প্রবন্ধ
কর্তা তার বউকে বললেন,
"ইশ, কি কালো"। বউটি রেগে তীর্যক দৃষ্টি হেনে বললেন, "আমি বলে বর্তে
গেছ। না হলে কে তোমায় বিয়ে করতো শুনি! চাল নেই, চুলো নেই! শুধু ফর্সা হলে হবে?’। কর্তা
গাঁজা টেনে বসে আছেন। ফুট কাটলেন, "কালী, কালী।" বউ আর কি করে! মনের দুঃখে
গরগর করতে করতে অন্য দিকে চলে গেলেন। এমনটা রোজ ঘটছে। রোজই পতিদেব তাঁকে কালো, কালী,
কালিকা বলে গঞ্জনা দিচ্ছেন। একদিন সবার সামনেই বলে ফেললেন, 'কালিকা'। আর সহ্য হয় না!
তিনি এক কীর্তি করে বসলেন। হিমালয়-দূহিতা দুর্গাকে মূর্তিতে, ছবিতে সারাজীবন ফর্সাই
দেখা গেছে। কখনও কনকবর্ণা, কখনও গোধুম বর্ণা, কাঞ্চনবর্ণা বা অতসী বর্ণা। সেই দুর্গাকেও
নাকি মহাদেব ‘কালী দুর্গা’ বলতেন! দুর্গা তো জেদী মেয়ে। ঠাট্টা-রসিকতায় সর্বদা পোষায়
না। তিনি নাকি রেগে গিয়ে টানা অনশনে বসলেন, কালো থেকে ফর্সা হতেই হবে। এই অনশন আন্দোলনে
দাবি পেশ করলেন স্বয়ং মহাদেবের কাছেই। তখন দেশিবিদেশী কোম্পানীর ফর্সা হওয়ার ক্রিম
পাওয়া যেত না। শাস্ত্রে দাবি, দক্ষযজ্ঞ স্থলে সতী আত্মাহুতি দিয়ে ছাই হয়ে যাওয়ায় পরের
জন্মে তাঁর গায়ের রঙ কালো মেঘের মতো হয়। তাই মহাদেব নাকি কালিকা ডাকতেন। এদিকে, শুম্ভ-নিশুম্ভদের
তাড়া খেয়ে স্বর্গ ছেড়ে পালিয়ে আসা দেবতারা কৈলাশে ধর্ণা দিলেন। শিব সবার সামনেই পার্বতীকে
বললেন ‘কালিকা তুমি ওদের উদ্ধার করো।’ সবার সামনে কালিকা বলায় পার্বতী অত্যন্ত ক্ষুব্ধ,
অপমানিত ও ক্রুদ্ধ হয়ে কঠিন তপস্যায় বসলেন। মহাদেবের কাছে দাবী, তাঁকে ফর্সা করে দিতে
হবে। গাঁজায় ধুম তুরীয়ানন্দে থাকা মহাদেবের হুঁশ ফিরলো। বউ অনশনে গেলে স্বামীর যে চলে
না। সময়ে অসময়ে গাঁজার কলকে কে সেজে দেবে? গাজনের দিনে সন্ধ্যেয় কোন অন্নপূর্ণা রেঁধে
দেবে দু-মুঠো ভাত? অগত্যা...। কিন্তু, রাতারাতি এসব হয় না, তাই মহাদেব ঠিক করলেন, ধীরে
ধীরে রঙবদল করবেন। এক পর্যায়ে কালো থেকে ফর্সা হওয়ার পর্বে দেবীর রঙ হয়ে গেল কাঁসার
বাসনের মত। ঠিক কালোও নয়, ফর্সাও নয়, কাঁসার রঙ। খানিকটা লালচে আভা আছে তাতে। এই কাঁসা বা তামাটে রঙের দুর্গাই কৌশিকী।
শাস্ত্রমতে,
তপস্যান্তে মানস সরোবরের জলে স্নান করে দেহের কালো কোষগুলি ত্যাগ করে ফর্সা হয়ে গেলেন
দেবী। আর, পরিত্যক্ত কালো কোষগুলি থেকে সৃষ্টি হল কৌশিকী দেবীর। কৌশিকী দেবীর পুজো
হয় ভাদ্রের অমাবস্যায়। তাঁর নাম কৌশিকী অমাবস্যা। কৌশিকী দেবীর সবচেয়ে বড় পুজো হয় তারাপীঠে।
বিরাট মেলা বসে। হাজার হাজার ভক্তের সমাবেশে সারারাত কীর্তন, বাউল গান চলে। কত ভাণ্ডারা
বসে, তাঁর ইয়ত্তা নেই। শাস্ত্রমতে, কৌশিকী দেবীর সৃষ্টি হয় শুম্ভ-নিশুম্ভ বধের প্রয়োজনে।
দেবীমাহাত্ম্যম্-এর শুম্ভ-নিশুম্ভ বধের কাহিনী অনেকটাই ফিল্মি বলে মনে হবে। অসুর দুই
ভাই শুম্ভ ও নিশুম্ভ স্বর্গ ও দেবতাদের যজ্ঞভাগ দখল করে নিলে দেবতারা কৈলাশে গিয়ে আদ্যাশক্তি
মহাদেবীর আরাধনায় অপরাজিত স্তব শুরু করলেন, যাতে আছে ‘যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ
সংস্থিতা’। পার্বতী গঙ্গাস্নানে এলে দেবতাদের স্তবে খুশী হয়ে শুম্ভ-নিশুম্ভ বধের দায়িত্ব
নিলেন। তাঁর কোষ থেকে জন্ম নিলেন দেবী কৌশিকী।
কৌশিকীকে
দেখে শুম্ভ-নিশুম্ভের চর চণ্ড ও মুণ্ড প্রভুদের জানালেন, এ নারী আপনাদেরই যোগ্য। শুম্ভ-নিশুম্ভর
দূত হয়ে মহাসুর সুগ্রীব গিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দিলে কৌশিকী বললেন, “ঠিকই বলেছ। বিশ্বে
শুম্ভ-নিশুম্ভের মতো বীর কে আছে? আমি অল্পবুদ্ধিবশতঃ আগেই প্রতিজ্ঞা করেছি, যে আমাকে
যুদ্ধে হারাবে, কেবল তাকেই বিয়ে করব। তুমি শুম্ভ বা নিশুম্ভকে বল, তাঁরা যেন এখানে
এসে আমাকে পরাস্ত করে আমাকে বিয়ে করেন।” একথা শুনে শুম্ভ উচিত শিক্ষা দিতে সেনাপতি
ধূম্রলোচনকে পাঠালেন। যুদ্ধে ধূম্রলোচন নিহত হল। এলেন চণ্ড-মুণ্ড ও অন্যান্য সেনারা।
কৌশিকী কালীর শরণাপন্ন হলেন। দেবী চামুণ্ডা রূপে চণ্ড-মুণ্ডকে বধ করলেন। চণ্ড-মুণ্ডের
মৃত্যুর খবরে অসুর সেনারা এল। এদের বধ করতে দেবী নিজের শরীর থেকে ব্রহ্মাণী, মাহেশ্বরী,
কৌমারী, বৈষ্ণবী, বারাহী, নারসিংহী, ঐন্দ্রী প্রমুখ রূপ নিয়ে প্রচণ্ড যুদ্ধে তাঁদের
পরাস্ত ও নিহত করলেন। এলেন রক্তবীজ, যার একফোঁটা রক্ত মাটিতে পড়লে লক্ষ রক্তবীজ সৃষ্টি
হয়। দেবী দুর্গার হয়ে মহাকালী রক্তবীজকে বধ করে তাঁর রক্ত ছিন্নমস্তা রূপে পান করলেন।
এবার এলেন নিশুম্ভ। দেবী কৌশিকী নিশুম্ভকে বধ করলেন। শেষে শুম্ভ এসে দেবীকে বলল, “তুমি
গর্ব করো না, কারণ তুমি অন্যের সাহায্যে এই যুদ্ধে জয়লাভ করেছ।” তখন দেবীর সঙ্গে শুম্ভের
ঘোর যুদ্ধ শুরু হল। দেবী শুম্ভকে শূলে গেঁথে বধ করলেন। মা দুর্গা মহাদেবী। তাঁর রঙবাজী
এত কম, হতেই পারে না। রঙ যখন বেশি, তখন তিনি আরও নানা বর্ণে নিশ্চয়ই আছেন! হ্যাঁ, আছেন
লাল রঙের। এই বাঙলাতেই আছে। রক্তবর্ণা দেবী
বা লাল মানে আবার কমিউনিস্ট ভাববেন না। একেবারেই লোকায়ত ব্যাপার।
নবদ্বীপের
লাল দুর্গা
দক্ষিণবঙ্গে
লাল বর্ণের দুর্গা আছেন নবদ্বীপে। নবদ্বীপ নামে নতুন দ্বীপ নয়, গঙ্গার বুকে একদা ভাসমান
নয়টি দ্বীপের সমাহার। নাম ছিল অন্তদ্বীপ, সীমন্তদ্বীপ, গোধ্রুমদ্বীপ, মধ্যদ্বীপ, কোলদ্বীপ,
ঋতুদ্বীপ, জহ্নুদ্বীপ, রুদ্রদ্বীপ ও মোদত্রুদ্বীপ। চৈতন্যদেবের সঙ্গে নবদ্বীপের নাম
অঙ্গাঙ্গী জুড়ে থাকলেও একসময় নবদ্বীপ ছিল শক্তিসাধনার কেন্দ্র। তারই এক নক্ষত্র ছিলেন
কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। বাংলায় সাংখ্যদর্শনের হাত ধরে বৌদ্ধধর্মের (বজ্রযান) মাধ্যমে
তন্ত্রসাধনার উৎপত্তি। সেই সাধনা চলতো সকলের অগোচরে, কেবল সাধকরাই জানতেন তার নিয়মাবলী।
সেই তন্ত্রসাধনাকে প্রথম সংস্কৃতে বৃহৎপরিসরে বই হিসাবে আনেন পণ্ডিত কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ।
নাম ‘বৃহৎ তন্ত্রসারঃ’। সেই রচনার ঐতিহ্য এখনও বহমান। সে-সময় অবশ্য তার কাজকর্মকে উপহাস
করে আগমবাগীশী কাণ্ড বলা হতো। বর্তমানে প্রচলিত কালীমূর্তি তাঁরই কল্পিত। দক্ষিণাকালীর
পূজাপদ্ধতিও তাঁরই প্রবর্তন।
প্রচলিত
আছে, সেই সময়ে আদ্যাশক্তির কোনও মূর্তি ছিল না। দেবী স্বপ্নে কৃষ্ণানন্দকে দেখা দিয়ে
বলেন, সকালে উঠে প্রথম দেখা মূর্তি অনুসারে যেন তার মূর্তি গড়া হয়। সকালে কৃষ্ণানন্দর
সামনে প্রথমেই হাজির হলেন এক গোপরমণী, যিনি পণ্ডিতকে দেখে লজ্জায় জিভ কাটলেন। কৃষ্ণানন্দ
সেই অনুসারেই আদ্যাশক্তির মূর্তি বানালেন। প্রতিদিন দক্ষিণাকালীর মূর্তি নিজের হাতে
গড়ে পূজা করতেন তিনি। তন্ত্রসারঃ গ্রন্থ তখন লেখা হলেও কেউ তার কথা জানত না। একদিন
সকালে মূর্তি বিসর্জন দিতে যাওয়ার একজন কাজী তা দেখে এলাকার ভূস্বামীকে জানান। সেই
ভূস্বামী এসে কৃষ্ণানন্দের কাছে দুই হাত পেতে আশীর্বাদ চান। আশীর্বাদ করার সময় উনি
মূর্তি দেখে সে-বিষয়ে জানতে চান। কৃষ্ণানন্দ তাঁর স্বপ্নবিবরণ ও তন্ত্রসার গ্রন্থের
কথা বলেন। সানন্দে ভূস্বামী সেই পূজাকে বৃহদাকারে সম্পন্ন করেন এবং কৃষ্ণানন্দকে ‘আগমবাগীশ’
উপাধি দেন। সেই থেকে কার্ত্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে আজও শ্যামাপূজা বা কালীপূজা হয়।
তার নামে
যে অঞ্চলটি নামাঙ্কিত, সেই আগমেশ্বরীতলার দুর্গা রক্তবর্ণা। অনেকেই বলেন, এর প্রচলনের
পিছনেও আগমবাগীশী কাণ্ডকারখানার ভূমিকা আছে। তবে নবদ্বীপের ভট্টাচার্য বাড়ির দুর্গার
রঙ লাল, এবং তার পিছনে দারুণ একটি কাহিনী পাওয়া যায়। এই পরিবারটি সেই সময় পদ্মা পার
থেকে এসেছিলেন নদীয়ায়। ভট্টাচার্য মশাই ছিলেন তন্ত্রসাধক, আগমবাগীশের অনুসারী। কথিত
আছে, একবার দুর্গাপূজার সময়ে চণ্ডীপাঠের সময়ে পরিবারের কর্তা ভট্টাচার্য মশাই তার ছেলে
রামেশ্বরের উপর ক্রুদ্ধ হয়ে অভিশাপ দেন, “মায়ের পূজা শেষ হওয়ার আগেই তুই মৃত্যুর কোলে
ঢলে পড়বি।” ভয়ে রামেশ্বর কাঁপতে থাকেন, আর মূর্তির রঙও রক্তবর্ণ হয়ে যায়। রাত কাঁটার
আগেই রামেশ্বর মৃত্যুভয়ে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন আর মূর্তির হাসিমুখ ম্লান হয়ে যায়। বিজয়া
দশমীর দিন মূর্তির বিসর্জনের সঙ্গে সঙ্গেই রামেশ্বরও দুনিয়ার মায়া কাটিয়ে চলে গেলেন।
দেবী কুপিতা
হয়েছিলেন বলেই তার রঙ বদলেছিল, এমনটাই কথিত। যেহেতু চণ্ডীপাঠের সময়েই ক্রোধে ছেলেকে
মৃত্যুর অভিশাপ দিয়েছিলেন রামেশ্বরের বাবা, তাই সেই থেকে এখানে দুর্গাপূজায় আর চণ্ডীপাঠ
হয় না। এখানে অবশ্য শুধু দূর্গার রঙই লাল, বাকি মূর্তিগুলির রঙ স্বাভাবিক। সরস্বতী
শ্বেতবর্ণা, লক্ষ্মী কমলা, কার্তিক হলুদ, গণেশ লালচে গোলাপী, সিংহ হলুদ আর অসুরের রঙ
সবুজ।
জলপাইগুড়ির
বৈকুণ্ঠপুর রাজবাড়ি
শুধু নবদ্বীপেই
নয়, জলপাইগুড়ির রায়কতপাড়ার বৈকুণ্ঠপুর রাজবাড়ির দুর্গারও গায়ের রঙ লালচে। দুর্গার দু’পাশে
কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী এবং জয়া-বিজয়া। রাজবাড়ির এই পুজোকে বলা হত দুর্গাধিপতিদের
দুর্গোৎসব। বৈকুণ্ঠপুর-রায়কত রাজবংশের শাক্ত রাজা ধর্মদেব জলপাইগুড়ি জেলার করলা নদীর
তীরে তার রাজধানী ও দুর্গ স্থাপন করেছিলেন। ৯১৭ বঙ্গাব্দে চার রাজপুত্র এই পারিবারিক
পুজো শুরু করেন। কিছু বিশেষ আচার ও রীতিনীতি আজও হুবহু মানা হয়। যেমন চণ্ডীমণ্ডপে
দেবীকে আনা হয় পরিবারিক রথে। মথুরা, বৃন্দাবন, বারাণসী-সহ পাঁচ তীর্থের জল আনা হয়
বোধনের জন্য। দুর্গাপ্রতিমার পাশে থাকেন শিবের চেলা ভৃঙ্গীর স্ত্রী বিজয়া এবং দেবীর
প্রিয়তম সখী জয়া। মূর্তির পেছনে কেবল শিব নয়, ব্রহ্মা এবং বিষ্ণুও থাকেন।
সময়ের
সঙ্গে সঙ্গে এখানে দেবী মূর্তি কিন্তু খানিকটা প্রচলিত আদল পেতে শুরু করেছে। শুরুতে
এখানে দুর্গার বাহন ছিল বাঘ, সিংহ নয়। ছেলেমেয়েদের কোনও বালাই ছিল না। ‘জলপাইগুড়ি জেলা
শতবার্ষিকী স্মারক গ্রন্থ’-তে (১৯৭০-এ প্রকাশিত) চারুচব্দ্র সান্যাল লিখেছিলেন, “রাজবাড়ির
দুর্গা প্রতিমা ছিল বিরাট আকারের, ঘোর লাল রং। বাঘের উপর দাঁড়িয়ে একটি মাত্র মূর্তি।
প্রায়, ষাট বছর আগে লক্ষ্মী-সরস্বতী, কার্তিক ও গণেশ বাহন-সহ জুটে গেল এই বিরাট মূর্তির
পাশে। দুর্গার রং-ও একটু ফিকে হয়ে গেল। বাঘটি ধীরে ধীরে হয়ে গেল সিংহ।...শুনতে পাওয়া
যায় প্রায় পঁচাত্তর বছর আগেও নবমীর গভীর রাতে কি যেন একটা অতি গোপনে বলি দিয়ে তখনই
করলা নদীর ধারে জঙ্গলে পুঁতে ফেলা হতো।” পুজোয় আজও পশুবলি হয়। এখনও প্রতীকি হিসেবে
নিশুতি রাতে সন্ধিপুজোয় হাড়িকাঠে বলি দেওয়া হয় মাটি-ধান দিয়ে তৈরি নরমুণ্ড। দশমীর
রাত শেষে সূর্য দেখা দেবার আগেই প্রতিমা বিসর্জন দেবার নিয়ম আছে বৈকুণ্ঠপুরের রাজাদের।
কোচবিহার
রাজবাড়ি
কোচবিহার
রাজ পরিবারের কন্যা ছিলেন প্রাক্তন বিজেপি সাংসদ মহারাণী গায়ত্রী দেবী। এই পরিবারেও
কনকদুর্গার পুজো হলেও মূল পুজো বড়দেবীর। অনেক গবেষকের মত, রাজ পরিবারের কেউ কেউ প্রচলিত
মূর্তির দিকে আগ্রহী হয়ে আলাদাভাবে বড়দেবীর পাশাপাশি পুত্রকন্যা-সহ কনকদুর্গার পুজো
শুরু করেন। কনকদুর্গায় একই সঙ্গে পুজো পান ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর, জয়া-বিজয়া। দুর্গা
সিংহের পিঠে থাকলেও পাশে বাঘ থাকে। এক সময় রাজবাড়িতে বলি দেওয়া মোষের মাথা দেবীকে অর্ঘ্য
দেওয়া হতো। দুর্গাপুজোর সময় হাতিশালের হাতিদের সাজিয়ে বরণ করে তাদের হাতিশালায় নিয়ে
যাওয়া হতো। তার নাম ‘হাতিচুমানি। দশমীর পরদিন রাজা শ্রেষ্ঠ হাতিটির ওপর বসে শিকারে
যাত্রা করতেন। এর নাম যাত্রা উৎসব। তা নিয়ে আরেক দুর্গার আরেক কাহিনী অন্য সময় বলা
যাবে।
এখন রাজাও
নেই, সেই রাজ্যও নেই। তা বলে রাজাদের সময়ের বড়দেবী পুজোর রীতিনীতি, আচার আয়োজনের সবটাই
বিসর্জিত হয়নি। প্রায় পাঁচশো বছরের প্রাচীন কোচবিহারের বড়দেবী পুজো ঘিরে তাই বাড়তি
উৎসাহ থাকেই। জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে বড়দেবীর ডাঙ্গোরাই মন্দিরে ময়না কাঠের দণ্ড বসিয়ে
যূপচ্ছেদন পুজোর পর তা মদনমোহন বাড়িতে আনা হয়েছে। এই ময়না কাঠেই দেবী মূর্তির শিরদাঁড়া
হয়। বড়দেবী মন্দিরে পুজো শুরু হয় মহালয়ার পরের দিন, প্রতিপদ থেকে দশমী পর্যন্ত টানা
পুজো চলে। পুজোপর্ব শেষ হয় জগদ্ধাত্রী পুজোর অষ্টমীতে, বামা পুজোর মাধ্যমে।
প্রচলিত
দুর্গামূর্তির চেয়ে কিছুটা আলাদা বড় দেবী। বড়দেবী এখানে রক্তবর্ণা। দেবীর এক দিকে
সাদা সিংহ, অন্য দিকে বাঘ। দুই পাশে কার্তিক, গণেশ কিংবা লক্ষ্মী, সরস্বতীর বদলে আছেন
জয়া, বিজয়া। কথিত আছে, মহারাজা বিশ্বসিংহর স্বপ্নে দেখা মূর্তিই প্রতিমায় রূপায়িত
হয়েছে। তাই, পুত্রকন্যা-রূপী লক্ষ্মী-সরস্বতী-কার্তিক-গণেশের পূজা এখানে হয় না। রাজা
নরনারায়ণের আমল থেকেই মৃন্ময়ী মূর্তিতে পুজোর প্রচলন। পুজোয় চলে বিচিত্র নানা লোকাচার।
ময়না গাছ কেটেই তৈরি হয় হাঁড়িকাঠ। অষ্টমীর দিন অঞ্জলি দেন রাজপরিবারের সদস্যরা। গভীর
রাতে দরজা বন্ধ করে অনুষ্ঠিত হয় দেবীর গুপ্ত সন্ধিপুজো বা নিশিপুজো। কথিত, এই পুজোতে
নরবলি হত। এখনও নিয়ম রক্ষার্থে বিশেষ এক ব্যক্তি বংশ পরম্পরায় হাত কেটে বড়দেবীকে রক্ত
দেন আর পুজোয় চাল বাটা দিয়ে তৈরি মানুষের মূর্তি বলি হয়। তবে আজও শুয়োর সহ নানা পশুর
বলি হয়।
বাংলাদেশে
লাল দুর্গা
বাংলাদেশের
মৌলভীবাজারের কাছে রাজনগর উপজেলার পাঁচগাঁওতে সর্বানন্দ দাসের বাড়িতে পুজো হয় রক্তবর্ণা
দুর্গার। রাজনগর উপজেলা সদর থেকে প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরে পাঁচগাঁও। এই পুজোও
প্রায় তিনশো বছরের পুরানো। মানুষের ধারণা, এই দেবী জাগ্রতা, তাই মানুষ বলি মানত করে।
বছর দুয়েক আগেও ৫০০ পাঁঠা, ৬টি মহিষ ও প্রায় ৭০০ জোড়া কবুতর এখানে বলি দেওয়া হয়েছিল।
লাখ লাখ মানুষ লালরঙের জাগ্রত দেবীদুর্গা দর্শনে আসেন বলে বিরাট মেলা বসে। এই পারিবারিক
পুজোর বর্তমান পরিচালক সঞ্জয় দাসের দাবী, এখানে পুজো শুরুর পর থেকে একবারও পুজো বন্ধ
হয়নি। শুধুমাত্র একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মূর্তি তৈরি সম্ভব না হওয়ায় ঘটে পুজো
হয়েছিল।
সঞ্জয়বাবু
শুনিয়েছেন এই পুজো শুরুর নেপথ্য কাহিনী। তাদের পূর্বপুরুষ সাধক সর্বানন্দ দাস আসামের
শিবসাগরে মুন্সীর পদে চাকরি করতেন। একবার আসামের কামরুপ-কামাক্ষ্যা গিয়ে কুমারীপুজোর
জন্য পাঁচ বছরের একটি মেয়ে চাইলে স্থানীয় মানুষ একটি মেয়েকে এনে দেন। সর্বানন্দ দাস
সেই মেয়েকে পুজো দিতে থাকেন। ধীরে ধীরে মেয়েটির রঙ বদলে লাল হয়ে যায়। মেয়েটির মধ্যে
স্বয়ং দেবী ভর করেন। মেয়েটি সর্বানন্দ দাসকে বলে, ‘তুমি আমার কাছে বর (আশীর্বাদ) চাও।
আমি তোমাকে বর দিব।’ প্রার্থিত বর দানের পর দেবী নির্দেশ দিলেন এই পাঁচগাঁওয়ের প্রতিমার রঙ হবে লাল। সেই থেকে এখানে
লাল বর্ণের মুর্ত্তির পূজা হয়ে আসছে। বাংলাদেশের
আর কোথাও লাল রঙের দুর্গা পুজো হয় বলে জানা নেই।
চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্য: কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন