জয় বাবা কেদারনাথ



প্রবন্ধ


নদী ফুলেফেঁপে উঠছে। আকাশ যেন ভেঙে পড়েছে। বিশাল আকার ধারণ করছে মন্দাকিনী। একী আগ্রাসী চেহারা নদীর! নদী না সমুদ্র? সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগের উত্তাল সমুদ্র কি জেগে উঠল আবার? একী বীভৎস ঢেউ! ভাসিয়ে নেবে তো সব! হ্যাঁ, নিয়েও গেলো সে। জনপদের বেশিরভাগ অংশ মুছে গেলো। শুধু হেলান দিয়ে জেগে রইলেন ঈশ্বর; হ্যাঁ, ২০১৩ সালের ১৬-১৭ জুনের সাঙ্ঘাতিক বিপর্যয়ের পরেও কেদারনাথ মন্দির জেগে আছে অমলিন। হিমবাহ যখন পাহাড় ভেঙে নেমে আসছে, ভেঙে পড়েছে গান্ধী সরোবরের পাড়, মন্দিরের পেছনে এসে ঠেকে দাঁড়ালো একটি বিশালাকৃতি বোল্ডারযেন ঈশ্বরের আরামকেদারার কুশন! মন্দির দাঁড়িয়ে রইল অনড়। মন্দিরের পেছন থেকে নেমে আসা উত্তাল বন্যা ঐ পাথরে বাধা পেয়ে দুভাগে ভাগ হয়ে ভেসে গেলো মন্দিরকে মাঝখানে রেখে। মানুষ বিশ্বাস করতো যে বাবা কেদারনাথ রক্ষা করবেন। কিন্তু ২০১৩ সালের হিমালয় সুনামি’, এই নামেই অভিহিত করা  হয়েছিল সেই বিপর্যয়কে যা সেই বিশ্বাসের উপরে বিরাট প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দিল।  হ্যাঁ, মন্দিরের কাঠামোয় কিংবা গর্ভগৃহে সেভাবে খুব বেশি আঁচ লাগেনি এটা ঠিক, কিন্তু মৃত্যুর হাহাকার উঠেছিল মন্দিরপ্রাঙ্গণে। হাজারে হাজারে মরেছিল। শবদেহের পূতিগন্ধে বাতাস ভারি হয়ে উঠেছিল। পাহাড়ে জ্বালানির অপ্রতুলতার কারণে সৎকারের জন্য মন্দাকিনীর তীরে প্রস্তুত করা হয়েছিল গণচিতা। তবুও নাকি সমস্ত শব পাওয়া যায়নি। এখনো নাকি পাথরের নিচে খুঁজলে মন্দিরের আশেপাশেই শবদেহ পাওয়া যাবে। এখনো নাকি ঘুরে বেড়ায় তাদের অতৃপ্ত আত্মা!  

কেদারনাথ মন্দির নিয়ে অজস্র লোককথা, রূপকথা। কেউ বলে এই মন্দির স্থাপন করেছিলেন আদি শঙ্করাচার্য্য অষ্টম শতাব্দীতে আবার কেউ বলেন মালব্যরাজ ভোজ তার রাজত্বের (১০৭৬-১০৯৯ খ্রিস্টাব্দ) সময়কালে বানিয়েছিলেন এই মন্দিরে। এই মন্দিরের উল্লেখ এমনকি মহাভারতেও পাওয়া গেছে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর, জ্ঞাতিহত্যার পাপ লাঘব করার জন্য পাণ্ডবরা বারাণসীর উদ্দেশ্যে রওনা হন। কিন্তু শিব দেখা দিতে আগ্রহী নন। তিনি পালিয়ে গেলেন হিমালয়ে। গুপ্তকাশীতে এক ষাঁড়ের ছদ্মবেশে লুকিয়ে রইলেন। কাশী থেকে পালিয়ে এসে শিবের এই লুকিয়ে থাকা, অর্থাৎ গুপ্ত থাকার স্থান হিসেবেই এই জায়গার এরকম নাম। শিব তো লুকিয়ে আছেন। যুধিষ্ঠির তপস্যাবলে জানতে পারলেন সে কথা। অমনি পঞ্চপাণ্ডব শিবকে খুঁজে বের করবার জন্য হিমালয়ে পৌঁছে গেলেন। গৌরীকুণ্ডের কাছে এসে দেখা পাওয়া গেলো সেই ষণ্ডের। স্বাভাবিকভাবে যে কাজে প্রচুর বলপ্রয়োগ প্রয়োজন সে কাজে মধ্যম পাণ্ডব এগিয়ে আসেন চিরকাল।  এখানেও তাই হল। ভীম দুহাতে একদম যেতে নাহি দিবস্টাইলে সেই ষাঁড়কে জড়িয়ে ধরতে গেলেন। বেগতিক দেখে শিব মাটির নিচে লুকিয়ে পড়ার চেষ্টা করলেন। পুরোপুরি পারলেন না। সেই ষণ্ডের পিঠের কুঁজ প্রকাশিত হল কেদারনাথে দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের অন্যতম একটি হিসেবে। ষণ্ডের নাভি,  দুহাত, মুখ ও জটা প্রকাশিত হল যথাক্রমে মদমহেশ্বর, তুঙ্গনাথে, রুদ্রনাথ ও কল্পেশ্বরে। কেদারনাথসহ এই পাঁচ তীর্থস্থান নিয়ে হল পঞ্চকেদার। আরেকটা গল্প  আছে যে একবার ব্রহ্মা আর বিষ্ণুর মধ্যে এই কেদার পর্বতে বসেই তুমুল ঝামেলা বাঁধলো সৃষ্টি নিয়ে। কে কোনটা বানিয়েছে, কে কোনটা বানাবে, ইত্যাদি আরকি! সত্যি কী কুচুটে দেবতা! দেবতারা যদি জনসমক্ষে ঝগড়া করেন, সেটা ভালো দৃষ্টান্ত নয়। তাই পাহাড়ে নির্জন জায়গায় গিয়ে ঝগড়া করা। ঝগড়া আর থামেনা। দুজনেরই কাজ বন্ধ। সৃষ্টি রসাতলে যাওয়ার দশা। বেগতিক দেখে শিব এলেন ঝগড়া থামাতে। ঝগড়া থামল; তারপর বিষ্ণু শিবকে কাকুতিমিনতি করে বললেন, কৈলাস থেকে যখন নেমেই এসেছেন, তাহলে দয়া করে এখানে থাকুন এবং মানবজাতিকে উদ্ধার করুন।  ব্যস, শিব অধিষ্ঠিত হলেন সেখানে (ছবি ১)। 

প্রত্নতাত্বিকদের মতে এই মন্দির নাকি প্রায় ৩০০০ বছরের পুরানো। যদিও মন্দিরগাত্রের উৎকীর্ণ  লিপিগুলির সময়কাল প্রায় ৬০০-৮৫০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ। চোরাবালি হিমবাহের ঠিক নিচেই এই মন্দিরের স্থিতি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সাড়ে তিন হাজার মিটার উপরে। কেদারনাথ মন্দিরের ঠিক উপরেই এই হিমবাহ থেকে উদ্গত মন্দাকিনী  নদীর সঙ্গে এসে মিশেছে পাশেই আরেকটি হিমবাহ থেকে বেরিয়ে আসা আরও একটি নদী, সরস্বতী। কেদারের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া মন্দাকিনী দুর্বার গতিতে পাহাড় কেটে তৈরি করেছে নিজের গতিপথ। মধ্য হিমালয়ের পশ্চিম ভাগে উত্তরাখণ্ডের কুমায়ুন হিমালয়ে অবস্থিত এই মন্দিরের শিব নাকি একান্তে থাকতে পছন্দ করেন। আসলে শিব নিজেও তো সেখানে সারাবছর থাকেননা। যখন বরফে ঢেকে যায় চারপাশ, শিব নিচে নেমে আসেন উখীমঠে। তাহলে কি শিব গরমের ছুটি কাটাতে উঠে যান কেদারে? হ্যাঁ, শুধুই প্রতি বছরে অক্ষয় তৃতীয়া থেকে কার্ত্তিক পূর্ণিমা অবধি কেদারে থাকেন এবং ভক্তজনকে কৃপা করেন। জানা যায় অবশেষে শিব পাণ্ডবদের কৃপা করেছিলেন। অবশ্য অত নাছোড় হলে কৃপা না করে পালাবেন কোথায়?  

কিন্তু বর্তমান সময়ের সভ্য মানুষ কি পঞ্চপাণ্ডবের থেকেও বেশি নাছোড়? এই প্রশ্ন মনে জাগা খুব স্বাভাবিক। পঞ্চপাণ্ডবের ক্ষেত্রে পুণ্যার্জনের তাগিদ ছিল সাঙ্ঘাতিক, কারণ তারা নিজের জ্ঞাতিগোষ্ঠীদের নিজেরাই খুন করেছিলেন, যদিও তাকে ধর্মযুদ্ধ বলা হয়েছিল। কিন্তু এখন? মানুষ কিসের আকর্ষণে এত ঝুঁকি সহ্য করে পৌঁছায় কেদারনাথে? কেন ওইরকম প্রাকৃতিক দুর্গম স্থানে গড়ে ওঠে বিশাল জনপদ? শুধুই কি মানুষের ভক্তি? নাকি লোভ?  মাত্রাতিরিক্ত ভক্তি কখন যে মানুষকে লোভের দিকে ঠেলে দিতে পারে, সেই উদাহরণ দেওয়া যেতেই পারে কেদারনাথ বিপর্যয়ের ঘটনা থেকে।   

ভক্তের দল ভিড় বাড়াবেন মন্দির ঘিরে, এ তো স্বাভাবিক। কিন্তু শিব স্বয়ং যে ভিড় এড়ানোর জন্য ঐ দুর্গম স্থানে বাসা বেঁধেছেন, এ কথার মর্ম এখন সভ্য মানুষের মগজে ঢুকলে তো! পাণ্ডবদের এড়িয়ে হিমালয়ে পালিয়ে যাওয়ার যে গল্প, সে হয়তো নিছক রূপকথা নয়। শিব চাননা যে বিশাল সংখ্যক মানুষ এসে ভিড় করুক তার চারপাশে। ভক্তির কষ্টিপাথরে কি ভগবান যাচাই করে নিতে চান ভক্তকে? তাই কি এই দুর্গম অঞ্চলে তার মন্দির? নাকি এই স্থান দুর্গম বলেই শিব স্বয়ং চাননি যে তাকে ঘিরে ভিড় জমুক। আসলে এই স্থান শুধু দুর্গম নয়, সাঙ্ঘাতিক বিপদসঙ্কুলও বটে। এই অঞ্চলের বসবাসী মানুষই হয়তো বহুযুগ ধরে এই অঞ্চলের ভূপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করে এরকম গল্পকথার জন্ম দিয়েছিল যে শিবঠাকুরকে পাহাড়ে গিয়ে বিশেষ বিরক্ত করা অনুচিত।     
   
ইন্ডিয়ান প্লেট এবং ইউরেশিয়ান প্লেটের সংযোগস্থলে ধাক্কা লেগে তৈরি হয়েছে হিমালয় (ছবি ২)। প্রায় ৫ কোটি বছর আগে শুরু হয়েছিল এই তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়া। তারও অনেক আগে এখানে ছিল সমুদ্র। সামুদ্রিক প্রাণীর জীবাশ্ম থেকে শুরু করে আরও নানাবিধ ভুতাত্বিক প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে যে এখন যেখানে হিমালয়, একসময় সেখানে ছিল টেথিস সাগর। ছিল বটে, এখন আর নেই। এখন তো পাহাড়। হ্যাঁ, পাহাড় বটে, কিন্তু এই পাহাড় তৈরির প্রক্রিয়া জারি আছে এখনো। দুই প্লেটের ধাক্কাধাক্কি চলছে। সেই কারণে হিমালয় পর্বতমালার পুরো অঞ্চলটিই প্রচণ্ড ভূমিকম্প প্রবণ। পৃথিবীর বয়সের তুলনায় হিমালয় যে শিশু। শিশুর চঞ্চলতা নিয়ে নির্মিত হয়ে চলেছে তার শরীর। পর্বতশৃঙ্গের হিমবাহগুলি থেকে যেসব নদী নেমে আসছে শিশুর উচ্ছলতা নিয়ে, তাদের চলার পথে বিশেষ কোনো বাধা থাকলে তারা অনায়াসে সরিয়ে পথ করে নিতে চায়। পাহাড় কেটে নামছে জলধারা প্রবল গতিবেগে, বর্ষার জল পেলে খুব স্বাভাবিক কারণেই তারা ফুলেফেঁপে ওঠে, ভেঙে আনে পাথর। পাহাড়ে নামে ধস। ভূমিকম্প এবং ধস এই দুটি বিপদ লুকিয়ে আছে হিমালয়ে সর্বদা। ধস নামার প্রবণতা বর্ষাকালে বেশি। সেই সময়ে পাহাড়ে ফুলেফেঁপে ওঠা নদীর শোভা অতুলনীয়। কিন্তু সেই নদীর প্রতি বাঁকে বিপদ। আর ভূমিকম্পও অনেকক্ষেত্রেই ধসের কারণ। সর্বদা যে বেশিমাত্রায়  ভূমিকম্প পাহাড়ে ঘটে এমন নয়। মানুষে হয়তো বুঝতে পারেনা এমন ছোটখাট কম্পন যা যন্ত্রে ধরা পড়ে, সেরকম কম্পন পাহাড়ে লেগেই থাকে। কারণ ঐ দুই প্লেট একটা আরেকটার ঘাড়ে উঠতে চাইছে, ফলে ধাক্কাধাক্কি এবং কম্পন। ছোটখাট কম্পন হলেও পাহাড়ে ধস নামে। উপরন্তু কেদারনাথ এলাকার যে ভূতাত্বিক চরিত্র, সেও খুব সুবিধের নয়। MCT (Main Central Thrust) অর্থাৎ হিমালয় পর্বতমালার পূর্ব-পশ্চিম বরাবর যে কেন্দ্রীয় প্রধান চ্যুতি বিস্তৃত হয়ে রয়েছে, সেই চ্যুতি এই অঞ্চলের খুবই কাছে (ছবি ২)। এখন, এরকম বিপদসঙ্কুল স্থানে যদি প্রচুর মানুষ ভিড় জমায়, তাহলে বিপর্যয় এলে তারা কি পালাবার পথ পাবে? অসম্ভব। সেই কারণেই কেদারনাথে এত মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। এখনো সঠিক হিসেব পাওয়া যায়নি, ঠিক কত মানুষের প্রাণ গিয়েছিল এবং কতটা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল।   

হিমালয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে যারা পাহাড়ের আদিবাসী, অতীতে তারা কোনোদিন কংক্রিটের গাঁথনিওয়ালা বাড়ি বানাতো না। হাল্কা কাঠের ঘর কিংবা হাল্কা ছাউনিওয়ালা কুঁড়েতে থাকতো। যারা তীর্থ করতে যেতেন, তারাও গুহা কিংবা    কুঁড়েঘরের চটিতে থাকতেন, এ বর্ণনা অতীতে হিমালয়ের ভ্রমণকাহিনীতে পাওয়া যেত। হাল্কা বাড়ি বানাবার অন্যতম কারণ ছিল যাতে ভূমিকম্প কিংবা ধসের বিপদ এলেও বিশাল ক্ষয়ক্ষতি কিছু না হয়। তাছাড়া পাহাড়ের গ্রামবাসী এবং তীর্থযাত্রীর সংখ্যাও অতীতে ছিল হাতেগোনা। ধীরে ধীরে এলো উন্নয়নের ভাবনার নামান্তরে ট্যুরিজম জমিয়ে তোলার  ব্যবসা। ব্যস, হোটেল, বহুতল ইত্যাদি তৈরি হওয়া শুরু হল। পার্বত্য প্রকৃতির মাঝে এইধরণের কাঠামো আরও বিপদ ডেকে আনে। প্রথমত, বেশি বেশি বাড়িঘর তৈরি হওয়ায় পাহাড়ে স্থায়ী-অস্থায়ী  সবধরণের জনসংখ্যা বাড়তে শুরু করলো, দ্বিতীয়ত ভূমিকম্প, ধস, বন্যা ইত্যাদি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময়ে এই ভারি  কাঠামোওয়ালা বাড়ি চাপা পড়ে প্রাণহানি হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে গেলো। নির্মাণ যে সবসময় অনুমোদিত প্ল্যানমাফিক হয় এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। বাড়ি, হোটেল, রেস্তোরাঁ, দোকানপাট গজিয়ে ওঠে এন্তার। রাস্তা কাটবার সময় পাহাড়ের ঢালে যথেচ্ছ বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। অনেকক্ষেত্রেই এর ফলে পাহাড়ের ঢালগুলির প্রাকৃতিক স্বাভাবিক স্থিতি ব্যাহত হয় এবং বেড়ে যায় ধস নামবার সম্ভাবনা। এছাড়া নদীখাতে কিংবা পাহাড়ের ঢালে অনেকসময় যথেচ্ছ খননকাজও চলতে দেখা যায় প্রাকৃতিক খনিজ আহরণের জন্য। পাহাড়ের নদীতে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ে তোলাও কিন্তু অনেকক্ষেত্রেই ব্যাহত করছে নদীর স্বাভাবিক গতিপথ। সেইজন্যই উল্লেখ করেছিলাম সভ্য মানুষের লোভের কথা। এর উপর আছে একদিকে মানুষের পুণ্যার্জনের অদম্য লোভ, সাঙ্ঘাতিক ভ্রমণেচ্ছা বা ভ্যান্দেরলুস্তএবং অন্যদিকে টুরিস্ট  আকর্ষণের জন্য হোটেলব্যবসা বাড়িয়ে তোলার লোভ, এই দুটো পরস্পর পরিপূরক কারণ। সবকিছু মিলিয়ে ভঙ্গ হল পাহাড়ের নির্জনতা; কেদারনাথের পাহাড়ে শিবঠাকুরের শান্তিতে গরমের ছুটি কাটানোর ইচ্ছে একেবারে মাথায় উঠল। 
     
শিবঠাকুরের শান্তি পছন্দ। এমন শান্তি যে বরফের নিচে ঘুমিয়ে থাকতে ভালোবাসেন তিনি। হ্যাঁ, জানা গেছে যে প্রায় চারশো বছর এই মন্দির ছিলো বরফের নিচে। দেরাদুন ওয়াদিয়া ইন্সটিট্যুটের ভূবিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে জানিয়েছেন আনুমানিক চতুর্দশ শতক থেকে প্রায় সপ্তদশ শতকের মধ্যভাগ, এই সময়কালের মধ্যে বরফে ঢাকা ছিল এই মন্দির। হিমবাহ অনেকখানি এগিয়ে এসেছিল সেই সময়কালে, হিমবাহের সেই রেখাচিহ্ন মন্দিরের গায়ে দেখেই বিজ্ঞানীরা এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে মন্দির বহুবছর বরফের নিচে চাপা পড়েছিল। এছাড়াও একরকমের ছত্রাক, লাইকেন, যেগুলো পাথরের গায়ে জন্মায় শীতল আবহাওয়ায়, সেই লাইকেনের বিস্তার ইত্যাদি থেকেও জানা সম্ভব হয়েছে যে হিমবাহ কতখানি সময় ধরে ঢেকে রেখেছিল এই মন্দিরটিকে। হিমবাহ খুবই ধীরে বয়ে যায় এবং হিমবাহের শরীরের মধ্যে যে  শুধুই বরফ থাকে, এমন তো নয়! পলিমাটি, পাথরের টুকরো টাকরা এসবও প্রচুর পরিমাণে থাকে। এগুলো সবসুদ্ধ মিলে ঢেকে রেখেছিল মন্দিরটা। মন্দিরের ভিতরগাত্রের পাথরও সেই হিমবাহের চলনের ফলে এক অদ্ভুত প্রাকৃতিক পালিশ নিয়েছে আপনাআপনি। ২০১৩ সালের ঐ বিপর্যয়ে মন্দিরটির সাঙ্ঘাতিক কোনো ক্ষতি না হওয়াতে বিশেষজ্ঞরা বিশেষ অবাক হননি, কারণ এই মন্দির বহুযুগ ধরেই প্রাকৃতিক চরম আবহাওয়া এবং বিচিত্র বিপর্যয় সামলে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।    
        
কেদারনাথের ২০১৩ সালের বিপর্যয়ে অবশ্য কোনো ভূমিকম্প হয়নি। হয়েছিল মেঘ বিস্ফোরণ। এরকম ঘটনাও বর্ষায় ওইরকম পার্বত্য উচ্চতায় খুব অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে এক্ষেত্রে বিশেষ সমস্যার সৃষ্টি করেছিল চোরাবালি  হিমবাহ। হিমবাহের সম্মুখে বরফগলা জল দিয়ে যে প্রাকৃতিক হ্রদ গান্ধী সরোবরতৈরি হয়েছিল, অতিরিক্ত বৃষ্টিতে ধসে গেলো হিমবাহের মোরেন বাহিত পাথরে নির্মিত সেই হ্রদের একপাশের পাড়। সমস্ত জল এবং মোরেনবাহিত পলি গিয়ে পড়ল মন্দাকিনীর খাতে। সেই কারণেই নদী হয়ে উঠল ভীষণা, প্রাণঘাতী। তাছাড়া জনপদের ঘনত্ব বাড়লে নদীর ক্ষতি হয় নানাভাবে। সেই ক্ষতি নদী যতক্ষণ জীবিত থাকে মেনে নেয়না, প্রতিশোধ সে নেবেই কোনো না কোনোভাবে।  এক্ষেত্রেও কিছুটা সেটাই হয়েছিল।  গ্রীষ্মে হয়ত নদীর কিংবা শাখানদীগুলির খাত শুষ্ক থাকে, অথচ বর্ষায় হড়পা বান এলেই তাদের মেজাজ  বদলে যায়। পার্বত্য অঞ্চলে এ অতি স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু নদীর পাশে জনপদের ঘনত্ব বেড়ে যাওয়ার কারণে, মানুষ যদি গ্রীষ্মের শুষ্ক খাত সভ্যতার বর্জ্যে ভরিয়ে রাখে, তাহলে নদী কোথায় যাবে? কোথায় যাবে সেই বন্যার জল? সে কি তখন জনপদসমেত মানুষকে ভাসিয়ে নেবার চেষ্টা করবেনা? আসলে শিব ক্রুদ্ধ হলে যে তাণ্ডবনৃত্য করে মহাপ্রলয় ঘটিয়ে দিতে পারেন, সে কথা ভক্তদের স্মরণে ছিল না সম্ভবত। সভ্য মানুষ আজ প্রকৃত ভক্তির স্বরূপ ভুলে গেছে এবং এখনো সম্পূর্ণ উদ্ঘাটন করে উঠতে পারেনি প্রকৃতির খামখেয়ালী আচরণের পিছনে নিহিত বিজ্ঞানের সমস্ত খুঁটিনাটি। অবশ্য বিজ্ঞানীদের কথা এবং রিপোর্ট চাপা পড়ে যেতে পারে বিভিন্নরকম ক্ষুদ্রস্বার্থের চরিতার্থতায়, ঠিক যেভাবে মন্দির লুক্কায়িত ছিল হিমযুগে।

বিপর্যয়ের পরে মন্দাকিনী নদী যেরকম গতিতে ঐ এলাকায় পলি এবং মাটিপাথর এনে জমা করেছিল, সে জিনিস কোনো মানুষ এমনকি যন্ত্র দিয়েও তড়িঘড়ি সরানো সম্ভব ছিলনা। তাছাড়া সেসব ইচ্ছেমত সরালেই তো আর হবেনা। আবার সে জঞ্জাল নদীখাতে ফেলা সম্ভব নয়। তাহলে নদীর গতিপথ রুদ্ধ হতে পারে। পাহাড়ি এলাকায় যেকোনো ঢালে নিয়ে গিয়ে সেটা ফেললে আবার সেই এলাকায় ধস নামতে পারে। কাজেই এই কাজে বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন প্রয়োজন। সেইসময় বিশেষজ্ঞরা রিপোর্ট দিয়েছিলেন ধীরেসুস্থে ঐ জঞ্জাল সরাবার পরে অন্ততঃ পাঁচবছর অপেক্ষা করা হোক। তাছাড়া ঐ অঞ্চলের ভূমিত্বক একেবারে শিথিল হয়ে গিয়েছিল। মৃত্তিকার সমস্ত কণা এবং বয়ে নিয়ে আসা পলিমাটি থিতিয়ে যাবার জন্য এবং মাটি শক্ত হবার জন্য ওইটুকু সময় প্রয়োজন ছিল। তার মধ্যে আবার নতুন করে আশেপাশে কোনোরকম নির্মাণকাজ যেমন- রাস্তা, আশ্রম কিংবা হোটেল ইত্যাদি একেবারেই সমীচীন নয়। অথচ এই কথা একেবারেই পাত্তা দেওয়া হয়নি। একবছরের মধ্যেই আবার সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছিল কেদারনাথের পথ। ভূমিত্বক নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সমস্ত রিপোর্ট অগ্রাহ্য করে আবার মন্দিরকে ঘিরে নানাবিধ নির্মাণকাজ শুরু করে দেওয়া হলো সময়সীমা পূরণ হবার আগেই। তাহলে কি আবার আরেকটা বিপর্যয়ের পথ প্রশস্ত হল না এরকম হঠকারী সিদ্ধান্তে?  

কেদারনাথের মত বিপদসঙ্কুল জায়গায় প্রতিনিয়ত কিছু সাবধানতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। যেমন, যেকোনো নির্মাণকাজ করবার আগে ভূবিজ্ঞানী এবং পরিবেশবিদদের মতামত ভালোভাবে বিবেচনা করা প্রয়োজন। আবহাওয়ার সব খুঁটিনাটি যেমন বাতাসের গতিবেগ, বৃষ্টিপাতের পরিমাণ, বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ এবং নদীতে বান আসবার সম্ভাবনা, এসমস্ত বিষয়ে এই এলাকাকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণের আওতায় রাখা দরকার। আশেপাশের গ্রামগুলিতে নিকাশি ব্যবস্থার বিশেষ উন্নতি করা প্রয়োজন। যদি দেখা যায়, কোথাও ভীষণ বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছে এবং নদীতে জলের স্তর বেড়ে চলেছে, সেক্ষেত্রে আরও জোরদার সতর্কীকরণ ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। বিশেষ ঋতুতে, যেমন বর্ষাকালে নদীগুলির জলস্তরের দিকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ জারি রেখে তথ্য সংগ্রহ করা দরকার। আবহাওয়ার পূর্বাভাস ইত্যাদি বিবেচনা করে হড়পা বান আসবার আগে যাতে গ্রামকে গ্রাম খালি করে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার বন্দোবস্ত করা যায়, সেই বিষয়ে বিপর্যয় মোকাবিলা টিম সুসংগঠিত থাকা প্রয়োজন। এই পদক্ষেপগুলি বিপর্যয়কে আটকাতে পারবেনা এটা ঠিক, তবে অবশ্যই প্রাণহানি এবং সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব। স্থানীয় মানুষজনের মধ্যেই বিশেষ ট্রেনিং দিয়ে টিম তৈরি করে রাখা প্রয়োজন, যাতে তারা ভূমিকম্প, ধস, হড়পা বান এরকম বিপর্যয়ের সময় কী কী করা দরকার সে বিষয়ে নিজেরা এগিয়ে এসে কাজ করতে পারে। প্রযুক্তিগত কৌশল ব্যবহার করে কীভাবে আবহাওয়া ইত্যাদির আগাম খবর স্থানীয় মানুষজনের পক্ষে জানা সম্ভব, অথবা ধস ইত্যাদির কারণে ভুমিক্ষয় রোধ করবার জন্য কী কী করা দরকার, এরকম সাধারণ  বিষয়গুলি নিয়ে স্থানীয় মানুষদের শিক্ষিত করা বিশেষ প্রয়োজন। পাহাড়ের ধাপ কেটে কেটে সেখানে চাষবাসের মাধ্যমে জীবিকানির্বাহ করাও সম্ভব, আবার পাহাড়ের ঢালের ভূমিক্ষয় রোধ করাও সম্ভব। এছাড়া নদীর ধারের জমিতে প্রচুর গাছ লাগিয়েও ভূমিক্ষয় অনেকখানি কমানো যেতে পারে। কাজেই এরকম বিষয়ে ঐ অঞ্চলে আরও সচেতনতা ছড়িয়ে দেবার প্রয়োজন আছে।


বর্তমান সময়ে যে প্রশ্নটা সবচেয়ে বড় হয়ে উঠেছে যে আমরা কি সত্যিই কিছু শিক্ষালাভ করেছি এই বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে? পৃথিবী, প্রকৃতি ক্রমাগত বদলে যাচ্ছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। বাড়ছে ভূপৃষ্ঠের গড় উষ্ণতা। হিমবাহের গলন বাড়ছে। কেদারনাথের কাছে চোরাবালি হিমবাহের মুখে আরও অনেক উচ্চতায় যেখানে বরফ গলবার কথা নয়, সেখানেও বরফ গলে গিয়ে তৈরি হয়েছে প্রাকৃতিক হ্রদ (ছবি ৩)। আবার যদি মেঘ বিস্ফোরণ হয়, তাহলে আবার  হিমালয় সুনামিঘটবার সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায়না। কেদারনাথ সামলে নিয়েছে যুগ যুগ ধরে বহু প্রাকৃতিক আঘাত, বিপর্যয়। এখন সভ্যতার হাতে রয়েছে একে রক্ষা করবার চাবিকাঠি। সভ্যতা কতখানি পারবে এই দায়িত্ব পালন করতে সেই জবাব আছে শুধুমাত্র সময়, অর্থাৎ মহাকাল কিংবা স্বয়ং শিবের কাছেই। 

নন্দিনী সেনগুপ্ত: কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত

                       
ঋণস্বীকারঃ
1 Dobhal et al. 2013. Kedarnath disaster: facts and plausible causes. CURRENT SCIENCE, VOL. 105, NO. 2, 25 JULY 2013
2 Google map
3. Kedarnath  wikipedia page.
4.  Prakash P. (2018). Study the 2013 Flood Damages and Risk Assessment in Kedarnath, Himalaya Area Using Geoinformatic Techniques. Journal of Geography and Natural Disasters, vol.8.1. DOI: 10.4172/2167-0587.1000216
5. USGS earthquake internet site

ছবিগুলির ক্যাপশান
ছবি ১ নানা বিপর্যয় সামলে অবিচল দাঁড়িয়ে আছে কেদারনাথ মন্দির।
ছবি ২ ইন্ডিয়ান প্লেট এবং ইউরেশিয়ান প্লেটের সংযোগস্থলে তৈরি হয়েছে ভঙ্গিল পর্বত হিমালয়। তিরচিহ্ন দিয়ে প্লেট এবং চ্যুত হয়ে যাওয়া ভুত্বকের আপেক্ষিক গতির অভিমুখগুলি বোঝানো হয়েছে।
ছবি ৩ চোরাবালি হিমবাহের চেহারা অতীতের তুলনায় শীর্ণ হয়ে এসেছে সেটা উপগ্রহ চিত্র থেকে বোঝা যাচ্ছে। হিমবাহ গলে গিয়ে আশেপাশে অনেক প্রাকৃতিক হ্রদ তৈরি হচ্ছে যেগুলির অবস্থান লাল উপবৃত্ত দিয়ে দেখানো হয়েছে।  



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন