রেশম পথের রেশ



ভ্রমণকাহিনী

শীত কালে শীতের দেশে বেড়াতে যাওয়ার মজাই আলাদা। ২০১৮ সালের বড়দিনের ছুটিতে আমাদের গন্তব্য  ছিল ওল্ড সিল্ক রুট সিকিম।  প্রাচীন কালে এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার মধ্যে ব্যবসা বানিজ্য হতো। এই পথে চীনা সিল্কের ব্যবসা হতো তাই সিল্ক রোড। এছাড়াও অন্যান্য পণ্য কেনা বেচা হতো। এই রেশম পথ খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকে চীনের হ্যান রাজ বংশের আমলে গড়ে ওঠে।  তখন মানুষ পায়ে হেঁটে কিংবা ঘোড়ায় চড়ে দুর্গম পথ পাড়ি দিত বানিজ্যের কারণে। এই পথে লাসা থেকে তমলুক চলে যাওয়া যেতো। চীনা, ভারতীয়, ফার্সি, আরবি ও ইউরোপিয় সংস্কৃতি ও সভ্যতার উন্নয়ন ও মেল বন্ধনে এই পথের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। 

গত বছর ডিসেম্বরে আমরা দুটো পরিবার মিলে মোট ৬ জনের একটি দল বেরিয়ে পড়েছিলাম। সেই সময় এতই আকাশ পরিষ্কার ছিল যে ট্রেন নিউ জলপাইগুড়ি পৌঁছানোর আগেই আমরা বরফের পাহাড় দেখতে পাচ্ছিলাম। এবং  তিনিই যে উনি মানে কাঞ্চনজঙ্ঘা আমরা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। যাকে কাছ থেকে দেখবো বলে মাঝে মাঝেই আমরা উত্তরে পাড়ি জমাই তিনি মেঘ না চাইতেই জল হয়ে ধরা দেবেন কে জানতো? যাই হোক স্টেশনে পৌঁছে আগে থেকে বুক করা গাড়িতে আমরা উঠে পড়েছিলাম ইচ্ছেগাঁও-এর উদ্দেশে। ড্রাইভার আমাদের গাড়িতে উঠিয়েই একটু এগোতে না এগোতেই গাড়ির চাকা পাল্টানোর জন্য থামল। গাড়ি ও ড্রাইভার দুজনেই একটু বয়স্ক। যাই হোক পাহাড়ি পথ এই দুজনই বল ভরসা। কথায় আছে পুরানো চাল ভাত বাড়ে এই মনে করে  কিছু সময় বাদে আবার জার্নি শুরু করলাম। পথেই ব্রেকফাস্ট সেরে নিয়েছিলাম।

পান্না সবুজ তিস্তাকে পাশে রেখে কাঞ্চনজঙ্ঘার সঙ্গে লোকোচুরি খেলতে খেলতে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। একেবারে সবুজ তিস্তার থেকে চোখ সরাতেই ইচ্ছা করে না। আবার কোথাও তিস্তাকে  বড় দুঃখী বদ্ধ জলাশয় মনে হয়েছিল। কালিম্পং হয়ে চলে যাচ্ছি ইচ্ছেগাঁও। সমুদ্র থেকে ৫৮০০ ফিট উচ্চতায় কালিম্পং জেলার এই ছোট্ট গ্রাম। একটা রাত্রি আমরা ইচ্ছে গাঁওতে ছিলাম। ২০১২ সালে এটা  ইকো টুরিজম সেন্টার হিসাবে গড়ে ওঠে। ইচ্ছে গাঁও এর বদলে সিলারি গাঁও দিয়ে সিল্ক রুট ট্যুর সাধারণত শুরু হয়। আমরা ভিড় এড়াতে ইচ্ছে গাঁও দিয়ে শুরু করেছি। সরু এবং চড়াই রাস্তা দিয়ে উঠছি। এখানে প্রচুর সিঙ্কোনা (ম্যালেরিয়ার ওষুধ) গাছের চাষ হয়।  দুধারে পাইনের জঙ্গল, এলাচ গাছ  আর ফুলের বাগানের শোভা। এখানকার মানুষেরা চাষ করতে খুব ভালোবাসে। বাড়ির সামনে সব্জির চাষ করেছে। গাড়ি এসে একজায়গায় থামল। তারপর হেঁটে কিছুটা উঠতে হয়। মেরিগোল্ড হোমস্টে আমাদের বুক করা ছিল। খাওয়া দাওয়া স্নানের গরম জল কোন কিছুতেই কোন অসুবিধা নেই। হাসিমুখে সবাই সবাইকে কাজে সাহায্য করছে কে কার অতিথি সেটা আলাদা করে বোঝা যাচ্ছিল না। অনেক টুরিস্ট এসেছিল। মনে হচ্ছিল একটাই দল। বড়দিনের আনন্দে একটু যেন বেশীই হইচই। পাহাড় কিন্তু মাইক বাজানো ভালোভাবে নেয় না। কোথাও একটু ছন্দ পতন। যাই হোক, একটু রাতে হোমস্টে পিছনের ভালুখপ জঙ্গলের মাথায় চাঁদ ওঠার অসাধারণ একটা দৃশ্যের সাক্ষী হয়েছিলাম আমরা।

পরদিন ভোরে কাঞ্চনজঙ্ঘা দৃশ্য দিয়ে দিনটা শুরু হল। ব্রেকফাস্ট সেরে এই অপূর্ব সুন্দর গ্রাম ছেড়ে আমরা বেরিয়ে এসেছিলাম। পরের গন্তব্য ৬৯ কিলোমিটার  দূরে জুলুক (৯৫০০ ফিট উচ্চতায়)।  পথে রংলিতে ভোটার কার্ডের ফটোকপি ও ছবি দিয়ে পারমিট করাতে হয়। ওখানে যতক্ষণ এই কাজের জন্য অপেক্ষা করতে হয় সেই সময় রংলি বাজার  থেকে একটু উলেন জিনিস বা খাবার কিনে নেওয়া যায়। এর পরে আর কোন মার্কেট নেই বললেই চলে। ড্রাইভারের সহযোগিতায়  তা আধ ঘন্টার মধ্যে করিয়ে নিয়ে আসা গেল।  পারমিট পেয়ে গেলে আবার গাড়ি চলতে লাগল। পথে পড়বে কিউখোলা ফলস। গাড়ি থেকে নেমে একটু পা ভিজিয়ে নেওয়া যেতেই পারে। পথ চলতি প্রচুর প্রেয়ার ফ্ল্যাগ উড়তে দেখলাম। কাশ ফুলের মত একধরনের সাদা ফুল ফুটে আছে সারা রাস্তার ধারে ধারে।  লিংতাম, পদমচেন হয়ে অবশেষে জুলুক পৌছাঁলাম। জুলুকে আমরা দু রাত্রি স্টে করেছিলাম। এটি প্রায় চীনের বর্ডারের কাছে অবস্থিত সেনা ছাউনি এলাকা।  আমাদের থাকার ব্যবস্থা হোমস্টে স্নো লাওনে।  

জুলুক পৌঁছাতে প্রায় দুপুর তিনটে বাজে। লাঞ্চ সেরে ওই দিন পায়ে হেঁটে একটু বেরিয়ে ছিলাম। মালিক চুন্দু ভুটিয়ার পরিবারের সঙ্গে আলাপ হয়ে ভালো লাগলো। আমরা কলকাতা থেকে চুন্দু ভুটিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করেই এই ট্যুরের সব ব্যবস্থা করেছিলাম।  তবে ইচ্ছেগাঁও থেকে অনেক কম টেম্পারেচার (মাইনাস) হওয়ায় ঠান্ডাতে একটু সমস্যা হচ্ছিলো। পরে যদিও ঠিক হয়ে যায়। যারা বেশী শীত পছন্দ করেন না তারা একটু নীচে পদমচেনে থাকতে পারেন। সেখানে উচ্চতাজনিত কষ্ট নেই। কাছেই মিলিটারি ক্যাম্প। এখানে সেনাদের ভারী ট্রাকের আনাগোনা লেগেই থাকে। সন্ধে বেলায় একটু চা খেয়ে আসা যায় ওদের ক্যান্টিন থেকে।  উলেন টুপি গ্লাভস ইত্যাদিও কেনা যায়। রাত্রে টেম্পারেচার ফল করে বলে আমরা রুম হিটার নিয়ে ছিলাম কিন্তু আমাদের ভাগ্য খারাপ সেগুলি খুব একটা কাজে আসেনি। ঘর গরম হচ্ছিল না। তবে বিছানা  আর ডাবল কম্বলে শীত কিছুটা সয়ে গিয়েছিল। পরের দিন সাইট সিইং।  যেটা সবচেয়ে সমস্যার সেটা হল রাতে পাইপ লাইনে জল জমে বরফ হয়ে যাওয়ায় জলের সমস্যা। জলের সমস্যা  মিটল সকালে মিস্ত্রী এসে পাইপ লাইনের বরফ ভেঙে স্বাভাবিক জলের ফ্লো আনার পর। নটা নাগাদ ব্রেক ফাস্ট করে বেরিয়ে পড়ি। আমরা বরফে হাঁটার গাম্বুট আর জ্যাকেট ইত্যাদি ভাড়া করে নিয়েছিলাম। সুন্দর আলো ঝলমলে সকালে জুলুক থেকে জিগজ্যাগ রাস্তা  ধরে ১৪ কিমি এগিয়ে এসে থাম্বি ভিই পয়েন্ট (১১২০০ ফিট)। এখান থেকে পাহাড়ি পথের ৩০টি হেয়ার পিন বাঁক পথ একসঙ্গে দেখা যায়। একে ভুলভুলাইয়া বলে।  ভারতের আর কোথাও এ দৃশ্য দেখা  যায় না। পরে এসে থামলাম লুংথুং। এখান থেকে পর্বত শৃঙ্গের সারি দেখা যায়। কাঞ্চন জঙ্ঘার প্যানোর‍্যামিক ভিউ দেখে আমরা মুগ্ধ। 

এর পরের গন্তব্য নাথাং ভ্যালী। নাথাং-এও টুরিস্টদের থাকার ব্যবস্থা আছে।  একটু নীচে নাথাং গ্রাম। খুব কম মানুষ বাস করে এই নাথাং গ্রামে। বরফের চাদরে ঢাকা এই উপত্যকা।  ভাড়া করা শীতবস্ত্র এবার কাজে লাগে। নাথাং পূর্ব সিকিমের উচ্চতম স্থান (১৩৫০০ ফিট)। ভ্যালীতে পৌঁছে আমরা কফি, ডিম সেদ্ধ, মোমো খাই। আর বরফে অনেকক্ষন গড়াগড়ি খেয়ে ছবি তুলে রাস্তার দুধারে বরফের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে আমরা বেশ দেরী করে ফেলেছিলাম। এরপর  নতুন বাবা মন্দির    টুকলাতে পুরানো বাবা মন্দির দেখতে গেছিলাম। পুরানো বাবা মন্দির  আসলে একটি বাঙ্কার। যেখানে ক্যাপ্টেন হরভজন সিংহের ছবি ও ব্যবহৃত জিনিসপত্র রাখা আছে। ১৯৬৮ সালে নাথুলাতে কর্মরত অবস্থায় মারা গেছিলেন। এখানকার সেনারা বিশ্বাস বাবা হরভজন সিংহ এখনো সীমান্তে পাহাড়া দিয়ে চলেছেন এবং বিপদ থেকে তিনি রক্ষা করেন। এটি  একটি পবিত্র জায়গা। সিঁড়ি দিয়ে কিছুটা উঠতে হয় তার সঙ্গে প্রবল ঠান্ডা হাওয়া। বেশ কষ্টকর। সেখান থেকে আবার চললাম কুপুপ লেক (১৩০৬৬ ফিট)। যেন চির শান্তির দেশ।  লেকের জল তখন আংশিক বরফ। নীল জলের লেক। অসাধারণ  জায়গা। ক্যামেরায় আর কতটুকু আসে।  হাতির শূরের মত  আকৃতির জন্য এটিকে  এলিফ্যান্ট লেকও বলা হয়। চীন ও ভারতের সীমান্ত জেলেপলা পাসের রাস্তায় এটা পড়ে। পর্যটকদের জন্য এখন নিষিদ্ধ। কুপুপেই আছে উচ্চতম গলফ কোর্স। যতদূর চোখ যায় শুধু বরফ আর তার উপর রোদ পড়ে চোখ ঝলসে যাচ্ছে। তারপর সোমগো লেক (ছাংগু) পর্যন্ত গিয়েছিলাম। ছাঙ্গু লেক দেখে বড্ড হতাশ হয়েছি। ১৯৯৮ সালে দেখা লেকের সঙ্গে মেলাতে পারলাম না। এখন গিজ গিজ করছে মানুষ। আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দোকান। ইয়াকের সঙ্গে ফটো তুলতে চাইলে বা ইয়াকের পিঠে চড়ে ঘোরাও যায়। রোপ-ওয়ে চড়ার বিশাল লাইন। সে সবে আর গেলাম না। গাড়ি থেকে নেমে অনেক খানি হাঁটতে হল।  সামান্য খেয়ে গাড়ি পর্যন্ত আবার পৌঁছাতেও বেশ সময় লাগল। বড়দিনের ছুটিতে প্রচুর টুরিস্ট এসে যাওয়ায় ফেরার পথে  ছাঙ্গুর কাছে জ্যামে আটকে যায় আমদের গাড়ি।  ছাঙ্গুকে এই ট্যুরে না রাখাই ভালো। তার চেয়ে নাথাং এ একটু বেশী সময় কাটালে ভালো হয়। এই সমতলের মানুষদের বরফ দেখলেই আদিখ্যেতা করা স্বভাব। একজন দেখলাম শার্ট খুলে খালি গায়ে ছবি তুলছে। কেউ আবার গাড়ির মাথায় করে বরফ নিয়ে আসছে। যেন বাড়ি নিয়ে যাবে। জ্যাম আস্তে আস্তে কেটে গেল। আকাশ পরিষ্কার থাকায় ভরপুর আনন্দ নিয়ে বিকালের সূর্যের আলোয় লাল কাঞ্চন জঙ্ঘারকে টুকি টুকি করতে করতে জুলুকে ফিরছি।  

কাঞ্চনজঙ্ঘা সারাক্ষন আমাদের সঙ্গে রয়েছেন বলে ওঁকে আমরা কাঞ্চনদা বলে ডাকতে শুরু করেছি। বেলা শেষের আলোয় তিনি লাল হয়ে ধরা দিলেন আমাদের ক্যামেরায়।  সূর্যের আলো নিভে গেলেই পাহাড়ে হঠাত করে উষ্ণতা নেমে যেতে শুরু করে। অন্ধকার রাস্তায় গাড়ির আলো ছাড়া আর কোনো আলো নেই, জুলুক থেকে ১৪ কিমি আগে আমাদের ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে বলে যে গাড়ি আর যাবে না। সিট থেকে নেমে ইঞ্জিন চাকা মোবাইলের টর্চ জ্বেলে পরীক্ষা করছে। আমরা গাড়ি থেকে নামি ওকে আলোটা ধরে সাহায্য করার জন্য। গাড়ির মধ্যে আর বাইরের টেম্পারেচার আকাশ পাতাল তফাত। সময় যত গড়াচ্ছে কিভাবে রাতটা গাড়ির মধ্যে কাটাবো এত ঠান্ডায় ভেবে পাচ্ছিলাম না।  অনেকক্ষন পরে ড্রাইভার জানলো ব্রেকশুতে স্টোন চিপ আটকে গেছে। বের না হওয়া পর্যন্ত আমদের গাড়ির মধ্যেই থাকতে হবে। পিছনের অনেক গাড়ির ড্রাইভার আমাদের সাহায্য করেছিল।  ঘন্টাখানেক বাদে গাড়ি ঠিক হল। তারপর ওই জিগ জ্যাগ রোড দিয়ে গাড়ি নামছে। এক এক কিলোমিটার এগোচ্ছি আর ঈশ্বরকে স্মরণ করছিলাম। ড্রাইভারও কোনো তাড়াহুড়া না করে নিরাপদে আমাদের জুলুক পৌঁছে দিলেন। সে যাত্রায় দেরী হলেও খবরের শিরোনাম হইনি।  

পরের দিন আমাদের রোলেপ যাওয়া।রংলি থকে ২০ কিমি দূরে সবুজ পাহাড় ঘেরা পূর্ব সিকিমের ছোট্ট গ্রাম।সারা বছর যে কোন সিজনেই আসা যায়। হোমস্টেতে যাওয়ার পথেই গাড়ি থেকে নেমে পাথুরে পথ ধরে একটু হেঁটে সোকেখোলা নদীর ৪৫ ফিট উঁচু বুদ্ধা জলপ্রপাতে কিছু সময় কাটালাম। সুন্দর জায়গা। দূর থেকেই ঝরনার জলের আওয়াজ পাওয়া যায়। আমাদের বুক করা হোমস্টে একদম রাস্তার ধারে। সেদিন ওখানে মুখ্যমন্ত্রীর আসার কথা। মিটিঙে  যোগদানের জন্য  সাধারন মানুষের  তৎপরতা দেখছিলাম। চুন্দু ভুটিয়ার সঙ্গে আবার দেখা হয়ে গেল এখানে। তিনিও মিটিং এর জন্যে এসেছেন। সেদিন গাড়ি করে গান বাজিয়ে দলে দলে যাওয়া এবং ফেরা উৎসবের চেহারা নিয়েছিল।  বুদ্ধা ওয়াটার ফলস হোমস্টেতে আমরা  লাঞ্চ সেরে বাইরে চেয়ারে বসে মিঠে রোদ পোহাতে ভালোই লাগছিল। বিকেলের দিকে নদীর উপর হ্যাঙ্গিং ব্রীজ চলে যাই।  সেখানে নদীর ধারে নামার পথ আছে। সেখানে বোল্ডারের উপর গিয়ে বিকালে বসে ছিলাম। ব্রিজের লাগোয়া একটি বাড়িতে চায়ের দোকান ও সুন্দর বসার ব্যবস্থা আছে। ফেরার সময়  সেখানে চা খেয়ে ফিরে এলাম হোমস্টেতে। এই সব জায়গায় পথে ঘাটে সুন্দর সুন্দর কুকুর ঘুরে বেড়ায়। তারা টুরিস্ট দেখলে বোঝে আর চা দোকান পর্যন্ত পিছু ছাড়ে না। এখানেও  তার অন্যথা হল না। রাস্তায় তাদের সঙ্গ আমরা উপভোগ করেছি।  আমদের হোমস্টের সামনে পায়ে হাঁটা খাঁড়া রাস্তা ধরে নদীতে নামা যায়। পরদিন সকালে স্থানীয় একজন মহিলাকে নামতে দেখে আমরাও নামার চেষ্টা করি। কিছু সময় এই দুঃসাহসিক কাজের প্রয়াস চালালাম। আমি পুরোটা নামতে না পারলেও বেশ কিছুক্ষন প্রকৃতির মাঝেই ছিলাম। পাহাড় নদী জঙ্গলের হাতছানি থেকে দূরে সরে আসা বড্ড কষ্টকর। নেহাত হাঁটু সাধ দিল না।

আমাদের এই ভ্রমণের শেষ গন্তব্য ছিল ঋষি (২০০০ ফিট)। এটি সিকিম ও পশ্চিম বঙ্গের বর্ডার এলাকা। কালিম্পং থেকে ৩৭ কিলোমিটার দুরত্বে ঋষি খোলার ধারে মোজিলা নেচার রিসোর্ট। এই রিসোর্টটি সিকিমের মধ্যে পড়েছে। আগে থেকে বুক করা ছিল। ঋষি খোলার এই দিকটা একেবারেই নির্জন পাহাড় জঙ্গলে ঘেরা নদীর ধারে। রোলেপ থেকে ঘন্টা তিনেক জার্নি করে   রাস্তার চারিধারে নাম জানা ফুলের শোভা আর সুন্দর সুন্দর বাড়ি দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম কাঁচা রাস্তায়। পৌঁছে দেখি জনমানব নেই। ভাবলাম ভুল পথে এসেছি। হোটেলের মালিক ছেত্রীকে ফোনে যোগাযোগ করে ড্রাইভারকে ফোন ধরিয়ে দিলাম। সে পথ বুঝে নিল। আরো কিছুটা মাটির রাস্তা দিয়ে এগিয়ে নিয়ে নদীর পারে এসে থামলো। সবার মুখে হতাশার ছাপ। কিছু সময় পরে রিসোর্ট  থেকে কিছু লোক আমাদের ব্যাগ ইত্যাদি নিয়ে যেতে এল। বোল্ডারে ভর্তি এবড়োখেবড়ো পথ দিয়ে বাঁশের সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলাম রিসোর্টে। 

পাশ দিয়ে নদী বয়ে চলেছে তার আওয়াজ , পাহাড়ে ঘেরা সবুজ গাছ গাছালি জঙ্গল তার মধ্যে অনেক খানি জায়াগা নিয়ে ছোট ছোট সুন্দর কটেজ। তিন চারটে কটেজ দেখিয়ে আমাদের বলল যেটা খুশি নিন। আমরা সব দেখে শুনে ছয়জনের একটি কটেজ মানে দুই পরিবার একসাথে থাকার পরিকল্পনা করলাম।  কিছু সময় পরে ওরা গরম গরম খাওয়ার পরিবেশন করলো। তবে কাঠের জ্বালে রান্না বলে একটু ধোঁয়া গন্ধ ছিল। আর সব জায়গাতেই মেনু এক।  লাঞ্চে ডিম আর রাতে চিকেন। সন্ধ্যে বেলায় পকোরা ইত্যাদি দিতো। একই খাবার আর ভালো লাগছি না। তবে পাহাড়ি মানুষদের আতিথেয়তায় কোথাও খামতি ছিল না। কটেজের সামনে খোলা মেলা বাঁশ দিয়ে বসার জায়গা বানানো আছে। বেলা বাড়তেই অনেক টুরিস্ট এসে উপস্থিত  হল। আমরা কলকাতায় ফোন করে খবর পাচ্ছিলাম অত্যধিক তুষার পাতে জুলুক যাওয়ার পথ বন্ধ। অনেক টুরিস্ট আটকে পড়েছে। এরকম অনেক টুরিস্ট যারা  জেতে  পারলেন না তাদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তখন  নিজেরদের খুব সৌভাগ্যবান বলে মনে হচ্ছিল। রিসোর্টের স্যামনেই নদীর জলে বাধ দিয়ে কিছুটা জায়গায় জল জমিয়ে সুইমিং পুলের মত করা আছে। গ্রীষ্মকালে এর মজা নেওয়া যেতে পারে। কটেজের মধ্যে না গিয়ে আমরা সারাক্ষন বাইরেই যে যার মত ঘুরে বেড়াচ্ছি। কত পাখিদের ওড়াউড়ি। বেশ কিছু পাখির ছবি তুলে নিয়ে এসেছিলাম। পরে গুগল থেকে তাদের নাম জানি সেগুলি হল 1. Green Avadavat Bird 2. White Crested laughingthrush 3. Rofouse-belled Niltava Bird প্রভৃতি।  সূর্যের আলোয় কিশোরী মেয়ের মত পাথরে ধাক্কা খেতে খেতে কুলুকুলু বয়ে চলা নদী দেখতে সকলেই হারিয়ে গেছিলাম কিছু সময়। কিছুক্ষন বাদে বৃষ্টি শুরু হল। বয়ে আনা ছাতা এবার কাজে লাগাই বলে ছাতা মাথায় দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ইতিউতি হাঁটতে। কাঠ দিয়ে বানানো ধাপ বেয়ে উঠে গেলাম উপরে। সেখান থেকে নদী আর রিসোর্টেকে এক ফ্রেমে বন্দী করে নীচে নেমে এলাম। সন্ধ্যে  বেলায় আকাশ পরিষ্কার। ওখানকার কর্মচারীরা আমাদের জন্য ক্যাম্প ফায়ারের ব্যবস্থা করলেন। সবাই গোল হয়ে বসে আড্ডা গান জমে উঠছিল। চিকেন রোষ্টেরও  ব্যবস্থা আছে। এত পরিষ্কার আকাশ সচরাচর দেখার সৌভাগ্য হয়নি। আকাশের দিকে তাকিয়ে গ্রহ তারা চেনার চেষ্টা চালালাম।  আর দু একটা খসে পড়া কমেটও নজরে এলো। পরবর্তীতে শুধু এখানেই  ছুটি কাটানোর জন্য দলবেঁধে আবার আসার পরিকল্পনা করলাম। একটা পাহাড়ি জঙ্গল কিনে নিয়ে তার সৌন্দর্য  যথাসম্ভব অটুট রেখে এইভাবেও ব্যবসা করা যায় !

ফেরার পথে অনেকে আরিটার হয়ে ফেরে আমাদের আগেই যাওয়া ছিল বলে এবারে যাইনি। ফেরার পথে  কাছেই পড়বে রেনক। রেনকে একটা গনেশ মন্দির আছে  নাম বিশ্ব বিনায়ক মন্দির।  সুসজ্জিত মন্দিরে প্রবেশ করলাম। সেখানে একটি সুন্দর ১২ ফুটের সিদ্ধিদাতা ১৬টা হাতের গজানন মূর্তি মাঝখানে আর চারিদিকে দেওয়ালে এক এক রূপে  অনেকগুলি গনেশের মূর্তি দর্শন করলাম। বাইরে সমুদ্রমন্থন স্ট্যাচু। বেশ সুসজ্জিত এই শান্ত জায়গায়টা না দেখলে ভুল করতাম। শেষ পাতে মিষ্টির মতো। ওখান থেকে ঘন্টা চারেকের মধ্যে  নিউ জলপাইগুড়িতে এসে পৌঁছালাম। হাতে কিছু সময় ছিল প্রিয়জনদের জন্য উপহার সামগ্রী ও রাতের খাবার নিয়ে নিলাম স্টেশন লাগোয়া দোকানগুলো থেকে। তারপর রাতের ট্রেনে কোলকাতা। সব শেষে, যাকে ছাড়া এই ট্যুরটি এত সুন্দর হত না সেই চুন্দু ভুটিয়ার যোগাযোগ নম্বর দিয়ে রাখছি বন্ধুদের সুবিধার্থে। হোমস্টে ও গাড়ির জন্য যোগাযোগ করা যেতে পারে। চুন্দু ভুটিয়া – ৯৪৭৪১২৫২৭৯।নিউ জলপাইগুড়ি যাওয়ার প্রচুর ট্রেন আছে। আমাদের যাওয়া আসা দুটোই দার্জিলিং মেলে। এছাড়া সড়ক পথে উত্তর বঙ্গ পরিবহনের বাসে যাওয়া যায় । বলাই বাহুল্য শীতের জামা কাপড় বেশী করে নিয়ে যেতে হবে। কোকা-৩০ (হোমিও প্যাথি ওষুধ) সঙ্গে রাখা ভালো। উচ্চতাজনিত কষ্ট হলে এটা খাওয়া যেতে পারে। বর্ষাকাল ছাড়া যে কোনো সময়ই এখানে যাওয়া যায়।


শীলা বিশ্বাস: কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন