রমাকান্ত নামা--ছাঁচ



গল্প

রমাকান্ত জানালার ধারে চেয়ার নিয়ে বসে আছেন। এমনটা প্রায়ই হয়। যখনই তাঁর নিজেকে একলা মনে হয় তখনই জানালার পাশে রাখা চেয়ারটায় বসে তিনি বাইরের দৃশ্য দেখতে থাকেন। সে সব দৃশ্য অতি সাধারণ--রাস্তায় চলাফেরা লোকদের দৃশ্য। বেশীর ভাগই অপরিচিত লোকের ভিড়। চেনা অচেনার মাঝখানের লোকগুলি মনে হয় ক্রমশ: যেন অপরিচিতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। নির্দিষ্ট কোন মানুষকে আজকাল যেন খুঁজে পান না তিনি। বয়স কালের এটাই কি ধর্ম! ক্রমাগত স্মৃতি ভ্রংশের দিকে এগিয়ে যাওয়া মানুষের এমনটাই বোধহয় হয়। কালে ভদ্রে এক আধটা মানুষকে তিনি চিনে ফেলেন। এই যেমন কদিন ধরে এক সন্ন্যাসিনীকে তিনি দেখছেন। প্রতিদিন এক আধ বার এ রাস্তায় তিনি যাতায়াত করেন। শুরুতে রমাকান্ত তেমন চোখ লাগান নি। অপরিচিত গণ্ডিতে ফেলে আলতো চোখে দেখেছেন। কিন্তু কদিন যাতায়াতের পর একদিন তার মুখমণ্ডলের দিকে স্পষ্ট তাঁর চোখ পড়ে গেল। সকালের সূর্য আভা তার দিকে পড়ে ছিল হবে। রমাকান্ত চকিত হয়ে গেলেন, এত চেনা, এই সাধিকা রমণীটি কে? মনের মাঝে প্রশ্নটা ঘুরঘুর করছিল। বেশ মোটা, থুলথুলে চেহারা, গেরুয়া বসনে আবৃত দেহ। চোখে পাওয়ার চশমা। বয়সের ভারে সামান্য ন্যুব্জ হলেও শরীরে বসন্তের পাতা ঝরার পূর্বের আনন্দটুকু যেন এখনও ধরে আছেন। এ সব কি ভাবছেন রমাকান্ত! একজন সাধ্বী সন্ন্যাসিনীর ওপরে এ কি ধরণের তাঁর ভাবনার ছিরি!

বয়স বাড়লেও রমাকান্ত দেখেছেন,ভাবনার ছাঁচ তেমন বদলায় না। এই ছাঁচ কবে থেকে তৈরি হয় কে জানে! জিনের ভেতরেই কি সে স্বয়ম্ভু নাকি? নাকি পরিবেশ তার মন গঠনে সাহায্য করে? জীবনে তিনি সাইকোলজি নিয়ে পড়েননি,তবে সে ধরণের এক আধটা বইয়ের পাতা যে উল্টে পাল্টে দেখেননি তা কিন্তু নয়। মনোগঠনে নাকি বংশ ও পরিবেশ দুটো ফ্যাক্টরই প্রায় সমান ভাবে কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করে। এ সব খটমট ব্যাপারে তিনি বেশী মাথা ঘামাতে চান না। হঠাৎ রমাকান্তের চোখে পড়লওই যে সেই সাধিকা মহিলাটি হেঁটে যাচ্ছেনএবার তাঁর জানলার পাশ ঘেঁষেই চলেছেন। বসার চেয়ার ছেড়ে দিয়ে নিজের অজান্তেই তিনি জানলার কাছ ঘেঁষে দাঁড়ালেন। বেশী হলে হাত দুই তিন দূর দিয়ে মহিলাটি যাচ্ছেন। রোদ্দুর আলোয় তাঁর চকচকে মুখের দিকে তাকাতেই রমাকান্ত চমকে উঠলেন, আরে, এ কি! কি দেখছেন তিনি! এ যে সেই শ্যামলী! যে নাকি তাঁর জীবনে দু দুবার এসে বেশ ঝাঁকিয়ে দিয়ে গিয়ে ছিল। সে ঝাঁকানোর মর্মভেদী একাধারী দুঃখানন্দ রমাকান্ত কি ভাবে ভুলে যেতে পারেন? মানুষ জীবনে কোথাও চঞ্চল,কোথাও বিহ্বল,আবার কোথাও বা শ্লথ। পুরুষ ধর্মের কোন কোন জাগায় সাময়িক হলেও শারীরিক  সুখ দুঃখের উত্থান পতন অবস্থাটা কিন্তু বড় গুরুত্ব পূর্ণ। এই পেতে পেতে না পাবার দুঃখ অবসাদ বড় কম নয়। ইচ্ছের পরিণতি না ঘটলে অতৃপ্তি থেকে যেতেই পারে।

এই সেই শ্যামলীদেখতে শ্যাম বর্ণা হলেও যার দেহ সৌরভে অনেকটা কাঁঠালি চাঁপার গন্ধ তিনি পেতেন। সুখময় সে গন্ধ।  সেই গন্ধের উৎস ধরে তার দোর গোড়ায়ও তিনি পৌঁছেছেন। কিন্তু সেই আনন্দ ঘনতার স্বাদ থেকে তিনি যে বঞ্চিত ছিলেন। এই সেই শ্যামলী। যার প্রতি তলে তলে তাঁর একটা টান থেকেই গেছে। আসলে সেই আনন্দ ঘন অবস্থান থেকে তিনি যে বঞ্চিত ছিলেন। ধুর,কি ভাবছেন তিনি! বয়সের দিকে তাঁর ফিরে তাকানো উচিত। পঁয়ষট্টি পার হতে চলেছে। শরীরে জড়ত্ব না এলেও সেই বয়সের ঝরঝর ভাব কোথায়?

স্ত্রী শৈলবালা মারা গেছেন আজ ছ বছর পার হয়ে গেল। তারপর থেকে বৈরাগ্য জীবন চলছে রমাকান্তর। সেই অবিবাহিত যুবক কালের কথা,প্রথমবার এই শ্যামলী এসে ছিল তাঁর ঘরে। এক সময় ভালবাসার আলাপ সংলাপে উভয়ে মজে গিয়েছিল। এক ধার ঘেঁষা সান্নিধ্য, মাতাল করা বাতাসের কুণ্ডলায়িত ঘ্রাণ,গভীর শ্বাসের বেষ্টন, অবশেষে আলিঙ্গনের বাহুপাশ। কিন্তু উভয়ের ঘনত্ব বাঁধনের পূর্ব মুহূর্তেই সব ম্যাচাকার হয়ে গিয়েছিল--শ্যামলী তার দাঁত বসিয়ে দিয়েছিল রমাকান্তর হাতের কব্জিতেআর গল গল করে সে ক্ষতস্থান থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল। এটা ছিল শ্যামলীর সঙ্গে প্রেমের প্রথম পরিণতি।

আর দ্বিতীয়বার শ্যামলীর সঙ্গে তাঁর দেখা হল স্ত্রীর মারা যাবার দু বছর পরে। সেই খালি ঘর, অবাধ স্মৃতিচারণ, উভয়ের মধ্যে আবার নৈকট্য নিয়ে এসে ছিল। কিন্তু রমাকান্ত জানতেন যে শ্যামলী মানসিক অসুস্থ। বিগত জীবনের দুই স্বামীকে চরম আনন্দের পূর্ব মুহূর্তে  কব্জিতে দাঁত ফুটিয়ে দিয়ে স্বামী পরিত্যক্তা হতে হয়েছিল তাকে। এত কিছুর পরেও রমাকান্ত সব ভুলে দ্বিতীয় বার শ্যামলীকে কাছে টেনে নিয়ে ছিলেন। উভয়ে শৃঙ্গার আনন্দ লাভের পর অবশেষে ঘনতম মুহূর্তেই রমাকান্তর চোখ পড়েছিল, শ্যামলী দ্রুত বদলে যাচ্ছে, হঠাৎ সে তার মুখ রমাকান্তের হাতের কাছে নিয়ে এসে ছিল। আর কয়েক মুহূর্ত বাকী, দংশনের পূর্ব মুহূর্তেই এক ঝটকায় রমাকান্ত তাঁর হাত সরিয়ে নিয়ে ছিলেন। তা না হলে নির্ঘাত শ্যামলীর দংশনে আরও একবার তাঁর হাতের কব্জির ক্ষত হওয়া ছিল অনিবার্য।

স্মৃতি রোমন্থন খারাপ লাগে না--হরিষে বিষাদ যাকে বলে আর কি! রমাকান্ত দেখেছেন,পুরুষ জাতটাই এমনি,মেয়েছেলের ব্যাপারে তাদের মনের মধ্যে ছুঁক ছুঁক ভাব লেগেই থাকে। এই ভগবান ব্যক্তিটিকে বোঝা দায়--পুরুষ তৈরি করেছ তার উন্নত মানসিকতা কেন দাও নি বাবা! যে পুরুষ আকাশ দেখলে উদার হয়, শীতল বাতাসে শরীর জুড়ায়,কিন্তু ওই রংচং বস্তু দেখলেই এত উতলা হয়ে যায় কেন? রাত নামলে এক চোর চোর ভাবনা,লুকোচুরি খেলার অমায়িক ইচ্ছা কেন এমন ভাবে ফুটে ওঠে মনের ভেতর? শরীর রসায়নের সংস্কারের বাঁধ কেন সব সময় ভেঙে ফেলতে উদ্যত হয়! কখনও তো রাতের অন্ধকারে আমরা বন্য হয়ে যাই। সুযোগের অপেক্ষায় ওত পাতা শিকারী হয়ে যাই। শিকারের সঙ্গে খেলতে খেলতে শিকারও ভুলে যায় নিজের সত্তা। শিকারী পুরুষ আর শিকার নারী এক সময় এক জাগায় আতুর হয়ে পড়ে--শিকারী ও শিকার উভয়ে শিকারী বনে যায়। রমাকান্ত দেখেছেন, বন্য জন্তু জানোয়ার আর মানুষের মাঝে খুব একটা পার্থক্য নেই।  দিনের সভ্যতার তলে রাত নেমে আসে। রাতের বন্যতায় সব তছনছ...

রমাকান্ত বর্তমানে ফিরলেন। ওই তো আসছে শ্যামলী,এই পথ ধরেই তার যাতায়াত। তবে কি এখানেই কোথাও থাকে ও? কোনও আশ্রমে? কোন আশ্রম ধারে কাছে আছে বলে তো মনে পড়ছে না! তবে, হ্যাঁ, ওল্ড এইজ হোম এখানে একটা আছে বটে। কিন্তু সন্ন্যাসিনী বেশে সেখানে শ্যামলী কি থাকতে পাবে? কাছাকাছি এসে গেছে শ্যামলী। রমাকান্ত ভাবলেন,একবার ডাকবেন কি না। কিন্তু শ্যামলী তো জানে যে এখানে রমাকান্ত থাকেন। তবে কেন সে একবারও তাঁর ঘরে আসে নি? তবে কি সে মন থেকে সত্যি সন্ন্যাসিনী--সংসারের মায়া মমতা ত্যাগ করে নিজের মনের অভ্যন্তরে নিজের জাগা করে নিতে পেরেছে? কে জানে হবেও বা!

এই তো এক্কেবারে জানালার পাশটি দিয়ে হেঁটে চলেছে শ্যামলী। সাধ্বী বেশ, হাতে আবার ওটা কি? ত্রিশূল নাকি? হ্যাঁ,তো,ছোট,হাত খানেক লম্বা সরুএকটা ত্রিশূল--ধারালো মুখওয়ালা। ওটা কেন হাতে? ওটা কি তা হলে আত্মরক্ষার জন্যে--সাধু সন্ন্যাসীদেরও কি তা হলে হাতিয়ার রাখতে হয়! নেড়া ল্যাংটাদেরও সঙ্গে হাতিয়ার রাখার প্রয়োজন থাকে? হ্যাঁ, হতেই পারে, নিজেকে বাঁচাতে, অন্তত কুকুরের হাত থেকে। আর সাধু সন্ন্যাসীরা, বিশেষ করে সন্ন্যাসিনীরা তো একেবারে বিপদ শূন্য হতে পারে না। কিন্তু শ্যামলী? ওর তো বয়স হয়েছে--হ্যাঁ, ষাট পার না করলেও তার কাছাকাছি তো বটেই! তবে তার নির্ঝঞ্ঝাট চেহারা এখনও শেষ বাঁধন ছাড়ে নিতবে ওকে অপুরুষম্পশ্যা বলা যাবে কি?

শ্যামলী কোথাও চাকরি টাকরি করে নাকি? রমাকান্ত বাবু নিজের মাঝে আর থাকতে পারলেন না--মৃদু অথচ গম্ভীর গলায় ডেকে উঠলেন, শ্যামলী, শ্যামলী! শুরুতে মনে হল শ্যামলীর কান পর্যন্ত সে ডাক পৌঁছায় নি--কিন্তু ক পা এগিয়ে গিয়ে ও দাঁড়িয়ে পড়ল,ঈষৎ মুখ ফিরিয়ে তাকাল। চোখ ঘুরে ফিরে শেষে সেই জানলায় দাঁড়িয়ে থাকা রমাকান্তের চোখে গিয়ে পড়ল। ধীর পদে শ্যামলী এসে জানালার পাশে দাঁড়ালো। গাঢ় হাসির রেখা ব্যাপ্ত হল রমাকান্তর গালে,শ্যামলীর মুখমণ্ডলের হাসি সন্ন্যাসিনীর আয়ত্ত সীমানা পর্যন্ত এসে থেমে গেল। তবে পরিচিত চার চোখের উজ্জ্বলতা বেড়ে গেছে।

--কেমন আছ? রমাকান্ত গলায় গাম্ভীর্য নিজে বলে উঠলেন।
সাধ্বী রমণীর মতই ধৈর্য নিয়ে উত্তর দিল শ্যামলী,আমি খুব ভাল আছি—
 বেশভূষার সঙ্গে সঙ্গে কথাবার্তার ধরনও দেখছি বেশ রপ্ত করে নিয়েছে শ্যামলী,রমাকান্ত মনে মনে আওড়ে নিলেন। লক্ষ্য করলেন,এবার শ্যামলী তাঁকে রাম দা,বলে সম্বোধন করেনি। তার মানে সে সন্ন্যাসিনীর বাধা নিষেধগুলি লঙ্ঘন করতে চায় নি-- ভালো, ভালো, খুব ভালো।
--আপনি ভালো তো?
শ্যামলীর প্রশ্ন কানে বাঁধল রমাকান্তর--আপন,আপন তুমি ভাব ছেড়ে দিয়ে এবার শ্যামলী আপনি, বলে সম্বোধন করেছে। পরিবর্তন এসে গেছে তা হলে ওর মধ্যে!
--আমি একটা কাজে বেরিয়েছি--মাপাজোপা কথা শ্যামলীর।
--যা বাবা,এত পরিবর্তন? মুখ ফসকে কথা বেরিয়ে গেল রমাকান্তর,একবার সময় পেলে এস!
--না, না, আমি আজকাল কারও ঘরে যাই না--নিঃস্পৃহ ভাব নিয়ে নিজের গন্তব্যের দিকে পা বাড়াল শ্যামলী।

ব্যাসওই পর্যন্ত,সে দিন আর কথা হল না। রমাকান্ত যেন হঠাৎ নিভে গেলেন। এই বয়সে মনের মাঝে কু অভিসন্ধিকে বড় একটা মাথা চারা দিতে দেন না তিনি। স্বাভাবিক ভাবে তিনি চেয়ে ছিলেন, অন্তত পরিচিত কেউ তাঁর বাড়ি এলে টাইম পাস ব্যাপারটা হয়ে যায়। নিজের একলাপন ভাবটা কাটানো যায়। এখন তিনি একেবারেই একলাটি। এক মাত্র ছেলে,ছেলে বউ,আর নাতি নাতনিরা বছরে দুবার এসে ঘুরে যায়। তবে সপ্তাহে দু তিনদিন ওদের ফোন তিনি পান। পাঁচ দশ মিনিট কথা হয়। নাতি, নাতনিদের সঙ্গে কথা হলে বেশ লাগে। কিছু সময়ের জন্যে তিনি ভুলে যান যে ঘরে তিনি একমাত্র প্রাণী বাস করেন। স্ত্রীশৈলবালা বেঁচে থাকতে হাসি খুশি ভালবাসাবাসির স্বাদ নিয়ে দিনগুলি কেটে যেত। অবশ্য স্ত্রীর বয়স যত বাড়ছিল তত যেন সাদামাটা হয়ে যাচ্ছিল। আর তার বিছানার শাসন বড় বেশী বেড়ে গিয়েছিল। তার মনের কোন কোণে সন্দেহের বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল--এখানে যাবে না,ও দিকে তাকাবে না,বিছানায় ছটফটাবে না,নাক ডাকবে নাকোলবালিশ জড়িয়ে ধরবে না--এমনি কত যে বাধা নিষেধ ছিল তা বলে শেষ করা যাবে না। এত বাধার মাঝে ছিলেন বলেই বোধহয় মনটা তাঁর মাঝে মাঝে উঁচকে উঠত। আর তাই তো স্ত্রীর মৃত্যুর পর শ্যামলী দ্বিতীয়বার যখন তাঁর ঘরে এলো তখন ওই বয়সেও তিনি যেন কেমন উৎফুল্ল হয়ে পড়েছিলেন। তিনি বুঝে ছিলেন,শ্যামলীর ব্যাপারে তাঁর মনে কথাও যেন দুর্বলতা থেকে গেছে। বর্ষা কালের বর্ষা কেমন জমে উঠেছিল। সকাল থেকে মেঘলা আকাশ,ঝমঝমিয়ে বৃষ্টির পরে সেই যে টিপ টিপ ধারায় বৃষ্টি পতন শুরু হল তার শেষ হবার নাম নেই।

রাত তখন আটটা হবে,রমাকান্ত স্বপাক ভক্ষণ করে বিছানার পাশটিতে রাখা চেয়ারে বসে আছেন। আজকের দিন অনেক কষ্টে পার হচ্ছে--ঘরের টিভি আর কত সময় নজরে রাখা যায়! নিউজ দেখতে দেখতে মনের মধ্যে থ মারা একটা ভাব জমে আছে। তবু একলা চলে ফিরে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। কিন্তু এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে এখনও মন যেন কেমন কেমন করে! সেই গানের কলির মত এখন তো আর বলা যায় না যে কবে পাব তোমার নিমন্ত্রণ! সে সব দিন যে রমাকান্ত বহু কাল আগে ফেলে এসেছেন।

রমাকান্তকে চমকে দিয়ে হঠাৎ ঘরের বেল বেজে উঠলো। দেওয়াল ঘড়িতে তখন নটার কাছাকাছি। এ সময় কে এলো রে বাবা! কেউ আসার কথা তো নয়! চোর ডাকাতের ব্যাপার হতে পারে না। কারণ রমাকান্ত তো বলতে গেলে নেড়া ল্যাংটা বাস করেন। ঘরে বেশী টাকা পয়সা রাখেন না। স্ত্রীর গয়নাগাটি ও বহুদিন ধরে ব্যাঙ্কের লকারে পড়ে আছে--তবে? ধীরে ধীরে দরজার কাছে এগোলেন তিনি। হ্যাঁ,দরজায় কী-হোল আছে বটে,তবে লেন্স নেই,দেখার চেষ্টা করলে একেবারে সরাসরি দেখা যাবে। বাইরে ঝমামঝ বৃষ্টির শব্দ--তার সঙ্গে ষ্ট্রীট লাইটের ঝাপসা আলো। কী-হোল দিয়ে তাকালেন তিনি। অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই বোঝা গেল না। মনে হল বাইরের ব্যক্তিটিও কী-হোল দিয়ে ভেতরের দৃশ্য নিরীক্ষণ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

কিছুক্ষণ ইতস্তত করে দরজার এক দিকের পাট সামান্য ফাঁক করলেন তিনি।
--দরজা ছাড়ুন,ভেতরে যেতে দিন তো--
ও মা! এ যে শ্যামলী সন্ন্যাসিনী--প্রথমটা ঠাওর করা না গেলেও গলার আওয়াজ অনেকটা পরিষ্কার করে দিল।
--এসোএসো ভেতরে এসো
সন্ন্যাসিনী ঘরে ঢুকলেন,নিজেকে বাঁচানো গেল না--একদম ভিজে গেছি--
রমাকান্ত কথা জুড়লেনঝির ঝির করেই তো পড়ছিল সারা দিন--
--হ্যাঁ,হঠাৎ জোরে নাবল,ছোট ছাতায় মানানো যাচ্ছিল না। আর তা ছাড়া ঝড়ও তো শুরু হয়েছে দেখলাম।
রমাকান্ত স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করলেনবেশ করেছ,কিছু সময় এখানে বসে যাও--
রমাকান্ত লক্ষ্য করলেন,শ্যামলীর চালচলন অনেক ধীর স্থির হয়ে গেছে। কথাবার্তাও আর আগের মত ছলবল করে বলে না। পালঙ্কের পাশে রাখা চেয়ারে শ্যামলী বসে গেল। রমাকান্ত জানালার পাশের  চেয়ারটা টেনে এনে বসলেন
--কোথায় আছ?
--ওই এ পাড়ার লেডিস হোস্টেলে।
 অসুবিধা হচ্ছে না তো?
--সব সয়ে গেছে--এখন নিজেকে গুছিয়ে নিতে শিখেছি।
--সন্ন্যাসিনী হলে কবে থেকে? মৃদু হাসির রেখা ছড়িয়ে প্রশ্ন করলেন রমাকান্ত।
--সে তো অনেক গল্প--সময় পেলে বলব কোন দিন।
--এক কাপ চা চলবে?
--না,না,ব্যস্ত হবেন না--আমি কারও ঘরে খাই না--
মনে সামান্য সাহস জুগিয়ে রমাকান্ত বলে উঠলেন,আপনি না বলে তুমি বলা যায় না?
হাসির প্রলেপ পড়ল শ্যামলীর মুখে,বলল,ও সব দিন তো আর নেই--
--তবু তোমার আমার সম্পর্ক --
--সে সব আর রাখতে চাই না--একটু চুপ থেকে শ্যামলী কিছু ভেবে নিয়ে ঠোঁটের কোণে হাসির স্মিত ঝিলিক দিয়ে বলল,তোমাকে তুমি বলতেই ইচ্ছে করে--

ভাল লাগছিল রমাকান্তর,শ্যামলীর কথাগুলি নিঃসঙ্গতার ফাঁক ফোঁকর গলিয়ে,নির্জনতা ভেঙে উঁকি দেবার চেষ্টা করছিল। ভাল লাগবে বই কি--তিনি বললেনহ্যাঁ, আমার ভাল লাগবে। এবার পুরনো সম্বোধনে ফিরে এলো শ্যামলী,বলে উঠলোকেমন করে দিন কাটছে তোমার,রাম দা? রমাকান্তর মনের কোথায় এবার চন,করে উঠলো--তাঁর স্নায়ুতন্ত্রের তার কোথাও যেন ঝন,করে বেজে উঠলো। পুরনো কাটা কাটা স্মৃতির ঝাঁপ মনোচোখে ভেসে উঠছিল। এত সময় লক্ষ্য করলেন রমাকান্ত,শ্যামলী তার হাতে ধরে রাখা ছোট ত্রিশূলটা পালঙ্কের পাশের ছোট টেবিলের ওপরে রেখে দিল। ওটা ওর রক্ষা কবচ হবে। সন্ন্যাসিনীর শত্রু থাকতেই পারেআর  নারীর শত্রু তো পথেঘাটে ওত পেতেই থাকে। আচ্ছা,রমাকান্তও শ্যামলীর শত্রু নাকি! মনে পড়ে গেল তাঁর হ্যাঁ,পরিণামে শত্রুই বলা যেতে পারে। আর সে কারণেই শ্যামলী একদিন তাঁকে দংশন করে ছিল। কে জানে এখন হয়তো দাঁত নড়বড়ে হয়ে যাওয়ায় ত্রিশূল অস্ত্র  হিসাবে তাকে ধারণ  করতে হয়েছে!

--কি হল--একে বারে বোবা বসে থাকা ভাল লাগে না,রাম দা!
--কি বলব বল--তোমার আর আমার স্মৃতি তো ওই--
খানিক অন্যমনস্ক হল শ্যামলী--বোধহয় সে সব স্মৃতি কথা মনের গভীরে নাড়াচাড়া খাচ্ছিল,সে স্মৃতি নিয়েই সে এক সময় জেগে উঠলো। মৃদুমন্দ হাসি তার মুখে ফুটে উঠলো--সন্ন্যাসিনীর মুখে এখন জেগে উঠল সলজ্জ হাসির চমক।

রমাকান্ত জানেন যে শ্যামলী কোন ভাবনায় আটকে আছে--সেই ছন্দায়িত ঘন লতা বিতানের আড়ালে দুই প্রেমিক প্রেমিকার উষ্ণ শ্বাস। চার চোখের পরিপাটি তাকানোর গভীরতা,সমস্ত সময় পান করে নিয়ে কেবল বিহ্বল শরীরের ঘনত্বের আশ। আর সেই অসূর্যস্পশ্যা স্থানটুকু পাবার অফুরান চাহত। পরক্ষণেই তাৎক্ষনিক ক্ষিপ্রতায় নারীর ফুঁসে ওঠা বিষের ছোবল দাঁত।

--এখনও জানলা দিয়ে কি তাকিয়ে দেখো রাম দা! বয়সের ভার হারিয়ে ফেলে ক্রমশ: প্রগলভ হয়ে উঠছে নারী--শরীরের জড়ানো কৌপীনের কথা কি সে ভুলে যাচ্ছে?
হাসলেন রমাকান্ত,মুখ খুললেন,হ্যাঁ দেখি,রাস্তার লোকজন,তাদের চলা ফেরা,তাদের কথাবার্তা, চালচলন আমার চোখে পড়ে।
--আর সেই ছাদের কথা মনে পড়ে তোমার?
হ্যাঁ,ভুলে যাবার উপায় কোথায়? সে দিনের ছাদে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা আজ হয় তো বার্ধক্য পার করে গেছে--সংসার বন্ধনের লতাপাতায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছে। রমাকান্ত মুখে বললেন,হ্যাঁ, ভুলে যাবার উপায় কোথায়?
--শুধু আমিই তোমায় মনে করে দিয়ে যাই--তাই না?

হাসলেন রমাকান্তবড় সহজ সরল সে হাসি। সন্ন্যাসিনীও তো অনেক সহজ হয়ে এসেছে। বয়সের বাকল ফেলে সেও সঞ্জীবিত হয়ে উঠেছে। উভয়ের শরীরে সঞ্জীবনী বটিকার কাজ শুরু হয়ে গিয়ে ছিল। সন্ন্যাসিনী তার অতীত স্মৃতি মন্থনে ব্যস্ত। দেহে কম বেশী  জারক রস তৈরি হচ্ছিল। এবার রমাকান্ত ধীর পায়ে সেই জানলার ধারে গিয়ে দাঁড়ালেন। পুরনো স্মৃতি টাটকা হয়ে উঠছিল। সন্ন্যাসিনী এগিয়ে যাচ্ছে সেই স্মৃতিময় জানলার পাশে। শরীরের জড়ত্ব ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছিল। বয়সের জড় আলগা হয়ে আসছিল। নীরবতা নিয়ে ওরা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে আছে। এখন আর সেই উঁচু দালানের প্রতীক্ষা রত মেয়েটি নেই--বহু যুগ আগের স্মৃতি তবু কেন আজ হৃদয় ধরে আছে!

সব সরে যাচ্ছিল দ্রুত--বর্তমান বলবতী হয়ে উঠছিল। প্রেমিক প্রেমিকা নিজের দেহে আবার প্রকাশমান হয়ে উঠছিল। রমাকান্ত তাঁর সিক্ত ঠোঁট যুগল এগিয়ে আনল শ্যামলীর দিকেরসসিক্ত হয়ে উঠেছে সন্ন্যাসিনীর ওষ্ঠ যুগলও। আর ধরে রাখা যাচ্ছিল না--এক চৌম্বকীয় আবেশ ওদের ঠোঁট একাত্ম করে দিল। ক্রমশ: নিবিড়তা দৃঢ় হতে চলেছে। ঘন শ্বাসের ধারা এক পংতিতে বয়ে যাচ্ছিল। শরীরের সেই উৎস দেশ থেকে আনন্দ বারির স্পর্শ অনুভূত হচ্ছিল। ওরা ক্রমশ: ঘরের পালঙ্কের নিকটতম হল। ওদের সামনে পরিপাটি বিছানা--তার এক কোণে রাখা পাশ বালিশটা ঝিমচ্ছিল। আর এক সময় ওরা উতলা হয়ে উঠলো। এখন কেবল স্বয়ংক্রিয় ইচ্ছাগুলি কেন্দ্রীভূত হয়ে আসছে। শেষ ছোঁয়াটুকু নিতে রমাকান্ত তৎপর হতে গিয়ে হঠাৎ তাঁর চোখে পড়ল,শ্যামলীর মুখ খুলে গেছে। এক কাঠিন্য ভাব ওর সম্পূর্ণ মুখমণ্ডলে পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। রমাকান্ত আঁতকে উঠলেন,নিজের কব্জিতে শ্যামলীর ভোঁতা দাঁত অনুভব করলেন। সে দাঁত কব্জিতে ফুটে যাবার আগেই এক ঝটকায় তিনি দূরে সরে দাঁড়ালেন,দেখলেন যে কখন যেন সন্ন্যাসিনী টেবিলের ওপর থেকে তুলে নিয়েছে তার ত্রিশূল--নিজের আত্মরক্ষার অস্ত্র!

                                                    সমাপ্ত                                      
তাপসকিরণ রায়: কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন