অনুভূতিনামা




রম্যরচনা


শপিং মলে ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছিল হিয়া। এই দুপুরগুলো আর কাটতে চায় না। আজ ইচ্ছে করেই গাড়ি নিয়ে বেড়িয়েছে। ভাস্কর ফিরবে আজ। কিছু টুকটাক কেনাকাটা করে একবারে এয়ারপোর্টে যাবে। ওকে নিয়ে ডিনার করে ফিরবে সে। ভাস্কর যেহেতু চাকরির প্রয়োজনে অধিকাংশ সময় বাইরে বাইরে থাকে,তাই কলকাতা ফিরলেই তাকে যতটা সম্ভব সময় দেওয়ার চেষ্টা করে।হিয়া বোঝে, আসলে তাকে বড়ো ভালোবাসে সে। তাই তাকে খুশি রাখার চেষ্টা করে।আর হিয়া! কেন সবসময় খুশি হতে গিয়েও...একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সময় দেখে। কেনাকাটা হয়ে গেলেও হাতে বেশ কিছুটা সময় আছে তো। তাই একটু উইন্ডো শপিং করছিল, হঠাৎ চোখ পড়ল--- নিজেকে আড়াল করে চলে যাচ্ছিল হিয়া, নামটা শুনে থমকে গেল! এখনো!

--অনুভূতি!

মনে আছে! পা দুটো আর নড়ে না তার! সেই তেইশ বছর আগে যেমন এই নামটা শুনলেই স্থির হয়ে যেত অমন চঞ্চল উড়ে চলা হিয়া। আজও কেন! এত বছর পরও! কেন? সব তো শেষ হয়ে গেছিল সেদিন। তবে! শেষ হয়নি?
 -- অনুভূতি! কেমন আছিস?
ঘোর কাটে হিয়ার। সামনে তাকিয়ে দেখে তার অনুভব।
তার! নাহ্ তার নয়। তার অনুভব তো..

-- চিনতে পারছিসনা?  নাকি চিনতে চাইছিস না?
সত্যিই সেই কলেজ জীবনের প্রগলভা হিয়া আজও কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছেনা।
সত্যিই কি চিনতে কোনোদিন পেরেছিল সে অনুভবকে! কানে আসে সেই পরিচিত গলায়,
--তোকে আমি অনুভূতিই ডাকবো..
-- আর কিছু বলিস না প্লিজ।
-- জানি, আমি ...
অনুভবের গলাটা ধরে এসেছে। হিয়া বলল,
--কি খবর তোর?
-- ভালো, তোর?
-- খুব ভালো।
-- সত্যিই?

অনুভবের চোখ থেকে চোখ সরাতেই আগের মতো হেসে বলল অনুভব-  তোর চোখে দেখেই কিন্তু আমি এখনও বুঝতে পারি তোর মনের কথা। তোকে দেখে তো তেমন ব্যস্ত মনে হচ্ছে না আজ। তবে চল একটু বসি। আর কথা না বাড়িয়ে আগের মতোই হিয়ার হাতটা ধরে এগোতে থাকে। সেই স্পর্শ! শরীরে আজও কাঁপন লাগে! হাতটা ছাড়িয়ে নিতে গেলে, অনুভব বলে, আমি না চাইলে হাত ছাড়াতে পারবি? আজ হিয়ার কি হলো! উত্তর দিতে পারছেনা কেন?  হাতটা চাইলেও ছাড়াতে পারছেনা সে। ফুড কোর্টে একটা কোণা দেখে বসল তারা। অনুভবই জিজ্ঞেস করল,
 --  কি খাবি? ওয়েট আমি বলছি, গ্রেভি চাউ উইদাউট প্রণ, একটা ম্যাঙ্গো জুস,আর আইসক্রিম- তাইতো? দেখ তো কেমন মনে আছে সব। তার চোখে চোখ রেখে বলল অনুভব। ও তো জানে ঐ চোখে.. নাহ্ এবার  আর না।

কেটে কেটে উত্তর দিল হিয়া, আমি বদলে ফেলেছি আমার সবকিছু। তাই শুধু মাত্র কোল্ড কফি।
--ওকে! আমি অর্ডার দিয়ে আসছি।

অনুভব উঠে গেলে হিয়া দেখতে থাকে অনুভবকে। আগের থেকে একটু ভারি হয়েছে চেহারাটা ঝকঝকে চোখদুটো,আজ চশমার আড়ালে। আড়ালেই থাকুক, হিয়া জানে ঐ চোখে সম্মোহন আছে। শুধু কি চোখ? হিয়া তো অনুভবকে প্রথমে দেখেনি। তার কন্ঠস্বরেই তো সে প্রথম সম্মোহিত হয়েছিল। আজও মনে পড়ছে, কলেজ  অ্যানুয়ালে হিয়া তখন সাজঘরে মেকাপ করছিল। আইলাইনার হাতে থমকে গেছে এক উদাত্ত গলায়, "আমি  রূপে তোমায় ভোলাব না-- ভালোবাসায় ভোলাব--"  শুনতে শুনতে বিভোর, তারপর  তার কন্ঠেই--

"আমার   মনের কোণের বাইরে
আমি জানলা খুলে ক্ষণে ক্ষণে চাইরে---"

গায়ককে দেখার জন্য মনটা কেমন করছিল। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রেডি হয়ে ব্যাকস্টেজে দাঁড়িয়ে শুনতে থাকে তার গান। গৈরিক পাঞ্জাবি আর জিন্স পরা ফর্সা সৌম্য দর্শনের গানে সবাই মন্ত্রমুগ্ধ।সেও তো মোহাবিষ্ট। হুঁশ ফিরলে দেখে সে তার সামনে দাঁড়িয়ে তাকে বলে ,

-- মনে হয় তোমার নাম এনাউন্স হয়েছে।  লজ্জায় হিয়া কোনোমতে তাকে পাশ কাটায়।

নাচ শেষে স্টেজ থেকে নেমেই আবার দেখা। চোখে মুখে মুগ্ধতা নিয়ে সে হিয়াকে বলেছিল, বাহ্! আমি তো তোমার নাচে মুগ্ধ হলাম। এক মুহূর্ত  দাঁড়াতে পারে নি হিয়া ঐ চোখের সামনে। বুঝেছিল সর্বনাশ লেখা আছে ঐ চোখেই। দুদিন পর কলেজ যেতেই, গেটের কাছে অনুভবকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, হিয়ার হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। অনুভবই এগিয়ে এসে তার সাথে কথা বলতে শুরু করে। জানা যায়, দুজনেই  ফার্স্ট ইয়ার , শুধু একজন বিজ্ঞান আরেকজন বাণিজ্য বিভাগ। এক নতুন সম্পর্কের  সূচনা হলো। তারপর কলেজে- ক্যান্টিনে- লাইব্রেরী- অনুভব আর হিয়া-- কখন কিভাবে এত কাছাকাছি এসেছিল , জানা নেই হিয়ার। নাহ্ হিয়া নয়- সে তো অনুভবের অনুভূতি-- মনে পড়ছে--সেই  বৃষ্টিভেজা  সন্ধেবেলা--  হ্যাঁ,  সায়নীর  জন্মদিনে তাড়াতাড়ি খাওয়া সেরে ফেরার পথে অনুভবের সাথে ফিরছিল সে। দুদিন পরেই অনুভব হায়ারস্টাডিসের জন্য   চলে  যাবে ম্যাড্রাস l যাওয়ার  আগে  সেদিন  একসাথে  সেই  পুকুর  পাড়ে নির্জন  রাস্তায় দুজন ফিরছিল l মন  খারাপ  ছিলো  হিয়ার  আর সেই  মন  খারাপের  মেঘ  ওই  আকাশে  জমছিলl হঠাৎই কালোমেঘে  আকাশ  ছেয়ে  নেমে আসে  তুমুল  বৃষ্টি। বৃষ্টির হাত থেকে  বাঁচতে  কাছেই  একটা  নির্ণীয়মান  বাড়ির  একতলায়    গিয়ে  দাঁড়ায় সেই সন্ধ্যায়  একান্ত  নিভৃতে  অনুভবের  কথাগুলো  আজও  কানে বাজে, -- আমি  না  থাকলে  ভুলে  যাবি?

--- বল  আগে, ভুলে  যাবি?
 
একটু চুপ  করে  থেকে   হিয়া  বলেছিলো -- তোকে  আমি অনুভব  করি  আমার  মনে, ভুলবো  কি  করে  বল! আমার  অনুভবে জড়িয়ে  আছিস  যে তুই... ধরা  গলায় আর  কথাগুলো  শেষ হবার আগেই   তাকে  বুকে টেনে  নিয়েছিল অনুভ তার বুকে  হিয়ার  মাথাটা  রেখে বলেছিলো,
--আজ  থেকে  তোর নাম  অনুভূতি --
--- কেন?
--- আমি যেমন  তোর অনুভবে  থাকি  তবে  তুইও  আমার  অনুভূতিতে  থাকিস জানিসনা...
  তারপর! তারপর  অনুভব  আর  অনুভূতির ঠোঁট মিশেছিল  সেই  বৃষ্টির  সন্ধ্যায়..

  
আবার  সেই  গলার শব্দে বাস্তবে ফেরে  হিয়া নিজেকে  খুঁজে  পায়  ফুড  কোর্টে।  সেই  চোখদুটোর  সামনে,-- তুই  তো  চা- কফি  খেতি  না,  যাক  এই  নে--
  
তাকিয়ে  দেখে  হিয়া  আইসক্রিম  মেশানো কোল্ড  কফির  গ্লাস, ওপরে  চকলেট  সসের সাথে চকলেট চিপস দেওয়া

--আমি ভুলিনি তোর আইসক্রিম আর চকলেটের প্রতি ভালোবাসা। এটাও জানি ইচ্ছে করেই তুই খাবারগুলো বদলাতে চেয়েছিস। সত্যিই বল তো, বদলাতে পেরেছিস? একবার ও মনে পড়ে না আমায়?

হিয়া জানে না উত্তর। সত্যিই কি অনুভবকে সে ভুলতে পেরেছে!না কখনো পারবে! তবু সে ভোলেনি  সেই দিনগুলো।  ম্যাড্রাস যাওয়ার পর তার বাড়িতে চিঠি আসার সমস্যার জন্য সায়ন্তনীর বাড়িতে তাকে লেখা অনুভবের চিঠি আসতো। তাই তার নামে আসা সব চিঠিই তার আগেই পড়ত  সায়ন্তনী। তারপর ...তারপর তার জন্য চিঠি আসার সংখ্যা কমতে লাগলো। সে রোজ অপেক্ষায় থাকতো অনুভবের চিঠির... কিন্তু বোকা হিয়া বুঝতে পারে নি যে চিঠি আসতো, তবে তার জন্য নয়। সায়ন্তনীর জন্য---
 
হঠাৎ তার হাতের ওপর অনুভবের হাতের স্পর্শে চেতনা ফেরে তার। হাত সরিয়ে নেয় হিয়া। তার মনের অনুভূতি নিয়ে যে দুজন খেলা করছে, তাদের কারো জন্যই হিয়ার মনে দূর্বলতা নেই।

-- থ্যাঙ্কস ফর দ্য কোল্ড কফি। তবে আজকাল আমি আইসক্রিম খাইনা। আমি ডায়েট মেইনটেইন করি।
-- কিন্তু আমি তো তোর পছন্দের..
-- আমি আমার পছন্দ বদলে ফেলেছি অনুভব। ঠিক যেমন করে তুই বদলে ফেলেছিলি -হিয়া থেকে সায়ন্তনীকে..
-- আমার ভুল ছিল। বিশ্বাস কর, সেসময় একটা মোহের মতো ওর সাথে জড়িয়ে পড়েছিলাম।
-- আমি কোনো মোহে পড়িনি আর কোনো ভুল ও করবোনা। আজ উঠি, ভাস্কর ওয়েট করবে। বাই।
পার্স থেকে পাঁচশো টাকার নোট বের করে টেবিলের ওপর কফির কোল্ড কফির গ্লাসটা চাপা দিয়ে বেরোনোর আগে হিয়া আবার বলে,
--আর হ্যাঁ--যে অনুভূতি অনেক আগেই হারিয়ে গেছে, তাকে ফিরে পাওয়ার কোনো ইচ্ছেই আমার নেই।

হিয়া  মল থেকে বেরিয়ে গাড়িতে ওঠে। কানে ইয়ার ফোন লাগিয়ে নিজেও গুণগুণ করে ওঠে--
"দূরে কোথায় দূরে দূরে--
আমার  মন বেড়ায় গো ঘুরে ঘুরে--
যে বাঁশিতে বাতাস-- কাঁদে সেই বাঁশিটির সুরে সুরে--
যে  বাঁশিতে বাতাস-- কাঁদে সেই বাঁশিটির সুরে সুরে--
যে পথ সকল দেশ পারায়ে  --
উদাস হয়ে যায় হারায়ে--
সে পথ বেয়ে কাঙাল--
পরান যেতে চায়-- কোন্‌ অচিনপুরে ---":

বৃষ্টি নামে কোথায় যেন, সব ঝাপসা  হয়ে আসে---


অর্পিতা বোস: কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন