মৃণালিনী



প্রবন্ধ

রবীন্দ্রনাথ শৈশব থেকেই তাঁর বিবাহের বিশেষ দিনটার স্বপ্ন দেখতেন। অথচ তাঁর বিয়েতে কোন জাঁকজমক হয় নি। এই নিয়ে কবির মনে চিরকাল আক্ষেপ ছিল।তিনি পরে ঘনিষ্ট আত্মীয় বন্ধুদের বলতেন,"আমার বিয়ের কোন গল্প নেই।" "আমার বিয়ে যা-তা করে হয়েছিল।" বিয়ের জন্য পাত্রীর সন্ধান পাওয়াও খুব সহজ হয়নি।পাত্রীর সন্ধানে কবির বৌঠানরা—কাদম্বরী দেবী,ঞ্জানদানন্দিনী দেবী, দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সত্যেন্দ্রনাথের দুই ছেলেমেয়ে সুরেন্দ্র ও ইন্দিরা আর বাইশ বছরের সদ্য যুবক রবীন্দ্রনাথ এলেন যশোর জেলার নরেন্দ্রপুরে।সেখানে ঞ্জানদানন্দিনীর বাপের বাড়ি।আশেপাশে দক্ষিণডিহি,চেঙ্গুটিয়া প্রভৃতি গ্রাম গুলোতে সন্ধান করেও তাঁর বৌঠানদের মত সুন্দরী পাত্রী পাওয়া গেল না। শেষে ফুলতলি গ্রামে এসে তাঁদেরই স্টেটের কর্মচারী বেণীমাধব রায়ের বড় মেয়ে ভবতারিণীকে পছন্দ করলেন অভিভাবকরা।বিবাহের দিন স্থির হল ১৮৮৩,৯ ডিসেম্বর। রবীন্দ্রনাথ শর্ত দিলেন  তিনি ফুলতলিতে আসবেন না বিয়ে করতে,বিয়ে জোড়াসাঁকোতেই হবে। নিজের বিয়ের নিমন্ত্রণ পত্র কবি নিজেই লিখে পাঠিয়েছিলেন বন্ধু প্রিয়নাথ সেন ও অন্যান্য বন্ধু বান্ধবকে। সেই পত্রের মাথায় সূর্যোদয়ের সাথে ভোরের পাখিদের প্রথম আবির্ভাবের ছবি, নিচে মধুসূদন দত্তের "আশার ছলনে ভুলি কি ফল লভিনু হায়"--লিখে পাশে লিখলেন, " আমার Motto নহে।"

পত্রের ভিতরে লেখা:----

   প্রিয় বাবু,

        আগামী রবিবার ২৪ অগ্রহায়ণ তারিখে শুভদিনে শুভলগ্নে আমার পরমাত্মীয় শ্রীমান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শুভ বিবাহ হইবেক। আপনি তদপুলক্ষে বৈকালে উক্ত দিবসে ৬ নং জোড়াসাঁকোস্থ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভবনে উপস্থিত থাকিয়া বিবাহদি সন্দর্শন করিয়া আমাকে এবং আত্মীয়বর্গকে বাধিত করিবেন।

          ইতি
 অনুগত
        শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

বাড়িতে এক 'দৌড়দার' বেনারসী শাল ছিল। বরসজ্জায় সেই শালখানি গায়ে জড়িয়ে দাঁড়ালেন বিয়ের পিঁড়ির ওপরে।তাঁকে বরণ করলেন ভবতারিণীর এক আত্মীয়া 'বড়ো গাঙ্গুলীর স্ত্রী'।সম্প্রদাণের পর বরকনে এসে বাসরে বসলো। বাসরে বসেই রবীন্দ্রনাথ দুষ্টুমি শুরু করলেন। ভাঁড় খেলার বদলে ভাঁড়গুলো ধরে ধরে উপুর করে দিতে লাগলেন।তাঁর ছোট কাকিমা ত্রিপুরাসুন্দরী বললেন,

"ও কি করিস রবি? এই বুঝি তোর ভাঁড় খেলা? ভাঁড়গুলো সব উলটেপালটে দিচ্ছিস কেন?" রবীন্দ্রনাথকে শ্বশুরবাড়ি যেতে হয় নি। নিজের বাড়ি আর নিজেই তিনি বর,অসংকোচে বললেন, "জানো না কাকিমা সব যে উলট পালট হয়ে যাচ্ছে---কাজে কাজেই আমি ভাঁড়গুলোকে উলটে দিচ্ছি।" কাকিমা আবার বললেন,

"তুই একটা গান কর।তোর বাসরে আর কে গাইবে,তুই এমন গাইয়ে থাকতে?"কবি তখন বাসরে গান জুড়ে দিলেন---" আ-মরি লাবণ্যময়ী

কে ও স্থির সৌদামিনী,
পূর্ণিমা জোছনা দিয়ে
মার্জিত বদনখানি!
নেহারিয়া রুপ হায়,
আঁখি না ফিরিতে চায়,
অপ্সরা কি বিদ্যাধরী
কে রুপসী নাহি জানি।"

গানটি তাঁর ন'দিদি স্বর্ণকুমারী দেবীর লেখা।

রবীন্দ্রনাথের কান্ড দেখে বালিকা বধূটি বিবাহ বাসরে ওড়নায় মুখ ঢেকে মাথা নীচু করে বসে ছিল।তখন তার বয়স মাত্র নয় বছর নয় মাস। কবি পরে 'সানাই' এর 'হঠাৎ মিলনে' কবিতায় নববিবাহিতা বধূটির সেই একটুখানি সলাজ হাসির কথা লিখে রেখেছেন---"আঁচল আড়ে দীপের মতন একটুখানি হাসি/নিবিড় সুখের বেদন দেহে উঠছিল নিশ্বাসি।"

বিবাহের পর ঠাকুর পরিবারে ভবতারিণীর নতুন নামকরণ করা হল মৃণালিনী। নামটি হয়তো কবি তাঁর প্রথম প্রিয়া আন্না তড়খড়ের(নলিনী) নামের সাথে মিলিয়েই রেখেছিলেন! এরপর জোড়াসাঁকোর বাড়িতে শুরু হল ভবতারিণীর মৃণালিনী হয়ে ওঠার শিক্ষা। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের নির্দেশে মহর্ষির পুত্রবধূ নীপময়ীর কাছে ঠাকুরবাড়ির আদব কায়দা ও বাচনভঙ্গীর ঘরোয়া তালিম নিলেন।তারপর নীপময়ীর মেয়েদের সাথে পড়তে গেলেন লোরেটো হাউসে লোরেটোয় তাঁকে অন্যান্য ছাত্রীদের সাথে না পড়িয়ে স্বতন্ত্র শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। প্রায় এক বছর মৃণালিনী স্কুলে ইংরেজি পড়েছেন‌। এছাড়াও কবির আগ্রহে বাড়িতে সংস্কৃত শেখাতে আসতেন আদি ব্রাহ্ম সমাজের আচার্য পন্ডিত হেমচন্দ্র বিদ্যারত্ন। হেমচন্দ্রের কাছে মৃণালিনী রামায়নের অনুবাদ করেছেন আর ভাশুরপুত্র বলেন্দ্রনাথের কাছে ইংরেজি বাংলা ও সংস্কৃত সাহিত্যও পাঠ এবং অধ্যায়ণ করেছেন। অনুবাদ চর্চা,ভাষাশিক্ষা ও সাহিত্যচর্চার পাশে মৃণালিনী পরিবারের অন্য বধূদের সাথে অভিনয়ও করেছিলেন। পার্ক স্ট্রীট অঞ্চলে সত্যেন্দ্রনাথের বাড়িতে রবীন্দ্রনাথের লেখা "রাজা ও রানী" নাটকে অভিনয় করলেন নারায়ণীর ভূমিকাতে। এটাই ছিল মৃণালিনীর প্রথম অভিনয়। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর  পরে লিখেছেন," মা কখনো স্কুলে লেখাপড়া শেখেননি....বাবার কাছেই যা শিক্ষা পেয়েছিলেন। অল্প বয়স থেকেই বলুদাদা(বলেন্দ্রনাথ) সাহিত্যরসেমাতোয়ারা ছিলেন। তিনি সংস্কৃত,বাংলা, ইংরাজিতে যখন যে কোন বই পড়তেন,কাকিমাকে সেগুলি  একবার পড়ে না শোনালে তাঁর তৃপ্তি হত না।" রবীন্দ্রনাথের উৎসাহে মৃণালিনী অনেক সুন্দর সুন্দর রুপকথার কাহিনী সংগ্রহ করে একটা খাতায় লিখে রাখতেন। কবির ভাইপো অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কাকিমার সেই সংগৃহীত রুপকথা থেকেই 'ক্ষীরের পুতুল' গল্পটি নিয়েছিলেন। মৃণালিনী খুব পড়তেও ভালোবাসতেন,ছোট কন্যা মীরার লেখাতে পাওয়া যায়--"শান্তিনিকেতনের দোতলার গাড়ি-বারান্দার ছাতে একটা টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে। মার হাতে একটা ইংরেজি নভেল। তার থেকে বাংলায় অনুবাদ করে দিদিমাকে পড়ে শোনাচ্ছেন....গল্প শোনবার লোভে বোধ হয় তাঁদের গল্পের আসরে কখনো গিয়ে বসেছি। তাই  বইটার একটি মেয়ের নাম কি করে যে মনের মধ্যে গাঁথা হয়ে গিয়েছিল খুবই আশ্চর্য লাগে।" মৃণালিনী জোড়াসাঁকোর বৃহৎ পরিবারে খুব সুন্দর নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিলেন। তিনি সুগৃহিনী ছিলেন,অভিমানিনী অথচ ব্যক্তিত্বময়ী। জোড়াসাঁকোর বাড়িতে সকলের ছোট, তবু সবাই তাঁর কথা শুনতেন। সবাইকে নিয়ে তিনি আমোদ আহ্লাদ করতেন,অন্য বউদের সাজাতেন কিন্তু তিনি নিজে সাজতেন না। তাঁর রান্নার হাতটিও ছিল চমৎকার। কবির জন্য প্রায়ই তিনি নিজের হাতে ঘরে নানা ধরণের মিষ্টি তৈরী করতেন। তাঁর হাতে তৈরী চিঁড়ের পুলি,দইয়ের মালপো,পাকা আমের মিঠাই যাঁরা একবার খেতেন তাঁরাই তাঁর খাবার তৈরীর পটুত্বে মুগ্ধ হয়ে যেতেন। রবীন্দ্রনাথ স্ত্রীকে নিত্য নতুন রান্নার ফরমায়েশ করতেন। মৃণালিনীকে তিনি নুতন প্রণালীতে রান্না শিখিয়েও নিজের শখ মেটাতেন।পরে গৌরব করে বলতেন,"দেখলে তোমাদের কাজ তোমাদেরই কেমন একটা শিখিয়ে দিলুম।"  কবিপত্নী তখন ছদ্মরাগে বলতেন,"তোমাদের সঙ্গে পারবে কে? জিতেই আছ সকল বিষয়ে।"

১৮৮৬ তে কবি এবং মৃণালিনীর প্রথম সন্তান বেলার জন্ম হয়। কবি আদর করে তাঁর জ্যেষ্ঠা কন্যাসন্তানের নাম রাখলেন মাধুরীলতা। পঁচিশ বছর বয়সে কবির প্রথম জন্মদিনটি পালিত হয়েছিল তাঁর ভাগ্নী সরলা দেবীর উদ্যোগে। তখন মৃণালিনীর বয়স মাত্র বারো। এর দুই বছর বাদেই সাতাশ বছর বয়সে দ্বিতীয় বার তাঁর জন্মোৎসব মৃণালিনী খুব জাঁকজমক সহ পালন করলেন। এই জন্মদিনে মৃণালিনী স্বামীকে সোনার বোতাম গড়িয়ে উপহার দিলেন।রবীন্দ্রনাথ পুরুষের সোনা পরাকে লজ্জাজনক বলে আপত্তি করায় কবিপত্নী সেই বোতাম ভেঙে ওপেল বসান বোতাম গড়িয়ে দিলেন। কবি জন্মদিনে হঠাৎ এই উপহার পেয়ে মুখে আপত্তি করলেও মনে মনে খুব খুশী হয়েছিলেন।এরপর থেকে প্রতি বছর মৃণালিনী রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনের উৎসব নিয়ম করে পালন করে গেছেন। বিবাহের চার বৎসর বাদে রবীন্দ্রনাথ শিশুকন্যা ও স্ত্রী মৃণালিনী সহ এলেন পশ্চিমে গাজীপুরে। সুবৃহৎ ঠাকুর পরিবারের বাইরে এসে গাজীপুরের শান্ত নিভৃত নিবাসে মৃণালিনী প্রথম স্বাধীনভাবে দাম্পত্য জীবনের আনন্দ অনুভব করবার সুযোগ পেলেন। এই প্রথম তিনি স্বামীকে সম্পূর্ণ আপন করে পেলেন। রবীন্দ্র জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় এই গাজীপুর বাস প্রসঙ্গে লিখে গেছেন,"স্বামীকে আপনার সংসারে, নিজের মত করিয়া কেবল নিজের করিয়া পাইবার আকাঙ্খা  নারীর পক্ষে অত্যন্ত স্বাভাবিক,তাহা পত্নী মৃণালিনী দেবীর সংসার জীবনে এই প্রথম ঘটিল, রবীন্দ্রনাথও  যৌবনের পরিপূর্ণতার মধ্যে স্ত্রীকে পাইলেন সঙ্গিণীরুপে প্রেয়সীরুপে।"  গাজীপুরেই মৃণালিনী ও রবীন্দ্রনাথের দ্বিতীয় সন্তান রথীর জন্ম হল। এখানেই কবি 'মানসী' কাব্যের কবিতাগুলি রচনা করেছিলেন।  দুইবছর গাজীপুরের সাময়িক বাস থেকে ফিরে মৃণালিনী স্বামী পুত্রকন্যা সহ শিলাইদহের কুঠি বাড়ি ও পদ্মানদীর বুকে 'পদ্মা' বোটে কিছুদিনের জন্য বাস করেছিলেন।শিলাইদহে মৃণালিনী তাঁর বান্ধবী দেশবন্ধুর বোন অমলা দাশ ও ভাসুরপুত্র বলেন্দ্রনাথ সহ পদ্মার চরে বেড়াতে গিয়ে পথ হারিয়ে ফেলেন।সেই ঘটনা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন তাঁর নৌকাডুবি উপন্যাসটি। রবীন্দ্রনাথ এরপর ইউরোপ থেকে ঘুরে আসার পরে মৃণালিনী স্বামী পুত্র কন্যাসহ  কখনো জোড়াসাঁকোতে কখনো শিলাইদহে কখনো শান্তিনিকেতনের অতিথি আবাসে সংসার করেছেন।এরমধ্যেই ১৮৯১ তে কন্যা রেনুকা ১৮৯৩ তে কন্যা মীরা ও ১৮৯৪ তে কনিষ্ঠ সন্তান শমীর জন্ম হল। মাত্র একুশ বছরবয়সের মধ্যেই মৃণালিনী পাঁচটি সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। ১৮৯১ এপ্রিল-মে মাসে স্বামী সন্তানসহ মৃণালিনী প্রথম শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন। জুন মাসে কবি সাহজাদপুর থেকে স্ত্রীকে'ভাই ছুটি' সম্বোধন করে চিঠিতে লিখলেন: "আজকাল তুমি দুবেলা খানিকটা করে ছাতে পায়চারি করে বেড়াচ্চ কিনা আমায় বল দেখি। এবং অন্যান্য সমস্ত নিয়ম পালন হচ্চে কিনা তাও জানাবে।...তোমার যে মাথা ধরত এখন কি রকম আছে?"

এই সময় থেকে স্ত্রীকে লেখা সব চিঠিতেই রবীন্দ্রনাথ এই মধুর সম্বোধন করতেন। সংসারযাত্রার পথে মৃণালিনী-রবীন্দ্রনাথ দাম্পত্য এগিয়েছে পারস্পরিক নির্ভরতা আর ভালোবাসার হাত ধরে। ১৯০১ সালে(৭ই পৌষ,১৩০৮) শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়। রবীন্দ্রনাথ ঐ বিদ্যালয়কে ঘিরে তাঁর স্বপ্নকে সার্থক করে তুলতে সপরিবারে চলে এলেন শান্তিনিকেতনে।ঐ মহৎ কর্মযঞ্জে কবির সংকল্পকে সার্থক রুপ দিতে প্রাণপাত পরিশ্রম করেছিলেন মৃণালিনী। তিনি হয়ে উঠলেন আশ্রম বিদ্যালয়ের ছোট ছোট শিশুদের ধাত্রী, জননী।ছাত্রদের দেখাশোনা থেকে শুরু করে তাদের দু'বেলা রান্না করে খাওয়ানো, এই সকল কাজের দায়িত্ব মৃণালিনী একার হাতে বহুমাস ধরে সামলেছেন। বিদ্যালয় চালানোর জন্য অর্থের সংস্থান করা একটা সময় অসম্ভব হয়ে পড়ে কবির কাছে। অর্থের প্রয়োজনে মৃণালিনী সেইসময় তাঁর গায়ের সোনার গহনা একে একে তুলে দিয়েছেন কবির হাতে বিক্রির জন্য।

কম বয়সে অল্প ব্যবধানে পাঁচটি সন্তানের জন্মদানের ধকল সয়েছেন। তারপরে আশ্রম বিদ্যালয়ের জন্য একটানা এত পরিশ্রমের ভার সহ্য করতে পারল না মৃণালিনীর শরীর। ১৯০২ এর জুন জুলাই থেকে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। জ্বর ও তলপেটের অসহ্য যন্ত্রণায় মৃণালিনী শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। ক্রমশঃ তাঁর স্বাস্থ্যভঙ্গ ও রোগের অবনতি হতে থাকল। কবির নির্দেশে তাঁর শ্যালক মৃণালিনী ও পুত্রকন্যাকে নিয়ে এলেন জোড়াসাঁকোয়। তাঁর অসুখ প্রসঙ্গে কবির ভাইঝি ইন্দিরা দেবী বলেছেন,"শুনেছি শান্তিনিকেতনের ছাত্রদের জন্য রোদের তাতে রেঁধে রেঁধেই কাকিমা অসুস্থ হয়ে পড়েন।" রথীন্দ্রনাথ লিখেছেন," আমার এখন(পরিণত বয়সে) সন্দেহ হয় তাঁর এ্যপেন্ডিসাইটিস হয়েছিল।" কলকাতায় ডি এন রায়,

প্রতাপ মজুমদারের মত নামকরা ডাক্তারদের ওপর মৃণালিনীর চিকীৎসার ভার দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি নিজেও শেষের কটি মাস অসুস্থ শয্যাশায়ী স্ত্রীর সেবা করেছেন অক্লান্তভাবে। হেমলতা দেবী লিখেছেন,"মৃত্যুশয্যায় কবি নিজের হাতে যে শুশ্রূষা করেছিলেন তার ছাপটি মুদ্রিত হয়ে রয়েছে পরিবারের সকলের মনে আজও। প্রায় দু মাস তিনি শয্যাশায়ী  ছিলেন,ভাড়া করা নার্সদের হাতে পত্নীর শুশ্রূষার ভার কবি একদিনের জন্যও দেন নাই।" রবীন্দ্রনাথের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে ২৩ নভেম্বর ১৯০২ সালে শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ঠিক এগারো মাস পরে,মাত্র উনত্রিশ বছর বয়সে মৃণালিনী পরলোক গমন করলেন। পিতৃস্মৃতি' গ্রন্থে রথীন্দ্রনাথ লিখে গেছেন,"সমবেদনা জানানোর জন্য সেদিন রাত পর্যন্ত লোকের ভিড়। বাবা সকলের সঙ্গেই শান্তভাবে অসম্ভব ধৈর্যের সঙ্গে কথা বলে গেলেন। কিন্তু কী কষ্টে যে আত্মসংবরণ করে তিনি ছিলেন তা আমরা বুঝতে পারছিলুম। ....যখন সকলে চলে গেল,বাবা আমাকে ডেকে নিয়ে মায়ের সর্বদা-ব্যবহৃত চটিজুতো জোড়াটি আমার হাতে দিয়ে কেবলমাত্র বললেন,"এটা তোর কাছে রেখে দিস্,তোকে দিলুম।'এই দুটি কথা বলেই নীরবে তাঁর ঘরে চলে গেলেন।"

শ্রান্ত বেদনাহত শোকদগ্ধ রবীন্দ্রনাথ এরপরে ফিরে এলেন শান্তিনিকেতনে। বিদ্যালয়ের কাজে প্রাণ-মন আরো বেশী ঢেলে দিয়ে ভুলতে চেষ্টা করলেন শোকের যন্ত্রণা। মৃণালিনীর মৃত্যুতে তাঁর অবরুদ্ধ শোক ও আবেগ প্রকাশ পেল মৃণালিনীর উদ্দেশ্যে লেখা এক গুচ্ছ কবিতায়। সেই কবিতাগুলি পরে 'স্মরণ'কাব্যগ্রন্থ হয়ে প্রকাশিত হল। 'সার্থকতা' কবিতায় লিখলেন:----

"তুমি ওগো কল্যাণরূপিণী
মরণেরে করেছ মঙ্গল।
জীবনের পরপার হতে
প্রতিক্ষণ মর্ত্ত্যের আলোতে
পাঠাইছ তব চিত্তখানি
মৌন প্রেমে সজল কোমল
মৃত্যুর নিভৃত স্নিগ্ধ ঘরে
বসে আছ বাতায়ন পরে
জ্বালায়ে রেখেছ দীপখানি
চিরন্তন আশায় উজ্জ্বল।
তুমি ওগো কল্যাণরুপিণী
মরণেরে করেছ মঙ্গল।।"

মাত্র উনত্রিশ বছর বয়সে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেও মৃণালিনী কখনো রবীন্দ্রনাথের মন থেকে বিদায় নেন নি। জীবিত অবস্থায় যে ভাবে কবির;জীবনকে ভরে রেখেছিলেন--দুঃখের দিনের সাথী হয়ে কল্যাণ কাজের প্রেরণা দিয়েছিলেন,মৃত্যুর পরেও সেইভাবে রবীন্দ্রনাথের জীবনকে পূর্ণ করে রেখেছিলেন। জীবনের অনেক অন্তরঙ্গ মুহূর্তে নিঃসঙ্গ কবি পত্নীর সান্নিধ্য কামনা করেছেন। তাঁকে পার্থিব রুপে না পাওয়ার কষ্ট জীবনসায়াহ্নে বলেছেন মৈত্রেয়ী দেবীকে,"সব চেয়ে কী কষ্ট হত জান? এমন কেউ নেই যাকে সব বলা যায়। সংসারে কথার পুঞ্জ অনবরত জমে উঠতে থাকে।ঠিক পরামর্শ নেবার জন্য নয়, শুধু বলা,বলার জন্য। এমন কাউকে পেতে ইচ্ছে করে যাকে সব বলা যায়---সে তো আর যাকে তাকে দিয়ে হয় না!" সাংসারিক জীবনের কোন নিঃসঙ্গ মুহূর্তে অমলা দাশকে কবি বলেছিলেন," দেখো অমলা,মানুষ মরে গেলেই যে একেবারে হারিয়ে যায়,জীবিত প্রিয়জনের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়,সে কথা আমি বিশ্বাস করি না। তিনি এতদিন আমাকে ছেড়ে গেছেন,কিন্তু যখনই আমি কোনো একটা সমস্যায় পড়ি যেটা এটা মীমাংসা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়,তখনই আমি যেন তাঁর সান্নিধ্য অনুভব করি। শুধু তাই নয়,তিনি যেন এসে আমার সমস্যার সমাধান করে দেন। এবারেও আমি কঠিন সমস্যায় পড়েছিলুম,কিন্তু এখন আর আমার মনে কোনো দ্বিধা নেই।" জীবনের অন্তিম লগ্নে কবি মৃণালিনীর  সেবাময়ী  রুপটির কথা স্মরণ করে লিখলেন 'রোগশয্যার'

৩৩ ন‌ং কবিতাটি :-

"...সুললিত বাহুর কঙ্কনে
প্রিয়জন কল্যাণের কামনা বহিছে
সযতনে।
প্রীতি আত্নহারা
আদি সূর্যোদয় হতে
বহি আনে আলোকের ধারা।
দূরকাল হতে তারি
হস্ত দুটি লয়ে সেবারস
আতপ্ত ললাট মোর আজো ধীরে
করিছে পরশ।"

দীপক চৌধুরী:কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত
   
তথ্যসূত্র:--
১. রবিজীবনী --প্রশান্তকুমার পাল।
২.ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল--চিত্রা দেব।
৩.রবি ঠাকুরের ডাক্তারি--ডা. শ্যামল চক্রবর্তী।
৪.মৃণালিনী দেবী রবীন্দ্র কাব্যে ও জীবনে--প্রঞ্জাপারমিতা বড়ুয়া।







কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন