বিবাহবার্ষিকী



গল্প


সুজাত আর নিপার পঁচিশতম বিবাহবার্ষিকী। দিনটাকে স্মরণীয় করে রাখতে মরিয়া চেষ্টা ছিল সুজাতর। সুজাতর আগ্রহ দেখে অনিচ্ছাসত্ত্বেও সায় দিতে বাধ্য হয় নিপা। দৈনন্দিন জীবনের একঘেয়েমিগড্ডলিকা প্রবাহের মত বহমান পঁচিশ বছরের দাম্পত্য জীবনে ভীষণ হাঁপিয়ে উঠেছে সুজাত। একটু স্বাদ বদল করতে ক্ষতি কি? তদুপরি চাকুরী ক্ষেত্রে সে যে কতটা উচ্চ পদে আসীন,তাও কিছুটা বোঝানো যাবে আত্মীয়স্বজনদের। নিপা ইদানীং সব ব্যাপারেই বড়ো নির্লিপ্ত,যদিও একমাত্র ছেলে ও স্বামীকে নিয়ে নির্ঝঞ্ঝাট সংসার নিপার। ছেলে অভীক জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে। চাকরির বড়সড় অফার এসেছে। বন্ধুবান্ধব,আত্মীয়স্বজন অনেকেই আমন্ত্রিত। তবে সবাই প্রায় সুজাতর তরফ থেকে। নিপার বাড়ির না আছে কোন আত্মীয়স্বজননা আছে নিপার কোন বন্ধুবান্ধব। সেটা অবশ্য সুজাতর কল্যাণেই। নিপার বাড়ির আত্মীয়দের খুব অপছন্দ সুজাতর। আর গৃহবধূর বন্ধুবান্ধব থাকা তো মহাপাপ। তার একমাত্র ধ্যানজ্ঞান হওয়া উচিৎ তার স্বামী, সন্তানসংসার আর শ্বশুর বাড়ির আত্মীয়।

উচ্চশিক্ষিতা নিপা অবশ্য সবটাই মানিয়ে নিয়েছে। স্বামীর মনের মত হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে এত বছর ধরে শুধুমাত্র ভালোবাসার তাগিদে। অবশেষে পঁচিশতম বিবাহবার্ষিকী পালন করা ঠিক হয়মহা সমারোহে। ভোরবেলায় দক্ষিণের বারান্দায় রাখা ইজিচেয়ারে বসার অভ্যাস নিপার। সঙ্গে এক কাপ চা। অনুষ্ঠানের দিনও সে এসে বসে ইজিচেয়ারে। তবে হাতে আর চায়ের কাপ নেই। মাথাটা ডানদিকে ঈষৎ হেলানো। চোখদুটি আধবোজাযেন ধ্যানমগ্না। কাজের মাসি বেশ সকাল সকালই চলে আসে। বৌদিমণিকে সে খুব ভালোবাসে তার মিষ্টি শান্ত স্বভাবের জন্য।

"বৌদি,ও বৌদি", বেশ কয়েক বার ডাকলেও সাড়া দেয় না নিপা। সুজাতকে খবর দেয় মাসি। সুজাত নিপার গায়ে ধাক্কা দিয়ে ডাকে,কিন্তু একি? নিপার গা এত ঠান্ডা কেন? ভালো করে ওর দিকে ঝুঁকে দেখে সুজাত। একইরকম ভাবে শুয়ে আছে নিপা। কোন নড়ন চড়ন নেই। বুঝতে অসুবিধা হয় না যেনিপা আর নেই।

বেলা বেশ বেড়ে চলেছে। ডাক্তারবাবু কিছুক্ষণ আগে ডেথ সার্টিফিকেট দিয়ে গেছেন। মৃত্যুর কারণ হার্ট অ্যাটাক। আমন্ত্রিত আত্মীয়স্বজন ইতিমধ্যেই আসতে শুরু করেছেন। কিন্তু আনন্দ করতে এসে যে এমন ঘটনার সম্মুখীন হতে হবে,তা বোধকরি স্বপ্নেও কেউ ভাবেননি। বাড়িতে ভিড় খুব বেড়ে চলেছে। নিপার মৃত্যু সংবাদ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে।  সকলে ছুটে আসছে তাকে শেষবারের মত একবার দেখতে। পাড়াপ্রতিবেশীদের মুখে তো ধন্যিধন্যি পড়ে গেছে,"আহা! কি সতীলক্ষ্মী, মাথায় সিঁদুর নিয়ে চলে গেল। "এয়োরা সবাই সেই সতীলক্ষ্মীর মাথায় সিঁদুর দিয়ে নিজেরা ধন্য হচ্ছেনসেই সিঁদুর পরম ভক্তিভরে নিজেদের সিঁথিতে ছোঁয়াচ্ছেন। বাড়িতে যেন বেশ একটা উৎসব উৎসব মেজাজ। ডাক পড়ে সুজাতর। নিপাকে শেষবারের মতো সিঁদুর পরাতে হবে ওকে। এটাই নাকি নিয়ম। কিছুটা সংকোচে সিঁদুর হাতে নিয়ে সুজাত পরিয়ে দেয় নিপার সিঁথিতে। মনে পড়ে যায় তার প্রথম দিনের সিঁদুর পরানোর স্মৃতি।  উলুধ্বনি,শঙ্খধ্বনিতে মুখরিত হয়েছিল চারিদিক। নিপার লজ্জাবনত লজ্জাবস্ত্রে ঢাকা মুখ দেখে কী ভীষণ ভালো লেগেছিল সুজাতর। এরপর আরো অনেক বার নিপাকে সকলের অলক্ষ্যে সে সিঁদুর পরিয়েছে বিয়ের প্রথম প্রথম,ভালোবেসে। খুশির বন্যায় ভেসে যেত নিপার মুখ। নিপার সেই খুশিতে ঝলমল করে উঠত যেন ওদের গোটা সংসার। আকাশ বাতাসও আনন্দে মুখরিত হয়ে উঠতসাক্ষী হয়ে থাকত ওদের গভীর প্রেমের। কিন্তু আজ সে আনন্দ  আর কোথাও নেই। চারিদিক থেকে উঠে আসছে চাপা ক্রন্দনের প্রতিধ্বনি।

সুজাত আর অভীক ভাবলেশহীনভাবে দাঁড়িয়েএইসব মেয়েলি কান্ডকারখানা দেখছিল। জীবনের পঁচিশতম বিবাহবার্ষিকীতে সুজাত নিপার জন্য একটা বেশ ভালো শাড়ি এনেছিল। পরম যত্নসহকারে আত্মীয়রা নিপাকে সেই শাড়িতে সাজিয়ে দেয়। মাথায় টকটকে লাল সিঁদুরকপালে চন্দনের টিপপা ভর্তি আলতা। রাজরানীর মত স্বামীসন্তানের কাঁধে চেপে শববাহী গাড়ি অবধি পৌঁছে যায় নিপা। ইলেকট্রিক চুল্লীতে নিপার বড়ো ভয়,একথা বার কয়েক বলেছিল নিপা। নিপার সেই  ইচ্ছার সম্মান জানাতে সুজাত কাঠের চুল্লীতেই নিপার দাহের ব্যবস্থা করে।

নিপার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে সুজাত। কতদিন হয়ে গেল ও নিপার সাথে ভালো করে কথা বলেনি,ফিরেও তাকায়নি। কত বদলে গেছে সুজাত! অভীক জন্মানোর পর থেকে নিপা বড়ো বেশী অভীককে নিয়ে ব্যস্ত থাকত। সুজাতর মনে ধারণা হয়,নিপা সুজাতকে অবহেলা করে। নিপার ভালোবাসার কেন্দ্রবিন্দু অভীক। কোথাও বেড়াতে যেতে বললেও নিপা এড়িয়ে যেত,অভীকের পড়াশোনার দোহাই দিত। আসলে অভীককে নিয়ে আর পাঁচটা মায়ের মতোই ইদুঁর দৌড়ে সামিল হয়েছিল সে। সেটাকে ভুল ব্যাখ্যা করেই  সুজাতর মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া  ঘটেছিল নিপার প্রতি। নিপা যেন বড্ড বেশী ঘরোয়া,একঘেয়ে ওর জীবনযাত্রা,যেটা একদমই পছন্দ হতনা সুজাতর।

ভীষণ সুন্দর লাগছিল নিপার নিষ্প্রাণ মুখটা। অবশ্য বরাবরই নিপা বেশ সুন্দরীই ছিল। সেকারণে পাড়ার উঠতি বয়সের ছেলেরা নানাভাবে উত্যক্ত করত ওকে। সুজাত পরবর্তীকালে এসব কথা নিপার কাছ থেকে জানতে পেরেছিল। নিপার বাবা মা ওকে নিয়ে বেশ ভয়ে ভয়েই দিন কাটাতেন। তবে নিপাও কম যেত না। সর্বদা যেন চোখে মুখে কথা বলত। বেশ ছটফটে ছিল ওর প্রকৃতি। পাড়ার কোনো একটি ছেলে ওকে প্রতিনিয়ত প্রেমের প্রস্তাব দিত। নিপার একেবারেই পছন্দ ছিল না তাকে। কলেজে একই বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করার সুবাদে পরিচয় ঘটে সুজাত- নিপার। একদিন সেই পাড়ার ছেলেটি কলেজ অবধি পৌঁছে যায় নিপাকে অনুসরণ করে। খোঁজখবর করে ডিপার্টমেন্ট অবধি চলে আসে। নিপা তাকে দেখে বেশ ভয় পেয়ে গেলেওতা প্রকাশ করেনি। উল্টে,মুখে একরাশ বিরক্তিভাব ফুটিয়ে তোলে। যদিও সুজাত তখন শুধুমাত্র নিপার বন্ধু ছিল,তবুও সুজাতকে দেখিয়ে নিপা ছেলেটিকে বলে বসে যেসে সুজাতর বাগদত্তা। সুজাত ছিল বেশ সুঠাম চেহারার অধিকারী। বোধকরি ওকে দেখে ভয়েই ছেলেটি কলেজ থেকে বিদায় নেয় এবং পরিশেষে নিপাকে মুক্তি দেয়। সুজাত অবশ্য এব্যাপারে কোন কৌতূহলই দেখায়নি। জিজ্ঞাসাও করেনি সে নিপাকে,তার এমন মিথ্যা আচরণের কারণ কি? নিপাও কোনরকম কৈফিয়ত দেওয়ার তাগিদ অনুভব করেনি। এভাবেই কেটে গেছে বেশ কিছুদিন। যে যার পড়াশোনার জগৎ নিয়ে ব্যস্ত। ইতিমধ্যে কলেজে নবীনবরণ অনুষ্ঠান পালিত হয়। তাতে নিপা মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করে। অপূর্ব অভিনয় দক্ষতায় সকলের মন জয় করে নেয়। স্বভাবতই দৃষ্টি আকর্ষণ করে কলেজের ছাত্রকূলের। ওর একটু হাসি বা ওর সাথে একটু কথা বলতে পারলেযেন নিজেদের ধন্য মনে করত তারা। কিন্তু নিপার দৃষ্টিভঙ্গী ছিল কিছুটা স্বতন্ত্র। তাই ওর চোখ বোধহয় এমন কাউকে খুঁজে বেড়াতো,যে ওর প্রতি আদৌ কোন আকর্ষণ অনুভব করেনা। শেষপর্যন্ত জীবনের অনেক হিসাব কষেইও সুজাতকে প্রেমের প্রস্তাব দেয়। প্রথম প্রথম ওকে একেবারেই পছন্দ ছিল না সুজাতর। বন্ধু মারফৎ সেকথা জানিয়েছিল নিপাকে। কিন্তু নিপা ছিল বেশ জেদী। ওর মধ্যে সুজাতকে পাওয়ার জেদ চেপে যায়। ও ছলেবলে কৌশলে সুজাতর কাছাকাছি আসার চেষ্টা করত,সুজাত সযত্নে তা এড়িয়ে যেত। অবশেষে একদিন  এক বন্ধুর মাধ্যমে সুজাতর কাছে পৌঁছায় নিপার প্রথম প্রেমপত্র। অনেক গড়িমসি করার পর সুজাত শেষপর্যন্ত নিপার প্রস্তাবে সায় দেয়। বেশ কিছুটা সময় লেগেছিল ওদের সম্পর্কটা ঠিকঠাক ভাবে গড়ে উঠতে। তারপর অবশ্য এই সম্পর্কটা এতটাই মজবুত হয়ে গড়ে উঠেছিল,যে একে অপরকে না দেখে একদিনও থাকতে পারতনা।  দুজনের প্রেম পর্ব চলেছিল টানা আট বছর।

ভালোবেসে বিয়ে করেছিল ওরা। তাতে নিপার বাড়িতে ঘোরতর আপত্তি ছিল। মন থেকে সেভাবে মেনে নিতে পারেননি নিপার বাবা মা। আর সেখান থেকেই সংঘাতের সূত্রপাত সুজাত ও নিপার বাড়ির লোকজনের। নিপা ছিল ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে। কিন্তু সুজাত অব্রাহ্মণ। গোড়া রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ পরিবারের মানুষেরা কোনভাবেই মেনে নিতে পারেননি বৈষম্যযুক্ত বিবাহের প্রস্তাব। নিপার বাবা মা নানারকম ভাবে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেন। পরিশেষে হতাশ হয়ে নিপার সাথে বাক্যালাপও বন্ধ করেন বাবা মা। কী দুর্বিষহ যন্ত্রণায় কেটেছিল ওর সেসব দিনগুলো! তবুও নিজের লক্ষ্যে সে ছিল অবিচলএতটাই গভীর ছিল ওদের ভালোবাসা। সুজাতর প্রতিষ্ঠিত হওয়া অবধি সে ধৈর্য্য সহকারে অপেক্ষা করে গেছে। সুজাত সেসময় নিপাকে মানসিকভাবে শক্তি যোগানোর অনেক চেষ্টা করেছে। অবশেষে উচ্চপদস্থ চাকুরী পেয়ে প্রথম আনন্দ সংবাদটা সে নিপাকেই দেয়। দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হয় নিপার। চাকুরী পাওয়ার পর সরাসরি নিপার বাবামায়ের সম্মুখীন হয়েছিলেন সুজাতর বাবা। বাধ্য হয়েই অবশেষে বিবাহে সম্মতি দেন নিপার বাবা। বেশ ধুমধাম করেই ওদের বিবাহকার্য অনুষ্ঠিত হয়। সে বিষয়ে কোনরকম কার্পণ্য করেননি নিপার বাবা। কিন্তু ভাঙা কাঁচ জোড়া দিলেও তার দাগ যেমন থেকে যায়,তেমনই একটা সূক্ষ্ম দাগ থেকে গিয়েছিল নিপার পিতৃকূল আর শ্বশুরকূলের মধ্যে।

বদলির চাকুরীর কারণে সুজাত নিপাকে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যায়। তাই স্থায়ীভাবে কোথাও চাকুরী করার স্বপ্ন ত্যাগ করে নিপা। এরপর আসে অভীক। তাকে পেয়ে আঁকড়ে ধরে নিপা। সন্তান মানুষ করতে হবে ভালো করেমেয়েরা চাকুরী করলে সংসার অবহেলিত হয়,এই বদ্ধমূল ধারণা ছিল নিপার মায়ের মধ্যে। তিনি ক্রমাগত বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে মেয়েকে বোঝান সেকথা। চাকুরী করার কারণে বেশ কিছু সংসার ভেঙে যেতেও দেখেছে নিপা। বিশেষ করে সুজাতর সন্দেহবাতিক মনের কিছুটা পরিচয়ও পেয়েছিল নিপা বিয়ের পরেতাই মেনে নেয় মায়ের যুক্তি। সচ্ছ্বল সংসারে সত্যিই তো দুজনের চাকুরী করার কোন মানে হয়না। বরং মাতৃস্নেহ থেকে যেন অভীক কোনভাবেই বঞ্চিত না হয়,আর সংসারে যাতে শান্তি বজায় থাকে,সেই দিকেই সদাসতর্ক দৃষ্টি থাকত নিপার।

দিব্যি বেড়ে ওঠে অভীক। জীবনের সমস্ত রকম মূল্যবোধ ভালোভাবেই তাকে শিক্ষা দিতে চেষ্টা করেছে নিপা। চুরি করতে নেই,কখনো কারো কাছে কিছু চাইতে নেইগুরুজনেদের সম্মান করাকারো মনে দুঃখ না দেওয়াগরীব মানুষকে নিজের সামর্থ্য মত সাহায্য করা,উচ্চ নীচ প্রভেদ না করাআরো কত কী। কিন্তু অভীক বয়স বাড়ার সাথে সাথে বড্ড যেন অন্যরকম হয়ে যায়। ঠিক নিপার মনের মতন নয়। সর্বক্ষণ ফোন নিয়ে নাড়াচাড়া।  নিপার বারণ সত্ত্বেও সুজাত অভীকের হাতে তুলে দিয়েছে দামী স্মার্টফোন। অভীক আর সেভাবে পড়াশোনায় মনযোগ দেয় না। দেখতে দেখতে বিরক্ত নিপা অভীকের ফোনটা একদিন ছুঁড়ে ভেঙে দিতে যায়অভীক তখন তার মায়ের হাত এমন ভাবে মুচড়ে দেয়যেনিপার ডান হাতের একটা আঙুল ভেঙে যায়।

ভীষণ রাগ অভীকের। প্রথম যেদিন নিপাকে "পরজীবী" সম্বোধন করে অভীক,সেদিন আর চোখের জল বাধা  মানে নি নিপার। সুজাতকে  জানিয়েছে নিপাছেলের সকল দুর্ব্যবহারের কথাকিন্তু এ ব্যাপারে সুজাত কখনো শাসন করেনি অভীককে। বরং একাধিকবার বিভিন্ন কারণে ছেলের সামনেই তিরস্কার করেছে নিপাকে। তাই অভীক আজ বোঝে ওর মায়ের স্থানটা সংসারে ঠিক কোথায়। বাবা যেখানে মাকে সম্মান করেনাসেখানে তারও তো দায় নেই মাকে সম্মান দেখানোর। "বাবা" বা "মা" ডাকটা যে কবার মুখে উচ্চারণ করেছে অভীক তার জীবনেতাও ঠিক মত মনে পড়েনা সুজাতর। সন্তান মানুষ করতে নিপা একদম গোহারান হেরে গেছে।

সুজাতর আত্মগ্লানি হয়। ও নিজেও তো কতসময়ে নিপার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে। অফিসের বন্ধুবান্ধবরা এলে,নিপাকে তাদের সাথে আলাপ করানো তো দূর অস্ত,কাজের লোকের মত ব্যবহার করেছে। শুধু চা জলখাবার দেওয়ার ফরমাশ করেছে। নিপাও অবলীলায় সেসব ফরমাশ পালন করে গেছে। সুজাতর আবার বন্ধুর থেকে বান্ধবীর সংখ্যা একটু বেশী। নিপাকে এক সাধারণ গৃহবধূ ছাড়া আর কিছু মনে হয়না সুজাতর। অফিসের স্মার্ট  মেয়ে কলিগদের সাথে বেশ হেসে হেসে কথা বলা ওর স্বভাব। কারণ কোনভাবে ও মেয়েদের অপমান করতে চায়না,তারা কষ্ট পাক সেটা ও একদম চায়না। এহেন অফিসের মেয়েরা,তাদের স্যারের যখন ইনিয়ে বিনিয়ে নানারকম ভাবে তারিফ করে,তা বেশ তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করে সুজাত। মধ্যবয়সে বা যৌবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা একজন পুরুষ এর চেয়ে বেশী আর কি চায়? ফোনে নিয়মিত চ্যাটও  চলে বিভিন্ন বান্ধবীদের সাথে।   নিপা আগে আগে তীব্র প্রতিবাদ করেছে কিন্তু কোন ফল পায়নি। একদিন তো সুজাতর এক বন্ধুর স্ত্রী,নিপার সামনেই সুজাতর হাত ধরে টানতে টানতে তাদের বাড়ি নিয়ে যায়। নিপা সেটা সহ্য করতে পারেনি। সুজাতকে ওর বিরক্তির কথা প্রকাশও করে। উত্তরে সুজাত বলেনিপা সংকীর্ণমনাতাই সে এমন  ভাবে। আসলে ভদ্রমহিলা নাকি সুজাতর বোনের মত। কিন্তু এই বোনের মত  ভদ্রমহিলা কেন যে নিপার সাথে কথা বলার সৌজন্যতাটুকু পর্যন্ত দেখান নাতা নিপার বুঝতে অসুবিধা হয়না। তবে নিপা যদি কোন পরপুরুষের সাথে কখনো কথা বলে,তখন তাকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করতে সুজাতর কিন্তু কোনদিন ভুল হয়নি।

প্রতিসপ্তাহেই প্রায় সুজাত যায় তার নিজের বাড়িতে। ছেলের পড়াশোনার কারণে সবসময় বাড়িতে বন্দী থাকত নিপা। নিজের বৃদ্ধ বাবা মাকে ছয়মাসে একবার একদিনের জন্যও দেখতে যেতে পারত না নিপা,যদি সুজাত বা অভীকের কোন অসুবিধা হয়,সেই চিন্তায়। ফেসবুকের দৌলতে এখন আবার স্কুল,কলেজ, ইউনিভার্সিটির বন্ধুবান্ধবীদের সাথে যোগাযোগ খুব বেড়ে চলেছে। গেট টুগেদারের হিড়িকটাও বড্ড বেশী দেখা যাচ্ছে সুজাতর মধ্যে। সেখানে অবশ্য নিপা ব্রাত্য। ওকে  কোথাও নিয়ে যাওয়া যায় না। অফিসের পার্টিপিকনিককোথাও কখনও নিপাকে নিয়ে যায়নি সুজাত। কারণ কি পরিচয় দেবে সেখানে ও নিপার? একজন গৃহবধূ যে কিছুই করেনাতাহলে কোন সম্মান থাকবে ওর,সোসাইটিতে? তবে অবশ্য ঘটা করে ভিডিও করে এনে দেখাত নিপাকে। বন্ধুর বৌদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতে করতে ওর মুখ  উদ্ভাসিত হয়ে উঠত। কোন কিছুই চোখ এড়ায় না নিপার। কোন বন্ধুর বৌ ভালো গান গায়,কোন বান্ধবী দূর্দান্ত আবৃত্তি করে তা বাড়িতে এসে ছবির মতো বর্ণনা করে যেত সুজাত। নিপা একদিন শুনতে শুনতে বলে বসে যে,সেও তো ভালো গান গাইতকিন্তু তাকে তো সুজাত গান গাইতে উৎসাহ দেয়নি কখনও। শুনে সুজাত ও অভীকের মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি দেখে নিপার মাথা নত হয়ে যায়।

নিপার চাহিদা ছিল খুব কম। গয়নাগাটিভালো কাপড়চোপড়কোন কিছুতেই ওর কোন আকর্ষণ ছিল না। তাই সুজাত সামান্য যা কিছু ওকে এনে দিততাতেই ও খুশি থাকত। সুজাতর পছন্দই ছিল নিপার পছন্দ। নিপার চরিত্রের এই দিকটা অবশ্য বেশ উপভোগ করত সুজাত। অভীক বড়ো হয়ে যাওয়ার পরেও,স্ত্রীকে নিয়ে পঁচিশ বছরের বিবাহিত জীবনে ঠিক কটা সিনেমা দেখেছে বা বেড়াতে গেছে,তা হাতে গুণে বলে দিতে পারে সুজাত। সব সময় কাজের অছিলায় এড়িয়ে গেছে নিপাকে। নিপার সেসব নিয়েও কোন অভিযোগ ছিলনা। তবে বন্ধুবান্ধবের ডাকে,হাজার কাজের চাপেও ছুটে যেতে ভুল করেনি সুজাত।

একবার সুজাতর বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু বন্ধু বান্ধবীকে বাড়িতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল নিপা। ওদের কিভাবে আপ্যায়ন করবেকি কি খাওয়াবেঘরদোর কিভাবে সাজাবেতা নিয়ে উন্মাদনার শেষ ছিল না ওর। যদিওএকই কলেজে পড়লেওপরবর্তীকালে তাদের বিশ্ববিদ্যালয় ছিল আলাদা। তাই নিপার সাথে তাদের পরিচয় ছিলনা। নিপা নিজে ফোনে ওদের প্রত্যেককে আসার  অনুরোধ জানায়। তারাও প্রথমে ওদের বাড়িতে আসতে সম্মত হয়। কিন্তু নিমন্ত্রণের ঠিক আগের দিন বিশেষ কিছু কারণ দেখিয়ে,সুজাতর বাড়িতে আসা নাকচ করে ওরা। সুজাতকে বাইরে অন্য জায়গায় ডেকে নেয়। নিপাকে সেকথা জানানোর প্রয়োজনটুকুও বোধ করেনি কেউ। সুজাত সেদিন নিপাকে সম্পূর্ণ অবহেলা করেই বেরিয়ে যায়। স্ত্রীর অপমানের তুলনায় বান্ধবীদের ডাকই ওর কাছে বড় হয়ে উঠেছিল। সেই শেষবারের মতো গর্জে উঠেছিল নিপা। কিন্তু সম্পূর্ণ নীরবে। অপমানেঅভিমানে সেদিন সারাদিন জলস্পর্শ করেনি ও। পরে একদিন কথায় কথায় সে কথা জানতে পেরেছিল সুজাতঅভীকের কাছ থেকে। অভীক মাকে খাওয়ার জন্য বিন্দুমাত্র অনুরোধও করেনি,যদিও সবটাই তার দৃষ্টিগোচর হয়েছিল। এরপর নিপা প্রেসারকোলেস্টেরল সব ওষুধই বন্ধ করে দেয়। নিয়মিত ওষুধ আসত বটেকিন্তু সেগুলোর যে স্থান হত ডাস্টবিনে,তা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি সুজাতনিপার এত কাছে থেকেও। প্রতিবাদের যে এমন ভাষা হতে পারে,তা ভাবতেও পারেনি ও স্বামী হিসাবে। নিপার মৃত শরীরটা জড়িয়ে ধরে কাজের মাসি কাঁদতে কাঁদতে বলে,নিপার নিজের ওষুধপাতি ফেলে দেওয়ার কথা। সুজাত বুঝতে পারেনিপা তাহলে একপ্রকার আত্মহত্যার পথই বেছে নিয়েছে।

সবার মধ্যে থেকেওকিভাবে একা থাকতে হয়তা শিখে গিয়েছিল নিপা। চরম উদাসীন হয়ে যায় সে। সবকিছুতেই  একটা নির্লিপ্ততা। কোনকিছুই আর সেভাবে নাড়া দিতনা ওকে। নিজের মনের কথা আর কারো সাথে ভাগ করতনা। অবশ্য ভাগ করবেই বা কার সাথে!! ওর কথা শোনার  আগ্রহ কার আছে? কিন্তু কোন কাজে কখনও এতটুকু ফাঁকি দেয়নি নিপা। ফুলশয্যার পরদিন থেকে যেমন সংসারের সব কাজ মুখ বুজে করত,তেমন জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তার ব্যতীক্রম হয়নি। "সংসারকে কখনো অবহেলা করবেনা",এটা যে নিপার বাবা মায়ের শিক্ষা।

চিতার ওপর কাঠ সাজানো হয়। মায়ের মুখাগ্নি করতে এগিয়ে যায় অভীক। সুজাতর চোখের কোণাতে বারেবারে জল জমতে থাকে। নিজের বহুদিনের ছায়াসঙ্গীর বিদায়লগ্নে সুজাতর মনে পরে পুরানো দিনের কলেজ জীবন ও সংসার জীবনের হারিয়ে যাওয়া সেইসব মধুরস্মৃতির দিনগুলি। সে স্মৃতিতে ভেসে ওঠে শুধুই সুজাতর প্রতি নিপার আনুগত্য ও ভালোবাসা,সংসার ও আত্মীয়স্বজনদের প্রতি নিপার গভীর কর্তব্যবোধ,সন্তানের প্রতি সব রকম দায়িত্বপালন। নিপার ওপর সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব ভার চাপিয়ে কত নিশ্চিন্তে সুজাত ওর দিনগুলো কাটিয়ে দিত। চাকুরী করা ছাড়া সংসারের কোন দিকেই দৃকপাত করতে হত না ওকে। নিপার চিতার আগুন ক্রমশঃ নিভে আসে। নিপা যতদিন পাশে ছিল,ততদিন সুজাত অনুভব করে নি ওর উপস্থিতি। নিপা যেন ছিল ওর সম্পত্তিগত অধিকার,তাই তার ইচ্ছা অনিচ্ছার কোন মূল্যই ছিলনা সুজাতর কাছে, যদিও ভালোবেসে ও বিয়ে করেছিল নিপাকে। কিন্তু আজ নিপার অনুপস্থিতি ওকে বুঝিয়ে দিতে থাকে যে,সত্যিই আজ আর নিপা কোথাও নেই ওর পাশে,ওর জীবনে। ও আজ একা। সংসার,অভীক এমনকি নিজের দায়িত্ব,সব কিছু এখন একা হাতে সামাল দিতে হবে ওকেই। ওর বন্ধু নিপা বিলীন  হয়ে গেল পঞ্চভূতে,যেখান থেকে হাজার ডাকলেও নিপা আর কোনদিন ফিরে আসবে না। অনুতাপ হয় সুজাতর,একটু যদি ভালো ব্যবহার পেত নিপা ওদের থেকে,তাহলে নিশ্চয়ই এত তাড়াতাড়ি এভাবে  ওদের ছেড়ে চলে যেতনা। সুজাত নিজের মনেই বলে ওঠে, "যাও নিপাএবার তুমি বিশ্রাম নাও। আজ থেকে তুমি মুক্ত। এতদিন তুমি বেঁচে মরেছিলে,আজ তুমি সত্যি বাঁচলে।"
 
মালবিকা মল্লিক:কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন