খুঁজে পাওয়া বই



গল্প


ঘটনাটার স্থায়িত্ব কয়েক ঘণ্টার ছিল। কিন্তু তার রেশ রেখে গেল আজীবন। আসলে পিসিমণিকে কখনো এমন দুর্বল হতে দেখিনি তো। ঘটনাটা বলা যাক। যখন থেকে জন্মদিন আর উপহারের কার্য-কারণ সম্পর্ক বুঝতে শিখেছি, তখন থেকেই পিসিমণির জন্মদিনে তাকে একটা উপহার দেওয়া নিজেই নিজের কাছে বাধ্যতামূলক করে তুলেছিলাম। সেই অভ্যাস মতোই বই খুঁজতে বেড়িয়েছি। এই উপহারের ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। পিসিমণি বই পড়তে ভালো তো বাসেই, কিন্তু আরো ভালোবাসে পুরোনো বই পড়তে। ওই যে হলুদ হয়ে যাওয়া পাতা, সামনের পাতায় লেখা ছোট্ট দুটো কবিতার লাইন বা আশীর্বাদ সূচক কথা, মাঝের পাতায় রাখা কোনো ভুলে যাওয়া চিঠি, বা শুকনো ফুল। ভীষণ ভীষণ প্রিয় পিসিমণির। তার কথায়, "জানিস রুপু এক একটা পুরোনো বই এক একটা সময়ের, স্মৃতির গল্প বলে। এদের যে কেন বিক্রি করে দেয়?"

সেইজন্য আমি প্রতি জন্মদিনে পিসিমণিকে একটা নতুন বই আর একটা পুরোনো বই উপহার দিই। পিসিমণি সযত্নে তুলে রাখে ঠাকুর্দার পুরোনো সেগুনকাঠের বইয়ের আলমারিতে। ছোটবেলা থেকেই পিসিমণিকে একই রকম দেখে এসেছি। সাদামাটা পোশাক, লম্বা বিনুনি, চোখে সরু ফ্রেমের চশমা আর হাতে কালো ব্যান্ডের ঘড়ি। পিসিমণি একটা সরকারি স্কুলের অংকের শিক্ষিকা। বিয়ে করেননি। কেন করেননি জিজ্ঞাসা করিনি আমরা। প্রত্যেকটি মানুষেরই নিজের, একান্ত নিজের একটা চোরা কুঠুরি থাকে। সেখানে সবাইকে প্রবেশ করতে নেই। গড়িয়াহাটের জনবহুল, মনোগ্রাহী, ঝকমকে দোকানপাটগুলোকে ডানদিকে ফেলে বাঁক নিয়ে একটু এগোলেই দেখতে পাওয়া যায় একফালি কলেজস্ট্রিট। গোলপার্কের অলিগলিতে যেমন রয়েছে বিলাসবহুল রেস্টুরেন্টের খোঁজ তেমনি ফুটপাথের প্রতি বাঁকে রয়েছে অমূল্য বইয়ের সম্ভার। এই জায়গাটা আছে বলেই দক্ষিণ কলকাতার মানুষরা সবসময় কলেজস্ট্রিট ছোটেননা।

বেশ ক'বছরের আসা-যাওয়ায় দু-একটি দোকান বেশ পরিচিত। তাদেরই একটি থেকে একটা নতুন আর একটা পুরোনো কবিতার বই কিনে ব্যাগে ভরে ঢাকুরিয়া লেকের দিকে চললাম। উচ্চমাধ্যমিকের পর এখানকার বিখ্যাত ইনস্টিটিউটে ফ্রেঞ্চ শিখতে এসে প্রায়ই বন্ধুদের সাথে সূর্যাস্ত দেখেছি। এই নতুন ভাষা শিখতে আসাটাও ওই একজন মহিলার অনুপ্রেরণাতেই। আসলে পিসিমণির ওপর আমাদের তিন ভাইবোনের সমস্ত ভার বাবা-কাকা-মা-কাকিমা নিশ্চিন্তে অর্পণ করেছেন আমাদের জন্মের পর থেকেই। তাই আমাদের ভবিষ্যতের যেকোনো সিদ্ধান্তেই পিসিমণির যথেষ্ট অবদান রয়েছে। আমরা তখন না বুঝলেও এখন বুঝি যে এই দায়ভার মানুষটার একাকিত্ব কাটানোর টোটকা হিসেবে কাজে লাগানো হয়েছিল। ভাইদের সংসারে সে যেন নিজেকে ব্রাত্য না মনে করে। বর্তমানে ছোট্ট পরিবারেও চিড় ধরতে থাকা দেওয়াল আর সম্পর্কদের দেখে নিজের পরিবারের প্রতি বেশ গর্ব বোধ করি। আর শ্রদ্ধা করি মা-কাকিমাকে।

দিনটা মঙ্গলবার। সবারই অফিস, স্কুল, কলেজ। তবু কলেজ থেকে ফেরার পথে আমার খুড়তুতো বোন নীতু কেকটা নিয়ে এলো। দাদা নিয়ে এল খাবার। মা বানালো লাউ-চিংড়ি, কাকিমা পায়েস। আজকের দিনটা আমরাই জোর করে পালন করি। একটা অভ্যাসের মতো। যেমন লক্ষীপুজো হয়, যেমন নীলষষ্ঠীর ব্রত, ঠিক তেমনপিসিমণি বরাবরই নিষেধ করেন, আর আমরা বরাবর অপেক্ষা করি তার ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে বাড়ি ফেরার। কাকদ্বীপের একটা প্রাইমারি স্কুলে পিসিমণির পোস্টিং হয়েছে বছর তিনেক হলো। বাড়ি ফিরতে বেজে যায় সাতটা, কখনো আটটা। দরজা ঠেলে বসার ঘরে পা রাখতেই আমরা আলো জ্বালিয়ে তাকে চমকে দিলাম। পঞ্চাশোর্ধ্ব পিসিমণির ক্লান্ত মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। এই হাসি মুখটাই আমাদের ভালোলাগা, আসল পাওয়া। আসলে যে মানুষটা নির্বিবাদী তবু ব্যক্তিত্বময়ী। তাকে যেমন ভালোবাসা যায়, তেমন ভয় পাওয়াও যায়। সে যেমন আপন, তেমন দূরের মানুষ।

রাতের খাবারের পর সকলে মিলে যখন আড্ডা দিচ্ছে বসার ঘরে, আমি ব্যাগ থেকে বের করলাম আমার উপহার। একটা সুনীল গাঙ্গুলির প্রেমের কবিতা আরেকটি একজন নতুন কবির বই। পিসিমণি সাগ্রহে নতুন বইটা নেড়েচেড়ে দেখে, পুরোনো বইতে হাত দিতেই চমকে উঠলো। আমি লক্ষ্য করলাম তার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। কাঁপা কাঁপা হাতে প্রথম পাতাটা খুলতেই কিছু একটা পড়ে সে বইটাকে ছুঁড়ে ফেলল সোফার উপর। আর তারপরেই আমাদের সকলকে অবাক করে দৌঁড়ে চলে গেল নিজের ঘরে।

ঘর ভর্তি সকলে আমার মুখের দিকে চেয়ে আছে। এদিকে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। কি এমন রয়েছে ওই বইতে? খুলে দেখলাম প্রথম পাতায় লেখা,

"তোমার চুলের গন্ধ নিয়ে, বাতাস আসবে আমার জানলায় প্রতি ভোরে। শুধু তুমি মনে রেখো।
                                               জাহাঙ্গীর।১৯৮৮।"

আমার কিংকর্তব্যবিমূঢ় মুখ দেখে বাবা আমার হাত থেকে বইটা নিয়ে পড়লেন। তারও মুখ ফ্যাকাসে। এরপর বইটা একে একে মা,কাকিমা, কাকা, দাদা সকলের হাত ঘুরে আবার এসে পড়ল সোফার ওপর। সকলের চেহারাটাই কেমন পাল্টে গেল। কিছু বুঝতে পারছিলামনা শুধু আমি আর আমার খুড়তুতো বোন। এ বাড়িতে পিসিমণির প্রিয় বান্ধবী আমার মা। পিসিমণির সব রন্ধ্রই যেন মায়ের পরিচিত। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর মা কিছুক্ষন স্তব্ধ হয়ে বসেছিল। তারপর স্বাভাবিক কণ্ঠেই সকলকে খেতে বসতে বলে রান্নাঘরে হাঁটা লাগালো। মায়ের কাছে থেকে এই ব্যবহার আমরা কেউই আশা করিনি। দাদা বাদে আমি আর নিতু ঘাড় নেড়ে বললাম, "না, যার জন্মদিন সে খেলো না আর আমরা চেটেপুটে খাবো? কি বলছো তুমি মা?" মা একইরকম ভাবে বলল, "ঋতু আর আসবে না হয়তো। তোরা খেয়ে নে তারপর দেখছি খাওয়ানো যায় কিনা।" আমি বিচলিত হয়ে বললাম, "কিন্তু কি এমন ছিল বইটাতে যে পিসিমণি এভাবে চলে গেল।" এবার বাবা ধমকের সুরে বললেন, "মা যা বলছেন তাই করো রুপু। তর্ক কোরোনা।" অগত্যা বাধ্য মেয়ের মতো খাবার টেবিলে বসলাম। কিন্তু মুখটা বিস্বাদ লাগছিল। হঠাৎ মনে হলো, মা সব জানে। সুতরাং রাতের বেলা মাকে চেপে ধরতে হবে।

রাত বারোটা। পিসিমণি ঘর থেকে বেরোয়নি। আমরা ছোটরা খেয়ে নিলেও, বড়রা খায়নি। তারা কোনো এক বিষয় নিয়ে গভীর আলোচনা করছে। সেখানে আমাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। দাদা বাধ্য ছেলের মতো নিজের ঘরে গিয়ে দরজা দিয়েছে। আমার মনে হলো দাদাও অনেক কিছু জানে। কিন্তু আমাদের সামনে মুখ খুলছে না। নানান অছিলায় বসার ঘরের এদিক ওদিক ঘুরে বেরিয়ে কথা শোনার চেষ্টা করছি আমি আর নিতু। কিন্তু ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারছি না কিছুই। জানলার গা ঘেঁষে সবে দুজনে একটা সুবিধাজনক পজিসন নিয়ে দাঁড়িয়েছি এমন সময় মনে হলো আমাদের পিছনে যেন কেউ দাঁড়িয়ে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম মা। আমাদের দিকে কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে, আমাদের দুজনের হাত ধরে নিয়ে এলো বসার ঘরে। সকলে আমাদের দিকে গুরুগম্ভীর চোখে তাকিয়ে। কাকু এখুনি বকা দিল বকে। কিন্তু আজ হয়তো সব কিছুই অন্যরকম হওয়ার ছিল। মা আমাদের ও  ঘরে উপস্থিত সবাইকে অবাক করে দিয়ে বলল, "ওরা বড় হয়েছে। ওদের মনে কোনো প্রকার অন্ধকার থাকা উচিৎ নয়। ওদের সব কিছু বলে দাও।" বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, "আমাদের সকলের থেকে তুমি বেশি জানো। তুমিই বলো।"  আমরা দুজন কোণের একটি সোফায় বসলাম। মা বলতে শুরু করলেন।

তখন আমরা সবে কলেজে ঢুকেছি। স্কুলের গন্ডী পেরিয়ে সকলেরই একটু আধটু ডানা গজায়। আমাদেরও অন্যথা হয়নি। ঋতু মানে তোদের পিসিমণির সাথে আমার বন্ধুত্ব এই কলেজে এসেই। আশুতোষ কলেজ। ১৯৮১।মাএর চোখ যেন কোন সুদূরে হারিয়ে গেল। যেন মা সেই সময়টাতে বসেই কথাগুলো উচ্চারণ করছে। তবে ঋতু আমাদের মতো ফাঁকিবাজ ছিল না। বুঝতেই পারছিস। বেশ সিরিয়াস, পড়ুয়া, মিতভাষী। আমি ছিলাম উল্টো। তবু আমাদের বন্ধুত্বটা হলো। এভাবেই দিনগুলো কাটছিল। হয়তো এভাবেই কাটতো যদি না জাহাঙ্গীর নামের ঝড়টা আসতো। হ্যাঁ ঝড়ই বটে। ঝড়ের মতো চলতো ওর কথা, ওর মন, ওর সিদ্ধান্ত। সেকেন্ড ইয়ারের প্রথমেই এসে ভর্তি হলো। ওর বাবা মারা যাওয়ার পর ওর মামা ওকে আর ওর মাকে মুর্শিদাবাদ থেকে নিয়ে আসেন কলকাতায়। ক্লাসের সকলের সঙ্গেই ওর বেশ সখ্যতা হয়ে গেল। করিডোর থেকে ক্যান্টিন সব জায়গায় জাহাঙ্গীর বেশ ফেমাস। শুধু একজনই তাকে পাত্তা দিত না। ঋতু মৈত্র। তাতে অবশ্য ওপর পক্ষের কোনো হেলদোল নেই। কে তাকে পাত্তা দিল, কে দিল না, তাতে জাহাঙ্গীর আহমেদের কিস্যু যায় আসতো না। দুটো ভিন্ন মেরুর দুজন মানুষ। একজন নিজের ভবিষ্যতের সমস্ত প্লানিং করে তার মূল লক্ষ্য আই. এস পরীক্ষাকে পাখির চোখ করে এগোচ্ছে। আরেকজন সম্পূর্ণ বোহেমিয়ান। কোথায় যাবে, কি করবে, কি পড়বে কিছুই ঠিক নেই।

আমি মাকে বাধা দিয়ে বললাম, "তাহলে ওদের পরিচয় হলো কিভাবে?" মা হেসে বললেন, "সেটাই তো গল্প। জাহাঙ্গীরের সাথে আমারও বন্ধুত্ব ছিল। পরীক্ষা চলে এলো। আমরা মধ্য মেধার ছেলে মেয়েরা আমাদের মধ্য মানের পড়াশুনা নিয়ে প্রস্তুত। ঋতুর পিছনের সিটেই বসেছে জাহাঙ্গীর। পরীক্ষা শুরু হওয়ার একঘন্টা পর থেকেই শুরু হলো বিপত্তি। জাহাঙ্গীর শুরু করলো উত্তরের খোঁজ। ৪নং প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে পাশের একজন, ৬নং বড় প্রশ্নের থিম বলছে আরেকজন। শেষে ঋতুকে ধরলো। সে এসব খুবই অপছন্দ করে। কটমট করে পিছন ঘুরে তাকালো জাহাঙ্গীরের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে ইনভিজিলিটরের চোখ পড়ল ওদের দুজনের ওপর। তিনি এসেই বকাঝকা শুরু করলেন ওদের দুজনকে। ঋতুর চোখ মুখ লাল হওয়ার উঠল অপমানে। সে একবার চেষ্টা করল স্যারকে বোঝাবার যে সে চিটিং করছিল না। কিন্তু চেষ্টা বৃথা, কড়া পরীক্ষক। অগত্যা, দুজনেরই খাতা ক্যানসেল। আমরা এই ঘটনা ঘটবে ভাবতেই পারিনি। খাতা ক্যানসেল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঋতু ক্লাস ছেড়ে বেরিয়ে গেল। ওর মুখে অপমানিত হওয়ার ছাপ স্পষ্ট। আমি এবার একটু রাগান্বিত হয়েই জাহাঙ্গীরের প্রতি বললাম, "জাহাঙ্গীর তুই তো জানিস আসল ঘটনাটা। কেন পরিষ্কার করে বলি না স্যারকে? তুই সারা বছর পড়াশুনা করিসনি। তার জন্য আরেকটা মেয়ে কেন suffer করবে বলতো?" জাহাঙ্গীর এবার লজ্জা পেল। সে নিজের দোষ স্বীকার করে ঋতুর খাতা আবার ফিরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করলো। ঘটনাটা প্রিন্সিপাল ম্যাম এর অফিস অবধি গড়াল। আর সেই প্রথম আমরা বাবা মানে তোদের ঠাকুর্দাকে দেখলাম। তিনি ছিলেন প্রভাবশালী ব্যারিস্টার। মেয়ের ওপর এমন অপবাদ লাগায় তিনি ভীষণ বিরক্ত ও অবাক। স্যার এসে সমস্ত ঘটনা বললেন এবং এটাও বললেন যে ঋতু আবার ওই পেপারে পরীক্ষা দিতে পারবে। সমস্যার সমাধান হলেও ছাড় পেলনা জাহাঙ্গীর। তাকে কলেজের বাইরে পেয়ে অপমানসহ বেশ ধমক ধামক দিলেন বাবা। জাহাঙ্গীর নিজের দোষ স্বীকার করে ক্ষমা চাইলেও তাঁর মন গলল না।
 
কথায় বলে না, আমরা ভাবি এক আর নিয়তি ভাবেন আরেক। এই ভুল বোঝাবুঝির ঘটনাটাই ওই দুটি মেরুকে এক করে দিল। টেস্টের পর এডমিট কার্ড নিতে এসে ওদের প্রথম কথা হয়। এরপর থার্ড ইয়ার থেকে বন্ধুত্ব গাঢ় হয়ে ওঠে। বোহেমিয়ান জাহাঙ্গীর হিসেবি ঋতুর সংস্পর্শে এসে পাল্টে যেতে থাকে। তার চিন্তা-ভাবনা, কাজ, কথা সব কিছুতেই ঋতুর মননের ছাপ স্পষ্ট। আরেকদিকে সেই গম্ভীর মেয়েটা, যে আমার কাছেই শুধু নিজের মনের কথাগুলো মেলে ধরতো সেও ধীরে ধীরে মিশতে শুরু করলো বাইরের জগতের সাথে। ওদের বন্ধুত্ব যে কখন প্রেমে রূপান্তরিত হলো তা হয়তো ওরা নিজেরাই জানতে পারতো না, যদি না জাহাঙ্গীরের হাতে এসে পৌঁছতো ওর চাকরি পাওয়ার চিঠি। ওর মামা কোনো এক পদস্থ কর্মচারীকে হাতে পায়ে ধরে জাহাজের চাকরিতে জায়গা করিয়ে দেন জাহাঙ্গীরের। গ্রাজুয়েশন হলেই চাকরি, বেশ ভালো মাইনে। আর কি চাই ছেলেটার! কিন্তু আসলে ছেলেটা হয়তো তাই চাইত না। তার আকাঙ্খা হয়তো ছিল আরো বড়। তাই ফ্যাকাসে মুখে যখন সে খবরটা দিল বন্ধু মহলে তখন আরো ভীষণ ফ্যাকাসে হয়ে উঠেছিল আরেকজনের মুখ। অনেকেই জাহাঙ্গীরকে এই সুযোগ হেলায় হারাতে নিষেধ করলো। এরকম সুযোগ নাকি মেলে না। কিন্তু জাহাঙ্গীরের চোখ ছিল একটা মুখের ওপরেই নিবিষ্ট। ও যেন চাইছিল সেই মুখটা একবার মাথা নেড়ে বলুক, না যাস না। থেকে যা।"

তবে ঋতুর মুখ থেকে সে কথা না বেরোলেও একদিন নিভৃতে সে জাহাঙ্গীরকে ডাকে কলেজের কাছের এক পার্কে। তোরা হয়তো ভাবছিস আমি এতো কিছু কি করে জানলাম। আমি সবটাই জানি। ঋতুর মনের সমস্ত কোণ, ওর জীবনের সব মুহূর্ত আমার জানা। ওদের সেদিনের কথাগুলো হয়তো পুঙ্খানুপুঙ্খ বলতে পারবো না তবে খুব সাদামাটা ভাবেই নিজেদের মনের কথা ব্যক্ত করেছিল ওরা। আসলে চোখের ভাষাতেই ওদের সব কথা বলা হয়ে গেছিল অনেক আগেই। সেগুলো শুধুই শব্দ হয়ে উঠলো সেদিন। কিন্তু সেদিন আরো একটা চুক্তি হয়েছিল ওদের মধ্যে। সেটা ছিল নিজের পায়ে দাঁড়ানোর শপথ নেওয়ার। দুজনে শপথ নিল যে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পরই ওরা বাড়িতে জানাবে নিজেদের সম্পর্কের কথা। সেইমতো জাহাঙ্গীর চলে গেল জাহাজের কাজে আর ঋতু তৈরি হতে শুরু করলো ওর লক্ষ্যমাত্রার জন্য।

এর মধ্যে এই বাড়ীতে আসা যাওয়ার সুবাদে মাএর মানে তোদের ঠাকুমার আমাকে পছন্দ হয়। তোর বাবার সাথে বিয়ের সম্বন্ধ ঠিক হয়। দুপক্ষের কারুরই অমত ছিল না। বিয়ের নিমন্ত্রণ পাঠানো হলো সব বন্ধুদের জাহাঙ্গিরকেও। ছমাস পর বিয়ে। নির্ধারিত দিনে জাহাঙ্গীর সহ সব বন্ধুরা এলো। বৌভাতের দিন বাজটা পড়লো ওদের দুজনের জীবনে। বাবা ঋতুর সাথে ওঁর বন্ধুর ছেলের সাথে বিয়ের কথা ঘোষণা করলেন। অন্ধকার নেমে এলো আমাদের সকলের মুখে।

ঋতু ভীষণ বাধ্য ছিল, মিতভাষী ছিল, কিন্তু স্বাধীনচেতা ব্যাপারটা ওর বাবা-ই ওর মধ্যে সঞ্চার করেছিলেন। সেই মনোভাবটাই বাবা-মেয়ের সম্পর্কে চিড় ধরালো। ওর বাবা ওর বন্ধু ছিলেন, ফিলোসফর, গাইড ছিলেন কিন্তু তার ভগবান হতে চাওয়াটা ঋতু মানতে পারলো না। তাই আমাদের বিয়ে মেটার কিছুদিন পরেই নিজেই জাহাঙ্গীরের হাত ধরে সামনে এসে দাঁড়ালো বাবার। বাবা দুঁদে ব্যারিস্টার। মেয়ের ইঙ্গিত বুঝতে বিন্দুমাত্র সময় নিলেন না। আমরা সেদিন কেউই বাড়িতে ছিলাম না। বাড়ি ফিরে শুনলাম জাহাঙ্গীরকে চরম অপমান করে বাড়ী থেকে বের করে দিয়েছেন বাবা। একে আর্থিক পার্থক্য, তার ওপর সেই কলেজের ঘটনা। বাবার চোখের বালি হয়ে গেছিল জাহাঙ্গীর। ঋতুর কাছে শুনেছিলাম জাহাঙ্গীর ওকে প্রস্তাব দেয় ওর সাথে এক কাপড়ে বেরিয়ে আসার। ঋতু রাজি না হয়ে আরো কিছুদিনের সময় চেয়ে নিয়েছিল পরিস্থিতি সামলানোর জন্য। কিন্তু অপমানিত জাহাঙ্গীর আর এক মুহূর্তও থাকতে চায়নি এ বাড়িতে। ঋতুর সব অনুরোধ অগ্রাহ্য করে চলে গেছিল। তারপর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি ওর। ওর বাড়িতে খোঁজ করলেও তারা বলতে চাননি। তারপর থেকে কি এক প্রতিহিংসা চেপে বসে ঋতুর মাথায়। কোনো দিনও বিয়ে না করার পণ নিয়ে বসে সে। বাবার মতো একজন জাঁদরেল মানুষও হেরে যান ওর জেদের কাছে। বাবার জেড, অহংকার, জাহাঙ্গীরের অবহেলা, ছেলেমানুষী মেয়েটাকে পাল্টে দিলো। বাড়ির সকলের কথা অবজ্ঞা করে ও একাকীত্বের জীবনটাই বেছে নিল।

এই পর্যন্ত বলে মা থামলো। আমাদের সকলের মুখ থমথমে। আমি বইটা হাতে নিয়ে একদৃষ্টে দেখছিলাম। এটা হয়তো পিসিমণির সেই প্রিয় মানুষটির দেওয়া উপহার যেটা দাদুভাই অন্যান্য পুরোনো, অদরকারি জিনিসপত্রের সাথে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। আজ আবার ফিরে এলো আমার হাত ঘুরে। কতটা অভিমান মনে জমলে একটা মানুষ তার স্বপ্নের ভবিষ্যৎ এর মিনার ভেঙে একটা সাধারণ চাকরিতে ঢুকতে চায়। দাদুভাইয়ের ওপর এটা কি অভিমানের বশে নাকি তাঁকে শাস্তি দেওয়ার জন্য? হয়তো তাই। হয়তো তাঁর দেখানো ভবিষ্যতের স্বপ্ন পিসিমণি অগ্রাহ্য করে তাঁকে আঘাত করতে চেয়েছিল। যাই ঘটে থাকুক সে সব অনুমান করে সিদ্ধান্ত নেওয়াটা আমাদের কাছে অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়ার সমান। সেই ঢিল জায়গা মতো লাগলো কি না লাগলো তা পরিষ্কার করে বলে দেওয়ার মানুষটা কিছুতেই মুখ খুলবে না।

পিসিমণির ঘর থেকে এসরাজের সুর ভেসে এলো। "চিরসখা হে.."। আমাদের বুকের ভেতর থেকে একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস। সকাল সাড়ে সাতটা। ধড়মড়িয়ে উঠলাম। পিসিমণি নিশ্চই বেরিয়ে গেছেন। চেতলা থেকে কাকদ্বীপ, অমানুষিক দূরত্ব। তবু পিসিমণির ঘরে গেলাম। ঘর ফাঁকা। ফিরে আসতে যাবো এমন সময় থমকে গেলাম। পিসিমণির টেবিলে একটা কাগজ পরে। এগিয়ে গিয়ে দেখলাম একটা চিঠি। মনে মনে হেসে ফেললাম। পিসিমণি এই ফেসবুক whatsapp এর যুগে বড্ড খাপছাড়া। আজও একটা স্মার্টফোন হাতে ধরাতে পারলাম না, মেসেজ করা শেখানো তো দূরের কথা। যদিও তাঁর মতো ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রীর এসব শেখা জলভাত। থাক যে যেমন থাকতে চায় থাক। চিঠিটা আমাকে উদ্দেশ্য করেই লেখা।

প্রিয় রুপু,
    কাল রাতের ব্যবহারে খুব খারাপ লেগেছে না তোর? তোর মায়ের কাছে তো সবই শুনলি, কি করি বলতো, আমিও তো মানুষ। সবসময় দুর্বলতা গুলো লুকিয়ে রাখতে পারি না। যাইহোক, বলা হয়নি, উপহারটা খুব পছন্দ হয়েছে আমার। তোদের ভালোবাসাতেই তো বেঁচে আছি এতো বছর। তুই এ বছর খুব দামী উপহার দিলি আমায় জানিস তো। একটা পুরোনো দিনের সঙ্গী ফিরিয়ে দিলি। জাহাঙ্গীর অভিমান করে চলে গেছিল। ওর কাছে ওর আত্মাভিমান বড় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ভালোই হয়েছে এভাবে হয়তো আমাদের সংসার করাই হতো না। আমিও এদিকে বাবার দম্ভ ভাঙার খেলায় বহুদূর এগিয়ে গেলাম। এতদূর যে সম্পর্কগুলো কেমন ছন্নছাড়া হয়ে গেল। তুই পুরোনো স্মৃতি আবার ফিরিয়ে দিলি। আমার যৌবন ফিরিয়ে দিলি। অনেক ধন্যবাদ আর ভালোবাসা তোকে। জাহাঙ্গীর সশরীরে না হোক আমার মননে প্রেমের কবিতা হয়েই থাক।

                                                                                      ভালোবাসা,
                                                                                       পিসিমণি।

এক ফোঁটা জল টুপ করে ঝরে পড়লো চিঠিটার ওপর।

কেয়া চ্যাটার্জী: কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত



1 টি মন্তব্য:

  1. অনেক ধন্যবাদ কবিতা উৎসব ও সম্পাদক মহাশয়কে। শুভ বিজয়ার প্রীতি ও শুভেচ্ছা।

    উত্তরমুছুন