গল্প
ছাদে
উঠে একেবারে ওই পাঁচিলের ধারে এসে দাঁড়ালো পরী। কে ওর এই নামটা রেখেছিল কে জানে!
মা, ঠাকুমা না বাবা বারবার জানতে চেয়েছে সে।
এত কালো মেয়ের নাম পরী কি করে কেউ রেখেছিল,
আজও
ভাবলে অবাক হয় সে।
ঠাকুমা
যতদিন বেঁচে ছিল বুকে জড়িয়ে শুতো রোজ রাতে। আর ঘুমন্ত পরীর কানে কানে বলতো, "এমন সুন্দর মুখ চোখ কজনের হয়! দেখিস ঠিক একদিন রাজপুত্তুর এসে
নিয়ে যাবে তোকে বিয়ে করে।" ঘুমন্ত
পরী স্বপ্নের দেশে যেতে যেতে সেই রাজপুত্তুরকে কতবার কতভাবে দেখার চেষ্টা করেছে, কিন্তু কি জানি কেন কোনদিনই তার মুখটা সে দেখতে পায় নি। আজ
এতবছর পরে ঠাকুমার কথা মনে পড়ে দুচোখে জল ভরে এলো পরীর।
ঠাকুমা
নিজের এই কালো নাতনির বিয়ে অবধি বাঁচেন নি ,
না
হলে জানে পরী আজ সবথেকে বেশী খুশী হতেন তিনি। বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটু দূরে
বানানো সাদা শ্বেত পাথরের বেঞ্চের ওপরে এসে বসে পড়লো পরী। বন্ধ চোখের আড়াল থেকে
একে একে সেই বউ হয়ে আসা পরী আর সেই অনেকগুলো চলে যাওয়া মানুষ এসে দাঁড়ালো আজ
একেবারে সামনে।
পরী
নিজের এই কালো রং নিয়েও কি করে যে এই সেন বাড়িতে রূপে গুণে ভরা মানুষগুলোর মাঝে
জায়গা পেয়েছিল সেটাই কম আশ্চর্যের কথা নয়। অথচ একবার দেখাতেই বিয়েটা হয়ে গেছিলো
তার।
বৌ
হয়ে সে এসেছিল যেদিন এই বাড়িতে, আজও চোখ বন্ধ করলে সে
দিনের সবটুকু তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
মধ্যবিত্ত
বাড়ির আর পাঁচটা মেয়ের মতোই অনেক স্বপ্ন ছিল তার মনের মাঝে। স্কুলে কলেজে লেখাপড়ার
ফাঁকে ফাঁকে গান বাজনার চর্চাও ভালোই ছিল তাদের বাড়ির সব কজন ছেলে মেয়ের।
বাবা
আর ঠাকুমা নিজেদের সময়ের বেশ চর্চিত ছিলেন এই ক্ষেত্রে।
অথচ
মা চাইতেন না তার দুই মেয়ের কেউ গান বাজনা নিয়ে মেতে উঠুক। নিঃসন্তান জেঠু তার ছোট
দুই ভাইয়ের সন্তানদের নিজের বুকের মাঝে রেখেই মানুষ করেছিলেন। জেঠিমা খুব একটা
পছন্দ করতেন না এসব অথচ জেঠুর কথায় কোনদিন বাধাও দেন নি।
পরী
নাচতে খুব ভালবাসতো, কিন্তু মা'র বারণে ভর্তি হয়ে গেছিল ওই পাড়ার কাছেই একটা গানের স্কুলে। মা
বলতেন একেই তো সারাদিন ধিঙ্গিপনা করে, নাচ শিখলে আর কি বসবে
এই মেয়ে এক জায়গায়।
পরী
আড়ালে আবডালে নাচতো, স্কুলের কলেজের ফাংশনে নেচে পুরস্কারও
পেয়েছে অনেক, কিন্তু মা দেখেও কোনদিন কিছু বলেন নি
তাতে।
আর
সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা ছিল গাইতোও পরী খুব ভাল। ওর গানের সুরে তালে মিশে যেতো যেন
ওর মনের সব দুঃখ, সব ব্যথা। দিদিরা মুগ্ধ হয়ে শুনতো ওর
গান আর বড়দের আড়ালে বলতো, "যাকে মালা পরাবি, সে তো এই গান শুনেই ভালবাসবে তোকে।"
কিন্তু
তাই কি হলো! পরীর গান শুনে ওর শ্বশুর শাশুড়ি জা ভাসুর সবাই খুশী হয়েছিল বটে, কিন্তু ওই যাকে মালা পরিয়ে এ বাড়িতে এসেছিল সে, সেই মানুষটা একদিনও ওর গান শুনেছিল কি!
দুই
দিদির বিয়ের পরে পরেই পরীর বিয়েটা হয়ে গেলো হঠাৎ করে।
বাবার
কোন ছোটবেলার বন্ধুর ছেলে। দেখতে এসেছিল সবাই শুধু ওই ছেলেকে ছেড়ে। গায়ের রং সেদিন
বোধহয় ঢাকা পড়ে গেছিল পরীর গাওয়া সুন্দর গানের তলায়। কেউ কিছুই বললো না তেমন। শুধু
দূর সম্পর্কের এক কাকিমা বলে ছিলেন এমন সুন্দর নাক নকশা, এত ভাল গানের গলা এই মেয়ের গায়ের রং ফর্সা হলে এ মেয়ে সিনেমার
নায়িকা হতো। আমাদের সাধ্য কি ছিল একে বৌ করে নিয়ে যাওয়ার!
সবাই
হেসে উঠেছিল সেই কাকিমার কথা শুনে, শুধু কি জানি পরীর
দুচোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়েছিল। দেখতে এসে এর আগে সবাই তো শুধু ওই গায়ের রং নিয়েই কত
কথা বলে গেছে। আজ এই প্রথম কেউ তার গুণের তারিফ করলো বোধহয়।
দুমাস
পরেই বিয়েটা হয়ে গেলো পরীর। বাবা মা জেঠু জেঠিমা চোখের জলে বিদায় করলো তাকে। পরী
কেঁদেছিল সেদিন শুধু ঠাকুমার জন্য। কি জানি কেন এই বাড়িটা ছেড়ে যেতে যেতে শুধু মনে
হচ্ছিল পরীর যদি একটিবার সেই আগের মতো ঠাকুমাকে জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ লুকিয়ে বলতে
পারতো, "আমায় লুকিয়ে নাও তুমি ঠাম্মা। ওরা নাহলে
যে ধরে নিয়ে যাবে।"
আজ
এই এত বছর পরেও ঠোঁটের ফাঁকে এক চিলতে হাসি এসে নাড়িয়ে দিয়ে গেলো তাকে। ওই দূরে
আকাশের তারার মাঝে সবথেকে জ্বলজ্বলে তারাটা যেন ওই অত দূর থেকেও আজ স্নেহের
দৃষ্টিতে দেখছে তাকে। জানে পরী ওটা তার ঠাকুমা ছাড়া আর কেউ নয়, আসলে আর কেউ হতেই পারে না যে।
আজ
জীবনের এই এতগুলো বছর পেরিয়ে এসে আর কাউকে নয় শুধু ওই ঠাম্মার মুখোমুখি হতে চায় সে
একটিবার। গলা জড়িয়ে বলতে চায় তাকে অনেক কথা। সেই একবস্তা না বলা কথা যা বুকের মাঝে
লুকিয়ে রেখে রেখে জমাট বেঁধে পাথর হয়ে গেছে তার পুরো শরীর মন আর সবকিছু। সেই কত
ছোট ছোট সুখ দুঃখের মুহূর্ত .. সেই কত শত
বার পরীক্ষা দিয়েছে সে !
সেই
পরীর কথা ঠাম্মা তুমি শুনবে তো আজ!
বিয়ে
হয়ে যেদিন এলো এই বাড়িতে পরী আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবের আড়ালে নিজেকে যেন হারিয়ে
ফেললো সে।
কেউ
বললো গান করো, কেউ পাশে বসে বাপের বাড়ির গল্প শুনলো, আর কেউ বা ঘোমটা খুলে চুলে হাত বুলিয়ে বলে গেলো, "বাঃ ভারী সুন্দর চুল তো"
হারিয়ে
গেলো পরী এতজনের মাঝে।
খুঁজে
পেলো নিজেকে অনেক রাতে বড় ননদের সাথে শুতে গিয়ে। সেদিনটা যে কালরাত্রি ছিল। বয়েসে
বেশ বড় ননদ একথা ওকথার মাঝে বুঝিয়ে দিলো তাকে,
যে
পরীর বর মানে তার ছোট ভাইটি কিন্তু একটু রাগী বা রগচটা।
বিয়ে
হওয়া থেকে এখনও পর্যন্ত তার সাথে একটা দুটো কথা ছাড়া মোটেই কথা হয়নি পরীর, তাই মাথা নেড়ে চুপচাপ সব শুনে ঘুমিয়ে পড়লো সে সেই রাতে।
পরদিন
সকাল থেকেই নানান অনুষ্ঠান। স্নান সেরে সাজিয়ে গুজিয়ে তাকে মন্দিরে নিয়ে যাওয়া
হলো। বাড়ির সাথেই লাগোয়া বিশাল মন্দির আর ঠাকুর দালান। এককালে নাকি এই বাড়িরই এই
মন্দিরের ওপরে সম্পূর্ণ অধিকার ছিল। এখন অবশ্য আর তেমনটা নেই। তবু আজও এক কথায়
চেনে সবাই এদের এই তল্লাটে।
পুজোর
পরে বাড়ি ফিরে ভাত কাপড়ের অনুষ্ঠানও বেশ ভালভাবেই কেটে গেল। আত্মীয় স্বজনের পাতে
ভাত পরিবেশন করে অনেক উপহারও পেলো সে।
একটু
বিশ্রামের পরেই শুরু হলো সাজানোর পালা। অনেক গয়না আর ভারী বেনারসী পরে পরী নিজেকেই
চিনতে পারলো না যেন। বাবা মা জেঠু জেঠিমা আর বোনেরা এলো আর পরীকে দেখে খুশী মনে
সবাই ফিরে গেলো রাতে এই বলতে বলতে, "নাঃ মেয়েটা বেশ ভালোই
শ্বশুরবাড়ি পেয়েছে।"
অনেক
রাত হয়ে গেলো সব মিটতে মিটতে। একে একে অতিথিরা সব বিদায় নিলো। আত্মীয়স্বজনও
ক্লান্ত শরীরে এদিক ওদিকে গিয়ে শুয়ে পড়লো।
পরীকে
আগেই দুই বৌদি আর ননদেরা এসে অন্য শাড়ি পরিয়ে বসিয়ে রেখে গেছে। রাত প্রায় দেড়টা বা
দুটো হবে দরজায় আওয়াজ পেয়ে পরী মুখ তুলে দেখলো।
দরজার
ঠিক সামনে ইন্দ্রনীল দাঁড়িয়ে আছে। হাতে ধরা একটা প্যাকেট। পরী একটু লজ্জা পেয়ে মুখ
নামিয়ে নিলো। মনের মাঝে সেই কবেকার ঠাম্মার বলা একটা কথা ঝিলিক দিয়ে মিলিয়ে গেলো।
সেই
রাজপুত্র এসে নিয়ে যাবে তার সাধের পরীকে! সত্যিই কি তাই! কে জানে?
একটু
আনমনা পরী আজ জানলার বাইরে ওই আকাশকে দেখলো। পূর্ণিমার আলোয় ভরে আছে আজ চারদিক।
এমন রাতে না কি দেবতারাও সব ভুলে মর্ত্যে নেমে আসে। তাই যদি হয় তবে ওই তারার দেশে
চলে যাওয়া প্রিয় মানুষগুলো! তারা কি আসে না একটিবারও .... দেখার জন্য!
হালকা
গোলাপি বেনারসী শাড়ি আর তার সাথেই মেলানো অল্প কিছু গয়নায় বড় মোহময়ী লাগছিল পরীকে।
এগিয়ে
এসে কাঁধে হাত রাখলো ইন্দ্রনীল আর নিজের দিকে ফিরিয়ে বললো, "কার চিন্তায় হারিয়ে ফেলেছো নিজেকে! সত্যি বলো তো আমাকে!"
জানলার
বাইরের জোছনা পরীর চোখে মুখে কি জানি কেমন রং ভরিয়ে দিয়েছিল ইন্দ্রনীল মুগ্ধ হয়ে
দেখছিল শুধু।
পরীর
হাত ধরে বারান্দার দরজা খুলে নিয়ে এলো তাকে ওই এদিক ওদিক সাজানো অনেক গাছ গাছালির
কাছে আর একদিকে লাগানো দোলনায় বসিয়ে নিজেও পাশে বসলো বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
হাওয়ায়
হাওয়ায় কে যেন এসে বলে গেল আজ দুজনের দুজনকে চেনার রাত, জানার রাত। একেবারে অচেনা অজানা দুজন আজ ধীরে ধীরে চিনবে জানবে
দুজনকে। জুঁই ফুলের গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছিল চারিদিকে। পাশে পড়ে থাকা দু একটা ফুল হাতে
তুলে নিয়ে এগিয়ে গেলো একটু ইন্দ্রনীল। পাতার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়েছিল
দুজনেরই মুখে। পরী ভেবেই পাচ্ছিল না আজ এই এত রাতে কি বলার জন্য ইন্দ্রনীল তাকে
ডেকেছে এখানে।
পড়ে
থাকা জুঁই ফুল সেও কুড়িয়ে নিলো নিজের হাতে। এগিয়ে গেলো ধীর পায়ে নিজের নতুন জীবন
সাথীর কাছে। পাশে দাঁড়িয়ে খুব ধীরে অথচ সহজ ভাষায় বললো, "আপনি কি কিছু বলতে চান আমাকে? মনে
হয় আপনার আমাকে পছন্দ হয়নি? না দেখেই বিয়েটা
হয়েছে আমাদের তাই হয়তো আপনি আজ এত রাতে আমাকে এখানে ডেকে পাঠিয়েছেন কিছু বলার
জন্য। বলে দিন আপনার যা বলার আমি সবটুকু শুনতে রাজি আজ।"
ইন্দ্রনীল
একবার তাকিয়ে দেখলো পরীর দিকে। তারপর আবার আগের বলা কথাটাই আবার একবার বললো। কি যে
হচ্ছিল তার মনে আর অন্তঃকরণে তা বোঝার সাধ্য কারো ছিল না হয়তো।
বাইরে
ঝড় উঠলো বুঝি তখন। জোরে হাওয়া এসে শুকনো পাতা আর খড় কুটো কোথা থেকে এসে উড়ে পড়লো
দুজনের মাঝখানে।
ইন্দ্রনীল
পরীর ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে ছিল এতক্ষন। এবারে ধীরে ধীরে ওর সামনে এসে দাঁড়ালো। দূরের
আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ তার নিজের সবটুকু আলো পরীর চোখে মুখে আর বুঝি বা তার শরীরেও
ছড়িয়ে দিয়েছিল সবটা। পরী কালো হলেও কি জানি কেন আজ বড় মোহময়ী লাগছিল তাকে। উড়ে আসা চুলের বাহার বারবার ঢেকে দিচ্ছিল তার
মুখের বেশ কিছুটা। একটু দ্বিধা আর একটু লজ্জা মেশানো গলায় বলে উঠলো সে, "আপনার যা বলার আছে আর দেরী করবেন না। এবার বলেই দিন আমায়! ভয়
নেই যদি চলে যেতে হয় এই বাড়ি ছেড়ে, তাও আমি কাউকে জানাবো
না কোনদিন যে, তাতে আপনার কোন ভুল ছিল। এটাই জানবে
সবাই যে আমারই ভালো লাগেনি এই ঘর বাড়ি আর সবকিছু। তাই আমি চলে যাবার সিদ্ধান্ত
নিয়েছি।"
ঝড়ো
হাওয়ায় চাঁদের আলো মেঘে ঢেকে গিয়েছিল কিছুটা,
তাই
আলোছায়ার মাঝখানে দাঁড়িয়ে এই দুই সদ্য বিবাহিত নারী পুরুষকে কেমন যেন স্বপ্নের
দেশের মনে হচ্ছিল।
এগোনো
পরীর কাঁধে হাত রেখে নিজের দিকে ফেরালো ইন্দ্র আর তার পরে ওর হাত ধরে টেনে এনে
আবার বসালো সেই পাথরের সাদা বেঞ্চে। দুজনের বুকের মাঝে তুফান এসে বারেবারে ভেঙে
দিতে চাইছিল সবকিছু। তবু শান্ত হয়ে বসেছিল দুজনেই।
পরী
নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে গিয়ে দাঁড়ালো ওই বিশাল ইউক্যালিপিটাসের পাশে। না চাইতেও
দুচোখের বাঁধ ভাঙা জল এসে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চাইলো ওকে। পরী না চাইতেও কেঁদে ফেললো
একেবারে ছেলেমানুষের মতো। ওর উথালি পাথালি কান্নার কারণ ও নিজেও জানতো না হয়তো, শুধু মনে হচ্ছিল খুব খারাপ কিছু শুনতে হবে ওকে। হয়তো এই এক
কাপড়েই কাল বেরিয়ে যেতে হবে ওকে এই বাড়ি থেকে!
বাড়িতে
মা বাবা জেঠু জেঠিমা সবাইকে কি বলবে ও, তা নিয়ে আগেই ভেবে
রেখেছিল, কিন্তু এখন কেমন যেন সব গুলিয়ে গেলো। এই
দুদিন আগে আসা বাড়িটা কেমন যেন নিজের বাড়ি বলে মনে হয়েছিল তার। সেই ছোট থেকেই
ঠাম্মার কাছে শুনে এসেছে বিয়ের পরে মেয়েরা না কি নিজের বাড়িতে যায়। যুগের হাওয়ার
সাথে সবকিছু বদলেছে হয়তো, কিন্তু পরী নিজে যে
বদলায় নি এক ফোঁটাও। সে যে সেই পুতুল খেলা থেকেই ভেবে এসেছে একটা সুন্দর বাড়ির
কথা। এক গা গয়না পরে লাল টুকটুকে বেনারসী পরে ওই ছেলে পুতুলের সাথে চলে যাওয়া
নিজের মেয়ে পুতুলের সংসারে সে তো বারেবারে নিজেকেই খুঁজে পেয়েছিল।
ভুল
ঠিক কিছুই সে জানতো না তখন হয়তো কিন্তু আজ মনে হয় সব বুঝি ভুল ভেবেছে সে।
তারপরে
যা শুনলো সে তা শুনে তার মন একদিকে ব্যথায় আর অন্যদিকে কেমন যেন এক শূন্যতায় ভরে
গেলো।
অনেক
ছোটবয়েস থেকেই খেলাধুলা ভালবাসতো ইন্দ্র। বাবা মা আদর করে ডাকতো বাপ্পা বলে। দাদু
ঠাম্মা আর বাড়ির সকলের আদরের মণি। বাড়িতে ছেলে মেয়ে আরো ছিল, কিন্তু কে জানে কেন সবাই ভালবাসতো ওকে একটু বেশী। সে হয়তো ওর
স্বভাবের জন্যও হতে পারে। খুব একটা শান্ত সে ছিল না হয়তো, কিন্তু সবার মন জয় করার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল তার। স্কুলে
কলেজে পাড়ায় এক ডাকে চিনতো সবাই ইন্দ্রনীলকে।
এমনই
একদিনে কলেজের খেলার মাঠে ফুটবল প্রতিযোগিতায় বিপক্ষের বল এসে লেগেছিল তার শরীরের
খুব সংবেদনশীল স্থানে। অচেতন ইন্দ্রনীলকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল শহরের নামকরা এক
নার্সিং হোমে। প্রাথমিক চিকিৎসার পরে ডাক্তার গম্ভীর মুখে জানিয়েছিলেন অপারেশন
করতেই হবে।
পুরো
বাড়ি আর পাড়ার কেউ বাকি ছিল না সে রাতে ওদের বাড়ি এসে ইন্দ্রর খবর নেওয়ার জন্য।
বাড়িতে
কেউ খায় নি সে রাতে, রান্নাঘরে যাবার কথা ভুলে গেছিল হয়তো মা
জেঠিমা। পরের দিন হলো অপারেশন। আর তারও প্রায় ছ'সাতদিন
পরে ছুটি পেয়ে বাড়ি এলো সে সবার সাথে।
কিন্তু
কি যেন বদলে গেলো ওর জীবন থেকে। সবাই কেমন যেন চুপচাপ, মনমরা। বাড়িতে ইন্দ্র ফিরে এলো বটে, কিন্তু কোন খুশী এলো না যেন ওর সাথে। সবাই কি যেন লুকিয়ে
রেখেছিল, তা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিল না ও।
সময়
পেয়ে একদিন মাকে প্রশ্ন করলো, "আচ্ছা মা সবাই তোমরা
এত চুপচাপ এত গম্ভীর কেন বলো তো! খেলতে গিয়ে এমনটা তো কত জনের সাথেই হয় তা'বলে এত ভেঙে পড়ে কি সবাই!"
মা
কিছুই না উত্তর দিয়ে শুধু চোখের জল শাড়ির আঁচলে মুছে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।
কিছুই
বুঝতে না পেরে ইন্দ্রনীল মা-কে আবার ডাকলো। মা কিন্তু ফিরে এলো না তখন। রাতে ছোট পিসি এলো দেখতে তাকে। একা পেয়ে পিসিকে
জিজ্ঞেস করলো ইন্দ্র, "আচ্ছা পিসিমনি সত্যি
বলো তো সবাই এত গম্ভীর কেন! কেন কেউ কথা বলছে না ভালো করে? পিসিমনি সস্নেহে দেখলো নিজের এই ভাইপোকে। আর তারপরে বলে দিলো
সেই সব কথা যা বলার সাহস আর কেউ পায় নি এই বাড়িতে।
ফুটবলের
আঘাত শুধু শরীরের ওপরে নয় শরীরের ভেতরেও যে বেশ কিছু অঘটন ঘটিয়ে গেছে তা জানলো
ইন্দ্র পিসির কাছে। অপারেশনে রাজি হচ্ছিলো না তাই ইন্দ্রের বাবা কিছুতেই। ডাক্তার
আগেই সাবধান করে দিয়েছিলেন কিছু ব্যাপারে। হয়তো ইন্দ্র বিয়ের পরে ভবিষ্যতে আর
কোনদিন বাবা হবার সৌভাগ্য পাবে না।
কিছু
না বুঝেও অনেক কিছু বুঝে গেলো সে রাতে ইন্দ্র। সবার চুপচাপ থাকা আর গম্ভীর হবার
কারণ একবারেই বুঝতে পারলো সে। বিছানার থেকে উঠে নিচে নামতে গেলো সে। আর ওখানেই
মাথা ঘুরে বসে পড়লো একেবারে।
পিসির
আওয়াজে ঘরে এসে পৌঁছলো সবাই। আর এই অবস্থা দেখে চমকে উঠলো ইন্দ্রর বাবা আর মা।
সে
রাত কেমন কেটেছিল তাদের বাড়িতে তা বলতে গিয়ে আজও কেঁদে ফেললো ইন্দ্রনীল।
বিয়ের
আগে তাকে জানানোর কথা বলেছিল সে বাবা মাকে। তারা বলেছিল চেষ্টা করবে। কিন্তু পরীকে
দেখে আসার পরে জেঠিমার কাছে জেনেছিল ইন্দ্র কেউ কিছু বলেনি তাকে।
বাবা
মা মাথা নিচু করে নিয়েছিল আর জেঠিমা একদিন এসে পরীর একটা ফটো ইন্দ্রনীলের টেবিলে
রেখে দিয়েছিলেন।
অনেকবার
চেয়েছিল ইন্দ্র পরীর সাথে ফোনে যোগাযোগ করতে। কিন্তু কি জানি কেন মুখ ফুটে বলে
উঠতে পারেনি সে।
আজ
বলার কোন মানে নেই জানে ইন্দ্রনীল। বিয়ের ঠিক দুদিন পরে একথা জানিয়ে সে অনেক
অন্যায় করছে জানে সে। কিন্তু আজ না বললে আরো যে দেরী হয়ে যাবে তাই আজ বলা।
সে
রাতে বাইরেই বসে ছিল পরী। তার চোখে জল এসেছিল কিনা তা আমি জানি না। শুধু এইটুকু
জানি, ওই দূরের আকাশের দিকে তাকিয়ে সে রাতেও
সে নিজের ঠাম্মার সাথে অনেক কথা বলেছিল। কখন যেন দুচোখ বন্ধ হয়ে এসেছিল তার সে
জানে না তা।
চোখ
খুলে দেখলো মাঝরাতে বিছানায় সযত্নে কে যেন শুইয়ে দিয়েছে তাকে। গায়ে চাদর জড়ানো।
উঠে
বসে বাইরের আকাশের দিকে চোখ গেলো তার। সূর্য তখন সোনালী আভা সবে ছড়ানো শুরু করেছে।
পাখীরা বাসা ছেড়ে ওড়ার প্রস্তুতি করছে বোধহয়। হাওয়া এসে জানলার পর্দাকে দোলা দিয়ে
যাচ্ছে বারবার। একটু দূরে সোফার ওপরে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে ইন্দ্রনীল। বিছানা ছেড়ে
উঠে দাঁড়ালো পরী। চাদর নিয়ে খুব ধীরে জড়িয়ে দিলো নিজের জীবনসঙ্গীর গায়ে। আর কি
ভেবে দাঁড়িয়ে দেখলো একমুহূর্ত তাকে।
ছেলেমানুষের
মতো সারল্য তার মুখে ছেয়ে আছে। নিজের না করা দোষের ভাগী হয়ে কত অনুতপ্ত সে আজ।
সবটাই
লুকিয়ে সে যেতে পারতোই। জগতে এমন কত ঘটনা রোজ ঘটে চলেছে জানে পরী। কত মেয়ে কত ভাবে
বঞ্চিত হচ্ছে রোজ। বঞ্চনা লাঞ্ছনা গঞ্জনায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে কত জীবন নিত্যদিন।
অথচ
এখানে নিজের না করা দোষের শাস্তি সত্যিই কি দেবে তাকে পরী, না কি তার হাত দুটো নিজের হাতে নিয়ে বলবে, "তোমার আমার দোষ গুন সবটাই আমাদের হবে। এমনটা তো বিয়ের পরেও হতে
পারতো। তখন কি তোমায় ছেড়ে আমি চলে যেতাম! না কি আমার আজ কিছু হলে তুমি আমায় ছেড়ে
দেবে ইন্দ্র।"
মনের
কথা কি চোখের ভাষায় বোঝা যায়! কে জানে!
কারণ
সে দিন পরী কি সব মনের কথা বলতে পেরেছিল ইন্দ্রনীলকে, না কি স্নান সেরে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে উঠিয়েছিল যখন ইন্দ্রকে, সব উত্তর পেয়ে গিয়েছিল সে বুঝি।
তারপরের
দিনগুলো কিন্তু বড্ড অন্য রকম ভাবে কেটেছিল। পরী নিজের নতুন সংসারের সবটুকু দায়িত্ব
নিজের ওপরে ধীরে ধীরে নিয়ে নিয়েছিল। ইন্দ্রনীলের বাবা মা জেঠু জেঠিমা সবাই অবাক
হয়েছিল আর মুগ্ধ চোখে দেখেছিল এমনটাও হয়।
একটা
মেয়ে কোনদিন মা হতে পারবে না জেনেও ভেঙে পড়েনি একটিবারের জন্যও। পরীকে বুকে জড়িয়ে
শুধু ইন্দ্রর মা একটি কথাই বলেছিল, "তোকে অনেক আশীর্বাদ
করি বৌ। আমার ইন্দ্রকে দেখিস তুই।"
তারপর!
তারপর পরী নিজেই মনে করতে পারে না আজ কি কি হলো তার জীবনে। একের পর এক ঘটনার ঢেউ
এসে ভাসিয়ে নিয়ে গেছিলো পরীকে।
পরী
কি সে দিনের পরে আর কোনদিন মন খারাপের হাওয়ায় ভেসে ছিল, তা কই, মনে করতে পারে না তো
সে।
শুধু
মনে আছে ওই বিয়ের ঠিক তিনমাস পরে একদিন ছোট পিসি এসে একেবারে সদ্যজাত এক শিশুকে
তার কোলে দিয়ে বলেছিলেন, "এ কে আর কোথা থেকে
এলো সে কথা পরে বলছি। আগে নে তো একে কোলে।"
হতপ্রভ
পরীকে কিছু বলার অবকাশ না দিয়েই ঘরের বাইরে চলে গেছিলেন পিসিমনি।
পরে
জেনেছিল পরী এই শিশুর জন্মের সময়েই তার মায়ের মৃত্যু হয়। পিসিমনির নিকট আত্মীয়
তারা। সবরকম কথা বার্তা বলেই আজ তাকে নিয়ে এসেছে এখানে পিসি।
বাড়ির
সবার সম্মতি আগেই ছিল। শুধু পরী কি বলবে সেই ভয়টাই সবাই পাচ্ছিল।
তারপর
সেই শিশুকে বুকে জড়িয়ে বেঁচেছিল তো সে এত কাল। পরী তার মা হয়ে উঠেছিল নিজের সবটুকু
সত্বা দিয়ে। যারা জানতো না কেউ বিশ্বাস করতে চাইতো না যে পরী ওর মা নয়।
সেই
মেয়ের নামও রেখেছিল সে নিজে। বাধা দেয় নি কেউ বরং খুশী হয়েছিল সবাই। নীলা হ্যা এই
নামই তো রেখেছিল সে। আর সবার আড়ালে ইন্দ্রর কোলে দিয়ে বলে উঠতো, "আমি জানি তুমি ওকে আমার চেয়েও অনেক বেশী ভালবাসো।"
ইন্দ্র
অবাক হয়ে দেখতো পরীকে। আর বুকে জড়িয়ে নীলাকে বলতো, "তোর
মা-টা জানিস একটা পাগলী একদম।" ছোট্ট নীলা খিলখিল করে হেসে বাবার বুকে মুখ
লুকোতো।
কেটে
গেলো দিনগুলো স্বপ্নের পাখায় ভর করে। বড় হয়ে গেলো কবে যেন নীলা আর এই বাড়ির সবার চোখের
মণি হয়ে উঠলো সে।
কিন্তু
আবার যে পরী আজ একা। গতকালই বিয়ে হয়ে চলে গেছে নীলা নিজের নতুন সংসারে। আজ বড্ড
একা লাগছে কেন তার! সেই অনেক বছর আগের সেই ছোট্ট নীলা যেদিন প্রথম তার কোলে এসেছিল
সেই দিনটা ভেসে ভেসে আসছে কেন বারবার চোখের সামনে।
কেন
পরীর বুক ভেঙে আজ কান্না আসছে এত! নীলাকে তো সে জন্ম দেয় নি, তবে এই এত কষ্ট কেন হচ্ছে তার!
দূর
আকাশের এক জ্বল জ্বলে তারা এসে দাঁড়ালো ঠিক তার অশ্রুভেজা চোখের সামনে। দেখলো পরী
দু'চোখ মুছে ঠাম্মা দাঁড়িয়ে আছে ওই অনেক
দূরে আর মিষ্টি হেসে বলছে, "জন্ম না দিয়েও মা
হওয়া যায় রে পরী! তুই তো নীলার সত্যি সত্যি মা! শুধু যে নিজের মা এত ভালবাসতে পারে
রে! তোর নিজের শরীর থেকে ওর জন্ম হয়নি বটে,
কিন্তু
আজ এই একুশ বছর বুকের মাঝে আগলে তুই যে ভাবে মানুষ করেছিস, তা শুধু এক মা পারে যে।"
কান্নার
মাঝেও একটু শান্তি পেলো আজ যেন সে। কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে দেখলো
পরী। ইন্দ্র দাঁড়িয়ে আছে পরীর ঠিক পেছনে।
পরীকে
নিজের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে বললো ইন্দ্র,
"আজ
তো সময় আছে তোমার কাছে। আমাকে একটা গান শোনাবে পরী!"
ভেসে
গেলো ওই কালো মেয়েটা নিজের প্রিয়তমের বুকের মাঝে ...
জলে
ভাসা চোখেরা আজ আর কোন বারণ মানলো না সেই কত কত যুগ পরে আজ প্রথমবার পরী সত্যি
সত্যি ডানা মেলে উড়লো আর ভাবলো ... নাঃ
ঠাম্মা ঠিকই বলেছিল , রাজপুত্রেরা আসে বৈ
কি এমন পরীদের জীবনে .... শুধু সময়ের অপেক্ষা !
চন্দ্রাণী মিত্র বোস
চন্দ্রাণী মিত্র বোস: কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন