গল্প
-
রামুদা,এই টাকাটা রাখো।
-
দাদাবাবু,এত টাকা কী হবে?
-
অন্য
কোথাও থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে নাও। বাড়িটা প্রোমোটারকে দিয়ে দিচ্ছি। পুজোর পর
ফিরে এসে প্রোমোটারের থেকে বাড়ির হিসেব বুঝে নেব।
-
কিন্তু
দাদাবাবু...!
-
কোনও কিন্তু
নয়,রামুদা। কিসের টানে
বাড়িটা রাখব বলতে পারো? বাবাকে কতবার আমাদের সাথে ক্যালিফোর্নিয়া নিয়ে যেতে
চেয়েছিলাম। কিন্তু ওই যে একগুঁয়ে স্বভাব! এই বাড়ি আঁকড়ে পড়ে থাকল। আজ যখন সেই
মানুষটাই নেই,তাহলে আর এই বাড়িটাই বা
রেখে কী করব?
-
দাদাবাবু,বড়বাবু কী আর সাধে যেতে
চাননি বাড়ি ছেড়ে! এই বাড়ির প্রতিটা কোণায় কোণায় যে তোমার মায়ের স্মৃতি জড়িয়ে আছে!
সে স্মৃতি ভুলে বিদেশে চলে যাওয়া কী এতই সহজ?
-
যত সব
পুরোনো ধ্যান-ধারণা! দেখো রামুদা,আমরা তো এখন পাকাপাকিভাবে ক্যালিফোর্নিয়াতেই শিফট্ করে
গেছি। কলকাতায় ফেরার ইচ্ছে আর নেই। তাই এই বাড়িটারও আর কোনও প্রয়োজন নেই।
-
তাই বলে
এত সুন্দর বাড়িটা প্রোমোটারকে দিয়ে দেবে দাদাবাবু! আর একটু ভেবে দেখলে পারতে।
-
আর কিছু
ভেবে দেখার নেই। বাড়ি রাখা মানেই ঝামেলা। এত বড় বাড়ি মেইনটেইন করবে কে? আর একেবারে মধ্য
কলকাতার বুকে এই বাড়ি। তাই বিক্রির টাকাটাও মন্দ পাচ্ছি না। তবে আর দোটানায় পড়া
কেন!
-
আমি আর কী
বলি! যা ভালো বুঝবেন,তাই
করুন দাদাবাবু।
চোখের জলটা কোনওরকমে আটকে দ্রুত ঘর থেকে
বেরিয়ে গেল রামু। টাকার বান্ডিলটা টেবিলের ওপর রেখে চিৎকার করে শুভ্রাংশু বলল,”রামুদা,টাকাটা রইল,দেখে নিও।"
না খেতে পাওয়া অনাথ ছেলেটাকে স্টেশন চত্বর
থেকে নিয়ে এসে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিল বড়বাবু মানে বাড়ির কর্তা সুধাংশু
চ্যাটার্জি। প্রথম প্রথম সন্তানস্নেহে মানুষ করলেও পরে যখন বড়বাবুর নিজের ছেলে হল,তখন রামুর বুঝতে
অসুবিধে হল না যে এই বাড়িতে তার স্থান একজন ভৃত্যের চাইতে বেশি কিছু নয়। তাতে
অবশ্য কোনওদিন কোনও অভিযোগ ছিল না রামুর। ও সবসময় নিজের ভাগ্যের প্রতি প্রসন্ন
ছিল। যে ছেলেটা একবেলা দু’মুঠো ভাত পেলে আর একবেলা উপোস করে কাটাত,সেই ছেলেটার এই বড়বাবুর
বাড়িতে দু’বেলা খাওয়া-পরার অভাব
নেই। মানুষটা খুব স্নেহও করত রামুকে। বাংলা বর্ণমালা চিনিয়েছেন,নিজের নাম লিখতে
শিখিয়েছেন,
বই পড়তে
শিখিয়েছেন। ওই মানুষটার জন্যই রামু আজ সাক্ষর। তাই অভিযোগ তো অনেক দূরের কথা, সুধাংশুবাবুকে দেবতার
আসনে বসিয়ে পুজো করত এই বিশ্বস্ত ভৃত্য রামু। আজ সুধাংশুবাবু না থাকলে হয়তো রামুকে
অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে টিকে থাকার জন্য আস্তাকুঁড় হাতড়ে রুটির টুকরো কুড়িয়ে
খেতে হত। তাই রামু ওর বড়বাবুর কাছে অশেষ কৃতজ্ঞ।
আজ চল্লিশ বছর ধরে বাড়িটা ভৃত্য রামুর
নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে জড়িয়ে গেছে। শুভ্রাংশু বয়সে রামুর থেকে বছর দশেকের ছোট। জন্মের
পর থেকে ছেলেটাকে কোলে-পিঠে মানুষ করা থেকে শুরু করে গল্প বলা,খাইয়ে দেওয়া,স্নান করানো, ইস্কুলে নিয়ে যাওয়া –সবেতেই রামু প্রধান
ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু দু’মুঠো খাওয়া-পরা ছাড়া কোনওদিন কোনও দাবি-দাওয়া জানায়নি
সে। দাদাবাবুও খুব ভালোবাসত রামুকে। নিজের মা-বাবার থেকেও অনেক বেশি। ওর বেড়ে ওঠাই
তো এই রামুর হাত ধরে। ছোট থেকে মা-বাবার আদর ও যত না পেয়েছে,তার থেকে অনেক বেশি
কাছে পেয়েছে রামুকে। তাই রক্তের সম্পর্ক না থেকেও এই মানুষটার প্রতি শুভ্রাংশুর
মারাত্মক টান ছিল। আর রামুও কোনওদিন নিজের কথা চিন্তা না করে ছেলেটাকেই সমস্ত
ভালোবাসা উজাড় করে দিয়েছে। কোনটায় ওর ভালো হবে,কোনটায় ও কষ্ট পাবে, এসবের
প্রতি রামুর ছিল তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। সবসময় আগলে রাখত ছেলেটাকে।
শুভ্রাংশু তখন ক্লাস সিক্সে পড়ে। সেবার পুজোর
ছুটিতে কাকু-কাকিমা আর ওদের মেয়ে বিন্নি ওদের বাড়িতে ঘুরতে এসেছিল। সুধাংশুবাবু,ওনার স্ত্রী অরুণিমা
কিংবা শুভ্রাংশু –কেউই
কোনওদিন রামুর সাথে চাকরের ভতো ব্যবহার করেনি। রামু ছিল ওদের পরিবারেরই সদস্য।
কিন্তু সেইবার রামুর প্রতি কাকু-কাকিমার খারাপ ব্যবহারে খুব কষ্ট পেয়েছিল
শুভ্রাংশু। ও চিৎকার করে রাগ দেখাতে চেয়েছিল ওদের ওপর। কিন্তু রামু ওকে আদর করে
বোঝায়,“দাদাবাবু,রাগ করে না, ওনারা তো কয়েকদিনের
জন্য বেড়াতে এসেছেন। তুমি কিছু বললে ওনারা তোমাকে খারাপ ছেলে ভাববেন। তুমি কী খারাপ? তুমি তো ভালো ছেলে।
তাহলে ওরকম কোর না। ক’দিন
পরেই তো ওনারা বাড়ি চলে যাবেন। তখন আমি আর তুমি আবার আগের মতো সারা বাড়ি ছুটে খেলে
বেড়াব। আর আমাদেরকে কেউ বাধা দেবে না।" রামুর কথায় ক্ষান্ত হয়েছিল শুভ্রাংশু।
কিন্তু যেদিন কাকিমা কানের দুল চুরির অপবাদটা রামুকে দিল,সেদিন আর চুপ থাকতে পারেনি বছর
বারোর এই শুভ্রাংশু। চিৎকার করে ঠোঁট ফুলিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল ও। কাকিমাকে
ধাক্কা দিয়ে বলেছিল, “তুমি
মিথ্যে কথা বলছ। আমার রামুদা এমন কাজ করতেই পারে না। বেরিয়ে যাও তুমি আমাদের বাড়ি
থেকে।" রাগে লাল হয়ে যাওয়া দু’চোখ বেয়ে টসটস করে জল পড়ছিল শুভ্রাংশুর। সুধাংশু বাবু আর
অরুণিমা দেবীও রামুকে সমর্থন করে বলেছিলেন,“অনিতা! মিথ্যে দোষারোপ কোর না।
রামু চোর নয়। তুমি ভালো করে খুঁজে দেখো,ঠিক পেয়ে যাবে কানের দুল।" পরে অবশ্য ওই কানের দুল
কাকিমা অর্থাৎ অনিতা দেবীর ভ্যানিটি ব্যাগেই পাওয়া গিয়েছিল। শুভ্রাংশু রাগে আর
ঘৃণায় রামুদার কাছে কাকিমাকে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করেছিল। অপমানিত বোধে জর্জরিত
হয়েছিল ওর কাকু-কাকিমা। তারপর থেকে ওনারা আর কোনওদিন ওদের বাড়িতে আসেননি। সেদিন
রামু বুঝেছিল এ বাড়ির মানুষগুলো ওকে ঠিক কতটা ভালোবাসে! সারাদিন ও কেঁদেই চলল।
শুভ্রাংশু জিজ্ঞাসা করেছিল,“রামুদা,তুমি যে চুরি করনি,সেটা তো প্রমাণিত হয়েই
গেল। ওরা চলে গেছে। তুমি তাহলে এভাবে কাঁদছ কেন?”
রামু ছোট ছেলেটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল,“দাদাবাবু,এ অশ্রু তো দুঃখের নয়, আনন্দের। আমার ওপর
তোমাদের বিশ্বাস দেখে আমি স্তম্ভিত,দাদাবাবু। জীবনে আর আমার কিছুই চাওয়া-পাওয়ার নেই। আমি
সবকিছু পেয়ে গেছি। কালে তুমি অনেক বড় মানুষ হবে,দাদাবাবু। অনেক নাম-ডাক হবে
তোমার,মিলিয়ে নিও।"
সময়ের নিয়মে বছর এগিয়ে চলল। রামুর বয়স বাড়তে
লাগল,বড়বাবু আর মা-ঠাকরুণেরও
বয়স বাড়তে লাগল। দাদাবাবু কলেজে ভর্তি হল। রাত করে উন্মাদ হয়ে বাড়ি ফেরা,উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপন – কিছুই চোখ এড়াত না
রামুর।
ও একদিন শুভ্রাংশুকে বলল,“দাদাবাবু,তুমি অনেক বদলে গেছ।
তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে একটা কথা বলার ছিল,নিজেকে সংযত করো।"
শুভ্রাংশু বলেছিল,“রামুদা, তুমি মাঝে মাঝে বোধহয়
ভুলে যাও যে তুমি আমাদের চাকর। নিজের সীমা অতিক্রম কোর না। আমার ব্যাপারে নাক
গলাতে এসো না।"
সেদিন জীবনের সবচেয়ে বড়ো আঘাতটা পেয়েছিল রামু।
ওর মুখ থেকে কথা সরছিল না। কী বলবে,বুঝতে পারছিল না। পাথরের মূর্তির মতো হতভম্ব হয়ে এক
জায়গায় চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল ও। এ কী শুনছে ও আজ! যাকে মানুষ করার জন্য নিজের
ভবিষ্যতের দিকে কোনওদিন তাকায়নি ও,যার জন্য সারা জীবন অবিবাহিত থাকল,তার মুখে আজ এসব কী
কথা! সেদিনের শুভ্রাংশু আর আজকের শুভ্রাংশুর তো বিস্তর ফারাক! যে বাড়ির মানুষগুলোর
জন্য রামু নিজের প্রাণ বিসর্জনেও প্রস্তুত,যে বাড়ির প্রতিটা ইঁট ওর
বিশ্বাসের সাক্ষ্য বহন করছে,সেই বাড়ির ছেলের মুখে এরকম কথা শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল
রামু।
নিজেকে সান্ত্বনা দিল এই ভেবে,“দাদাবাবু তো ভুল কিছু
বলেনি। আমি তো সত্যিই এ বাড়ির চাকর। আমিই ভুলে গিয়েছিলাম। এবার থেকে নিজেকে সংযত
করব। চাকর হয়ে মালিকের জীবনে হস্তক্ষেপ করা আমার মোটেই শোভা পায় না।"
রামু সেদিনই চলে যেতে চেয়েছিল,কিন্তু পারেনি বড়বাবু
আর মা-ঠাকরুণের মুখের দিকে তাকিয়ে। ছেলেটা তো উচ্ছন্নে গেছে! এখন এই বৃদ্ধ বয়সে
রামু যদি ওদের সহায় না হয়,তবে মানুষগুলো বাঁচবে কী করে! দাদাবাবু খারাপ কথা বলেছে,বড়বাবু বা তাঁর স্ত্রী
তো বলেননি। তাহলে তাঁদের কথা না ভেবে অবিবেচকের মতো বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া
বিশ্বাসঘাতকতার সামিল। আর রামু কোনওদিনই বিশ্বাস ভঙ্গ করতে পারবে না। ওর মন সায়
দেবে না। এসব ভেবেই বাড়ি ছেড়ে আর যাওয়া হল না রামুর। মায়ার বন্ধনে জড়িয়ে গেছে যে
ও!
তারপর দাদাবাবু আরও বড় হল। বড়বাবু অনেক টাকা
খরচ করে ছেলেকে বিদেশে পড়তে পাঠালেন। আসা তো দূরের কথা,সারাদিনে একবার ফোন করে বৃদ্ধ
মা-বাবার খবর নেওয়ারও প্রয়োজন মনে করত না শুভ্রাংশু। বরং ওকে ফোন করলে ও বিরক্ত হত,ঝাঁঝিয়ে উঠে ফোন কেটে
দিত। সারা সপ্তাহে হয়তো একবার ফোন করত বাড়িতে। পাড়ার লোকেরা সুধাংশুবাবুকে বলত, “আপনার তো দারুণ ভাগ্য
মশাই! ছেলে তো একেবারে সোনার টুকরো। ওমন ছেলে পাওয়া অনেক পুণ্যের ফল।" আনমনা
হাসি ফুটে উঠত সুধাংশুবাবুর মুখমণ্ডলে। সত্যিই ওনার ভাগ্য বড় সুপ্রসন্ন। সেই জন্যই
বোধহয় ব্যস্ত ছেলে মা-বাবার খোঁজ নেওয়ারও প্রয়োজন বোধ করে না।
এরকমই একদিন সকালে ছেলের ফোন।
-
হ্যলো
বাবা!
-
হ্যাঁ রে
শুভ্র,বল্,দিন পাঁচেক পর বাবাকে
মনে পড়ল তাহলে?
-
বাবা,খুশির খবর আছে। সেই যে
ক্যালিফোর্নিয়ার মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিটার কথা তোমায় বলেছিলাম না.....
-
হ্যাঁ,হ্যাঁ,মনে আছে।
-
ওখানে
চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি।
-
কী
আনন্দের খবর দিলি রে বাবা! আমার জীবন সার্থক। এবার পুজোয় আসছিস তো বাবু?
-
ওসব পরে
ভাবব। রাখছি তাহলে এখন।
মুহূর্তে ফোনটা কেটে দিল শুভ্রাংশু। মা-বাবার
শরীরের খবরও জানার অবকাশ হল না তার। এমনকী মায়ের সাথে কথা বলে সুখবরটা জানানোরও
প্রয়োজন মনে করল না ব্যস্ত ছেলে। সুধাংশুবাবু এই ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দিলেন,“হয়তো ছেলে কাজে ব্যস্ত
আছে। এত বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে কাজ পেয়েছে বলে কথা! আমাদের তো রাগ করা সাজে
না।"
উনি নিজেই সুখবরটা সবাইকে দিলেন, “ওগো শুনছ! অরুণিমা!
রামু! কোথায় তোমরা? শোন, শোন,আমাদের শুভ্র
ক্যালিফোর্নিয়ার বিশাল বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছে।" বড়বাবু
রামুর হাতে টাকা দিয়ে বললেন,“আজ পুরো পাড়াতে মিষ্টি দিতে হবে। কিনে আন, রামু।" রামু
খুশিতে ডগমগ হয়ে মিষ্টি এনে সারা পাড়ার সকলকে খাওয়ালো। দাদাবাবুর এই সাফল্যে আজ
সবচেয়ে বেশি খুশি ও। ওর আশীর্বাদ আজ ফলে গেছে। অনেক নাম-ডাক হয়েছে দাদাবাবুর।
কিন্তু শুভ্রাংশু মানুষ হতে পেরেছে কী?
সেইবার পুজোয় বিনা নোটিশে শুভ্রাংশুর বাড়িতে
আগমন। ভীষণ খুশি সুধাংশুবাবু আর অরুণিমা দেবী। কিন্তু শুভ্রাংশুর সাথে ওটা কে? টি-শার্ট আর জিন্স
পরিহিত এক মহিলা। মেয়েটি দেখতে ভীষণ সুন্দর। শাঁখা-পলা বা সিঁদুরের বালাই নেই। তাই
বিবাহিত না অবিবাহিত, বোঝা
মুশকিল। জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে সবাই তাকিয়ে থাকে শুভ্রাংশুর দিকে। শেষে সব প্রশ্নের
সমাধান করে ও উত্তর দেয়, “মা,বাবা,রামুদা,ওর নাম মালিনী। আমার বিবাহিত স্ত্রী।"
নির্বাক হয়ে যায় তিনটে মানুষ। হতচকিত হয়ে পড়ে
ওরা। এ তো স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি ওরা কোনওদিন। শুভ্রাংশু কাউকে কিছু না জানিয়ে
বিয়ে করেছে! জীবনের এত বড় সিদ্ধান্ত নিজেই নিয়ে নিল! একবার জানানোরও প্রয়োজন মনে
করল না! জিভের ডগাগুলো শুকিয়ে গেছিল তিনটে মানুষের,মুখ থেকে কথা সরল না। ছেলের
বিয়েতে কখনওই আপত্তি করতেন না সুধাংশুবাবু। অনেক আশা ছিল ধুমধাম করে একমাত্র ছেলের
বিয়ে দেবেন ছেলের পছন্দ করা মেয়ের সাথেই। এরকম অপ্রত্যাশিত ঘটনা হতবাক করে দিল
তাঁকে। কিন্তু কিছু করারও তো নেই। কাজেই বৌমা’কে মেনে নিলেন ওনারা। বৌমাও
ক্যালিফোর্নিয়াতেই একটি আই.টি সেক্টরে চাকুরিরতা। দশমীর দিনই চলে গেল ওরা।
অরুণিমা দেবী এই ঘটনার আকস্মিকতা কাটিয়ে উঠতে
পারেননি তখনও। কথাবার্তা বলেনই না, খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। শরীরের কষ্টগুলো প্রকাশও করেন
না। সুধাংশুবাবুর নিজেকে বড় অসহায় মনে হয়। মনের জোর নিয়ে জোর করে স্ত্রী’কে অনেক বোঝান, কিন্তু
সমাধান হয় না। শেষে একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখলেন অরুণিমা দেবী তখনও ঘুমিয়ে। আজ
বত্রিশ বছরের সংসার জীবনে এমন ঘটনা তো একদিনও ঘটেনি। অরুণিমা দেবী বরাবর খুব ভোরে
ওঠেন,সুধাংশু বাবুর অনেক
আগে। তবে আজ কী হল! স্ত্রী’র গায়ে হাত দিয়েই চমকে ওঠেন সুধাংশুবাবু। বরফের মতো
ঠান্ডা গা,অনেক ধাক্কা দিয়েও ঘুম
ভাঙছে না। ডাক্তার ডেকে আনে রামু।
“ম্যাসিভ স্ট্রোক। ঘুমের মধ্যেই মৃত্যু। আপনার
স্ত্রী বড় বেশি চিন্তা করতেন।" –কথাগুলো সুধাংশুবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন ডক্টর দত্ত।
ছেলেকে ফোন করে খবর দেন সুধাংশুবাবু। কিন্তু
ছেলে জানিয়ে দেয় যে সে ছুটি পাচ্ছে না, কাজেই আসতে অপারগ। স্ত্রী’র মুখাগ্নি নিজেই করেন
সুধাংশুবাবু।
ভেতর ভেতর মারাত্মক ভাবে ভেঙে পড়েছিল মানুষটা।
যে মানুষটা একদিন নিজের সর্বস্ব দিয়ে সবার পাশে ছিল,সে আজ বড় একা। এই শেষ জীবনে
বিশ্বস্ত ভৃত্য রামু ছাড়া কেউই তার পাশে নেই। রক্তের সম্পর্কও এভাবে হারিয়ে যায়!
রামু বড়বাবুর পাশে ছায়ার মতো উপস্থিত থাকে সর্বক্ষণ। মানুষটার মনের জোর আর
একেবারেই নেই। অন্তর্দ্বন্দ্বে জর্জরিত তিনি আজ।
এভাবেই আরও নয় বছর কেটে গেল,ছেলে আর আসে না। মাসে
একবার ফোন করে,এক মিনিটের জন্য কথা
বলে। দিদিভাইটার বয়স আট বছর হল। নাতনিটাকে বড় দেখতে ইচ্ছে করে সুধাংশুবাবুর।
কিন্তু ওরা আনে না,নিজেরাও
আসে না। তবে নিয়ম করে প্রতি মাসে টাকা পাঠায় বাড়িতে।
শরীর আর মন কোনওটাই আর ঠিকঠাক নেই
সুধাংশুবাবুর। বয়সটাও অনেক হল। এবার পৃথিবীর মায়া কাটাতে চান তিনি। রামু আর এই
বাড়িটা ছাড়া আর কোনও পিছুটান তো তাঁর জীবনে অবশিষ্ট নেই। এভাবেই একদিন হার্ট
অ্যাটাক,চিরতরে বিদায় নিলেন
সুধাংশু চ্যাটার্জি। রামু অনেকবার ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে শুভ্রাংশুর সাথে,কিন্তু ফোন সুইচড্ অফ।
বড়বাবুর শেষকৃত্য সম্পন্ন করে এই পুরাতন ভৃত্য রামু।
বড়বাবুর মৃত্যুর দুই সপ্তাহ পর শুভ্রাংশুর
ফোন। রামুর মুখে সব জানতে পেরে পরের দিনই ফ্লাইটে করে দেশে ফেরে শুভ্রাংশু।
প্রোমোটারের সঙ্গে কথা বলে বাড়ি বিক্রির সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে। তারপর রামুকে টাকা
দিয়ে বাড়ি ছাড়তে বলে ফিরে যায় ক্যালিফোর্নিয়াতে।
আজ দশমী,দাদাবাবু ফিরবে। বাড়িটা ছেড়ে
যাওয়ার কথা ভাবতেও পারে না রামু। এই বাড়িটাকে,বিশেষ করে বাড়ির মানুষগুলোকে
চল্লিশ বছর ধরে আঁকড়ে ধরেই তো ওর বেঁচে থাকা। বড়বাবু আর বৌ-ঠাকরুণের স্মৃতি জড়িয়ে
থাকা বাড়িটাকে কিছুদিন পর গুঁড়িয়ে দেবে প্রোমোটারের লোকজন। দাদাবাবুর দেওয়া টাকার
পরিমাণটা অনেক বেশি, কিন্তু
টাকা দিয়ে কী মায়ার বন্ধন ছিন্ন করা যায়? কোথায় যাবে রামু? কী করবে? চারপাশটা বড় বেশি
অন্ধকার লাগে ওর।
“চললাম দাদাবাবু, চিরবিদায়। একটাই আক্ষেপ রয়ে
গেল। নাম-যশ পেলে। কিন্তু তোমার মানুষ হওয়া আর হল না।" টাকার বান্ডিলের নীচে
রামুর লেখা একটা চিরকুট।
বাইরে বিসর্জনের বাদ্যি বাজছে। ছাদ থেকে ঝুপ
করে ভারী কিছু পড়ার শব্দ। চল্লিশ বছরের মায়া কাটিয়ে রামু চিরতরে বাড়ি ছেড়ে বিদায়
নিল।
প্রিয়াঙ্কা ভুঁইয়া: কপিরাইট
লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত
যে কোনো গল্পেই যদি চরিত্রগুলো পাঠকের দৃষ্টিতে তাঁর অন্দরমহলে প্রবেশ করে ,তাহলে লেখার আসল সার্থকতা বজায় থাকে। আর এক্ষেত্রে তোর লেখাটি সেই আসনে বসাতে আমার বিন্দুমাত্র দ্বিধা বোধ হবে না!
উত্তরমুছুনঅনিন্দ্য সুন্দর লিখেছিস ।
সেরার সেরা প্রাপ্তি, স্যার। এই উপহারে আমি আপ্লুত।
মুছুন