আরশোলা



গল্প


পর্ব এক

"বসুন"।
"কোথায়? এই চেয়ার টা তে?"
"আপনার যেটাতে ইচ্ছে সেটাতে বসুন। ....বলুন এবার।"
"...মানে আমি একটু সমস্যায় পড়েছি। আমার নাম.."
"জানি, আপনার ফিল আপ করা ফরম টা আমি পড়েছি, বলুন"।
"....কি যে সমস্যায় পড়েছি, কি যে ঝামেলা, আপনি বিরক্ত হতে পারেন..."
"বিরক্ত হবো না, বলুন।"
"...মানে আমি না হঠাৎ হঠাৎ করে একটা আরশোলা কে দেখতে পাচ্ছি, মানে আরশোলা টা যদি actually নাও থাকে তাও দেখতে পাচ্ছি।"
"আরেকটু ব্যাখ্যা করুন"।
"....মানে ধরুন হঠাৎ দেখলাম আরশোলা টা আমার সামনের টেবিলটাতে ঘুর ঘুর করছে। আরশোলা তে আমার খুব ঘেন্না। ধরুন আপনার টেবিলের এই মোটা বইটা দিয়ে এক ঘা কষিয়ে দিলাম। আর ওটাও থেঁতলে গেল। পরে আবার ওটাকে দেখলাম ধরুন ওই বুক সেল্ফএর কাছে। ঘুরে বেড়াচ্ছে।"
" একই আরশোলা? আপনি কি করে বুঝলেন? আপনি কি আরশোলা দের আলাদা করে চিনতে পারেন নাকি?"
"এই আরশোলা টাকে চিনতে পারি। এটার চলা-ফেরা অন্যরকম। শুঁড় গুলো ছোট-বড়। ডানদিকের পাখনা টা একটু ছড়ানো। প্রতিবারই এটা একই রকম ভাবে থেঁতলে যায়। মানে, ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন তো? মানে একটাই আরশোলা বার বার ফিরে আসছে, মারতে পারছিনা, মানে মরছে না। মানে কিছুতেই...."
"বই-টোই পড়েন? কাফকা?"
"সে কলেজে থাকতে পড়েছি, 'মেটামোরফসিস'এর কথা বলছেন তো? না, সে রকম নয়, আমি আরশোলা হয়ে যাচ্ছি না, মানে...."
"আপনি কি করেন, মানে আপনার পেশাটা কি?"
"এঞ্জিনীএরিং কলেজে পড়াই, ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেফটি আর রিলেটেড সাবজেক্টস।"
"আপনি বিবাহিত? সন্তান আছে?"
"হ্যাঁ, একটা মেয়ে আছে।"
"কত বয়স?"
"৬ বছর।"
"এই বিশেষ আরশোলা টা আপনাকে কতদিন বিরক্ত করছে?"
"তা ধরুন মাস ছয়েক। এর মধ্যে ওটাকে আটবার মেরেছি আমি। প্রতিবারই ওটা ফিরে এসেছে। আমার খাওয়া, ঘুম নষ্ট হয়ে গেছে, বুঝতে পারছেন তো, একটা আরশোলা..শালা কিছুতেই মরছে না।"
"প্রথমবার কোথায় দেখেছেন ওটাকে?"
"হলদিয়াতে, ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেফটি নিয়ে একটা সেমিনারে বক্তৃতা দিচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখি মাইকের সামনে ওটা ঘুর ঘুর করছে। হাতের কাছে জলের গ্লাস ছিল, ভর্তি, সেটাই ওর ওপর চাপিয়ে দিলাম। গ্লাস ভেঙে জল-টল ছিটিয়ে একসা। ওটা কিন্তু থেঁতলে গেল। দেখি সবাই কি রকম অবাক হয়ে আমায় দেখছে। আর লেকচার দিতে পারিনি। খুব ঘেন্না করছিল। হাতে লেগেও ছিল খুব। খুব ইচ্ছে করছিল হাত ধুতে।"
"তারপর আবার কবে দেখলেন?"
"তার ঠিক তিনদিন পর। ফুচি, মানে সংহিতা, মানে আমার মেয়ের জন্মদিন ছিল। আজকাল কেক না কাটলে জন্মদিন হয় না। তারওপর একটা নতুন জিনিস বেরিয়েছে। প্লাস্টিকের চোঙা, জোরে ঠুকলে ফেটে গিয়ে কুচি কুচি কাগজ বেরোয়। ওই একটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। ফুচি মোমবাতিতে
ফুঁ দিলেই আমি ওটা ফাটাব। ঠিক তখনই আমি আবার দেখলাম ওটাকে। কেকের ওপর ঠিক 'হ্যাপি' আর 'সংহিতার' মাঝখানে ওটা নড়ছে। ওটার শুঁড় গুলো 'সংহিতা' লেখাটাকে ছুঁয়ে রয়েছে। আর থাকতে পারলাম না। হাতে ধরা চোঙা টা বসিয়ে দিলাম। ওটা যথারীতি থেঁতলে গেল। কেক-ফেক চারী দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে একসা। দুম করে চোঙা ফেটে চারিদিকে কাগজ ছিটিয়ে এক বিশ্রী ব্যাপার। ফুচি ভ্যা করে কেঁদে দিল। দেখা দেখি বাকি বাচ্চা গুলোও কাঁদতে শুরু করল। এম্বেরসমেন্ট টা একবার ভাবুন! নমি, মানে আমার স্ত্রী কোনও রকমে ম্যানেজ করল। মানে...."
"আমার কথা আপনাকে কে বলল?"
" দেবাশীষ, মানে দেবাশীষ পাল। আচ্ছা আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি? মানে, আমার কিন্তু আর কোনও অসুবিধা নেই, দিব্যি খাচ্ছি-দাচ্ছি, কাজ করছি। খালি ওই আরশোলা টা..."
"আপনার স্ত্রীর পুরো নাম টা কি? কি করেন?"
"নমিতা। এসিস্টেন্ট প্রফেসর, মানে সোসিওলজি র, মানে সরকারী কলেজে পড়ায়।"
"লাভ marriage?"
"হ্যাঁ।"
"কোথায় আলাপ হয় ওনার সাথে?"
" ও আমার এক বন্ধুর বোন। ওদের বাড়িতে যাতায়াত ছিল। ওদের বাবা-মার আপত্তি ছিলোনা। তাই....আমাদের বিয়ে হয়েছে প্রায় বছর দশেক।"
"স্ত্রী কে ভাল বাসেন?
" .....মানে সেতো বাসি। মানে..."
"কেমন সম্পর্ক আপনাদের?"
"মানে...সম্পর্ক তো ভালোই, মানে .....'
"আপনার বাবা-মা?"
"বাবা মারা গেছেন বছর পনের। মা থাকে ভাইয়ের কাছে, চুঁচরো তে"।
"মা আপনার বাড়িতে আসেন?"
"মা আসলে আসতে চায়না। ফ্ল্যাটে নানা রকম অসুবিধে, পুরোনো দিনের লোক তো, মানে আজকালকার ধরণ-ধারণ , মানে...কমোড-টমোড, মানে.... বোঝেনতো...."
"আপনার ভাই কি করেন?"
"ডিমের ব্যবসা। বিয়ে করেনি। চলে যায় কোনো রকমে। লেখা-পড়া ওর দ্বারা হয়নি।"
"আপনাদের নিজেদের বাড়ি?"
"না, ভাড়াবাড়ি। একতলায় একটা ঘর। বাথরুম বাইরে"।
"বাবা কি করতেন?"
"সে রকম কিছু নয়, বড়বাজারে এক মারওয়ারীর গদিতে হিসেব রাখার কাজ। লোক ভাল ছিল জানেন, আমার বাবা ভাল শ্যামাসঙ্গীত গাইত, চমৎকার হাতের লেখা ছিল।"
"ছোটবেলায় বেশ স্ট্রাগল করেছেন তাহলে।"
"স্ট্রাগল? হয়তো...সেরকম টের পাই নি জানেন!
পড়াশোনায় বেশ ভালো ছিলাম। এঞ্জিনীরিং পড়েছি সরকারী কলেজে। বাড়িতে সবসময় একটা আনন্দের পরিবেশ ছিল। মা আমাদের একদম বকতেন না, বাবাও না। অভাব খুব একটা টের পাইনি। খুব একটা চাহিদাও ছিলনা। তারপর বাবা মারা গেল......"।
"আপনার স্ত্রী র সাথে আপনার মার সম্পর্ক কেমন?"
"...সম্পর্ক..., মানে ভালোই তো। মানে ঝগড়া-টগড়া
কখনো হয়নি। আমার মা ঝগড়া করার লোকই নয়। মাঝে-মধ্যে কথা হয়, এই ধরুন বিজয়ায়।"
"বুঝলাম, তা আপনি মাকে টাকা-পয়সা পাঠান?"
"না, আগে দু-একবার পাঠিয়েছিলাম, ফেরত দিয়ে দিয়েছে। ভীষণ অবুঝ"
"হুঁ, আচ্ছা, আপনি আর আপনার স্ত্রী কি একসাথে শো'?"
"...একসাথে, মানে, নমিতা আর ফুচি একঘরে শোয়, আমি আরেক ঘরে, মানে আমার আবার রাত জেগে পড়ার অভ্যেস, মানে...ওদের অসুবিধে হতে পারে, মানে....কম হলেও ও আমার ঘরে আসে, মানে কখন-সখনো..."
"শেষ কবে এসেছিল?"
"শেষ কবে? এই ধরুন মাস ছয়েক হবে"।
"আপনার স্ত্রীর সাথে কথা বলা দরকার। এখন বলা যাবে?"
"ও তো, মানে এখানে নেই এখন, মানে আউট অফ স্টেশন, মানে ভুবনেশ্বর গেছে। কি একটা সেমিনার আছে। দু দিনের জন্য।"
"আপনার মেয়ে, সে তো বেশ ছোট, সেও কি গেছে, নাকি...."
"ওর আয়া মাসি আছে, অসুবিধা নেই।"
"একা গেছেন, আপনার স্ত্রী?"
"মানে ঠিক একা নয়, মানে সঙ্গে আরেকজন আছে, মানে কলীগ।নাম ...প্রকাশ মাইতি। ওদের কলেজে ই পড়ান।"
"কত বয়স?"
"কার?"
"আপনার স্ত্রীর?"
"ছত্রিশ।"
"আর প্রকাশ মাইতির?"
"ঠিক জানিনা, এই বছর পঁয়তাল্লিশ।"
"এই প্রথম গেলেন আপনার স্ত্রী?"
"নাহ, মাঝে মাঝে যায় আর কি! মানে বোঝেনই তো, মানে সেমিনার তো, তাই...."
"আপনার খারাপ লাগেনা?"
"না, খারাপ লাগার তো কি কিছু নেই, মানে যেতে তো পারেই, মানে....আমার খারাপ লাগলে কি যায়-আসে! জোর করে আটকে রাখব, তাতো সম্ভব নয়!"
"কথা বলুন স্ত্রী র সাথে, বলুন আপনি এটা পছন্দ করেন না। বলেছেন কখনো?"
"হ্যাঁ, বার দুয়েক। ওদের কলেজ থেকে একজন ফোন করেছিল, নাম বলেনি। ।  ....গোটা কলেজ এ ঢি ঢি পড়ে গেছে, স্টুডেন্টরা ওদের নিয়ে হাসা-হাসি করে। আমি বললাম ওকে...বললাম এসব চলবেনা। তুমুল ঝগড়া হলো। ওর এক বন্ধু উকিল। আমায় ফোর নায়েন্টি এইট এর ভয় দেখিয়েছে। আমি আর কিছু বলিনি। আমি পেরে উঠবো না। তার চেয়ে এই ভাল। দিন কেটে যাচ্ছে। খালি আরশোলা টা...আপনি আমায় বলুন ওটার হাত থেকে কি করে মুক্তি পাব।"
"শেষ কবে দেখেছেন আরশোলা টাকে?"
"এই দিন তিনেক আগে। বাথরুমের আয়নাটার সামনে ঘুরে বেড়াছছিলো। টোকা দিয়ে নিচে ফেলে দিলাম, তারপর পা দিয়ে থেঁত করে দিলাম। কি যে আনন্দ!"
"তারপর আর দেখেননি?"
"না।"
"রাতে ঘুম হয়?"
" আগে হোত, এখন ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুম হয়, জেগেই থাকি বেশির ভাগ।"
" স্বপ্ন দেখেন? কোন বিশেষ স্বপ্ন, বার বার একই স্বপ্ন?"
"না, স্বপ্ন-topn দেখিনা। সে সব চুকে গেছে বহু দিন"
"বেড়াতে যান? ছোট খাট আউটিং? এই ধরুন দিঘা কি শান্তিনিকেতন? আপনারা তিন জন।"
"আগে দু-একবার গেছি। এখন সময় পাইনা।"
"উইকএন্ড ডিনার? এই একটু বাইরে বেরোনো, খাওয়া, ঘোরা- ফেরা?"
"নাহ, দুজনেরই প্রচুর কাজের চাপ, আমার প্রজেক্ট, ওর খাতা দেখা, কিছু না কিছু লেগেই থাকে।"
"সকালে চা খান একসাথে? রাতে ডিনার?"
"রাত জেগে কাজ করি তো, সকালে উঠতে পারিনা। ও আবার খুব সকালে ওঠে, ফুচুর মর্নিং স্কুল, ওকে রেডি করতে হয়, নমি বেরিয়ে যায় ন টা নাগাদ। আমি বেরোই প্রায় সাড়ে এগারোটা। রাতে ফিরতে ফিরতে এগারোটা। তখন মা আর মেয়ে ঘুমোয়। আমার কাছে চাবি থাকে। আমি রাতে খেয়ে আবার কাজে বসি। শুতে শুতে দু টো বেজে যায়। "
"এই রুটিন কতদিন চলছে?"
" তা হবে বছর চারেক।"
"আপনার মেয়ে, ফুচু, তার সাথে আপনি খেলেন, গল্প করেন?"
" মানে...ফুচু...আমাকে একটু ভয় পায়, মানে কাছে আসতে চায় না। ওর যত আবদার ওর মায়ের কাছে আর আয়া মাসির কাছে। আমি খুব চেষ্টা করি ওকে খুশি করার। একটা প্লেস্টেশন কিনে দিয়েছি। কিন্তু তবু ...."
"আপনি তো খুব নিঃসঙ্গ লোক মশাই! যাকগে,
আপনি এক কাজ করুন, কয়েক দিন একটু ঘুরে আসুন চুঁচরো থেকে। মা'র সাথে দু এক দিন কাটান। আর একটা ওষুধ দিচ্ছি, রাতে খাবার আগে খাবেন। ভাল ঘুম হবে। দু সপ্তাহ পরে আসুন, আবার কথা হবে। একটা কথা মনে রাখবেন, ভাল থাকতে গেলে ভাল থাকার চেষ্টা করতে হয়, ভাল বাসতে হয়। আজ থেকে ভাল থাকার চেষ্টা করুন। তারপর.... দেখা যাক।"


পর্ব দুই

"ফুচু, আমরা আজ রাস্তাতেই সূর্য ওঠা দেখব।"
"বাবা, তুমি সূর্য ওঠা দেখেছ?"
"হ্যাঁ, আমি আমার বাবার সাথে প্রত্যেক মহালায়ায় গঙ্গায় যেতাম, তখন ঘাটে বসে সূর্য ওঠা দেখতাম। তোর মার সাথে দেখেছি দিঘা তে।"
"খুব ভাল?"
" হ্যাঁ মা, খুব ভাল লাগে।"
"বাবা আমরা ঠাম এর কাছে কেন যাচ্ছি?"
"এমনি ঘুরতে, অনেকদিন ঠাম কে দেখিনি, ঠামও তোকে অনেকদিন দেখেনি, কাকাই তোকে দেখেনি, তাই।"
"এই রাস্তাটা ঠাম এর বাড়ী যায়?"
"হ্যাঁ, এটার নাম দিল্লী রোড, এটা দিয়ে সোজা গিয়ে তারপর আরেকটা রাস্তা ধরতে হবে। তারপরেই বাড়ি।"
"বাবা, তারের ওপর কালো কালো ওগুলো কি পাখি?"
"ওগুলো ফিঙে পাখি, লেজটা কি রকম দেখেছিস?"
"হ্যাঁ, মাঝখান থেকে কাটা। ওগুলো কি খায়?"
"পোকা-টোকা ধরে খায়"।
"আরশোলা খায়?"
" ..........জানিনা, তোর খিদে পেয়েছে? কিছু খাবি?একটু পরেই একটা মোড় পরবে, ভাল মিষ্টি পাওয়া যায়। চল দুজন মিলে খাব।"
"বাবা, একটা কথা জিজ্ঞেস করব? তুমি বকবে না তো?"
"না মা, তোর যা খুশি তুই জিজ্ঞেস কর"
"বাবা তুমি কি পাগল হয়ে গেছ?"
"...............কেন বলত? তোর এরকম মনে হল কেন?"
"সে দিন সখী মাসি বলছিল। মা খুব কাঁদছিল আর বলছিল দিদি আমি আর পারছিনা। এভাবে আমি আর বাঁচব না। তখন সখী মাসি বলল একটা পাগলের সাথে থাকার কোন দরকার নেই। মনে রাখিস আইন তোর সাথে আছে, আমি তোর সাথে আছি। সখী মাসি খুব রাগ করেছিল।"
" না রে, আমি পাগল নই। খালি একটু একলা হয়ে গেছি।"
"কেন? আমি আছি, মা আছে, সবাই তো আছি।"
"ঠামকে কিন্তু এসব বলিস না। চিন্তা করবে।"
" ঠিক আছে। বাবা পাগল কি করে হয়?"
" ঠিক জানিনা রে। কারুর কারুর কাজ-কর্ম, চলা-ফেরা একটু অন্য রকম হয়ে যায়। বাকিদের মত আর থাকেনা। তখন তাদের ব্যাপার-স্যাপার বাকিরা বুঝতে পারে না। তখন কেউ কেউ তাদের পাগল বলে।"
" আমি কিন্তু সব বুঝতে পারি। তুমি যখন মার দিকে তাকিয়ে থাক, আমার দিকে তাকিয়ে থাক তখন ঠিক বুঝতে পারি।"
"কি বুঝতে পারিস?"
"তুমি আমাদের খুব ভালবাস।"
" কিন্ত তোর মা তো আমার ওপর রাগ করেছে। কথাই বলেনা। আচ্ছা, ধর এরকম যদি হয়, তোকে নিয়ে আমি অনেক দূরে চলে যাই, শুধু তুই আর আমি। তুই যাবি আমার সাথে? খালি আমরা দুজন।"
"মা যাবে না?"
"না।"
" মা খুব কষ্ট পাবে। আমি মাকে ছেড়ে যাব না।"
"আর তোর মা যদি তোকে নিয়ে চলে যায়, আমায় ফেলে রেখে?"
"আমি যাব না।  মাও যাবে না। ।"



পর্ব তিন

" কি রে তুই? এত সকালে? সঙ্গে ফুচু...হ্যাঁরে সব ঠিক আছে তো? আয় আয় ভেতরে আয়।"
"সব ঠিক আছে। মা কোথায়?"
"চানে গেছে, ডাকছি।"
"থাক, ডাকতে হবে না। তুই কাজে বেরস নি এখনও?"
"এই বেরোচ্ছিলাম, তারপর....একটা খবর দিলি না আগে! বৌদি ভাল আছে তো?"
"চমৎকার আছে, ও গেছে ভুবনেশ্বর, সেমিনার এটেন্ড করতে, ফুচুর স্কুল ছুটি। তাই আমরা দু জন চলে এলাম। ভোর বেলা বেরিয়েছি। ফাঁকা রাস্তায় ড্রাইভ করার মজাই আলাদা। রাস্তাটা বেশ ভাল বানিয়েছে। "
" সে বেশ করেছিস। হাত-মুখ ধো, গুছিয়ে বস। আমি চট করে একটু বাজার থেকে ঘুরে আসি।"
"যাবিখন, এখন বস। তোর ব্যবসা কেমন চলছে? বাইরে দেখলাম একটা মোটরবাইক দাঁড়ান, তোর?"
" হ্যাঁ, মাস দুয়েক হোল কিনেছি, মাল ডেলিভারি করতে সুবিধে হয়।ব্যবসা চলছে মোটামুটি।"
"শোন, আমার একটা খুব জরুরি কাজ আছে, বাইরে যেতে হবে। ফুচু আজ এখানেই থাকবে। ওকে একা একটা পুরো দিন আয়ার কাছে রাখতে ইচ্ছা করল না। বেচারা! তুই সময় পেলে ওর সাথে একটু গল্প করিস। আমি কাল এসে ওকে নিয়ে যাব। হ্যাঁরে তপু, তুই এখনও ঘুড়ি ওড়াস? পারলে একবার ওকে একবার ঘুড়ি উড়িয়ে দেখাস তো! আমার দ্বারা এসব তো আর হলো না। মার জন্য আর অপেক্ষা করছি না। খুব তাড়া আছে। তুই মা'কে বুঝিয়ে বলিস।"
" দাদা দাঁড়া। তোর ব্যাপার কি বলত? কি হয়েছে? কোথায় যাচ্ছিস? আমি তোর সঙ্গে যাবো। তোকে একা ছাড়ব না।"
" চিন্তা করিস না। একটা প্রজেক্ট হঠাৎ আটকে গেছে। একটা ছোট সল্যুশন মাথায় এসেছে। কাজ সেরে কাল আসব। তুই মাকে বুঝিয়ে বলিস।"



পর্ব চার

" প্রকাশ দা আমি ওদের বুঝিয়ে বলেছি। মনেতো হচ্ছে খানিকটা কনভিন্সড। কমবয়সী মেয়ে গুলো অনেক বেশি রেস্পনড করছে। যত সমস্যা বৃদ্ধা দের নিয়ে। এরা কিছুতেই নিজেদের প্র্যাক্টিস বদলাবে না। তোমার কাজ কতদূর? গ্রাম প্রধান কনভিন্সড?"
"নাহ, প্রায় রাজি হয়ে গিয়েছিল। এর মধ্যে ওর ছোট ছেলে এসে হাজির। এক কানে ইয়ারফোন গোঁজা, হাতে বালা, এসেই গোলমাল পাকাল। বাপের সাথে  টাকা নিয়ে ঝগড়া, মাঝখান থেকে আমার আর কথা বলা হলোনা।  দেখি....বিকেলে আরেকবার চেষ্টা করব। তা তুমি হঠাৎ চললে কোথায়?"
" সামনের ওই টিলাটার ওপর, একমাত্র ওখানেই টাওয়ার পাওয়া যায়। মেয়েটার সঙ্গে একটু কথা বলব।"
"এর পরের বার থেকে তুমি ওকে নিয়ে এসো সঙ্গে করে। সঙ্গে কর্তা কেও। দেখো, ওদের ভাল লাগবে।"
" ফুচুর বাবা? অসম্ভব! ওর কাছে ওর কাজ ছাড়া বাকি আর কোনো কিছুরই মূল্য নেই। সে আছে নিজের কাজ নিয়ে। মেয়েটা বড্ড একা হয়ে যায় আমি না থাকলে।  আমি যাই, প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। রাতে ট্রেন কটা য়?"
"সাড়ে নয়টা, এই সাত টা নাগাদ বেরোব। যাও তুমি আর দেরি করোনা।"
.......
" হ্যালো, তপু, অনেক গুলো মিস কল দেখলাম তোমার নম্বরে, কি ব্যাপার? ... আমি ঠিক আছি... সেকি! কোথায় গেল? ফোনে পাচ্ছ না? আরে আমি যেখানে আছি সেখানে ফোনের টাওয়ার নেই। অতি কষ্টে ফোন করছি। ফুচু কে কিছু বলেছে? ...কেউ কিছু জানেনা! আর পারিনা বাবা! তোমরা আটকে রাখতে পারলে না! আচ্ছা আমি দেখছি, দেখি পুনুর মাকে ফোন করে বাড়িতে গেছে নাকি। আমি তোমায় জানাব।"



পর্ব পাঁচ

"আপনি প্রকাশ মাইতি? আমার একটু কথা ছিল আপনার সাথে।"
"কে? আরে ব্রাদার, কি ব্যাপার! হোয়াট এ প্লেসন্ট সারপ্রাইস! এই তোমার কথাই বলছিলাম। আমি নমিকে বার বার বলি তোমায় নিয়ে আসতে। আমাদের কাজ তুমি দেখবে, তোমার ইনপুটস দেবে, তবে তো কাজে আনন্দ। তাছাড়া জায়গাটা তো চমৎকার। তা ফুচু কে আনো নি?"
"আপনি আমায় চেনেন?"
"বল কি! তোমার বিয়েতে খেলাম, ফুচুর মুখেভাতে খেলাম, তোমায় চিনব না! কি ব্যাপার বলত? তুমি কি কোনো কারনে টেনশনে আছ? ফুচু ঠিক আছে তো? তোমার মা ঠিক আছেন? গাড়ি নিয়ে এসেছ দেখছি, এতটা নিজেই ড্রাইভ করলে!"
"সবাই ভালো আছে। ফুচু কে মার কাছে রেখে এসেছি। নমি কে দেখছিনা?"
"ওই তো সামনের টিলা টার ওপর। ওখানেই খালি মোবাইলের টাওয়ার পাওয়া যায়। যাও না, দেখা করে এস। ওখান থেকে এলাকাটার একটা ভাল ভিউ পাবে।"
"শহর থেকে এত দূরে, আপনারা ....."
"আহা, শহরে এদের আর পাচ্ছি কোথায় বলো। এই গ্রাম টা কোন্দ দের। এরা এখনো এদের অতিপ্রাচীন জীবন-যাপন পদ্ধতির অনেকটাই অপরিবর্তিত রেখেছে। এদের নিজেদের ভাষা আছে,  আইন আছে, নিজস্ব সংস্কৃতি আছে। নমির রিসার্চের জন্য এর চাইতে ভাল জায়গা আর নেই। এখানে আমার একটা প্রজেক্ট চলছে, হেলথ এন্ড স্যানিটেশন এর ওপর। WHO থেকে আমরা বেশ ভালোই সাহায্য পাচ্ছি, তাছাড়া ডিস্ট্রিক্ট এডমিনিষ্ট্রেশন আমাদের হেল্প করছে। তাই ....। তোমায় নমিতা বলেনি এসব?"
"আমি...মানে বলেছিল, মানে...আমি যাই নমির সাথে দেখা করে আসি।"


পর্ব ছয়

" তুমি এখানে? ওদিকে তপু, মা, দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে আছে। কাউকে কিছু বলে আসোনি। তোমার কি কোন কাণ্ডজ্ঞান নেই!....
আচ্ছা, তুমি জানলে কি করে আমি এখানে? আমি তো তোমায় বলিনি!"
"নমি.....নমি...আমি মানে..."
"ঠিক করে বল, তুমি কি করে জানলে? সখী দি বলেছে, তাইত! শুনেই চলে এলে গোয়েন্দাগিরি করতে। তা কি দেখলে? তোমার বউ কতটা খারাপ বুঝতে পেরেছো তো?"
"আমি এসেছি শুধু তোমার কাছে আসব বলেই, আর কোন কারন নেই।"
"মিথ্যে কথা বোলোনা। কে কোথা থেকে একটা ফোন করল আর তুমি...,ছি:"
"তুমিও তো আমায় কিছু বলোনি, আমি..."
"তোমার সাথে কথা বলা যায়! আমার আর ফুচুর কোনো অস্তিত্ব আছে তোমার জীবনে! তোমার লজ্জা করেনা আমায় প্রশ্ন করতে! আমার অনেক সৌভাগ্য প্রকাশ দা রাজি হয়েছেন আমার থিসিস সুপারভাইস করার জন্য। তুমি কিনা তাকেই ..."
"নাহ, লজ্জা করেনা। আমি লজ্জা পাবার অবস্থায় নেই। আমার খালি একা লাগছিল। ভীষণ একা, অসহায়। তাই ....., "
" দেখেতো মনে হচ্ছে সারাদিন খাও নি কিছু, চল, আমার কাছে বিস্কুট আছে। আগে তপু কে একটা খবর দি। ওদিকে সবাই খুব চিন্তা করছে।"
পর্ব 7
"হ্যালো, ডাক্তার বাবুর সাথে একটু কথা বলতে চাই।"
"উনি এখন পেশেন্ট দেখছেন। কথা বলবেন না।"
" আচ্ছা, একটা খবর দেওয়া যাবে ওনাকে?"
"বলুন..., আগে আপনার নামটা বলুন।"
"নাম বললে কি আর চিনতে পারবেন! খালি বলবেন আরশোলা টা আর নেই, মানে মরে গেছে, মানে পার্মানেন্টলি নেই। বুঝেছেন তো। আর কোন প্রবলেম নেই।"
"কে আপনি ইয়ার্কি করছেন! "
" না না ইয়ার্কি নয়। সিরিয়াসলি, আরশোলা টা.. মানে উনি জানেন....আরশোলা টা.."

রজত ভট্টাচার্য: কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন