সোনা রঙের মানুষ




গল্প


এক

একা দাঁড়ানো বাড়িটার চেহারায় কেমন একটা বিষণ্ণ ভাব আশপাশের ল্যান্ডস্কেপ রুক্ষ শেষ বিকেলের আলোয় ঠিক কি কারণে এরম মনে হচ্ছে, বুঝতে পারলো না সুমিত এখানেই ছোড়দাদু থাকতেন। সুমিতের জন্য অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার একটা ঘর খুলে দিয়েছে ধীরেন। এখানে সেই বরাবর দেখাশোনা করতো দাদুর। ট্রেন লেট হয়ে সুমিতের আসতে দুপুর গড়িয়ে গেল কাজলকে মিস করতে লাগলো সুমিত, টিমে ওই আর্ট ডিরেক্টার সে থাকলে হিস্ট্রি জিওগ্রাফি বা মনস্তত্ব ঘেঁটে এইসব বিষণ্ণতা নিয়ে কিছু একটা সমাধান দিতো জায়গাটা কেমন যেন অস্বস্তিকর, আকাশ বাতাসের রং লালচে  অধুনা ঝাড়খন্ডের সিংভূম ডিস্ট্রিক্ট বসতি যা আছে তা মূলত মাইনে কাজ করা লোকজনদের তাই সবার জীবনযাত্রাও মাইনের টাইমিং অনুযায়ী চলে সন্ধের পর থেকে সব একদম কানা সোনার খনি হলেও জায়গাটায় বিশেষ সম্বৃদ্ধির চিহ্ন নেই

সুমিতের অবশ্য এরম জায়গায় থাকার অভ্যেস আছে তার ছুটোছুটির চাকরির সুবাদে খাওয়া শোওয়ার ব্যাপারে কোনও বাদবিচার নেই তবে মিনিমামটুকু এখন ব্যবস্থা হবে কিনা বুঝতে পারছে না সুমিত কারণ ওর প্রোডাকসান ম্যানেজার কল্যাণ সঙ্গে নেই এখানে এসে এতো কিছু নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন হতো না অন্য সববারের মতো এই ট্যুরটা অফিসিয়াল নয় বলেই ভাবান্তর আসছে বলে সুমিতের মনে হল। অবাস্তব একটা মরীচিকার পেছনে ছুটে এসেছে বলেই মনে হবে যে কারোর সামান্য একটা ডায়েরি আর কিছু পুরনো চিঠি  এবং শুধুমাত্র অনুমানের ওপর ভর করে অন্য কেউ পথে বেরোতো না কিন্তু সুমিত ছেলেটা একটু বেয়াড়া প্রকৃতির তবে এবার টিমের অন্য কাউকে না খবর দিয়ে চলে আসাটা খানিকটা অস্বাভাবিক বিশেষত যখন একটা রহস্য বা গোলমালের গন্ধ আছে! অথবা ওর কপালটাই এরযেখানে যায় সেখানেই যেন কী একটা গোলমাল পেকে ওঠে

সুমিত একটু বাউন্ডুলে টাইপের বাড়িতে মন টেঁকে না ওর দুচার দিন কলকাতায় থাকলেই হাঁফিয়ে ওঠে বন্ধুরা বলে, ঘরে বউ না থাকলে এই হয়... উড়ে উড়ে বেড়ানো কিন্তু সুমিত এই জীবনটাকে বেশ এনজয় করে। টাক পড়া ভুঁড়িওলা সরকারি চাকরি করা, বাজার করা আর সন্ধেয় বাড়ি ফিরে চা মুড়ি খাওয়া লোকজনদের জীবনযাপন প্রচণ্ড ঘেন্না করে সুমিত এদের সম্পর্কে খানিকটা তাচ্ছিল্যভাব আছে ওর – ‘কেউ কিছুই বোঝে নাকেউ জানেই না ও কিভাবে প্যাসেঞ্জার ট্রেন ধরে বা টিটিকে ম্যানেজ করে ভোররাতে বাড়ি ফেরে, কখনও জায়গা না পেয়ে বাসের মাথায় শীতের রাতে হু হু হাওয়ার মধ্যে নট নড়নচড়ন হয়ে বসে থাকতে বাধ্য হয়। তবু এই সময়গুলোতে ওর তেমন অভাববোধ হয় না, সবসময়েই দেখে বেশ কিছু লোক ওর মতো অবস্থাতেই আছে তারাও ওর মতো নিশ্চিত নয় প্ল্যাটফর্মে রাত কাটাতে হবে নাকি ঘরে ফিরতে পারবে রাতের দুনিয়ার সম্ভবত কোনও কুহক মায়া আছে গভীর নেশার মতো তাতে সবাই বিভোর হয়ে থাকে একবার টাটায় গিয়ে সে মায়া সুমিত সম্যক বুঝেছিল সেবার বাধ্য হয়ে স্টেশন থেকে দূরে একটা ছোট হোটেলে রাত কাটাতে হয়েছিল হোটেলটার একটা ফ্লোরে ও একা থাকার জন্যই বোধহয় প্রথম থেকেই একটু অস্বস্তি হচ্ছিল রাত বাড়ার সাথে নিঝুম হয়ে যাওয়া চারপাশে আশ্চর্যভাবে জেগে উঠলো হাঁটাচলার শব্দ, খেয়াল করে সুমিত বুঝল শব্দটা ওর আশপাশেই কোথাও আছে বিরক্ত সুমিত আলো জ্বেলে দেখলো ওর জুতোটা চলার মতো ভঙ্গিতে ঘরের মাঝমধ্যিখানে পড়ে আছে ভয়টয় নয়, ওর মনে হয়েছিল দিনরাত এত হাঁটাহাঁটি, সে অভ্যেসেই হয়তো জুতোটা একা একা খানিকটা হেঁটে ফেলেছে অন্য কেউ হলে যেখানে ভয়ে মরতো, ও নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েছিল তারপর যদিও কল্যাণ মানতে চায় না এসব কথা বলে, সন্ধে হলেই দারু নিয়ে বসে পড়লে খোয়াব তো দেখতেই হবে সেটা অবশ্য ভুল নয় খোয়াব দেখাটা সুমিতের স্বভাব বটে তবে দারুতে ওর নেশা হয় না, নার্ভগুলো বেয়াড়া প্রকৃতির বলেই সবসময় সজাগ থাকে ওর অধিকাংশ খোয়াবের সাক্ষ্মী থাকে একজনই দীপঙ্কর সে হল চিফ আসিটেন্ট ... যদিও সব ব্যাপারে সুমিতকে সমর্থন করার কারণেই তার সাক্ষ্যের কোনও মূল্য দেয় না বাকীরা 

দুই

কিছুদিন আগে হঠাৎ এসেছিল লোকটা গ্রাম্য চেহারার এই লোকটা যে ডায়েরিতে লেখা ঠিকানা দেখে ওদের বাড়ি খুঁজে বের করেছে সেটাই বেশ আশ্চর্যের বিষয় লোকটার নাম ধীরেন সে যদিও সুমিতের বাবার নাম ধরেই ডাকছিল কারণ তিন বছর আগে বাবার মৃত্যুর খবর তার কাছে পৌঁছয়নিতার থেকে আশ্চর্যের ব্যাপার যেটা, লোকটা ছোড়দাদুর শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী তার মারা যাওয়ার প্রায় পাঁচ বছর পরে তার টুকিটাকি জিনিসপত্র ওদের কাছে পৌছে দিতে এসেছে। সাথে ওখানকার বাড়ির দলিল এবং কিছু ব্যাঙ্কের কাগজপত্রও আছে তাতে মায়ের সাথে সুমিতের নামও আছে উত্তরাধিকার হিসেব সম্পর্কে মায়ের কাকা এই ভদ্রলোক সারা জীবনে দশ বারো জায়গায় কাজ করেছেন তখনকার দিনে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করা লোকের চাকরির অভাব ছিল না বোধহয়  বিয়ে থা করেননি, ঘরের টান ছিল না বলেই বোধহয় এক জায়গায় বেশী দিন থাকতেন না

ছোটবেলার কথা সুমিতের মনে পড়ে উনি মাঝেমধ্যে বাড়িতে আসলেও দুএকদিনের বেশী থাকতেন না এটাও মনে আছে অদ্ভুত ধরণের জিনিসপত্র গিফট আনতেন উনি। পাথরের পাত্র থেকে হাতির দাঁতের খেলনা কিংবা মায়ের জন্য অদ্ভুত দেখতে গয়না কেমন যেন পুরনো দেখতে হতো, যদিও সেগুলোর সাথে বেশ খানিকটা ইতিহাস বা গল্প জুড়ে থাকতো জিনিসগুলো যতই মূল্যবান হোক না কেন, বালকবুদ্ধিতে সুমিতের কাছে খুব আকর্ষণীয় মনে হতো না জিনিসগুলো। ছোড়দাদুর চরিত্রের সাথে ব্যাপারটা মানানসই ছিল বলেই এখন মনে হচ্ছে সুমিতের

উনি নমাসে ছমাসে চিঠি লিখতেন অবশ্য তাতে নানারকম অ্যাডভেঞ্চারের কথা থাকলেও বাবা বিশেষ গুরুত্ব দিতেন বলে মনে হয় না বরং মা সেগুলোর সাথে আরও কিছু গল্প মিশিয়ে সুমিতকে খাওয়ানোর সময়  বলতো। সেসবের দিন ফুরিয়ে যাওয়ার পর ওইসব বিষয়ে কথাবার্তা বন্ধ হয়ে গেছিল স্বাভাবিকভাবে যদিও পরবর্তীতে মা বলতো, ছোটকাকার মতোই নাকি হয়েছে সুমিত সেই একই রকম ডানপিটে, ঘর ছেড়ে পালানো স্বভাবইঞ্জিনিয়ারিং, এমনকি কিভাবে যেন সুমিতের এখনকার চেহারার সাথে ওনার যৌবনের ছবির বেশ সাদৃশ্য আছে যদিও কথাগুলো সুমিত খুব একটা গুরুত্ব দিত না

দাদু যখন মারা যায়, তার আগেও এসেছিলেন ওদের বাড়ি সুমিত তখন সদ্য ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে শুরু করেছে। ইন্সট্রুমেন্ট নিয়ে পড়লেও দাদু কথাবার্তায় বুঝেছিলেন তাদের মেকানিক্যালের অনেক জিনিসপত্র জানতে হয়, শুনে উনি বেশ খুশি হয়েওছিলেন

তবে একটা কথা ধীরেনের আসার পর মনে হয়েছিল সুমিতের এই সব কাগজপত্র এবং সেই আশ্চর্য জিনিসের খবর তাকে উদ্দেশ্য করেই লেখা কারণ ছোড়দাদু যথেষ্ট বুদ্ধিমান লোক ছিলেন তিনি এটুকু বুঝতেন বাবার এসব ব্যাপারে কোনও উৎসাহ নেই, তিনি শিক্ষকতার পেশা এবং কাগজ কলম নিয়েই মেতে আছেন আর এখন ওনার যা বয়স দাঁড়াতো তার পক্ষে কোথাও গিয়ে কিছু খুঁজে বের করাও সম্ভবপর ছিল না এই কথাটা মনে হওয়ার পর থেকেই সুমিত ছটফট করতে শুরু করেছিল এখানে আসার জন্য অন্তত চোখের দেখা তো হবে। আর আইন মোতাবেক সেই যখন উত্তরাধিকারী

কিন্তু প্রতি চিঠিতে মানুষটা যে কোনও একটা অদ্ভুত জিনিসের কথা বলতে চেয়েছেন এবং বিশেষ কোনও কারণে পরিষ্কার বলে উঠতে পারেননি সেই কথা মাথায় রেখেই সুমিত আশ্চর্য জিনিসের অনুসন্ধান চালাতে চাইছে। ব্যাপারটা যে সঠিক কী সেটা কারোর জানা বা বোঝার কথা নয় অবশ্য। তবু সুমিত বিশ্বাস করছে কিছু একটা থাকবেই, নয়তো একটা বিচক্ষণ লোক বারবার সেই কথা বলতো না যদিও এই অঞ্চলে বলবার মতো কিছুই নেই!

পড়াশোনা শেষ করে কবছর চাকরি হয়ে গেছে সুমিতের ইস্ট জোনের বিভিন্ন ফ্যাক্টারিতে ওদের কোম্পানির বসানো ইন্সট্রুমেন্ট মেন্টেনেন্সের দায়িত্ব ওর অতিরিক্ত হিসেবে নর্থ ইস্টের কিছু জায়গা।গিটারটা পাশের পাড়ার একটা ছেলেকে দিয়ে দিয়েছিল আগেই। সাইকেলটাও স্ক্র্যাপ হয়ে গেছে সুমিতের শখ বলতে টিকে ছিল বিভিন্ন দেশের ফিল্ম দেখা - ডাউনলোড করে কিংবা সিডি কিনে। নিজেকে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন গল্পের চরিত্র হিসেবে কল্পনা করতো  সুমিত সে কারণেই তাদের পাড়ার চারজন বন্ধুর গ্রুপটাকে সুমিত ফিল্মি কায়দায় ভাবতো ও ডিরেক্টার, চিফ অ্যাসিট্যান্ট দীপঙ্কর, আর্ট ডিরেক্টার কাজল আর সবথেকে কাজের প্রোডাকশান ম্যানেজার কল্যাণ।

ওদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপটায় এখানকার কথা যথাসম্ভব ডিটেলস লিখে সবাইকে আজ রাতের বা কাল ভোরের ট্রেন ধরে পৌঁছতে বলে দিল সুমিত লাস্টে লিখে দিল যাবতীয় অজুহাত যেন বর্জন করা হয়।

তিন

দুপুরের দিকে বিরক্ত মুখে কল্যাণ এসে গেল এসে খানিকটা অবজ্ঞার সুরে বলল, তাহলে আশ্চর্য জিনিসটা কি? ইউনিকর্ন নাকি উড়ন্ত চাক্তি! বিকেলে দীপঙ্কর এলো, এসে বলে বসলো তুমি যখন বলছ ... কিছু একটা নিশ্চয় আছে! শুনে কল্যাণ যথারীতি মুখ ভ্যাংচালো কাজল সন্ধেয় এসে ক্লান্তিতে শুয়ে পড়লবলল, জায়গাটাকে ছকে ফেলতে হবে বিশেষত হিস্ট্রোরিক্যাল ব্যাকগ্রাউন্ড রাতে ধীরেনের হাতের ঝাল দিশি মুরগী আর কল্যাণের জোগাড় করে আনা কান্ট্রির জন্য জায়গাটাকে আর ততটা খারাপ লাগছিল না সুমিতের। বেশ একটা আউটিংয়ের মতো ব্যাপার একটু জিরিয়ে উঠে কাজল তার ব্যাকগ্রাউন্ড খোঁজার কাজ শুরু করে দিল ধীরেনের ইন্টারভিউয়ের মাধ্যমে লোকটা নেহাত বোকা টাইপের হলেও কথাবার্তা বলতে পারে ভালই। ধীরেন বলল, ওর বাবু এখানকার লোকজনকে খুব ভালোবাসতেন... মাইনের কুলিদের খাওয়াতেন দাওয়াতেন কিন্তু সে দলটা অবশ্য খানিকটা গোঁয়ার প্রকৃতির, সাঁওতালদের মতো নয়... দেখতেও চকচকে ফরসা এরা নিজেদের মহল্লায় আলাদা থাকে, কারো সাথে মেলামেশা করে না লোকে বলে, ওদের আদি লোকটাকেই নাকি সোনার দেবতা খনির পথ চিনিয়েছিলেন। সেজন্যই কিনা কে জানে, এই দলটাই সোনার খনির একদম ভেতরে নামে অন্য কেউ সেটা পারে না

ধীরেন একটু থেমে বলল, বারবার বলা সত্ত্বেও ওরা বাবুকে নিজেদের মহল্লায় নিয়ে যেতে চাইতো না

দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলো, মহল্লাটা কোথায়? এখানে তো তেমন কিছু চোখে পড়েনি ধীরেন বলল, ওই পাহাড়ের পেছনে... তাদের ওখানে কি যেন রাগী দেবতা আছে, তাই বাইরের লোককে ঢুকতে দিতে চায় না

তারপর একটু থেমে ধীরেন বলল, কিন্তু বাবু যেতো ... একা একা, গভীর রাতে লুকিয়ে ধীরেন ওদিকটার আকাশে ভুতুড়ে আলোর ছটা দেখেছিল দুএকবার  

কাজল জিজ্ঞেস করলো, এসে কি কিছু বলতেন তোমার বাবু?

ধীরেন বলল, কখন ফিরতেন তাতো জানি না ... সকালে কিছু বলতেন না শুধু যেদিন মারা গেলেন... সেদিন মাঝরাতে আমাকে ডেকেছিলেন ওনার বুকের কষ্ট হচ্ছিল

এতটা শুনে সবাই চুপ করে সেই রাতের কথা ভেবেছিল তাহলে কি ওনার মৃত্যুটা ঠিক স্বাভাবিক ছিল না

সুমিত এতক্ষন কিছু বলেনি, এবার বলল না এসব পাঁচ বছরের পুরনো কাসুন্দি ... আসল ব্যাপারটা জানতে ফিল্ডে যেতে হবে। দীপঙ্কর একটুতেই ধেইধেই করে ওঠে দেখে কল্যাণ বলল, এতো তাড়াহুড়ো করার কিছু নেই, আগে ওই মহল্লার আশপাশে ঘুরে খবর নিতে হবে... ওদের ওখানে ঢুকতে বাঁধাটা এক্সাটলি কির

মাঝরাতে কাজল সবার ঘুম ভাঙালো, বেশ খানিকটা উত্তেজিত মুখ নেট সার্চ করতে গিয়ে আশ্চর্য একটা গল্প চোখে পড়েছে ওর পার্সোনাল  ব্লগগুলোতে যেমন নানারকম গালগল্প পাওয়া যায় বক্তব্য যেটা, এখানকার কুলিরা সোনার দেবতের পুজো করে... সোনার দেবতা যদিও তাদের সোনা দেয় না কিন্তু শরীর ভালো রাখেন তাই এই সম্প্রদায়ের মানুষের গড় আয়ু অনেকটাই বেশী সত্তর আশি বছরের লোকও নাকি বেশ কর্মক্ষম। সঠিক জায়গাটার কথা না লিখলেও সেটা সিংভূম ডিসট্রিক্টে দেখে কাজলের মনে হচ্ছে, এ জায়গারই গল্প আরও একটা আশ্চর্য বিষয় লিখেছেন প্রতিবেদক, কিছু একটা জিনিসকে আড়াল করার কারণেই তারা মহল্লায় কাউকে ঢুকতে দেয় না আর এসব প্রত্যন্ত অঞ্চল নিয়ে প্রশাসনও বিশেষ মাথা ঘামায় না তবে কবছর আগে এখানকার আকাশে অদ্ভুত একটা  গোলাকার আলোর মতো কিছু দেখা গেছিল  বেসরকারি একটা চ্যানেলে সেই ছবি দেখা গেলেও কেউ পাত্তা দেয়নি। সবকিছু সত্ত্বেও সুমিতের মনে একটা খটকা রয়ে যাচ্ছে, এখনও পর্যন্ত স্ক্রিপ্টে তেমন অদ্ভুত কিছু তো নেই। আর লোকাল লোকেদের এরম বিশ্বাস তো অনেক ব্যাপারেই থাকে তারা তাদের মহল্লায় বাইরের লোককে অ্যালাও না করা মানেই খুব রহস্য আছে তাতো নয় হতেই পারে শহুরে লোকেদের তারা খুব একটা বিশ্বাস করে না করার কথাও নয় ... সভ্যতার নাম করে খনিজ প্রাকৃতিক সম্পদ, শ্রম কিংবা নারী লুঠ তো বরাবরই করছে শহরের মানুষ

চার

পরের দিন সকাল থেকে বেশ একটা চাপা উত্তেজনা মুখে কেউ কিছু না বললেও সবাই জানে এবার আসল ব্যাপারটাকে ধাওয়া করতে হবে কল্যাণ একা সকালে বেরিয়ে গেল সে ওই পাহাড়ের কাছাকাছি ঘোরাঘুরি করে যা বুঝলো, এদিকটা আরও ফাঁকা লোকবসতি নেই পাহাড়টাকে দূর থেকে ছোট মনে হলেও সামনে থেকে বেশ খাড়াই বলেই মনে হচ্ছে, লোকগুলো রোজ পায়ে হেঁটে টপকায় কিকরে কিছুতেই বুঝতে পারলো না কল্যাণ দুপুরে সে যখন ক্লান্ত হয়ে ফিরলো, সাথে দুটো কান্ট্রি লিকারের বোতল আর একটা বেহেড মাতাল ছাড়া কোনও উল্লেখযোগ্য ব্যাপার নেই দিশির ঠেকে এর কাছে কল্যাণ শুনেছে, ওই পাহাড়টাকে আদিবাসীরা বলে ভুলো পাহাড় ... ওখানকার ফরসা লোকগুলো ছাড়া কেউ রাস্তাও চিনতে পারে না পথ হারিয়ে ফেলে টেম্পারেচার, বায়ুচাপ অথবা কোনও ভৌগলিক কারণে অনেকসময় মানুষের ব্রেন বা নার্ভাস সিস্টেম হয়ত অদ্ভুত আচরণ করে সেটাই এখানে ঘটে বলে সুমিতের সন্দেহ হল

রহস্যটা আরও যে কারণে তৈরী হয়েছে ওই লোকগুলো বাকীদের সাথে বড় একটা মেলামেশাও করে না। দলবেঁধে টাইমে মাইনে আসে আবার টাইমে ফিরে যায় সবথেকে আশ্চর্যের যেটা ওখানকার মেয়েগুলো যে ঠিক কেমন দেখতে সেটাই কেউ জানে না ওখানকার ছেলেদের গায়ের রং দেখে মেয়েদের সম্বন্ধে কল্পনা চলে লোকাল লোকজনের মনে কিন্তু কেউ তাদের দেখেনি, তারা হয়তো নিজেদের মহল্লার বাইরে বেরোয় না ওখানকার মেয়েদের সাথে বাইরের কোনও ছেলের বিয়ে হয় না এটাই ছিল মাতালটার আসল দুঃখের কথা  

শুনে  দীপঙ্কর হাসল, কল্যাণকে বলল তবে কি তুমি ভেবেছিলে তারা ধেই ধেই করে দল বেঁধে এসে তোমাকে নাচ দেখাতে আসবে! কল্যাণ বিরক্ত মুখে বলল, না তোকে বিয়ে করবে কিনা খবরটা নিতে গেছিলাম সুমিত এসব পাত্তা না দিয়ে বলল, রাস্তাটা ফলো করেছিলি কি? কল্যাণ ঘাড় নেড়ে বলল, ঠিকমতো বোঝা যাচ্ছে না কোথা থেকে শুরু হয়ে রাস্তাটা কোথায় মিশেছে আর লোকাল লোকেরা বলছে ওখানে গেলে সব ভুলে যায় বলে কেউ পৌঁছতে পারেনি কোনোদিন।

যত অসম্ভব পথই হোক না কেন, শেষ না দেখে ছাড়াটা সুমিতের ধাতে নেই তাই রাতের অন্ধকারে ওরা বেরিয়ে পড়লো। ঘন অন্ধকার রাস্তা তার ওপর বেহেড একটা পথপ্রদর্শক ব্যবস্থা বেশ ভালোই যদিও বেশ কিছুটা হাঁটার পর লোকটা  সফলভাবেই পাহাড় অব্দি ওদের পৌছে দিল এরপর তার আর জানাবোঝা কিছু নেই তাকে ছেড়ে দেওয়াই ভালো

খাড়া পাহাড় দিয়ে তো আর চড়া যাবে না, তাই ওরা আশপাশে কোনও পথ আছে কিনা খুঁজতে লাগলো অনেক কষ্টে একটা খাঁজ দেখতে পেল দীপঙ্কর টর্চের আলোয় যেটুকু ঠাওর হয় সেটা দিয়ে এগোতে এগোতে সুমিত বুঝতে পারলো এটা স্বাভাবিক কোনও রাস্তা নয় বরং চলতে চলতে মনে হচ্ছে এটা যেন মানুষের তৈরি সবথেকে অবাক করা যেটা পথটা যেন ক্রমশ চওড়া হয়ে পাহাড়টাকে আড়াআড়ি অতিক্রম করছে

বেশ কিছুক্ষণ চলার পর ওরা যেখানে পৌছল সেটার সামনে একটা খাড়া দেওয়াল উঠে গেছে এবং এই পাথরটা যে পাহাড়ে আলাদা করে আটকানো সেটা পরিষ্কার বুঝতে পারলো সুমিত কিন্তু কিভাবে! এটাকে দেখে খানিকটা ভালভের মতো মনে হল সুমিতের আর সে সবাইকে দেওয়ালের নীচের দিকটা আলো ফেলতে বলল সবাই লক্ষ্য করলো, নীচের দিকটা মাটিতে লেগে থাকলেও একটা জায়গায় খানিকটা ফাঁক আছে হাঁটু গেড়ে বসে সেই জায়গাটা পরীক্ষা করতে করতে একটা হাতলের মতো জিনিসে হাত ঠেকতেই সুমিত চঞ্চল হয়ে উঠল একবার দুবারের চেষ্টায় সেটা না নড়লেও তৃতীয়বারে পাথরটা খানিকটা  সরে এল রোমাঞ্চিত চারজন সেখান দিয়ে গলতে যাওয়ার সময় আরও আশ্চর্য একটা ঘটনা ঘটলো দেখলো আকাশে অদ্ভুত একটা লালচে আলো ছড়িয়ে পড়ছে   

সকলেই বুঝতে পারছিল কিছু একটা ঘটতে চলেছে তাই একটু সময় তারা অপেক্ষা করে নিল, তারপর আবার চলতে শুরু করলো তাদের চলার শব্দ হতে লাগলো রাস্তা এবড়োখেবড়ো হওয়ার ফলে হোঁচটও খেল কিন্তু ঠিক কোথায় যাবে বুঝতে পারছে না কিছুই তাই ওরা চলতে লাগলো আলোর উৎসটাকে লক্ষ্য করে ওরা বুঝতে পারছিল কোনও একটা ভারী ধাতব গন্ধ হাওয়ায় ভাসছে, সবার অস্বস্তি হতে লাগলো মনে হল রক্তচলাচলও দ্রুত হচ্ছে সুমিত বুঝতে পারছে এরম বেশিক্ষণ চললে সেন্স চলে যেতে পারে তাই ওরা প্রাণপণে ছুটতে লাগলো কিন্তু আশ্চর্যের ব্যপার, জমাট হাওয়ায় ধাক্কা খেয়ে পড়লো চারজনই পড়ে যাওয়ার মুহূর্ত পর্যন্ত কেউই বুঝতে পারলো না, ধাক্কাটা কিসে খেল

পাঁচ

আচ্ছন্নভাবটা যখন কাটলো তখন অন্ধকার বেশ কেটে গিয়ে আকাশে বেশ জোরালো আলো প্রথমে উঠতে গিয়ে সুমিতের মনে হল, তবে কি রাত ফুরিয়ে গেল! তারপর ঘড়ির দিকে চোখ যেতে দেখলো ঘড়ি বন্ধ অন্য তিনজনকে একইভাবে পড়ে থাকতে দেখলো সুমিত ঘটনাটার পরম্পরায় এতটাই আভিভূত হয়ে গেছে, কাউকে ডাকতে পারলো না বরং চারপাশটায় চোখ বোলাতে গিয়ে চমকে উঠল সারি সারি পুতুল অ্যাটেনশান মোডে দাঁড়িয়ে আছে তাদের চেহারা মানুষের মতো কিন্তু বোঝা যাচ্ছে এগুলো অত্যাধুনিক ছাঁচে ফেলা মানুষতাদের গায়ের রং যাকে বলে কাঞ্চনবর্ণ  ওদিকে আকাশের আলোটা বাড়তে থাকলো কিছুক্ষণের মধ্যে সুমিত লক্ষ্য করলো গরমকালের সূর্যের মতো চোখে লাগছে আলোটা হঠাৎ মনে হল, পুতুলগুলোর দেহে প্রাণের স্পন্দন প্রথমে অল্প অল্প তারপর দলবদ্ধভাবে পুতুলগুলো নড়াচড়া করতে লাগলো মানুষের মতো অঙ্গভঙ্গি করে  দেখলে যে কোনও লোকের আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার কথা কিন্তু সুমিত এতক্ষণের ঘাত প্রতিঘাতে খানিকটা নিঃস্পৃহ হয়ে গেছে বলেই সে সাধারণ অবস্থাতেই রইলো বুঝতে চেষ্টা করলো বিষয়টা। ঠিক তখনই সূর্যের মতো আলোটার ভেতর থেকে চাপা স্বর ভেসে এলদূরাগত ধ্বনির মতো হলেও পরিষ্কার শোনা গেল কথা ...

-           আপনি সভ্যতার একমাত্র মানুষ, সম্পূর্ণভাবে এই ঘটনার সাক্ষ্মী থাকলেন

সুমিত বুঝলো তাকে উদ্দেশ্য করেই বলা... কিন্তু সে না ঘাবড়ে চড়া গলায় বলে উঠল, এসবের মানেটা কি? এই রোবটগুলোর উদ্দেশ্যই বা কী!

স্বর ভেসে এলো, উচ্চ প্রযুক্তির মাধ্যমে এগুলোকে তৈরী করে এই আবহাওয়ায় পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে কয়েক যুগ ধরে... এগুলো সোলার সিস্টেমে চলে, তাই রাতে নিস্ক্রিয়

-           কিন্তু কারণটা কী? এখানকার লোকজন তো আছেই কাজকর্ম করার জন্য

-           উদ্দেশ্য মহৎ ... মানুষের ক্রমশ শারীরিক মানসিক কল্পনা ও যৌনক্ষমতা কমে যাচ্ছে, শুধু ক্যালকুলেশানের ক্ষমতা বাড়ছে কায়িক শ্রম কমানোর জন্য অটোমোশান যেমন ইন্ট্রোডিউস হয়েছিল ... একই কারণে এই ব্যবস্থা

-           কিন্তু মানুষের ভাত মারার কী দরকার ... যন্ত্র এসে তো ক্রমশ কাজের সুযোগ কমছে
-           এটা সঠিক মূল্যায়ন ... প্রাথমিকভাবে এটা ভাবনার মধ্যে ছিল না
-           আপনাদের কি মনে হয় না কয়েকটা যন্ত্র দিয়ে মানুষের মস্তিষ্ককে সাবস্টিটিউট করা অসম্ভব
-           আপনি ছকের বাইরে ভাবতে পারছেন বলেই, প্রবল প্রতিকূলতা কাটিয়ে সুস্থ থাকতে পেরেছেন

-           আর বাকীরা?
-           তাদের স্মৃতি ছাড়া অন্য কোনও ক্ষতি হবে না
-           কিন্তু এইসব যন্ত্র কি অনন্তকাল চলবে?
-           তা কখনও নয়, সবার লাইফটাইম আছে ...তবে তা সাধারণ মানুষের থেকে খানিকটা বেশী
-           কী উপায়ে এগুলোকে তৈরী করেছেন আপনারা?
-           সে প্রযুক্তি মানুষ এখনও জানে না ... তবে শেষ কুড়ি বছরে মানুষের প্রযুক্তি অনেকটাই এগিয়েছে... মানুষ খুব দূরে নেই এরম যন্ত্র তৈরি করা থেকে
-           কিন্তু আমি একটা কথা কিছুতেই বুঝতে পারছি না, আপনারা কম্যুনিকেট করছি কিকরে!
-           আপনি নিজের ভাষা শুনতে পারছেন ইন্টারপ্রিটারের মাধ্যমে... একইভাবে আমরাও আপনার কথা বুঝতে পারছি আদি ভাষা সংস্কৃতের কাছাকাছি ভাষায় আপনি কথা বলছেন বলে বেশ সুবিধা হচ্ছে
-           কিন্তু এসবের শেষ কোথায়!
-           শেষ মহাশূন্যে ... প্রলয় পেরোনোর জন্য জলচরকে পাঠানো হবে তখন তাকে আপনি লালন করবেন 
অবাক হয়ে সুমিত বলে উঠল, সেতো মনুর গল্প ...
কন্ঠস্বর ভেসে এলো, প্রতি যুগেই সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে মনুকে প্রয়োজন তার যৌনক্ষমতা কাজে লাগবে পরবর্তী প্রজন্মকে আনতে
-           কিন্তু আমি কেন! আমার মতো সাধারণ মানুষের মধ্যে কী আছে?
-           আপনি মানুষের সেই ব্রিডের প্রতিনিধিত্ব করছেন যারা প্রতিকুলতার উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে আগুণ জ্বালিয়েছে, চাকা গড়িয়েছে, যুদ্ধ করে বাকীদের নিরপত্তা দিয়েছে
শুনতে শুনতে সুমিতের মনে হল আলোটা ক্রমশ নিভে আসছে, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পুতুল মানুষগুলো আড়ালে চলে যাচ্ছে। সামনে নিঃস্পন্দ অন্ধকারে বন্ধুদের অচেতন দেহগুলোর মাঝে সে একা দাঁড়িয়ে আছে অনন্তকাল। 

দীপঙ্করের ব্যাগে জল পেয়ে বাকীদের মুখে ঝাপটা দিয়ে ওদের জাগাতে লাগলো সুমিত তাকেই দায়িত্ব নিতে হবে সবাইকে নিরাপদ আস্তানায় নিয়ে যাওয়ার

বৈদূর্য্য  সরকার: কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন