নেই গল্পের চরিত্র



গল্প


ফাল্গুনের ২৪ তারিখ শনিবার,সন ১৩৫৯

গরাণিয়া খালে ভিড়লো কলকাতা থেকে আসা ভূঞ্যাদের নৌকো। নৌকোয় প্রচুর জিনিসপত্র কিছু লোকজন,সম্পন্ন পোশাক আশাক। খালের দক্ষিণে উঁচু ধান জমি। ধানজমির শেষ প্রান্তে মিত্তিরবাবুদের বিশাল দোতলা মাটির বাড়ি। ওপরে খড়, নিচে টালির ছাউনি। নৌকো থেকে পাটাতনে পা রেখে খালপাড়ে নামলেন মিত্তিরবাবুর বড় ছেলে। আগে থেকে বাড়ির কাজের লোক ধানিয়া, কানু, গেনু দাঁড়িয়েছিল। তারাই নৌকোয় থাকা বাবুর জিনিসপত্র মাথায় তুলে মিত্তিরবাবুর বাড়ির দিকে রওনা দিল। মিত্তিরবাবুর মেজছেলের বিয়ে লেগেছে, মিত্তিরবাবুর এক মেয়ে, সদ্যপুত্র সন্তান হয়েছে ফাল্গুনের ১২ তারিখে। চৈত্রমাস মল মাস। মেয়ে সপুত্র শ্বশুরবাড়ি কাঞ্চননগরে, ছেলের বিয়ের পরদিনই রওনা হবে। বড়বাবু ধনিয়াকে জিজ্ঞেস করলেন পালকি ঠিক হয়েছে কিনা। ধনিয়া জানালো - হ্যাঁ, তিনটে পালকি ঠিক হয়েছে। বিয়ের জন্য দুটো,ভবানীদির জন্য একটা। কথায় কথায় বাড়ির দাওয়ায় পৌঁছালেন বড়বাবু। মিত্তিরমশাই হাতলওয়ালা চেয়ারে বসে তামাক সেবন করছেন,বড়বাবু কত্তামশাইকে প্রণাম করে বিনয়ের সাথা জিজ্ঞেস করলেন,পালকি কত নেবে। মিত্তিরমশাই ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, ইক্ষুপত্রিকার গুণধরমাহারা এসেছিল, ওই তিনটে পালকির দায়িত্ব নিয়েছে। প্রতি পালকির জন্য ১৮০ টাকা। প্রত্যেক পালকিতে ছজন করে মাহারা থাকবে।

তারপর তামাক,বেনিয়া,টিক্কামার্কা দেশ্লাই,মুড়ি নারকোল দিতে হবে। বিয়ের জন্য পালকি কনের বাড়িতে থাকবে। তার জন্য কিছুটা ধরাট ধরে দিতে হবে। ইক্ষুপত্রিকার বরেনঠাকুর আজকে আসবে। রান্নাবান্নার ব্যাপারটা আলোচনা করে নেওয়া যাবে। তুমিতো এসে গেছ।

ফাল্গুনের ২৭ তারিখ মঙ্গলবার, বাংলা সন ১৩৫৯

সামনে দুটো পালকি দাঁড়িয়ে। লম্বা গোয়ালঘরের বারোজন বেহারা কেউ বসে,কেউ শুয়ে ঘুমুচ্ছে। শাঁখ বেজে উঠলো,মেজোবাবু বরের সাজে তৈরি। একটা পালকিতে তৈজসপত্র উঠলো। ওটাতে আগামীকাল কনেবৌ আসবে। আর একটাতে বর উঠলেন। বেশ কজন বরযাত্রী উঠোনে দাঁড়িয়ে। বেলা দ্বি-প্রহর, এখনই বেরিয়ে পড়ার নির্দেশ দিলেন মিত্তিরমশাই। সন্ধ্যার আগেই লাক্ষীগ্রামে পৌঁছোতে হবে। এবার একটা পালকিতে নিতবর আর বর উঠে বসার পর পালকি কাঁধে তুলে নিল বাহকেরা, উঠোন পেরিয়ে রাস্তায় পা রেখে বেহারাদের কেউ ডাক দিল বাবুর বাড়ির ছেলের বিয়ে হুমনা, হুহুম না...

২৮ শে ফাল্গুন বুধবার, বাংলা সন ১৩৫৯

সকাল সকাল এসে হাজির গুণধর মাহারা। সঙ্গে আরও পাঁচজন মাহারা, সঙ্গে পালকি। মিত্তিরবাবুর মেয়ে নাতিকে নিয়ে যাবে কাঞ্চননগর শ্বশুরবাড়ি, কত্তাবাবুর মেয়ে তৈরি হয়েছিল। পালকিতে একদিকে কিছু জিনিসপত্র টিনের তোরঙ্গ সহ তৈজসপত্র উঠলো, মেয়ে ভবানী কাঁদতে কাঁদতে পালকিতে উঠে বসলো। বাড়ির বড়বৌমার কোলে নতুন শিশুটি পিট পিট করে তাকিয়ে। ভবানীর কোলে শিশুটিকে তুলে দিতে দিতে ব্লললো ঠাকুরঝি, তোমার যাদুকে নাও। কত্তামশাই হাঁকলেন, খাসমহল মাঠে পালকি রাখবি। নতুন বৌমার পালকি ওখানে আসবে। ভবানীর সাথে দেখা হওয়ার পর কাঞ্চননগরের দিকে যাবি। পালকি রওনা দিল দুলকি চালে। পালকিওয়ালাদের ডাক মিলিয়ে গেল আস্তে আস্তে।মাঠ রাস্তা সাঁকো দালান হাট পেরিয়ে একটানা চার মাইল রাস্তা উজিয়ে ছয় বেহারার পালকি হেঁড়্যা পার হয়ে ধ্বজিভাঙা খালের দক্ষিণের খাসমহলের মাঠ ওখানে ভবানীর পালকি দাঁড়ালো। পালকি নামিয়ে কদমগাছের ছায়ায় বেহারার ঘাম মুছতে বসলো। খানিক পরে বেহারারা যে যার মুড়ি পোঁটলা পালকি থেকে নামিয়ে পাশের ডোবায় গিয়ে ঘাটে নেমে মুড়ি পোঁটলা জলে ভেজালো। তারপর নারকেল আর মুড়ি খেতে লাগলো। খানিক পরে লাক্ষীগ্রাম থেকে পালকি দুটো এসে প্রায় পালকির গায়ের কাছে দাঁড়ালো। সদ্য বিবাহিত মেজবাবু আর সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীকে বললো আমার বোন, আর কোলে আমাদের ভাগ্নে জগন্নাথ। ভবানী মুচকি হেসে বললো মাত্র চোদ্দদিন, দেখো বৌদি, তোমাকে কেমন দেখছে। মেজবৌমা বাচ্চাটির দিকে হাত বাড়ালো। ভবানী পুত্রসন্তানকে নববধূর হাতে তুলে দিতে দিতে ব্লললো এই নাও, আজ থেকে এ তোমার বড়ছেলে বৌদি। কিছুক্ষণ পর বরকনের পালকি রওনা দিল বামুনিয়ার দিকে। আর ভবানীর পালকি সপুত্র রওনা দিল শ্বশুরবাড়ি কাঞ্চননগরের দিকে। ঘণ্টা দুয়েক পর পালকি পৌঁছাল বাড়ির কর্তা চন্দ্রমোহন দত্ত বাবুর বাড়িতে। সুব্রত বলে ডাক পাড়লেন কর্তাবাবু। সুব্রত এসে দাঁড়ালো। পাড়ার বৌঝিরা সবাই দৌড়ে এলো নতুন আগন্তুককে দেখবে বলে, কেউ বলে সুব্রতর মতো দেখতে, কেউ বলে ভবানীর মতো কেউ বলে কেষ্টঠাকুরের মতো।

দিন আগেই পাশেই করণবাবুদের জমিদারির উঠোনে সার সার ধানের গাদায় কে বা কারা আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। লোকে বলাবলি করছে তেভাগা আন্দোলনের লোকেরাই নাকি রাতের অন্ধকারে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। সে নিয়ে থানা পুলিশ হয়েছে। গ্রামে পুরুষ মানুষ প্রায় নেই। শীতলা মন্দিরের পাশের মাঠে মিটিং হয়েছে, কোন সমাধান হয়নি। অহেতুক ধরপাকড় চলছে। চন্দ্রমোহনবাবুর কিছু জমিজমা ও ভাগচাষীরা চাষ করে। সুব্রত বাবার সঙ্গে কথা বলে চাষীদের নিয়ে বসে তেভাগার প্রথা মেনে দশ আনা ছআনা হিসেবে ধান ঝাড়াই মাড়াইর পর চাষীদের মধ্যে ধান ভাগ বাঁটোয়ারা করে মরাইতে বাকি ধান উঠেছে। এ নিয়ে পাশের জোতদার পাহাড়ীবাবু,পণ্ডাবাবু,বেরা বাবুদের সঙ্গে একটু কথা চালাচালি হয়েছে। চন্দ্রমোহনবাবুর চিন্তা কদিন পরে নাতির অন্নপ্রাশন। সবাই আসবে তো?

মাস অতিক্রান্ত হওয়ার পর ভরা শ্রাবণে ২রা শ্রাবণ সোমবার ১৩৬০ বহু আত্মীয় পরিজন নিয়ে নাতি শৌভিক এর অন্নপ্রাশন করলেন। চাষের ভরা মরশুম। তবুও চন্দ্রমোহনবাবু নাতির অন্নপ্রাশনের কোন ঘাটতি রাখেন নি। ক্রমে ক্রমে শৌভিককে মা বাবার কোলে বড় করে তুলতে লাগলো। ধীরে ধীরে মা বাবার হাত ধরে হাঁটা, হামাগুড়ি দেওয়া থেকে বাড়ির অন্য কাকিমা জ্যেঠিমা ভাই বোনদের সাথে বড় এক সংসারের শরিক এখন সে। ধীরে ধীরে স্কুলের থেকে শুরু করে স্কুল গণ্ডি পেরিয়ে কখন যে কলেজ থেকে স্নাতক হয়ে গেল সেই কথা ভেবে শৌভিক এখন চোখের সামনে দুটো হাত তুলে উল্টেপাল্টে দেখতে থাকে। এ হাতেই একে একে দাদু,ঠাকুমা,মা, বাবা সকলকেই দাহ করতে হয়েছে। সে যন্ত্রণা ছাপিয়ে, এখন আবার শ্মশান থেকে ফিরে শৌভিক চান শেষ করে ফিরে ঘরে ঢুকে চিতার আগুনের কাঠে পুড়ে যাওয়া হাতটার যন্ত্রণা তাকে ঝলসে দিচ্ছে বুঝতে পারলো। শীতে ঠকঠক্ করে কাঁপতে কাঁপতে ভিজে জামাকাপড় বদলালো। হাতটাতে বার্ণল লাগাতে লাগাতে ভাবলো স্মৃতি ভাগ্যিস জানতে পারেনি। জানলেই দৌড়ে এসে বলতো হাতটা কতটা পুড়েছে বল তো?” স্মৃতি কথা বানিয়ে বলতে চায় না,কথার পিঠে কথা জুড়ে কথার মালায় রোমাঞ্চিত হয় না, রোমাঞ্চিত করে না, তবুও ওর মধ্যে সবটুকু সৌন্দর্য আছে। আমি একদিন ওকে বলেছিলাম স্মৃতি তুমি খুব সুন্দর।” “... তোমার চোখে আমি মৃত্যু পর্যন্ত সুন্দর। কারণ তুমি আমাকে ভালোবাসো। তুমিও সুন্দর। আমি একটু ভেতরে নিজেকে দেখে হেসে নিলাম। আমার গায়ের রঙটা কালো, দেখতে আহামরি না হয়ে অনেকের মতে ছিঃ ছিঃ। আমাকে স্মৃতির সঙ্গে দেখে দেখে অনেকেই ইতিমধ্যে বলে ফেলেছে বাঁদরের গলায় মুক্তোর মালা, কথাটা শুনতে শুনতে এখন আমার আত্মতৃপ্তি হয় অবশ্য স্মৃতি কাছে কাছে থাকলে। এসব স্মৃতিলেখা জানে বোঝে। তাই কখনো স্মৃতিকে আমার সম্বন্ধে মন্তব্য করতে শুনলাম না। স্মৃতি বলেছিল জানো এক একদিন কিছু খেতে ইচ্ছে করে না। নিজে কখনো খাও না খাওনা? নিজের শরীরটাতো নিজে দেখবে। এক কাজ কর তুমি বিয়ে কর।

“... দূর তাই কখনো হয়। আমার স্মৃতির কি হবে। স্মৃতি আমার সবটুকু সত্ত্বা

শৌভিক বললো। “... কেন স্মৃতিকে স্মৃতি করে রাখতে পারবে না। যদি ধরো আমি মরে যাই। তখন...”, “তখন এখন বুঝি না। তুমি এসব কথা বাদ দাও।বিষন্নতায় মলিন হল শৌভিকের মুখ। বললো জানো স্মৃতি সব মৃত্যু বোধহয় সমান নয়, কিছু মৃত্যু থাকে বাতাসের মতো গতিময় শরতের আকাশের পেঁজাতুলোর মতো মেঘ- এক সময় ভেসে ভেসে চলে যায় চোখের নাগালের বাইরে। তারপর মনের থেকে মুছে যায়।

“...কিছু মৃত্যু নাকি বরফের মতো তুষার শুভ্র মস্ত চাঙড় একখানা, তারপর রোদে গলে জলে মিশে জল হয়ে যায়, তারপর সবাই যেমন চলছিল চলছে, তেমন চলবে।স্মৃতি কথাটা বলে চোখে জিজ্ঞাসা আর মজা নিয়ে শৌভিকের দিকে তাকালো।কিছুটা গম্ভীর হয়ে ধরা গলায় শৌভিক বললো না-স্মৃতি, কিছু কিছু মৃত্যু থাকে বিশাল পাহাড়ের মতো মস্ত ভারি, তা আর বুক থেকে নামতে চায় না’, তাই বোধহয় সব্বাই বলে ভালোবাসার কখনো মৃত্যু হয়না...

“...কাব্য শুরু করলে।বলেই চোখ পাকিয়ে তাকালো স্মৃতি। শৌভিক হাসলো, হেসে বললো তুমি তো উৎস হয়ে উঠলে, কেন বললে বিয়ে কর।

“...ব্যাস, আর বলব না তাহলে।স্মৃতি বললো।

স্মৃতি ওরকমই। কখনো কোন কিছু বাড়তে দিতে চায় না। একসময় ঠিক থামিয়ে দেবে। ওর মুখের দিকে তাকালে বুঝতে পারি ওর ভিতরে অনেক কষ্টের প্রতিচ্ছবি মুখ তুলে তাকিয়ে আছে। অথচ মুখে কিছুই বললো না। ওর চোখের তারায় তারায় অনেক কথা চকচক করে ওঠে। কখনো ওর চোখে জল দেখিনি। চুপচাপ কিছু ভাবা ওর সামনে ওর কাছে কষ্টকর স্মৃতি নিজেই ও কথা বহুবার বলেছে। ও নীরবে সব শুনতো আর আমি বলে যাবো কথা অনর্গল ওটাই ও চাইতো। ওকে একটু হালকা করে দিতে আমি বললাম জানো স্মৃতি, তুমি তো পড়াশুনোতে খুব ভালো ছিলে, এখনো তোমার কাজকর্মে তোমার বুদ্ধির প্রশংসা না করে কেউ পারবে না। আমি ততোটা না হলেও জানো আমাদের ছেলে হলে না ... খুব বুদ্ধিমান হবে।

“...আজকাল এইসব ভাবছো, না... স্মৃতি বললো। প্রমোশন পরীক্ষায় কী হ, আগে পাশ করো, বিয়ে হয়ে গেলে আমি কিন্তু এখানে থাকবো না। আর চাকরি ও করতে পারবো না বলে রাখছি।হ্যাঁ, হ্যাঁ, চেষ্টা করছি। স্মৃতির দিকে তাকিয়ে শৌভিক বলল চাকরি করবে না কেন?”

“...কী দরকার তুমি খাওয়াতে পারবে না? মধ্যবিত্ত সুখের নেশা পেয়েছে নাকি? বউ, ছেলে, বউয়ের চাকরি, তারপর ঘর, ঘর সাজাতে, ফ্রিজ, টিভি, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, দুচাকা, চারচাকা, জীবন খুঁজতে জীবন সাজাতে আর একটা অন্য বউ শেষে ডিভোর্স...

‘...কী যে বলো।শৌভিক বললো।

‘...আমি বলি নাকি। তুমি তো বলাও।ঠোঁটে জিভ বুলিয়ে আদরে মুখের শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে একটু হাসলো স্মৃতি, পায়ের উপর একটা পা তুলে পায়ের আংটি ঘোরাতে থাকলো।

দিন স্মৃতি আসে নি। ওর শরীরটা ভালো নেই। ওই বলেছিল কদিন আগে।বাড়িতে অনেক খাটাখাটুনির পর স্মৃতি অফিসে যায়। অফিস থেকে ফিরে বাড়িতে আবার হাজারো ফাইফরমাস খাটতে খাটতে একসময় ও ক্লান্ত হয়ে পড়ে; বুকের যন্ত্রণায় কষ্ট পায়। কাউকে বলেও না কোনদিন। আমি বহুবার জিজ্ঞেস করেছি, স্মৃতি এখনো কষ্ট হয়? তোমার বুকের ব্যাথাটা কেমন আছে? ও এড়িয়ে গেলো না আবার খোলাখুলি তেমন কিছু বললও না। বললো ওসব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। অফিসে যাওয়ার আগে বলে গেছিল ফিরে বাসায় থেকো আমি আসবো। দরজায় টোকায় আওয়াজ পেয়ে শৌভিক ভাবনা ছেড়ে দরজা খুলে দিলে স্মৃতি বললো জানো, দিন ছুটি নিচ্ছি,আসতে পারবো না, কদিন দেখা হবে না, সাবধানে থাকবে, সময় মতো খাবে,সাবধানে থাকবে, আমি... আসছি এ্যাঁ।আমি স্থাণুর মতো বসে শুধু মাথা নাড়লাম; স্মৃতি চলে গেলে ওর চলে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ওর মুখের দিকে তাকাতে সাহস হয়নি, ওর চোখকে আমার ভয়। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে ওর না বলা, ওর মুখের থেকে না শোনা কথাগুলো খুঁজতাম।

স্মৃতি বললো অমন করে কি দেখছো?’

আমি থতমত খেয়ে বললুম না তোমার চোখগুলো খুব সুন্দর।

‘...হ্যাঁ ঐ চোখ দ্যাখো। ঐ রকম চোখে আগুন।স্মৃতি বললো।

‘...আগুনে তো আলো আছে স্মৃতি, আরো আলো, মানে অন্ধকারহীন অনাবিল পবিত্র উজ্জ্বলতা।শৌভিক বললো।

‘...তোমাকে ভুতে পেয়েছে।রেগে উঠে বলেছিল। ‘...মাথায় কি আর কোন চিন্তা নেই?’

স্মৃতি কদিন আসে নি। জানি না কেমন আছে। বুকের কাছটা টনটন করছে। ঘুমচোখে বিছানায় শুয়ে শুয়ে বুকের উপর হাতটা বার কয়েক ঘসে নিল। পাশের বাড়ির শুভদা এসে ডাকল শৌভিক তুই আমার সঙ্গে চল। ঘুম চোখ ছেড়ে বিছানা থেকে উঠে জিজ্ঞেস করলো কোথায়? শুভদা শুধু বললো আয় না।

সামনে মড়াটা কাঁধে করে চারজন। আমি শুভদা আরও অনেকে মড়ার পিছনে হাঁটছিলাম। আমার পা দুটো টলছিল। চোখের জলে ভেজা ঝাপসা দৃষ্টিতে দেখলাম সামনে চলছে মড়ার মিছিল। দুপাশের দোকান থেকে কী বিশ্রী সব ভূতেরা হাত পা নেড়ে আমাকে ধমকাচ্ছে। এসময় স্মৃতি কাছে থাকলে আমি একটুও ভয় পেতাম না। তোমাকে আর চাকরি করতে হবে না। আমার প্রমোশন হয়ে গেছে। তুমি তো আমার কাছে থাকবে। আমাকে আর পায় কে ... তুমি-আমি ... শ্মশানে পৌছে গেছি আমরা সবাই। মড়ার বাড়ির লোকেরা অনেক আগেই এসে গেছিল। চিতা সাজানো হয়েছিল। মড়াকে চিতায় তোলা হল। কাঠ চাপালো মড়ার উপর। সোনা রঙ শরীরে জমে উঠলো কাঠের স্তুপ। জ্যান্ত মানুষ জন্মালে শিশুর কান্না, মায়ের অশ্রু ভেজা চোখে সৃষ্টিসুখের পবিত্রতা, মুখে প্রশান্তি ... শিশুর কান্না - বাবার চোখে মুখে আদর শাসানি - তারপর হাঁটি হাঁটি পা - পা খোকা খুকী বড় হয়। সংসার করে। যৌবন যায়। বার্ধক্য আসে। সাজানো সংসারের মানুষ মৃত্যুর পর মড়া হয়ে যায়। ঐ মড়াটা তো সংসার করে নি। চিতাটা পুড়ে পুড়ে শেষ হয়ে গেল। শুভদা আমার হাতে একটা চেলা কাঠ দিয়ে বললো ওটা চিতায় দিয়ে দে। আমি জিজ্ঞেস করলাম কেন?’ শুভদা বললো নইলে মড়া কাঁধে থেকে যায়। তাই শ্মশানে যারা মড়ার সঙ্গে আসে তাদেরকে চিতায় কাঠ দিতে হয়।আমি চিতায় কাঠ দিতে এগিয়ে গেলাম ... চিতায় কাঠ দিতে দিতে স্মৃতির কথাগুলো ভাবলাম ... স্মৃতি বলেছিল তোমার ঘাড়ে ভূত চেপেছে ... ভাবতে ভাবতে হাসতে গিয়ে অন্যমনস্কতায় আগুনের কাছে হাত ফসকে গেলে হাতে চিতার আগুনের ডেলা ঠিকরে এসে পড়লো। শুভদা দৌড়ে আমার কাছে এলো ... আমাকে ধরলো, ধরে নিয়ে আসার সময় বলতে বলতে এলো, “শৌভিক, তুই কি আগুনে ঝাঁপ দিতে গেছিলি?”

আমি এখন আমার ঘরে বসে একা একা পোড়া হাতটায় বার্ণল লাগালাম, চোখ থেকে কফোঁটা জল পোড়ার জায়গায় পড়লো বুকের ভেতরটা জ্বলে উঠলো কারণ স্মৃতিকে এই মাত্র চিতায় জ্বালিয়ে এলাম।

বিকাশ চন্দ: কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন