বরফের মুকুটে বরফের কথামালা



ভ্রমণকাহিনী

অনেক লড়াই-ঝগড়া করে তবে আমি একটা শৈলশহর দ্যাখাতে পেরেছি, আমার শাশুড়ি মা’কে।আমার শ্বশুরবাড়ির সবাই ঘরকুনো। এদিকে আমার পায়ে সর্ষে। নিজেও ঘরে থাকতে পারিনা আর কাছের মানুষদের ঘরে থাকতেও দিই না।  সালেমের কাছে ইয়েরেকুদ। বাচ্চা উটি। সরবরে নৌবাইচ আর পাশে গুলাবের বাগিচা। চা নেই গলফ কোর্স নেই। উটি ব্রিটিশের শহর। জেল্লাই আলাদা। দুই মিনিটে চির স্মরণিকা ফ্যামিলি ফটো। প্রিন্টফটো তো আজকাল সব জায়গাতেই। কন্যাকুমারী যোগ ফলস মুরুদেশ্বর। সব জায়গাতেই। তবে ইয়ারাকুদে, ফটো দিয়ে সাথে সাথে বানিয়ে দ্যায় চাবিরিং, ফ্রেম। পেয়ালা। ভঙ্গুর এবং অভঙ্গুর। আমার মেয়ের হাতের তালুতে বাঁধা ছিল তাজমহল তার শিশুকালে। আর কন্যাকুমারির সূর্যি মামা। মেয়ে এখন পূর্ণনারী। নারীপূর্ণিমা। তবু তার সেইসব ছবিকণা আমাদের মনের ছবকোঠায় বানিয়ে রেখেছে তার ঝর্ণাবেলা। এই যে ভ্রমণগুলি আমাদের। ছোট ছোট তটঘেরা কেরল থেকে তামিলনাদু বা মহারাষ্ট্র। গোয়া ছাড়া কোথাও প্রাকৃতিক বেলাভুমিগুলি মেইনটেইন করা হয় না। তাছাড়া  আরব সাগরের তট বালির আবহাওয়া বঙ্গপসাগরের থেকে মধুর আর ঠাণ্ডা।

২০১৯ আমাদের জীবনে এলো ভ্রমণের ডালি নিয়ে। বইমেলার বার্ষিক তীর্থ-পরিক্রমায় আমরা প্রতিবছর কলকাতায় যাই। বই প্রকাশেরর জন্যে। তারই মাঝে কয়েকফোঁটা  শান্তিনিকেতন দুবরাজপুর। দুরগাপুর। বকখালি বিষ্ণুপুর। পোড়ামাটি। জোড়বাংলো। মদনমোহন। ছিন্নমস্তা।  লঞ্চবিলাস। পিয়ারলেসের দুর্দান্ত লাঞ্চ। তবে এবারের ট্র্যাভেল-মেনু ছিল একদম আলাদা। চণ্ডীগড় থেকে পিঞ্জর। বাগান বাগান। মহীশুর বৃন্দাবন-গার্ডেনের জেরক্স। তারপর কসৌলির সূর্যাস্ত। চম্বাঘাট। পথে ধরম্পুরের হাভেলি।বিরিয়ানি সিজলার। অজস্র অমৃতের স্বাদ। ফেব্রুয়ারির সিমলা। লিফটের তলায় বরফের দোতলা। আর লিফটের দুই তলার ওপর ব্রীজ বা মল। সেখানে আবার বরফ অতখানি  জমাট নয়। ঝুরো ঝুরো। ২০০৪ এ আমরা  মেয়েকে নিয়ে গিয়েছিলাম ছাঙ্গু। তখন মাইনাস পাঁচ ছলছে সেখানে। জ্যাকেট ভরতি আমরা। জিন্সের ভেতরেও ঠকঠক। মেয়েকেও দেওা হল সামান্য বুড়ো সন্ন্যাসী। আমরাও দুজনেও। ঠাণ্ডা সহ্য করতে পারছিল না মেয়ে, কাঁদতে কাঁদতে বলছিল, আমাকে আর এমন জায়গায় এনো না তোমরা প্লিজ, প্লিজ। সেই পুচকিটা এখন বিটেক। কমপ্লিটের মুখে। এখনকার বেড়ানোগুলোতে তাকে আর পাওয়া যায়না।  আমরা দুজন একা এবং একা। দুইজন একা মিলে গেলে কখনো সখনো একটি অপূর্ব আবহ তৈরি হয়। ৮০০ ফুটের অনেক নিচে সিমলা। বরফ বোঝাই। ২৬ শে জনুয়ারিতে নাকি রাস্তা বন্ধ ছিল। মলে বসা হল। কফিগরম। সাথে সরদারজীর পরোটা। চানা-কুলচা। আমাদের পরনে মাঙ্কিক্যাপ। সোয়েটার জ্যাকেট। হাতমোজা পা’মোজা।

সিমলার হোটেলটি ছিল সরু পাহারি রাস্তার শেষে। আমাদের ইনোভা অন্দরে প্রবেশ করছিল না। তাই হোটেল মালিক নিজে আসে আমাদের ভেতরে নিয়ে গেলেন। ড্রাইভারের খাওা দাওা সব মুফৎ। ঘর থেকে দ্যাখা যাছছিল জঙ্গল। সঙ্কটমোচন। মন্ত্রমুগ্ধতার যেন শেষ নেই। আবছা অন্ধকার ঘন আলোর আলেয়া। সিমলার রাত মানেই তুমুল রংগিলা। পরদিন ব্রেকফাস্ট বরফের সাথে। বরফের পাশে। গরমাগরম আলুর পরোটা। অপূর্ব স্বাদ। মাখনে ভেজানো। ছোলে বাহার। আমাদের দিল খুশ অবস্থা। তারপরে আগুনগরম কফি খেতে খেতে বরফদৃশ্যের ঝলকানি। দুপুরে আবার মকাই দি রোটি। সরসো দা শাগ। মাখনরাঙানো। মাত্র সত্তর টাকায় পেটচুক্তি। সেই স্বাদ জীবনেও ভোলা যাবে না। আমাদের ড্রাইভার ছিল অমৃতসরের। তাকে বলে দিয়েছিলাম, আমাদের রোডসাইড ধাবাগুলিতে খাবার খাওয়াতে। নামজাদা রেস্তরাঁয় একদম নয়। সেসব খানা কি আমাদের কম খাওা হয়। তাই আমরা চেয়েছিলাম মাটির গন্ধ। ঝুপড়ির স্বাদ। খুঁটে খুঁটে খাওয়া। সিমলা মানেই হিমালয়ান কুইন ট্রেন। আর ডালাঘাট পেরিয়ে শত্রদ্রু বিপাশা ধরে চার লেন রাস্তার ভিড় সরিয়ে। সাম্নের দিকে অন্তহীন ছুটে চলা। সাম্নেই কাসলের নদীপার। এখানে নাকি সস্তার গাঁজা চরস আর হাসিসের স্বাদ। ছোট ছোট তাঁবুতে রাত্রিবাসের আগুন। হাল্কা থেকে মাঝারি রঙের ধোঁয়া। প্রেম পিরীতি দেশি বিদেশি যুগলের জলবায়ু এবং আবহাওয়া।

ক্যাসলের পাশেই মনিকরন। সেখানে শহুরে  দেওালের একপাশে বরফশিতল ঝর্ণা। অন্য পাশে উষ্ণ প্রস্রবণ। অসম্ভব সব সম্ভবের দিব্যতা। চূড়ান্ত ঠাণ্ডা আবার উষ্ণতাও এমন তুলকালাম গরম যে পুঁটুলিতে চাল বেঁধে সেই জলে কিছুক্ষণ রাখলে ভাত হয়ে যায়।ভাবা যায়? প্রকৃতি এমনি লীলাময়। মনিকরনে বিখ্যাত গুরুদ্বারা। শুধু মনিকরন নয়, মান্দির গুরু গোবিন্দ সিনহের গুরুদ্বারা। আর স্বর্ণমন্দির গুরুদ্বারা, অমৃতসর। ঈশ্বরময় মানবতার জয়জয়গান। সেবাধর্মই প্রকৃত ধর্ম। সস্তায় থাকা, বিনি পয়সার খাওা। হাত পেতে নেওয়া রুটি। আমরা আসলে তো ভিক্ষাজীবী। যত ধনী হই না কেন। মাথা পেতে দিই দুয়ারের। তেষ্টার গেলাস। পিয়াসার জল দুধ। খিদে মুখে ডালরুটি। এই তো জীবন দর্শন আর দর্শনের অনুপান। পেট ভরে খাবার কিন্তু নষ্ট কিছুতে করা যাবে না। কেন না কেউ কেউ খিদেমুখে বেঁচে থাকে, খাবার পায় না। পৃথিবীর সেরা ধর্মের নাম মনে হয় শিখধর্ম। প্রতি সন্ধ্যায় যুবতী স্বামী-স্ত্রী জীবনের স্বাধআহ্লাদ ছুঁড়ে ফেলে সেবাব্রতে ব্রতী হয়।

সেই আবহ থেকে বেরিয়ে এলাম নতুন এক আলাপন নিয়ে। অল্পবিরাম নিয়ে ফের। আরও একবার বেরলাম আমরা। ততক্ষণে সন্ধে নেমেছে মনিকরনে। কনকনে ঠাণ্ডা আবহাওয়া। ঝর্ণার থেকে উঠে এসে আরও শক্তিমান আর জোরালো। আলোতে আলোতে সেজে উঠেছে কুলু উপত্যকা। কুলুতে বিপাশার দুই তীর ধরে রাস্তা। এক রাস্তা শহরের ভেতর দিয়ে। মানালি। অন্যটি অন্য পারে। দ্বিতীয় রাস্তা বেয়ে গাঁ গঞ্জ পেরিয়ে আমরা পৌঁছলাম মানালি। কুলু থেকে একঘর দুই আকাশ বরফের সূত্রপাত। মাহিন্দ্রার রেসোর্তে পৌঁছে দেখি থোকা থোকা বরফের পুঁজিবাদ। সিমলায় রুমহিটার লাগেনি। তাপাঙ্ক ছিল ছয়ের ঘরে। মলের রাস্তায় ছিল চার। মলের ভেতরে দুই। মানালির ঘর উষ্ণতায়  দুই। আমি ভুল করে সেন্ত্রাল এসির নব অন রেখেছিলাম। তাতে গিন্নীর জ্বর-জ্বর।

ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে বিছানা থেকে অপরূপা বরফের বেলাভুমি। লনে পা রাখতেই বরফের আপ্যায়ন। আমাদের জড়িয়ে ধরল বরফের ধবল প্রতিমা। সেই সৌন্দর্য আমরা হরফে গুনেও শেষ  করতে পারি না। বার বার ভুল হয়ে যায় অঙ্ক। ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা বেরলাম সোলানের উদ্দশ্যে। শীতকালে এই এলাকার সমস্যা হল যে বেশির ভাগ রাস্তাই অবরুদ্ধ থাকে। বরফের কারণে। এই সোলানেই পুরো গরমকালটাই গলফ। স্বপ্নিল সাম্রাজ্য। প্যারাগ্লাইদিং থইথই। এখন রিমঝিম বরফ। সরু রাস্তায় হাজার গাড়ি। যত্রতত্র পারকিং। না পুলিশ। না সিভিক। তো এইসব পেছনে ফেলে । মানালিকে বাঁদিকে রেখে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলল। বিপাশায়। পাথরের ওপরে গুঁড়ো বরফ, চার চাকা ড্রাইভ চাই। অগত্যা, নতুন গাড়ি ভাড়া নেওা হল। ড্রাইভার সাহেব জানালেন। তিনি তার এই জিপসিতে দেব, শুভশ্রীকে সফর করিয়েছেন। নানারঙের গল্পের মোরব্বা। যখন সোলান পৌঁছলাম তখন সাড়ে নটা পেরিয়ে গিয়েছে ঘড়ির কাঁটা। স্নোবাইক। স্নোস্কুটার। স্লেজকার। রোপওয়ে। অপূর্ব মনোরম সাদাটে সেইসব গোলাকৃতি রঙ। মনে পড়ে যাচ্ছে। ১৯৮৯ এ এসেছিলাম মা বাবার সাথে। হাওড়া-কাল্কা মেল। তারপর ট্রেন-বাস। সিমলা থেকে বাসে মানালি। পৌঁছোবার পরে মা-বাবার হোটেল খোঁজা। কখনো বাবা একাই। আমি আর মা প্রতীক্ষায়। বরফিলা বরফ বাতাস। হাওয়ার দমকা। তারপর হোটেল গরম বিছানা।কম্বল।

২০১৯ এর ভ্রমণে আমি নায়ক। রেডবাস অথবা মেকমাইত্রিপ। অতএব সম্পূর্ণ টেনশনহীন। সমস্ত কাজ আগে থেকেই গোছানো। বরফের দোলনায় দুলতে দুলতে চা অমলেট টোষ্ট, কুফরির মতো মাখন মাখানো পরোটা সাথে ডিমসেদ্ধ। মাখনের কম্বলে সব খাবারি মাখামাখি। মাখনই গরম রাখে শরীর। আর মূল্য? ফেলো কড়ি মাত্র দেড়শো। মানালি মানেই বাঙালী। ছুটি বিলাস। সোলাং থেকে ফেরামানে ঘণ্টা দেড়েক অপচয়। ততক্ষণে আবহাওয়ার অবনতি। বৃষ্টি শুরু। ফেরার লাইন দীর্ঘ। ফেরার লাইন দীর্ঘতর। গাড়ির পর্যটকেরা নেমে পড়েছে ব্রিজে রাস্তায় বিতস্তায়। বরফে চড়ার নেশাসব। সাধারণ গাড়িদের দেখে আমাদের মাথায় প্রশ্ন ঘোরে, ক্যানো খামকা এই ৫০০০ অপচয়?  উত্তর মিললো একটু বাদে। চার চাকা বড় গাড়ি পুরু বরফের ওপর দিয়ে সর্পিল গতিতে ওপরে। কোচি থেকে গুলাবা। মাত্র ছয়খানা গাড়ি। আমরাই দুজনায়। এই আমাদের প্রথম স্বর্গ দর্শন যেন। সিমলা কুফরির মতো থরে থরে বরফ নয়। যেন শুধু বরফেরই অট্টালিকা। যেদিকে যতদূর চোখ যায় বরফের ক্ষেত। বরফের মাটি। অনাবিল আনন্দে মাতোয়ারা হই। বরফের পুতুল গড়া, বরফ দিয়ে ধুলোখেলা। বরফের রান্নাবাটি। আমরা যেন পঞ্চাশের নই আর। বছর পাঁচেকের দুই শিশু মেতেছি বরফ রাঙানো বরফের পুঁইমাচা আর লতানো হিমশিম। তারপর খেলা ফুরোলে ড্রাইভার অনেক কসরত করে গাড়ি ঘুরিয়ে মানালির দিকে। মানালিতে ঘণ্টা বাজানো রেস্তোরা। মাখন মাখামাখি যাপনপাখি। এই জীবন তো পাখিযাপনই বটে। হিড়িম্বা মন্দির। চাতাল। ছবিতোলা ফটোগ্রাফার।

সন্ধের আসর জমাতে জম জমাট রাঙালী মাছ। ভাত। আর দেশীদারুর সাথে ট্রাউট মাছ ফ্রাই। কিম্বা তন্দুরি। রুইমাছের দাম এখানে খুব বেশি। ট্রাউটের কিলো হাজার দেড়েক। স্বাদ অনবদ্য। ফিরতি পথে নাগরের কিল্লা। প্রাসাদ। মিউজিয়াম। মান্দি থেকে ডালহৌসির দিকে। দূরে বরফ, কাছে টেরেসের চাষ। মায় চা বাগিচা। এখানে। এই এলাকাতেও প্যারাগ্লাইডারদের স্বর্গ। আর র‍্যাফটিং। এক্কেবারে তিস্তা কিম্বা হৃষীকেশ কিম্বা কুমীর প্রধান কালীনদী গনেশগুঁড়ির মতো। পালামপুর মানেই সেই বিখ্যাত সিনেমা রাজা হিন্দুস্থানী। কাশ্মীরের বিকল্পই যেন এই পালামপুর। বলিউডের শুটিংতীর্থ। রাত পোহালাম বানিক্ষেতে। বৃষ্টি হচ্ছে প্রচুর। যেখানে বুকিং ছিল সেই হোটেলের সামনে অনেক জল। সেই বুকিং ক্যান্সেল করে স্পট বুকিং কর হল। অই অতো রাতে সেখানে গরম খাবারও পাওা গেল। গরম ভাত আর ধোঁয়া ওঠা ডাল। অমৃত কাকে বলে।

এবং ঘুম। সকাল আটটায় বের হবার কথা ছিল। রাত ভর বৃষ্টি। তুষারপাত। তাপমাত্রা ৫ ডিগ্রী। ডালহৌসির দিকে রওনা। স্নোফলের ভীতি। ঘন কুয়াশার অলৌকিক। আগের সন্ধে থেকে নাকি বন্ধ ছিল রাস্তা। সকালে সেনারা বরফ পরিষ্কার করে খুলে দিয়েছে রাস্তা। রাভি নদীর ধার বেয়ে রাস্তা ঢুকছে পাঞ্জাবে। এই এলাকাতেই দারুণ নামকরা সব বোর্ডিং স্কুল। সমতলের শুরু। দূর থেকে দূরে চলে যাচ্ছে বরফের শ্যামলিমা। দুপুরে খাবার খাওয়া হল হাভেলির ঐতিহ্যবাহী রাস্তায়। তারপর। ওয়াগা-আতারি সীমান্ত। অসামান্য বিটিং রিট্রিট। দেশমায়ের সঙ্গীত বিভোর সময় কাটানো হল ...রাতে অপরূপ রূপ নিয়ে প্রস্ফুটিত হলেন স্বর্ণমন্দির ... তারপর জালিয়ানয়ালা, দুর্গামন্দির। পাঞ্জাবের বিখ্যাত নাগরা জুতো। লস্যি। নানা রকম পরোটা। কচুরি রাবড়ি মালাই। ফুলকারি নয়নলোভন। তারপর আকাশের কাঁধে ভর দিয়ে ফিরে আসি আপন কুলায় ... যেমন পাখিরা ... তাদের পালকে, বালক-ডানায় ...নিন্দ ঘোষ: কপিরাইট লেখক কর্তৃ
অনিন্দ ঘোষ: কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত

1 টি মন্তব্য: