গল্প
"রঞ্জা!
আলুর দমটা কিন্তু কসা কসাই কোরো! আমি বাসস্ট্যান্ডের কাছ থেকে দরবেশ কিনে নেবো, ওখানে দরবেশ
ঘিয়ে পাক করে। "
"উঃ!
লোকটা সারাজীবন খাই খাই করেই গেল! "
রঞ্জা, রঞ্জাবতী,লুচি আলুর দম টিফিন ক্যারিয়ারে গুছোতে
গুছোতে বিড়বিড় করে। ছেলেটা অনেক দিন থেকেই নাচছে চিড়িয়াখানায় যাবে। সত্যিই তো!
কলকাতার সব বাচ্ছারাই ঘুরে এসেছে চিড়িয়াখানায়, শুধু তার
ছেলেটা বাদে। বাপ পেয়েছে বটে একটা! বৌ ছাড়া কোনোদিনই আর কিছু জানে না। মনে মনে
যদিও সে গর্ব করে এমন বর পেয়ে,এত ভালবাসা তার ভাগ্যে ছিল?
কয়েক বছর আগে সে আশাও করতে পারে নি। যদিও ছেলেকে কিন্তু মোটেও
অবহেলা করে না প্রবাল, বরং প্রচন্ডই ভালবাসে। আর প্রতি রাতেই
রঞ্জা অনুভব করে ওদের বিয়ের দশবছর পরেও আজও প্রবাল প্রথম দিনের মতোই চায়, রঞ্জাও প্রতি রাতেই ভরে ওঠে প্রবালের উষ্ণ আদরে। তার বহুদিনের স্বপ্নের
আদর সে পেয়ে রোজ যেন ভরে ওঠে কানায় কানায়।সব ব্যাপারেই প্রবাল সমান দায়িত্ব-বান।
সবার খাওয়া দাওয়া, সংসারের খুঁটিনাটি, স্ত্রীর
চাহিদা, সন্তানের চাহিদা, সবার শরীর,
সব সব। প্রবালকে ওর দায়িত্ব কর্তব্য নিয়ে কখনোই আঙ্গুল তুলতে হয়নি
রঞ্জাবতীকে।এমনকি অফিস থেকে ফিরে ছেলেকে নিয়ে পড়তে বসায় রোজ প্রবালই ।আবার ছুটির
দিনে ছেলের সঙ্গে ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন তো আছেই। ছেলেটাও
বাবা-অন্ত-প্রাণ।
ছেলের
সঙ্গে সারাক্ষণ চিড়িয়াখানায় নেচে বেড়িয়েছে প্রবাল। গেটের কাছে ট্যাক্সি থেকে নেমেই
শুধু কেমন থতমত খেয়ে গিয়েছিল পুলিস দেখে। আজব লাগে রঞ্জার ওর এই পুলিস-ভীতি। ও
মাঝেমাঝেই ব্যঙ্গ করে প্রবালকে বলে, "তুমি কি চোর না পকেটমার? পুলিস
দেখলেই ওরকম করো কেন? "
প্রবাল
হাসে, বলে, "আমি তো গাঁয়ের ছেলে, আমাদের বাবা-মায়েরা ছোটোবেলায় এমন পুলিসের ভয় দেখাতো, লাল-পাগড়ী পুলিসের, যে এখনো ওটা মনের মধ্যে গেঁথে
আছে। আর বোধহয় এ জন্মে যাবেনা ।"
তারপর
ভেতরে ঢোকার পর থেকেই প্রবাল যেন একটা বাচ্ছা হয়ে গেল। আট বছরের ছেলের সঙ্গে
সারাক্ষণ যেন খেলে বেড়াতে লাগল গোটা চিড়িয়াখানা। রঞ্জা মা হয়ে মাঝে মাঝে যেন
বিরক্ত হয়ে যাচ্ছিল ছেলের প্রশ্নে কিন্তু প্রবালের না বিরক্তি, না ছোটায়
ক্লান্তি। রঞ্জার মনটা খুশীতে, গর্বে ভরে ওঠে।সে মনে মনে
ভাবে, নির্ঘাত কিছু পূণ্য করেছিল পূর্ব জন্মে তাই সে
প্রবালকে পেয়েছে স্বামী হিসেবে। চিড়িয়াখানা থেকে ওরা আসে ভিক্টোরিয়ায়। সবুজ ঘাসের
ওপর শতরঞ্জি পেতে খাবার নিয়ে বসে রঞ্জাবতী। থালায় খাবার সাজায় ওদিকে বাপ ছেলে
ততক্ষনে ফ্লাইং ডিস নিয়ে মত্ত। "লোকটার কি ক্লান্তি লাগেনা? কিগো! খাবে? নাকি নেচেই চলবে? " রঞ্জার চিৎকারে দুজনেই ছুটে আসে
বাধ্য ছেলের মত। হাত ধুয়ে নেয়। রঞ্জা সোপ পেপার, হ্যান্ড
স্যানিটাইজার এনেছে সঙ্গে করে। স্বাস্থের ব্যাপারে ও বড় খুঁতখুঁতে। তবুও ছেলেটা
বড্ড ভোগে। প্রবাল একটুকরো আলু মুখে পোরে, "অপূর্ব,
রঞ্জা! "
রঞ্জা
একটু মুচকি হাসে,
"কি অপূর্ব? "
"দমের
আলু এবং আমার রঞ্জা দুইই! এখন আলু, রাতে রঞ্জা "ইঙ্গিতপূর্ণ হাসে
প্রবাল। রঞ্জা চোখ পাকায় কপট রাগ দেখিয়ে।হো হো করে হেসে ওঠে প্রবাল।তার তিনকুলে কেউ
না থাকার আক্ষেপটা আজকাল আর হয়ই না, এমন বর পেয়ে। সত্যিই যেন
বর, ঈশ্বরের প্রসাদ মনে হয় প্রবালকে।সে সত্যিকারের সুপুরুষ
এবং সুঠাম স্বাস্থ্যের অধিকারী। মোটা মাইনের সরকারী কর্মচারী। পৈতৃক সম্পত্তি
ভালোই, তাও আবার খোদ কোলকাতার বুকে। একছেলে, ফলে সেখানেও ভাগীদার নেই ।প্রবালের বাবাও ভাল চাকরিই করতেন কোলকাতায়।
কাজের জন্যে কোলকাতায় থাকতে হতো বলে গ্রামের সম্পত্তি বেচে পাকাপাকিভাবে চলে আসেন
শহরে। বেশ সস্তায় একটা বাড়িও পেয়ে যান কুদঘাটে।
একটা
অল্পবয়সী যুগল এসে বসেছে ওদের থেকে একটু দুরেই।"আরে !মেয়েটাকে দেখতে একেবারে
শর্মিষ্ঠার মত না?
এক চেহারার গড়ন, এক রকম নাক চোখ, এক হাসি, কথা বলার সময় ঐরকম মাথা নাড়িয়ে কথা বলা,
একভাবে অকারনে চোখ পাকানো,কথা বলার সময় একটু
চোখ উল্টে কথা বলা। সময় পাল্টালেও মানুষ কেমন একই থেকে যায়। প্রায় কুড়িটা বছর
পেরিয়ে গেছে কিন্তু কত মিল দুটো প্রজন্মের মধ্যে " ভাবতে থাকে প্রবাল। ওদের
দেখতে দেখতে আচমকা প্রবাল ফিরে চলল পিছনে, কুড়ি বছর পিছনে
।স্মৃতিরা কোনো আভাস না দিয়েই হঠাৎ আবির্ভূত হয় মনের মধ্যে। 'আর মনের এই আশ্চর্য গতিবিধিই কি টাইম মেশিন কনসেপ্টের জন্মদাতা?' মাথা চুলকাতে চুলকাতে প্রবাল হারিয়ে যায় অতীতের সমুদ্রে ।
ওরা
প্রায়ই আসত ভিক্টোরিয়ায়,
কলেজ কাট দিয়ে। ও আর শর্মিষ্ঠা, শর্মিষ্ঠা ওর
জীবনের প্রথম প্রেম, প্রথম নারী। কলেজেই প্রথম দেখা, প্রেম। প্রেমের চরম পরিনতিও সঠিক ভাবেই ছাদনাতলা পেয়েছিল। প্রবালের জীবনে
এইসময় খুব চটপট কেটে গিয়েছিল কয়েকটা বছর। শর্মিষ্ঠার সঙ্গে দেখা, প্রেম, বিয়ে, হানিমুন, প্রথম সন্তানের বেলায় আচমকা গর্ভপাত। কাটতে চায়নি তার পরের বছরগুলো। ওঃ!
কি ভয়ানক সেই অধ্যায়! আজ আর প্রবাল তা ভাবতেই চায়না। হাসপাতাল থেকে মানসিক ভাবে
সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত শর্মিষ্ঠাকে পরম যত্নে বাড়ি আনে প্রবাল। অনেক ভালবাসা, অনেক সেবা, অনেক আদর দিয়ে দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে
থাকে তার সুস্থতার জন্যে ।কিন্তু প্রথম সন্তানকে হারিয়ে সে হারিয়ে ফেলে অনেক কিছু।
হারিয়ে ফেলে স্বামী-সান্নিধ্যে র উদ্যম। কিছুতেই যেন আর শর্মিষ্ঠা নিজেকে মেলে
ধরতে পারে না প্রবালের কাছে।
অপেক্ষার
প্রথমদিকে আশা ছিল অনেক। মানসিক চিকিৎসকের সব চেষ্টা যখন বিফলে যায়, তখন কি কোথাও
কিছুটা অধৈর্য হয়ে পড়ে প্রবাল? সব ক্ষেত্রেই শর্মিষ্ঠা সুস্থ,
সব কাজই স্বাভাবিক, শুধু রাতে বিছানায় সে যেন
অন্য নারী। প্রবাল তার চেনা উন্মত্তযৌবনা স্ত্রীকে কিছুতেই যেন খুঁজে বার করতে
পারে না এই নারীর মধ্যে। শর্মিষ্ঠাও বোঝে প্রবালের মনের কান্না। একদিন সে বলেই
ফেলে তার স্বামীকে,"দ্যাখো! আমি আমার জীবনের একটা বড়
অনুভূতি হারিয়ে ফেলেছি কিন্তু তুমি এভাবে নিজেকে কষ্ট দিও না। তুমি বিয়ে করো আবার!
"
প্রবালের
বুক থেকে একটা হাহাকার দীর্ঘশ্বাস হয়ে বেরিয়ে আসে। বিমর্ষ ভাবে হেসে বলে, "তা হয়না
শর্মি! তোমাকে কাঁদিয়ে আমি কিছুই চাইনা। আমি তোমাকেই চাই, পাগলের
মত চাই ।আমি জানি একদিন তুমি ঠিক ফিরে আসবে আমার কাছে। "
মাঝেমাঝে
মনের বিরুদ্ধে শর্মিষ্ঠা যে চেষ্টা করেনি তা নয়। কিন্তু ঐ মনহীণ শরীর ঠিক
বাহুবন্দী করতে পারেনা প্রবাল। কেমন একটা বিরক্তি ভাব আসে। সরে
যায়, বলে, "থাক শর্মি! আরো কিছু দিন অপেক্ষা করি
!যদি কোনদিন ঈশ্বর সুদিন দেয় সেদিন না হয় আবার,,,,, " কান্নার ভার বড় কঠিন গলাতেই
আটকে দেয় কথাকে।
একসময়
এতেও অভ্যস্ত হয়ে যায় সে। ঘুমের ওষুধের ভক্ত হয়ে পড়ে। মাঝেমধ্যে মদ্যপানটা
শর্মিষ্ঠা হয়ত ভাবে তার জন্যেই কিন্তু প্রবালের মনে হয় এটা ঠিক নয়, এটা আচমকাই
বন্ধুদের থেকে শেখা। কেন, আগে কি বন্ধু ছিল না? ছিল,
প্রায় না থাকার মত ওটা ইদানীংই বেড়েছে। শর্মিষ্ঠা কিছু বলেনা,
নীরবে চোখের জল ফেলে।
সেদিন
প্রবাল অফিস থেকে বেরিয়ে রোজকার মতো দাঁড়িয়ে আছে ধর্মতলায়, বাসস্টপে। এখান
থেকেই রোজ সে টালিগঞ্জের বাস ধরে। হঠাৎই কানে এলো ওর নাম ধরেই কেউ ডাকছে। ডাকতে
ডাকতে লোকটা সামনে এসে জড়িয়ে ধরলো তাকে। সে চিনতে পারলো, অভিজিৎ
,ওর স্কুলের সহপাঠী। একগাল হেসে অভিজিৎ জিজ্ঞাসা করে,
"কেমন আছিস ভাই? কতদিন পরে দেখা।
বিয়ে থা
করেছিস? "
প্রবাল
সংক্ষেপে বলে,
"হ্যাঁ! "
চল
আজ আমার বাড়ি! "
"আজ
নারে অন্য একদিন !বৌটা চিন্তা করবে, মায়েরও বয়স হয়েছে। "
কিন্তু
অভিজিতের জেদের কাছে হার মানতে হয় প্রবালকে। যেতেই হয় যাদবপুরে অভিজিতের বাড়ি।
অভিজিৎ আলাপ করায় ওর স্ত্রী রঞ্জাবতীর সাথে। প্রবাল দেখে রঞ্জাবতী সুন্দরী কিন্তু
কেমন যেন মনমরা, মেঘে অবগুন্ঠিতা চাঁদের মতই বিষাদের কুয়াশা ঢাকা।কিন্তু প্রবালের মন যেন
বারবার বলে এ চাঁদ মেঘের চিকের আড়ালে আসতে চায় মাখতে চায় পৃথিবীর প্রাণের গোপন
উচ্ছাস সারাগায়ে।যাকগে পরের বৌকে নিয়ে অত ভাবতে চায়না সে। অভিজিতের বাড়ি থেকেই ফোনে শর্মিষ্ঠাকে জানায় তার দেরি
হবে। অভিজিৎ আবার যেচে নেমন্তন্ন নেয় প্রবালের বাড়িতে পরের রবিবার সস্ত্রীক
মধ্যাহ্ন-ভোজনের।
কয়েক
মাসের মধ্যেই প্রবাল ও রঞ্জাবতী মনে মনে অনেকটাই কাছাকাছি চলে আসে। রঞ্জাবতীও তার
যৌবনের সুধারস থেকে বঞ্চিত। অভিজিৎ পুরুষত্বহীণ কিন্তু বাকি সব দিক থেকেই সে ভরিয়ে
রেখেছে রঞ্জাবতীকে। তাই শরীরময় যৌবন কেঁদে বেড়ালেও সে স্বামীর স্বাদ থেকে বঞ্চিতই
।
সে
বছর পুজোর সময় অভিজিতের উৎসাহেই ওরা ওঠে ট্রেনের কামরায়, সিমলার পথে।
রঞ্জা রাতের খাবারটা করেছিল লুচি আর আলুর দম। শর্মিষ্ঠা করেছিল রাঙা-আলুর
পান্তুয়া। ট্রেনে বসা থেকেই হৈ হৈ, আনন্দ, গল্প চলল রাতের খাবারের আগে অবধি।
যাত্রীরা
একে একে আলো নিভিয়ে শুতে শুরু করেছে। অভিজিৎ বলে, "এবার শোয়া যাক! কাল সকাল
থেকে আবার জমিয়ে গল্প হবে, ট্রিপটা কিন্তু জমিয়ে এনজয় করতে
হবে ,মেমোরেবল ট্রিপ হয়ে থাকবে এটা! " সেদিন অলক্ষ্য থেকে বিধাতাও কি হেসেছিলেন এই
কথায়? কি জানি?
ট্রেন
ছুটে চলেছে অন্ধকারের বুক চিরে তার গন্তব্যের দিকে ঝড়ের গতিতে। প্রবাল লোয়ার
বার্থে, চাকার খটাখট শব্দে কেমন একটা নেশা আছে। ওর ওপরেই শর্মিষ্ঠা, মুখোমুখি লোয়ারে রঞ্জা তার ওপরের বার্থে অভিজিৎ ।রঞ্জার নাকি ওপরে শুতে ভয় করে। শর্মিষ্ঠা আর
অভিজিৎ ঘুমের ওষুধের কল্যাণে নিদ্রার জগতে চলে গেছে ।ওষুধ খেয়েও আজ কিছুতেই ঘুম আসছে না প্রবালের
চোখে। শুয়ে শুয়ে ভাবতে থাকে শর্মিষ্ঠা হয়ত সিমলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে আবার নিজেকে
ফিরে পেল। ও কল্পনাতে দ্যাখে তার বাহুপাশে ধরা দিয়ে বুকেতে নিবিড় হচ্ছে তার
স্ত্রী। সদ্য বিয়ের পরের উদ্দামতা নিয়ে ফিরে এসেছে সে তার কাছে। ওঃ! সত্যি সত্যি
যদি এমন হয় তাহলে ওর চেয়ে সুখী আর কে আছে পৃথিবীতে? কিন্তু
একি? ওর কল্পনায় কিভাবে ঢুকে পড়ে রঞ্জাবতী? এ স্বপ্ন ও চায়না! কিন্তু রঞ্জাবতীর সৌন্দর্যে ও মোহিত হয়ে পড়ে। সত্যিই
দেহ বিন্যাসে সে যেন একেবারে খাজুরাহোর মারকণ্যা! প্রবাল দুশ্চরিত্র নয়। রঞ্জাবতীর
দিক থেকে সে অনেক আগেই লাজুক আহ্বান পেয়েছিল কিন্তু পরকীয়ায় সে একেবারেই বিশ্বাসী
নয়। স্বীকৃতিহীণ ভালবাসা তার কাছে নিজেকে ছোট করা, ছোট করা
সঙ্গিনীকে, ছোট করা হয় ভালবাসাকে।সে ভালবেসে শরীর চায়,
ছড়াতে চায় তার প্রেমের উত্তাপ সঙ্গীনির দেহে মনে কিন্তু সমাজ
স্বীকৃত ভালবাসার।যে সম্পর্কের কোনো নাম হয়না তেমন সম্পর্কে সে মোটেই বিশ্বাসী নয়।
তাই সম্পর্কের মাধুর্য না হারিয়েই সে রঞ্জাকে এড়িয়ে গেছে।
"প্রবাল
দা! জেগে আছেন?
"চাকার আওয়াজের আড়ালে মৃদুস্বরে জিজ্ঞাসা করে রঞ্জা। প্রবাল
চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়েছিল। মুখটা বার করে রঞ্জার দিকে ফেরে, "কিছু বলবে? "
"ঘুম
আসছেনা "
"আমারও"
"একটু
হাতটা বাড়াবেন?
"
"কেন? "
"উঠবো!
" প্রবাল হাত বাড়ায়। রঞ্জা হাত ধরে।
প্রবাল রঞ্জার থরথর স্পর্শে একরাশ লুকোনো অনুভূতি উপলব্ধি করে। প্রবালের বেশ লাগে
ঐ স্পর্শ ঐ অন্ধকার কামরায়। রঞ্জা পাশ ফিরে দুহাতে প্রবালের হাতটা ধরে। ঐ মিটমিটে
আলোয় ও পরিস্কার দেখতে পায় রঞ্জার চোখ ভর্তি জল। বুকের ভিতরটা কেমন আনচান করে ওঠে।
কিন্তু নিজেকে বোঝায়,
আপ্রাণ বোঝায়। একটু ধাতস্থ হয়ে গলাটা ঝেড়ে বলে, "ঘুমোতে চেষ্টা করো! "রঞ্জাও গলা ঝেড়ে বলে, "না, একটু বাথরুমে যাবো ।একটু দাঁড়াবেন প্লীজ! ও ওষুধ
খেয়ে ঘুমোচ্ছে, এখন তোলা শক্ত। "
"চলো!"
রঞ্জা
আগে, প্রবাল পিছুপিছু চলে। যাত্রীরা যে যার বার্থে ঘুমোচ্ছেন। ট্রেনের দোলানিতে
রঞ্জা হটাৎ দেহের ভারসাম্য হারিয়ে পিছনের দিকে টলে যায়। প্রবাল ওর পতন আটকাতে
দুহাত বাড়ায়, রঞ্জাবতী ওকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে। ঐ আধো
অন্ধকারে একটা যুবতী দেহের স্পর্শ প্রবালের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা আগুনটাকে মুহুর্তে
উস্কে দেয়। রঞ্জা আরো নিবিড় করে জড়িয়ে ধরে প্রবালকে ।রঞ্জার চুলের থেকে একটা মিষ্টি গন্ধ প্রবালের
নাকে আসে। হাতটাও কি বুলিয়ে ছিল ওর পিঠে, কোমরে? আজ সেকথা ঠিক মনে নেই। প্রবালের বুক থেকে মুখটা তুলে চোখেতে দৃষ্টি ফেলে
রঞ্জা, "ভগবান কেন এত নিষ্ঠুর? কেন
আমাদের প্রথমেই দেখা হলোনা? "
প্রবাল কোনো উত্তর দিতে পারে না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চেয়ে
থাকে রঞ্জার সুন্দর মুখের দিকে।
বাথরুম
থেকে এসে সে চোখ বন্ধ করে একটু আগেই ঘটে যাওয়া ঘটনাটা ভাবতে থাকে। শর্মিষ্ঠা, অভিজিতের নাক
ডাকার আওয়াজ, চাকার আওয়াজ শুনতে শুনতে কখন জানি ঘুমিয়ে পড়ে।
হঠাৎ একটা প্রচন্ড আওয়াজের সাথে সাথে ও ছিটকে পড়ে মেঝেতে। একটা ভারী কিছু ওর মাথায়
পড়ে। সে দুহাতে মাথাটা চেপে ধরে। তারপর সব অন্ধকার।
কিছুক্ষণ
বাদে আবার চোখ খুলে যায় তার। কপালের ওপরটায় খুব যন্ত্রনা হচ্ছে। হাত দিতে হাতটা
রক্তে ভর্তি হয়ে যায়। বুঝতে পারে মাথা ফেটে গেছে। ট্রেনটাও থেমে রয়েছে। তবে কি
তাদের গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করল? বাকিরা কেমন আছে?কষ্ট হচ্ছিল
খুব, তবু সে উঠে দাঁড়ায়। তার ওপরের বার্থে শর্মিষ্ঠা। পা
দুটো কেমন অস্বাভাবিক রকম ঝুলে আছে বাইরের দিকে। প্রবাল দেখে তার পায়ের কাছে অচেতন
হয়ে পড়ে আছে অভিজিৎ, তার পাশে রঞ্জা। শর্মিষ্ঠাকে কোমোরে
মৃদু ধাক্কা দিয়ে ডাকে সে। কোনো সাড়া নেই। ওর মুখের দিকে চোখ পড়তেই মাথাটা ঘুরে
ওঠে প্রবালের। একটা লোহার রড ওর কপাল দিয়ে ঢুকে বেরিয়ে গেছে মাথার পিছন দিয়ে। ওর
চোখ দুটো খোলা, মুখ হাঁ, চাউনি
নিষ্প্রাণ। মাথা ধরে বসে পড়ে নাকি পড়ে যায়, ওর সীটে। চোখ
জড়িয়ে ঘুম আসতে থাকে। একবার সব শক্তি দিয়ে চেয়ে দেখে অভিজিৎ আর রঞ্জার দিকে ।শ্বাস
পড়ছে বলেই মনে হয়। ও ঘুমিয়ে পড়ে।
ওর
চোখে আবারও স্বপ্ন আসে,
স্বপ্নে রঞ্জা আসে। বাথরুমে যাবার আগে রঞ্জার সেই আলিঙ্গন, সেই আর্তি, "কেন আমাদের আগে দেখা হলোনা!
" প্রবাল দেখে সে আর রঞ্জা মেঘের
মধ্যে দাঁড়িয়ে ঝলমলে দিনে। রঞ্জাকে সে গাঢ় চুম্বন করছে।রঞ্জার চোখ থেকে খুশী ঝরে
পড়ছে রোদের মতন।ঈষৎ রোগা অথচ মখমলের মত কোমল দুবাহুতে মালা রচনা করে রঞ্জা তার গলা
জড়িয়ে ধরে তাকে প্রতিচুম্বন করছে। মেঘেরা উৎসাহী বন্ধুর মত উড়ে যাচ্ছে তাদের পাশ
দিয়ে। কেউ বা তাদের স্যাঁতসেঁতে শরীরের একটু ছোঁয়া দিয়ে যাচ্ছে ওদের গায়ে।ও নিবিড়
করে বুকে টানে রঞ্জাবতীকে।
ও
কি! ওটা কে বেরিয়ে এলো তার ভেতর থেকে? এ কোন্ প্রেতাত্মা? কুশ্রী, কুটিল, কালো! লকলকে
জিভ, ভাঁটার মত গনগনে লাল দুচোখে জিঘাংসা চিকচিকিয়ে ওঠে
ছুরির ফলার মত। এ কে ?কোথায় ছিল এতকাল, ছদ্মবেশের আড়ালে। প্রবাল চোখ বোজে, জাগরণের চোখ!সেই
শয়তান প্রেতাত্মার চোখ পড়ে অভিজিতের দিকে। পাশ ফিরে পড়ে আছে সে, অচৈতন্য, কিন্তু শ্বাস পড়ছে।অনুসন্ধানী চোখে
চারিদিকে তাকায় সেই পিশাচ। প্রায় সবাই অচেতন, কেউ কেউ
আর্তনাদ করছে, কারুর মুখে শুধুই গোঙানি ।এবার সেই
রক্ত-লোলুপের অনুসন্ধানী চোখ খূঁজে পায় একটা ভেঙে পড়া ডাণ্ডা গোছের শক্ত কাঠের
টুকরো। পৈশাচিক হাসি খেলে যায় ঐ মুখে। ওটা হাতে তুলে নেয়। তারপর বিপুল শয়তানী
শক্তিতে ওটা দিয়ে সজোরে আঘাত করে অভিজিতের মাথায় ,একবার,
দুইবার, তিনবার ।ঐরকম একটা আঘাতই একটা মানুষের
মৃত্যুর জন্যে যথেষ্ট,তাও যেন রক্তের লালসায় মেতে উঠেছে সে,
বহুযুগের জমানো তৃষ্ণা আজ মিটিয়ে নেবে।প্রথম আঘাতের পর অজ্ঞান
অবস্থাতেই অভিজিতের দেহটা কেঁপে ওঠে, হাত-পা ছটকায়, তারপর স্থির। তারপর আরো দুবার আঘাত। পাশ থেকে এক মুমূর্ষু নারী ঐ দৃশ্য
দেখে ভয়ে চিৎকার করে ওঠেন। শয়তানের ডাণ্ডা তাঁকেও চিরদিনের মত চুপ করিয়ে দেয় ঐ তিন
আঘাতে।
ডাণ্ডা
ফেলে দেয় শয়তান। চোখের জ্বলন্ত ঘোলাটে দৃষ্টি একটু যেন স্বাভাবিক হয়। এবার সে ঢুকে
পড়ে প্রবালের অর্ধ-চেতন ঘুমন্ত শরীরে।ঘুমের মধ্যেই খুব শ্বাসকষ্ট হতে থাকে ওর।
মাথার মধ্যে ভোঁ ভোঁ করতে থাকে। হারিয়ে যেতে থাকে ওর চেতনা।
প্রবালের
জ্ঞান ফেরে হাসপাতালে। মাথায় খুব ব্যথা। কয়েকটা সেলাই পড়েছে। ডাক্তারের কাছে জানতে
পারে রেলের উদ্ধারকারী দল তাকে এখানে এনেছে। কি আশ্চর্য! রঞ্জাবতী দাঁড়িয়ে আছে তার
বেডের পাশে? সেকি এখনো স্বপ্ন দেখছে? নাঃ! রঞ্জার স্পর্শ অনুভব
করছে তার কাঁধে, এ স্পর্শ জাগ্রত অবস্থার স্পর্শ প্রবাল
নিশ্চিত। রঞ্জার দুচোখে জল। "প্রবাল দা! একি হয়ে গেল? "
প্রবাল
জিজ্ঞাসু চোখে তাকায়। রঞ্জা বলে, "ওরা আর নেই! "
"কে
নেই? "
"শর্মিষ্ঠা
আর অভিজিৎ "
প্রবালের
হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়। মাথা ঘুরতে থাকে।
"আমি
এখন কোথায় যাবো তাই ভাবছি?
"রঞ্জার চোখে হতাশা ।প্রবাল আশ্বাসের চোখে তাকায় রঞ্জাবতীর
দিকে।
খুব
ভয় পেয়ে প্রবাল চমকে ওঠে পুলিশকে আসতে দেখে। সেই ওর পুলিশ ভীতি শুরু, হয়তোবা এই ভীতি
ওর বাকি জীবনটা তাড়িয়ে বেড়াবে। যদিও পুলিশ ওকে ভয় দেখায় নি। অফিসার শুধু দায়িত্ব
পালন করেছিল। খাতা দেখে জানিয়ে গিয়েছিল এই দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছে তার স্ত্রী
শর্মিষ্ঠা আর বন্ধু অভিজিৎ। পিশাচটা বোধহয় একবার হঠাৎ করেই শেষবার খলখল করে হেসে
উঠে আবার ঘুমিয়ে পড়ে প্রবালের বুকে।
বিমর্ষ
মনে বাড়ি ফেরে প্রবাল রঞ্জাবতীকে নিয়ে। মনে বোঝাই তখনো দুর্ঘটনার ভয়।
রঞ্জাবতীর
থাকার মধ্যে আছে এক বৃদ্ধ মামা। বাপ-মা হারা অনাথ মেয়েটাকে তিনিই মানুষ করেন।
সেখানে আর পাঠাতে চায়না প্রবাল বা তার মা। প্রবালেরও বয়স বিশেষ হয়নি। তাকে আবার
সংসারী করার জন্যে ওর মাই একটু জোর করে তিনমাস বাদে রঞ্জাবতীর সঙ্গে ওর বিয়ে দেন।
ফুলসজ্জার রাতে রঞ্জাবতীর উদ্দাম প্রেমের ছোঁয়ায় মাঝেমাঝে প্রবালকে ভয় দেখাতো যে
শয়তানটা স্বপ্নে এসে কিম্বা মনের ভেতর থেকে, তার মৃত্যু হয়। কিন্তু পুলিশভীতিটা আজও
রয়েই গেছে।তবে আজ সে স্ত্রী-পুত্র নিয়ে সুখী। তার মা বছর তিনেক আগে গত হয়েছেন। তার
বিগত জীবনের সবকিছুই আজ সে ভুলতে চায় কিন্তু স্মৃতির ফিরে আসার ওপর যে কারো হাত
নেই।
ছেলে
তার কাঁধে ধাক্কা দিয়ে বলে, "কিগো বাবা ! দরবেশটা বার করো! "
প্রবাল
ব্যস্ত হয়ে বলে,
"করছি বাবা! "
রঞ্জা
হাসে, "হ্যাংলামিতে ও তোমার নাম রাখবে।
"তারপর একটু গম্ভীর হয়ে প্রবালের দিকে তাকিয়ে বলে, "কি ভাবো বলোতো মাঝেমাঝে? "
প্রবাল
হাসে, "রঞ্জা! আজ রাতে কিন্তু তুমি ওপরে ,,,,," রঞ্জা হাসতে হাসতে প্রবালের মুখ
চেপে ধরে দুহাতে ,আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে ,"ভগবান! এই মানুষটাকে একটু সৎ বুদ্ধি দাও! "
সুকল্যাণ তপস্বী: কপিরাইট
লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত
ভীষণ ভালো লাগল, আসলে গোগ্রাসে গিললাম গল্পটা নাকি গল্পটাই টেনে নিয়ে গেল শেষ পর্যন্ত ! অসাধারণ বুনোট প্রথমার্ধের পরে যে এমনটা হবে ভাবাই যায়নি এখানে লেখক স্বতন্ত্র ও মুন্সিয়ানা কলমের।
উত্তরমুছুন