সমান্তরাল



গল্প



বাস থেকে নেমেই মোবাইলে রিচার্জ করতে গেল মিলি| টকটাইম থাকলেও নেট ব্যালেন্স ছিল না| দরকার হয়নি গত দিনচারেক| মামাতো বোনের বিয়েতে গিয়েছিল| এই কদিন ধরে খালি হুল্লোড় আর আনন্দ! ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, টিভি সবকিছু থেকে দূরে বেশ ভালোই কাটলো কদিন| খোলা হাওয়া, উন্মুক্ত আকাশ, গ্রাম্য মানুষের সারল্য সবকিছু মিলিয়ে আলাদা এক ভালোলাগার স্বাদ| আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে আজকাল অনেকদিন পরে পরে দেখা হয়| মামারবাড়ির গ্রামের লোকেরা অবশ্য কেউ আত্মীয়ের কম নয়| সবার মুখে প্রায় একই কথা, "কি রে মিলি কত্ত বড় হয়ে গেছিস!" তার সঙ্গে নানা মজাদার সংযোজন, কেউ বলল, মনে আছে জলে নামলে আর উঠতে চাইতিস না, আমার মা প্যাকাটি হাতে গিয়ে তোদের সবকটাকে বকে মেরে পুকুর থেকে তুলত? কেউ আবার বলে, মনে আছে সেই পাটকিলে রঙের কুকুরছানাটাকে বাড়ি নিয়ে যাবি বলে কেমন কান্না জুড়েছিলি? - মিলি শোনে আর মুখ টিপে হাসে | জানে, আগে যখন প্রায় প্রতিবছর আসত তখনও গ্রামসম্পর্কের এই মামা মাসিরা একই কথাগুলো বলে আনন্দ পেত | আসলে এদের নিস্তরঙ্গ জীবনে এই স্মৃতিগুলো বড় বেশি করে ধরা থাকে| একদিকে ভালো, শহুরে বাঙালির মতো বডি শেমিং ব্যাপারটা এদের মধ্যে নেই| দেখা হলেই, খুব মোটা হয়ে গেছিস বা এতো রোগা হয়ে গেলি কেন, অসুখ-বিসুখ কিছু হয়েছিল নাকি, - ইত্যাদি শুনতে বড় বিরক্ত লাগে |

ক্লাসে এসে বসার পর থেকে কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করতে লাগল মিলি | প্রথম দুটোই অনার্সের ক্লাস ছিল | কেউ বিশেষ কথা বলার সুযোগ পায়নি | অন্যদিন সোমা ওর পাশে বসে, আজ ক্লাস শুরুর সময় তাড়াহুড়ো করে এসে সামনের বেঞ্চে বসে পড়েছে | এর মধ্যেই দেবারতির সঙ্গে একবার চোখাচোখি হলো, চোখটা যেন সরিয়ে নিল মনে হল, নাকি মনের ভুল? অস্বস্তিটা বাড়তে লাগলো | মনে পড়লো, গত শুক্রবার  ইউনিয়ন রুমে একটা ঝামেলা হয়েছিল | এটা কি তার জের? সামনে কলেজের ইলেকশন, - তা নিয়েই রুদ্ধদ্বার বৈঠক | মিলিও ছিল সেখানে | বামপন্থী আবহে বড় হয়ে ওঠা মিলির ছাত্ররাজনীতিতে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যেতে বেশি সময় লাগেনি | সেই সূত্রে ছাত্রসংসদ নেতাদের কাছে মিলি'র সুকন্যা সরকার নামটা বেশ পরিচিত | সেদিনের মিটিংয়ে সৌগতদার পরিকল্পনাটা ওর পছন্দ হয়নি | স্পষ্ট বলেছিলো, "ওরা বহিরাগত নিয়ে এসে হামলা চালায়, আমরা অভিযোগ করি | স্টুডেন্ট আর মিডিয়ার  সিমপ্যাথি আমাদের সঙ্গে... এই অবস্থায় কোনো শান্তিপূর্ণ আলোচনাতেও পার্টির হস্তক্ষেপ আমাদের চাওয়া উচিত হবে না | না হলে আমরা আর আলাদা কিসে হলাম?"
- "সুকন্যা, বাস্তবটা বোঝার চেষ্টা কর ", অর্কদা থামাবার  চেষ্টা করলো |
- "বামপন্থীদের কাছে ক্ষমতা নয়, নীতিই আগে হওয়া উচিত |" মিলির সপাট উত্তর |
  সৌগতদা অপমানিত বোধ করছিল |
 " অর্ক তোরা আগে কথা বলে নে, তারপর আমায় ডাকিস, এক হিসেবে আমিও তো বহিরাগত! "বলতে বলতেই বেরিয়ে গেল সৌগতদা| পেছন পেছন অর্কদা ও অন্যান্যরা| পরে সব শুনে ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা মিলিকে সমর্থন করলেও, অর্কদা কিন্তু সারাদিনটাই ওকে এড়িয়ে এড়িয়ে ছিল | পরেরদিনও তাই |  মিলি বাইরে কিছু বুঝতে দেয়নি , তবে একটা চাপা অভিমান যেন অস্বস্তির মতো গলার কাছে আটকেছিল |
  
কলেজের সব মহলেই জনপ্রিয় অর্ক | প্রথম দেখার সময় থেকেই অর্কর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, তার দৃপ্ত উচ্চারণ, মন জয় করে নিয়েছিল সুকন্যার | তারপর নানা কাজে কাছাকাছি আসা,.... অর্কর সান্নিধ্য ভালো লাগতো ওর | তবে জ্ঞানত অন্য কোনোরকম সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি| আবেগকে ছেলেমানুষি মনে করা আধুনিকতার মোড়ক আর কমরেড-সুলভ কাঠিন্যই হয়তো সে পথের অন্তরায় ছিল | তাই,  সেদিন অর্কর অবজ্ঞাটুকু ওকে বেশী বিচলিত করে তুলছে দেখে মিলি নিজেও একটু অবাক আর লজ্জিত হয়েছিল | নিজের মনের গভীরে ডুব দিয়ে তার কারণ খুঁজবে, সে সাহস হয়নি | সে সময় কদিনের জন্য শহর ছেড়ে পালানোটা একদিক দিয়ে ভালো হয়েছিল | পালানোই বলা যায়, না হলে রেল অবরোধের কর্মসূচি আছে জেনেও একদিন আগে ও কলকাতা ছেড়ে যেত না |  ক্লাসে বসে আছে ঠিকই কিন্তু একটা কথাও কানে ঢোকেনি ওর | দেখল পি.কে.সি. বেরিয়ে যাচ্ছেন, সোমাও বেরিয়ে যাচ্ছে ওনার পেছন পেছন| মিলি প্রায় দৌড়ে গিয়ে ওকে ধরল, জানতেই হবে কী এমন হয়েছে যে....

চারিদিকে একটু চোখ চালিয়ে নিয়ে সোমা বলল, তুই ক্যান্টিনে গিয়ে বস, আমি স্যারের সঙ্গে একটু দেখা করে যাচ্ছি, কথা আছে | ধীর পায়ে ক্যান্টিনে গিয়ে কোনের একটা চেয়ারে বসল মিলি | সোমার 'কথা আছে' বলার মধ্যে এমন কিছু ছিল যাতে এটুকু বোঝা গেছে মিলির সন্দেহ অমূলক নয়, দেয়ার ইজ সামথিং রং | সেটা কী সোমাই বলবে, আগে থেকে বেশী চাপ নিয়ে লাভ নেই | নিজেকে একটু গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল মিলি | তবু একটা অজানা আশঙ্কা, একটা শিরশিরে অনুভূতি ওকে অস্থির করে তুলছিল | এ সময় অর্কদা পাশে থাকলে....  অস্থিরতা কাটাতে মোবাইল বার করে ফেসবুক স্ক্রোল করতে থাকে মিলি| প্রথমেই চোখ আটকে যায় আনন্দরূপের স্ট্যাটাসের ওপর.... এ কী ভয়ানক ব্যাপার !


অফিস থেকে কোনো মেসেজ এসেছে কিনা দেখে নিয়ে ফোনটা আবার সুইচ অফ করে দিল অরিন্দম | এভাবেই চলছে গত কয়েকদিন, বিশেষত যখন থেকে প্রেসের ফোন আসা শুরু হয়েছে | বাইরেও বেরোচ্ছে না আর | প্রথমদিন একটু বেরিয়েছিল, সবজায়গায় একই আলোচনা |  সত্যির চেয়ে গুজবের ভাগটাই বেশী| মনে হচ্ছিল কয়েকশো কৌতূহলী চোখ যেন ওর দিকে তাকিয়ে আছে | আর একটা নতুন কথা শুনল, খুনে ড্রাইভারটি নাকি বলেছে, "বেশ করেছি ! কুড়ি পঁচিশটাকে কেটে দিতে পারলে ভাল হত! "চিৎকার করে প্রতিবাদ করার ইচ্ছে হচ্ছিল অরিন্দমের ..  দমন করলো নিজেকে | ঘটনার সূত্রপাত চারদিন আগে, সোমবার | সেদিন রেল বাজেটে বাংলাকে বঞ্চনার প্রতিবাদে বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের রেল অবরোধ কর্মসূচি ছিল | শিয়ালদা থেকে লক্ষীকান্তপুর লোকাল নিয়ে যাচ্ছিল অরিন্দম | 

ইএমইউ স্টপ বোর্ডের কাছে ট্রেনটা দাঁড় করাতে গেলে এমনিতেই প্ল্যাটফর্মে ঢোকার সময়  স্পিডটা প্রায় পঞ্চাশে নামিয়ে আনতে হয় | সামনে বাঁক আছে বলে আরো আগে থেকেই স্পিডটা কমিয়ে দিয়েছিল অরিন্দম | হর্নও বাজাচ্ছিল বারবার | বাঁক ঘুরতেই দেখে লাইনের ওপর বহু মানুষ, হর্নের আওয়াজ পেয়ে ইতস্ততঃ দৌড়াদৌড়ি করছে | নিয়মিত যারা এখান দিয়ে যাতায়াত করে তারা জানে কোনদিকে সরতে হবে কিন্তু হাতে প্ল্যাকার্ড, ব্যানার নিয়ে ছাত্রছাত্রীর দল বুঝতে পারছিল না কী করবে ! কেউ কেউ হয়তো ভাবছিলো ব্যানার নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে পড়লেই ট্রেন থেমে যাবে! অভিজ্ঞ চালকের সহজাত প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় ইমার্জেন্সি ব্রেক মারল অরিন্দম| যদিও জানে এটুকু দূরত্বের মধ্যে কোনোভাবেই ট্রেন দাঁড় করানো সম্ভব নয়, তবু আস্তে হলে কিছু প্রাণ তো বাঁচবে! তাই হলো, একটু সময় পেতেই সবাই এদিক ওদিক ছিটকে যেতে পারলো | কেউ কাটা পড়েনি, তবে লাফিয়ে রেল লাইনের বাইরে যেতে গিয়ে চোট আঘাত লাগতে পারে | অকুস্থল থেকে বিশ পঁচিশ মিটার এগিয়ে ট্রেনটা দাঁড়িয়ে গেল | বুকের ভেতর তখনও যেন কেউ হাতুড়ি পিটছে অরিন্দমের | প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা একটি লোক জানলায় মুখ বাড়িয়ে বলল, "খুব জোর বাঁচিয়ে দিয়েছেন দাদা!"

তারপরের মুহূর্তেই  প্রবল চিৎকার করে তেড়ে আসার শব্দ, ক্যাবের দরজায় মুহুর্মুহ লাথি, তার সঙ্গে গালিগালাজ! একটু পরে শুরু হলো স্লোগান | চেনা স্লোগানের পাশাপাশি এরকমও শুনতে হল, শাসকের দালাল চালককে নাকি পাঠানো হয়েছে আন্দোলনকারীদের প্রাণ নেওয়ার জন্য! অরিন্দম স্তম্ভিত বললে কম বলা হবে | একবার মনে হল চিৎকার করে ওদের বলে,  "যে লাল রঙের ঝান্ডা হাতে নিয়ে তোমরা একজন চালককে এ কথা বলছ,  তোমরা জান না সেই রঙের মর্যাদা, এই রঙ বুকে নিয়ে চালকদের ঐতিহাসিক আন্দোলনের কথা, তাঁদের আত্মত্যাগের ইতিহাস, জেলে যাওয়া, চাকরি থেকে বিতাড়ন...

...বলতে ইচ্ছে করল,.. ছাত্রাবস্থায় আমরাও অনেক ট্রেন অবরোধ করেছি, ট্রেন দাঁড়াবার পর তার সামনে ব্যানার নিয়ে বসে পড়েছি, ছুটন্ত ট্রেনকে কখনো দাঁড় করাবার কথা ভাবিনি | আমরা জানতাম ট্রেন সাইকেল নয় যে ব্রেক মারলে সেখানেই দাঁড়িয়ে যাবে!" ঘটনার অভিঘাতে অরিন্দমের শরীর মন যেন অসাড় হতে শুরু করেছিল, 'দালাল' বলে রাজনৈতিক খোঁচাটা খানিকটা ওষুধের কাজ করল | ফোন সুইচ অন করে পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝিয়ে অফিসে জানালো |

 
সোম, মঙ্গল দুটোদিন খালি এনকোয়ারিতে হাজিরা দিতেই কেটে গেছে অরিন্দমের | ভরসার কথা রেল প্রশাসনকে বাস্তবটা বোঝানো গেছে | নিজের বিভাগীয় অফিসাররা তো পরিষ্কার বলে দিয়েছেন, চালকের সতর্কতার জন্যই বড় দুর্ঘটনা আটকানো সম্ভব হয়েছে | আলোচনায় বারবার উঠে এসেছে, দ্রুত, খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা যাচাই করার জন্য 'সাইকোলজি টেস্টে'র উপকারিতার কথা | সহচালকে নিয়োগ থেকে শুরু করে প্যাসেঞ্জার ট্রেনের চালক পর্যন্ত পদোন্নতির প্রতিটা ধাপে পেরিয়ে আসতে হয় এই কঠিন পরীক্ষা |
 
ইতিমধ্যে সোশ্যাল সাইটে 'খুনি ড্রাইভার' বলে জঘন্য প্রচার শুরু হয়েছে | কিছু কিছু  অরিন্দমের কানেও এসেছে | এতো বিশ্রী সব আক্রমণ! এত মিথ্যে! অরিন্দমের মনে হতে থাকে তার ঠান্ডামাথায় চিন্তা করার ক্ষমতা লোপ পাচ্ছে | এরকম মানসিক অবস্থাকেই কি ট্রমা বলে? কারো কাছে বলে মন হালকা করারও উপায় নেই |আরতি বাড়িতে নেই, ভাইঝির বিয়েতে গেছে | বাবা বাড়িতেই আছে, এই চুয়াত্তর বছর বয়সে তাঁকে আর চিন্তায় ফেলতে মন চায় না | অন্য সূত্র থেকেও তাঁর জানতে পারার সম্ভাবনা কম | মিলি দাদুকে একটা ফেসবুক একাউন্ট খুলে দিয়েছে ঠিকই, তবে তাতে বিশেষ আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না |

ঠিক সে সময় দোতলায় নিজের ঘরে, স্ত্রী সুমিত্রার ছবির সামনে বসেছিলেন অবিনাশবাবু | চোখে জলের ধারা | অরিন্দমের এই বিধ্বস্ত চেহারা আর তার কারণ জানার পর থেকে, ছেলেটার জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে | বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দূরত্ব বেড়ে যায়,  নাহলে ছোটবেলার মতো বুকে জড়িয়ে ধরে  সাহস দিতেন | দশ বছর বয়সে মাতৃহারা হয়, - তারপর থেকে দুহাতে আগলে রেখে বড় করেছেন ছেলেকে | তাই এখনো ছেলের আনন্দ, দুঃখ, উদ্বেগের স্পন্দন ছুঁয়ে যায়  অবিনাশকে | লক্ষণগুলো ভীষণ চেনা যে ! একেই বুঝি বলে আত্মজ! সোমবার অনেক দেরিতে বাড়ি ফেরা আর তারপর থেকে ক্রমাগত মুষড়ে পড়া চোখ এড়ায়নি অবিনাশের | বাকিটা জেনেছেন ওর কলিগ অমলকে জেরা করে | অরিন্দম বাথরুমে গিয়েছিল বলে অমলের ফোনটা উনিই ধরেছিলেন |

'সত্যেরে লও সহজে' এই আপ্তবাক্যকে আশ্রয় করে অবিনাশ নিজের জীবনের নানা ওঠাপড়ায় অবিচল থেকেছেন | কিন্তু তখন সোশ্যাল মিডিয়ার এই দৌরাত্ম্য ছিল না | তাছাড়া তিন প্রজন্ম ধরে তাঁরা যে রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুসারী সবচেয়ে কঠিন আঘাতটা আসছে সেইদিক থেকেই | উনি জানেন অরিন্দমের মনঃকষ্টের এটাও একটা বড় কারণ | সুমিত্রা একটা কথা প্রায় বলতেন, 'উৎপত্তির স্থলে নিষ্পত্তি' ! অবিনাশ বুঝেছিলেন সোশ্যাল মিডিয়ায় যে কুৎসার ঝড় উঠেছে সেখানেই তাকে কমব্যাট করতে হবে | প্রথমেই মনে পড়ল দিবাকরের কথা | দিবাকর দক্ষিণ-পূর্ব রেলের ইএমইউ ড্রাইভার বা মোটরম্যান | আবার কিছুটা সাহিত্যচর্চাও করে, সেই সূত্রে অবিনাশবাবুর সঙ্গে আলাপ | এর আগে একটি দুর্ঘটনা নিয়ে ছেলেটি ফেসবুকে লিখেছিল, 'ট্রেনচালকের হাতে দিক বদলের জন্য কোনো স্টিয়ারিং থাকে না, তাই দুর্ঘটনা হলে প্রথমেই চালককে দায়ী করা ঠিক নয়'| দিবাকরের নম্বরটা খুঁজে বার করে ফোন করলেন অবিনাশ |


সোমার জন্য বেশ কিছুক্ষন অপেক্ষা করতে হলো | ততক্ষনে মিলি উৎকন্ঠা আর উদ্বেগের শেষ সীমায় পৌঁছেছে | আনন্দরূপের পোস্ট থেকে খালি জানতে পেরেছে এক ট্রেনচালক অবরোধকারীদের ওপর দিয়ে ট্রেন চালিয়ে দিয়েছে এবং পরে বলেছে, কুড়ি পঁচিশ জনকে কেটে দিতে পারলে বেশ হতো! লোকটা তো অমানুষ! অসম্ভব রাগ আর ঘৃণা হচ্ছে মিলির | কিন্তু তার চেয়ে বেশী চিন্তার বিষয়, কলেজের কারো কিছু হয়নি তো? আহত বা... আর ভাবতেও পারছে না মিলি ! পোস্টের নিচে অনেক কমেন্টস| এমনকি ভাঙড় আন্দোলনের নেত্রী শর্মিষ্ঠাদিও কিছু লিখেছেন, কিন্তু কেউ হতাহতের কোনো খবর দেয় নি | সোমা আসতেই মিলি প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল,

"কী হয়েছে আমায় তাড়াতাড়ি বল, আমাদের কলেজের কারো কিছু হয়নি তো? "
সোমার মুখ আশ্চর্যরকম থমথমে | খুব আস্তে আস্তে কথা বলছিল,
"না, কারোর কিছু হয়নি | ওই লাইনে যারা ছিল সবাই এদিকওদিক ঝাঁপিয়ে প্রাণে বেঁচে গেছে |"
একটু থেমে সোমা বলল,
"কিন্তু তুই ফেসবুকে যা দেখলি তার বাইরেও খবর আছে "

এতক্ষনের মানসিক উত্তেজনার ধকলে মিলি ক্লান্ত, উৎসুক হয়ে চেয়ে রইল কেবল | সোমা বলে চলে, "অবরোধের দিন তুই যখন এলি না অনেকেই ভেবেছিল এটা সেদিন ইউনিয়ন রুমে বিতর্কের জের | তুই বিশ্বাস কর সুকন্যা এরপর যা যা ঘটেছে তাতে আমার কোনো সমর্থন নেই, তবু আমাকেই বলতে হচ্ছে, কারন বুঝতে পারছি তোর সবটা জানা দরকার | " সোমা মিলির হাতটা দুহাতে চেপে ধরল.. তারপর যেন শরীরের সমস্ত শক্তি এক করে বাকি কথাগুলো বলে ফেলল,

"সেদিন বিকেলের মধ্যে কলেজে খবর চলে এল, ইএমইউ  ড্রাইভারটির নাম অরিন্দম সরকার, হিস্ট্রি অনার্সের সুকন্যা সরকারের বাবা ! কে নাকি সে সময় ফটোও তুলেছে, আর তার সঙ্গে যোগ হলো, চালকের 'বেশ করেছি' জাতীয় একটা বয়ান | পরের দিন সৌগতদা তার দলবল নিয়ে এসে কলেজময় প্রোপাগান্ডা করল, 'চিনে নাও শাসকের দালাল, বিশ্বাসঘাতকদের!.. আমি আগেই বলেছিলাম '.তুই নাকি জেনেশুনেই সেদিন আসিস  নি.. ইত্যাদি| ... আমি একটু প্রতিবাদ করতে গিয়েছিলাম বলে যেভাবে অপমানিত হতে হলো ভাবতে পারবি না | 

ততক্ষণে সোমার হাত ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে মিলি | পাথরের মতো ভাবলেশহীন মুখ | শুধু গাল বেয়ে জল নামার শুকনো দাগ | মনে হচ্ছে গত ক'মিনিটে দশবছর বয়স বেড়ে গেছে মেয়েটার! এত কথা একদমে বলে ফেলার পর সোমা তখন প্রায় ফুঁপিয়ে কাঁদছে | ও ভালোভাবে কিছু বুঝে ওঠার আগেই, 'থ্যাংকস সোমা, আমি আসছি ' বলে দ্রুত পায়ে ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে পড়ল মিলি |


রুবিকস কিউবটা হাতে নিয়ে অন্যমনস্কভাবে নাড়াচাড়া করছিলো অর্ক | 'দিকে ছয় আলাদা আলাদা রঙের একইরকম ডিজাইন| একবার শিখে গেলে সমাধান খুব সহজ | জীবনের বাস্তব সমস্যাগুলোর মতো জটিল নয়! একই সমস্যা নানা দিক থেকে দেখলে তার ভিন্ন ভিন্ন স্বরূপ নিয়ে হাজির হয় | এইমুহূর্তে অবশ্য অর্ক রুবিকস কিউব কেন কোনোকিছুরই সমাধান করার মতো অবস্থায় নেই | ক্রমশ চরম হতাশায় ডুবে যাচ্ছে ও | অথচ এক সপ্তাহ আগেও সবকিছু অন্যরকম ছিল | সেদিনের মিটিংটা ভেস্তে যাওয়ার পর থেকেই যেন পাল্টে গেল সব! রজত সোজাসুজি ওকেই দোষ দিল, "এতো সাহস হয় কী করে সুকন্যার! অর্কই ওকে আস্কারা দিয়ে... "অন্যরা চুপ করে ছিল| অর্কর মুখের ভেতরটা একদম তেতো লাগতে শুরু করল | সেদিনটা আর কারো সঙ্গে কথা বলে নি | শনিবার কলেজ গেল না| ভাবার সময় চাই | সুকন্যাই যে ঠিক বলেছিলো সেটা যুক্তি দিয়ে সবাইকে বোঝাতে হবে |  কিন্তু তেমন কিছু ভাবার সুযোগ ও পেল না | সুকন্যার অভিমানী ছবিটাই কেবল ঘুরে ফিরে মনে আসতে লাগলো | আবেগ, উচ্ছ্বাস, ছেলেমানুষির অন্তরঙ্গ মুহূর্তগুলোর স্মৃতি তুমুল বর্ষার মতো ধুয়ে নিয়ে যেতে থাকে রাজনীতির যুক্তি তর্ক কূটকচালি! যে অন্তর্লীন ভালোবাসাকে অর্ক কখনো মান্যতা দেয়নি, সে যেন বিশাল রামধনুর মতো ওর আকাশ জুড়ে ঝলমলিয়ে উঠলো!

অর্ক ঠিক করল,এই ইস্যুতে সুকন্যার পাশেই থাকবে, তাতে বিরোধিতার জেরে যদি সাময়িক রাজনীতি ছেড়ে দিতে হয় তাহলেও | সোমবারই কলেজে গিয়ে নিজের অবস্থান জানিয়ে দেবে | তার আর সুযোগ পেল না অর্ক | আন্দোলনকারীদের ওপর সুকন্যার বাবার ট্রেন চালিয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে সৌগত-বাহিনীর প্রোপাগান্ডা,  একের পর এক এমন অকল্পনীয় ঘটনা ঘটে যেতে থাকল যে... | অর্ক ভেতরে ভেতরে বিধ্বস্ত হয়ে যায়, ভাবার চেষ্টা করে সুকন্যার মানসিক স্থিতি এখন ঠিক কিরকম | খবর পেয়েছে কাল পর্যন্ত কলেজে আসেনি | গভীর চিন্তায়  ছেদ পড়ল ফোনের আওয়াজে | অভ্র'র ফোন, গলায় ভীষণ উত্তেজনা নিয়ে বলল,

" অর্ক জলদি ফেসবুক খোল, আমি দিবাকর ঘোষের একটা পোস্ট শেয়ার করেছি, মন দিয়ে পড়... আমার মন বলছিলো কোথাও বড় একটা ভূল হচ্ছে, হাতেনাতে মিলে গেল !"

শেষ বাক্যটা অভ্র'র মুদ্রাদোষ, সর্বদাই ওর মন কিছু না কিছু বলছে আর হাতেনাতে মিলেও  যাচ্ছে | অর্ক তেমন গুরুত্ব দিল না |
- "আরে, কিসের কথা বলছিস সেটা তো আগে বলবি !" একটু রূঢ়ভাবেই বলল অর্ক|
- "সুকন্যার বাবার ব্যাপারে | ইচ্ছে হলে দেখ, না হলে দেখিস না, তোর এতো জেরার জবাব দেবার সময় নেই ! আমার তো মন বলছে......
পুরোটা আর শোনা হল না অর্কর, কল কেটে দিয়ে ও ততক্ষনে ফেসবুক খুলে ফেলেছে |
   
প্রায় এক নিঃশ্বাসে দিবাকর ঘোষের পুরো লেখাটা পড়ে ফেলল অর্ক | উনি নিজেও ইএমইউ ট্রেনের চালক | প্রথমেই কিছু স্ক্রিনশটের সাহায্যে দেখিয়েছেন, দুর্ঘটনা পরবর্তী যে কুখ্যাত বয়ানের কথা বারবার উদ্ধৃত করা হচ্ছিল, সেটা সদ্য চাকরি পাওয়া এক ট্রেনি ডিজেল সহচালকের ফেসবুক স্ট্যাটাস | সুদূর ভবিষ্যতেও তার পক্ষে ইলেকট্রিক লোকালের চালক হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম | ফেসবুক  প্রোফাইল দেখলেই বোঝা যাচ্ছে যে, ছেলেটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের অনুগামী হিসেবে এই বিশ্রী কথাটি পোস্ট করেছে | এটুকু পড়েই যেন অনেকটা স্বস্তি পেল অর্ক!

এরপর ভদ্রলোক বলেছেন, পাগল বা আত্মহত্যা করতে যাওয়া লোকেরও এটুকু কমনসেন্স থাকে যে দ্রুতগামী এতো বড় একটা ট্রেনকে হঠাৎ থামিয়ে দেওয়া যায় না, তাই সুইসাইড করার জন্য এটা সবচেয়ে সহজ ও জনপ্রিয় উপায় | দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনের সামনে অবরোধ করাটাই দস্তুর | ছুটন্ত ট্রেনের সামনে দাঁড়ালে চালকের আর কিছু করার থাকেনা | তবু এক্ষেত্রে চালকের চেষ্টাতে বহু মানুষের প্রাণ বেঁচেছে | আরো অনেক যুক্তিপূর্ণ কথা লিখেছেন দিবাকরবাবু | কয়েকঘন্টার মধ্যে একশোর ওপর শেয়ার হয়ে গেছে ! অর্কও শেয়ার করে, সুকন্যা, সোমা, রজত আরো অনেককে ট্যাগ করে দিলো |অর্কর মনে হতে লাগলো নতুন করে জীবন ফিরে পেয়েছে! সুকন্যা কি ফেসবুক দেখেছে? ওর এক্ষুনি দেখা দরকার, ওর বাবাও পোস্টটা দেখলে একটু শান্তি পাবেন|  কিছুক্ষন অপেক্ষা করে সুকন্যাকে ফোন করল অর্ক | সুইচ অফ ! ক্লাসে আছে? আবার চেষ্টা করে | বারবার...

এর মধ্যেই সোমার ফোন এল |
- "অর্কদা, তোমার পোস্টিংটা দেখলাম | কিন্তু সুকন্যা দেখেছে বলে মনে হয় না | ফোন সুইচ অফ | রবিবার থেকে ও কলকাতায় ছিল না | আজকেই আমার থেকে সব শুনল | শুনেই থমথমে মুখে ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে গেল...  তারপর আর ক্লাসেও আসেনি | কাকিমাকে ফোন করেছিলাম, বাড়ি ফেরেনি.. অর্কদা আমার খুব ভয় করছে... তুমি... তোমরা একটা কিছু করো.. খুঁজে বার করো ওকে.. "
....কান্নায় গলা বুজে গেল সোমার |

কোনোরকমে নিজেকে সোজা করে দাঁড় করালো অর্ক | রেডি হতে হতে রজত আর  অভ্র এদের ফোন করে কিছু নির্দেশ দিল | বেরিয়েই ট্যাক্সি ধরে সোজা যাদবপুর স্টেশন | অভ্রও এসে গেছে | দুজন দুদিকে ছুটতে শুরু করল লাইন ধরে....

কতক্ষণ প্ল্যাটফর্মে বসে ছিল আর কতক্ষন যে এরকম উদভ্রান্তের মতো হাঁটছে তা আর খেয়াল নেই মিলির... কতদূর এলো, কোথায় যাবে তাও জানে না | কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই ওর... শুধু  এই সমান্তরাল দুটো ইস্পাতের লাইন আর চলার ছন্দে আওয়াজ তোলা পাথরগুলোকেই আপন বলে মনে হচ্ছে  | এর মধ্যে একবার ফোনটা বেজেছিল.. অন্যমনস্কভাবে  ধরেও  নিয়েছিল মিলি | একটা যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর বলতে শুরু করল..  মাত্র ন'শো নিরানব্বই টাকায় লাইফটাইম রিচার্জ করুন...  রাগে, হতাশায় ফোনটা সজোরে ছুঁড়ে ফেললো মিলি, পাথরের ওপর পরে ছত্রখান হয়ে গেল সেটা...

 মাথার ওপর চড়া রোদ..  গলা শুকিয়ে কাঠ... রেল লাইন ধরে হেঁটে  চলেছে মিলি..
...দূরে কোথাও একটা শব্দ.. ক্রমশ এগিয়ে আসছে.. |

মানস ঘোষ : কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত


৯টি মন্তব্য:

  1. অনেক প্রকৃত সত্য জানতে পারলাম। খুব ভালো লাগলো।এরকম আরও কিছু ঘটনা ও তার প্রেক্ষিতে সাধারণ মানুষের ও মোটরম্যানে্র প্রতিক্রিয়া জানতে পারলে ভালো হতো। Rita Basu.

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. চেষ্টা করবো মোটরম্যান ও অন্যান্য ট্রেনচালকদের অভিজ্ঞতা জানাবার

      মুছুন
  2. ধন্যবাদ দিদি!আশাকরি ধীরে ধীরে আরো অনেক কিছু জানাতে পারবো 🙏

    উত্তরমুছুন