একটা অন্যরকম ভালোবাসার গল্প



গল্প


"কাকু, ও কাকু এবার ওঠো তো, কিছু খাবে চলো, সেই কখন থেকে ছবিখানা বুকে জড়িয়ে বসে আছো! খেতে হবে না বুঝি?"
"হুউউ....আরে দেখনা, ছবিটায় কত ধুলো পরে আছে, ভাল করে পরিষ্কার হয়নি কতদিন। এরকম দেখলে তোর মা আমায় আস্ত রাখবে ভেবেছিস!"
"মা চলে গেছে কাকু, আর আসবে না মা, সত্যিকরে চলে গেছে আমাদের ছেড়ে।"
"ধুর বোকা, কিযে বলিস, ওই পাগলীতো শুধু লুকিয়ে থেকে দেখছে আমরা কে কতটা ভালোবাসি ওকে। আসলে আমিও যে লুকিয়ে ছিলাম অনেকদিন, লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতাম কি করে ও, আমায় ছাড়া কতটা ছটফট করে! খুব ভাল লাগত বুঝলি, মনে হত আমি পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি যাকে কেউ এতটা ভালোবাসে। তবে তোর মায়ের খুব অপছন্দ ছিল ব্যাপারটা। খালি অভিযোগ করত'মেসেজ পড়ছ না তো, ফোনও তুলছ না, কেন এমন করছ, ফেসবুকেও দেখছি না, কোথায় তুমি, এমনভাবে থাকলে কি করে পাবো তোমার খোঁজ, এতদিন পরে খুঁজে পেলাম তো তোমায়, আবার কোথায় হারিয়ে গেলে বলো তো!'তাও আমি চুপ করে থাকতাম জানিস, কখোন আবার এসএমএস করত চুপ করে লুকিয়ে থেকে পার পাবে ভেবেছ, মরে গিয়ে পেত্নী হয়ে তোমার বাড়ির সামনের গাছটায় বাসা বানাবো, রাতদিন তোমায় জ্বালাব, সবার সামনে তোমার গালে চকাস করে একটা চুমু খেয়ে নেব, তুমি হাত পা ছুঁড়বে, লজ্জায় লাল হবে, আমি মহাশান্তিতে বসে পা দোলাব।'ভাব একবার কান্ডখানা!"

"হুম, মা তোমাকে খুব ভালবাসতো, খুব মিস করতো তোমায়, তুমি ফোনকরা বন্ধ করে দিলে আমায় জ্বালিয়ে মারত, 'দেখনা তোর কাকুর কি খবর, ফোন করছে না তো!'আচ্ছা তোমরা এত ফিল করতে কি করে দুজনে দুজনকে! জানো কাকু, আমি না বুঝতে পারি না তোমাদের ভালবাসাটা ঠিক কিরকম, কে কাকে কতটা ভালবাসতে, তবে আমার দেখা এটা সবথেকে অন্যই একটা ভালবাসা যেখানে এত পিওরিটি আছে এত বিশ্বাস আছে এত ভরসা আছে তবুও কেন এত কষ্ট!"

"কষ্ট তো হবেই, এ যে অনেক জন্মের লড়াই, তোর বাবাটা খুব হিংসুটে তো, শোধ নিয়েই ছাড়ল, নিয়ে নিলো আমার ভালো থাকাটা, একা করে দিলো আমায়আবার এখন দ্যাখ, কিছুতেই সহ্য করতে পারে না তো যে তোর মা আমায় কতটা ভালোবাসে, তাই তাকে নিয়ে সেই যে কোথায় পালালো, কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছি না।"

"আচ্ছা বুঝলাম, কিন্তু এই যে তুমি না খেয়ে এতক্ষণ বসে আছো, এটা কি মায়ের ভালো লাগছে বলো? মা যে লুকিয়ে থেকে সবটা দেখছে তা জানো!"
"হ্যাঁ, তাইতো, এটা তুই একদম ঠিক বলেছিস, আচ্ছা চল বাবা, পাকা বুড়ি একটা, একেবারে মায়ের জুরিদার হয়েছে, তোরা দুজনে মিলে দেখছি কোন কাজই করতে দিবি না আমায়, কত কাজ বাকি আছে, তোর মা ফিরে আসার আগে সব ফেলে রাখা কাজ সেরে ফেলতে হবে, উনি আবার বায়না করেছেন জানিস -'ধুর! এভাবে তো কথাই হয়না, কত কথা বলার আছে, জানার আছে তোমার কথা, এরকম ভাবে হবে না বুঝলে, আমায় শুধু দুটো দিন দিও কেমন, তোমার সাথে নিয়ে যেও একটা পাহাড়ে বা জঙ্গলে, যেখানে কোন ডিসটার্ব হবে না, বারবার তোমায় ফোন আসার জন্য আমার ফোন কাটতে হবে না, আমাকেও ছুটতে হবে না গল্প ছেড়ে রান্নাঘরে।'

চোখের জলটা কোনমতে আটকে নিয়ে মিমি ওর কাকুর হাতটা ধরে নিয়ে এলো খাবার খাওয়াতে। ইশ কি অবস্থা হয়েছে মানুষটার, একটা ফটো দেখে ও মাকে বলেছিল, 'মা যাই বলো হি ইজ টু হ্যান্ডসাম!'আর আজ সেই লোকটার এ কি চেহারা! মুখে ভর্তি দাড়ি, দু চোখে অসহায়তার আকুতি, চোখের জল শুকিয়ে একগাদা পিচুটি, কি সুন্দর হাসত কাকু, প্রাণখোলা হাসি, সে তো কবে কোথায় মিলিয়ে গেছে, চুলগুলো উসকো খুসকো, ব্যায়াম করা সুঠাম শরীরটা কেমন যেন অপরাধবোধে ঝুঁকে পড়েছে, দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে কত বড় ঝড় বয়ে গেছে ওর ওপর দিয়ে। না সান্তনার কোন ভাষা নেই মিমির কাছে। এই অনুভূতির সঠিক কি ব্যাখ্যা হবে ওর সত্যি জানা নেই, কয়েক মাসের মধ্যে একটা মানুষের এত পরিবর্তন হয় না দেখলে বিশ্বাসও করা যা না। যে মানুষটা কখোন নিজের অনুভূতি কে প্রকাশ্যে আনে নি পাছে একটা সংসার বিপর্যস্ত হয়, সে এই কদিনে কি অসহায় ভাবে বার বার প্রকাশ করেছে মাকে ছাড়া ও কতটা একা। অথচ মায়ের উপস্থিতিতে দুস্টুমির আড়ালে কিভাবে লুকিয়ে রেখেছিল এত প্রেম। এরকম ও হয়!

মায়ের মুখেই গল্প শোনা কাকুর, "আকাশ আমাকে দারুন বুঝতে পারতো জানিস, আমার ছোট ছোট জিনিসের খেয়াল থাকতো ওর, আমরা খুব ভাল বন্ধু ছিলাম , যতটা সময় আমরা কাটাতাম, এত ঝগড়া হতো আমাদের , সব ওর জন্য, পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করবে শুধু শুধু, অবশ্য ভাবটাও ওই করত, তার আবার কত কায়দা। বুঝতাম নির্ভেজাল ফ্লার্ট, তবুও খুব খারাপ লাগত না, কেমন একটা নায়িকা নায়িকা মনে হত নিজেকে। আসলে আমরা দুজন একে অপরের  অভ্যাস হয়ে গেছিলাম কখন বুঝতেই পারি নি কেউই। যখন বুঝলাম বড্ড দেরি হয়ে গেছে।"

তারপর আর কি, বাস্তবের ভিড়ভাট্টায় কখন হারিয়ে গেল কল্পনার ডানায় ওড়া একটা একরত্তি স্বপ্ন, আমার বিয়ের পর কোথায় যে গা ঢাকা দিল ব্যাটা, খুঁজেই পেলাম না আর। আর তখন তো মোবাইল ছিল না, ভরসা ল্যান্ডফোন। তাই বিশেষ সুবিধে হলোনা, আমার হ্যাংলামি করে খোঁজ খবর নেওয়াটা বিশেষ সুবিধের চোখে দেখল না ওর বাড়ির লোক। আমিও নতুন জগতে নিজেকে মানিয়ে নেবার চেষ্টায় আর অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে একটু একটু করে হারিয়ে গেলাম এক বুক অন্ধকারের রাজ্যে, হারিয়ে গেল তোর কাকু, মিলিয়ে গেল রাতের স্বপ্নর মতো।

তবে যোগাযোগ বন্ধ হলেও একটা ক্ষীণ আশার অবশিষ্ট ছিটেফোঁটা তবুও বেঁচে ছিল, তাই অনেক খুঁজলাম নির্লজ্জের মত, বন্ধুদের কাছে, পরিচিত মহলে, পুরোন অফিসে, সব সম্ভাব্য জায়গায়...... হারিয়ে যাওয়া প্রিয় জিনিস খুঁজে পাবার জন্য যেমন প্রানপন চেষ্টা করা যায় করলামও কিন্তু কিছুতেই কোন হদিশ পেলাম না,  আমাকে ভাল রাখার প্রতিজ্ঞায় তিনি তখন কে জানে কোন অজ্ঞাতবাসে। হয়ত দেখেছে কোনসময় আমাকে দূর থেকে, তবুও সামনে আসে নি কখনো। কার কাছে যে করেছিল আমার সামনে না আসার ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা, সেই রক্ষা করতে কাটিয়ে দিল পুরো দুটো যুগ। আর তারপরের কথা তো তুই জানিস, হঠাৎ করেই সোশ্যাল মিডিয়ায় খুঁজে পেলাম তোর কাকুকে, নম্বর খুঁজে ফোন করলাম, আর হারানো প্রাপ্তির বিজ্ঞাপনের মতোই একটা স্ট্যাটাসও দিলাম কপাল ঠুকে, আসলে আমার এই সব পাগলামিগুলোর ভয়ঙ্কর সাপোর্টার ছিল তো একসময়, তাই একটু বাজিয়ে দেখা আর কি, পছন্দ টা এত দিনে পাল্টে গেছে কিনা দেখার জন্য।

কিন্তু কথায় আছে না খ্যাপা খুঁজে ফেরে পরশ পাথর, খ্যাপা তো ছিলই ও একটু আধটু, আর এত বছরের পাথরচাপা দিয়ে রাখা জমাট বরফ-অভিমান ওর অনুভূতিগুলোকে চোখ রাঙিয়ে আটকে রেখেছিল, যেন ভাঙবে তবু মচকাবে না, বুঝতে পারছি আমাকে জ্বালানোর পুরোনো অভ্যাসটা ভোলে নি ব্যাটা, কিন্তু আমি রেগে যাওয়ার পর মানানোর উপায়টা তো আজ হাতছাড়া, তাই ছটফটিয়ে মরে, রোজ জব্দ করার নতুন নতুন ফন্দি আঁটে মাথায়, আমিও সব বুঝেই প্রশ্রয় দিতে থাকি, এইভেবে কি, এইটুকু নাটক তো করতেই পারে মানুষটা, যার গোটা জীবনটাই জেনে বুঝে একটা নাটকের মত হয়ে থাকল, হক বানতা হ্যায় ভাই।

এই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় আমি প্রায়শই কিছুক্ষণের মধ্যেই আত্মসমর্পণ করার চক্করে থাকতাম, আসলে মনের মধ্যে গলা অবধি প্রেম, সে না বেরিয়ে যায় কোথায়। কিন্তু প্রতিপক্ষের চাই একটা সত্যি করের যুদ্ধ,  তাই আমার তড়িঘড়ি রণে ভঙ্গ দেওয়ার নীতিটা মোটেই পছন্দ ছিল না তার, কৌশল করে তখন সে ঝুটমুটের নিরুদ্দেশে পারি জমাতো বেশ কয়েক দিনের জন্য, যখন দেখত শত্রু কেঁদেকেটে একেবারে ল্যাজে গোবরে অবস্থায়, তখন তিনি হালকা একটা সন্ধি প্রস্তাব দিতেন, কখোন বা কয়েকটা মেসেজ চুপচাপ পড়ে হজম করে নিচ্ছেন নিঃশব্দে তো কখোন অতি কষ্টে দশ পনের মেসেজ পড়ে একটি তিন চার শব্দের হেঁয়ালি পূর্ণ বাক্য বলেই আবার লম্বা সময় জুড়ে আত্মগোপনের খেলা।

তাও সেটাই বা কম কি বল, কমসে কম ওর উপস্থিতিটা তো ছড়িয়ে রয়েছে চারপাশে। আমি তো বরাবরের হেঙলু একটা, তার ওপর নেহাতই প্যাচ পয়যার বিহীন একটি আদ্যন্ত ছাপোষা নিরীহ জীবনে ওই টুকুই তো ভালো থাকার একটা চাবিকাঠি। তাই খুব যত্নেই রেখেছি সেটা মনের সিন্দুকে, মাঝে মাঝে বের করে দেখি আবার যত্ন করে রেখে দি জায়গা মত, বেশি দেখতেও ভয় লাগে, কে জানে যদি নিজের নজরই লেগে যায় ভুল করে অসাবধানে।

"এই রান্নাগুলো তুই করেছিস! তোর মা বলেছে বুঝি আমি কি কি ভাল খাই, সব দিকে খেয়াল ওর জানিস, শুধু নিজের দিকেই কোন খেয়াল নেই, দুপুরে খেতে হবে সেটাও ওনার যদি মনে থাকে, সব মনে রাখার দাসখত তো আমার নেওয়া না। ওনার আর কি!"

প্রসঙ্গ টা আবার মাকে ঘিরেই পরিবর্তিত হতে যাচ্ছে দেখে মিমি একটু ব্যর্থ চেষ্টাই করে-
"কাকু একটু তবলা শোনাবে, অনেকদিন বাজাও নি তো!"

"নারে! আজ ভাল লাগছে না মনটা, সত্যি করেই পাগলিটা এবার খুব প্যাচে ফেলেছে, কিছুতেই স্বীকার না করিয়ে ছাড়বে না যে ওকে ছাড়া আমার জীবনটা থমকে যাওয়া একটা গুমোটভাব, বড্ড ম্যাড়মেড়ে, একঘেয়েমিতে ভরা, তোকেই বলছি লুকিয়ে লুকিয়ে, তোর মাকে জব্দ করতে যত বার লুকিয়ে থাকতাম ততবারই ভেঙেচুরে একাকার হয়ে যেত মনটা, তবুও হার মেনে নিলে ওর ওই ঠোঁটের কোনের মুচকি হাসিটা কেমন যেন হেঁয়ালি করে বলত 'পেটে খিদে আর মুখে লাজ! 'তাই শেষ শক্তি দিয়েও খেলতাম, আর মনে মনে চাইতাম, ঢের হয়েছে এবার হার মেনে নাও।"

"কাকু একটা গল্প বলো, তোমার তো কত গল্প, কত জায়গা ঘুরেছ, তাই বলো।"
"হ্যাঁ রে মা বলছি গল্প, চল ওই বাগানে গিয়ে বসি দুজনে, কেমন চমৎকার ফুল ফুটেছে দেখেছিস, কত যত্ন করে বানিয়েছে তোর মা, কত খেয়াল... একদিন কোথাও যেতে হলে বলত ‘আকাশ আমার বাগানটার যে কি হবে, কি করে ছেড়ে যাই বলো তো!'বড্ড মায়া ছিল ওর সবেতেই, আর এখন! দিব্যি সব ভুলে বরের সঙ্গে লুকিয়ে থেকে জব্দ করছে সবাইকে, আমার এক একটা জ্বালানোর শোধ নিচ্ছে গুনে গুনে! আসুক না একবার ফিরে, দেখাচ্ছি মজা এমন জব্দ করব না এবার, ঠিক বলবে 'ঘাট হয়েছে আকাশ, মাফ করো, আর কক্ষনো করবো না এরকম, প্রমিস।'না থাক,  ফিরে এলে আর বেশি কাঁদাবো না ওকে, আবার  যদি লুকিয়ে পড়ে অনেক দিনের জন্য! তার চেয়ে এবার বরং পাগলিটাকে অবাক করে বলব –

'মহারানী হুকুম করুন বান্দা হাজির আপনার সেবায়, আপনার প্রস্তাবমত এডভেঞ্চারের সব ব্যবস্থাই করে রেখেছি, আপনি শুধু নিজের সুটকেসটা গুছিয়ে নিয়ে এই অধমের হাতটা ধরে চেপে বসুন দিকি আমার পক্ষীরাজের পিঠে। উড়িয়ে নিয়ে যাই আপনাকে ওই তেপান্তরের মাঠে!'বেশ জমে যাবে বল, একেবারে সিনেমার মত!"

যুক্তিহীন মিমি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে, এত ভালবাসাকে লুকিয়ে রেখে কি করে এত উদাসীনতায় ছিল এতদিন এই মানুষটা, আর আজ যখন সামনের ভালবাসার মানুষটাই চিরবিদায় নিয়েছে তখন কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না কেন সত্যিটা! সারাক্ষণ মায়ের কথা, কিন্তু এত দেরি করলে কেন কাকু, কেন মুখ ফুটে বললে না কোনোদিন মা বেঁচে থাকতে, কেন একবার বুকে জড়িয়ে নিলে না, মুছে দিলে না চোখের জল, কেন কাকু কেন!!

মনে আছে মাকে যখন এডমিট করা হল নার্সিংহোমে, বোঝা যায় নি আগে থেকে অতটা সিরিয়াস, জীবনকে সব সময় হাসিমুখে গ্রহণ করত মা, হঠাৎ করে শরীর খারাপ করল, চেপে থাকত যতক্ষণ না খুব বাড়াবাড়ি হয়, আর তাই হলো, হঠাৎই চলাফেরা বন্ধ হয়ে গেল, যে মানুষটা খুঁজে খুঁজে দিনরাত কাজ করে, সারাক্ষণ ওর পেছনে চিৎকার করে বলে ...'মিমি ঘরটা গোছা এক্ষুনি, কি করে রেখেছিল হাল! দাঁড়া সব ফেলে দিচ্ছি টান মেরে!'...সে মুখে কুলুপ এঁটে পড়ে আছে, নো চেঁচামেচি, ঘরবাড়ি এলোমেলো, বিশ্বাস করতেও যথেষ্ট কষ্ট হয়, দুদিন একটা প্রজেক্টের কাজে বাইরে গিয়েছিল তার মধ্যে এমন কি হলো মায়ের, ব্যাপার সুবিধের নয় দেখে ওরা ভর্তি করল মেঘাকে একটা নামী হসপিটালে। "কিচ্ছু করার নেই, লাস্টস্টেজ, সার্ভাইকাল ক্যান্সার, অনেক দিন চেপে রেখেছেন কষ্ট, এখন বাড়িতে নিয়ে যান শুধু প্রার্থনা করুন, আনন্দে রাখুন, মনের ওপর কোন রকম চাপ নয়, নো নেগেটিভ থট, সবার সঙ্গে থাকলে যদি কিছু দিনের আয়ু বাড়ে"- অঙ্কোলজিস্ট, ডাক্তার রাঠীর কথায় ছুটি করিয়ে নিয়ে আসা হল মাকে বাড়িতে, একটা জীবন্ত লাশ, এটা ওর মা! কি নিদারুন যন্ত্রণার ছাপ সারা শরীরে, এত কষ্ট চেপে রেখেছিলে মা তুমি! এত অভিমান তোমার! যাকে সারাজীবন রাজ্যের বকবক করতে শুনেছে সে চোখ বুজে শুয়ে আছে এভাবে, কি করে এত তারাতারি এত সব...কান্নাটা আর গিলে রাখতে পারে না মিমি, মনে হচ্ছে দম আটকে যাবে,  কিন্ত না, কাঁদলে চলবে না মায়ের সামনে, ভাল রাখতে হবে, বাবার দিকে তাকায় মিমি, সারাজীবন বড্ড নির্ভরশীল মায়ের ওপর তো এত বড় ধাক্কাটায় একেবারে বিপর্যস্ত।

প্রানপনে কষ্টটাকে সাজানো হাসি দিয়ে ঢেকে রাখে ওরা দুজনেই। বাড়ি আনার পর দুটো দিন ঝড়ের বেগে কেটে যায়.....ঘর গুছানো,  রান্না করা,  পুজো, মা যা যা পছন্দ করে, কিন্তু তাও মায়ের মত হয় কোথায়!  উফফ এত কাজ করত মা, ইশ, তাইতো ওরকম রাগ করত! কদিন পরে মিমি লক্ষ্য করে মা কিছু একটা বলার জন্য উসখুস করছে....কাকু! ইয়েস! এছাড়া আর কিছু হতেই পারে না। আরে...এই কদিনে কি করে ভুলে গেছিল এই কথাটা, তাড়াতাড়ি ফোন করে মিমি কাকুকে।

দুদিন লাগাতার চেষ্টা করেও কাকুর ফোন লাগে না, উফফ কাকু, কোথায় গেছ তুমি, ফোনটাও তুলছ না, মেসেজ পড়ছ না, খুব রাগ আসছে, মা যে কি করে এসব সহ্য করত কে জানে, এদিকে মার শরীর দিনদিন খারাপের দিকে। একেবারেই কথা বলেনা আজকাল, চোখে মুখে তীব্র যন্ত্রণার ছাপ, ঘুমোতেও পারে না.....হঠাৎ একদিন আমায় ডেকে খুব কষ্ট করে বলল "সময় তো বেশি নেই আর...  মানুষ দুটোর খেয়াল রাখিস।"

কাকুর ফোন না আসাটাকেও মেনে নিয়েছিল মা, অবশ্য একটা ক্ষীণ আশার ঝিলিক উঁকি দিত মাঝে মাঝে...এই বুঝি সেই পাগল ফোন করে বলবে, 'চালাকি হচ্ছে, এত সহজে পালাবে ভেবেছ, কথা দিয়েছ না, আমার কথা শুনে চলবে, সেটা ভুলে গেলে চলবে কেন!'মায়ের কষ্টটা বুঝতে পেরে মোবাইলে কাকুর ছবিগুলো, এডভেনচারের ভিডিওগুলো দেখাতাম মাকে, অস্থির চোখে নেমে আসত শান্তি, ঘুমিয়ে পড়ত মা ধীরে ধীরে। এইভাবে  দিনকুড়ি পার করে সব ফেলে শুধু কিছু স্মৃতি বুকে নিয়ে আর কাকুর জন্য অনেকটা জমিয়ে রাখা ভালোবাসা সাথে নিয়েই চলে গেল মা, সত্যি চলে গেল! আর সেই দিনই ফোন করল কাকু....

"কি বলছিস মিমি, মা চলে গেছে, আরে না না কোথায় আবার যাবে, আসলে রাগ করেছে তোর ওপর আর আমার ওপর, না বলে চলে গেছিলাম না তাই! এইটাই তো ব্যাপার, সবেতেই রাগ করে,  একটু বোঝে না ! আমিই বা কি করি বল, বললে তো হাজারটা বকবক শুনতে হবে, তোমার ওখানে যাওয়া উচিত নয়, বয়স হয়ে গেছে , কিছু হলে কে দেখবে! শুরু হলে আবার প্রবচন শেষই হতে চায় না ! ফিরে আসবে এবার, আমি এসে গেছি তো, ঠিক আসবে গন্ধে গন্ধে, ঝগড়া করতে, কি আর করা যাবে, কপাল আমার, লড়াই না হলে তো ওর আবার ভাত হজম হয় না, আচ্ছা শোন এলেই বলবি কিন্তু আমায় যেন ফোন করে, অনেক জায়গায় গেছিলাম এবার, দারুন সব গল্প, তিন চার দিনেও শেষ হবে না!"

না বিশ্বাস হয়নি কাকুর মা আর কোনদিন ফিরে আসবে না, মিমিও ভেবেছে একটু সামলে নিয়ে সামনাসামনি দেখা করে সব বুঝিয়ে বলবে কাকুকে। তার মধ্যে আবার এক দুর্যোগ। ঠিক দশদিনের দিন বাবার বুকে ব্যথা শুরু হয়, নার্সিংহোমে নিয়ে যাবার সুযোগটুকুও থাকে না, এক মাসের মধ্যে মাথার ওপর থেকে ছাতাটা সরে যায় মিমির, কাকুকে ফোন করে কান্নায় ভেঙে পড়ে, -"ওরা যে দুজনেই চলে গেল, আমি কি করে থাকব একাএকা এখন..."

পরের দিনেই আসলো কাকু। উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি ,  বিধ্বস্ত চেহারা...."কি হয়েছে মিমি, কোথায় তোর বাবা, এভাবে তোকে একা রেখে কোথায় গেছে দুজনে, আর মেঘা, সে কোথায়, কোথায় তোর মা...."বললাম সবটা,  মায়ের অসুখ, বাড়াবাড়ি, অস্থিরতা,  ফোন করেও না পাওয়া, সবটা.... মাথা নিচু করে শুনল কাকু...

"তোমার ফোন না আসায় শেষদিকে খুব অস্থির হয়ে পড়েছিল মা, যেন কি একটা ইম্পরট্যান্ট কথা বলার বাকি আছে তোমাকে, যেটা না বললে প্রানটা বেরোতে পারছে না দেহ ছেড়ে...তুমি কেন এলে না কাকু, এত কষ্ট বুকে করেই চলে গেল মা, কেন করলে এমন...এ কেমন লড়াই! একজন শেষই হয়ে গেল, এখন কার সাথে করবে যুদ্ধ! কাকেই বা দেবে সারপ্রাইস! কেই বা এত মন দিয়ে ভালোবেসে শুনবে তোমার গল্প, আর তো পাবে না মাকে...তাহলে.......!!"

সন্ধ্যে হয়ে গেল, এখনো মায়ের ছবিটা বুকে নিয়েই বসে আছে মানুষটা, দুচোখ বন্ধ, যেন ধ্যানে মগ্ন, সমাহিত এক আত্মা...হয়ত মনে মনেই কথা বলছে মায়ের সাথে, সব প্রশ্নের জবাব দিচ্ছে মায়ের, বলছে হয়ত নিজের ভেতর যত্ন করে লুকিয়ে রাখা এক একটা অনুভূতি, যা আগে কখনো বলতে পারে নি মুখ ফুটে, কে জানে....এই ভালোবাসার গভীরতা বোঝা বা ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা নেই ওর। তাই ইচ্ছে করছে না মানুষটাকে বিরক্ত করতে.....নিজের সাথে বোঝাপড়া করছে যে, এটুকু সত্যিই খুব দরকার। দরকার এই অন্য ভালোবাসায় একটা সম্পূর্ন সমর্পন। একটা পাগল পাগল সত্যিকারের ভালোবাসা স্বীকৃতি পাক, সব নকল লড়াই, যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার শেষে এবার শুধু অখন্ড শান্তি,  .....এই আত্ম সমর্পণের মুহূর্তটুকু অনেক দিনের কাঙ্খিত....

মৌসুমি ব্যানার্জী: কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন