ফিকে রক্তের সম্পর্ক




গল্প


অ্যালার্ম ক্লকটা এখন বিকল। সেই সুমিষ্ট সুরেলা আওয়াজে আর কাউকে ডেকে তোলে না। কোনো তাড়াহুড়ো নেই আর। নেই কোনো উৎকণ্ঠা। অজানা আশঙ্কায় আর মন কেঁপে ওঠে না! দুশ্চিন্তা জাগে না  অফিসে দেরি হওয়ার। আজ প্রয়োজন নেই জানান দেওয়ার ছেলেমেয়েদের স্কুলে পৌঁছানোর। এখন স্থবির ভাবে উদাসী চোখে তাকিয়ে থাকে টেবিলের উপর। সুদীপবাবুর দীর্ঘ কর্মমুখর জীবনে এই অ্যালার্ম ক্লকটির গুরুত্ব অপরিসীম। তাই বিকল যন্ত্রটিকে ফেলতে পারেননি এই বৃদ্ধাবাসের ঘর থেকে আজও। নিঃসঙ্গতাময় জীবনে ঘড়িটি এখনও তাকে ছেড়ে যায়নি।  বিকল হলেও ঘড়িটা আজও  সুদীপবাবুর  কাছে খুবই আপন।

***১***

এখন  বৃদ্ধাবাসে  বড্ড নিঃসঙ্গতার জীবন কাটছে সুদীপবাবুর। বিগত তিন বছর আগে স্ত্রী মনিমা গত হয়েছেন। মনিমার শেষ ইচ্ছাটুকুও রাখতে পারেননি সুদীপবাবু। এই দুঃখ আজও  কুরে কুরে খায় তাকে। একমাত্র ছেলে অনুদীপকে একটিবার দেখতে চেয়েছিল মৃত্যুর আগে। প্রথমে অভিমান করে মায়ের গুরুতর অসুস্থতার খবরটাও একমাত্র ছেলেকে দেননি। শেষকালে অসুস্থ স্ত্রীর কোমল মনের সামনে হার স্বীকার করে ফোন করেছিলেন সুপুত্রকে! বেশ কয়েকবার ফোনটা পর্যন্ত কেটে দিয়েছিল আদরের ছেলে।

-"হ্যালো, বাবান?"
-"হুম, আরে এখন মিটিং চলছে, পরে ফোন করো। কেন বুঝতে পার না যে আমার চাকরি আর কয়েকটা সাধারণ চাকরির মতো না। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির এক্সিকিউটিভ হওয়ার সুবাদে সারাদিন নানান ব্যস্ততায় কাটে। তোমরা যে কবে বুঝবে আমার স্ট্যাটাস। এইরকম কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণ করো কী করে?"

ছেলের অপমানকর কথায় অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন সুদীপবাবু। এদিকে মনিমার শারীরিক অবস্থা আরও খারাপের দিকে। ডাক্তার জবাব দিয়ে দিয়েছেন কিছুদিন আগেই। কেমো নেওয়ার পর শরীরটা আরও ভেঙে গেছে মনিমার। পেটে অসহ্য যন্ত্রণা। এই কষ্ট আর চোখে দেখা যায় না।হসপিটালের ডাক্তারেরা বললেন,"ওনাকে বাড়ি নিয়ে যান,জীবনের শেষ কয়েকটা দিন পরিবারের মধ্যে বাঁচতে দিন। কারণ আমাদের আর কিছুই করার নেই। খুব বেশি ভাবে স্প্রেড করে গেছে কর্কট নামক মারণ রোগটি। কেমো দিয়েও কোনো লাভ হলো না। এই বয়সে আমরা আর নতুন করে কষ্ট বাড়াতে চাই না ওনার। যে কয়েকটা দিন বাঁচেন,পরিজনদের  মধ্যে আনন্দ করেই বাঁচুক।" এই কথা শুনে সুদীপবাবুর দুচোখ বেয়ে নীরবে অশ্রুধারা বেয়ে আসলো। কী করে বলবে! আজ বৃদ্ধাশ্রমের বৃদ্ধ বৃদ্ধারাই তাঁদের  আপনজন। বর্তমানের সহায় সম্বল। বেশ কয়েক বছর এই আশ্রমের ছত্রছায়ায় কেটে গেলো। এখন আর নতুন করে আত্মীয় স্বজনদের সাথে দেখা করার ইচ্ছেটাই চলে গিয়েছে। এই বয়েসে এসে ভয় হয় রক্তের সম্পর্কের মানুষদের আবার দেখতে! চোখের সামনে মনিমার সেই অসহায় মুখটা আজও নাড়া দেয় তাকে। তাই আজ আর হয়তো  নিজের ছেলেকেও ক্ষমা করতে পারবেন না।

***২***

অনেক ধুমধাম করে সুদীপের সাথে এই বোসবাড়িতে বিয়ে হয়ে এসেছিলেন মনিমা। মনিমাকে সুদীপবাবুর বাবা রণদীপ বোস নিজে পছন্দ করে নিয়ে এসেছিলেন। মায়ের হালকা আপত্তি ছিল এই বিয়েতে।কারণ মনিমার স্কুলের মাস্টারি। মায়ের ইচ্ছা ছিল ঘরোয়া সুন্দরী মেয়ে,যে সারাদিন বাড়ির মধ্যেই থাকবে। মায়ের সাথে হাতে হাত দিয়ে টুকিটাকি কাজ করবে। কথা বলবে। মনিমার মধ্যে প্রথম দুটি গুণ থাকলেও সে যে স্কুলের চাকরি করত। বাবার অবশ্য কোনো আপত্তি ছিল না বাড়ির বাইরে কাজের ব্যাপারে। তাই প্রথম দর্শনেই মনিমার বাবা মাকে বিয়ের পাকা কথা দিয়ে এসেছিলেন রণদীপবাবু। একবারও সুদীপের কথা ভাবলেন না পাকা কথা দেওয়ার আগে। বাবার এরকম একটা দুম করে নিয়ে নেওয়া সিদ্ধান্তে  মৃদু আপত্তি ছিল সুদীপের।

কাউকে একদিনও না দেখে কী করে সারাজীবন একসাথে চলার অঙ্গীকার করা যায়! একটা অজানা আশঙ্কায় কয়েকটা দিন কেটেছিল তার। পরে সেইসব ভেবে খুব হাসি পেয়েছিল ওর। চরম উৎকণ্ঠায় কাটিয়েছিল প্রথম দিকের কয়েকটা দিন। কিন্তু তারপর মনিমাকে রবীন্দ্র সদনের সামনে দেখেই সব ভুল কেটে গেল। এই ব্যবস্থাটা মনিমার এক দুঃসম্পর্কের বড়দা করে দিয়েছিল। নাটকের লোক তো,তাই চেয়েছিলেন নাট্যশালার পুণ্যভূমিতে শুরু হোক আগামীতে চলার মেলবন্ধন। সেইদিনই সুদীপ মনে মনে বাবার এই বিশেষ সিদ্ধান্তের উপর খুব খুশি হয়েছিল। মনিমার স্বভাবটাই এরকম, যে দেখবে, প্রথম দর্শনেই সেই তার অনুরক্ত হয়ে পড়বে। আর ডানাকাটা সুন্দরী বলতে যা বোঝায়, মনিমা ঠিক তাই ছিল। তারপর বিয়ের আগেই সিনেমা,নাটক,গঙ্গাবিহার,মারকেটিং সব চুটিয়ে চলেছিল। একবার তো মনিমার বাবার কাছে প্রায় ধরা পড়ে গিয়েছিল আর কী?

ভাগ্যিস দূর থেকে মনি নজর করেছিল।তা না হলে সেদিনই প্রেস্টিজের দফা রফা! বিয়ের আগে সুযোগ পেলেই সুদীপ মনিমার স্কুলের সামনে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করত। কখন মনিমার স্কুল ছুটি হয়? মনিমা বেশ কয়েকবার বারণ করেছিল বিয়ের আগে এই দেখা সাক্ষাৎটা একটু কম করতে। কিন্তু সুদীপ বিশেষ কর্ণপাত করে নি।

***৩***

কয়েকদিনের মধ্যেই মনিমা সবাইকে খুব আপন করে নিল।বিশেষ করে মায়ের কাছে। যার মৃদু আপত্তি ছিল, সেই এখন মনিকে চোখে হারায়। অদ্ভূত দক্ষতার সাথে বাড়ি আর স্কুলে পড়ানোর কাজ সামলাতো মনি।
 
দেখতে দেখতে সে বোসবাড়ির সর্বেসর্বা হয়ে উঠল। কয়েক বছরের মধেই আনন্দ সংবাদ। মনিমার কোল জুড়ে এক ফুটফুটে সন্তানের জন্ম হলো। নাতি হওয়ার পর সেকী আনন্দ সুদীপের বাবা মায়ের! বহুদিন পরে বোসবাড়িতে আবার শিশুর প্রবেশ। ছোটবেলায় ভারী দুষ্টু ছিল অনুদীপ,ওরফে সকলের অতি আদরের বাবান। বাবান নামেই সবাই ডাকত। শুধু ঠাকুমা আদর করে ননী বলে ডাকতেন। কারণ ছোট বেলায় বাবানের চেহারাটা নদের নিমাইএর মতো নাদুস নুদুস ছিল। তাই ননী। বড্ড দুরন্ত ছিল বাবান। আর ঠাকুমা ঠাকুরদার আদরে আরও দুষ্টু হয়ে উঠেছিল। তবে পড়াশোনাতে অসম্ভব ভাল ছিল বাবান। তাই অনেক সময়ে দুরন্তপনা চাপা পড়ে যেত পড়াশোনায় ভাল হওয়ার জন্য। অনুপবাবুও মাঝেমাঝে উষ্মা প্রকাশ করতেন বাবা মায়ের এই নাতির প্রতি অত্যাধিক আদরের জন্য। যখন বাবান মনির পেটে,তখনই একদিন এক অ্যালার্ম দেওয়া টেবিল ঘড়ি কিনে আনলেন সুদীপবাবু।
 
মনিমা বলল,"হঠাৎ অ্যালার্ম ঘড়ি! এটার কী দরকার?"

-"আরে এটারই তো এখন সবচেয়ে দরকার। ডাক্তারবাবু তোমাকে ঘড়ি ধরে ওষুধ খাওয়াতে বলেছেন। এখন তুমি একা নও,আমাদের ভবিষ্যৎ আসছে। তোমার ও বাচ্চার খুব যত্ন নেওয়ার  প্রয়োজন এইসময়। যা যা ওষুধ উনি লিখেছেন,একদম ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে খাবে। কোনো নড়চড় যেন না হয়।",এক নিঃশ্বাসে কথাগুলি বললেন সুদীপবাবু।

"ঠিক আছে, ঠিক আছে।তোমাকে এত ভাবতে হবে না। আমি ও আমাদের সন্তান একদম ঠিক আছি।"
"তাও তুমি আমার এই কথাটি রেখ," সুদীপবাবু কাতরভাবে  বললেন।
 
আগামীতে এই অ্যালার্ম ক্লক যে এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে তা স্বপ্নেও ভাবেননি। বাবানকে ভোরবেলায় দুধ খাওয়ানো থেকে শুরু করে স্কুল কলেজের পাঠ শেষ করা পর্যন্ত সবসময় এই ঘড়িটি অঙ্গাঙ্গীভাব জড়িয়েছিল। কোনোদিন থেমে যায়নি। সবসময় আজ্ঞাবহ দাস। প্রত্যেকটি কাজে আগাম সতর্কতা দিয়ে এসেছে এতদিন। সুদীপবাবুও খুব উপকৃত এই সারাজীবনের সাথীটির কাজে। সবসময়ই তাঁর সাথে, জানান দিয়েছে প্রতিটি মুহূর্ত অতন্দ্র প্রহরী হয়ে।

***৪****

ইতিমধ্যে মনিমা সংসারের জালে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেল।একদিকে নিজের চাকরি,অন্যদিকে ছেলেকে বড় করা,আর সাথে শ্বশুর শাশুড়ির সেবাযত্ন করা। সব দিকে তীক্ষ্ণ নজর মনিমার। সুদীপবাবু বহুবার বলেছে", এবার একটু কম তালে পরিশ্রম কর। তোমারও তো বয়স হচ্ছে। একবার তুমি বিছানায় পড়ে গেলে এই সংসার যে ভেসে যাবে।"

কে কার কথা শোনে। মনিমা আরও বেশি করে সাংসারিক কাজে মনোনিবেশ করল। ইতিমধ্যে বাবান জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষায় খুব ভালো রেজাল্ট করে যাদপপুর ইউনিভার্সিটিতে কম্পিউটার সাইন্স নিয়ে ভর্তি হলো।

যেদিন জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষার রেজাল্ট বের হবে,কী টেনশন বাড়ির সকলের! অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করছিল একবাড়ি লোক। তারপর প্রতীক্ষার অবসান। বাবানের অসম্ভব ভালো রেজাল্টে বাড়ির সবাই খুব খুশি। সেকী আনন্দ! হইহুল্লোড়ে ভেসে গেল সমগ্র বোসবাড়ি। মনিমা আবার ছুটলেন দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়িতে। কারণ ছেলের ভালো জায়গায় সুযোগ পাওয়ার জন্য আগেই মানত করে ছিলেন  কালীবাড়িতে। তাছাড়া আড়িয়াদহে  বাড়ি হওয়ার সুবাদে প্রায়ই চলে আসত মা ভবতারিণীর কাছে। এক অদ্ভূত শান্তি পেত এখানে এসে। সুদীপবাবু বিয়ের আগেও এখানে এসেছে বহুবার। সাথে মনিমাকে নিয়ে। তাই ছেলের সাফল্যে সোজাসুজি এই পবিত্র স্থানে চলে এসেছিল মনিমা। শুধু দুঃখ একটাই, ঠাকুমা দেখে যেতে পারলেন না  তাঁর আদরের  ননীর এই সাফল্য। কারণ কিছুদিন আগেই গত হয়েছেন সুদীপবাবুর মা। মনিমা অনেকবার নিয়ে গিয়েছে ডাক্তারের কাছে শাশুড়িকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাঁচাতে পারেনি অনুপবাবুর মাকে। তার কয়েক বছরের মধ্যেই সুদীপবাবুর বাবাও গত হলেন। কেমন শূন্যতা ছেয়ে গেল বাড়িটিতে। বাবানও খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়ল নিজের উচ্চশিক্ষায়।


***৫****

আজকাল একটু ফাঁকা-ফাঁকা লাগে সুদীপবাবুর। শরীরটাও আর আগের মতো সাথ দিচ্ছে না। অত্যাধুনিক জগতের সাথে  সমান তালে চলতে কেমন বেমানান লাগছে নিজেকে। এই রঙ পালটে যাওয়া জীবনের সাথে মানিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছে তাঁর। ধীরে ধীরে বেশ বুঝতে পারছেন অনেক কিছুই পালটে যাচ্ছে এই নতুন দুনিয়ার।
 
পারিবারিক বন্ধনের রাশও আস্তে আস্তে  আলগা হয়ে আসছে সব পরিবারের মধ্যে। একান্নবর্তী পরিবারের ধারণাটি কেমন ফিকে লাগছে। সবাই কেমন অচেনা জগতের লক্ষ্যে ছুটছে দিকভ্রান্তের মতো। ছোটবেলা থেকেই বাবা মায়েরা সন্তানদের মধ্যে স্বার্থপরতা ঢুকিয়ে দিচ্ছে। মায়া মমতাবোধ কেমন কমে যাচ্ছে আজকালকার ছেলেমেয়েদের মধ্যে। বাবানও এই ধারায় গড়ে উঠেছে। কিন্তু সুদীপবাবু বা মনিমা কোনোদিন এই স্বার্থপরতা শেখাননি নিজের ছেলেকে। সব সময় চাইতেন বাবান যেন সবাইকে নিয়ে চলে। সবাইকে নিয়ে ভাবে। কিন্তু যুগের হাওয়ায় হয়তো বাবানকে ঠিক মতো মানুষ করে উঠতে পারলেন না তাঁরা। এটাই আজকাল খুব কুরে কুরে খায় নিজের মনকে। কেমন আনমনা হয়ে পড়েন অজান্তেই।

***৬***

দেখতে দেখতে অনেকটা বয়স হয়ে গেল সবার। মনিমার শরীরটাও একদম ভালো যাচ্ছে না ইদানীং।মাঝে একটা অপারেশনও করতে হলো। স্ত্রীরোগ সংক্রান্ত। মেজর অপারেশন। ব্লিডিং হচ্ছিল খুব। ডাক্তারের বিধান ইউটেরাস বাদ দিতে হবে।তা না হলে অন্য রোগ ছড়াতে পারে। কয়েকদিন নার্সিংহোম আর বাড়ি এই করতে হয়েছে একা সুদীপবাবুকে। অফিস থেকে তাই লম্বা ছুটি নিয়েছিলেন। মনিমার মৃদু আপত্তি ছিল এই ব্যাপারে।

"কী দরকার শুধু শুধু এত লম্বা ছুটি নেওয়ার?", মনিমা একটু অসন্তুষ্ট হয়ে বললেন সুদীপবাবুকে।
 
কিন্তু তিনি যে অপারগ। কারণ বাবানের সেমিস্টারের পরীক্ষা থাকায় এই রুগী  দেখাশুনার কাজটি তাকে একা হাতেই সামলাতে হয়েছে।তবে সময়করে সবটাই করতে পেরেছেন অ্যালার্ম ঘড়িটার জন্য। সময়ের নির্দেশিকায় এটি খুব পটু। শুনতে হাসি পেলেও এটাই চরম সত্য।

***৭***

বাবান এখন বিদেশে যাচ্ছে এক মস্ত বিদেশী কোম্পানির চাকরি নিয়ে। ক্যাম্পাস থেকেই  মোটা মাইনের চাকরি। আত্মীয় স্বজনেরা খুব খুশি। এই উপলক্ষ্যে কয়েকটা পার্টিও হয়ে গেল বাড়িতে। ছেলের সাফল্যে সুদীপবাবু ও মনিমা খুব গর্বিত। পাড়ার সবাই এর এককথা। হীরের টুকরো ছেলে মশাই আপনাদের। আমাদের এই পাড়ার গর্ব।মনিমার কিন্তু আপত্তি ছিল ছেলের বিদেশ যাওয়ার ব্যাপারে। কী দরকার অতদূরে চাকরি করার। এখানে বুঝি কেউ চাকরি করে না। শেষে বাবানের ঐকান্তিক ইচ্ছার সামনে আর বাধা হয়ে দাঁড়াননি।

"আরে তুমি কাঁদছো কেন? আমি বেশিদিন থাকব না ওদেশে।কয়েক বছরের মধ্যেই ফিরে আসব।", অনুদীপ মায়ের চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলল।

কিন্তু মনিমার কান্না আর থামে না। কী করে বোঝাব তোকে আমার মনের ভিতরটা পুড়ে খাক্ হয়ে যাচ্ছে এই বিদায়বেলায়! মন বলছে এরপর হয়ত শুধু বেড়াতেই বাড়ি আসবি!" তখন কী সুদীপবাবু জানত, বউয়ের কথাই ফলে যাবে ভবিষ্যতে।

***৮****

বাবান আর দেশে ফেরে নি। ইউ এস এ তে পাকাপাকি বসবাস। এখন সে মস্তবড় চাকরি করে এক মাল্টিন্যাশনাল কম্পানিতে। মোটা মাইনের চাকরি।ছেলের এদেশে আর ফেরার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই দেখে সুদীপবাবু অভিমানে আড়িয়াদহের পৈতৃক ভিটেবাড়ি বিক্রি করে দিলেন। মনিমার আপত্তি ছিল। কিন্তু  সুদীপবাবুর এককথা,বাড়ি পাহারা দিয়ে এই বুড়ো বুড়ি কী করব এই বয়েসে? তার চেয়ে ভালো একটা বৃদ্ধাশ্রমে চলো। ওখানে অনেক লোকজন পাওয়া যাবে। আপনজন থেকে পর ভালো। কয়েকদিনের মাথায় গঙ্গার ধারে এক সুসজ্জিত বৃদ্ধাশ্রমে চলে আসলো ওরা দু'জনে। বাবান সব শুনেও একবারও বলল না,’কেন বৃদ্ধাশ্রমে যাচ্ছ?কেনই বা বাড়ি বিক্রি করছ?’

***৯****

প্রথম চার বছর বেশ ভালো মন্দয় কাটছিল সুদীপবাবু ও মনিমার।এখানকার সমসাময়িক বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের পেয়ে ভালোই কাটছিল দিনগুলি। মনিমা মাঝেমধ্যে বাবানের কথা বললেও সুদীপবাবু একবারও ছেলের কথা মুখেও আনেন না। শুধু বউয়ের গুরুতর অসুস্থতার খবর ছেলেকে পৌঁছে দেওয়া ছাড়া। মনিমা চরম অভিমান দুঃখ নিয়ে চলে গেলেন পৃথিবী ছেড়ে। নিজের রক্তের সন্তানের একটিবার সময় হলো না, নিজের মাকে দেখতে আসার।

দুনিয়ার সবাই ছুটছে মান যশ খ্যাতির উদদ্দেশ্যে। প্রেম ভালোবাসা বন্ধন সব ফিকে হয়ে আসছে এই ধরার বুকে। রক্তের সম্পর্কে আর সেই তেজ কোথায়? পারিবারিক বন্ধনের মুক্তি বিভিন্ন নতুন গজিয়ে ওঠা  বৃদ্ধাবাসের ছত্রছায়ায়। সুদীপবাবুর চোখে জলের ধারা বয়ে গেল। আজ আর কেউ অবশিষ্ট নেই তাঁর চোখের জল মুছিয়ে দেওয়ার।

সুব্রত নন্দী : কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত



২টি মন্তব্য:

  1. দুর্দান্ত উপস্থাপনা। আগেও পড়েছিলাম, নিদারুণ বাস্তবের চূড়ান্ত রূপায়ন। এটাই তো বর্তমান আধুনিক জীবনের করুণ পরিণতি। ইঁদুরদৌড়ের অমানবিক রূপটির অনবদ্য প্রকাশ মুগ্ধ করল। লেখনীকে কুর্নিশ... ��������

    উত্তরমুছুন