি ইস দি মাদার অফ ইনভেনশনস।” মাথা তার কাজ শুরু করল নিমেষেই। শেষে বাড়ির ভেতরে গিয়ে
আইস ট্রে নিয়ে এলাম আর সূর্য্যিমামাকে দেখিয়ে দু পাশের ঘাড়টাকে কানের কাছে কুঞ্চিত
করে বললাম,
-“Umm cold or Ufffs hot” লুপিতা?
সে
আবার হেসে বলে,
-
Okkayyyyyyy
!!!!!
মুখে
বললাম,
'সেভ মি
ঠাকুর। জানি তুমি বলবে,“মন তোর। নিজের মন নিজে সামলাও তোমার মনের আমি কি করব?” বোঝো ঠ্যালা। মনের
নিজের কাজমত শেষে cold কফিই বানালাম আমাদের তিনজনের জন্য । দূরে গলার আওয়াজ
পাওয়া গেল। সিয়েরা খাবার নিয়ে ফিরে এসেছে। ওকে ঘটনাটা বললাম আর বললাম মাথা নিচু
করে,“সত্যি আমি ঠিক বুঝতে
পারি নি। ওকে কিছুতেই বোঝাতে পারছিলাম না।”
"আহা তাতে হয়েছেটা কি?”এদিকে সে তো "আমি
ফ্ল্যাট হয়ে পড়ে যাব”বলে
হেসে গড়াগড়ি দেয় আর কি। এইবার আমিও যোগ দিলাম তাতে। মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে গেল যেন।
সিয়েরার এখানেই জন্ম কাজেই ও দুটো ভাষাতেই সমান পারদর্শী। আমাদের হাসতে দেখে
লুপিতাও হাসছিল,খারাপও লাগছিল ওকে
দেখে। আদৌ লজ্জা পায় নি। মোটেই বিব্রত নয় সে। একে বলে চরিত্র । একেই বলে সংযম। তবে
ও একটু চালাক মনে হল। জানি শিখে যাবে ঠিক একদিন ও । ওকে আমরা 'okayy'করে ডাকতে শুরু করে
দিলাম। কিন্তু আশ্চর্য! লুপিতা নির্বিকার... কোন রাগ নেই । ও ও আমাদের সাথে সমান
তালে হেসে গেল। ওর প্রতি আমার ভালো লাগা ধাপে ধাপে লাফ দিয়ে বেড়ে গেল। আমরা হলে
একেবারে রেগে বাড়ি ই চলে আসতাম। নয়ত,মুখ গম্ভীর করে গম্ভীরানন্দ স্বামীজি-এর মতন হয়ে যেতাম।
হঠাৎ লুপিতা গাইল আমার দিকে তাকিয়ে......
cuando nos con si has
alguin con que recordar.......
ওর
গানের ভাষা আমি এইভাবে বুঝেছি... কি আনন্দ! যখন আমাদের মাঝে আছো সেই তুমিই! আছো তখন সাথে...!! গানের শেষে আমাকে বলল: Simi
que preciosa! সিমি
তুমি সুন্দর,
ভারী
সুন্দর মেয়ে। “que dios te la bendiga siempre” মানে হল, ভগবান তোমায় সবসময়
আশীর্বাদ করুন। গান থেমে গেছে। কি সুন্দর গান গায় এই লুপিতা । চারিদিকে ওর মিষ্টি
গানের সুর ঘুরে ফিরে বেড়াতে লেগেছিল। পারতাম কি ওর মত করে পরিবেশ কে সামাল দিতে? না অদ্ভুত এক আজনবী
মেয়ের সাথে দেখা হল। আর আমার পঞ্চেন্দ্রিয় নৃত্য করতে শুরু করে দিল,তাতা থই থই,তাতা থৈ থৈ। দুষ্টু মন
এবার গেয়ে উঠল...“এক
আজনবী হসিনো সে ইঁয়ু মুলাকাত হো গয়ী।”
-সমাপ্ত-
সীমা ব্যানার্জ্জী-রায় : কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন