গল্প
এক
হঠাত্
শুভ্রা এসে বলল, আগামী ৫ ই জানুয়ারি
রি ইউনিয়ন আছে বর্ধমান ইউনিভারসিটি তে! জুলজি ডিপার্টমেন্ট এর। যাবি তো? বলে উঠলাম হ্যাঁ যাব.... যাব নিশ্চয় ই!
ভেসে উঠল মনের মাঝে অনেকগুলো মুখ...... গত ত্রিশ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া.....মলিন
হয়ে যাওয়া কতগুলো মুখ....!ভীষণ রকম ভাবে মনে পড়ে যাচ্ছে সও....ব, সেই হাসি, আড্ডা, কথা।সেইই গোলাপ
বাগ.....হাতে হাত ধরে ঘুরে বেড়ানো সময়...... হাঁটছে যেন আমারই এপাশ ওপাশ দিয়ে।
আচ্ছা কি অদ্ভুত না! মনে হচ্ছে এই তো...এই তো সেদিনেরই কথা যেন। ওই তো... ওই তো
সমর বাবু ক্লাস নিচ্ছেন আর প্রাণপণ নোটস নিচ্ছি আমরা পাছে কিছু মিস হয়ে যায়! ক্লাস
শেষ হতেই আমি আর মীনাক্ষী গিয়ে বসলাম ডানদিকে ফার্স্ট বেঞ্চে এক্কেবারে ছেলেদের
মাঝখানে। হাসির হুল্লোড় উঠল, কড়া চোখে তাকাতেই
আবার সব চুপচাপ। বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল ক'দিনেই সবার সাথে। একসাথে টিফিন ভাগ করে খাওয়া, Ecology র practical এ ঝিল থেকে জল আনতে যাওয়া, পিছনে ফার্ম হাউসে প্র্যাক্টিক্যালের নামে ফাঁকি দিয়ে খানিক
আড্ডা মেরে আসা। স্যার দের নকল করে লেকচার থিয়েটার এর দরজা বন্ধ করিয়ে যখন তখন
ক্লাস নিয়ে নিত শৈবাল, ভোলা যায়না সুরেলা
মীনাক্ষীর ' চিঙ্গারী কোই বর্ষে ' বা কফি হাউসের সে আড্ডাটা গেয়ে ওঠা, আর তার সাথে তাল মিলিয়ে জগুর টেবল
বাজানো, চির রোমান্টিক গৌতমের গভীর চোখের
চাহনি.... ওহ কি দিন ই যে ছিল সেসব।
মাঝে
মাঝে ডিপার্টমেন্ট এর আড্ডা গুটি গুটি পাড়ি দিত তারাবাগের হোস্টেল ক্যাম্পাসের
সান্ধ্য মজলিশে। তুমুল ঝড় উঠত মাঝে মাঝে......মানে ওই সম্পর্ক টম্পর্ক নিয়ে আর কি!
কান্নাকাটি মন কষাকষি..... কিন্তু নাহ্,.... ক্যাম্পাসের সবুজ প্রেমময় পরিবেশ এক
নিমেষেই ভুলিয়ে দিত সব। ওহ্, কতদিন যে হাঁটিনি সেই
শাল তমালের ছায়ায় ঘেরা বনানীর পথে! কতদিন যে মাড়াইনি তোমায় পাতা আকীর্ণ পথ! খস খস
শব্দে শব্দে পৌঁছে যেতাম হোস্টেলে। মাথায় বুকে লেগে থাকত কৃষ্নচূড়ার
আদর......ক্যান্টিনের সুবাস.....বন্ধুদের উষ্নতা.....! ওই তো হেঁটে যাচ্ছে সিধু আর সুস্মিতা। মগ্ন আলোচনায় ব্যস্ত এখন
উত্তম আর জয়নাল। মিটিমিটি হাসছে দূরে অভিজ্ঞ বোরহান আলী। সুবোধ দার ক্যান্টিনে
চায়ের কাপে তুফান তুলছে বৃন্দা,
দীপা
আর রত্না! নেতাজী হোস্টেলে নাটকের রিহার্সালে ব্যস্ত বিধান, বিবেক আর গৌতম। বৈঁচি গ্রাম থেকে ট্রেন
লেট করেছে ভীষণ, তাই আজ পিসিবি র
ফার্সট ক্লাস টা মিস হয়ে গেল চৈতালী কুমারের। মিতালী আজকাল সাবধানে টিফিন
সামলায়..... শৈবাল সবটা খেয়ে নিলে ও বেচারা খাবে কি?? অনিন্দিতা মাঝে সাঝেই আজকাল শৈবালের সাথে কমনরুমে টিটি প্র্যকটিস করে......টুর্নামেন্টে
নাম দিয়েছে যে।
দুই
আচ্ছা, বন্ধুরা, তোদের মনে পড়ে রত্না মেহরার কথা। পড়তে পড়তে হঠাত্ ই যার বিয়ে
হয়ে গেল। আমরা তো চিন্তায় দিশেহারা। কেন
যে বিয়েতে রাজি হল ও! যাক গে, খুব সেজেগুজে হস্টেল
থেকে দল বেঁধে তো গেলাম, রত্নার বিয়ে খেতে।
বিয়েবাড়ি গিয়ে হরেক রকম আয়োজন দেখে আমাদের তো চক্ষু চড়কগাছ। এত রকম স্ন্যাক্স, তার ওপর মেইন কোর্স!!! বুভুক্ষুর দল, হস্টেলে তো আর ভাল মন্দ জোটেনা.... সেই
কবে শনিবার আসবে তার আশায় বসে থাকা.... বাড়ি গিয়ে যদি কিছু জোটে.... পরীক্ষার সময়
সে গুড়েও বালি! যাই হোক্, কিছু খাই না খাই
ঝপাঝপ হাত ব্যাগে পুরে নেওয়া গেল, এই দিয়েই পরের দিনের ফার্সটক্লাস ব্রেক ফাস্ট!! ছেলেদের দেখাদেখি আমরাও হাত লাগালাম!! সে এক কান্ড বটে! তারপর ফিরে এসে সে কি হাসির
ধূম। রত্না তুই যেখানেই থাকিস ভাই কিছু মনে করিস না, এই লেখায় তোর কাছে অকপট
স্বীকার করলাম।
হঠাৎই
মীনাক্ষীর পরের ইয়ারে উঠে একবার মনে
হল, নাহ আর বাড়িতে থাকা যাবেনা। গুরু গম্ভীর
বাড়ির পরিবেশে কেমন যেন মানিয়ে নিতে পারছিল না আর! রোজ এসে আমার কাছে একবার করে
কান্নাকাটি...., বিপদের সম্ভাবনা দেখে হোস্টেল সুপার মানসী দিকে বলে ও'কে সাউথ ব্লকের একতলার একটা রুমে থাকার
ব্যবস্থা করে দেওয়া হল। রোজ সকাল বিকেল
অন্তত একবার করে আমার ঘরে আড্ডা মারাটা তো হবে! বেশ চলছিল এইভাবে, রোজ একসাথে ক্লাস করতে যাওয়া, প্র্যাক্টিক্যাল, ক্যান্টিন, গল্প, আমার মত
গ্যাস্ট্রিকের রুগীর খাওয়া দাওয়ার প্রতিও ওর ছিল কড়া নজর। পাছে আমি উল্টো পালটা
খেয়ে পেটের ব্যামো বাধাই। সিধু ছিল আমাদের তিন নং বন্ধু। আমার আর মীনাক্ষীর মধ্যে
কার সাথে যে সিধুর বেশি সখ্যতা.... তাই
নিয়ে মাঝে মাঝে বাজি ধরত বন্ধুরা। এইভাবেই চলতে চলতে মীনাক্ষী একদিন হঠাৎ হোস্টেল
থেকে বেপাত্তা। সপ্তাহান্তে বাড়ি গিয়ে আর ওর কোন খোঁজ নেই। দিন তিন চারেক হওয়ার
পরে আমি আর সিধু ছুটলাম কার্জন গেটের উল্টোদিকে সোজা রাস্তায় খানিক গিয়ে বাসন্তী
চিঁড়ে মিলের গলি। মীনাক্ষী মানে বুলার ই
মুখস্থ করানো ঠিকানা। কাকু কাকীমা তো আমাদের দেখে অবাক। "তোমাদের প্রিয় বন্ধু
তোমাদের না জানিয়েই গেছে বুঝি! ও তো এখানে নেই, স্কুলের বন্ধু ছন্দিতা ও তার স্বামীর সাথে গেছে দীঘা উইক এন্ড
ট্যুরে"! আমাদের দুজনের তো এবার আকাশ থেকে পড়ার পালা।আর মাস দুই পড়েই
পরীক্ষা! এসময়ে..... এইভাবে...... নাহ্!
তিন
আমাদের
সময় সেমেস্টার সিস্টেম ছিলনা। ফিফ্থ আর সিক্সথ ইয়ারে ভাগ করা ছিল। যখন ঠিক সিক্সথ
ইয়ারে, তখন ঠিক হল এই রকমই রি- ইউনিওন হবে
সমস্ত প্রাক্তনী দের নিয়ে। ওহ্ সে কি উত্তেজনা.....। সয়েলের ডক্টর রয় বলে দিলেন
নাটক অভিনয় করতে হবে। আমার আর মীনাক্ষী র চোখে তো ঘুম নেই। স্যার তো বলেই খালাস, এম.সি.এম বললেন তোরা বরং চিরকুমার সভা
মঞ্চস্থ কর। তাহলে সভাপতি মানে নাটকের আর কি.... আপনি হচ্ছেন তো স্যার? ফস করে বলেই বসল মু -ফোড় মীনাক্ষী। সবাই এক্কেবারে হৈ হৈ করে
উঠল। স্যার এর রাজি না হয়ে উপায় আছে?? শুরু
হল ডক্টর রয়ের তত্তাবধানে রিহার্সাল। দুই হিরোয়িন নীরবালা, নিপবালা বলাই বাহুল্য আমি আর মীনাক্ষী। এদিকে দুই হিরো মানে
শ্রীশ্ আর বিপিন পাওয়া দুষ্কর। মীনাক্ষী তার বিপিন ঠিক করেই নিয়েছে ফিশারি ল্যাব
এর রিসার্চ স্কলার লম্বা ফর্সা সুন্দর দেবুদাকে। আর শয়তানি করে রাজি করানোর
দায়িত্ব চাপিয়েছে আমার ঘাড়ে। যাই হোক, দেবুদা
তো রাজি হল কোনমতে, কিন্তু আমি শ্রীশ্
পাই কোথায়?? গৌতম কে বলতেই ও
এককথায় রাজি। শুরু হল রিহার্সাল... রোজ ক্লাসের পড়ে গ্রাউন্ড ফ্লোরের লেকচার
থিয়েটারে। মহীতোষ স্যার, ডক্টর রয় আর পি.সি.বি
যতই শেখান, আমরা ততই ভুলভাল করি।
একদিন হঠাত্ কাঁচুমাচু মুখ করে গৌতম এসে হাজির। ও নাকি অভিনয় করবেনা ওর মায়ের খুব
অসুখ। বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি। যাচ্চলে নাটকের কি হবে? যাই হোক, বন্ধুরা পড়িমরি করে ছুটল সেখানে। স্যার
বললেন, ওরে শৈবাল এ যাত্রা তুইই উদ্ধার করে দে দিকিনি! তুই শ্রীশ্ হয়ে
যা, শৈবাল ছিল সব ব্যাপারে আমাদের মুশকিল
আসান। তাই বলে একেবারে অভিনয়.......! কিন্তু এখানে ওর কোন কথা ধোপে টিঁকলে
তো! শৈবাল কোনমতে বলে উঠল.... ওই অনিন্দিতা টাকে দেখলে আমার কোন ভাব ই আসেনা
স্যার...... পাত্তাই দিলেন না মহীতোষ স্যার। সে এক খোরাক বটে! এদিকে হয়েছে কি
রিহার্সাল রুমে একদিন অবলাকান্ত আর তার প্রেমিকা মানে নাটকের আর কি...... দুজনেই
আমাদের জুনিয়র শংকর বর্ধন আর দীপ্তশ্রী মান্না এক্কেবারে মিসিং। খোঁজ খোঁজ খোঁজ....
কোথায় গেল!! ঠিক তিনঘণ্টা পরে দেখি ডিপার্টমেন্ট এর পাশের গাছতলা দিয়ে গুটি
গুটি দুজনে আসছে, এক্কেবারে চুরি করে
ধরা পড়েছে যেন! সব্বাই মিলে.... এই কোথায় গিয়েছিলি র্যা???? চেপে ধরা আর কি!!!
বেচারিরা আর কি করে....স্বীকার করল যে গেছিল সিনেমা ... সদ্য রিলিজ হওয়া ঋষি-
ডিম্পলের.... সাগর দেখতে। যাই হোক দিন ঘনিয়ে আসে, আমরাও কোমর বেঁধে তৈরী। পুরো নাটকটাই এডিটিং করেছিলাম বলাই
বাহুল্য আমি আর মীনাক্ষী.... ডিপার্টমেন্ট
এর দুই দুষ্টু গ্রহ। এদিকে শুভ্রা আর জগু দিদি - জামাইবাবুর রোল নিয়ে ব্যস্ত।
মীনাক্ষী আর জগুর অপূর্ব গানের গলা খুব ভাল ভাবেই কাজে লাগানো হয়েছিল নাটকে।
সে
ঘটনায় পরে আসছি, আগে তো খুঁজে বার করি
বুলাকে।
চার
বুলার
দেখা মিলল আরো দিন সাতেক পরে। ভগ্ন বিধ্বস্ত চেহারা। ক্লান্ত পায়ে, অবিন্যস্ত চুল, চোখের নীচে বহু রাত না ঘুমোনোর কালি। চমকে উঠলাম দেখে। 'এ কি চেহারা হয়েছে তোর? গিয়েছিলিই বা কোথায়?' নিরুত্তর বুলার দুচোখে টলটলে জল। হস্টেল
থেকে ওর বইপত্র গুলো নিয়ে চলে যাচ্ছে ও, আমি
সন্তর্পণে ওর পিছু নিলাম। একটি জীবন বিমুখ মেয়েকে জীবনের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনার
প্রাণপন প্রচেষ্টায়। কখনো কি আসবে ফিরে?? আবার কখনো সেই সোনায় মোড়া দিনগুলো? নাহ্,.....বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস......! পদ্মনাভ স্যারের ক্লাস করতে
করতেই দূরে ঝিলের ওপর পাড়ে ম্যাথস্ ডিপার্টমেন্ট থেকে ভেসে এল বিহুর সুর..... শুভর
গলা না?? শিলচরের ছেলে, দারুন গায়! শুনতে কি
পাব? আর কখনো.... এমন ভাবে....!শুনেছি এখন বড়
হলে টিকিট কেটে শুনতে হয় ওর গান! কখনো কি আর ফিজিক্স এর শ্রীরূপ ডাকতে আসবে
আমায়.... চল রে অনিন্দিতা আজ বিকেলে
ইউনিভারসিটি প্রোগামের রিহার্সাল আছে....হেমাংগ বিশ্বাসের শংখচিল হবে জানিস তো!
তাতে আমি শংখচিল আর তুই সাগরিকা! আর কখনওই শৈবাল বা সিধু এসে আমাকে বা শুভ্রা কে
বলবে না, এই নে চিংড়ির চপ খা, তারাবাগের গেটের কাছে যা দারুন ভাজে না!
পরীক্ষার আগের দিন দুপুরে উত্তম আর সাইকেলে করে এসে বলে যাবেনা...... ওরে
লিসম্যানিয়া ডোনোভানি পড়েছিস তো?
ওটাই
আসছে কিন্তু কাল। কিংবা স্পেশ্যাল পেপারে হিলসার নোট টা রেডী তো? তা না থাকলে সিধুর থেকে নিয়ে নে রে!
বিশাল চেহারা বিবেকের মিষ্টি মিষ্টি হাসি, বিধান মন্ডলের শান্ত সমাহিত চেহারা.....ছটফটে সুমনার মিষ্টি
চেহারাটা, মনে ভাসে এখনো। কিংবা
আর্মি বেসক্যাম্পে লালিত পালিত মিতালি ভজনের সিভিল এরিয়ায় সব ব্যাপারেই ইনসিকিওরিটি ফিলিংস, হিন্দি- ইংরেজী মেশানো অনর্গল
ভুলভাল বাংলা কথা, দরাজ হাসি আর অসম্ভব মেধা....... মনে পড়ে যাচ্ছে সওব। সরস্বতীপূজার সময় হোস্টেলে
হোস্টেলে রাতজাগা, পাছে বাগানের সব ফুল চুরি না হয়ে যায়! এও সম্ভব ছিল? পিছনে তাকিয়ে ভাবি অবাক হয়ে!
পাঁচ
ঘনিয়ে
এল বহু অপেক্ষিত রি- ইউনিয়ন এর দিন। সালটা উনিশশো ছিয়াশি। সকাল থেকে নানারকম
সেমিনার, উদ্বোধনী অনুষ্ঠান.... অবশ্য ই মীনাক্ষী
আর জগুর তত্বাবধানে আমরা বাকিরা,
ন্যাশনাল
ইন্টিগ্রেশন এর ওপরে। এইবেলা গৌতম কে আর ছাড়া হয়নি, ওর রোমান্টিক ভয়েস কাজে লাগাতে হবেনা! ততদিনে ওর মা সুস্থ
মোটামুটি। প্রাক্তনীরা একে একে এলেন, নিজেদের
কথা, ডিপার্টমেন্ট এর কথা......আজ পঞ্চাশ
বছরের পুর্তি উপলক্ষে আমরাও কি একই কথা বলে এলাম.....! কি জানি! সেই ডিপার্টমেন্ট, সেই পথঘাট, পাল্টায়নি কিছুই! আরো
যেন ঝকঝকে হয়েছে! বিভাগ বেড়েছে! বেড়েছে রিসার্চ স্কলার......নেট কোয়ালিফায়েড
জে.আর.এফ. আর এস.আর. এফ এর সংখ্যা। প্রচুর সেমিনার, জানবার প্রচুর সুযোগ, উন্নতি হয়েছে
লাইব্রেরির। কথায় কথায় ছেলে মেয়েদের আর ন্যাশনাল লাইব্রেরি বা ব্রিটিশ কাউন্সিল
দৌড়তে হয়না। এও কি কম!! দেখে এলাম এক ঝাঁক সম্ভাবনাময় উজ্জ্বল তরুন মুখ। আমরা যে
সুযোগ পাইনি বা পেয়েও হয়ত সদব্যবহারের অভাবে হারিয়ে ফেলেছি...... এই দীপ্তিময়
ভবিষ্যৎ পাক সেই সুযোগ। কাজে লাগাক জীবন টাকে, নিজের ছাড়াও পরের জন্য।
অনুষ্ঠান
এর দিন দুপুরে খেয়াল হল, লাস্ট সিনে কস্টিউম চেন্জ আছে, আমি এখনো কোন বেনারসি শাড়ি যোগাড় করতে পারিনি। এই রেহ, কি হবে এখন? অতএব সেই অগতির গতি শৈবাল! মীনাক্ষি বলল, ডাক ডাক শৈবাল কে! তখন তো আর মোবাইল এর
যুগ নয়! যাই হোক কোনমতে উত্তমকে ধরে পরে অরবিন্দ হোস্টেলে শৈবাল কে খবর পাঠানো গেল। ঘন্টা খানেক পরে দেখি একখানা ঘন
নীল রঙের বেনারসি নিয়ে শৈবাল হাজির,
বলল
অতি কষ্টে মামিমা কে বুঝিয়ে বাঝিয়ে আমার জন্য যোগাড় করে এনেছে।
নাটক
তো উতরে গেল বেশ ভালভাবেই। মনে হয় প্রাক্তনী দর্শকেরা দু পাশের উইংস থেকে ডক্টর রয়
আর পিসিবি স্যার এর প্রাণপণ প্রম্পটিং শুনতে পাননি, আমাদের মত ফাঁকিবাজ গুলো নিজেদের পার্ট গুলোও ঠিক ভাবে মুখস্থ
করিনি যে! গোল বাধল নাটক শেষে, আমার গায়ের সবুজ ওড়না
খানি আর খুঁজে পাওয়া যায়না। শুনলাম,
আমি
যখন কস্টিউম পড়ছিলাম, শৈবাল তখন হাতের কাছে
কিছু না পেয়ে ওটাই দিয়ে দিয়েছিল স্টেজের বুক শেল্ফের কভার করার জন্য। কিন্তু নাটক
শেষে ওটা আর যথাস্থানে নেই। পাওয়া গেল
প্রায় মাস তিনেক বাদে অরবিন্দ হোস্টেলে....আমাদের ই ক্লাসের রামকৃষ্নর মাথার
বালিশের তলা থেকে। বলাই বাহুল্য শৈবালই উদ্ধার করে এনেছিল আমার সবুজ ওড়না। বেচারা
রামকৃষ্ন........ বন্ধুদের গঞ্জনা......
হাসাহাসি.....থাক আর নাইইই বা ভাঙ্লাম।
ছয়
বুলা
কলেজে ওর ই ক্লাসমেট একটি কাশ্মীরী ছেলেকে ভালবাসত। ছেলেটির একটি পা ছোট।স্পেশাল
জুতো পায়ে হাঁটত। সহানুভূতি জনিত কারনে বুলা ওর প্রতি বেশি সংবেদনশীল হয়ে পড়ে। কলেজ এক্সকারশনে গিয়ে প্রেম
জমে উঠল ওদের। বুলা ছিল অসম্ভব মেধাদীপ্ত কিন্তু আবেগপ্রবণ। পড়াশোনায় ছেলেটি ধারে কাছে কোথাও নেই। শুরু হল
বুলার ওকে পাশ করানোর অক্লান্ত প্রচেষ্টা। কখনো হস্টেলে গিয়ে নোট মুখস্থ করানো তো
কখনো পরীক্ষার হলে ইনভিজিলেটর এর অগোচরে খাতা খুলে দ্যাখানো সব রকম ই আর কি! এমন
কি পাশ করার পরে চাকরীর ইন্টার্ভিউ তেও সেই বুলার ই কোন তুতো দাদার হাত ছিল।যাই
হোক ইউনিভারসিটির একঝাঁক সম্ভাবনাময় উজ্জ্বল তরুন তরুণী র মধ্যে এই বুলাকেও আমি
পেলাম। অসম্ভব ভাল গানের গলা, আর তেমন ই মজার মেয়ে।
যত গানের প্রতিযোগিতা হয়....... আমরা ঠেলতে থাকলেও ও অনড় অবিচল। ওর
এক্সপেরিমেন্টাল ভেঞ্চার চলতেই থাকে। নিজে অংশ না নিয়ে জগা কে উৎসাহ দিয়ে পাঠাত, আর মোটামুটি সব বিভাগেই জগা প্রাইজ আনলে
সে কি খুশি বুলার! এই হল মীনাক্ষী,
এক
অভাবনীয় চরিত্র, অন্তত তিরিশ বছর আগে আমাদের চোখে। কার্জন গেটের কাছে উত্তরায়ণ
বলে একটা ঝাঁ চকচকে রেস্তরাঁ ছিল।ওখানে প্রায়ই দুপুরে খেতে যেতাম আমরা। কোন আধুনিক
খাবার না, প্লেন মাছের ঝোল, ভাত আর স্যালাড। হস্টেলের একঘেয়ে সিলভার
কার্পে আর ডাল নামক হলুদ ঝোলে বিবমিষা এলেই ছুটতাম উত্তরায়ণ আমি আর বুলা। প্রায়শই
রাতের মিল অফ করে বিরিয়ানি কিংবা চাউমিয়েন। তখন তো আর এত অনলাইন সার্ভিস ছিল না যে, অর্ডার করলেই ক্যাশ অন ডেলিভারি হবে!
তখন নিজেদের ই সবকিছু আনতে হত। তার মধ্যেও এক উৎসাহ ছিল,উদ্দীপনা ছিল বাজার যাবার, একটু হেঁটে আসার। সবুজের মাঝে খোলা বাতাসে অক্সিজেন নিয়ে আসার।
এমনই অক্সিজেন সংগ্রহ কালে আলাপ হয়েছিল ফর্সা, সুন্দর, মিস্টি দাড়িওয়ালা
আলাউদ্দিন এর সংগে। ও তখন মেডিকেল কলেজের
তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। আলাপ হওয়ার পরে
প্রায়ই হাঁটতে হাঁটতে চলে আসত, আমাদের হস্টেলের মাঠে, আড্ডা দিতে। বলাই বাহুল্য বক্তা আমি আর বুলা, শ্রোতা আলাউদ্দিন। মাঝেমাঝে ছোট ছোট
গালিবের শায়রী লিখে পাঠাত আমার ঠিকানায়।মনের গভীর কোনে কোন অনুভূতি ছিল কিনা আজ আর
মনে পড়েনা। তবে সেই শায়রী লেখা চিঠি পুরো হস্টেল ঘুরে তবে এসে পৌঁছত আমার হাতে।
মাঝে মাঝে দল বেঁধে ক্লাস কেটে সিনেমা যাওয়া হত। তাড়াহুড়ো করে এম.সি.এম ক্লাসে
ঢোকার আগেই বেরিয়ে যেতাম আমরা দশ বারো জন। শো শুরু হয়ে যাবে যে! যথারীতি এক ই
রিক্সায় আমি আর বুলা। ' শোন রিক্সাওয়ালা, মনে কর তুমি যেন অলিম্পিকে রিক্সা
চালাচ্ছ এমন করেই জোরে চালাও তো ভাই'। বুলার কথা শুনে লোকটা হাসবে না কাঁদবে ভেবে পেতনা। এহেন
প্রাণবন্ত মেয়ে জীবন বিমুখ হয়ে যায় কি করে?
সিধুকে
নিয়ে ছুটলাম ওর বাড়ি। কথাই বলতে চায়না! অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেল যে ও
গিয়েছিল দীঘা নয়.......শিলং এ। সঞ্জয়ের খোঁজে, ওর সেই কাশ্মীরী বন্ধু। নিজের স্কলারশিপ এর টাকা খরচ করে বুলা
তিনজনের আসা যাওয়ার প্লেনের টিকিট কেটেছিল। শুনলাম গত তিনমাস ধরে বুলার একটা চিঠির
জবাব ও সে নাকি দেয়নি! মাঝে বুলার পীড়াপীড়িতে একবার চিত্তরঞ্জনে গিয়েছিলাম আমি আর
সিধু ওই ছেলেটির মায়ের কাছে। ভদ্রমহিলা বুলাকে ধরে খুব ই কান্নাকাটি করলেন! সেই ছেলেটির মা বাবা দুঃখ পেলে কি হবে, যার জন্য এতকিছু সে নাকি
বুলাকে চেনেনা আর। বেচারির তো এক্কেবারে হার্ট ব্রোকেন অবস্থা। যাই হোক
অনেক বুঝিয়ে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য রাজী করালাম ওকে। ভালই পরীক্ষা দিল। আর তারপরেই
বিয়ে করে ফেলল ঝপ করে, খুব সহ্দয় ভাল মানুষ
ওর স্বামী। বুলাও ভালভাবে বিএড পাশ করে চাকরী পেল একটি ভাল বেসরকারি স্কুলে।
সাত
গরমের
ছুটিতে অনেক ছেলেমেয়েই বাড়ি যেত না। হস্টেলে থেকে পড়াশোনা করত। এদিকে তো মেস বন্ধ,কারন গ্রুপ ডি কর্মচারীরাও বাড়ি যায় এ
সময়। তাহলে উপায়? অতএব ডাব্বা সিস্টেম।
ছেলেদের হস্টেল অরবিন্দ বা রবীন্দ্র থেকে আসত খাবার। অবশ্যই দুবেলা। কেউ কেউ
একবেলাও নিত। এহেন ব্যবস্থা পনায় বই ও নোট শেয়ারিং করে পড়াশুনো নেহাৎ মন্দ হতনা।
অতবড় হস্টেলে খুব ই কম মেয়ে তখন।বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগত, মাঝে মাঝে মনে হত যেন দেয়াল গুলো গিলতে আসছে। তারাবাগ মানে
মেয়েদের হস্টেল ক্যাম্পাস এর গেটের কাছে যথেষ্ট দারোয়ান মোতায়েন থাকত, যারা বেশির ভাগ ই খৈনি ডলত আর নিজেদের
মধ্যে গল্প গুজব করতেই ব্যস্ত থাকত বেশি।শুরু হল বিহারী দের লগন, মানে বিয়ের মরসুম। একজন খৈনি ডলা পালোয়ানের বিয়ে লাগে তো বাকিরা অবশ্যই বারাতি। কালক্রমে এমন একদিন
এল যে সেদিন কোন দারোয়ানই আর তারাবাগের গেটে নেই। "মেয়েরা শোন, আজ হস্টেলে কোন গার্ড থাকবেনা।"
বাঁজখাই গলায় হস্টেল সুপার মানসী দি বাইরের মাঠে দাঁড়িয়ে বেশ জোরেই সেটা জানান দিলেন। তারপর জানিনা কি
হল, সন্ধের থেকেই এক গা ছমছমে পরিবেশ। মেয়ে
কম বলে সব ঘরে আলোও জ্বলছে না। বাইরের আলোও অপ্রতুল। স্ট্রীট লাইট গুলোও মিটমিট
করছে। সব মিলিয়ে বেশ আধিভৌতিক পরিবেশ। যাই হোক রান্নাবাড়ার ঝামেলা নেই, মেসে খেতে যাবারও বালাই নেই। এমতাবস্থায়
ছেলেদের মেস থেকে আসা ডাব্বা সিস্টেম এর খাবার খেয়ে নিশাচর রা ছাড়া মানে যারা
রাতের পর রাত জেগে পড়াশোনা করে আর কি, বাকিরা
বারোটার মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লাম। হঠাৎ ঘুম
ভাঙল, নবগ্রাম থেকে আসা রীতা বলে একটি মেয়ের
হাঁউমাউ চীৎকারে। কি হল কি হল করে আশে পাশের মেয়েরা ঘর থেকে দৌড়ে বেরোতে গিয়েই
দ্যাখে করিডোর এর অর্ধেকের বেশি লাইট জ্বলছে না।
কারো
কারো দরজা বাইরে থেকে ছিটকিনি দেওয়া। সন্ধ্যা ও যশবিন্দর তার ই মধ্যে জানলার
গ্রীলের ফাঁক দিয়ে কোনমতে বাইরে এসে
দ্যাখে হাতকাটা স্যান্ডো গেঞ্জী আর কালো হাফপ্যান্ট পরা তেক চুকচুকে কয়েকটা অবয়ব
ঘুরে বেড়াচ্ছে এদিক ওদিক। ওরা তার ই মধ্যে পা টিপে টিপে বাকি মেয়েদের মুক্ত করতেই
সিবাই মিলে তারস্বরে চীৎকার "চোওর.....চোওর....",সংগে সংগে বাগানে, করিডোরে, সিঁড়িতে ধুপধাপ আওয়াজ। যশবিন্দর ততক্ষনে সাউথ ব্লকের ভিজিটরস
রুমে গিয়ে, তারাবাগের সামনেই ছিল
অরবিন্দ হোস্টেল,সেখানে একটা ফোন করে
দিতেই হৈ হৈ করে চলে এল ছেলের দল। চোরগুলো আর পালাতে পথ পায়না। যে যেদিক দিয়ে
পারলো দৌড়ে, লাফিয়ে, ঝাঁপিয়ে হুড়মুড় করে পাঁচিল টপকে পালিয়ে
বাঁচল। স্ট্রীট লাইট গুলো আগেই ভাঙা ছিল, কে
যে কোথা দিয়ে পালাল, আজো রহস্য!
দিন
কয়েক পরেই শুরু হল অনুসন্ধান। কি করে হল......কিভাবে.... কেমন করে? এই সব আর কি! আমি, বুলা, ইন্দ্রাণী শীল, সন্ধ্যা, যশবিন্দর, আর বাকি কিছু
আউটগোয়িং ব্যাচের মেয়ে মিলে ঠিক করলাম, এর
একটা বিহিত করতেই হবে।যথারীতি মিটিং হল,স্থির
হল পরদিন সকাল দশটায় প্রথম ক্লাস গুলো আমরা কেউই অ্যাটেন্ড করব না। তার বদলে রাজবাটী র অফিসে গিয়ে আর্জি
জানাব, ভাইস চ্যান্সেলর এর কাছে। যাতে করে
মেয়েদের উপযুক্ত নিরাপত্তা র
ব্যবস্থা নেওয়া হয়। যেমন ভাবা তেমনি কাজ।
পরদিন
সকাল হতেই তৈরী হয়ে আমরা দল বেঁধে গেলাম রাজবাটী। স্যার আমাদের সময় দিলেন, মন দিয়ে সব কথা শুনলেন। ভাল লাগল সকলের।
তার দুদিন পর থেকেই শুরু হল দোতলা তিনতলা সমস্ত করিডোরে গ্রীল লাগানো, উপযুক্ত কোলাপসিবল লাগানো, ছাদের দরজা মজবুত করা ইত্যাদি।
আট
পত্রলেখা ছিল ডে-স্কলার। আসত অন্য এক দূর শহর থেকে
ট্রেনে করে। দারুন টিফিন করে দিতেন মাসিমা মানে ওর মা, আর আমরা হেস্টেল বাসী বুভুক্ষুর দল চেটেপুটে খেতাম সেসব, বেচারি র কপালে ডিম খানা শুধু জুটত, বেশির ভাগ দিন। ও চেয়ে দেখত আর বলত, 'খা রে তোরা, মা কে কাল বরং আর একটু বেশি দিতে বলব'। আমাদের হোস্টেল থেকে যখন তখন দুপুরের
দিকে উত্তরায়নে হানা দেবার সময় বুলা বলত, 'দ্যাখ
মরতে তো একদিন হবেই, তো না খেয়ে মরি কেন? খেয়েই মরব, তেল ঝাল মশলা যাই দেয় না কেন! হাহাহাহাহা '! শৌনকের কাজ ছিল সবার টিফিন খু্ঁজে খু্ঁজে
খেয়ে ফেলা!তাই সোমবার দিন্ টা ছিল আদর্শ। কারন, ওইদিন আমরা সবাই যে যার বাড়ির থেকে আসতাম। সেউদিন শৌনককে দেখা
যেত ঝিলের জলে লাল, নীল, হলুদ, গোলাপী হরেক রকম টিফিন বক্স ধুতে। বড় মজার ছিল সেসব দিন! কেয়ার
ফ্রী, দায় নেই, দায়িত্ব নেই,
ঝাড়া
হাত পা এক্কেবারে। এই পত্রলেখার সংগে আমাদের ই ক্লাসের শাম্বর এক অলিখিত মানসিক
সম্পর্ক তৈরী হয়ে গিয়েছিল। কেন যে সে সম্পর্ক স্থায়িত্ব পেলনা, জানিনা। এদের দুজনের সংগে আর কোনদিন
আমাদের দেখাও হয়নি।যেমন সম্পর্ক টেঁকেনি নীলকন্ঠ আর পারমিতার।শুনেছি পারো নাকি
এখনো তার নীল কে খুঁজে চলেছে কোন এক অ্যাসাইলামের নিভৃত প্রকোষ্ঠে।জীবন সবসময় সুখ
দেয় না সবাইকে।সুখ আহরণ করে নিতে হয়।সুখের আস্বাদ পেতে গেলে ত্যাগ ও স্বীকার করতে
হয় অনেক। আমরা ক' জন পেরেছি, সেই ত্যাগের মহিমায় মহিমান্বিত হতে?
আউট
গোয়িং ব্যাচ আমরা। দিন ফুরিয়ে আসছে তাড়াতাড়ি। ফুরিয়ে আসছে বন্ধুদের সাথে একসাথে
থাকার মেয়াদ ও। মন খারাপ লাগে ভীষণ। সেলিব্রেশনের জন্য একটা পিকনিক করলে কেমন হয়? যেমন ভাবা তেমনি কাজ! ঠিক হল পাল্লারোড
যাওয়া হবে, ব্যাস প্ল্যান মাফিক
একদিন দল বেঁধে বেরিয়ে পড়া গেল। ঠিক হল এটা মনে রাখার মত একটা অ্যাডভেঞ্চারাস
আউটিং হবে। শুধু ট্রেনেএ টিকিট কাটা হবে পয়সা দিয়ে,আর বাকি সব ই নিখরচায়। তাতে যদি খাওয়া জুটল তো ভাল, আর নইলে ভুখা পেটেই ফিরে আসব। নির্দিষ্ট
দিনে লম্বা লম্বা পা ফেলে স্টেশন পৌঁছলাম। কথামতো টিকিট কেটে ট্রেনে চড়ে বসল সকলে।
সে এক হৈহৈ রৈরৈ কান্ড। মাঠ, ঘাট, ধানক্ষেত পেরিয়ে ট্রেন
এসে থামল পাল্লারোড স্টেশনে। ট্রেন থেকে নেমে মেঠো রাস্তা ধরে গান গাইতে গাইতে দল
বেঁধে চলেছি আমরা। বর্ষা শেষ হয়ে শরতের উঁকিঝুঁকি। বড় মনোরম প্রকৃতি। সবুজে সবুজে
ছয়লাপ। সামনে একদিকে খোলা প্রান্তর,
অপরদিকে
ভরা দামোদরের শান্ত রূপ। চোখ জুড়িয়ে গেল। এদিকে তো পেট চুঁইচুঁই। যার কাছে
যৎসামান্য ঝেড়েঝুড়ে যা পাওয়া গেল,
তাই
দিয়ে মুড়ি চানাচুর সহযোগে চা, গ্রামের মোড়ের খুড়োর দোকান থেকে খেয়ে
ছেলেরা সব হাফপ্যান্ট পরে গামছা গায়ে টপাটপ দামোদরে ঝপাং। মেয়েরাও কিছু কম যায়না, শেষে গায়ের জামা গায়েই শুকোল সবার।
ইতিমধ্যে আমাদের উৎসাহ দেখে গ্রামের কিছু সাদাসিধে মানুষ আলাপ জমাতে এল। সুস্মিতা
ফাঁকতালে বলেই বসল আমাদের আজকের অভিযানের স্ট্যান্ড পয়েন্ট। এই কথা শুনে তো মানুষ গুলোর মাথায় হাত। ' ওম্মা, সে কথা বলেন কি কত্তা? চলেন চলেন, আজ আপনেরা আমাদের
অতিথি। ' এই কথা বলে নিয়ে চললেন ধরে বেঁধে আমাদের
ক' টিকে। সেই সাধারন মোটা চালের ভাত, ডাল, আর ক্ষেতের তরকারির স্বাদ যেন অমৃত, আজও মুখে লেগে আছে। সন্ধ্যে বেলা আবার দল বেঁধে হস্টেলে ফেরা।
এখন আর কোন কথা নয়, মন দিয়ে তৈরী হতে
হবে।ক'দিন পরেই যে পরীক্ষা।
নয়
পরীক্ষা
দিয়ে জীবনের স্রোতে যে যার হারিয়ে গেলাম আমরা।কেউ কারোর খবর আর কোথাও রাখিনি। না
ছিল মোবাইল, না ছিল সোস্যাল নেট
ওয়ার্কিং সাইট। হারিয়ে গেল বিবেক,
সমীর
মনি, সুমনা আর চৈতালী কুমার। খুঁজে পেলাম না
উত্তম, বোরহান, দীপা আর বৃন্দা মেনন কে। শুনেছি রুক্সানা হুদা চলে গেছে সেই
দূর বিদেশে। শৈবালও আর থাকেনা এদেশে। খবর নেই সিধু আর বিধান মন্ডলের। রত্না মেহরা
এখন বর্মন হয়েছে, দুই ছেলে মেয়ের মা, বিবেকানন্দ কলেজে পড়ায়। বছর পনেরো আগে
চেন্নাইয়ে একটি সেমিনারে যোগ দিতে গিয়ে হঠাৎ বুলার সাথে দেখা। সেইই বুলা, আমার স্টাইলিশ সখি, কি ভাল যে লাগছিল...। ওও এসেছে কলকাতা
থেকে সেমিনারে যোগ দিতে। কিছুতেই ছাড়ল না, ধরে নিয়ে গেল ওর হোটেলে, সারারাত ধরে চুটিয়ে আড্ডা, ঠিক যেন সেই আগের বুলা! ফিরে আসার পরে আবার যেন কেমন বেপাত্তা
হয়ে গেল। ওর খামখেয়ালিপনার কোন সারাজীবনেও পাইনি আমি। বুলার উৎসাহেই আমার প্রথম
স্কুলে চাকরি, ওর উদ্দীপনা, ওর ভালবাসা সব জমা রয়েছে মনের অগোচরে।
ফিরে এলাম আবার তিরিশ বছর পরে একই মাটিতে...হোক না তিরিশ জনের জায়গায় মোট সাতজনের
উপস্থিতি! তবু চোখের দেখাটা তো হল... নাই
বা এল বুলা আর সিধু... না হয়, না হয় নাইই বা ধরল
সুস্মিতা ফোন বারবার, রত্না চ্যাটার্জী আগের
দিন মেসেঞ্জারে ওর যাবার ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও ভীষণ অপারগতার কথা নাহয়
জানাল...রামকৃষ্ন চলেই না হয় গেল উইক এন্ডে বাড়ি...তবুও কেউ তো এল! সেই গৌতম আর
শৈবাল! চুলে পাক ধরেছে কেমন। দুজনেই দেশ
এবং বিদেশের ডি এস সি ডিগ্রিধারী স্বনামধন্য প্রফেসর, মুখে সেই অকৃত্রিম হাসি, সব্বার পেছনে লাগার মজার মানসিকতা।
আমাদের
সময়ের অধ্যাপকরা সকলেই রিটায়ার্ড। কেউ কেউ গত হয়েছেন। বাচ্চা বাচ্চা রিসার্চ
স্কলাররা দৌড়ে বেড়াচ্ছে। কত খাবার দাবার, কত আয়োজন, নয়নাভিরাম অপূর্ব বাগান...এককালে যেখানে আড্ডা মারতাম দল
বেঁধে।
জগার
কত আফশোষ, আসতে পারলনা
বেচারি... কিডনির ক্যান্সারে ভুগছে অধ্যাপক ডঃ জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়... গর্ব হয়
যখন শুনি ওর রবীন্দ্রসংগীতের অ্যালবাম। বহুদিন হল শুভ্রা আর মিতালির একলা পথ চলার।
দুটি দুর্ঘটনায় দু'জনেই হারিয়েছে তাদের
স্বামীদের। প্রাণোচ্ছল দুটি প্রাণ...চোখের দৃষ্টিতে বিষাদের ছায়া ভাঙতে দেয়নি সুদৃঢ় মনোবল। শক্ত হাতে তৈরী করে
চলেছে সন্তানদের, আর অগনিত ছাত্র
ছাত্রী। দেখা হল ICMR এর বিজ্ঞানী ডঃ
চৈতালি কুমারের সাথে, অনাবিল হাসি মনে
পড়িয়ে দেয় বৈঁচি গ্রাম থেকে পড়তে আসা সেই গ্রাম্য সরল চৈতালি কে। এরাই তো মানুষ
গড়ার কারিগর।
দশ
আহা, আবার যদি টাইম মেশিনে চেপে ঘুরিয়ে দেওয়া
যেত সময়!খুঁজে পেতাম সেই উজ্জ্বল দীপ্ত সময়! সেই তারুণ্য, টগবগে উত্তেজনা,
ইনোসেন্স, বিশ্বাস, নিবেদিত প্রাণ...... জীবন!! ভাবতে পারছি না সত্যিই।নবীন বরনের
কচিকাঁচা মুখগুলোই এক ঝটকায় কেমন বদলে গেল ফেয়ার ওয়েলের হলে।সামনে অনিশ্চিত
ভবিষ্যৎ.... কি হয় কি হয় ভাব.... বন্ধুরা
ছেড়ে যাচ্ছে..... কেউ কেউ জীবনের জুটি
বেঁধেছে.... কেউ বা পারল না..... হারিয়ে যাবে ধীরেধীরে.... আউট অফ সাইট.... আউট অফ
মাইন্ড.....!
ফেয়ারওয়েল
এর হলে স্যারেদের অনুরোধে মীনাক্ষী কফিহাউস গাইছে, আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনছি, সেই হলে ঘুরে বেড়ালাম কাল আমি আর মিতালি, কি নস্টালজিয়া, আবার ওই হলেই শৈবাল
ছবি তুলছে ওর ক্যামেরায় আর আমি নাচছি..... মীনাক্ষী গাইছে..... ভরা থাক.... ভরা
থাক.... স্মৃতিসুধায় জীবনের.... পাত্রখানি....!!
আজ
এত বছর পরে এসে বুঝেছি জীবনে কিছু শুন্যতা কখনো ভরেনা! আফসোস বয়ে বেড়াতে হয়
সারাজীবন!!
কষ্ট সুখের আঙিনায় ছায়া ফ্যালে নিঃসংগতা
কুরে কুরে খায় কথাগুলো, যখন
দরোজায় অপেক্ষিত শুন্যতা!
কখনো ভিতর কখনো বাহির
রক্তাক্ত হে সময়!!
ভুল বোঝার অবকাশে..... সময় বহে যায়
আর আমাদের অকারন.... বয়স বেড়ে যায়!!
স্মৃতি কি যায় মুছে? বলে যায় যে কথা ফিরে ফিরে!
অনেক কাজের মাঝে... মনের গহন অতলে
বেঁচে থাকা সেই স্মৃতির অনুভবেই,
মিথ্যে মায়ার বিষণ্ণতা!!
ভাবনা ছড়ায় আগামী.... জাল বুনে বুনে
চিন্তার পরতে সুখ মাখে জীবন
সুদিন আসে... যোগসুত্রের হাত ধরে,
ভুল বোঝার অবকাশে.... সময় বহে যায়
আর আমাদের অকারণ.... বয়স বেড়ে যায়!!
শেষ।
অনিন্দিতা সেন: কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন