রম্যরচনা
২৯/৯/১৯৮৬
সুচাকুরে,সুদর্শন পাত্রের মা বাবা দেখে যাবার সময় বলে গেলেন, " আমাদের তো মেয়েকে খুবই পছন্দ এখন ছেলে এসে যতক্ষণ না হ্যাঁ
বলছে ততক্ষণ ফাইনাল নয়,আমাদের ছেলে আবার
ভারি খুঁতখুঁতে, সহজে কিছু মনে ধরে না"।
সুতরাং
সেই খুঁতখুঁতে যুবকের আগমন প্রতীক্ষায় বাড়ির সবার কেটে গেল আরো প্রায় পনেরো দিন।
ইতিমধ্যে পরমার গ্র্যাজুয়েশন এর ফাইনাল ইয়ারের প্রিপারেশন ও চলছে। আর চলছে নিজের
মনের সাথে নিজের প্রবল সংঘাত।
বিয়ের
পিঁড়িতে বসতে হলে শৌভিকের প্রতি তার যে এখনো একটা প্রবল মানসিক টান আছে সেটার ওপরে
উঠে নিজেকে ভেঙ্গেচুরে আবার নতুন ভাবে বানাতে হবে যে। আকাট মুখ্যু ছেলেটা একবারের
জন্য ও জিনিসটাকে সিরিয়াসলি নিলো না অথচ পরমা জানে ওর ও একটা সফট কর্ণার আছে পরমার
জন্য।
তবে
ওকেও দোষ দিয়ে লাভ নেই। এতো অল্প বয়সে ছেলেরা মোটেই সিরিয়াস হয় না সেটা জানে পরমা।
তবু একবারের জন্যেও গাধাটা খোলসা করে বলতো যদি,
তোকে
ভালবাসি পরমা, তবে তো পরমা সেই পুঁজিটুকু সম্বল করে এই
বিশ্বদুনিয়ার সাথে একাই লড়ে যেত। বাবা মা দের ই বা কি যে এতো তাড়া কে জানে বাবা।
মাঝেমাঝে
মনে হয় রাম গাঁট্টা মারে ব্যাটার মাথায়। আমার প্রতি কিছু নেই
যদি তবে তো অন্য কারো সাথেও তো কিছু করতে পারিস। বাজারে তো সে ইনফরমেশন ও কিছু
নেই। যা ভালো বুঝিস কর বাবা,আমিও এমন সস্তা নই যে
গায়েপড়ে তোকে আগে থেকে ভালবাসি বলতে যাবো। সেটা যদি ভেবে থাকিস তবে কাঁচকলা। আমার
প্রতি তো কতো ছেলেরাই দিবানা, কই আমার তো তোর
প্যাঁচামুখ ছাড়া আর কিচ্ছুতেই কোনো বিকার নেই। তবে বিয়ে যদি করতেই হয় এতো তাড়াতাড়ি
তবে না হয় বাবা মা র ই মনোবাঞ্ছার ষোলকলা পূর্ণ হোক।
ফলে
যথানিয়মে সেই যথানির্দিষ্ট দিনে সেই অভিষ্ঠ খুঁতখুঁতে পাত্রের আগমণ ঘটলো। পরমা
হান্ড্রেড পার্সেন্ট কনফিডেন্ট ছিল যে পছন্দ হবে না সুতরাং ক্যাজুয়ালি একটা শাড়ী
পরে তাদের সামনে গিয়ে বসেছিল। বাবার সাথে রাজনীতি আর মামার সাথে খেলাধুলার বিস্তৃত
আলোচনার সেসনের মাঝে মা আর জেঠিমার ঘটনাবহুল চা জলখাবারের পর্ব ভালোই চলছিল।
ছেলের
সাথে তার দিদি আর জামাইবাবু ও এসেছিলেন। পরমার
ছোট বোন ও বেশ মাঝে মাঝে উচ্চিংড়ের মতো এসে যাত্রাদলের বায়েনের মতো একটা
করে ট্যাং বাজিয়ে যাচ্ছে। পরমাই শুধুমাত্র নির্বিকার হয়ে চুপচাপ বসে আছে সবার
মাঝে।
ছেলেটি
বেশ সুদর্শন আর সপ্রতিভ। হঠাৎ পরমার দিকে তাকিয়ে সরাসরিভাবে প্রশ্ন করলো, আপনি চুপচাপ বসে আছেন যে,
আপনার
এইসব ব্যাপারে কোনো মতামত নেই?
পরমা
বল্ল, রাজনীতি টা আমি চিরকাল ই একটু কম বুঝি
কিন্তু আমি ক্রিকেট,ফুটবলে ইন্টারেষ্টেড। তবে আমার ফেভারিট
হলো সাহিত্য।
পরমার
ঠাকুমা অমনি পাশ থেকে ফস করে বলে উঠলো, পারো আমাদের দারুণ
কবিতা লেখে, দারুণ হাতের কাজ, ও বৌমা একবার দেকাও না সেসব এঁদের।
কি
আশ্চর্যকথা!!! ঠাকুমাদের সেই মান্ধাতা আমলের মানসিকতা আর গেল না। চেনা নেই জানা
নেই যাকে তাকে সে তার কবিতা পড়াতে যাবে কেন?
কিন্তু
নিরুপায় পরমার আয়ত্তের বাইরে এখন পুরোটাই। সুতরাং তার পড়ার টেবিল থেকে তার ব্রাউন
কালারের ডায়েরী টি বোনের হাতে নাচতে নাচতে রঙ্গমঞ্চে বিনা বাধায় হাজির হয়ে গেল।
চিত্তির!!
চিত্তির!!! এইসব কবিতাগুলো তো সব ই ওই হতচ্ছাড়া শৌভিক কে নিয়ে লেখা। পাতার পর পাতা
চোখ বুলিয়ে শ্রীমান খুঁতখুঁতে বললেন, so
nicely expressed. Wonderful pieces of
emotion. এগুলো
সব আপনার নিজের লেখা?
পরমা
ভ্যাঁচার মতো মুখ করে বল্লো,না তো টুকলি মারা।
ওপার থেকে মা কটমট করে চোখ পাকাচ্ছে তাকে এই অহেতুক
প্রগলভ আচরণের জন্য আর পরমা ভাবছে রিজেকশান যখন হবেই তখন বেশ জম্পেশ করেই হোক।
সবাইকে
অবাক করে দিয়ে শ্রীমান খুঁতখুঁতে বল্লেন, আমি একটু পরমার সাথে
পাশের ঘরে একা কথা বলতে পারি?
পাশের
ঘরে মুখোমুখি বসে হ্যান্ডশেকের ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে বল্ল, হ্যালো আমি বৈশাখ।
পরমা হাতজোড় করে
নমস্কারের ভঙ্গিতে হেসে বল্ল, সেটা উত্তাপেই বুঝেছি।
বৈশাখ
বল্ল,
nickname টা
তো বেশ গুন্ডা গুন্ডা। হাত পা ও চলে নাকি মাঝেমধ্যে মুখের মতো?
ফিচেল
পরমা এবার ফর্মে, সেটা লোকবুঝে।
--
হনিমুনে কি পছন্দ আপনার সমুদ্র না পাহাড়?
যা:
ক্কেলো!!! এযে একেবারে মেঘ ডিঙিয়ে বৃষ্টি।
হঠাৎ একটা তীব্র দুষ্টুমি বুদ্ধি মাথার ভেতর কুণ্ডলী পাকিয়ে ওঠে পরমার। তার
বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে শুনলে যা একখানা পচা আমের মতো মুখটা দেখতে লাগবে না শৌভিকের!!!!
চোখের
তারায় রঙ মশাল জ্বালিয়ে সরাসরি বৈশাখের চোখে চোখ রেখে পরমা বলে, আপনার কোনটা? আমার তো কোনোটাতেই আপত্তি নেই।।
৮/৬/১৯৮৭
মফ:স্বল
শহরের মধ্যবিত্ত বাঙালি বাড়ির আ্যারেঞ্জড ম্যারেজ, তাও
আবার এই প্যাচপেচে জষ্ঠির ভরা গরমে সেটাও কিনা আজ থেকে প্রায় আঠাশ বছর আগে। তখন
বিয়ে মানে মাঠে প্যান্ডেল করে লোক খাওয়ানো,
পাশের
বাড়ীর বারান্দায় বা হলঘরে গদি -তাকিয়া পেতে বর বসানো, ঠাকুরের রান্না, নো ক্যাটারার,নো অনুষ্ঠান হল, ওনলি সানাই প্যাঁ পোঁ, প্যাঁ পোঁ এন্ড মাঝে মাঝে ক্যাসেটে "আমার ইচ্ছে করছে
ভালোবাসতে ভালোবাসবোই বাসবো,তোমার মুখ টা কি
সুন্দর আমি বলবোই বলব"।
তবে
পরমার আর্টিস্ট, রুচিশীল বাবার অবশ্য কড়া নির্দেশ যে
ছেঁদো আধুনিক বাজানো চলবে না। তাই সকাল থেকে বিসমিল্লা এক রাউন্ড ফুঁকে যাবার পর
আমাদের জর্জদা, মোহরদি আর সুচিত্রাদদি ব্যাটন টা এখন
হাতে নিয়েছেন। আর মাঝেমাঝে হেমন্ত দাদা সলিল বাবুর সাথে যোগসাজশ করে সুকান্ত বাবুর
কথায় পাখনা মেলছেন।
তখন
এমন রিফাইন্ড অয়েলের যুগ আসেনি তাই বাতাসে ডালডার প্রখর সুবাস। মাসি, পিসি, কাকী, জেঠি, বৌদিরা ছেলেপিলেদের
ভালো জামা পরিয়ে নিজেরাও তাঁত, সিল্ক বা অরগেন্ডিতে
মোহময়ী। মামা, পিসে, জ্যাঠার
দল স্নান সেরে পাজামা, গেঞ্জি সজ্জিত হয়ে
নিজ নিজ স্ত্রীদের কাছে পাঞ্জাবি প্রার্থী। চুল আঁচড়ে, সেন্ট মেখে ছোট ছোট আড্ডার গুলতানি। বিয়ে মানে একটা রিইউনিয়ন।
প্যান্ডেলে
লুচি, আলু চচ্চড়ি আর রসগোল্লার মেনুতে পুরোনো
দিনের হাজার গল্পের সাথে নষ্টালজিয়ার কাসুন্দি মাখানো জিরেন। বর- কনে এখানে গৌণ।
নানা আত্মীয়ের মহামিলন আর হাজার নিয়মাবলীর বিস্তৃত তোলপাড়ই তখনকার দিনে মুখ্য। আর
মুখ্য হাজার মানুষজনের লাখো কিসিমের মন্তব্যাবলীর
শতেক উপাখ্যান।
এরমধ্যে
হৈ হৈ করে গায়ে হলুদের তত্ত্ব ও এসে পড়লো। শাঁখ কই---- শাঁখ কই--- আসুন
আসুন----বসুন, বসুন---- হেঁ, হেঁ, -----আপনাদের আদি
বাড়ি-----ও আচ্ছা, ওপার বাংলা----- আমাদের অবশ্য সব
এপারেই----- হেঁ হেঁ----- মশায়ের কি করা হয়------দে,দে
আরো দুটো রাজভোগ ----- হেঁ হেঁ, খেয়ে দেখুন দাদা আমাদের
বাড়িতে ভিয়েন বসিয়ে কাল রাত্তিরে টাটকা বানানো হয়েছে।
ওদিকে,ওমা কি সুন্দর বেনারসিটার কালার দেখ বৌভাতের----- অনেক শাড়ি
দিয়েছে----- পরমার আমাদের কপাল ভালো ----- ইস কত্তো কসমেটিক্স আর নানা রকমের
মিষ্টি।
ওদিকে
পেয়ারাতলায় বড়ো উনোনে ছ্যাঁক করে রুই বাহিনী ইংলিশ চ্যানেলে অবগাহন করতে নামলেন।
দুপুরের রান্নার তোড়জোড়। ওরে বিল্টু, তোর পিসেমশায়কে বল যারা গায়েহলুদের তত্ত্ব নিয়ে এসেছেন তাঁদের
খেয়ে যাবার জন্য বসাতে। সব রেডি। মাছের কালিয়াটা এই নাবলো বলে।
৮/৬/১৯৮৭(
সন্ধ্যেবেলা)
সেকালে
বিউটি পার্লারের বিল এভাবে মাসকাবারির লিষ্টের সাথে জুড়ে পকেট ধ্বসানোর ঘুরঘুট্টি
চাল চালেনি। গিন্নিরা, মেয়েরা ঘরোয়া
রূপটানেই তিলোত্তমা ছিলেন। দুধে ভেজানো মুসুর ডাল, কাঁচা
হলুদ, মধু,আর ঠাকুরের আসনের
চন্দনের কাঠ স্বমহিমায় দাপিয়ে তাদের
স্নেহময় পরশে তুলে আনতো সুন্দরীদের গালের ঝিলিক।
বিউটিশিয়ান
দিদিদের ও বাড়ির চৌকাঠ পেরিয়ে অন্দরে প্রবেশের
দিন আসেনি। তাই কিছু অতি অভিজ্ঞা দিদি আর বৌদির তত্ত্বাবধানে পরমার বধূসাজ
শুরু হলো দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে না হতেই। একে জষ্ঠিমাসের প্রবল উত্তাপ তাহে সূয্যিমামা সারাদিনের
ক্যারদানি মেরে সবে নিভুনিভু হয়েছেন। তা
সেকালে তো আর এসি টেসির জমানা ছিল না, সুতরাং উদ্যোগী
সাজবিশারদরা যতো স্নো পাউডারের পোঁচ মারেন তেএঁটে গ্রীষ্ম ততই ফক্কুড়ি মেরে
ঘামিয়ে ধুইয়ে মুছিয়ে দেয়।
এইভাবে
বেশ কয়েক ঘন্টা পাঁয়তারা কষবার পর যখন মোটামুটি পরমার সুশ্রী মুখখানিকে শ্যাওড়া
গাছের শ্যামাসখীর মতো বানানো গেলো তখন সে দিদিবৌদিদের নিপুণ হস্তকলার হাত থেকে
মুক্তি পেলো।
ততক্ষনে
সন্ধ্যে ঘনিয়েছে------ বাতাসে সুখাদ্যের সুবাস ছড়িয়েছে-----+ঘরে ঘরে আয়নার সামনে
লাইন লেগেছে----- কান্তা সেন্ট------হিমানী স্নো----- ট্যালকম পাউডার----+ লিপ
গ্লস----আইলাইনার----কাজল পেন্সিল----কাঁটা ক্লিপ ----মরিয়া হয়ে ঘুরছে এহাত
ওহাত---- ও বৌদি আমার চুল টা একটু বেঁধে দাও না---- এ্যাই আমার জন্য রাখিস কিন্তু
একটা গোলাপ, খোঁপায় লাগাবো--- এ্যাই এ্যাই তোরা
ঢুকছিস কেন এখানে, যা যা সবাই শাড়ী পরছে---- ব্যর্থ মামাতো
ভাইটি শুধু একটি নিষ্পাপ চিরুনির খোঁজে এসে হতাশ হয়ে ফিরে গেল।
মেয়েদের
রূপসী হবার দাপটে ছেলেরা কোণঠাসা। কোনোমতে
আয়না ছাড়াই চুল আঁচড়িয়ে আর সেন্ট মেখে জামাজুতো পরে রেডি। কিছু অসীম সাহসী দাদা-
কাকা- জামাইবাবু অবশ্য কাঁধে তোয়ালে আর হাতে মগ নিয়ে ফাঁকা বাথরুম খুঁজছেন
ফাঁকতালে দাড়িটা কামিয়ে যদি oldspice মেখে কিঞ্চিৎ মাঞ্জা
দেবার সুযোগ ঘটে।
এমা,সানাই টা এখনো লাগায় নি। দে, দে
ক্যাসেট টা চালিয়ে, সুতরাং প্যাঁ ওওওওওপোঁ জুড়ে গেল
রজনীগন্ধার মধুর সুবাসের সাথে কারণ তখন হাইব্রিডের যুগ আসেনি বলে সেকালের
রজনীগন্ধারা গন্ধের মামলায় সেণ্ট পার্সেণ্ট জেনুইন ছিল।
কে
জানে বর কদ্দুর এলো?? দায়িত্বশীল বড় মামা
আর জ্যাঠামশাইএর কপালে কুঞ্চন। এতো আর আজকালকার
মতো ফোনাফুনির দিনকাল নয় যে মিনিটে
মিনিটে ট্র্যাক করা যাবে---- যাক বাবা ভারি ভয় ছিল জষ্টীমাস ----কোনো ঝড়বিষ্টি
আসেনি---- দূগগা বলে চারহাত এক করে দিতে পারলেই
হয়।
সেকালের
সংসার চিত্রে কন্যাদায় এক যৌথ উদ্যোগ। একা
শুধু বাবা মা নয়,জেঠিমা, কাকিমা, মামা, মাসি, পিসি, জ্যাঠা, কাকা, মেসোমশায়, দিদি, জামাইবাবু সবাই ব্যস্ত,সবাই যুক্ত, সবাই চিন্তিত। মেয়ে বাড়ির মেয়ে, কাজ
টা বাড়ির সবার কাজ।
এ্যাই
বিশু, বেশি ফান্টুসি মেরে না ঘুরে
ক্যাম্পাকোলার বোতলগুলো সব বরফের ড্রামে ঢুকিয়ে রাখ ঠিকঠাক----তা দাদা বর যাত্রী
কতজন?----- তাদের জলখাবারের ডিস পত্তর সব ধুয়ে মুছে
রেডি আছে তো? ----- বরের বাবা অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি কোনো
দাবিদাওয়া নেই--- তাঁদের আপ্যায়নে যেন বিন্দুমাত্র ত্রুটি না ঘটে--- বর যাত্রীদের
জলখাবারের পাঠ টা এদিকে চুকে গেলে ওদিকে ব্যাচ বসাতে শুরু করে দিও----- মাংস টা
খেয়াল রেখো একটু ---- হারু অবশ্য আমাদের পাকা রাঁধুনি।
মেজোকাকিমা বিয়ের জায়গাটায় দারুণ আলপনা দিয়েছে--- ছিরি টা
কে বানিয়েছে রে রীণাবৌদি না? দারুণ হাতের কাজ---
এ্যাই শয্যাতুলুনি তে কিন্তু মোটা টাকা চাইতে হবে জামাইবাবুর কাছে--- তোর লিপষ্টিক
টা একটু ধ্যেবড়ে গেছে দে ঠিক করে দি----- উফ বাবা যা গরম----- এ্যাই আমার কানপাশা
টা কি চেপে বসে গেছে ---- দে না একটু ঠিক করে,
দেখিস
খোঁপা টা না খুলে যায়---- বরের দুচারটে সুন্দর ভাই বা বন্ধু আসলে ভাল জমে যাবে
বাসর বল?-------- হাহা হা হা ----এই ক্যামেরা কে কে এনেছে
রে?
----- বুবলা
দা, হীরেন জামাইবাবু আর রাণাদা------- চল চল
রাণাদা বলে দুটো ফটো তুলি এইবেলা।
এ্যাই
বর এসেছে,বর এসেছে। সেলোটেপ দিয়ে লাল গোলাপ
সাঁটানো সাদা এ্যাম্বাসেডর থেকে নেমে দাঁড়ালো ছয় ফুট দু ইঞ্চি লম্বা, গৌরবর্ণ,স্লিম, প্রশস্ত ললাট, কোঁকড়ানো চুল, উজ্জ্বল চোখ এক
অনিন্দ্যকান্তি যুবক। বর দেখে তো সবাই বিশেষত শালী কূল একেবারে অভিভূত। চারিদিকে
ইস কি দারুণ!! ইস কি দারুণ!!!! শুনে মাসল বাগানো বরের বুঝিবা একটু পায়া ভারি হয়ে
যায়।।
যথানিয়মে
বরণ ইত্যাদি নিয়মকানুন সাঙ্গ হবার পর সবার বসার আয়োজন হলো। বরের বোন আর ভগ্নিপতি গাড়ী থেকে নেমেই পড়িমড়ি করে ছুটল
তাদের বছর খানেকের ছোট ছেলেটির দুধ গোলার জন্য গরম জলের সন্ধানে। সে বেরসিক তখন চিলচিৎকার জুড়েছে ক্ষিদেয়।বাকিরা
সবাই হৈ হৈ করে বৌ দেখতে ছুটলো।
বধুটি
খুব একটা সলজ্জ টাইপ নয় বরং বেশ চঞ্চল ও সপ্রতিভ। সে উঠে দাঁড়িয়ে এসো এসো করে সব
বর যাত্রীদের সাদর অভ্যর্থনা করে বসালো। এযুগে এটাকে সবাই স্বাভাবিক ভাবলেও সেযুগে
একটু অহেতুক লজ্জা পাওয়াটাই রীতি ছিল।
বরযাত্রীদের
যথাবিহিত আদর আপ্যায়নের পর পুরুত মশাই নাকে দু টিপ নস্যি লাগিয়ে হাঁকলেন, নিন এবার বর কে
ছাঁদনাতলায় আনুন।
ওদিকে
মাঠে খাবার প্যান্ডেলে তখন ফার্স্ট ব্যাচ ষ্টার্ট হয়েছে। সে তো আর এখনকার মতো welcome drinks এবং starter এর
যুগ নয়। সোজাসুজি একেবারে মেনকোর্সে হামলে পড়া---- কাঠের টেবিলের ওপর
সামান্য জল ছিটিয়ে সাদা কাগজের রোল পেতে তার ওপর কলাপাতা------ পাশের মাটির খুরি
মাংস দেবার জন্য আর জল দেবার জন্য মাটির গ্লাস।
মুকুজ্জেবাবুর
ছেলে বিনু নুন আর লেবু দিয়ে গেল---------ধপাধপ অনশন রত নেতার মতো পাতে শুয়ে পড়লো
বোঁটাশুদ্ধু ভাজা বেগুন--- --- একপাশে গুটিসুটি মেরে নিপীড়িত খনি শ্রমিকের
মতো সামান্য শাক ভাজা---- -----এত
ভালোমন্দের মাঝে কেউ খায় না তবু দেওয়াটা নাকি রীতি-------+আহা বাতাসে ম ম গন্ধ
ছড়িয়ে লুচি এসে গেল--- ---পাশে নারকেল কোরা দিয়ে ছোলার ডাল-------নিন লাহিড়ীদা
শুরু করুন----- ---- হ্যাঁ রে সমু, মাছ না মাংস নাকি
দুটোই ???? ----তখন তো আর মেনুকার্ডের দিন আসেনি, তাই মেনু আগে থেকে জানা যেত না।
এইসব
ডায়েটিং আর ফুড কন্ট্রোল এর যুগ ও নয়----- যারা পেট চিরে খেয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে
প্রাণটাকে কোন মতে গলায় বেঁধে বাড়ি ফিরবেন তারা মেন আইটেম গুলোর ওপর অর্জুনের মতো
তাগ করেই বিয়েবাড়ি আসতেন। তাই জোগাড়
যথেষ্ট বেশি রাখতে হতো। কে কতোটা টানবে
আগে থেকে বোঝা মুশকিল।
এই
সব বিয়ে বাড়িতে তখনকার দিনে গিনিস রেকর্ড তৈরি হতো------ --- হেঁ হেঁ মনে আছে
মিহির,
সেবার
প্রশান্তবাবুর ছোটখোকার বিয়েতে আমি দুকেজি মাংস খাবার পর বাহাত্তর টা রাজভোগ
খেয়েছিলুম-------শেষে ওনার বেহাইমশাই নিজে এসে পেড়াপিড়ি করায় বাধ্য হয়ে দুকেজি দই
ও খেতে হলো------এই জেরে শান্তিপুরের কাঁচাগোল্লাটুকু দশ খানার বেশি আর খাওয়া হলো
না---- সে আফসোস আমার সারাজীবনে যাবে না।
ও
মেজ পিসিমা, ঠাকুর মশাই কনে কে এবার যে ছাঁদনাতলায়
আনতে বলছেন গো? সুতরাং মামাতো, জ্যাঠতুতো ভাইদের সাহায্যে পিঁড়িতে চেপে পান পাতায় মুখ ঢেকে
কনের বিবাহ মঞ্চে প্রবেশ। বাড়ির বাগানের
একপাশটা সাফ করে বিয়ের জায়গা বানানো হয়েছে।
ভাই
রা বোঁ বোঁ করে ঘোরাচ্ছে পিঁড়িশুদ্ধু তাকে। সাতবার ঘোরাবার পর বর বড়ো না কনে বড়ো? মেয়ের বাড়ির লোকেরা
মেয়েকে যত উঁচু করে, বরের বাড়ির লোকেরা বরকেও তত কোলে নিয়ে
ওপরে ওঠায়।
হঠাৎ
পরমা দেখে বাগানের একটা ঝুলন্ত আমগাছের ডালে বৈশাখের মাথাটা প্রায় ধাক্কা লাগার
জোগাড়,
কারো
হুশ নেই এইসব মজার দাপটে। সে তাড়াতাড়ি পানপাতা টাতা ফেলে দিয়ে দুহাতের তেলো দিয়ে
হুমড়ে পড়ে বৈশাখের মাথাটা গার্ড করে।
ঘটনার
আকস্মিকতায় পরমার দিকে চকিতে চোখ তুলে
তাকায় বৈশাখ। সোজাসুজি তাকায় পরমাও। ------সবার অলক্ষ্যে দুজনের শুভদৃষ্টি হয়ে যায়!!!!! কি ছিল সেই
দৃষ্টিতে!!!!!! কি নিবিড় শিহরণ!!!!!
চিন্তা নেই!!!!! আজ থেকে তুমি আমার পরম আপন জন----- তোমার সব সুখ
আমার------ তোমার সব বেদনা আমার-----
তোমার প্রাণ আমার কাছে নিজের প্রাণের চেয়েও দামী -----+সব বিপদ আপদে আজ
থেকে আমি আছি তোমার পাশে --------তোমার জন্য
নিজের সব টুকু বাজী রেখে ----------চিরদিন তোমার অনন্ত মঙ্গল কামনায়।।
বিবাহ
ডায়েরি -৫
একজন
ঠোটকাটা মামাতো দিদি ফোড়ন কেটে উঠলেন, বাব্বা, বিয়ে না হতেই এত্তো দরদ? দরদ কোথায়? এটা তো একটা স্বত:স্ফূর্ত অভিব্যক্তি। হ্যাঁ, পরমা ঠিক এমনটাই। সে
খুব স্পষ্ট আর স্বচ্ছ। তার তাৎক্ষনিক বুদ্ধি যা বলে সে তাই করে। তাতে তার কোনো
লুকোছাপা বা জড়তা নেই।
তার
কাছে আবেগ বড়বেশি প্রধান। যেখানে আবেগের সায় নেই, সেখানে আপনাআপনি তার সম্পর্কের সুতো ছিঁড়ে যায়। এই যে সে একবার
শৌভিকের থেকে নিজের আবেগের অভিমুখ পরিবর্তন করে নতুন দিশায় পাল বাঁধলো আর সে
সেদিকে মোটেও ফিরবে না। এটাই তার নীতি।
কারণ
সে মানে, প্রতিটি সম্পর্কের ক্ষেত্রেই বিশ্বস্ততা
হল এগিয়ে যাবার মুখ্য সোপান। যে দুটি মানুষের মাঝখানে বিশ্বস্ততা নেই, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ নেই,
সহানুভূতির
বাড়িয়ে দেওয়া হাত নেই, স্বচ্ছ,দাবীহীন বন্ধুত্ব নেই তাদের মাঝখানে প্রেম কেন কোনো সম্পর্ক ই
দানা বাঁধে না। শুধু দিনাতিপাতের দায় বহন
করে অযথা কালক্ষয় করে সেসব সম্পর্ক।
বিশেষত
আ্যারেঞ্জড ম্যারেজের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ দুটি অচেনা মানুষ, একেবারে অচেনা দুটি পরিবার।
বড় যত্নে লালন করা দরকার। শুধু দুটি হৃদয়ের বন্ধন তো নয়, দুটি পরিবারের মধ্যে
বন্ধন। এক্ষেত্রে শুধু একজনের প্রতি একজনের প্রেমের পরিসর বড়ো গৌণ। সবার মাঝখানে
নিজেকে মেলে ধরা, সবার প্রিয় হওয়া। তাই বিবাহ একটি
গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।একটি যৌথ উদ্যোগ।
তার
পরিবারের সবাইকে ভালবেসে ভালবাসার মানুষটির মন জিতে নেওয়া। নইলে যে পরস্পরের
ভালবাসার ভিত মজবুত হয় না। প্রাথমিক শারিরীক আকর্ষনের দিন গুলি পেরিয়ে গেলে
তখন শুধুমাত্র তুচ্ছ স্বার্থের সম্পর্ক নখ দাঁত কঙ্কাল বার
করে নগ্ন হয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। দিন যাপন বড় ভারি হয়ে ওঠে তখন দুজনের মাঝে।
এদিকে
সময়ের তালে তালে পরমার বিয়ের অনুষ্ঠানধারা
এগিয়ে যায় নিজের গতিতে-----------আজ তোমার হৃদয় যেখানে আমার হৃদয় সেখানে------
হোমের আগুনে পুড়ে যায় পুরোনো জীবন------ শুরু হয় নতুনের দিকে যাত্রা।
গরমে
ঘেমে নেয়ে বিপর্যস্ত নব দম্পতিকে একটু স্বস্তি দেবার জন্য পেছন থেকে তৎপর হয় তাল
পাতার পাখাবাহিনী। শেষটায় মাথা আর মুখ ভরা একগাদা সিঁদুর মেখে পরমাকে যখন আর
কালিপূজোর বলির পাঁঠার চেয়ে আলাদা কিছু ভাবা যাচ্ছে না তখন অনুষ্ঠানের যাঁতাকল
থেকে মুক্তি।।
৯/৬/১৯৮৭
বাপ
রে বাপ!! যথেষ্ট হয়েছে।এবার এই যাত্রাপালার সাজপোশাক ছেড়ে হালকা হতে পারলেই
বাঁচি----- ওরে পাগল মেয়ে চল্লি কোথায়???-----
এখন
থেকে আর যে আলাদা আলাদা হবে না---- এক গাঁটছড়াতে দুজনে বাঁধা পড়েছিস যে-----
সপ্তপদীর মানে বুঝিস???------ সাত জনমের ডোর-----
এড়াতে চাইলেই কি আর মুক্তি পাবি রে এখন???
বাসরের
হাজার কলরবের মাঝে কখন যে একপাশে ঘুমিয়ে পড়েছিল পরমা। ঘুম ভাঙলে দেখে সবাই নিজের
নিজের জায়গা খুঁজে ঘুমন্ত। কিন্তু বৈশাখকে
তো কোথাও দেখা যাচ্ছে না। তার হাতে গাঁটছড়া গছিয়ে দিয়ে সে আবার কেটে পড়লো কোথায়????গেছে হয়ত কোথাও এদিকওদিক। যাক বাবা এবার স্নান টান সেরে ফ্রেশ
হয়ে নিই একটু। কাল সারাদিন যা গেছে।
পরমাদের
বাড়ি বেশ বড়। ওপর নীচ মিলিয়ে অনেকগুলো ঘর, বারান্দা। স্নান সেরে
আবার নতুন একটা শাড়ী পরে সেজেগুজে বাসরের ঘরটায় ফিরে পরমা দেখে ডেকোরেটার্সের
লোকেরা শতরঞ্চি গোছাচ্ছে।
সবাই
গেল কোথায় তাহলে। ভেতরের বারান্দায় জ্যাঠা,
কাকা,মামা,পিসেমশায়দের দল
ততক্ষনে চা নিয়ে গল্প জুড়েছে নিজেদের মধ্যে। বিয়ে বাড়ীর টুনি বালবের আলোক মালাও
আস্তে আস্তে নেভানো হচ্ছে। মেয়ের বিয়ে এক রাত্তিরের মামলা। এক ঘরে বাতি
নিভিয়ে আর এক ঘর আলো করতে তাদের যাত্রা।
গুটি
গুটি পায়ে ছাতে ওঠে পরমা। ছাতে টবে টবে বাবার সাধের গাছেরা ভোরের হাসি আর মিষ্টি
সুবাস ছড়িয়েছে। বেলি, গন্ধরাজ, রঙ্গন আর নানা রঙের
গোলাপের মাঝে ও কে??
সাদা আদ্দির পাঞ্জাবি পরা, সদ্যস্নাত ঝকঝকে একটি
অপরূপ যুবা।।।। রাজ্যের ছোট -বড় সবাই
এক দঙ্গল বসে আছে ছাতের মেঝেয় শতরঞ্চি পেতে আর সে কাঠের চেয়ারে বসে অর্ধনিমীলিত
চোখে গাইছে,
"হয়তো
তোমারি জন্য, হয়েছি প্রেমে যে বন্য, জানি তুমি অনন্য,আশায় হাত
বাড়াই"।
বা:
দারুণ গলা তো!!!!! ছুপা রুস্তম!!!! নট ব্যাড!!!!!!! আজ থেকে এই পুরুষ আমার, শুধু আমার একার, পরমার যেন বিশ্বাসই
হতে চায় না।।
দুপুরের
খাওয়া দাওয়ার পর বিদায়ের সাজ শুরু হলো। পরমার বুকের ভেতর কি অদ্ভুত এক বিচ্ছেদের
বিহ্বল সুর। কেন মেয়েদেরই শুধু পুরোনো সব ছেড়ে আবার নতুন দুনিয়ায় রোপণ করে নিতে হয়
তার স্বপ্নের ভ্রুণ।
আশীর্বাদের
অনুষ্ঠানের সাথে সাথে চলে বিদায়ী কান্নার নানা তালে তবলা লহরা। এই কান্না বস্তুটি
হলো ভারি ছোঁয়াচে রোগ। একের সাথে অনেকে তাল মেলালে যেন মহামারীর আকার ধারণ
করে।কখনো ফ্যাঁচ-ফ্যাঁচ, কখনো ভেউ-ভেউ, কখনো হুঁ-হুঁ। বাপরে
বাপ। কান্নার প্রবল তাড়নায় পাশে বসা নতুন বরটির বোধকরি নিজেকে প্রবল পাষণ্ড কিংবা
জল্লাদ মনে হতে থাকে যে কিনা একটি নিরুপায় রাজকন্যেকে জোর করে তার প্রিয়জনদের কাছ
থেকে লুঠ করে নিয়ে যেতে চাইছে।
তার
ও মনটা কেমন যেন ভারি হয়ে ওঠে। হঠাৎ সে পার্শ্ববর্তী একজন মামিমাকে ডেকে বলে, আহা ও এত কান্নাকাটি করছে আজকের দিনটা না হয় আপনাদের সাথেই
থাক। আমি বাড়ি চলে যাই, কাল আপনারা যখন
আমাদের বাড়ি কনেযাত্রী যাবেন ওকেও সাথে করে তখন নিয়ে যাবেন। সহৃদয় বরের কথা শুনে
পরমা বেশ উৎফুল্ল হয়ে নিমেষে চোখের জল মুছে ফেলে। যাক, আজ তবে আর যেতে হবে না।
কিন্তু
কি আশ্চর্য, সবাইকে অবাক করে দিয়ে তার নিজের মা’ই বলে ওঠেন,ওমা, সেকি কথা, তা আবার হয় নাকি? মেয়ে আজই যাবে বাবা
তোমার সাথে। কই ঠাকুমা বা দাদু ও তো আর তার হয়ে মায়ের বিরুদ্ধে গেলো না। ভারি
অভিমান হয় পরমার। বিয়েটা জিনিসটা কি এমন আহামরি ব্যাপার যে সবাই এত চেঞ্জ হয়ে গেল
একদিনেই।
বেশ
তাই হবে। আজ থেকে ওই অচেনা ছেলেটার সাথেই তার নতুন পথে চলা শুরু হোক। সেখানে
স্নেহময়ী ঠাকুমা নেই, কথায় কথায় তার হয়ে
বাবা মার শাসনের বিরুদ্ধে ওকালতি করার ডার্লিং দাদু নেই, তবু এই রুক্ষ মাটিতেই তার ভালোবাসার চারাগাছটিকে একদিন সে
পুষ্পিত করে তুলবেই। হেরে যাবার মেয়ে সে কোনোকালেই নয়।আজ থেকে এটাই তার চ্যালেঞ্জ।
না দেখা,
না
চেনা একটা শহরে একটা অচেনা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় তাদের গাড়ী। ওহ, আজ থেকে তাহলে এটাই তার বাড়ি??? এইসব
মানুষজনেরাই তার আপনজন??
বরণ
করে নামানো হয় তাকে। কাঁখে দিয়ে দেওয়া হয় পিতলের ঘড়ায় জল। বাঁহাতে একটা রুমালে
ল্যাঠা মাছ কে মুড়িয়ে বলা হয় শক্ত করে চেপে ধরো দিকি নতুন বৌ। পায়ের কাছে দুধ আর
আলতা গুলে তাতে পা ডুবিয়ে পেতে রাখা লাল পেড়ে শাড়ীর ওপর দিয়ে হেঁটে বধূর প্রথম গৃহ
প্রবেশ। চঞ্চল পরমা একটুও ভুলভাল না করে
ঠিকঠাক সেরে ফেলে সবকটি নির্দেশ। রান্নাঘরে
গ্যাসের জ্বালে ডেকচিতে উথলিয়ে ওঠে দুধ।
সামগ্রিক
উলুধ্বনি আর শঙখের আওয়াজে মুখরিত সন্ধ্যায় আজ তার নব জীবনের সূচনা।একটু আগে কোথাও
বুঝিবা বৃষ্টি হলো। এক ফোঁটা দুফোঁটা এখানেও ঝরে পড়তে শুরু হয় । ভারি সুন্দর একটা
মিষ্টি হাওয়া আর মাটির সোঁদা গন্ধে ছেয়ে যায় চারদিক। একজন ভারি বিজ্ঞ বয়স্কা কেউ
বলে ওঠেন, যাক বউমার আমাদের লক্ষণ ভালো, সাথে করে বিষ্টি নিয়ে
এলো।।
৯/৬/১৯৮৭(
সন্ধেবেলা)
আজ
রাত্রি কালরাত্রি। আজ বউয়ের মুখ দেখবে না বর। কিন্তু তাতে পরমার কি? বাড়িতে যেমন সব ছোট ভাই বোনদের দলপতি ছিল সে। সব্বাই দিদিভাই
বলতে এক্কেবারে অজ্ঞান। এখানেও দুতিন ঘন্টার মধ্যে সে বেশ একটা ফিল্ড বানিয়ে ফেলেছে সে। নন্দাইদের বড়দা, মেজদা,ছোড়দা, ননদদের ও তেমনি নামকরণ,
পিসি, মাসি, মামী এমনকি বরের
বন্ধুদের সাথেও বেশ ভাব জমিয়ে ফেলেছে। তার স্বভাবে অকারণ জড়তা বরাবরই কম।
তাকে
ঘিরে ভেতরকার বেডরুমে ছোটদের নাচ, বড়দের গান, আবৃত্তি ঘিরে আসর একেবারে জমজমাট। ওদিকে বৈশাখ নির্বাসিত
হলদিঘাটের যুদ্ধে পরাস্ত রাণা প্রতাপের মতো অন্যঘরে শুকনো মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
হঠাৎ কোত্থেকে কে একজন পাড়ার বৌদিকে ধরে এনে সে পরমার সাথে পরিচয় করাবার অছিলায়
সেই নিষিদ্ধ ঘরে ঢুকে পড়ে।
সাথে
সাথে তার ই কোনো এক হাড়বজ্জাত বন্ধু টিপ্পনী কেটে ওঠে, এই পরিচয়টা বোধহয় কাল করালেও চলতো রে বৈশাখ। কটমট করে
তাকিয়ে প্রায় তাকে ভস্ম করে দেবার মতো চোখে তার দিকে তাকায় সে। অনন্ত বিভীষণ
বৌদিটিও সেই অলপ্পেয়ে বন্ধুটিকে সমর্থন করে বলে ওঠেন, আমিও তো সেকথাই বলেছিলাম ভাই, কিন্তু
বৈশাখদা কিছুতেই শুনলেন না।
সবাই
হো হো করে হেসে ওঠায় ভারি অপ্রতিভ হয়ে যায় বৈশাখ। শেষে তার প্রতি নিতান্ত
করুণাপরবশ হয়ে জনআদালতে এই বিল পাশ হয় যে বৈশাখ ওই ঘরে বসতে পারবে কিন্তু বউয়ের
দিকে পেছন ফিরে যাতে তার মুখ দেখা না যায়। বৈশাখ একেবারে নির্ভেজাল বাধ্য ছেলের
মতো সেভাবেই বসে।
হঠাৎ
গান শুনতে শুনতে পরমার চোখ পড়ে সামনের আয়নার দিকে।। বৈশাখ ওদিক দিয়ে দিব্যি তার
দিকে যে তাকিয়ে আছে। এতক্ষণ সে একবার ও
সেটা খেয়াল ই করেনি।।। ওহো তবে এই ছিল তোর ঘটে!!!!!! বাদবাকি লোক খেলো ঘোলা জল
তুমি বেশ চালু বটে।। ফিক করে হেসে ফেলে পরমা।
লজ্জায় অপ্রতিভ হয়ে যায় সে ধরা পড়ে গিয়ে।
পরদিন
সকাল থেকেই বৌভাতের তোড়জোড়। দুপুরে বউ এর হাতে ভাতের থালা আর শাড়ী তুলে দিয়ে বর
বলবে, আজ থেকে তোমার ভাত- কাপড়ের দায়িত্ব
আমার। মানে fooding,lodging and overall
maintenance এর
agreement একেবারে পাক্কা। আচ্ছা, বিনিময়ে তার কি কি
করণীয় সেকথা তো বলে কয়ে নেওয়া হলো না। তবে পুরো ব্যাপারটাই মিউচুয়াল ফান্ডের rules and regulations এর মতো। মানে কিনা bond value is changeable according to the market
risks.
সবাইকে
আজ পায়েস রেঁধে খাওয়াবার দায়িত্ব নতুন বৌয়ের। কিন্তু পরমা যা রন্ধনপটিয়সী জীবনে
একগ্লাস জল গড়িয়ে খেতে গেলেও ঠাকুমা এগিয়ে এসে হাতে জোগান দিয়েছেন এতকাল। পায়েস
রেঁধে খাওয়াবার প্রস্তাবে তো তার গলা শুকিয়ে কাঠ। শেষটায় তার বড়ো ননদ মূর্তিমতী
পরিত্রাতার ভূমিকায় আবির্ভূতা হয়ে তাকে অভয় দান করেন। তার চিন্তান্বিত মুখ দেখে বলেন, চিন্তা নেই, আমি সাথে আছি, সব করে দেব, তুমি শুধু নেড়ে দিও
মাঝেমাঝে।
আজ
সবার পাতে খাবার দেবে নতুন বৌ। বধূ মানে অন্নপূর্ণা, গৃহের
সকলের মঙ্গলস্বরূপা। তার স্বভাবগত সৌন্দর্য ও ভালবাসায় আঁচে বাঁচে গৃহের শ্রী, সুখ আর সমৃদ্ধি। এই শ্রীময়ী হয়ে উঠতে গেলে সবার মাঝে একটু নিজের বিস্তার লাগে যে। পরমা
ভাবে সেই ছেলেমানুষির দিন গুলি এবার ফুরালো
বুঝি, সে কি পারবে তার স্বভাবগত ভালবাসা দিয়ে
সবার মন জয় করে নিতে???।।
১০/৬/১৯৮৭
আজ
ফুলশয্যা। ফুলের বাসরে বর ও বধূর প্রথম
একান্ত মিলন। আজকের সন্ধ্যা বড় সুন্দর, বড় স্বপ্নময়। এই
সন্ধ্যার গায়ে কি আলাদা কিছু গন্ধ মাখানো থাকে? জানিনা।। তবে এই
সন্ধ্যা এত মদির কেন?? এতো অপেক্ষার কেন??? কেন নানারঙের জামদানি কারুকাজ এই সন্ধ্যার গায়ে গায়ে??
নিয়মমাফিক
অতিথি আগমণ ও আপ্যায়নের পালা চুকলে নিজস্ব বেডরুমে ঢোকে বৈশাখ। সামনে ফুলের মশারির
ভেতর চাদরের ওপর গোলাপের পাপড়ি দিয়ে রঙ্গোলি আঁকা আর তার উপর একগলা ঘোমটাপরা পরমা।
ঘরের আলো ঈষৎ নিষ্প্রভ আর স্বপ্নঘোর নীলাভ।
ঠিক একেবারে আজকের সিচ্যুয়েশানের সাথে পার্ফেক্ট ম্যাচিং।
ঘরে
ঢুকে ছিটকিনি লাগিয়ে ফুলের মশারি তুলে ভেতরে আসে বৈশাখ। কিছুটা দুরত্ব রেখে
বসে তার পাশে। বলে, তোমার শরীর ঠিক আছে তো পরমা, নতুন জায়গা, নতুন সব
মানুষজন। কিছু অসুবিধে হলে নির্দ্বিধায়
আমাকে বোলো তুমি।
বধূটি
ঘোমটাশুদ্ধু ঈষৎ ঘাড় হেলিয়ে সম্মতি জানায়।
বৈশাখ
বলে, কি অদ্ভুত ব্যাপার দ্যাখো, মাত্র কয়েকদিনের পরিচয় তবু তোমাকে আমার মনে হচ্ছে কতো আপন। কি
কোনো উত্তর দিচ্ছ না যে? তুমি কি এতটাই লাজুক? অথচ যেদিন তোমাদের বাড়ি গেছিলাম তোমাকে দেখতে সেদিন তো তুমি
কতো ইজি ছিলে। তবে আজ কেন এত লজ্জা পাচ্ছ?
বধূটি
চূড়ির রিনরিন শব্দ করে আর ঘোমটার আড়ালে মাথা নাড়ায় অল্প অল্প।
তোমার
বন্ধুদের কাছে আজকের রাত সম্বন্ধে নানাধরনের গল্প শুনে শুনে তুমি বোধহয় অযথা টেনশনে পড়ে গেছো? কিছু ভয় নেই আজ থেকে
তুমি আর আমি সবচাইতে কাছের বন্ধু দুজন দুজনের। নাও এবার গাঁয়ের বধূর মতো একগলা
ঘোমটা টেনে বসে না থেকে ঘোমটা খুলে
স্বাভাবিক হয়ে বসো দেখি। এই গরমে কি করে মুড়িশুড়ি দিয়ে এভাবে বসে আছো?
বৈশাখ
এবার নিজের পাঞ্জাবির পকেট থেকে আংটির বাক্সটা বার করে বলে, দাও তো তোমার হাতটা।
বেনারসির
ভেতর থেকে অগত্যা বাধ্য হয়ে বেরিয়ে আসে একটি হাত। আঙুলে আঙটি পরাতে গিয়ে হাতটা
হাতের ওপর নিয়ে কেমন যেন খটকা লাগে
বৈশাখের। কিরকম যেন শক্ত আর খরখরে। বিয়ের সময় যখন হস্তবন্ধনী, খৈ ঢালা এসব অনুষ্ঠান করা হয়েছিল তখন তো এক ভারি মোলায়েম আর
নরম হাতের স্পর্শ ছিল। এটা যেন কেমন অন্যরকম। একটু সম্বিৎ পেয়ে শাড়ির
আঁচলটাকে সরিয়ে দেখে হাতে বেশ কালো কালো
বড় বড় লোম ও আছে।
চকিতে
তড়াক করে ফুলের মশারি সরিয়ে বাইরে বেরিয়ে
এসে বড় টিউব লাইটটা জ্বালিয়ে বৈশাখ জোর গলায় বলে ওঠে, এ্যাই তুই কে রে??
ফুলের
মশারি থেকে নেমে ঘোমাটার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে একটি সদ্য গজানো গোঁফ দাড়িওয়ালা
ভারি বিপন্ন মুখ। সেই মুখটি বৈশাখের পিসতুতো ভাই প্রতীকের। সে ধরা পড়ে গিয়ে প্রায়
কাঁদোকাঁদো মুখে বলে, মাফ করে দাও দাদামণি।
ওই দিদি আর বৌদিদের দল ই আমাকে জোর করে........।
এবার
শুরু হয় ঘরময় মিলিটারি তল্লাশি। আলমারীর পেছন, খাটের তলা, টেবিলের কোণা ইত্যাদি থেকে অবাধে ধরা পড়ে আরো তিন চারজন অসীম
ধুরন্ধর গুপ্তচর। সব কটাকে ভাগিয়ে একরাশ হাসি ঠাট্টার রেশ কাটিয়ে নিয়ে প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার পর বৈশাখের
জ্যাঠতুতো বৌদি এবার ঘোমটাহীন অখণ্ড পরমাকে নিয়ে এসে বলেন, এইবার নাও ভাই তোমার ১০০% খাঁটি বউ। নো ভেজাল, নো দুনম্বরী।
তারপর, সেই রাতে, কি বিষয় নিয়ে যে
আলোচনা হয়নি সেটাই ভাবার। নকশাল আন্দোলন থেকে দ্যাস ক্যাপিটাল, জয়দেব-কালিদাস থেকে
শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বৈশাখের জীবনের নানা ঘাতপ্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে বড় হবার গল্প, নানা সময়ের নানা ভালোলাগার নারীদের কথা, পরমাও শৌভিকের প্রতি তার লাইক নেসের কথাটা উহ্য রাখেনি। এমন কি
এই দুর্ধর্ষ গরমে নতুন জায়গার জলে বেটাইমে
স্নান করে পরমার সেই বিদঘুটে, ফ্যাচফ্যাচে হাঁচি টা শুরু হওয়ায় তার প্রতিরোধক হিসেবে নাক দিয়ে জল নিয়ে কিভাবে মুখ দিয়ে বার করতে হয়
সেই নাসাপানের পদ্ধতিটা পর্যন্ত।
উফ
কি বাচাল ছেলে রে বাবা।।।।। থ্যাংক গড!!!! তাকে যে সে উনিশের ঘরের নামতাটা জিজ্ঞেস
করেনি।।।।।।সেটাই তার পরম
ভাগ্যি!!!!!তাহলে অংকে অগাধ দিগগজ পরমা
নির্ঘাত দু তিনটে ভুল বলতো।
অত:পর, পরিশেষে নিবেদনং মিদং, বাদ বাকি যা কিছু সেন্সার বোর্ডের বিবেচনাধীন প্রসঙ্গ সেটুকু
না হয় ওদের দুজনের ব্যক্তিগত মালিকানাতেই থাক।
তবে
সেইদিনটার পর থেকে দুজনের মধ্যে যে আন্ডারস্ট্যান্ডিং এর বন্ডিং টা ধীরেধীরে তৈরি
হবার সূত্রপাত হয়েছিল, তাতে বৈশাখ আর পরমার
দোস্তির গাড়িটা আজীবন বেশ স্মুথলি ই রাণ
করেছিলো।।
*****উপহারের
বদলে শুভেচ্ছাই কাম্য******
**** পত্রদ্বারা নিমন্ত্রনের ত্রুটি মার্জনীয়
*******
(সমাপ্ত)
তনিমা হাজরা: কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন