মেঘ রমণীর ডেরা – পাহাড় কোলে কোলাখাম



ভ্রমণকাহিনী


চার দেওয়ালের মাঝে বদ্ধ ঘরের মধ্যে  হঠাৎ  ছুটির দমকা হাওয়া  মনের  মধ্যে  ছুটির পিওন বাঁশি বাজিয়ে গেলেই কে যেন হাতছানি দেয় বারে বারে  স্মৃতির প্রেক্ষাপটে ভেসে ওঠে আকাশ, পাহাড়, সমুদ্র, অভয়ারণ্য আরও কত কি! সেই নিশির ডাকেই পথে বেরিয়ে পড়া এর নামই পর্যটন এবারও ব্যতিক্রম নয় যাব না যাব না করেও বেরিয়ে পড়লাম এতদিন বাইরে বাইরে ঘুরে মনে হল পশ্চিমবঙ্গের  অনেক জায়গাই তো দেখা বাকি আছে, বলা ভালো  দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া ... চারজন ভ্রমণপাগল বন্ধু সপরিবারে কাঞ্চন কন্যা এক্সপ্রেসে রওনা দিয়ে পরের দিন সকাল দশটায় পোঁছালাম ডুয়ার্সের নিউ মাল জংশনে এখানে অপেক্ষামান সুদর্শন হাসিখুশি নেপালি যুবক গণেশ প্রধান ও তার বন্ধুর দুটি বোলেরো জীপে রওনা দিলাম ৫২ কিমি দূরে লাভার উদ্দেশে গরুবাথান পেরোতেই সবুজে মাখামাখি প্রকৃতি চা বাগানের বুক চিরে ছুটে চলেছি পাহাড়ের পথে পথের পাশে পয়েন্ট সিস্টার্স ফুলের গুলদস্তা তার উজ্জ্বল লাল রঙের আলোয় চোখ টানল আমাদের সবুজের সমারোহের মধ্যে চলতে চলতে পউছালাম ছোট্ট জনপদ লাভায় ভুটানি ভাষায় লামানে ভগবান আর ভামানে উপস্থিতি, অর্থাৎ লাভা মানে  ভগবানের ডেরা সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ২১৮০ মিটার  উঁচুতে  এককালের সুন্দর পাহাড়ি গ্রাম লাভা এখন অত্যধিক পর্যটকের চাপে জনবহুল হয়ে পড়েছে ঠিক দুপুরেই লাভা গুম্ফার সামনে গাড়ি দাঁড়াল নেমে চারপাশে তাকাতেই মনে হল মেঘ রমণীদের দেশে এসে পড়েছি বড় অদ্ভুত এখানকার আকাশ, এই শীত বেলার মিঠে রোদের আদর  আবার পর মুহূর্তেই সাদা মেঘ এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে প্রচুর হাসিখুসি  বাচ্চা থেকে বড় লামা গুম্ফার লনে ইতিউতি শুয়ে বসে সময় কাটাচ্ছে ছবি তোলাতেও বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই তাদের 



আমাদের আসল গন্তব্য লাভা থেকে ১২ কিমি দূরে পাহাড় কোলের শান্ত নিস্তব্ধ পাহাড়ি একটি গ্রাম, নাম কোলাখাম গণেশের কথায় আর দেরি না করে চড়ে বসলাম গাড়িতে রাস্তা দেখতে দেখতে আরও সরু হল দুপাশে কখনও নিবিড় বন, কখনও টিলা পাহাড়ের আদুল শরীরের বেয়াদবি দেখতে দেখতে এগিয়ে চলেছি পথের  ধারে যেখানে সেখানে  ঈশ্বরের তুলির টান প্রকৃতির সবুজ ক্যানভাসে  চোখে পড়ছে কয়েকটি মেরুন সোয়েটার পরা পাহাড়ি ছেলেমেয়ে চোখে পড়ল গান করতে করতে হেঁটে চলেছে, মনে হল স্কুল থেকে ফিরছে



এখানকার পাহাড়ি মানুষেরা খুব খোলা মনের ও হাসিখুশি স্বভাবের হয় প্রকৃতির সাথে চিরকালীন নিবিড় আত্মীয়তা তাদের নিবিড় যতটা, গভীরও এটা ওদের দেখে অনুভব করি বলেই প্রকৃতির পাহাড়ি শরীর ছুঁয়ে একান্তে কটা দিন কাটিয়ে যাওয়ার এত তাগিদ দেখতে দেখতে পোঁছে গেলাম কোলাখাম মাত্র ৬০-৬২ টি পরিবারের বসবাস এখানে প্রায় ৬১৮০ ফুট উঁচুতে নেওড়াভ্যালি ন্যাশন্যাল পার্কের কোলে এই গ্রাম থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার দৃশ্য অসাধারণ একদিকে দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ বন, অন্য দিকে গভীর খাদ খাদের অদূরে ঘন সবুজের মধ্যে দিয়ে দিগন্ত জোড়া কাঞ্চনজঙ্ঘা তারই মাঝে পাহাড়ের গায়ে আঠা দিয়ে যেন লেপটে আছে ছবির মতো সুন্দর গ্রাম কোলাখাম



গ্রামের অধিবাসীরা সবাই নেপালি, রাই সম্প্রদায়ের লোক লাভা থেকে গ্রামে যাওয়ার রাস্তা খুব খারাপ বড় বড় বোল্ডারের ওপর দিয়ে অভিজ্ঞ হাতে গাড়ি চালিয়ে চলেছে সদা হাসিমুখের নেপালি ছেলে গণেশ প্রধান বাড়ি ওর ডুয়ার্সের চালসায় ও কখনো কোলাখামে আসেনি পাহাড়ি ছেলে গণেশ, পাহাড় ওর রক্তে ভয়ংকর সুন্দর রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে ও আমাদের অনেক পাখি দেখাল  ভারডিট ফ্লাইক্যাচার, স্কারলেট মিনিডেট, গ্রীন টেল্ড গানবার্ড, ডার্ক সাইডেড ফ্লাইক্যাচার আরও কত কি নাম তাদের গণেশের পাখি নিয়ে আগ্রহ দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছিলাম


লাভা থেকে কোলাখাম পুরো রাস্তাটাই নেওড়াভ্যালি জঙ্গলের বাফার এরিয়া নেওড়াভ্যালির রাস্তা ভেতরে ঢুকেই দুভাগে ভাগ হয়ে গেছে ডানদিকের রাস্তাটা সোজা চলে গেছে ওপরে রচেলার দিকে বাঁ দিকের রাস্তায় নীচে নামলেই সুন্দরী কোলাখাম  পাইন বনের নিস্তব্ধতা ভেঙে মাঝে মাঝে শোনা যায় পাখির কূজন ভাগ্য সহায় থাকলে হঠাৎ করে সামনেই দেখা হয়ে যেতে পারে রেড পান্ডার সাথে কিছুটা এগোলেই  নেওড়াভ্যালি জঙ্গল ক্যাম্পের যেখানে, হেল্প ট্যুরিজমের সহায়তায় পাহাড়ের ধাপ কেটে কেটে তৈরি করা হয়েছে সুন্দর ছোট ছোট রিসর্ট



আরও এগিয়ে আমরা পউছালাম দীপক রাই এর সাইলেন্ট ভ্যালি রিসর্টে রাই পরিবারের উষ্ণ অভ্যর্থনায় অভিভূত হলাম সবাই এখানে ঘর গুলো সব কাঠের রুম সংলগ্ন বারান্দায় বসে চোখ চলে গেল সামনে বিস্তৃত কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে মিঃ রাই দেখালেন বাঁ দিকে দেখা যাচ্ছে রূপসী রিশপ ডানদিকে নেওড়াভ্যালির দিগন্ত বিস্তৃত প্রান্তর সামনে সিকিমের ছবির মতো শহর রেণক দেখা যাচ্ছে শুনলাম রেণকের ওপরেই আরিতার লেক আমরা পরে আরিতার যাবো বলেই নামটা শুনে রোমাঞ্চিত হলাম 



সরু চালের গরম ভাতে বাড়িতে তৈরি গাওয়া ঘিয়ে তৃপ্তির সুগন্ধ সঙ্গে ঘন মুগের ডাল, ঝুরঝুরে আলুভাজা আর ডবল ডিমের কষা পেটপুরে   দুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরে ঘন্টাখানেক গ্রামের রাস্তায় হেঁটে বেড়ালাম সবাই গণেশ আমাদের জোঁক থেকে সাবধান থাকতে সতর্ক করল এখানের ছোট্ট বাচ্চারা খুবই হাসিমুখ ও আদুরে চকলেট দিলেই হাসিমুখে ফটো তোলার জন্যে দাঁড়িয়ে পড়ছে প্রত্যেকটি বাড়িতেই সিজন ফ্লাওয়ারের গাছ চোখে পড়ছে



গোটা গ্রাম জুড়েই আদা আর এলাচের চাষ হয় লক্ষ্য করলাম হোম স্টে তে ফিরে দেখলাম বাগানে ছোট চালাঘরের মধ্যে গাছের গুঁড়ি কেটে তার ওপরে সুন্দর কুশন বিছিয়ে বসার ব্যাবস্থা করা হয়েছে ওখানে বসতেই নীচে বয়ে চলা রিশি নদীর শব্দ কানে এল নেপালি ভাষায় নদীকে খোলা বলা হয় সারাদিন নির্জনতার মধ্যে কলকল রবে খোলার বয়ে চলার শব্দ, মাথার ওপরে নীল আকাশে সাদা মেঘের গাভীর মতো আনাগোনার মধ্যেই নিজেদের হারিয়ে ফেলার কথা অনেকদিন মনে থাকবে আমাদের দলের জয়তী আর জয়ন্তী কখন যে গান শুরু করেছে বুঝতেই পারিনি মেঘ পিওনের ব্যাগের ভিতর মন খারাপের দিস্তা, মন খারাপ হলে কুয়াশা হয়, ব্যাকুল হলে তিস্তা আমাদের ছোট্ট বাচ্চারা নীল, সানু, খুশি আর দিয়া মনের আনন্দে ইতিউতি ছোটাছুটি করছে এভাবেই কখন যে বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যে নামল পাহাড়ের বুকে তা বুঝতেই পারিনি 



অন্ধকার নামতেই বৃষ্টি নামল মুষলধারায় কিছু করার না থাকায় রাতের রুটি সব্জি আর চিকেন কষা দিয়ে নৈশ ভোজ সেরেই আটটার মধ্যেই বিছানায় উঠে পড়লাম বিছানার মাথার কাছে দিগন্ত খোলা জানালা পাহাড়ে অদ্ভুত নিয়ম প্রকৃতির রাতে বৃষ্টি হলেই পরেরদিন সকালের আকাশ ঝকঝকে হয় রেজাই এর উষ্ণতা থেকেই রাত কাটতে জানালায় চোখ অপার বিস্ময়ে লক্ষ্য করলাম রক্তিম আকাশে কাঞ্চনজঙ্ঘার মাথায় যেন সোনার মুকুট আর একটু পরেই নীল আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া সাদা তুলোর মতো মেঘ বরফে ঢাকা কাঞ্চনজঙ্ঘার রেঞ্জ এবারে পরিষ্কার দৃশ্যমান কানের কাছে কে যেন বলে চলেছে একি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ প্রাণেশ হে 


আর একটু সকাল হতেই হেঁটে নামা শুরু হল পাঁচ কিমি দূরের ৪০০ ফিট নীচে ছাঙ্গে ফলসের দিকে যারা উৎরাই এর রাস্তায় পুরো টা নামল না তারা ভিউ পয়েন্টে বসে ফলসের জলের ধারার শব্দের সাথে একাত্ম  হয়ে পড়ল বাকিরা নীচ থেকে ফিরে আসতেই এবারে সুন্দরী কোলাখামকে বিদায় জানানোর পালা


গরম গরম চিকেন স্যুপ ও মোমো দিয়ে প্রাতরাশ পর্ব মিটিয়ে মিঃ দীপক রাই আমাদের আবার আসার অনুরোধ জানালেন বিদায় বেলায় ওনার পরিবারের সবাই এসে দাঁড়িয়েছেন হঠাৎ করে মিঃ রাই আমাদের অবাক করে দিয়ে বলে উঠলেন,এই গ্রামের সবাই নিরামিষাশী আমাদের মতো পর্যটকদের কথা চিন্তা করেই ওঁরা নীচের অন্য গ্রাম থেকে আমিষ রান্না করিয়ে আনেন বিস্মিত হলাম ওদের এই আতিথেয়তাতে



দূরে কাঞ্চনজঙ্ঘা মেঘের ওড়নায় মুখ ঢেকে ফেলেছে ততক্ষণে এই অনাবিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছেড়ে অন্য কোনও খানে পাড়ি দিতে মন সায় দিচ্ছে না তবুও যেতে হয় সারা গ্রাম জুড়ে নানা রঙের ফুলের মেলা, অপরূপ বনপথ পাইনের ছায়া সঙ্গী হল আমাদের গণেশরা গাড়ি ছোটাল আবার লাভার দিকে, ওখান থেকে যাবো রূপসী রিশপ সে কথা না হয় অন্য কোনোদিন ... 

ভাস্কর বাগচী: কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন