বিবিধ
শিশির পতনের শব্দের মতো কোথাও যেন একটা কিছু ভেঙে যাচ্ছে। আমি অনুভব করি। কোথাও কিছু থেমে নেই। সবাই নিজের ছন্দে পথ চলেছে। কারও পরিবর্তনে কারও যেন কিছু যায় আসে না। আমি অনুভব করি আকাশের রঙ আস্তে আস্তে বদলে যাচ্ছে। খুব ধীর গতিতে। আকাশের সঙ্গীতে যারা সাড়া দেয় একমাত্র তারাই এই বদলে যাওয়া রঙ বুকের ক্যানভাসে অনুভব করে। শিল্পী সকালের আলোর ওপর হালকা হলুদ একপ্রস্থ চাপিয়ে দেন। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আলোর উদ্ভাস দেখতে দেখতে শিল্পী আরও এক প্রস্থ হালকা হলুদের সংস্পর্শে আসেন।
মনের সদর দরজায় কার যেন ছায়া পড়ে। আমার সমগ্র অস্তিত্ব জুড়ে
যেন কার দাপাদাপি। বুঝতে পারি সে আসছে। শীতের দুপুর। খুব সামান্য সময়ের জন্য তার আসা।
"প্রেম এসেছিল নিঃশব্দ চরণে"-র মতোই তার আসা। খুবই অল্প সময়ের জন্য। কেউ
ফিরেও তাকায় না। কারও মনে সামান্যতম দাগও কাটতে পারে না সে। শুধু কবি দেখে তার আসা
যাওয়া -------
বাতাস
কাঁপছে
দুপুরের হৃদয়ে ।
দুপুর নিশ্চল ।
দুপুর একাকী ।
বাতাস
কাঁপছে
দুপুরের হৃদয়ে ।
------ সনৎ দে
আমি দেখতে পাই, বাতাসে অল্প অল্প দুলছে দুপুর। শীতের বাতাস।
মৃদুমন্দ নেই। একছন্দে বয়ে চলে। বড় বৈচিত্র্যহীন তার পথ চলা। একাকী দুপুর নিশ্চল।
শীতের বাতাসে সে কথা বলবে কেন? একে একে সবাই পেরিয়ে যায়। শীতের দুপুর কারও বুকে ছায়া
ফেলে না। অথচ কথা তো কম নেই। কিন্তু কোথায় হবে তার প্রকাশ? কে নেবে দুপুরের সুখ-দুঃখের
ভাগ? ঠিক এইসময়েই যেন মনে হল, বাতাস দুপুরকে ছুঁয়ে গেল। আমি দুপুরকে দুলে উঠতে দেখলাম।
গতির সঙ্গে মেলে না। তবুও দুপুর বাতাসকে ধরে। দুঃখের মহাভারে
দুপুর নিশ্চল। আস্তে আস্তে দুপুর যেন প্রাণ ফিরে পায় বাতাসের সংস্পর্শে। দুপুরের গায়ে
কান পাতলেও বাতাসের চোখ বড় অস্থির। তবুও কথা চলে। আমি অনুভব করি, দুপুরের হৃদয়ে বাতাস
কাঁপছে।
( দুই )
মনখারাপ করা বিকেলগুলোতে সমস্ত প্রিয় মুখ পার হয়ে এসে দাঁড়াতাম
স্কুলের মাঠে। আমার একমাত্র দাঁড়াবার জায়গা। তখন সমগ্র চরাচর জুড়ে সন্ধ্যা নামছে।
সব কোলাহল ছাড়িয়ে খোলা আকাশের নিচে আমি আর আমার সমগ্র শরীর জুড়ে মিশে থাকা সন্ধ্যা।
আকাশের চোখে চোখ রেখে কত কত কষ্ট কথা অন্ধকারকে বলেছি। যত সময় গেছে অন্ধকার যেন আরও
নিবিড় হয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরেছে। একে একে তার হাতে ধরিয়ে দিয়েছি আমার যাবতীয় দুঃখ-কথা।
কোনোদিনও সে আমার দিক থেকে মুখ ফেরায়নি। বন্ধুতা কখন যেন হৃদয় ছুঁয়েছে। লক্ষ্য করেছি
অন্ধকারেরও একটা নিজস্ব আলো আছে। সেই আলোর বর্ণপরিচয় আমার চিরকালের অবলম্বন। আমার
একমাত্র প্রাণের দোসর।
( তিন )
অন্ধকারের কত যে রূপ ! চারদেয়ালের মধ্যে জানলা দিয়ে বাইরের
যে অন্ধকারকে দেখতাম তাও তো আমাকে সবসময় কাছে টানত। রবীন্দ্রনাথের কাছেও এক অন্ধকারের
সন্ধান পেয়েছিলাম ----- " পুষ্করিণী নির্জন হইয়া গেলে বটগাছের তলাটা আমার সমস্ত
মনকে অধিকার করিয়া লইত। তাহার গুঁড়ির চারিধারে অনেকগুলি ঝুরি নামিয়া একটা অন্ধকারময়
জটিলতার সৃষ্টি করিয়াছিল। " আর পাতার নিচে অন্ধকারকে দেখছেন কবি সনৎ দে
------
" পাতর
নিচে
বাতাস আর
অন্ধকার
প্রফুল্ল ।
"
এ তো আর এক অন্ধকার। পড়ার ঘর থেকে কত কতদিন তাকে দেখেছি।
অনেকদিনের পরিচয়। সমগ্র শরীর দিয়ে সে আমাকে ডাকত। সে তো জানে তার প্রতি আমার দুর্বলতা।
পড়ার একঘেয়েমিতার মাঝে তার ডাক আমাকে আলো এনে দিত। ডাকলেই কি আর আমি যেতে পারতাম।
পড়ার ভারে যখন আমি প্রায় নুব্জ তখন পাতার নিচে তাকে দেখতাম। বাতাসের সাথে অদ্ভুতভাবে
মিলেমিশে আছে। পড়ার মধ্যে কখন যে আবার ডুবে যেতাম নিজেও জানি না। দমকা বাতাসে ঘোর
কাটলে বুঝতাম অন্ধকারের বার্তা। চিনে নিতাম অন্ধকারের দূতকে। এক অদ্ভুত প্রফুল্লতা
তাদের সমগ্র সত্তায় জড়িয়ে আছে। দূরে থাকলেও যা আমাকে প্রতি মুহূর্তে স্পর্শ করে যেত
-------
" পাতার
নিচে
দুপুর
একাকী । "
এক একসময় অন্ধকারকে আমার খুবই উদার বলে মনে হয়। তার মধ্যে
যেন সকল অস্তিত্বকে খুঁজে পাওয়া যায়। আমি দেখতে পাই, পাতার নিচের দুপুরে অন্ধকার।
এই দুপুরকেই তো আমি কতবার অন্ধকারের মধ্যে খুঁজে পেয়েছি। এক ভাবগম্ভীর অবস্থান। এক
দারুণ মগ্নতায়। এই দুপুরকে আমি কিছুতেই চিনতে পারি না। চিরচেনা এক অস্তিত্ব হঠাৎ করে
আমার থেকে কত দূরে।
পাতার নিচে দুপুর তাকিয়ে আছে দিগন্তের দিকে। তার চোখ স্থির।
কোনো এক গভীর ভাবনায় যেন সে ডুবে। তার এই অবস্থান আমাকে প্রতি মুহূর্তে ছুঁয়ে যায়।
কিন্তু আমি এখন তাকে কিছুতেই পড়তে পারি না। তার এই পরিবর্তনের কারণ?
" দুপুরের হৃদয়ে
পাখি পতঙ্গের
গান বাজছে নিরন্তর
। "
দুপুরের বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত। অসাধারণ এক সুরসাগরে সে ডুবে যাচ্ছে।
তাকে খুঁজে আনবে কার সাধ্য। এখন আমি রোদ্দুরের হাত ধরে দুপুরের সদর দরজায়। শুনতে পাই
পাখি পতঙ্গের গান। বুঝতে পারি দুপুরের মগ্নতার হেতু। পাতার নিচে বসে আমিও সেই পাখি
পতঙ্গের গানের মধ্যে ডুবে যাচ্ছি।
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়: কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন