সিন্ধুপারে



গল্প


এক

যদি যোগাযোগ রাখেন তবে থাকবে না-হলে এই ট্রেন-জার্নির পর আর নয় ওকে সবচেয়ে ভালো লেগেছিল আমার ছেলের সে তখন ক্লাস এইটে পড়ে জলপাইগুড়ি জেলা স্কুলে লাল একটা সাহেবি আমলের স্থাপত্য শিলিংগুলি বেশ উঁচু সবুজ মাঠ আর ওপারে তিস্তা মাঝখানে অবশ্য মাটির টানা বাঁধ খুব বৃষ্টি হলে বাঁধের অন্য পারের বাড়ি-ঘর ভেসে যেতো তখন সব মানুষ বাঁধের ওপর এসে অস্থায়ী ঘর করে থাকতো হাটুরেদের খিচুড়ি বিক্রি হতো আমি কয়েকবার খেয়েছি শালপাতার থালায় মাত্র ৩ টাকা আর সঙ্গে পোড়া পাপড় তখন নোকিয়ার মোবাইল সবে এসেছে সাদা কালো স্ক্রিন সবুজ আলো জ্বললে ধরতে হয় আর লাল আলো মানে চলভাষের বার্তা শেষ হলো ভারত সঞ্চার নিগম নামটাও বোধহয় তখন এসেছে নেট ওয়ার্কের জন্য তখন থেকেই কুখ্যাত

ছেলেকে বললাম, দিদিভাইয়ের নম্বরটা টুকে নে ...আমার ছেলেকে চিবুক ধরে আদর করে বললো ~ কিউট তারপরেই বলতে থাকলো ৯০০ ............. আরো সব ডিজিট আমার বউ তখন বাথরুমে গেছে সে ফিরে এসে বললো তুমি কি এনেছো! খাবে না!  সে বললো ম্যাগি আমার দিকে তাকিয়ে বললো, দেখেছেন বউদির কাছে আমি কতোটা গ্রহণীয়! আমার বউ লুচি, আলুর দম দিলো ওকে তিস্তা তোর্সা এক্সপ্রেসটাই এরকম সবাই বাঙাল ভাষায় কথা বলে আমরা দুজনেই বা তিনজনেই পিতৃ-মাতৃ সূত্রে বাঙাল কিন্তু কাষ্ঠ বাঙালের পরিচয় কথায় নেই আসলে আমরা উওর কলকাতায় বেড়ে উঠেছি পাশের সিটগুলিতে একটি মেয়ে বেশ জোরে জোরেই বললো আমাগো দ্যাশের সোয়াদই আলাদা কলকাতায় এই যে যাইতাছি ~ হালায় পানির মধ্যেও অষুধের গন্ধ মানুষগুলারও কেমন ধারা বাড়ি গেলে বইতে কই না খাওন তো পরের কথা ওর ডাক নাম ঝুমুর, ভাল নাম অয়ন্তিকা ভট্টাচার্য

ঝুমুর একটু আগে বলেছিল, ম্যাগিতে সারা রাত হয়ে যাবে কিন্তু এখন লুচি আলুর দম চোখ বুজে আহ্লাদ করে খাচ্ছে
কলকাতার লোক হওয়ায় আপনার গায়ে লাগলো না কথাগুলি
আমি বললাম,
আসলে পিতৃ-মাতৃ সূত্রে আমিও বাঙাল তবে উওর কলকাতায় শৈশব, কৈশোর, যৌবন
আর বার্ধক্য!
আমি বললাম জানি না তো এখনও তো যুবক
বার্ধক্য বারানসী
আমি বললাম, ঠিক আছে আমরা সকলেই বুড়ো, বুড়ি হয়ে তখন একসঙ্গে থাকবো
ঝুমুর বললো অতোদিন আমি কি বেঁচে থাকবো!
সাহসিনী মেয়েটির অজান্তেই চোখ দুটো ছলছল করে উঠেছিল
তারপরেই বললো ধুস্‌ খুব গুমোট আজকে
এরকম পেশা নিলে কেন!
বা-রে ~ মেয়েরা কি রিপোর্টার হতে পারে না!
কেন, হবে না! বললাম
আমার বউ বললো তোমার ভালো নামটা কি!
অয়ন্তিকা ভট্টাচার্য
পড়েছি মনে হয় বিদিশা  মানে আমার বউ বললো
আমি বললাম কবিতা, গল্পও লেখো!
না আমি একদম ফ্রি লান্সার
আর কোন কিছু ভালো লাগে না
কবিতা লেখা আমার কাছে মাথা ভর্তি খুসকির মতো কিছুতেই শান্তি দেয় না সেই কারণে আমার কাছে থাকে নোটবুক আর পেন
ট্রেন সবে আলুয়াবাড়ি ছাড়িয়েছে আমার পাশেই এসে বসলো
ছোঁ করে কেড়ে নিলো আমার রাইটিং প্যাড আর প্যাডে ভর্তি হতে থাকলো কবিতার বদলে এইসব শব্দ স্প্যাসমো, নাইট্রো, ব্রাউন সুগার, হেরোইন
কোন থানা বলছেন! বিধাননগর!
ফোনে কথা বলতে বলতে একজন তরুণি লিখে চলেছে এসব আমার কবিতা লেখা নিয়ে তার কোন মাথা ব্যথা নেই
শেষমেশ না পেরে বললাম হলো তোমার!
মিষ্টি হেসে অয়ন্তিকা বললো ~ ধন্যবাদ
খুব কাজে দিলো আপনার প্যাড-টা
আর কোনরকম অনুমতি না নিয়ে প্যাডের পাতাগুলি ছোট্টু বটুয়াতে ভরে নিলো
কিছুক্ষণ বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে রইলাম
শেষমেশ কোন ড্রাগ প্যাডলার নয় তো! সুন্দরী মেয়েরা আজকাল এসব করছে
নিজেই শুরু করল অয়ন্তিকা
দারুণ সাফল্য এসেছে আজ গাঁজার কিট চিলিম সাফি গাট্টি ছুরি সরিয়ে হেরোইন, ব্রাউন সুগার পুলিশ আসতে বাধ্য হয়েছে আমার করা স্কুপ নিউজে
হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম যেন
আলুয়াবাড়ি স্টেশন থেকে উঠলেন প্রথম দর্শনে বলেছিলাম
হাত জোড় করে তখন সেই মেয়েটি বললো ~ আমাকে ঝুলন বলে ডাকতে পারেন ভালো নামটা মন্দ না কিন্তু বড্ডো দীর্ঘ
আমরা তিনজনেই হেসে উঠেছিলাম
ঝুমুর বললো থানায় যখন খবর দিলাম আমার তখনও ব্রাশ করা হয়নি চোখে হয়তো পিচুটিও লেগে ছিল থানাতো পাত্তাই দেবে না, তারপর বললাম – ‘প্রেস কার্ড দেখালাম
আমার ক্যামেরাম্যান সৌরভ সঙ্গে একটা গিটার নিয়েছিল
অলকদামে ঘাম জমেছে ঝুমুরের ভাদ্র মাস, গরম রয়েছে বেশ তিস্তা-তোর্সায় জলপাইগুড়ি থেকে বাড়ি ফিরছি
আমার বউ বললো ঘামটা মুছে নাও
ঝুমুর বললো ~ থ্যাঙ্কস
আমি বললাম ধরতে পারলে!
একদম কুপির তেলের টিমটিমে আলো ইলেকট্রিক লাইন কাটা সৌরভ গীটারের সুরে ডাকলো- মাসী
তখনই দরজা খুলে গেলো, চারিদিকে শুধু ধোঁয়া আর ধোঁয়া
আমি বললাম ওসব জায়গায় তুমি পৌঁছুলে কি করে! পুলিশের সঙ্গেই ছিলে
ওরা সাংবাদিকদের মানুষ মনে করে না স্রেফ সিটের তলায় ঢুকে পড়েছিলাম সৌরভ আর আমি
আমার ছেলে সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে অয়ন্তিকা বা ঝুমুরের দিকে
আমি বললাম তুমি ক্রাইম রিপোর্টার!
না, ক্রাইমের এই বিভাগটার নাম ন্যারকোটিক্‌স 
ঝুমুর আবার হেসে বললো ফ্রি নিউজ সাপ্লায়ার খবর বিক্রি করি শুধু তাই নয় পুলিশ ও প্রশাসনকে সচেতন করি

দুই

ইসলামপুরে আমি বহু বছর আগে ছিলাম তখনও ইসলামপুর পশ্চিম দিনাজপুরের অধীন ছিল বালুরঘাট ছিল প্রশাসনিক হেড কোয়ার্টার আয়েত্রি নদী পেরিয়ে মোনালিসালজে উঠেছিলাম ইসলামপুরে সেভাবে কোন নদীর কথা মনে পড়ে না আমাদের একটা অফিসার্স ক্লাব ছিল নাম কিশলয় ওখানকার কেয়ার-টেকার ছিল দীনেশ

আমি বললাম ~ তুমি কি ইসলামপুরের মেয়ে!
ঝুমুর হেসে বললো ~ না, না  আমাদের বাড়ি যাদবপুরের বাঘা যতীনে বাবা-মায়ের সূত্রে আমরা ও বাঙাল এখানে আমার বিয়ে হয়েছে
আমার বউ বললো ~ এরকম সব বিপদজনক কাজে রয়েছো, এখানে কেউ বাধা দেয় না!
বাধাও দেয় না, সাহায্যও করে না ঝুমুর বললো
ট্রেনের কামরায় অনেকেই লাইট নিবিয়ে দিয়েছে খাবারের বাসনের টুং টাং শব্দ, কখনও কখনও নাসিকা গর্জন আর ট্রেনের ঝিকঝিক ছাড়া টুকরো সংলাপ, হাসির হিল্লোল তেমন শোনা যাচ্ছে না আর
আমার বউ বললো ~ তোমার কি আপার টাওয়ার অসুবিধে হবে না তো!
ঝুমুর বললো ~ না
ঝুমুর এবার বললো ~ আপনারা কি খুব তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েন!
আমি বললাম না
ট্রেনে পড়ার জন্য একটি বই সঙ্গে করে এনেছি, শঙ্খ ঘোষের ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ
দূরবতির্নী এক নারীর চরিত্র আর রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর এক সাংকেতিক কিন্তু গভীর ভালোবাসার কথোপকথন
ঝুমুর বললো ~ আমার খুব প্রিয় বই
মনে মনে বললাম ট্রেন থেকে নেমে গেলে অয়ন্তিকাও সুদূরেই চলে যাবে সেও তো থাকে কোন রহস্য সিন্ধুর ওপারে সুস্থ, সুখী জীবন দূরে সরিয়ে গন্ডিবাঁধা জীবনকে তোয়াক্কা না করে তার ক্রাইম জার্নালিজম
ভেলার মতো বুকে টানি /  কলমখানি / মন যে ভেসে চলে ......
আমাকে অবাক করে দিয়ে ঝুমুর বললো
বললো এবার ~ জানেন আমিও কবিতা লিখতাম, ছাপাও হতো কিন্তু তারপরেই মনে হলো নির্জন, নিঃসঙ্গতা আমার জন্য নয়
এবার বললাম বইটা পড়েছো কিনা, পড়া ধরবো!
ঝুমুর হেসে বললো ~ জানি আমি আপনার প্রশ্নটা!
বাপ-রে! মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়ল শব্দটা  টিকটিকি কেউ কেউ আমার সম্পর্কে বলে বলেই সে হেসে উঠল

পরিচয় আর অ-পরিচয়ের মধ্যে এই মানবীকে চেনা খুব কঠিন ভীড় থেকে দূরে থেকে সহসা আমাদের পরিচয় ঘটে কখনও কখনও এরকম কারুর সঙ্গে অফিসে সেদিন লোকজন খুব কম বৃষ্টি পড়ছে, শ্রাবণ মাসের একটি সন্ধে একটি মেয়ে আমার কাছে এলো বিশ্রস্ত চুল কিন্তু বুদ্ধিদীপ্ত দুটো চোখ

সরাসরি বললো খোদা হাফিজের সভায় আপনি গেছিলেন কেন!
আমি বললাম ড্রাগ বিরোধী সভা উদ্দেশ্য তো মহৎ
মেয়েটি বললো খোদা হাফিজেই তো পালের গোদা
আমাদের গ্রামে সব পুরুষেই নেশায় আসক্ত আর তার মূল কারণ সে-ই
আমি বললাম, পুলিশ আমাকে বলেছিল, ওঁকে ছাড়া পোস্ত-চাষ আমরা বন্ধ করতে পারবো না
আপনাদের সভায় হাততালি দিচ্ছিল কারা জানেন!
আমি বললাম কারা?
ড্রাগ প্যাডলারেরা চা, মিষ্টি সব অয়োজন ওদেরই করা পুলিশ সব জানে এবার আপনাকে পাশে দেখার পর গ্রামের মেয়েরা অসহায় হয়ে পড়েছে
তুমি যে এলে আমার কাছে!
আমার মনে হয়েছিল আপনাকে ভুল বোঝানো হয়েছে
বললাম ~ কি নাম তোমার!
কুলসুম বিবি আমরা লড়তে চাই এর বিরুদ্ধে,আপনাকে সাথে থাকতে হবে
কুলসুম বিবিকে দেখে আমার অয়ন্তিকার কথা মনে পড়ে গেলো
সে বলেছিল,যদি কোনদিন তেমন বিপদে পড়ি,আপনাকে ফোন করবো বাঁচাতে হবে কিন্তু তখন
বলেছিলাম ~ মৃত্যুকে ভয় করো!
না তবে কাজের মতোন কাজ করে মরতে চাই
কুলসুম বিবিকে বললাম
তোমার স্বামীও কি ড্রাগ নেয়!
নিতো, এখন সে সৌদি আরবে চাকরি করতে গেছে ফিরে এসে আবার নেবে
বললাম কি করতে চাও!
আপনাকে সব জানাবো, সাহায্য করতে হবে
রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতিতে লিখেছিলেন, আমরা সব ‘ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কৃত্রিম সীমায় আবদ্ধ যা কিছু জীর্ণ পুরাতন এবং অবক্ষয়ের তা-তো নতুনের পথ জুড়েই থাকে পারি না পারি তাকে আহ্বান করতে দ্বিধা থাকবে কেন!
কুলসুম বিবিকে বললাম আমি আছি তোমাদের পাশে
তার চোখ দুটো জলে ভরে উঠেছিল বলেছিল আমি জানতাম আপনি থাকবেন আমাদের পাশে
ঝুমুরের মতোন তাকেও বললাম মৃত্যুভয় নেই!
সে বলেছিল, আমরা কি বেঁচে আছি!

কখনও কখনও এরকম ঝড় আসে, গাছের পাতারা উড়তে থাকে, সব কিছু মুহূর্তেই লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়
উত্তর দিতে পারিনি
আমার জানা প্রশ্নটা করবেন না!
আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী .....
বলবো না প্রেরণদাত্রী কে!
আমাকে অবাক করে দিয়ে ঝুমুর বললো তোমায় বিদেশিনী সাজিয়ে কে দিলে, ছেলেবেলায় গানটা শুনেছিলেন রবীন্দ্রনাথ বোধহয় জীবনস্মৃতিতে রয়েছে
আমি বললাম ~ তোমার কর্মকৃতিময় প্রতিদিনে সংসারের  ছায়া কেমন লাগে!
মন্দ লাগে না আমার স্বামীর একটি কাপড়ের দোকান আছে ইসলামপুর বাজারে সে খুব ঠাকুর দেবতা নিয়ে থাকে সন্ধেবেলায় হরিসভায় যায় তবে সে নেশা করে না এসবের বিরোধীও আমাদের বয়সের পার্থক্য রয়েছে তবু সে কিন্তু ভালো ভীতু মানুষ বলেই হয়তো আমার জন্য তার গর্ব হয়, আবার দুশ্চিন্তাও হয় সামান্য অবাক হয়ে গেলাম আমরা হয়তো নারীদের বিজয়িনী, সাহসিনী খেতাব দেওয়ার আড়ালে এক অসুখী দাম্পত্য কল্পনা করি ঠকে গিয়ে মন্দ লাগলো না
এবার বললাম আমি জানো তোমার মতোন রিপোর্টার ছিলাম!
তাই!
উৎসাহে প্রায় আপার টায়ার থেকে পড়েই যাচ্ছিল কোন কাগজে!
বলতে পারো ফ্রি ল্যান্সার বা মনে মনে!
মনে মনে ওকে বললাম, তুমি থাকো সিন্ধুপারে হাওড়া স্টেশনে নামার সঙ্গে সঙ্গে অন্বয় ছিন্ন হয়ে যাবে তুমি থাকবে সিন্ধুপারে আমি আমার নিরীহ, গোবেচারা সাংসারিক জীবন আর অফিসের রুটিন-কর্মে
একটা স্মরণীয় রিপোর্টিং অভিজ্ঞতা বলুন
বলতে শুরু করলাম,
তখন আমার বয়স ১৯-২০
খুব হ্যান্ডসাম ছিলেন
একদম নই ৪৯ কে. জি. ওজন হাইট তো ৫ আর মাথা ভর্তি খুসকি বান্ধবীরা বলতো ‘Wildly clad’
ঝুমুর বললো তারপর!
ঘুম পাচ্ছে না তো! এতো পরিশ্রম করে দৌড়ুতে দৌড়ুতে ট্রেন ধরলে
আপনি দেখেছেন!
বাহ,মনেরও তো চোখ রয়েছে না!
খুব সুন্দর কথা বলেন আপনি
এটুকুই যা, না-হলে আপাদমস্তক ভীতু,একজন কাপুরুষ
আচ্ছা বলুন ঝুমুর অস্থির হয়ে উঠল

গাড়ি ফারাক্কা ব্রিজ পের হলো নীচের গঙ্গা নদীকে দেখা যাচ্ছে নিশ্চয় আপার টায়ার থেকে দেখা সম্ভব নয় বউ,আর ছেলেকে ডাকলাম নদী দেখতে তারপর সকলে মিলে গ্যেটের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম সামান্য ফাঁক করে রাখলাম জাহাজের ভোঁ,নদীর জলে হলদে আলোর খেলা ~ জীবন যেন অপার্থিব মানুষেরই গুণে আবার ভেবে দেখলে নিজেদের স্বার্থে আমরা নদীকে বন্দী করেছি এর প্রতিদানও হয়তো একদিন দিতে হতে পারে

ঝুমুর বললো ~ এক রাত আড্ডা দিয়ে কাটালে হয় না! ট্রেনে তো আমার এমনিতে ঘুম হয় না
আমার বউ বললো তুমি তো বাবা মায়ের কাছে যাবে, প্রচুর আড্ডা অনন্ত ঘুম আর আমার যে শ্বশুর বাড়ি
ঝুমুর বললো ~ আমার মাবিছানা থেকে উঠতে পারে না অথচ একদিন নৃত্য শিল্পী ছিল সেই কারণেই আমাকে আসতে হয় এমনিতে আয়া আছে
বাবা কি করেন!
ছোট্ট মুদির দোকান তার উপর খুব সৎ মানুষ
আমার বউ বললো ~ এই কারণে তুমি অন্যায় আর অসত্যের বিরুদ্ধে লড়ছো
আমার স্বামীও ভীষণ সৎ আর ধর্মপ্রাণ
কতো বছর হলো বিয়ে হয়েছে!
তিন বছর
ছেলে মেয়ে হয়নি!
না
কোন একটা অজানা স্টেশনে ট্রেন থেমে গেলো
আমার বউ বললো তিস্তা তোর্সা চলছে বলেই মনে হয় না
ছেলে বললো ~ গোরুর গাড়ি
ঝুমুর বললো ~ আমার খুব তাড়াতাড়ি পৌঁছানো দরকার ছিল
হঠাৎ আমার বউ বললো যে গ্যাং ধরা পড়লো তারা তো প্রায় মাফিয়া
হ্যাঁ হেসে বললো অয়ন্তিকা বা ঝুমুর
তোমাকে অনুসরণ করছে না তো!
করতেই পারে আপনারা কোথায় নামবেন!
ব্যান্ডেল নামলেও হবে, না হলে হাওড়া
অয়ন্তিকা বললো হাওড়া তো যাবে না, এটা তো শেয়ালদা যাবে
আমার বউ বললো ঠিক, ঠিক আমাদের টিকিট কতোদূর কাটা আছে!
শিয়ালদহ অবধি রয়েছে আমি বললাম
আমার বউ বললো শেয়ালদা যদি নামি, তবে আমার বাপের বাড়ি কাছে হবে
কোথায় বউদি আপনার বাপের বাড়ি!
বেহালা
আমি বললাম মা কে বলা আছে তো!
অপেক্ষা করবে ঘরে বাইরে করবে না গেলে
অয়ন্তিকা বা ঝুমুর বললো টস করি বৌদি হেড না টেইল
আমি বললাম – ‘হেড
হারলাম আমি, অগত্যা বেহালা এক রাত থেকেই কোন্নগর যেতে হবে ওদের মদনমোহনতলার বাড়ির ছাদটা আমার খুব প্রিয় কলকাতার উপকণ্ঠে একটা গঞ্জ টলটলে পুকুর আছে বাজারে তাজা সবজি পাওয়া যায় খেয়ে, শুয়ে আরাম হবে কিন্তু বাবা- মায়ের মুখটা খুব মনে পড়বে, আর অপেক্ষা করতে করতে হয়তো কেঁদেই ফেলবে মা অভিমানও হবে খুব
অয়ন্তিকা বললো ~ শেয়ালদা আপনার নামলে আমার সুবিধা হবে
আমার বউ বললো অন্তত কিছুক্ষণ একা থাকতে হবে না
আমি বললাম তথাস্তু তবে একটা গান শোনাতে হবে এখনই
বউ বললো হ্যাঁ, পাগল ভেবে সবাই তাড়া করুক
অয়ন্তিকা বা ঝুমুর বললো বউদি ভোরের অহনা আলোয় গাইবো সকলে কি গাইবেন!
তুমি বলো!
এসো প্রাণভরণ, দৈন্যহরণ হে .......... ~ গাইবেন বউদি
বাহ, খুব সুন্দর গাইবো গীতিকার, সুরকার ~ কে জানো!
না, বউদি দাদার কীর্তিসিনেমায় শুনেছিলাম
আমি বললাম অতুলপ্রসাদ
আমার বউ বললো ডাহা, ফেল
আমার ছেলে বললো রবীন্দ্রনাথ
হলো না
অয়ন্তিকা বললো ~ অতুলপ্রসাদই তো মনে হচ্ছিল
না গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়
সুর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়
অয়ন্তিকা বললো ~ গানটা গাইতে গাইতে আমার খুব কান্না পায়
কেন গো!
আসলে মায়ের কাছে গিয়ে গানটা গাইলে অসাড় হাত দুটোতে সাড়া আসে সামান্য চোখের জল চট করে মুছে নিয়ে অয়ন্তিকা বা ঝুমুর বললো ~ সেই আপনার রিপোর্টার জীবনের অভিজ্ঞতা শোনা হলো না যে!
আমার বউ বললো ~ ধুস্‌ ওর আবার কি অভিজ্ঞতা ~ সব বানিয়ে বানিয়ে বলবে
অয়ন্তিকা বললো ~ আমারটা কিন্তু সব সত্যি খোদা হাফিজ জামিন পেলে আমায় ছাড়বে না

এখন মনে পড়তেই চমকে উঠলাম বেশ কয়েক বছর হয়ে গেছে অয়ন্তিকা তো আমাকে খোদা হাফিজের কথা বলেছিল সে-ই মহাপুরুষ তো এখনও দিব্যি বেঁচে রয়েছে,সাম্রাজ্যও অক্ষত আমি তার ডাকা সভায়ও গেছি

তারপর ঝুমুরকে সংক্ষেপে বলেছিলাম এক ইংরেজ কবি রবার্ট ফাউলেকে কলকাতা শহর ৩ দিন ঘুরিয়ে দেখেছিলাম তার একটা ছবি মানি-ব্যাগে ছিল, দেখালাম
লেখেননি কোথাও!
রিপোর্টিং হয়নি ~ গল্প হয়ে গেলো শেষমেশ
আমাকে নিয়েও তো গল্প হতে পারে ~ তাই না!
আমি বললাম হয়তো তোমার যেদিন আমার চেয়েও শক্তি মান সৃজনশীল মানুষের সঙ্গে দেখা হবে ~ তিনি পারবেন
আমার বউ বাথরুমে চলে গেলে, ঝুমুর বললো ~ লিখবেন কিন্তু আর ছাপা হলে আমায় পাঠাবেন
আমি হেসে বললাম চেষ্টা করবো
বললাম সত্তর দশকে নকশালদের ঠেক ছিল হাড়কাটা গলি অন্য কোন কারণ নয় নোনা ওঠা দেওয়াল, তিতকুটে গন্ধের মধ্যে লুকোনো সহজ ছিল তখন ওসব নেশার দ্রব্য দেখেছি হিন্দু হোস্টেল থেকে ঝিলিক-দা পাইপ গান রাখার জন্য আমায় পাঠাতো আমি তখন বালক রাজনীতির কিছুই বুঝি না
চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান ~ মেয়েবেলায় কতো বলেছি
ঝিলিক-দা বেঁচে আছেন!
না, আত্মহত্যা করেছিল
আমি বললাম তোমার রিপোর্টিং যদি ব্যর্থ হয় ~ কেমন লাগবে তখন!
খারাপ তবে আমি ছাড়বো না আবার লিখবো
কি করবে!
চেষ্টা করবো মিডিয়া তো আমাকে সাপোর্ট করছে
কিছু বললাম না, মনে মনে বললাম জয় হোক অয়ন্তিকার
গাঁজাকে কি বলা হয় ~ জানো!
কি?
উইশডোম অফ স্মোকিং নেশার প্রজ্ঞা
বিপ্লবও তাই আসলে ফাঁপা অয়ন্তিকা বললো
একটা চাদর জড়িয়ে নিলো অয়ন্তিকা
আমি বললাম শীত করছে!
জ্বর হয়েছে সামান্য কপালে হাত দিয়ে জ্বরদেখলো হয়তো মেয়েটা খুব খুশী হতো ফরসা হয়ে আসছে ট্রেন বর্ধমানের কাছাকাছি চলে এসেছে মনে হয় কারণ একটা হল্ট স্টেশন দ্রুত পেরিয়ে গেল, নাম পড়তে পারিনি শরৎকাল আসছে দিনের আলোয় নদীর ধারগুলিতে কাশফুল স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে হাওয়ায় দুলছে
বউ বাথরুম থেকে ফিরে এলে অয়ন্তিকা বললো এবার সবাই মিলে!
কী?
গান
দুষ্টু মেয়ে, ভোলোনি!
আমরা সবাই মিলে গাইতে শুরু করলাম এসো প্রাণভরণ দৈন্যহরণ হে
বিশ্বভূমঃ পরম স্মরণ হে
জ্যোতিপূর্ণ কর হে গগন সুধাগন্ধে ভরো হে পবন
..........................................................
সূর্য উঠেছেন,প্রাণের প্রকাশ পাওয়া গেলো
ট্রেনে অনেকেই উঠে পড়লেন
কেউ কেউ বললেন বাহ,মনটা ভরে গেলো একজন এসে আমাদের বলেও গেলেন খুব সুন্দর গাইছিলেন আপনারা।
ট্রেন আর কোথাও থামলো না বর্ধমানের পর
শিয়ালদহ স্টেশন চলে এলো
ঝুমুর বললো ~ আমায় একটা লাগেজ দিন আমার তো খালি হাত
লাজুক হেসে বললাম, সেটা কি ঠিক হবে!
তুমি কি পারবে!
ঝুমুর বা অয়ন্তিকা বললো ~ আমি ট্রেকিং করি
কেড়েই নিলো সে
বললাম ~ লিখতে যদি পারি,তোমার ঠিকানাটা দিয়েছো তো!
সে বললো ~ ভুলেই গেছিলাম,আমার তো কার্ড রয়েছে
আমি হেসে বললাম ক্রাইম জার্নালিস্ট বলে কথা! তার উপর ন্যারকটিক সাব সেকশন

শিয়ালদহ স্টেশনের ভীড়ে আমার হাতে লাগেজ সমর্পণ করে হারিয়ে গেলো অয়ন্তিকা বা ঝুমুর পরে তার ঠিকানা,ফোন নম্বর খুঁজতে গিয়ে আর পেলাম না হারিয়ে ফেলেছি কোথায়! হয়তো তখনই জনবহুল স্টেশনে আমার অসাবধানতায় পদপিষ্ট হয়েছিল সেই চিরকুট

অনেকদিন পর একটা রোড অ্যাক্সিডেন্টের খবরে অয়ন্তিকার মৃত্যু সংবাদ ছোট্ট করে লেখা খবরের কাগজে দেখলাম অয়ন্তিকা ভট্টাচার্য নামের এক তরুণি সাংবাদিক পথ দুর্ঘটনায় (লরিতে  পিষ্ট হয়ে) মারা গেছে ভোরের অহন আলোয় আজও যেন শুনতে পাই সে-ই গান ~ এসো প্রাণভরণ দৈন্যহরণ হে .................। ওকে নিয়ে গল্পটা লেখা হয় নি আর সে যে রয়ে গেলো সিন্ধুপারে

অভিজিৎ চৌধুরী : কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন