তোমার কথা এরা কেহ তো বলেনা




প্রবন্ধ

বর্ষার প্রতি বাঙালির একটা আলাদা টান আছে। আর পাঁচটা ঋতুর থেকে সে আলাদা। বর্ষা  বাঙালির "বিদ্বজ্জন" ঋতু। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে,আমাদের ভালোবাসাটা চিরকালই প্রাতিষ্ঠানিক।  ছুটির দুপুর। খিচুড়ি ও ইলিশমুখরিত অঝোর বর্ষা। কী গভীর আবেদন! কিংবা রাত্রে শুতে গেলেন,ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। বর্ষাকে বেটোফেনের মতো মায়াবী মনে হ'ল আপনার। এই তো ভালোবাসা।  কিন্তু কিন্তু কিন্তু;অফিসে যাবার সময় যদি বৃষ্টি আপনার কাঁধে হাত রাখে,অথবা যদি কাজের সময় আপনার সামনে এসে দাঁড়ায়,কিংবা ধরুন নাছোড় বৃষ্টিতে লোডশেডিং হয়ে বন্ধ হ'ল "করুণাময়ী রাণি রাসমনি"! সে কি পাবে আপনার ভালোবাসা? তখন বর্ষার সাথে আপনার এক বর্ষাতি দূরত্ব। এবার যদি মেঘের অভিমান হয়,তাকে কি দোষ দেওয়া চলে? বর্ষা তো মেঘের কবিতা। প্রাতিষ্ঠানিক এই ভালোবাসার প্রতি গর্জে উঠতে পারে মেঘের কবিমন। এমনই এক মেঘ-অভিমানের নাম রবীন্দ্রনাথ!

চিরকাল প্রাতিষ্ঠানিকতার বিরুদ্ধে লড়ে গিয়ে কবে যেন নিজেই হয়ে গেছেন বাঙালির সবচেয়ে বড়ো প্রতিষ্ঠান।  বাঙালায় তেমন ব্যবসা নেই তো কী;রবীন্দ্রনাথ তো আছেন।  আর কী চাই। বছরভর "হরির লুট"।  গীতাঞ্জলীর কয়েক কোটি সংস্করণ। গীতবিতান আরো কয়েক হাজার। প্রতি গলিতে রবীন্দ্রমূর্তি। প্রতি ব্লকে একটা করে রবীন্দ্রভবন।  হাজারখানেক রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষাকেন্দ্র। লক্ষাধিক সিডি-ডিভিডি। পঁচিশে বৈশাখ বাইশে শ্রাবণ। বাঙলাময় রবীন্দ্রপ্লাবন।  জমজমাট রবীন্দ্রব্যবসা! তবে ভুল করেও ভাবার কোনও কারণ নেই যে সবাই রবীন্দ্রনাথ পড়ছেন। রবীন্দ্রনাথে বোঝার একবিন্দু দায়ও অধিকাংশের নেই।  বুঝলে এই বাংলায় অনেক সমস্যার সমাধান এমনিই হয়ে যেতো। তবুও চারিদিকে মারাত্মকভাবে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের ছায়া। কিন্তু কেনো? শুধুই কি অনন্যসাধারণ কবিতা? চিরসবুজ রবীন্দ্রসংগীত? শান্তিনিকেতন? আসলে এইসবকিছুকে একছাতার তলায় নিয়ে এসে দানবিক এক ভাবমূর্তি তৈরি করে দিল নোবেল পুরস্কার। সবাই একধাক্কায় পদতলে। কিন্তু তাতে রবীন্দ্রনাথের কী? কেউ কি বুঝেছে রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠার ব্যথা? কেউ কি পড়েছে বিচ্ছেদের পাণ্ডুলিপি? ভিড়ের মাঝে বিশাল একজন একার নাম রবীন্দ্রনাথ। আলোর দিনে যারা মালা পড়িয়েছে,অন্ধকারে তাদের ছায়াও পাশে থাকেনি।  সুযোগ পেলে কাদা মাখাতে পিছিয়ে যায়নি অনেকেই। রবীন্দ্রনাথ জানতেন।  রবীন্দ্রনাথরা এসব জানেন বলেই বৃষ্টি নেমে আসে কলমের ঠোঁটে।  

পৃথিবীতে আর কোনো কবি প্রায় একার চেষ্টায় একখানা এমন বিশ্ববিদ্যালয় গড়েছেন কি? আমার অন্তত জানা নেই। শান্তিনিকেতন। সেময়ের ব্রহ্মচর্যাশ্রম। কোথাও চাপিয়ে দেওয়া হয়নি নিয়মের পাথর। সবাই যেন পরম আন্তরিকতায় লালন-পালন করছে নিয়মের সংসার। কেন্দ্রে রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁকে ঘিরে উৎসর্গ কিছু প্রাণ। প্রাণের আরাম।  

সেময় আর এসময়ে চিরকালই অনেক অমিল।  কিন্তু এই দু'জনের অন্ত্যমিলের মতোই একই থেকে গেছে শিশুদের মন। তাই সেকালে বা একালে পুজোর ছুটির পরে শিশুমন কাঁদে। আবার সেই পড়াশুনার ঝক্কি। শান্তিনিকেতনও এর ব্যতিক্রম নয়। সেবার অর্থাৎ ১৯১৩ সালের ১০ নভেম্বর পুজোর ছুটি শেষে খুলেছে শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়।  ছাত্ররা ফিরে এসেছে। তাদের অনেকের মন তখনও ফেরেনি ফেলে আসা বাড়ি,আত্মীয়-স্বজনদের থেকে। এমন আবহে ১৫ নভেম্বর সেসময় শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের সর্বাধ্যক্ষ শ্রী জগদানন্দ রায় ঘোষণা করলেন চার দিনের ছুটি! শিশুমহলে আনন্দের অকালবোধন। শুধু শিশু কেন গোটা শান্তিনিকেতন যেন অশান্ত হয়ে উঠেছে কোনো অজানা সুখে।  

সুখ আর শান্তির মাঝে যে সূক্ষ্ম পার্থক্য,তাকে বোঝার জন্যই তো শান্তিনিকেতনের ছাতিমতলা।   কিন্তু সেদিন যেন শান্তিনিকেতন সুখে ভেসে গ্যালো। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ভেসে গেলেন না। তিনি বরাবরের মতো শান্তির খোঁজে।  শান্তি "অধরা মাধুরী"। ৩ নভেম্বর দু'টো লাইন লিখেছেন -"রস যেথা নাই সেথা যত কিছু খোঁচা। মরুভূমে জন্মে শুধু কাঁটাগাছ বোঁচা"। ভাবসম্প্রসারণ করার প্রয়োজন বোধ করেননি কেউ।  এই মুহূর্তে শান্তিনিকেতনে কেমন পাগল-পাগল হাওয়া।  রবীন্দ্রনাথ এসব থেকে দূরে।  বরাবর এসব থেকে দূরে থাকা কবির ঋষিপ্রতিম বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথের মনেও কেমন আনন্দধারা।  ছোটভাইকে স্নেহচুম্বন করেছেন তিনি।  রবীন্দ্রনাথ কেমন যেন নির্লিপ্ত।  

বছর খানেক আগের কথা। ১৯১২ সালে সুইডেনে বিদ্বজ্জন সমাজে হইচই ফেলে দিয়েছেন টমাস মুর। ভদ্রলোকের পুরো নাম টমাস স্টার্জ মুর। ইনি কে? ১৯১১ সালে টমাস মুর সুইডেনে গ্রেট ব্রিটেনের রয়্যাল সোসাইটি অব্ লিটারেচারের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে অভিষিক্ত হন।  তাঁর কাজ ছিল মূলত ইংল্যান্ডের দিক থেকে নোবেল প্রাইজের ব্যাপারটা দেখা। এই পর্যন্ত কোনো অস্বাভাবিকত্ব নেই। দায়িত্ব পাওয়ার একবছরের মাথায় যে তিনি এমন কাণ্ড ঘটিয়ে বসবেন তা কারুর মাথাতেই আসেনি। টমাস স্টার্জ মুর কিনা একান্ত অপরিচিত জনৈক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নোবেল প্রাইজ দেওয়ার জন্য সুপারিশ করে বসলেন সুইডিশ অ্যাকাডেমির কাছে! ঝড় আর কবে বলে কয়ে আসে। সুইডিশ অ্যাকাডেমিতে ঝড় উঠল।  রবীন্দ্রনাথ এবং সেইসময়ের আপামর বাঙালি কিংবা ভারতবাসী কেউ এসবের কিছুই জানতে পারলেন না। সুতরাং যে বাঙালি বিদেশে প্রলয় তুললেন তিনি স্বদেশে মৃদুমন্দ সুশীল বাতাস হয়ে থাকতে বাধ্য হলেন। তাতে অবশ্য তাঁর কিছু এসে গ্যালো না। ওই একই সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তক-নির্বাচনী-সমিতি রবীন্দ্রনাথের পাঠসঞ্চয়'কে মনোনয়ন দিলেন না।  বাঙলার বাঘ আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর।  তিনি ছোট করে হলেও গর্জন করেছিলেন। আরও ৬ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথকে সাম্মানিক ডক্টর অব্ লিটারেচার দেওয়ার প্রস্তাব দিলেন তিনি। সিন্ডিকেট প্রস্তাবটিকে সিনেটের কাছে পাঠিয়ে শান্ত হল। ব্যস এইটুকুই। এর কিছুদিনের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথ নোবেল পাবেন।   আর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় গর্বচিত্তে ভাববে - মালা পরাইনি তো কী;মালা পরাবো ভেবে তো ছিলাম। নোবেল-পূর্ববর্তী কবির একটি চিঠি। প্রাপক বিশিষ্ট দার্শনিক শ্রী সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত।   তারিখ ২ নভেম্বর, ১৯১৩ :

    "কোনোদিন উপাধির অপদেবতা আমার স্কন্ধে ভর করিবে এমন আশঙ্কা স্বপ্নেও আমার মনে আসে নাই। অবশেষে বনগমনের বয়সে সেটাও ঘটিল।  আমার নামটার সঙ্গে একটা আওয়াজের যন্ত্র বাঁধিয়া দিয়া বিধাতা এ কি কৌতুক করিলেন? ঝুমঝুমি সাপের পুচ্ছিদেশে ভর করিয়া  তাহার নকীব তাহার আগমন ঘোষণা করিতে থাকে - আমার মতো নিরীহ জীবের পক্ষে তো সেরূপ বিধান অনাবশ্যক। আমার কাব্যলক্ষ্মীর মাথায় এতদিন যে ঘোমটা ছিল সে ভালই ছিল,বিশ্ববিদ্যালয় সেটাকে সভাস্থলে উন্মোচন করিয়া যখন তাহার মাথায় পাগড়ি পরাইয়া দিবে তখন সেটা কিছুতেই মানাইবে না। "

কাকে কী মানাবে সে তো আগে থাকতেই স্থির করা।  আমরা শুধু নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট স্থানে হাজিরা দেব। এই যেমন রয়্যাল সোসাইটি অব্ লিটারেচারে হাজির হয়েছেন টমাস মুর। তাঁর প্রস্তাবে আলোড়িত হচ্ছে গোটা নোবেল কমিটি। তারা ঠিক করেছে টমাস মুরের প্রস্তাবটির গ্রহণযোগ্যতা বিচারের জন্য এক-সদস্যের কমিশন গঠন করা হবে। দায়িত্ব বর্তায় অ্যাকাডেমিশিয়ান পের হ্যালস্ট্রম-এর উপর।   ২৯ অক্টোবর ১৯১৩ হ্যালস্ট্রম তাঁর রিপোর্ট শেষ করেন। তিনি রিপোর্টে লিখছেন : "the small collection of poems create such a surprisingly rich and genuinely poetic impression that there is nothing odd or absurd in the proposal to reward it even with such a distinction as it is a question here." মারাত্মক, অন্তত তৎকালীন য়্যুরোপের জন্য,একটি বাক্য লিখেছেন তিনি এই রিপোর্টে : "something more remarkable than anything that European poetry has to offer at present" ভাবা যায়! হ্যালস্ট্রম তাঁর রিপোর্ট শেষ করেছেন এইভাবে- " It is certain, however, that no poet in Europe since the death of Goethe in 1832 can rival Tagore in noble humanity, in unaffected greatness, in classical tranquility."

য়্যুরোপে না থাকুকবাঙলায় সেসময় রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর সাহিত্যের অনেক "rival"তাদের হিংসার দীর্ঘশ্বাস দীর্ঘতর হচ্ছিল প্রতিদিন। বিভিন্ন পত্রিকায় বা সভায় কবিকে আক্রমণ করাই ছিল কিছু মানুষের কাজ। সজনীকান্ত দাশের "শনিবারের চিঠি"-র বাঁকা দৃষ্টিই হোক,কিংবা দ্বিজেন্দ্রলালগোষ্ঠীর কর্দমাক্ত বিরোধিতা কিছুই অজানা ছিল না রবীন্দ্রনাথের।  এসব জানার কথা নয় পের হ্যালস্ট্রমের।  তিনি শুধু এটুকুই জানতেন যে তাঁর এই রিপোর্ট নেহাতই নিয়মমাফিক। আদতে মূল্যহীন।  হলও তাই;নোবেল কমিটির তৎকালীন সভাপতি হ্যারল্ড হ্যাজার্ন-এর কমিটি পুরস্কারের জন্য রবীন্দ্রনাথের নাম অনুমোদন করলেন না। ইংল্যান্ডের রয়্যাল সোসাইটি অব্ লিটারেচারের ৯৭ জন সদস্য থমাস হার্ডির নাম প্রস্তাব করলেন এই পুরস্কারের জন্য। কিন্তু Poetic Justice 'লে একটা কিছু চিরকালই ছিল।  হ্যারল্ড হ্যাজার্ন-এর অকালমৃত্যুতে কমিটির নতুন সদস্য হন সেই পের হ্যালস্ট্রম। কিন্তু কার্যত রবীন্দ্রমুগ্ধ হ্যালস্ট্রম ছিলেন কমিটিতে একা। তিনি কিছুই করে উঠতে পারছিলেন না এই বাঙালীর জন্য।  

বাঙলা ভাষা কিন্তু বাঙালীর থেকে দ্রুতগামী এবং বহুবিস্তৃত। প্রমাণ?১৯১৩-র ইন্টারনেটহীন দুনিয়ায় নোবেল কমিটিতে এমন একজনের সন্ধান পাওয়া গ্যালো যিনি বাঙলা জানেন! বাঙলা নিয়ে যাঁর সুগভীর পড়াশুনা! তিনি সুইডেনের বিখ্যাত কবি Esaias Tegner এর পৌত্র,বৃদ্ধ প্রাচ্যবিদ Esaias Henrik Tegnerইনি রবীন্দ্রনাথের হয়ে সওয়াল করলেন।  পাশে এসে দাঁড়ালেন আরও একজন,যাঁকে অমান্য করা নোবেল কমিটির পক্ষে কার্যত অসম্ভব ছিল। সুইডেনের সমসাময়িক শ্রেষ্ঠ কবি Carl Gustaf Verner Von Heidenstam রবীন্দ্রনাথের পরেই সাহিত্যে নোবেল পাবেন এই কবি।  আপাতত এক কবির হয়ে কলম ধরেছেন আরেক কবি –

          "I was deeply moved when I read them and I do not remember having read any lyric writing to equal them during the past twenty years or more. They gave me hours of intense enjoyment; it was like drinking water of a fresh, clear spring. The intense and loving piety that permeates his every thought and feeling, the purity of heart, the noble and natural sublimity of his style, all combine to create a whole that has a deep and rare spiritual beauty. There is nothing vain, worldly and petty, and if ever a poet may be said to possess the qualities that make him entitle to a Noble Prize, it is he... "

রাসপূর্ণিমা। জ্যোৎস্নায় স্বর্গীয় হয়েছে পারুলডাঙার শালবন। বোলপুর স্টেশনের পুব ধারে এই পারুলডাঙা।  পশ্চিম থেকে পূর্বের দিকে ধেয়ে আসছে নতুন ইতিহাস। রবীন্দ্রনাথের সে-কথা জানা নেই। আপাতত কবিতার কথা কুড়িয়ে আনতে কবি ছুটলেন পারুলডাঙার শালবনের দিকে। সঙ্গী হয়েছেন দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর,পুত্র রথীন্দ্রনাথ,আশ্রম-সচিব নেপালচন্দ্র রায় এবং আরও কয়েকজন আশ্রমিক। বের হতে যাবেন,ঠিক সেইসময় রবীন্দ্রনাথের হাতে এসে পৌঁছল একটি টেলিগ্রাম। কবি তাকে পকেটেই রেখে দিলেন। পড়লেন না। রবীন্দ্রনাথের জানা নেই এইমুহূর্তে তাঁর পকেটে কবিতার ইতিহাস।  কবি হাঁটছেন।  যেন ইতিহাস নিজে হাঁটছে।  

বনের গভীরে ডুবে গ্যাছেন রবীন্দ্রনাথ।  চিঠির কথা তাঁর মনে থাকার কথা নয়। থাকেও নি। কিন্তু বাকিরা কবিকে টেনে ধরলেন। জ্যোৎস্নার আলো এসে পড়ল ইতিহাসের মুখে।  একরাশ অনীহা নিয়ে কবি পড়লেন "নোবেল প্রাইজ কনফারড্ অন ইউ,আওয়ার কনগ্রাচুলেশনস"।  বাকিরা দেখলেন জ্যোৎস্না-মাখা শালবনে স্নিগ্ধ এক অতিমানবের ছায়া আস্তে আস্তে মাটিতে মিশে যাচ্ছে।  অত্যন্ত নিরাসক্ত ভাবে রবীন্দ্রনাথ টেলিগ্রামটি তুলে দিলেন নেপালচন্দ্রের হাতে। বললেন,"নিন,নেপালবাবু,আপনার ড্রেন তৈরি করবার টাকা। "নোবেল-পরবর্তী প্রথম রবিকিরণ! নেপালবাবু তখন আশ্রমের পূর্তবিভাগের দায়িত্বে ছিলেন।  তিনি ভালোই জানতেন,শান্তিনিকেতনে তখন টাকার টানাটানি। কবিমনকেও যা চিন্তিত করে রেখেছিল। একটা পাকা নর্দমা অর্ধখনিত অবস্থায় পড়েছিল বহুদিন।  কেউ পাশে এসে দাঁড়ায়নি। নোবেল হল নর্দমার টাকা! চাঁদের আলোয় অভিমানী দেখাল সূর্যের মুখ।  

সূর্য সেদিন একটু বেশিই উজ্জ্বল ছিল কলকাতার আকাশে।  কলকাতার এক সান্ধ্য ইংরেজি দৈনিক দ্য এম্পায়ার'-এ প্রথম প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের নোবেলপ্রাপ্তির খবর।  লন্ডন থেকে রয়টারের পাঠানো সেই খবর। 'গ্রেট অনার ফর টেগোর/নোবেল প্রাইজ কনফারড্/লার্জেস্ট কন্ট্রিবিউশন টু/দ্য কমন গুড।  'আরও লেখা হয়,'দ্য নোবেল প্রাইজ ফর লিটারেচার হ্যাজ/বিন কনফারড্ অন দ্য ইন্ডিয়ান পোয়েট রবীন্দ্রনাথ টেগোর। 'সান্ধ্য খবর এমনিতেই লোকে খুব একটা পড়ে না। তার উপর প্রথম পাতাতেও স্থান পায়নি খবরটি।  সেই সন্ধ্যের মতো ঝড় থেমে রইল।  খবরটি কিন্তু এসে ধরা দিল কলকাতাতে কবির তিন ভক্তের চোখে। মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়,সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এবং চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁরা তিনজনে মিলেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রবীন্দ্রনাথকে টেলিগ্রাম করেন।   কলকাতার তার বিভাগে সেটি জমা পড়ে বিকেল ৪-১০ মিনিটে এবং বোলপুরের ডাকঘরে পৌঁছয় বিকেল ৪-৪৩ মিনিটে। মজার ঘটনা হল,নোবেল পুরস্কার-কমিটির টেলিগ্রাম কিন্তু কবির কাছে পৌঁছেছিল অনেক দেরিতে।  আসলে কবির ঠিকানাই ছিল না তাঁদের কাছে। গীতাঞ্জলির প্রকাশক ম্যাকমিলান কম্পানির কাছ থেক তা জোগাড় করে কবিকে টেলিগ্রাম করা হয়। টেলিগ্রামটি কবির জোড়াসাঁকোর ঠিকানায় আসে পরের দিন রাত্রে। কবির ছোট জামাই,শ্রী নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় ১৬ নভেম্বর সকাল ৭-১০ মিনিটে টেলিগ্রাম করেন কবিকে,"ফলোয়িং কেবল রিসিভড মিডনাইট /সুইডিশ অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডেড ইউ নোবেল প্রাইজ লিটারেচার/প্লিজ ওয়্যার অ্যাকসেপটেশন সুইডিশ মিনিস্টার। "ততক্ষণে কলকাতাসহ গোটা বাঙলায়,এমনকি দেশেও,খবরটা বন্যার মতো ছড়িয়ে পড়েছে। ফলত কবির প্রতি ভালোবাসা,শ্রদ্ধা "বিপদসীমা" অতিক্রম করল। মানুষ চিরকালই ভুলে এসেছে,ভালোবাসা বিজ্ঞাপনের বিষয় নয়। রবীন্দ্রনাথের এসব মোটেই পছন্দ নয়।  

শান্তিনিকেতনের শিশু ছাত্র-ছাত্রীরা ব্যাপারটা কিছুই বুঝে উঠতে পারল না। "নোবেল" ব্যাপারটা এখনও তাদের কাছে অজানা। তারা কেউ ভাবছে,গুরুদেব নভেল লেখেন তাই নোবেল;কেউ ভাবল  গুরুদেব মহান বলে এই নোবেল সম্মান। নোবেলের থেকেও চারদিনের অকাল ছুটি তাদের কাছে বেশি গুরুত্ববাহী। এটুকু তারা বুঝতে পেরেছে কিছু একটা অস্বাভাবিক বড় ব্যাপার ঘটেছে।  গুরুদেব বড় কিছু একটা করেছেন। পরিস্থিতি অস্বাভাবিক তো বটেই। স্বভাব-গম্ভীর ক্ষিতিমোহন সেনের মুখে গাম্ভীর্য আর নেই;তাঁর মধ্যে শিশুর চাঞ্চল্য। বিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং রবীন্দ্রসাহিত্য সমালোচনা গ্রন্থের প্রথম লেখক,অজিতকুমার চক্রবর্তী হাঁটছেন নৃত্যের তালে তালে। আমরা এখানে শান্তিনিকেতনের তৎকালীন আশ্রমিক শ্রী প্রমথনাথ বিশির বয়ান দেখে নেব,"একদিনে আশ্রমের চেহারা বদলাইয়া গেল - কোথায় গেল অধ্যাপকদের গম্ভীর চালচলন,কোথায় গেল ক্লাসের নিয়মিত ঘণ্টা,স্নানাহারের সময়ও গোলিমাল হইওয়া গেল। তারপর কোথা হইতে অতিথি-অভ্যাগতে আশ্রম ভরিয়া উঠিল।  "শান্তিনিকেতন পরিণত হ'ল জাদুঘরে।  

৭ অগ্রহায়ণ তারিখটা রবীন্দ্রনাথের জীবনে এতদিন পর্যন্ত থেকে এসেছে ধূসরতম।  এই তারিখেই একদিন হারিয়েছেন স্ত্রী মৃণালিনী দেবীকে;আর-এক ৭ অগ্রহাণে চলে গ্যাছে কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথ।   আজ ভাগ্যের ফিরিয়ে দেওয়ার পালা। আজ আবার ৭ অগ্রহায়ণ।   ২৩ নভেম্বর ১৯১৩।  কলকাতা থেকে পাঁচশোর বেশি রবীন্দ্রভক্ত সমবেত হন শান্তিনিকেতনের আম্রকুঞ্জে কবিকে সংবর্ধনা দিতে।   আয়োজন করা হয় বিশেষ ট্রেনের।  ১৯ নভেম্বর 'দ্য ইন্ডিয়ান ডেইলি নিউজ'পত্রিকায় এই বিশেষ ট্রেনের বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়। বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন কবির বিশেষ বব্ধু ও বিশিষ্ট বিজ্ঞানী শ্রী জগদীশচন্দ্র বসু।  

বাঙালীদের সময়ের ব্যাপারে চিরকালই নামডাক আছে। ২৩ নভেম্বর বিজ্ঞানাচার্য জগদীশচন্দ্র বসু স্টেশনে পৌঁছতে দেরি করে ফেললেন। ট্রেনটি তাই ৪৪ মিনিট দেরি করে ১০-৫৫ মিনিটে হাওড়া থেকে রওনা দিল। এলাহি আয়োজন। অপূর্ব সেই দৃশ্য। সবাই চলেছেন ইতিহাসের সাক্ষী হতে।   শুধু ইতিহাস নিজেই কেমন যেন সবকিছু থেকে দূরে।  

দুপুর ২-৩০ নাগাদ বিশেষ ট্রেনটি বোলপুরে এসে পৌঁছল। প্রবল ভিড়। আশ্রমের লোকেরা এসেছেন সবাইকে অভ্যর্থনা জানাতে। বোলপুর একসঙ্গে এত মানুষ এর আগে কখনও দেখেনি। তারা বিস্মিত।   মিছিল করে সবাই চলেছে,শান্তিনিকেতনের দিকে। পথের পাশে,বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে সেই মিছিল দেখছে বোলপুরের মানুষ। আশ্রমের ছাত্ররা আগে হেঁটে যাচ্ছে।  তারা গাইছে "আমাদের শান্তিনিকেতন" গানটি। পথের দু'ধারে বাঁশ পোঁতা হয়েছে। তাতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে আম্রপল্লব,পদ্মফুল,মালা,ধানের শিষ,কড়ি ইত্যাদি মঙ্গল চিহ্ন। মেঘের কোনও চিহ্ন নেই আকাশে।  

সংবর্ধনাসভায় এই মুহূর্তে রবীন্দ্রনাথ ছাড়া সবাই উপস্থিত। সভাপতির আসনে বসে রয়েছেন জগদীশচন্দ্র। সভার পাঁচজন মনোনীত প্রতিনিধি কবিকে সভায় আহ্বান করে আনতে গেলেন।   রবীন্দ্রনাথের আগমনে শাঁখ বেজে উঠল। কবিকে মালা পড়িয়ে দিলেন জগদীশচন্দ্র। শুরু হল উদ্বোধনী সংগীত,'বিশ্ববীণা রবে,বিশ্বজন মোহিছে। মনীষী হীরেন্দ্রনাথ দত্ত রেশমি কাপড়ে মুদ্রিত অভিনন্দনপত্র পাঠ করেন। অভিনন্দনপত্রটি লিখেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত নিজে।  মাটির টবে বসানো ছোট্ট একটা লজ্জাবতী গাছ কবিকে উপহার দিলেন জগদীশ্চন্দ্র। সংবর্ধনাসভা এসময় হয়ে উঠল সর্বধর্মসভা। বঙ্গীয় পণ্ডিতদের পক্ষ থেকে সতীশচন্দ্র বিদ্যাভূষণ,ভারতীয় খ্রিস্টানদের হয়ে মি.  মিলবার্ন,ইংরেজ সমাজের পক্ষ থেকে মি.  হল্যান্ড,মুসলিম সমাজ থেকে মৌলবি আবুল কাশিম,জৈনদের হয়ে পূরণচাঁদ নাহার,বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের ছাত্রসভ্যদের পক্ষ থেকে মন্মথনাথ বসু রবীন্দ্রনাথকে অভিনন্দন জানালেন। রবীন্দ্রনাথের মনে পড়ে গ্যালো মাত্র আট বছর আগেই এদের অনেকে হাসিঠাট্টা করেছেন।  অথচ এই সর্বধর্ম মিলনই তো তিনি চেয়েছিলেন এই বাঙলায়।   কিন্তু পারেননি।  ১৯০৫ সালে বাঙলার বিচ্ছেদ আটকাতে পারেননি তিনি। একটা নোবেলের কত ক্ষমতা! কবিকে বড় ক'রে দিতে পারে কবিতার থেকে! রবীন্দ্রনাথ ভাবছেন আর ঘুমন্ত আগ্নেয়েগিরির মতো নিজের ভেতরেই ফুটছেন। একথা অবশ্য তখনও কেউ জানেন না। তারা চোখের সামনে দেখতে পারছেন সৌম্যকান্তি এক পর্বতকে।  যার গুণগান ক'রে নিজেদের মধ্যেই একটা জয়ের অনুভব করছেন তারা। কবির কন্ঠে অভিমানের অভ্যুত্থানের খবর স্বাভাবিকভাবেই তাদের কাছে নেই।   সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত পাঠ করছেন 'আভ্যুদয়িক'নামে তাঁর বিখ্যাত কবিতা। অনুষ্ঠানের এখনও কিছুটা বাকি...

এইধরনের অনুষ্ঠান বরাবরই নিয়মের রাজপথে হাঁটে। আর রবীন্দ্রসরণী তো একবারে ঝকঝকে ট্র্যারফিক।  আগে থাকতে সব ঠিক করা;কোনটা কার পরে,সব পূর্বনির্ধারিত। এটাই ঠিক ছিল যে রবীন্দ্রনাথ নিজে এদিন বক্তৃতা দেবেন না;কিছু দিন আগে লেখা "এ মণিহার আমায় নাহি সাজে" আজ গাইবেন।  সুপরিকল্পিত চিত্রনাট্য।  কিন্তু সমস্যা হচ্ছে,সবকিছু সত্যিই পূর্বনির্ধারিত। তাই জন্য রোদঝলমলে দিনের মাঝে নেমে আসে বৃষ্টি;'বিনা মেঘে বজ্রপাত'-হয়ে যায় বিখ্যাত প্রবাদ।   তাই গণ্ডগোলটা হয়েই গ্যালো। সারাজীবন তাঁকে টেনে নামানোর চেষ্টা করেছে,হিংসা করেছে এমন কিছু মানুষকে সভার সামনে আসনে প্রসন্নচিত্তে বসে থাকতে দেখে নিজেকে আর সামলাতে পারলেন না রবীন্দ্রনাথ। জমে থাকা মেঘের বৃষ্টির ভাষা আমরা এবার শুনে নেব -" আজ আপনারা আদর করে সম্মানের যে সুরাপাত্র আমার সম্মুখে ধরেছেন তা আমি ওষ্ঠের কাছে পর্যন্ত ঠেকাব,কিন্তু এ মদিরা আমি অন্তরে গ্রহণ করতে পারব না। "ভক্তরা এই আকস্মিকতায় অবাক। যারা নোবেলাঘাতে ভক্ত হয়ে উঠেছিলান আক্রান্ত। রবীন্দ্রনাথ নিজেও প্রচণ্ড উত্তেজিত -যে ছবিটা আসল-নকল সব অনুরাগীর কাছেই অপিরিচির।  কাছের বন্ধু জগদীশচন্দ্র বসু কিছুই বুঝে উঠতে পারলেন না।  তিনি তখনও জানতে না যে আজ সকালেই রবীন্দ্রনাথের কাছে এসে পৌঁছেছে একট চিঠি।  যে চিঠির ছত্রেছত্রে এই সভা নিয়ে নানান কটুক্তি। জগদীশচন্দ্র সামনের সারিতে বসা সেই মুখগুলোকেও চিনতেন যারা শুঁয়াপোকা থেকে প্রজাপতি হওয়ার প্রচেষ্টায় ছিলেন। যাই হোক সারা দেশে বিতর্কের ঝড় উঠল। আমরা শুধুই ঝড় দেখি,কেন সে ঝড় উঠল তাতে আমাদের কোনও আগ্রহ একালেও নেই,সেকালেও ছিল না। সুতরাং ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা কেউ করলেন না। কিন্তু কী বললেন কবি? সেসময়ের 'সঞ্জীবনী' পত্রিকা থেকে আমরা তুলে নেব সে ঝড়ের ভাষ্য -

"আজ আমাকে সমস্ত দেশের নামে আপনারা যে সম্মান দিতে এখানে উপস্থিত হয়েছেন তা অসঙ্কোচে সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করি এমন সাধ্য আমার নেই।   ...

... যাঁরা জনসাধারণের নেতা,যাঁরা কর্মবীর,সর্বসাধারণের সম্মান তাঁদেরই প্রাপ্য এবং জনপরিচালনার কাজে সেই সম্মান তাঁদের প্রয়োজনও আছে। যাঁরা লক্ষ্মীকে উদ্ধার করবার জন্য বিধাতার মন্থনদণ্ডস্বরূপ হয়ে মন্দার পর্বতের মত জনসমুদ্র মন্থন করেন,জনতাতরঙ্গ উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠে তাঁদের ললাটকে সম্মানিধারায় অভিষিক্ত করবে,এইটেই সত্য,এইটেই স্বাভাবিক।  

কিন্তু কবির সে ভাগ্য নয়। মানুষের হৃদয়ক্ষেত্রেই কবির কাজ এবং সেই হৃদয়ের প্রীতিতেই তাঁর কবিত্বের সার্থকতা। কিন্তু এই হৃদয়ের নিয়ম বিচিত্র - সেখানে কোথাও মেঘ,কোথাও রৌদ্র।   অতএব প্রীতির ফসলেই যখন কবির দাবী তখন একথা তাঁর বলা চলবে না যে,নির্বিশেষে সর্বসাধারণেরই প্রীতি তিনি লাভ করবেন।  যাঁরা যজ্ঞের হোমাগ্নি জ্বালাবেন তাঁরা সমস্ত গাছটাকেই ইন্ধনরূপে গ্রহণ করতে পারেন;আর মালা গাঁথার ভার যাঁদের উপরে,তাঁদের অধিকার কেবলমাত্র শাখার প্রান্তর ও পল্লবের অন্তরাল থেকে দুটি চারটি করে ফুল চয়ন করা।  

কবি-বিশেষের কাব্যে কেউ বা আনন্দ পান,কেউ বা উদাসীন থাকেন,কারো বা তাতে আঘাত লাগে এবং তাঁরা আঘাত দেন।  আমার কাব্য সম্বন্ধেও এই স্বভাবের নিয়মের কোনো ব্যতিক্রম হয়নি,এ কথা আমার এবং আপনাদের জানা আছে। দেশের লোকের হাত থেকে যে অপযশ ও অপমান আমার ভাগ্যে পৌঁছেছে তার পরিমাণ নিতান্ত অল্প হয়নি এবং এতকাল আমি তা নিঃশব্দে বহন করে এসেছি। এমন সময় কি জন্য যে বিদেশ হতে আমি সম্মান লাভ করলুম তা এখনো পর্যন্ত আমি নিজেই ভাল করে উপলব্ধি করতে পারিনি। আমি সমুদ্রের পূর্বতীরে বসে যাঁকে পূজার অঞ্জলি দিয়েছেলাম তিনিই সমুদ্রের পশ্চিম তীরে সেই অর্ঘ্য গ্রহণ করবার জন্য যে তাঁর দক্ষিণ হস্ত প্রসারিত করেছিলেন সে-কথা আমি জানতুম না। তাঁর সেই প্রবাদ আমি লাভ করেছি- এই আমার সত্য লাভ।  

যাই হোক্,যে কারণেই হোক্, য়ুরোপ আমাকে সম্মানের বরমাল্য দান করেছেন। তার যদি কোনো মূল্য থাকে তবে সে কেবল সেখানকার গুণিজনের রসবোধের মধ্যেই আছে,আমাদের দেশের সঙ্গে তার কোনো আন্তরিক সম্বন্ধ নেই। নোবেল প্রাইজের দ্বারা কোনো রচনার গুণ বা রস বৃদ্ধি করতে পারে না।  

অতএব আজ যখন সমস্ত দেশের জনসাধারণের প্রতিনিধিরূপে আপনারা আমাকে সম্মান উপহার দিতে প্রবৃত্ত হয়েছেন তখন সে সম্মান কেমন করে আমি নির্লজ্জভাবে গ্রহণ করব? আর এ সম্মান আমি কতদিনই বা রক্ষা করব? আমার আজকের এদিন তো চিরিদিন থাকবে না আবার ভাঁটার বেলা আসবে তখন পঙ্কতলের সমস্ত দৈন্য আবার তো ধাপে ধাপে প্রকাশ হতে থাকবে।  

তাই আমি আপনাদের কাছে করজোড়ে জানাচ্ছি - যা সত্য তা কঠিন হলেও আমি মাথায় করে নেব,কিন্তু যা সাময়িক উত্তেজনার মায়া,তা'আমি স্বীকার করে নিতে অক্ষম...

... যিনি প্রসন্ন হলে অসম্মানের প্রত্যেক কাঁটাটি ফুল হয়ে ফোটে,প্রত্যেক পঙ্কপ্রলেপ চন্দনপঙ্কে পরিণত হয় এবং সমস্ত কালিমা জ্যোতিষ্মান হয়ে ওঠে,তাঁরি কাছে আজ আমি এই প্রার্থনা জানাচ্ছি,-তিনি এই আকস্মিক সম্মানের প্রবল অভিঘাত থেকে তাঁর সুমহান বাহুবেষ্টনের দ্বারা আমাকে নিভৃতে রক্ষা করুন।   "

রবীন্দ্রনাথে এই অন্তরের আবেদন স্বীকৃত হয়েছিল কিনা জানার কোনও উপায় নেই।  কিন্তু এটা জানা যায় তাঁর এই পরাক্রমী অভিমান বর্ষণে সেদিনের সেই বিপুল আয়োজন খড়কুটোর মতো ভেসে গেছিল। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির নামকরা কারিগর আর আশ্রমের প্রধান ঠাকুর সতীশ গাঙ্গুলি তাঁর দলবল নিয়ে যে বিপুল জলযোগের আয়জন করেছিলেন,তা মুখে না তুলেই সবাই বোলপুর স্টেশনের দিকে রওনা দিলেন। আশ্রমের ছেলেরা ঘাড়ে বয়ে সে-সব নিয়ে গিয়ে বোলপুর স্টেশনে গিয়ে বিতরণ করেন।  খাদ্যের সদ্গতি তো হলো;কিন্তু রবীন্দ্রাথের অনুভব,তাঁর অভিমান সেসব কেউ সেদিন বোঝার চেষ্টাও করলেন না।  আজও সেসব অধরা। শুধু বছর পারে কোনও কবিপ্রণাম অনুষ্ঠানে কেউ যখন গান "এ মণিহার আমায় নাহি সাজে" খুব অস্বস্তি হয়। সাদা-কালো একটা মেঘের ছবি মনে পড়ে। আর মাথায় ঘুরতে থাকে কয়েকটা লাইন "বহুযুগের ওপার হতে আষাঢ় এল... " ।  মনটা ভিজতে থাকে।  

তমোঘ্ন চট্টোপাধ্যায়:কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত



1 টি মন্তব্য: