প্রবন্ধ
ভারতের
প্রথম মোঘল সম্রাট মোঙ্গলজাত বাবর (চুঘতাই ভাষায় ‘বাবুর’), পুরো নাম মির্জা জহিরউদ্দিন
মোহাম্মদ জালালউদ্দিন বাবর। বাবরের স্ত্রীরা হলেন – আয়েশা সুলতান বেগম, বিবি মুবারিকা
ইউসুফযায়, দিলদার বেগম, গুলনার আগাচেহ, গুলরুখ বেগম, মাহাম বেগম, মাসুমাহ বেগম, নারাগুল
আগাচেহ, সাদিয়া আফাক। তাঁর সন্তানসন্ততিরা হলেন – মির্জা হুমায়ুন, কামরান মির্জা, আসকারি
মির্জা, হিন্দাল মির্জা, বারবুল মির্জা, ফারুক মির্জা, সুলতান আহমেদ মির্জা, আলোয়ার
মির্জা এবং কন্যারা হলেন গুলবদন বেগম, মেহেরজান বেগম, ঈশান বেগম, গুলগাদার বেগম, গুলরঙ
বেগম, গুলচেহারা বেগম। বাবর ভারত উপমহাদেশে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট। তিনি
তৈমুর লঙের সরাসরি বংশধর এবং মাতার দিক থেকে চেঙ্গিস খানের বংশধর ছিলেন। তিনি মির্জা
ওমর শেখ মির্জার পুত্র, এবং তৈমুরী শাসক আবু সৈয়দ মির্জা প্রপৌত্র। বাবর জন্মেছিলেন
১৪৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি, ফরঘান প্রদেশের (বর্তমানে উজবেকিস্তান নামে পরিচিত) আন্দিজান
শহরে। তিনি ফরঘান প্রদেশের শাসনকর্তা ওমর মির্জার বড়ো পুত্র ছিলেন। মোঙ্গলদের থেকে
উদ্ভূত বারলাস উপজাতিতে বেড়ে উঠলেও বাবরের জাতিতে তুর্কি ও পারস্য সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ছিল। বাবরের মাতৃভাষা
ছিল চুঘতাই, যা তাঁর কাছে তুর্কি ভাষা নামে পরিচিত ছিল। বাবর একজন মোঙ্গলীয় (ফারসিতে
মোগল বা মুঘল) হয়েও মধ্য এশিয়ার তুর্কি এবং ইরানিদের কাছ থেকে ব্যাপক সহযোগিতা লাভ
করেছিলেন এবং তার সৈন্যবাহিনীতে পারসি, পাঠান, আরবীয় মানুষ ছিলেন। এছাড়াও তাঁর সৈন্যবাহিনীতে
কুইজিলবাস যোদ্ধারা ও অন্তর্ভুক্ত করেছিল। পিতা ওমর শেখ মির্জার অকালমৃত্যুতে ফরগানা
শাসনের গুরু দায়িত্ব বাবরের কাঁধে চেপে বসে। সালটা ১৪৯৪। বাবর যে যুগের মানুষ সে যুগে নিজরাজ্য রক্ষা করা
খুব সহজ কাজ ছিল না। বিশেষ করে বাবর যে অঞ্চলের রাজা বা শাসক ছিলেন, সেই মধ্য এশিয়ায়
তো কোনোমতেই সম্ভব ছিল না। সেই মধ্য এশিয়ায় অসংখ্য রাজ্য বা দেশ, তার অসংখ্য রাজা।
সকলেই চেঙ্গিস খাঁ ও তৈমুর লঙের বংশধর মনে করতেন। ফলে সকল রাজার চোখে দিগ্বিজয়ের নেশা।
অতএব প্রতি মুহূর্তেই রাজ্যের সীমানা, স্থিতি এবং রাজার ভাগ্য সরু সুতোয় ঝুলে থাকত।
কখন কোন্ রাজার ভবলীলা সাঙ্গ হবে তা কেউ জানত না। দেশ বা রাজ্যগুলি বারবার আক্রমণ ও
প্রতি-আক্রমণের কখনো আকারে ছোটো হয়ে যেত, কখনো বড়ো হয়ে যেত। কখনো-বা গোটা দেশটাই ভ্যানিশ
হয়ে যেত। সেইসঙ্গে প্রজাদেরও ভাগ্য বদলে যেত।
বাবরের
ঠাকুরদা আবু সৈয়দ মির্জা বংশীয় রীতি অনুসারে তাঁর চার ছেলের মধ্যে আপন রাজ্য ভাগ করে
দিয়ে গেলেন। সেই ভাগে বাবরের পিতার ভাগ্যে একটি ছোট্ট রাজ্য ফরঘান। বাবররা চার ভাই
ছিলেন বটে, কিন্তু চার ভাইই এক মায়ের সন্তান ছিলেন না। তাঁরা ছিলেন ভিন্ন ভিন্ন মায়ের
সন্তান। বাবরের পিতা ওমর শেখ মির্জারও ছিল রাজ্য বিস্তারের নেশা। শুধু নেশা থাকলেই
তো হবে না, সেইসঙ্গে যথেষ্ট সামর্থ্য থাকাও জরুরি। অন্যের ফলে কামড় বসাতে হলে নিজের
দাঁতের মজবুতিটাও বুঝে নেওয়ার দরকার। সেটা না-বুঝেই বাবরের পিতা পড়শি রাজ্যগুলির সঙ্গে
পায়ে পা লাগিয়ে এলাকাগুলি দখল করতে ছুটলেন। শক্তিসামর্থ্য না-থাকার ফলে রাজ্য বিস্তার
তো দূরের কথা, উল্টে নিজের রাজ্যই ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র হতে থাকল। তাঁর রাজ্যের একটা
বড়ো অংশই চলে গেল তাঁরই শ্বশুর ইউনুস খানের কবজায় ।শ্বশুরের সেনাবাহিনীর হাতে ব্যাপক
মার খেলেন বাবরের পিতা। যুদ্ধনীতি অনুসারে বন্দিও হলেন তিনি। শিকলে বেঁধে মোঙ্গল-প্রধান
তথা শ্বশুর ইউনুস খানের কাছে হাজির করা হল বাবরের পিতা ওমর শেখ মির্জাকে। জামাইকে দেখে
তো শ্বশুরমশাই হতভম্ব। তিনি নিজেই উঠে এসে জামাইয়ের বাঁধন খুলে দিলেন এবং নানাবিধ উপহারাদি
দিয়ে ফরঘানে পাঠিয়ে দিলেন। সঙ্গে ইউনুস খান নিজে ফরঘানায় এলেন।
যাই হোক,
ইউনুস খানের মৃত্যুর পর তাঁর রাজ্য মুঘলিস্তান দুই ছেলে মাহমুদ খান ও আহমেদ খানের মধ্যে
ভাগ হল। বড়ো ছেলে মাহমুদ খানই হলেন মোঙ্গল-প্রধান। এদিকে বাবরের পিতা ওমর শেখ মির্জা
এত মার খেয়েও শিক্ষা হয়নি। তাঁর বড়ো ভাই সুলতান আহমদ মির্জা ও বড়ো শ্যালক মোঙ্গল-প্রধান
মাহমুদ খানের সঙ্গে বিবাদ বাধাতে গেলেন। মাহমুদ মির্জা কেবল আহমেদ মির্জার শ্যালকই
ছিলেন না, তাঁরা মৈত্রী সূত্রে আবদ্ধও হয়েছিলেন। সেই মিত্রতা আরও দৃঢ় করতে আহমদ মির্জার
মেয়ের সঙ্গে মাহমুদ মির্জার বিয়েও দেওয়া হয়েছিল। এই বিয়ে প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে রাজতন্ত্রে
নিজের রাজ্যকে সুরক্ষিত রাখতে এবং রাজ্যের রাজাদের সঙ্গে জোট বাঁধতে নিজেদের মধ্যে
বিয়েপ্রথা ছিল একটা সহজতম পথ। প্রয়োজনে একাধিক বিয়ে করতে হত। এটাকে বলা যায় ‘রাজনৈতিক
বিবাহ’।
বাবরের
পিতার কার্যকলাপে আহমদ মির্জা ও মাহমুদ খান দুজনেই ক্রুব্ধ হলেন। বাবরের পিতাকে চিরকালের
মতো রাজ্যক্ষুধা মিটিয়ে দিতে তাঁরা দৃঢ়সংকল্প হলেন। আহমদ মির্জা ও মাহমুদ খান ফরঘানার
দু-দিক থেকে সাঁড়াশি আক্রমণ করলেন। এই আক্রমণে ফরঘান রাজ্য ভ্যানিশ হয়ে যাওয়ার উপক্রম
হল। এই বিপর্যস্ত অবস্থাতে বাবরের পিতা ওমর শেখ মির্জা ক্ষান্ত হলেন না। ধন-সম্পদ-রাজ্য-জীবন
বাজি ধরে শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠলেন। ফরঘানার
রাজধানী অন্দিজানের শাসনভার শিশু বাবরের হাতে অর্পণ করে যুদ্ধে রওনা দিলেন। বাবরকে
সাহায্য করার জন্য রেখে গেলেন কয়েকজন বেগ বা আমিরকে। ভাগ্য সহায় না-থাকলে যা হয় ! বাবরের
পিতা উমর শেখ মির্জার মৃত্যু হল ভগ্নস্তূপ চাপা পড়ে। অখসি দুর্গ রক্ষা করতে গিয়ে দুর্গের
ভিতর কবুতরখানা বাড়িটি অকস্মাৎ ধসে পড়ে উমর শেখের ঘাড়ে। মাত্র ৩৯ বছর বয়সে তাঁর অকালমৃত্যু
হয়।
এ সংবাদ
শুনে শিশু বাবরের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। কীভাবে সে রাজ্য রক্ষা করবে ? শোকে চোখের জল
ফেলবার অবকাশ নেই তাঁর। শিশু রাজার কাছে এখন তাঁর অস্তিত্ব রক্ষাই বিরাট প্রশ্নের মুখে।
যে-কোনো মুহূর্তেই শত্রুর অস্ত্রে শিশু বাবরের শরীর ফালাফালা হয়ে পারে। শেরিম তঘাই
পরামর্শ দিলেন – ‘রাজধানী অন্দিজান ত্যাগ করে আউজকিন্টের রওনা দিন এবং সেখানকার পাহাড়ি
এলাকায় গা-ঢাকা দিয়ে থাকুন। পরে সয়-সুযোগ বুঝে বড়ো মামা সুলতান মাহমুদ বা ছোটো মামা
আহমদ খান যাঁর সঙ্গে খুশি চলে যাবেন।’ এ খবর জানাজানি হতেই রাজপরিবারের ওস্তাগর (দর্জি)
খাজা মোহম্মদ ছুটলেন শিশু বাবরকে ফিরিয়ে আনতে। সফলও হলেন তিনি। দুর্গে ফিরিয়ে আনলেন
শিশু বাবরকে। উপস্থিত বেগেরা সমগ্র পরিস্থিতি খুঁটিনাটি বিচার করে সিদ্ধান্ত নিলেন,
শত্রুপক্ষের কাছে কোনোমতেই মাথা নত করা হবে না। এরপর শিশু বাবরকে প্রচুর যুদ্ধ করতে
হয়েছিল। সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য নয়। শত্রুপক্ষের আক্রমণকে প্রতিহত করতেই তাঁকে যুদ্ধ
করতে হয়েছিল। সেই শত্রুপক্ষের মধ্যে বাবরের আত্মীয়রাই ছিল। যেমন তাঁর বড়ো মামা সুলতান
মাহমুদ বা ছোটো মামা আহমদ খান প্রমুখ। সকলের চোখেই দিগ্বিজয়ের নেশা। পররাজ্য গ্রাসের
দিকে নজর। আর শিশু বাবরের ফরঘান রাজ্য তো সকলের দৃষ্টিতে অনাথ। বাবর সহ পিতৃহীন তিন
নাবালক শিশু যাঁর উত্তরাধিকারী। তার উপর তাঁরা আবার এক মায়ের পেটের ভাই নয়। বালক রাজাকে
থিতু হয়ে বসতে দেওয়া যাবে না কিছুতেই। সুলতান আহমদ মির্জা ও মোঙ্গল-প্রধান মাহমুদ খান
ঝাঁপিয়ে পড়লেন ফরঘানে। এর ফলে অন্য রাজ্যের আক্রমণে বাবরের রাজ্য ফরঘান ক্রমশই ছোটো
হয়ে যাচ্ছে। তবু দুই শক্তিধর রাজার শক্ত হাতের মুঠোর ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসতে পেরে বালক
বাবর তাঁর সৈন্যদের মনোবল বেড়ে গেল। একসময়
শত্রুমুক্ত হয়ে বালকরাজা বাবর ও তাঁর বেগেরা এবার নিজরাজ্যের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে তৎপর
হলেন। নজর দিলেন প্রশাসন ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার দিকে ।একথা বলে রাখা জরুরি যে, মুসলিম
শাসকদের মাতামহীরা ছিলেন প্রবল ক্ষমতাধর, বিচক্ষণ। সিরাজের পাশে যেমন ছিলেন তাঁর নানিজান,
তেমনি বালক বাবরের পাশেও পাচ্ছি মাতামহী অইসান দৌলত বেগমকে। অতি বুদ্ধিমতী ছিলেন এই
মহিলা। রাজ্যের প্রকৃত ক্ষমতা তো আসলে তাঁর হাতেই ছিল। তাঁর নির্দেশ-উপদেশ মতোই রাজ্য
পরিচালিত হত।
বাবরের
কাকা উপর্যুপরি তাঁকে সিংহাসন চ্যুত করার চেষ্টা করেছিলেন। অন্যন্য বহিঃশত্রুতা ছিলই।
একসময় সে বাবরকে ক্ষমতাচ্যূত করতেও সফল হয়। ফলে জীবনের বেশকিছু সময় তাঁকে আশ্রয়হীন
এবং যাযাবর থাকতে হয় কিশোর বাবরকে। এই সময়টুকুতে তাঁর সঙ্গে কেবল তাঁর বন্ধু ও চাষিদেরই
যোগাযোগ ছিল। ১৪৯৭ খ্রিস্টাব্দে বাবর সমরকন্দের উজবেক শহর আক্রমণ করেন। সাত মাস পর
সেই শহর দখল করতে সমর্থ হন। কিন্তু ফরগানায় কিছু নোবেলদের বিদ্রোহের কারণে তাঁকে স্থানটি
হারাতে হয়। ফরগানা পুনরুদ্ধারের জন্য অগ্রসর হলে তাঁর বাহিনীর লোকজন তাঁকে ফেলে চলে
যায। ফলে তাঁকে সমরকন্দ ও ফরগানা উভয় অঞ্চলই হারাতে হয়। ১৫০১ খ্রিস্টাব্দে বাবর পুনরায়
সমরকন্দের দখল নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হন। তবে বাবর পরাক্রমশালী প্রতিপক্ষ মোহাম্মদ শেবানি
খানের কাছে বিশ্রীভাবে পরাজিত হন। তবে তিনি তাঁর কয়েকজন অনুগামীদের নিয়ে পালিয়ে যেতে
সক্ষম হন।
বাবর বুঝলেন
এভাবে হয় না। এভাবে টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব। তাঁর সেনাবাহিনীকে প্রচণ্ড শক্তিশালী করে
তুলতে হবে। তিনি একটি শক্তিশালী সৈন্যদল গঠনে মনযোগী হন। বিশেষ করে সেই সেনাদলে প্রধানত
তাজিক ও বাদাক্শানদেরকে তাঁর দলে অন্তর্ভুক্ত করেন। ১৫০৪ খ্রিস্টাব্দে বরফাবৃত অঞ্চল
হিন্দুকুশ পর্বত অতিক্রম করেন এবং কাবুল (বর্তমানে আফগানিস্তানের অন্তর্ভুক্ত, রাজধানী)
দখল করেন। এই দখলের মধ্যে দিয়ে তিনি একটি নতুন ধনী ও সমৃদ্ধ রাজ্য লাভ করে নিলেন। অনুকূলে
ঘুরে যায় বাবরের ভাগ্য এবং তিনি ‘বাদশাহ’ উপাধি গ্রহণ করেন। এর মধ্যে তিনি এই রাজ্যকে
প্রাচূর্য্যমণ্ডিত করে তোলেন। হেরাতের শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের আধিক্য তাকে
চমৎকৃত করে। ঘনিয়ে আসা একটি বিদ্রোহ তাঁকে হেরাত থেকে কাবুল আসতে বাধ্য করে। তিনি
এই পরিস্থিতিও সামলে নেন। তবে দুই বছর পর একটি বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পর তাঁর কিছু শীর্ষস্থানীয়
নেতা তাঁকে কাবুল থেকে তাড়িয়ে দেন। বাবর কিছু সঙ্গী সহ সেই মুহূর্তে শহর ছেড়ে পালিয়ে
গেলেও পুনরায় তিনি শহরে ফিরে এসে কাবুল দখল করেন। বিদ্রোহীদের তিনি তাঁর অধীনে আনতে
সক্ষম হন। অপরদিকে বাবর যাঁর কাছে বিশ্রীভাবে পরাজিত হয়েছিলেন সেই মোহাম্মদ শেবানি
খান ১৫১০ খ্রিস্টাব্দে পার্সিয়ার শাসনকর্তা ইসমাঈল সাকাভিদের কাছে নিহত হন। বাবর সেই
সুযোগের সদব্যবহার করলেন। তাঁর পূর্বপুরুষের রাজ্য তিমুরিদ পুনঃরুদ্ধার করতে চেষ্টা
করেন এবং বছর কয়েক বাদে বাবর শাহ ইসমাঈলের সঙ্গে মধ্য এশিয়া দখলের জন্য মিলিত হন।
বাবর সাকাভিদকে তাঁর রাজ্যে ‘সার্বভৌম’ রাজা হিসাবে পরিচালনা করার অনুমতি দেন। শাহ
ইসমাঈল বাবর ও তাঁর বোন খানজাদার মধ্যে পুনর্নিলন ঘটান। খানজাদাকে শেবানি খান বন্দি
করে জোরপূর্বক বিয়ে করেছিলেন। ইসমাঈল বাবরকে অনেক ধনসম্পদ এবং রসদ সরবরাহ করেছিলেন।
প্রতিদানে বাবর শাহ ইসমাঈলকে শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রদান করেন। ১৫১১ খ্রিস্টাবে প্রায়
দশ বছর পরে বাবর সমরকন্দে পুনরায় প্রবেশ করতে সমর্থ হন। বাজার স্বর্ণবেষ্টিত হয়ে গিয়েছিল
এবং আবারও জনগণ তাঁদের মুক্তিদাতাকে সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। আট মাস পরে বাবর পুনরায়
উজবেক জয় করতে সক্ষম হন।
বাবরের
এবারের লক্ষ্য ভারত ভূখণ্ড। শৈশবকাল লড়াই করতে করতে শত্রুর মোকাবিলা করতে করতে বাবরের
মনোবল ও আত্মবিশ্বাস প্রবলতর হয়েছে। এদিকে পশ্চিমদিক থেকে উজবেকদের আক্রমণের ভয়ও ছিল
তাঁর। বলা যায় আত্মরক্ষার জন্যেই তাঁকে ভারতের দিকে মনোনিবেশ করতে হয়। বিশেষ করে আইয়ুদিয়ার
রাজ্য এবং পেনিনসুলার মালায়া।
তিনি কাবুলের
পশ্চিমদিক থেকে আক্রমণ চালানোর একটি রণকৌশল ঠিক করেন ভারত দখলের জন্য। পূর্বেই কান্দাহার
অবরোধ করে দিয়েছিলেন। প্রায় তিন বছর পর কান্দাহার ও এর পৌরদুর্গ বেদখল হয়েছিল এবং
এছাড়াও অন্যান্য ছোটোখাটো যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই খণ্ডযুদ্ধগুলো বাবরকে সফল হওয়ার সুযোগ
করে দেয়। পাঞ্জাবে প্রবেশের সময় বাবরের রাজদূত লঙ্গর খান নিয়াজি বাবরকে পরামর্শ
দেন জানজুয়ার রাজপুত্রকে এই অভিযানে সম্পৃক্ত করার জন্য, তাঁদের এই দিল্লি জয়ের অভিযান
বেশ পরিচিত লাভ করে। বাবর তাঁর প্রধান ব্যক্তি মালিক আসাদ এবং রাজা সংঘর খানের কাছে
তাঁর রাজ্যে ঐতিহ্যগত শাসনের সুফল এবং তার পূর্বপুরুষের সহযোগিতার কথা তাঁদের কাছে
উল্লেখ করেন। বাবর শত্রুদের পরাজিত করে তাঁদের নিজের দলে ভিড়ান। ১৫২১ সালে গাখারসে
তার মিত্রদের একত্রিত করেন। বাবর তাঁদের প্রত্যেককে সেনাপ্রধান হাসান রানা সঙ্গকে পরাজিত
করেন, এটিও তার ভারত দখলের অন্তর্ভুক্ত। ইসমাঈলের
বিশাল অশ্বারোহী বাহিনী নিশ্চিহ্ন হয় অটোম্যান রাজার বিরুদ্ধে চালদ্রিরান যুদ্ধে।
এই যুদ্ধে ‘ম্যাচলক মাস্কেট’ নামক এক ধরনের নতুন অস্ত্র ব্যবহার করা হয়। বাবর এবং
ইসমাঈল দু’জনেই প্রযুক্তির উন্নয়ন উপলব্ধি করেন এবং বাবর তার বাহিনীকে ম্যাচলক যন্ত্রের
প্রশিক্ষণ দিতে একজন অটোম্যান উস্তাদ আলিকে তাঁর বাহিনীতে আমন্ত্রণ জানান। উস্তাদ আলিকুলি
খান তখন ম্যাচলক মানব নামে পরিচিত ছিলেন। এই অস্ত্রগুলো স্বল্পসংখ্যক সৈন্যের হাতে
দেওয়া হয় শত্রুদের মোকাবিলা করার জন্য। ভারতের পথে অগ্রসর হওয়ার সময় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র
জাতিগুলোর সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধের সময় এটি ব্যবহার করা হয় শুধুমাত্র শত্রুদের অবস্থান
এবং কৌশল পরীক্ষা করার জন্য। বাবর কোনো অঞ্চল জয়ের পর স্থানীয়দের খুশি করার চেষ্টা
করতেন। স্থানীয় মানুষরা তাঁর উপর যাতে বিরাগভাজন হয়ে না পড়েন সেজন্য স্থানীয় সংস্কৃতি
পালনের পাশাপাশি বিধবা ও অনাথদের সাহায্য করতেন।
ইব্রাহিম
লোদি তাঁর রাজ্যের কাছে খুবই অপ্রিয় মানুষ ছিলেন, এমনকি তাঁর নিজস্ব নোবেলদের কাছেও
বিরাগভাজন ছিলেন। বাবর প্রায় ১২০০০ সৈন্য সংগ্রহ করেন এবং লোদির আফগান নোবেলদেরকে তাঁর
শামিল হওয়ার আমন্ত্রণ জানান। এই সৈন্যসংখ্যা ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছিল। কেননা তাঁরা অগ্রসর
হওয়ার সময় স্থানীয় অনেকেই তাঁদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছিল। ১৫২৬ সালের ২১ এপ্রিলে ইব্রাহিম
লোদিও প্রায় এক লক্ষ সৈন্য এবং ১০০টি হাতি সহ বাবরের দিকে অগ্রসর হন। তখন বাবরের সৈন্যসংখ্যা
লোদির অর্ধেকেরও কম ছিল, যা সর্বসাকুল্যে প্রায় ২৫০০০-এর মতো। সংঘটিত এই যুদ্ধটি পানিপথের
প্রথম যুদ্ধ নামে খ্যাত। এটাই বাবর ও লোদির মধ্যে প্রধান সংঘাত। আধুনিক প্রযুক্তিতে
তৈরা করা ‘ম্যাচলক মাস্কেট বাবরের সৈন্যদলে থাকার কারণে এই যুদ্ধে ইবরাহিম লোদি নিহত
হন এবং তাঁর সৈন্যবাহিনীদের পরাজিত করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। বাবর আর কালবিলম্ব না-করে
দ্রুত দিল্লি এবং আগ্রা উভয়ের দখল নেন। ঐদিনই বাবর তাঁর পুত্র হুমায়ুনকে আগ্রা যাওয়ার
আদেশ দেন জাতীয় ধনসম্পদ লুটপাটের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য। হুমায়ুন সেখানে গোয়ালিয়রের
রাজাকে পেয়ে যান। সেই রাজার সঙ্গে যুদ্ধ সংঘঠিত হয় এবং রাজা যুদ্ধে নিহত হন। রাজার
পরিবারের সদস্যরা নিরাপত্তা নিশ্চয়তা লাভের আশায় হুমায়ুনকে একটি বড়ো হিরে দেন।
এই হিরেটিই জগদ্বিখ্যাত কোহিনুর। কোহিনুর শব্দের
অর্থ আলোর পর্বত।
বিজয়ের
তৃতীয় দিন বাবর দিল্লি পৌঁছোন। পরে তিনি আগ্রার দিকে অগ্রসর হন ছেলে হুমায়ুনের সঙ্গে
সাক্ষাতের জন্য। দিল্লি ও আগ্রা দখলের পর বাবর মেবারের রাজপুত রাজ রানা সংগের দুশ্চিন্তায়
বিনিদ্র রজনী কাটাতে লাগলেন। বাবরের অভিযানের আগে রাজপুতের জমিদারেরা সালতানাতের কিছু
জাতি জয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁরা বাবরের নতুন রাজ্যের দক্ষিণ পশ্চিমের একটি অঞ্চল
সরাসরি শাসন করত, যা ‘রাজপুতানা’ নামে পরিচিত ছিল। এটি কোনো একতাবদ্ধ রাজ্য ছিল না।
বলা যায়, এটি ছিল রানা সংগের অধীনস্থ কিছু রাজ্যের সমষ্ঠি।
বাবর আক্রমণকারীই
হোন অথবা বিজয়ী -- বাবর সম্পর্কে সাধারণ মানুষের কাছে খুব বেশি তথ্য নেই। ইতিহাসবিদ
হরবংশ মুখিয়ার কথায়, “সংস্কৃতি, সাহসিকতা আর সেনা পরিচালনার ক্ষেত্রে বাবর নি:সন্দেহে
এক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন। যদি বাবর ভারতে না আসতেন, তাহলে এই দেশের সংস্কৃতি
হয়তো এতটা বিচিত্র হওয়ার সুযোগ পেত না।” ভাষা, সঙ্গীত, চিত্রকলা, স্থাপত্য, পোশাক
অথবা খাবার-দাবার - প্রতিটা বিষয়েই মুঘলদের অবদান অনস্বীকার্য বলে মনে করেন ইতিহাসবিদ
মুখিয়া।
হরবংশ
মুখিয়ার মতে, বাবরের চিন্তাধারায় কখনও হার না মানার একটা মানসিকতা ছিল। শারীরিক দিক
থেকে সম্রাট বাবর ভীষণ শক্তপোক্ত গড়নের মানুষ ছিলেন। কথিত আছে, তিনি তাঁর দুই কাঁধে
দুজন প্রাপ্তবয়ষ্ক মানুষ নিয়ে দৌড়ে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে যেতে পারতেন। এছাড়া একটানা ৩০
ঘণ্টা সাঁতার কাটতে পারতেন তিনি। একজন সফল শাসক তথা যোদ্ধার যেমনটা হওয়া উচিত। তাঁর
মাথায় সমরখন্দ দখলের স্বপ্ন ছিল। তিনবার দখল করেছিলেন, কিন্তু প্রতিবারই ফিরে আসতে
হয়েছিল তাঁকে। যদি তিনি সমরখন্দ দখলে সফল হতেন, আর সেখানকার রাজা হিসাবেই থেকে যেতেন,
তাহলে হয়তো কাবুল বা ভারত দখল করে রাজত্ব করার কথা তিনি ভাবতেনও না। তাছাড়া উজবেকদের
ভয়েও বাবরের ভারতে আসার অন্যতম কারণ।
তুর্কি
ভাষায় কবিতা লিখতেন বাবর। বাবরনামায় ব্যবহৃত বেশ কিছু শব্দ এখন ভারতে প্রতিদিনের
ভাষার অঙ্গ হয়ে গেছে। যেমন ‘ময়দান’ শব্দটা তাঁর জীবনীতেই প্রথমবার দেখা যায়। সেভাবেই
অনেক তুর্কি আর ফারসি শব্দ ভারতীয়দের মুখের ভাষায় ঢুকে গেছে। ইতিহাসবিদ মুখিয়ার মতে যুদ্ধ, সাম্রাজ্য পরিচালনার মধ্যেও
নিজের পরিবারের প্রতি নিষ্ঠাবান ছিলেন বাবর। ১৫২৯ সালে ঘাঘরার যুদ্ধে আফগানদের বিরুদ্ধে
চূড়ান্ত বিজয় মোগল সাম্রাজ্যকে হিন্দুস্তানে পাকাপোক্ত একটি অবস্থান গড়ে দিলো। যদিও
খানুয়ার যুদ্ধে রাজপুতদের পরাজয়ের পর মুঘল সাম্রাজ্যের সমস্ত শত্রুশক্তিই মাটিতে মিশে
গিয়েছিল। কিন্তু তারপরেও হিন্দুস্তানের পূর্বাঞ্চলে আফগানরা বেশ শক্ত অবস্থান ধরে রেখেছিলো।
অবশেষে নতুন আফগান অধিপতি ইব্রাহীম লোদির ভাই সুলতান মাহমুদের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে মুঘল
সাম্রাজ্যের জন্য শেষ এই হুমকিটিও নির্মূল হয়ে গেলো। ঘাঘড়ার যুদ্ধের বেশ কয়েকমাস আগেই,
১৫২৭ খ্রিস্টাব্দের ১৬ মার্চ খানুয়ার যুদ্ধে রাজপুতদের পরাজিত করে সম্রাট বাবর নিজের
পরিবারের জন্য হিন্দুস্তানকে নিরাপদ ভাবতে শুরু করেন।
২২ ডিসেম্বর,
১৫৩০ সাল। আগ্রার পুরোনো দুর্গ। নিজের শারীরিক দুর্বল অবস্থা নিয়েই সম্রাট বাবর রাজদরবারে
তাঁর সিংহাসনে গিয়ে বসলেন। পরিবার আর সভাসদের সবাই অনুরোধ করছিলেন যা বলার তা নিজের
ব্যক্তিগত কক্ষ থেকেই ঘোষণা করতে। কিন্তু সম্রাট বাবর চাইছিলেন যা বলার তা এই সিংহাসন
থেকেই বলবেন। অসুস্থ সম্রাট সিংহাসনে বসে আছেন। দরবার আর পরিবারের লোকেরা উৎসুক দৃষ্টিতে
সম্রাটের দিকে চেয়ে আছেন। সম্রাট বাবর হঠাৎ কিছু বলতে শুরু করলেন। তবে তার কন্ঠ শুনে
বোঝা যাচ্ছিলো কথা বলতে সম্রাটের বেশ কষ্ট হচ্ছিল। তারপরও তিনি বলতে লাগলেন -- ‘আল্লাহর
কৃপায় ও আপনাদের সমর্থনে আমি আমার জীবনে সব কিছুই অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি। পৃথিবীতে
আমার সব ইচ্ছাই পূরণ হয়েছে। তবে আমি সুস্থ অবস্থায় নিজের সব কাজ সম্পন্ন করতে পারলাম
না। আজ আপনাদের সামনে আমি নিজের শেষ ইচ্ছা প্রকাশ করছি। আমার পরে আমি মুঘল সিংহাসনে
হুমায়ুনকে বসিয়ে যেতে চাই। আমি আশা করবো, আমার প্রতি আপনারা যেমন অনুগত ছিলেন, বাদশাহ
হিসেবে আপনারা হুমায়ুনের প্রতিও ঠিক তেমনই অনুগত থাকবেন। তার সকল কাজকে সমর্থন জানাবেন।
আমি আশা করছি, মহান আল্লাহর দয়ায় হুমায়ুন সফলভাবে তার দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হবে।’
এরপর সম্রাট বাবর হুমায়ুনের দিকে তাকিয়ে দুর্বল কন্ঠে বললেন -- ‘হুমায়ুন আমি তোমাকে,
তোমার ভাই-বোন, আত্মীয়স্বজন ও তোমার প্রজাদের আল্লাহর হাতে সমর্পণ করে যাচ্ছি।’
সম্রাট
বাবর চাইলেই পারতেন নিজের ব্যক্তিগত কক্ষে সবাইকে ডেকে নিজের শেষ ইচ্ছার কথা বলে যেতে।
কিন্তু তিনি ষড়যন্ত্রকারীদের কোনো সুযোগ দিতে রাজি ছিলেন না। তিনি জানতেন, তাঁর মৃত্যুর
পর হুমায়ুনকে সিংহাসনে বসতে বাঁধা দেওয়া হবে। তাই জীবিতকালেই সকলের সামনেই আনুষ্ঠানিকভাবে
তিনি হুমায়ুনকে সিংহাসনের বৈধ দাবিদার স্বীকৃতি দিয়ে দিলেন। তিনি ভালো করেই জানতেন,
চার বছর আগে ইব্রাহিম লোদির মায়ের দেওয়া বিষের ফলে তিনি যখন শয্যাশায়ী ছিলেন, তখন এই
দরবারের একাংশ হুমায়ুনের পরিবর্তে তাঁর ভগ্নিপতি মেহেদি খাজাকে সিংহাসনে প্রায় বসিয়ে
ফেলার আয়োজন করে ফেলেছিল। সম্রাট বাবর হয়তো এই ষড়যন্ত্রের ব্যাপারটি জানতেনই না, কিন্তু
মেহেদি খাজার বোকামিতে বিষয়টি ধরা পড়ে যায়। হুমায়ুনের পরামর্শে মেহেদি খাজাকে নিজের
বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। একইসঙ্গে তাঁর জন্য দরবারের কারোর সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং বাবরের দরবারে
নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। সেইবার বাবর বেঁচে গেলেও বিষের প্রভাব তাঁর শরীরে থেকে গিয়েছিল।
খুব ধীরে ধীরে হলেও বিষাক্রান্তের ফলে শরীরের ভিতর থেকে দুর্বল হচ্ছিলেন তিনি। এমনিতেই
হিন্দুস্তানের আবহাওয়াও বাবরকে কম ভোগায়নি। সব মিলিয়ে হিন্দুস্তানে আসার পর থেকেই বাবর
বিভিন্ন মানসিক আর শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছিলেন।
পুত্র
হুমায়ুনের প্রতি ছিল গভীর পিতৃস্নেহ ছিল। হুমায়ুনকে তিনি তাঁর অন্য যে-কোনো পুত্র
থেকে বেশি ভালোবাসতেন। গোটা হিন্দুস্তান অভিযানের সময় বাবরকে সঙ্গ দিয়েছিলেন তাঁর এই
পুত্র। তাই বাবর আর হুমায়ুনের মাঝে একটি বিশেষ আত্মিক বন্ধন তৈরি হয়েছিল, যা বাবরের
মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত বজায় ছিল। ইতিহাসবিদ লিখেছেন, হুমায়ুনের একবার কঠিন অসুখ হয়েছিল,
সেই সময়ে বাবর ছেলের শরীর ছুঁয়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করেছিলেন যে, “হে আল্লাহ,
যদি একজনের প্রাণ নিয়ে আরেকজনের প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়, তাহলে পুত্রের প্রাণের
বিনিময়ে আমার নিজের প্রাণ উৎসর্গ করতে আমি প্রস্তুত।” মুখিয়া বলেন, “হুমায়ুন সে যাত্রা
সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন বটে, কিন্তু ওই ঘটনার কিছুদিন পরেই বাবর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং
তারপরেই তাঁর মৃত্যু হয় ২৬ ডিসেম্বর, ১৫৩০ সাল। ।” ১২ বছর বয়স থেকে ৪৭ বছর বয়সে মৃত্যু
পর্যন্ত টানা যুদ্ধ করে যেতে হয়েছে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহিরুদ্দিন মোহম্মদ
বাবর। সম্রাট বাবর মৃত্যুর পূর্বেই তাঁকে কাবুলে সমাহিত করার নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন।
তাঁর ইচ্ছানুযায়ীই মৃত্যুর পর মোগল এই বীরকে যমুনার আড়াই কিলোমিটার পূর্বে আরামবাগের
চারবাগে সমাহিত করা হয়। এখানেই একটি বিভ্রান্তির
সৃষ্টি হয়েছে। যমুনার পূর্বদিকে তৎকালীন সময়ে
প্রচুর বাগান ছিল, যা হিন্দুস্তানের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য থেকে বেশ ব্যতিক্রম ছিল। ঠিক
এ কারণেই হিন্দুস্তানের অধিবাসীরা তখন এই স্থানটিকে কাবুল বলত। বাবর তাঁর ইচ্ছাতে এই
কাবুলের কথাই বলেছেন। আর সম্রাট হুমায়ুনও পিতার ইচ্ছাটির কথা জানতেন। তাই সম্রাট বাবরকে
যমুনার পূর্ব তীরেই সমাহিত করা হয়েছিল। কিন্তু শের শাহের শাসনামলে বাবরেরই এক স্ত্রী
বেগা বেগম বাবরের দেহাবশেষ আফগানিস্তানের কাবুলে বাবরের আর-এক সৃষ্টি ‘বাগ-ই-বাবুর’-এ
স্থানান্তর করেন। বেগা বেগমের এই সিদ্ধান্তের কারণ আজও অস্পষ্ট! বাদশাহ বাবরের আদেশে
১৫২৮ খ্রিস্টাব্দে কাবুলে এই বাগানটি নির্মাণ করা হয়েছিল। মোগলদের সবসময়ই বাগানের প্রতি
বিশেষ আকর্ষণ ছিল। মোগলরা যেখানেই সীমানা বিস্তার করতে পেরেছিলেন, এখানেই তৈরি করেছেন
বিভিন্ন সুন্দর সুন্দর বাগান। কিন্তু এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, হুমায়ুন সে সময় ক্ষমতায়
থাকলে নিজের পিতার সমধি কখনোই আফগানিস্তানের কাবুলে স্থানান্তর করা হত না। বাবর সারাজীবন
তাঁর ভালোবাসার হিন্দুস্তানের মাটিতেই শুয়ে থাকতে পারতেন। হিন্দুস্তান বাবরের নিকট
অপছন্দের হলেও তিনি নিজের ভাগ্য মেনে নিয়েছিলেন। তিনি জানতেন, তাঁর ভবিষ্যৎ বংশধররা
ঠিকই একদিন হিন্দুস্তানকে নিজেদের মতো করে সাজিয়ে নেবে। আর তাঁরা হিন্দুস্তানকে মন
থেকেই আপন করে নেবে। বাবরের ধারণা কোনো অংশেই ভুল প্রমাণিত হয়নি। বাবরের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম
ঠিকই হিন্দুস্তানকে ভালোবেসে শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছিলেন। নিজেদের মনমতো নানা রঙে তাঁরা
হিন্দুস্তানকে সাজিয়ে তুলেছিলেন। আজও হিন্দুস্তানের পথে প্রান্তরে তাঁদের ভালোবাসার
সেসবের ছাপ খুঁজে পাওয়া যায়। তবে বাবর একবারেই হিন্দুস্তানকে পছন্দ করতে পারেননি। পছন্দ
করতে পারেননি মূলত জলবায়ু ও আবহাওয়ার কারণে। বাবর লিখেছেন – “হিন্দুস্তানে কোনো মজা
নেই। লোকগুলোর কোনো সৌন্দর্য নেই ... এদের শিল্পকলা, হাতের কাজে কোনো সুসংগতি, সামঞ্জস্য
নেই... এখানে বরফ পাওয়া যায় না... কোথাও স্নানাগার নেই।” উত্তর-পশ্চিম ভারতের বর্ষাকাল
বাবরের পছন্দ ছিল বটে। তবে ভ্যাপসা ভাবটা একদম পছন্দের ছিল না। যে বাবরনামার জন্য বাবর
সর্বাধিক স্মরণীয়, সেই বাবরনামায় ১৫২৮ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত
এই পাঁচ মাসের বিবরণ পাওয়া যায় না। ওই অংশটা হারিয়ে গেছে। কীভাবে হারাল তা রহস্যাবৃত।
অনেকে বলেন, ওই সময়কালে বাবর অযোধ্যায় ছিলেন এবং নির্মাণ হয় বাবরি মসজিদ। বাবরনামা
থেকে ওই সময়ের পৃষ্ঠাগুলি হারিয়ে যাওয়ায় রামমন্দির ধ্বংস করে মসজিদ গড়েছিল, নাকি মসজিদস্থলে
কোনো মন্দির ছিলই না, তা জানার কোনো উপায় নেই। বাবরি মসজিদ বিষয়ে পরে বিস্তারিত আলোচনা
করব।
মৃত্যুর
পূর্বে সম্রাট বাবর তাঁর পুত্রের জন্য ফারসিতে ‘ওয়াসিয়াতনামা-ই-মাখফি’ বা ‘গোপন উইল’
শিরোনামে একটি গোপন নির্দেশনামা রেখে যান। এই উইলটি ভারতের ভুপালের হামিদা লাইব্রেরিতে
সংরক্ষিত ছিল। নানলাল সি মেহতা (তিনি এনসি মেহতা নামেই বেশি জনপ্রিয়)। সাহাদত হোসেন
খানের ‘মোগল সাম্রাজ্যের সোনালী অধ্যায়’ শীর্ষক গ্রন্থটির সৌজন্যে উইলটির বাংলা অনুবাদ
উৎসুক পাঠকদের জন্য উল্লেখ করা হল – “সকল প্রশংসা মহান আল্লাহর জন্য। নাসরুদ্দিন মুহাম্মদ
হুমায়ুনের নিকট জহির উদ-দিন মোহাম্মদ বাবর বাদশাহ গাজির গোপন উইল। আল্লাহ তোমাকে দীর্ঘজীবী
করুন। সাম্রাজ্যের স্থিতিশীলতার জন্য আমি তোমার নিকট এই নির্দেশাবলি রেখে যাচ্ছি। আমার
প্রিয় পুত্র, হিন্দুস্তান একটি বৈচিত্রপূর্ণ দেশ। মহান আল্লাহর কাছে অসংখ্য কৃতজ্ঞতা
প্রকাশ করছি যে, তিনি হিন্দুস্তানকে আমার সাম্রাজ্য হিসাবে দান করেছেন। তোমাকে সকল
ধর্মীয় গোঁড়ামির উর্ধ্বে উঠে প্রত্যেক ধর্মের মূলনীতি অনুযায়ী ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা
করতে হবে। তবে, বিশেষ করে হিন্দুস্তানে গোরু জবাই থেকে বিরত থাকতে হবে। গোরু জবাই থেকে
বিরত থাকাই হচ্ছে এ দেশের মানুষের মন জয় করে নেওয়ার একমাত্র উপায়। এই কাজটি করলে সাম্রাজ্যের
হিন্দুপ্রজারা তোমার অনুগত থাকবে। রাজকীয় নিয়ন্ত্রণের আওতাভুক্ত প্রতিটি সম্প্রদায়ের
মন্দির ও উপাসনালয় ধ্বংস করা থেকে বিরত থাকতে হবে। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবে, যেন
তুমি তোমার প্রজাদের নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারো। এর ফলে প্রজারাও তোমাকে নিয়ে সন্তুষ্ট
থাকবে। উদারতার সাহায্যে এই দেশে ইসলামকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। তরবারির সাহায্যে নয়।
শিয়া ও সুন্নিদের মতপার্থক্যকে আমল দেবে না। শিয়া ও সুন্নিদের মতপার্থক্য হল ইসলামের
ভিতর দিকের একটি দুর্বলতা। চারটি মূলনীতিতে সকল ধর্মের প্রজাদের এক কাতারে নিয়ে আসবে।
হজরত তাইমূর সাহিব-কিরানির শিক্ষা স্মরণ রাখবে, যাতে শাসনকাজে তুমি পরিপক্বতা অর্জন
করতে পারো। কখনো ভাইদের বিরোধিতা করবে না, যদিও এর প্রয়োজন দেখা দেয়। (প্রথম জমাদিউল
আউয়াল, ৯৩৫ হিজরি, ১১ জানুয়ারি, ১৫২৯ সাল)”
আমরা বাবর
সম্পর্কে যেটুকু জানতে পারি তা বাবর রচিত ‘বাবরনামা’ থেকেই। এছাড়া ওঁর কনিষ্ঠা কন্যা
গুলবদন বেগমের স্মৃতিকথা ‘হুমায়ুননামা’ থেকেও কিছু জানতে পাই। এছাড়া যেসব সূত্র থেকে
বাবর সম্পর্কে জানতে তার বেশিরভাগই অতিরঞ্জিত এবং স্ববিরোধে ঠাসা। বাবরনামাই ইসলামীয়
সাহিত্যের প্রথম আত্মজীবনী। আত্মজীবনী হলেও বাবর এই রচনাকে ইতিহাস হিসাবেই দেখতেন এবং
তাঁর দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ছিল যে, বিবরণে তিনি যৎপরনাস্তি সৎ ও নিরপেক্ষ থাকবেন। বাবরনামায়
সম্রাট বাবর লিখেছেন – “আমি এত সব লিখেছি কোনো অনুযোগ করার জন্য নয়। আমি কেবল সত্যটা
তুলে ধরেছি। নিজের প্রশংসা করার জন্যেও এসব লিখিনি। যা যা ঘটেছে ঠিক ঠিক সেই বিবরণই
দিয়েছি। যেহেতু এই ইতিহাসে শুধু সত্যটুকুই লিখব মনস্থ করেছিলাম এবং সত্যের বাইরে কিছু
ছোঁব না, তাই বাবা বা ভাইয়ের যা ভালো এবং যা মন্দ দেখেছি তার সবই উল্লেখ করেছি। সেইসঙ্গে
আত্মীয় বা অপরিচিতের সমস্ত গুণ ও দোষের কথা বলেছি। পাঠক যেন আমায় ক্ষমা করেন। এই রচনা
পাঠ হলে শ্রোতা যেন দোষ না ধরেন।” এইভাবে বাবরনামায় বাবরের মুখোমুখি করায় আমাদের। একজন
সামরিক যোদ্ধা হিসাবে বাবর নিঃসন্দেহে বর্বর খুনে ছিলেন এবং অবশ্যই কবি ও পণ্ডিত ব্যক্তি
ছিলেন।
মহাপণ্ডিত
রাহুল সাংস্কৃত্যায়ন রচিত ‘মধ্য এশিয়া কা ইতিহাস’ নামে গ্রন্থে যা লিখেছেন, তা এখানে
উল্লেখ করা অত্যুক্তি হবে মনে করি না। তিনি লিখেছেন – বাবর বাদশাহ তাঁর আপন দেশে চুঘতাই
ভাষায় একজন শ্রেষ্ঠ ও সাহিত্যিক হিসাবেই পরিচিত। তাঁর রচনা সে দেশের নীচু শ্রেণি থেকে
উঁচু শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয়। তাঁর লেখা গদ্য পদ্য ইত্যাদি রচনা সব শ্রেণিতে অবশ্যপাঠ্য।
বলা বাহুল্য, ওদেশের মানুষের কাছে সাহিত্যিক পরিচয়ের বাইরে সাম্রাজ্য বিজেতা বাবরের
পরিচয় অতি নগণ্য এবং গৌণ। সংগত কারণেই ভারতের ইতিহাসে বাবরের সাহিত্য কীর্তি কেউ জানে
না বললেই চলে চলে। এখানে সাম্রাজ্য বিজেতা ও মোগল রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবেই আলোচিত।
ভয়াল, ভয়ংকর এক বিদেশি সাম্রাজবাদীর চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই
যে, বিশ্ব-ইতিহাসে বাবরের মতো প্রতিভাধর ব্যক্তির দৃষ্টান্ত বিরল, যিনি এক হাতে তলোয়ার
ও অন্য হাতে কলম নিয়ে বিশ্বজয়ের পথে পা বাড়িয়েছিলেন। তলোয়ার দিয়ে তিনি বিশ্বজয় করতে
তেমন সমর্থ না-হলেও কিছু ভূখণ্ড তো শাসন করেছিলেনই। তবে নিঃসন্দেহে বলা যায়, তিনি তাঁর
কলমাস্ত্র দিয়ে বিশ্বমানুষের হৃদয় জয় করে নিয়েছেন।
তবে মোগল
সাম্রাজ্য নিঃসন্দেহে বিশাল ছিল। কিন্তু সেই সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক শৃঙ্খলা ছিল অপূর্ণ।
বাবর তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, যোগ্য ব্যক্তিদের দূরবর্তী পরগনাগুলিতে পাঠিয়ে শাসনব্যবস্থা
কায়েম করার অবসর তিনি পাননি। তা ছাড়া বাবরের শাসকীয় যোগ্যতাও তেমন ছিল না। অতি দ্রুত
তিনি সাম্রাজ্যের আয়তন বাড়িয়েছিলেন একথা যেমন সত্য, তেমনি তাঁর সাম্রাজ্যের শাসনশৃঙ্খলা
ছিল শিথিল। প্রান্তিক কেন্দ্রগুলোতে দিওয়ান এবং তার নীচের স্তরে কোতওয়াল ও শিকদার ছিলেন
রাজ্যের প্রধান প্রশাসক। দূরের সাম্রাজ্যগুলিতে কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল
না। বাবর এর জন্য কোনো চেষ্টা করেননি। শুধুমাত্র সামরিক শক্তির উপর শাসন নির্ভরশীল
ছিল। জনসাধারণের মোগল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার বিশেষ কোনো প্রভাবই ছিল না। মোগল সাম্রাজ্যের
সুবিধা-অসুবিধা মূল সমাজের নিম্নস্তর পর্যন্ত পৌঁছোতে সক্ষম হয়নি। তা ছাড়া জনসাধারণও
মোগলদের দেশীয় ভাবত না, ভাবত বিদেশি। ফলে কখনো সখনো তাঁরা বিদ্রোহ করত। মোগল সাম্রাজ্যের
প্রথম পাঁচ বছর তো যুদ্ধবিগ্রহই লেগে ছিল। আর্থিক অবস্থাও ছিল শোচনীয়। বাবর ধনসম্পদের
প্রচুর অপব্যবহার করতেন। তাঁর দানপ্রিয়তার কারণেও আর্থিক দূরবস্থা আরও প্রকট হয়ে পড়ে।
বাবরের সৈন্যদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন দেশের লোক ছিল, যেমন – চুঘতাই, মোগল, ইরানি, তুরানি,
আফগানি ও ভারতীয়। নানা জাতি, নানা বর্ণ, নানা ধর্মের কারণে সেনাদের মধ্যে পূর্ণ ঐক্য
ছিল না। সেনা সংগঠনগুলি ছিল মূলত গোত্রপতিনির্ভর। মোগল সংস্কৃতি বলতে যা বুঝি বাবর
তা কোনোদিনই প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি।
বাবরের
কথা লিখলে ‘বাবর-ই-মসজিদ’ নিয়ে তো লিখতেই হয়। বাবর-ই-মসজিদ, যা ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে ভেঙে
গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। দাবি : বাবর মন্দির ভেঙে এখানকার মসজিদ গড়ে তুলেছিলেন। দাবিদার
: রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক (আরএসএস), বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এবং ভারতীয় জনতা পার্টি। বাবরি
মসজিদ রামমন্দির বিতর্কের প্রথম এবং প্রধান সূত্র হল – যেহেতু সম্রাট বাবর সংশ্লিষ্ট
স্থানে ত্রেতাযুগে নির্মিত রামমন্দির ধ্বংস করে ১৫২৮ খ্রিস্টাব্দে বাবরি মসজিদ নির্মাণ
করেছিলেন, সেহেতু বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে সেই স্থলে রামমন্দির নির্মাণ করা হবে। এই সূত্র
কতটা সঠিক বা বেঠিক সেটা বিশ্লেষণ করে দেখা যেতে পারে।
বাবর রামমন্দির
ধ্বংস করেছেন এই অভিযোগে দাগিয়ে দিলে বাবরকে হিন্দুধর্ম বিদ্বেষী হিসাবে চিহ্নিত করতে
সহজ হয়। কিন্তু ইতিহাসের বিভিন্ন বিশ্লেষণ থেকে জানা যাচ্ছে, বাবর পরধর্মবিদ্বেষী ছিলেন
এমন কোনো নথি বা ইতিহাসে প্রমাণ মেলে না। ইতিহাসবিদ ডঃ ত্রিপাঠীর কথা স্মর্তব্য। তিনি
লিখেছেন – “সম্রাট বাবর অমুসলিমদের প্রতি ধর্মসহিষ্ণু ছিলেন। তাঁর শাসনব্যবস্থায় ধর্মের
কোনো প্রভাব ছিল না। অধ্যাপক পি মাইতি তাঁর ‘ইতিহাস পরিক্রমা’ গ্রন্থে তার প্রমাণ আছে।”
ডঃ অমলেন্দু দে তাঁর ‘ধর্মীয় মৌলবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা’ গ্রন্থে লিখেছেন – “আঃ কুদ্দুস
গাঙ্গোহি নামে একজন মুসলিম ধর্মগুরু সম্রাট বাবরকে পত্র লিখে শরিয়তি শাসন পরিচালনার
উপদেশ দেন। বাবর তাঁর উপদেশ অগ্রাহ্য করেন। তিনি হিন্দু প্রজাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান
পালন করার পূর্ণ অধিকার দেন এবং হিন্দুদের সেনাবাহিনী ও প্রশাসনে নিযুক্ত করেন।”
এহেন সম্রাটের
বিরুদ্ধে রামমন্দির ধ্বংসের অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে মনে করি। কেন ভিত্তিহীন বলে মনে করি?
বলা হয় ১৫২৮ খ্রিস্টাব্দে বাবর রামমন্দির ধ্বংস করে মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। দেখা যাচ্ছে,
তুলসীদাস তাঁর ‘রামচরিতমানস’ রচনা করেছিলেন ১৫৭২ খ্রিস্টাব্দে, অর্থাৎ মসজিদ নির্মাণের
৪৪ বছর পর। তুলসী ছিলেন একজন একনিষ্ঠ রামভক্ত সাধক। তিনি তাঁর রচনায় ম্লেচ্ছ যবনদের
প্রভাব. মুসলিম রাজশক্তির উত্থান সম্পর্কে তাঁর উদ্বেগ চেপে রাখেননি। যদি মুসলিম সম্রাট
রামমন্দির ধ্বংস করতেন, নিশ্চয় তারও উল্লেখ তিনি করতেন। তুলসীদাস রামচরিতমানস রচনা
করেছিলেন কাশী নগরীতে বসে। কাশী থেকে অযোধ্যার দূরত্ব সামান্য। সেখানে একটা রামমন্দির
ধ্বংস করে দিল এক মুসলমান শাসক, আর সেই খবর তুসলীদাসের কানে পৌঁছবে না?
তাহলে
হঠাৎ কী এমন হল বাবর রামমন্দির ধ্বংস করে নিজের নামে মসজিদ গড়ে ফেলার অভিযোগে অভিযুক্ত
হল? ১৫২৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কেউ কোনো উচ্চবাচ্য করলেন না,
কোনো তথ্য লিপিবদ্ধ করলেন না। হঠাৎ ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে প্রথম মন্দির ভেঙে মসজিদ নির্মাণের
অপবাদ দেওয়া শুরু হয়। শ্রীমতী বেভ্যারিজ বাবরের বাবরনামা ইংরেজিতে অনুবাদ করলেন। বাবর
তাঁর ‘বাবরনামা’ চুঘতাই তুর্কি ভাষায় রচনা করেছিলেন। ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন, ভালো
কথা। এ কাজ মোটেই দোষের নয়। কিন্তু উদ্দেশ্য তাঁর মহৎ ছিল না। আর তাই বেভ্যারিজ একটা
মনগড়া কাহিনি লিখে ফেললেন সংযোজিত পরিশিষ্টে। সংযোজিত পরিশিষ্টে তিনি লিখলেন – ১৫২৮
খ্রিস্টাব্দের ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ১৫২৯ খ্রিস্টাব্দের ৫ সেপ্টম্বর, এই প্রায় এক বছরের
মধ্যে বাবরের নির্দেশে মির বাকি নামক জনৈক ব্যক্তির নেতৃত্বে মসজিদ নির্মাণ করেন। মসজিদ
নির্মাণ করার কথা উল্লেখ থাকলেও মন্দির ভেঙে মসজিদ গড়া হয়েছে এমন কোনো কথাই উল্লেখ
নেই সেখানে। মন্দিরের ভাঙার কথা তিনি নিজে উল্লেখ না-করলেও ফৈজিবাদ গেজেটিয়ার থেকে
একটি উদ্ধৃতি তুলে ধরেন। জনৈক মিঃ এইচ আর নেভিল তাঁর গেজেটিয়ারে কোনো তথ্যসূত্র ছাড়াই
লিখেছেন – “একটি মন্দির ধ্বংস করা হয় এবং মসজিদ নির্মাণ হয়ে।” অবশ্য সেই মন্দির রামমন্দির
কি না, সেটা উল্লেখ করেননি। তাহলে রামমন্দিরের ব্যাপারটা এল কোথা থেকে? শিল্পীর পরিচয়
ও সময়কাল উল্লেখ ছাড়াই একটি তৈলচিত্র পাওয়া যায়, সেই চিত্রে দেখানো হয়েছে – বাবরের
সৈন্যরা রামমন্দির ধ্বংস করছে এবং হিন্দুনিধন করছে। চিত্রে পরিচয়লিপিতে বলা হয়েছে,
“বাবরের সৈন্যরা অযোধ্যার রামমন্দির আক্রমণকালে ৭৫,০০০ হিন্দুকে হত্যা করে ও তাঁদের
রক্ত দালানের মসলায় মেখে বাবরি মসজিদ নির্মাণ করে।” ভয়ংকর অভিযোগ। ৭৫,০০০ হিন্দু হত্যা!
গল্প বলার একটা সীমা থাকে। ব্রিটিশদের সুপরিকল্পিত এই অতিরঞ্জিত কল্পকথা ইতিহাস বলে
ভেবে নিলে বড়ো ভুল হবে।
আর একটু
গভীরে যাওয়া যাক। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমদিক পর্যন্ত বাবরি মসজিদ নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য
হয়নি। উচ্চবাচ্য নয়, এবার বাবরি মসজিদকে ঘিরে রীতিমতো খুনোখুনি হয়ে গেল ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দ
থেকে ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। ১৮১৬ খ্রিস্টাব্দে অযোধ্যার বেগমের সঙ্গে চুক্তি অনুসারে
ব্রিটিশরা অযোধ্যার রাজস্ব আদায় ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পায়। কিন্তু মুসলমান নাগরিকরা
ব্রিটিশদের এলাকা ছাড়া করে রাজ্যের বাইরে বের করে দেয়। সেই অপমান ব্রিটিশরা কোনোদিন
ভুলতে পারেনি। ব্রিটিশের জাত সেই অপমানের বদলা নিতেই সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের খেপিয়ে
তোলার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হল। শুরু হল বাবর নির্মিত মসজিদকে নিয়ে। কোনো প্রমাণ সূত্র ছাড়াই
বাবর রামমন্দির গুঁড়িয়ে দিয়ে মসজিদ গড়েছে প্রচার শুরু করে দিল। ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে মন্টেগোমারি
মার্টিন তাঁর এক সার্ভে রিপোর্টে নির্দেশ দেন এই গল্পটি প্রচার করতে। তিনি সেই রিপোর্টে
লিখলেন – “জনশ্রুতি আছে যে, অযোধ্যার রামমন্দির ভেঙে বাবরি মসজিদ নির্মিত হয়। তবে আমি
একথা বিশ্বাস করি না।” বুঝুন চালাকিটা। শুরু করলেন ‘জনশ্রুতি’ শব্দটা ব্যবহার করে,
কারণ জনশ্রুতির কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। আর শেষ করলেন -- “তবে আমি একথা বিশ্বাস করি না” ধরি মাছ না ছুঁই
পানি, এমন বিবৃতিতে সাপ তো মরলই লাঠিটাও ভাঙল না।মানুষ ‘জনশ্রুতি’ আর ‘তবে আমি একথা
বিশ্বাস করি না’ কথাগুলি ভেবে দেখল না, মনেও রাখল না। কেবল মনে রাখল – “অযোধ্যার রামমন্দির
ভেঙে বাবরি মসজিদ নির্মিত হয়”। বাতাসে আগুনের ছড়িয়ে গেল। ধর্মে সুড়সুড়ি শরীরের এক জায়গায়
দিলে সারা শরীরই কেঁপে ওঠে। শুধু শরীরই নয়, সারা ভারত উপমহাদেশ কেঁপে উঠল। কারণ এই
জনশ্রুতির ভুয়ো গল্পই হয়ে উঠল ‘ইতিহাস’। এই রিপোর্টই পরবর্তী সময়ে ব্রিটেনের কেমব্রিজ
ও অক্সফোর্ডের বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে ঢুকিয়ে দিল সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকার। আর
এটাই প্রতিষ্ঠিত হল ‘অযোধ্যার রামমন্দির ভেঙে বাবরি মসজিদ নির্মিত হওয়ার’ নির্ভরযোগ্য
‘রেফারেন্স’। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের উদ্দেশ্য ছিল অযোধ্যার নবাব ওয়াজেদ আলি শাহকে
সিংহাসন থেকে উৎখাত করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করা। অতএব পথ একটাই, ধর্মীয় উসকানি।
সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুপ্রজাদের খেপিয়ে তোলার প্রয়োজন অনুভব করল ব্রিটিশরা। কর্নেল উইলিয়ম
স্নিমার ও জেমস আউট্রামের হাতে এই সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়ানোর দায়িত্ব পড়ল। তাঁরা সুচারুভাবে
সেই দায়িত্ব পালন করল। কাজও হল মোক্ষম। হিন্দুরা এই প্রথম মসজিদে মন্দিরের দাবি তুলল।
সোজা বাংলায় বলা যায়, হিন্দুদেরকে দিয়েই এই দাবি তোলানো হল বা তুলতে প্ররোচনা দেওয়া
হল। স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ দাঙ্গার শিকার হল। শুরু হল সংঘর্ষ। বাবরি মসজিদকে ঘিরে শুরু
হল প্রথম রক্তপাত। খানেই শেষ নয়। এলো গোদের উপর বিষফোঁড়া। ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে ফৈজাবাদের
ব্রিটিশ সেটেলমেন্ট অফিসার পি কার্নেগি একটা নথি বানিয়ে ফেললেন, বললেন – “অযোধ্যা যেহেতু
রামের জন্মভূমি, অতএব সেখানে নিশ্চয়ই একটা রামমন্দির থেকে থাকবে এবং আমার মনে হয় সম্রাট
বাবরের নির্দেশেই ওই মন্দির ধ্বংস করা হয়েছে।” এমন ভিত্তিহীন কথা আদালতে পেশ করা যায়
না। আদালত ছুঁড়ে ফেলে দেবে ডাস্টবিনে। ‘যদি’, ‘কিন্তু’, ‘হয়তো’ ‘নিশ্চয়ই’ শব্দগুলি
বিচারাধীন হয় না। তবুও একে সাদা চামড়ার ব্রিটিশ, তায় সেটেলমেন্ট অফিসার – সে কি মিথ্যা
বা ভুল বলবেন? অতএব ওনার স্বরচিত তথ্যই হল নথি, পাকাপোক্ত দলিল। অথচ বাস্তবে --প্রথমত,
হিন্দুদের কোনো ধর্মগ্রন্থে অযোধ্যার রামমন্দিরের উল্লেখ পাওয়া যায় না। দ্বিতীয়ত, রামভক্ত
তুলসীদাসী রামচরিতমানসেও অযোধ্যার রামমন্দিরের উল্লেখ নেই। তৃতীয়ত, ৪০০ খ্রিস্টাব্দে
রচিত ‘বিষ্ণুস্মৃতি’ গ্রন্থে হিন্দুদের যে তীর্থস্থানের তালিকা পাওয়া যায়, সেখানেও
অযোধ্যার কোনো রামমন্দিরের উল্লেখ নেই। চতুর্থত, হিন্দুদের তীর্থস্থান সংবলিত ‘তীর্থ
চিন্তামণি’ পুস্তকেও অযোধ্যার কোনো রামমন্দিরের উল্লেখ নেই। পুস্তকটি রচিত হয় ১৪২০
খ্রিস্টাব্দে। পঞ্চমত, ফাহিয়েন, হিউয়েন সাঙ, ইবনে বতুতা প্রমখ ব্যক্তিদের রচিত ভারতভ্রমণ
বিষয়ক গ্রন্থগুলিতেও অযোধ্যার কোনো উল্লেখ নেই। অর্থাৎ যেখানে বাবরি মসজিদটি ছিল, সেখানে
কোনো রামমন্দির ছিল, এমন কোনো নির্ভরযোগ্য/অ-নির্ভরযোগ্য কোনো দলিল বা তথ্য বা সূত্রই
পাওয়া যায়নি। ষষ্ঠত, শিবাশিবাজী প্রায় সারাজীবন মুসলিম সম্রাট আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে
লড়াই করেছিলেন। সেই শিবাজী কখনো মুসলিমদের বিরুদ্ধে এক কলম লেখেননি। এমনকি বাবর রাম
মন্দির ভেঙে মসজিদ বানিয়েছেন, এমন কথাও কোথাও লেখেননি। সপ্তমত, স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী
ফৈজবাদ দাঁড়িয়ে মুসলমান শাসকদের বিরুদ্ধে অনেক কথা বলেছিলেন। কিন্তু বাবর রাম মন্দির
ভেঙে মসজিদ বানিয়েছেন, একথা কখনো বলেননি। অষ্টমত, স্বামী বিবেকানন্দ, যিনি শিকাগো গিয়ে
দুর্ধর্ষ ভাষণ দিয়ে সমস্ত হিন্দুজাতিকে গৌরবান্বিত করেছিলেন। তিনি ২০০ গ্রন্থ লিখেছিলেন।
তাঁর কোনো গ্রন্থে সম্রাট বাবর রাম মন্দির ভেঙে মসজিদ বানিয়েছেন, একথা কখনো লেখেননি।
নবমত, মহাত্মা গান্ধি, যিনি মৃত্যুর শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত রামনাম জপেছিলেন, তিনিও প্রচুর
গ্রন্থ লিখেছিলেন, তাঁর কোনো গ্রন্থে বাবর রাম মন্দির ভেঙে মসজিদ বানিয়েছেন, একথা কখনো
লেখেননি। কখন মানুষ জানল যে, বাবর রাম মন্দির ভেঙে মসজিদ বানিয়েছিল, যখন ভারতীয় জনতা
পার্টির ক্ষমতায় আসার প্রয়োজন হল। অত্যন্ত মুনসিয়ানার গোয়েবলসের কায়দায় প্রচার করা
শুরু হল – যেখানে বাবরি মসজিদ, সেখানে পূর্বে রাম মন্দির ছিল। ‘হিন্দুবিদ্বেষী’ সম্রাট
বাবর সেই মন্দিরকে গুঁড়িয়ে দিয়ে মসজিদ বানিয়েছিল। ঘটনা পরম্পরা থেকে জানতে পাওয়া যায়
–
১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের
একেবারে শেষদিকে বাবরি মসজিদের ভিতর হঠাৎ করে অলৌককভাবে এক রাম ও সীতার মূর্তি পাওয়া
গেল। প্রত্যক্ষ গণ্ডগোল শুরু হল সেইদিন থেকেই। অলৌকিক বললাম বটে, কিন্তু অলৌকিক বলে
কিছু হয় না, সবই লৌকিক। ১৫২৮ থেকে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তো কোনো মূর্তি ছিল না।
তা ছাড়া মসজিদে মূর্তি থাকার কথাও নয়। কারণ ইসলামে মূর্তি নিষিদ্ধ। তাহলে বাবরি মসজিদের
ভিতর কীভাবে এলো সেই রামসীতার যুগলমূর্তি? ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে
দশটায় তৎকালীন জেলাশাসক কে ডি নায়ার উত্তরপ্রদেশের তদানিন্তন মুখ্যমন্ত্রী গোবিন্দবল্লভ
পন্থ রাজ্যের মুখ্য সচিব ও স্বরাষ্ট্রসচিবের কাছে এক বেতারবার্তায় জানান – ২২ ডিসেম্বর
রাতে যখন মসজিদ জনশূন্য ছিল, কয়েকজন হিন্দু তখন মসজিদে মূর্তি রেখে গেছে। রাতে যে ১৫
জন পুলিশ পাহারায় ছিল তাঁরা এই কাজে বাধা দেয়নি।”
রাতের
অন্ধকারে নির্জন মসজিদের মধ্যে মূর্তি রেখে দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ২৩ ডিসেম্বর অযোধ্যা
থানায় এফআইআরও করা হয়। এখন প্রশ্ন হল, মসজিদের ভিতর মূর্তিটা রাখল কে? এলেতেলি কেউ
নন, তিনি একজন জেলাশাসক ফৈজাবাদের জেলাশাসক কে ডি নায়ার। তিনিই চুপিসারে রাতের অন্ধকারে
মসজিদের ভিতর মূর্তি রেখে আসেন। ঘটনাটি অবশ্য পরে জানাজানি হয়ে যায়, গোপন রাখা যায়নি।
অথচ এই জেলাশাসকই উপরোক্ত বেতারবার্তা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন যথাক্রমে মুখ্যমন্ত্রী, মুখ্যসচিব
ও স্বরাষ্ট্রসচিবের কাছে। এই কর্মকাণ্ডে জেলাশাসক মূল পাণ্ডা হলেও মূল কাজটি করার জন্য
বেছে নিয়েছিল দিগম্বর আখড়ার এক তরুণ মহন্ত, নাম পরমহংস রামচন্দ্র দাস। রামচন্দ্র দাসই
মসজিদের ভিতর ঢুকে রামসীতার মূর্তি রাখার কাজটি সারেন। পাহারায় থাকা জনৈক পুলিশ অফিসার মাতাপ্রসাদ নির্দেশমতোই
প্রচার করে দেন। তিনি বলেন, আকাশপথে আলোর ঝর্ণাধারায় নেমে আসে রামলালার মূর্তি এবং
মসজিদের ছাদ ভেদ করে ভিতরে ঢুকে পড়ে।
মহন্ত
পরমহংস রামচন্দ্র দাসের প্রকৃত নাম ছিল চন্দ্রেশ্বর ত্রিপাঠী। আদিবাড়ি বিহারের ছাপড়া
জেলার সিংখিনপুর গ্রাম। অযোধ্যায় রামজন্মভূমি আন্দোলনের প্রথম ও অবিসংবাদিত নেতা। ২০০৩
খ্রিস্টাব্দের ৩০ জুলাই ৯৩ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে উপস্থিত
ছিলেন দেশের প্রধানমন্ত্রী, উপ-প্রধানমন্ত্রী সহ সরকারে পদস্থ ব্যক্তিরা। উপস্থিত থাকবেন
নাই-বা কেন ! মসজিদের ভিতর মূর্তি ঢুকিয়ে দেওয়ার মতো অসাধ্য কাজটি সাধন করেছেন, তিনি
তো সমগ্র হিন্দুসমাজের উদ্ধারকর্তা বটে! দাবি করা হল বাবরি মসজিদের নীচে রামমন্দির
আছে। এই সূত্র ধরেই তো বাবরি মসজিদ মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়েছে।
মহামান্য
এলাহাবাদ হাই কোর্টের লখনউ বেঞ্চের নির্দেশে বাবরি মসজিদের নীচে খননকার্য চালিয়ে আদালত
নিযুক্ত প্রত্নতাত্ত্বিকরা যে রিপোর্টটি এলাহাবাদ হাই কোর্টের লখনউ বেঞ্চের বিচারপতিদের
তুলে দিয়েছেন, সেখানে বলা হয়েছে মসজিদের ঠিক নীচেই এবং ৫০ মিটার নীচে মন্দিরের একটা
কাঠামোর উপস্থিতির কথা। বলা হয়েছে, ওই মন্দিরের কাঠামোটিতে ১০০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৫২৮
খ্রিস্টাব্দ, অর্থাৎ মসজিদ নির্মাণকাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে মন্দিরের নির্মাণকাজ
চলার প্রমাণ মিলেছে। প্রত্নতত্ত্ববিদরা বলেছেন, মাটি খুঁড়ে যেসব নিদর্শন পাওয়া গেছে,
তা হল – পাথর, নকশা করা ইট, মিথুন মূর্তি, পাতার নকশা, কালো পাথরের ভাঙা আটকোণ বিশিষ্ট
স্তম্ভ, পদ্মফুলের মোটিভ, জলের ফোয়ারা এবং কমপক্ষে ৫০টি পিলার। মন্দিরেরে যে কাঠামোটি
পাওয়া গেছে বলে দাবি করা হয়েছে, সেটি উত্তর-দক্ষিণে লম্বায় ১৫০ ফুটের বেশি এবং পূর্ব-পশ্চিমে
প্রস্থে প্রায় ১০০ ফুটের মতো। ওই কাঠামোটির কেন্দ্রবিন্দুতে ঠিক উপরেই ছিল মূল মসজিদটি।
ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে – যেসব কাঠামোর নিদর্শন পাওয়া গেছে, সেগুলির চরিত্র ও ব্যবহার
সম্পর্কে কিছু বলা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ এই ব্যাপারে ধারণাকে সঠিক বলে প্রতিষ্ঠিত করার
মতো কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
২০০৩ সালের
১৮ জুন দৈনিক গণশক্তি সংবাদপত্র থেকে জানা যায়, ১৭ জুন দেশের রাজধানী নতুন দিল্লিতে
এক ভিড় ঠাসা সাংবাদিক সম্মেলনে প্রথিতযশা প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিকরা স্পষ্ট ভাষায়
জানিয়েছেন – “মন্দির নয়, বাবরি মসজিদের নির্মাণের আগে ওখানে আর-একটি মসজিদ ছিল।”
১৯৯১ খ্রিস্টাব্দের
লোকসভা নির্বাচনে ২২৪ জন সদস্য নিয়ে কেন্দ্রে ক্ষমতায় এল কংগ্রেস, যে সরকার গঠিত হল
তার প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসিমা রাও। অপরদিকে ২৪ জুন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হলেন
বিজেপির কল্যাণ সিং।মুখ্যমন্ত্রী হয়েই তিনি চললেন অযোধ্যায়, বাবরি মসজিদে। রামলালার
দর্শন করে পুজো দিলেন। কল্যাণ সিংয়ের মন্ত্রীসভায় একজন মুসলিম মন্ত্রী ছিলেন ইজাজ রিজভি।
তিনি কল্যাণ সিংয়ের সঙ্গী ছিলেন। তিনিও ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি দিলেন। এর পর কয়েক মাস ধরে
কিছু নাটকও চলল। এলো ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দ। সংঘ পরিবার ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দের ৬ ডিসেম্বর অযোধ্যায়
করসেবার ডাক দিল। সংঘ পরিবারের ডাকে সাড়া দিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লক্ষ লক্ষ
রামভক্ত করসেবকরা অযোধ্যায় জমায়েত হল। তার আগের দিন ৫ ডিসেম্বর উত্তরপ্রদেশের লখনউ
শহরে এক বিশাল সভার আয়োজন করেছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ি, লালকৃষ্ণ আডবানী, কল্যাণ সিং,
মুরলীমনোহর যোশি, অশোক সিংহল প্রমুখ। শুরু হল গরম গরম বক্তৃতা। বাজপেয়ি বললেন, যত টিলা
আছে সব সমান করে দিতে হবে। তোড়জোড় শুরু হল বাবরি মসজিদ ধ্বংসের। সব জল্পনাকল্পনার অবসান
হল ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর। ধুলোয় মিশে গেল সাড়ে ৪০০ বছরের প্রাচীন বাবরি মসজিদ। একই
সঙ্গে ধংস হয়ে গেল ভারতবর্ষের ধর্মনিরপেক্ষতার প্রাচীর। ধর্ষিত হল দেশের ঐতিহ্য আর
সম্প্রীতির বাতাবরণ।
একজন মুসলিম
শাসককে কলংকিত করা খুবই সহজ। প্রমাণ করার বাধ্যবাধকতা নেই। বাবরও কলংকিত হলেন। কিন্তু
ভারত কলংকিত হল। ৬ ডিসেম্বর ‘কালাদিবস’ হিসাবে চিহ্নিত হল, যা প্রতি বছর উদযাপন করা
হয়। বাবরি মসজিদ ধ্বংস মামলায় ধ্বংসকারীরা দোষী হল। রামমন্দির আজও নির্মাণ করা সম্ভব
হয়নি। সিদ্ধান্ত অমীমাংসিত অবস্থায় আটকে আছে সুপ্রিম কোর্টে।
দুই প্রত্নতাত্ত্বিক
সুপ্রিয়া ভার্মা ও জয় মেনন এএসআইকে খননের পূর্বে প্রাক্কলিত ধারণার ধারণ করার এবং
খননকালে নৈতিক কোড এবং পদ্ধতির লঙ্ঘন করার অভিযোগ করেন। জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের
প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ভার্মা, শিব নাদার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রধান
মেনন আদালতে বলেন, খননে এএসআইয়ের উপসংহারকে সমর্থন করে এমন কিছু পাওয়া যায় নি। ২০১০
খ্রিস্টাব্দে তাঁরা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সাপ্তাহিক একটি কাগজ প্রকাশ করেছিল, প্রমাণ
সংগ্রহের জন্য ব্যবহৃত পদ্ধতি এবং তার ব্যাখ্যাকে চ্যালেঞ্জ করেছিল।
বাবরি
মসজিদ ধ্বংসের ২৬ তম বার্ষিকী উপলক্ষে ভার্মা ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে পাওয়া প্রমাণের তিনটি
মূল অংশ সম্পর্কে হাফপস্ট (HuffPost) ভারতকে কথা বলেছিলেন, কেন তিনি মনে করেন যে, এএসআই
তার উপসংহার তৈরি করার জন্য বাধ্য হয়ে পড়েছিল এবং বি আর মণির নেতৃত্বাধীন খননকার্যের
সময় পদ্ধতিগত ব্যর্থতা অনুভব করেছিল। পরে মণি, যিনি পরে এলাহাবাদ হাই কোর্টের আদেশে
প্রতিস্থাপিত হন। ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে মোদি সরকার ন্যাশনাল মিউজিয়ামের মহাপরিচালক হিসাবে
মণিকে নিয়োগ দেন। কী ছিল সেই প্রশ্নোত্তর পর্ব? মূল ভাষায় হুবহু এখানে উল্লেখ করলাম
সেই সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর পর্ব –
Q.
Is there any archeological evidence that the Babri Masjid was built over a
temple devoted to Ram?
Ans.
No, there is nothing. Even today, there is no archeological evidence that there
was a temple under the Babri Masjid.
Q.
What is the evidence on the basis of which the ASI is saying there was a
temple?
Ans.
There are three things. What the ASI has excavated is not evidence there was a
temple underneath the mosque. One is this western wall, the second are these 50
pillar bases and third are architectural fragments. The western wall is a
feature of a mosque. It is a wall in front of which you say namaaz. It is not
the feature of a temple. Temple has a very different plan. Underneath the Babri
Masjid, there are actually older mosques. Now, as far as these pillar bases are
concerned, these are completely fabricated and we filed many complaints to the
court about it. Our argument is that if you look at what they are claiming to
be pillar bases, these are pieces of broken bricks and they have mud inside
them. There is no way a pillar can even stand on it; it is so unstable. It's a
completely political issue. They wanted that report to say there are pillar
bases and it said there are pillar bases.
Q.
What about the architectural fragments?
Ans.
The third piece of evidence is these architectural fragments. They say there
are some 400-500 fragments, which are pieces of architectural buildings. Of
these, they say 12 are the most important. Of these 12, none of these were
found during the excavation. These were recovered from the debris lying above
the lime floor of the masjid. There is this one particular sculpture, which is
closest to some kind of image, which they called a 'divine couple.' But even
that is just one man and a woman and is half-broken. There is nothing else. A
temple, a stone temple—supposedly this is a stone temple—has much more
sculptured material than what they have found.
Q.
Can this sculpture not be dated?
Ans.
The stone cannot be dated. What you date in archeology is the deposit, the
layer in which the particular artefact has been found. In that also, you can
date organic material. So, for example, a bone or a shell or charcoal. The ASI
have got some dates. But this sculptured piece has not even come from a
stratified deposit.
Q.
It could have come from anywhere?
Ans.
It could have come from anywhere. There is no way of dating it. In other words,
there is no evidence for a temple.
Q.
Can you date the pillar bases?
Ans.
You can date those floor levels. They clearly belong, in my opinion, to the
period from the 12th to the 15th century at different levels.
Q.
Does the ASI date the temple it claims was under the mosque?
Ans.
No. They don't say that. They just say there was a temple underneath. That's
all. They give it no precise date.
Q.
Doesn't the report say the temple is from the 10th century?
Ans.
On the one hand, they are claiming a massive temple with more than 50 pillar
bases, but they are also saying that there is a circular shrine under these
pillar bases, which is much smaller in size, about three to four meters in
diameter, which they claim belong to the 10 century. But I have examined walls
next to the circular structure, and the information mentioned in the site
notebook of that particular trench, which mentions these walls belong to the
Gupta period. And that is why this circular structure would also belong to the
Gupta period around 4th-6th century AD.
Q.
How many excavations have there been in Ayodhya?
Ans.
There is Alexander Cunningham who is the first Director General of the ASI,
who, in 1861-62, does some kind of survey around Ayodhya region, and he
mentions three mounds. And of these three mounds, two have some kind of
Buddhist Stupa and one of them has a Vihara. He also said that there are oral
traditions that say that three temples were destroyed, but in his account,
there is no mention of a temple being destroyed on the site of the Babri
Masjid. That is the first time that archeologically some kind of survey had
been carried out. Now, in terms of excavations, the story begins in 1969-70.
The first excavation is carried out by the Department of Archaeology, Banaras
Hindu University. They did not really conduct the excavations close to the
Babri Masjid, but in the near vicinity. The only report that we have is in what
we call IARs, which is the Indian Archeology Review published by the ASI, every
year. It is not a very detailed report. There is a one-page description of what
they found. They say it looks like it was inhabited in what we call the early
historic period, which is about 6th century BC to 6th century AD. And they say
that there is some medieval occupation, but they don't really get into the
details. That's the end. Then, what happens is from about 1975 to about 1980,
there is a project by B.B. Lal.
Q.
Who is B.B. Lal?
Ans.
BB Lal was also the director general of ASI and he took early retirement in
1972 and joined the Archeology Department of the Jiwaji University in Gwalior.
And from there he went as a fellow to the Institute of Advanced Studies in
Shimla. And he came up with this project on the archeology of Ramayana. He also
had a project on the archeology of Mahabharata. As part of the archeology of
Ramayana, he excavated Ayodhya and a couple of other sites, which have been
mentioned in Ramayana. He carried out excavations for a period of five years
but a report is only available for two years in the IAR. He pretty much
substantiates what is mentioned by the BHU. That there are occupations in the
early historic period and there is some sign of desertion and you also find
some floors from the medieval period. That's all there is. Then it is only in
1988, by which time the VHP has picked up this whole issue of temples having
been demolished at three sites—Ayodhya, Mathura and Varanasi—and in 1988, B.B.
Lal takes a photograph of pillar bases, which he says was taken and excavated
at Ayodhya between 1975 and 1978, and publishes it in Manthan, which is the RSS
(Rashtriya Swayamsevak Sangh) journal. He also presented the photograph at the
World Archeological Congress in Croatia, saying that if excavations are to be
carried then they will find evidence of a temple.
Q.
What does the photograph show?
Ans.
The photographs are what he calls pillar bases, which are pieces of bricks put
together in a half-squarish, half rectangular, half circular forms. There are
three pillar bases that he marks out in that photograph.
Q.
Where does he find the pillar bases?
Ans.
This excavation was carried out near the wall of the Babri Masjid.
Q.
What happened after Lal's photo?
Ans.
Then, the BJP picks up the Ayodhya movement and it becomes a political
movement. In 1992, the mosque is demolished and they have paved the way for
excavations. The title suit, that case of who owns the land, is carrying on in
the Lucknow Bench of the Allahabad High Court. Once NDA comes to power, which
is in 1999, the court orders that now possibly we should excavate. In 2002,
they would order the ASI, the government body, to carry out a Ground
Penetrating Radar (GPR) survey. Certain signals are sent through a machine and
if there are structures underneath the mound then it bounces back. On the basis
of that report, the court ordered excavation be carried out. In March 2003, the
excavations began and they ended in August. Then, they submitted the report.
Q.
How did you get involved?
Ans.
Once the excavations began, there were a lot of apprehensions because the ASI
comes directly under the Ministry of Culture. And also, because archeology as a
discipline is fairly technical. At that point, the Sunni Waqf Board people
thought that they should have an archaeologist who would be present and point
out in case there are any procedures that are not followed the way it should be
in terms of methods and recording. They contacted Irfan Habib, who is a
professor of medieval history at Aligarh Muslim University, and he contacted
us. I, and I think I can speak for my colleague Jaya Menon, we were both quite
keen. We both wanted to know what exists under the mosque. It is not as though
we had any kind of bias either way. We went with an open mind. For us, it was
an academic issue. We knew that we probably would never be able to get the
chance unless we go there ourselves. It was at the cost of our professional
careers as well. As an archaeologist, if I have to excavate any site, I have to
get permission from ASI. So, if you antagonise the ASI, chances are that you
are not going to get a permit, and that is why very few archaeologists were
willing to even go.
Q.
You went as observers because the Sunni Waqf Board were petitioners in the
title suit?
Ans.
Just to note whether correct procedures were being followed or not. The NDA was
in power. There was fear that the data would be manipulated. There was even
fear that outside material would be planted over there. In fact, some of us
also thought they would try and do it if they don't find evidence for a temple.
They might bring material from outside, some idol, some image, and put it
there.
Q.
Did you face any kind of backlash?
Ans.
We were lucky that they lost the elections, and we went on to excavate two
sites (not connected to the Ayodhya dispute). Today, if I apply, I'm not
certain whether I will get permission.
Q.
What does the ASI say in the report?
Ans.
If you read the entire report, there is no mention of any temple. It is a
standard report. You have a chapter on the trenches, you have a chapter of
chronology, you have a chapter on different structures, you have a chapter on
pottery. What is missing is a chapter on bones and human skeletal remains. That
is what they also found but they never published it. What you will also find is
that the names of the people who wrote those chapters is mentioned. But in the
conclusion, there is no name mentioned. And in the conclusion, in the last
paragraph of the report, they say that given the evidence of this western wall,
and pillar bases, and some architectural fragments, there was a temple
underneath the Babri Masjid. It is literally written in three lines. Otherwise,
nowhere in the discussion, is there any talk of a temple being found. With the
same evidence, we have interpreted that there were actually two or three phases
of smaller mosques underneath the Babri Masjid.
Q.
In your expert opinion, as of today, there was no temple under the Babri
Masjid? What was under it?
Ans.
There was no temple under the Babri Masjid. What there was, if you go beyond
the 12th century and you come down to the levels of the 4th to 6th century,
i.e. the Gupta period, there seems to be a Buddhist stupa. So, there was
Buddhist occupation here, and that is something even Alexander Cunningham has
said. Outside the Babri Masjid, there are several other archeological mounds
which seem to be sites of Buddhist stupas as well as monasteries. There was
clearly a Buddhist community here, in the period, roughly from the 2nd century
BC to 6th century AD. To us, it looks like this was then abandoned and
reoccupied sometime around the 11th-12th century and possibly because there was
a Muslim settlement that came up. And they had a small mosque, which was
expanded as the community increased, in size and finally a much larger mosque
was built by Babar in 1528.
Q.
So, there is no evidence of this narrative that Babar's general Mir Baqi
knocked down a temple to build a mosque?
Ans.
There is no evidence but there is oral tradition that starts coming up in the
late 19th century and it is recorded in a colonial period gazetteer. Even when
Alexander Cunningham, he goes in 1861-62, he is traveling around and he does
record oral traditions. He does not mention a temple being underneath the Babri
Masjid. He talks about three temples, there is oral tradition of three temples
being destroyed, but these are not underneath the Babri Masjid. They are some
other temples in Ayodhya.
Q.
What impact did the report have on the title suit?
Ans.
The bench comprised of three judges, two Hindus and one Muslim. The Muslim
judge, S.U. Khan, clearly did not go into the archeological evidence. There was
a strong viewpoint that this is a title suit and it does not matter who lived
here before the present occupants. It is immaterial. And many of us also felt
that they should have never dragged in history and archeology into a title
suit. They should have just gone by what was the status when the first suit was
filed in 1950. But the other two judges, D.V. Sharma and Sudhir Agarwal, much
more Sudhir Agarwal, he did say that the ASI is saying a temple was there under
the mosque and therefore we have to accept what the ASI is saying because they
are the experts.
Q.
A generic temple?
Ans.
Yes. Some generic temple. They don't get into whether it was a Ram Temple and
they don't date it.
Q.
In the EPW report, you write about being concerned about certain procedures?
Ans.
Yes. They are claiming that this is the site of Ram Temple, which is a Vaishnav
temple, where generally, you would not expect to find any bones because of this
vegetarianism etcetera, but when they started excavating, they started finding
a lot of bones, animal bones. How do you explain finding animal bones in a
Vaishnav temple? They clearly did not want that recorded. So, we noticed that
the labour they had hired were just throwing the bones away. The other thing
they were also doing, there is a certain pottery, ceramic type, which is known
as glazed ware, which is generally associated with Muslim communities. They
were finding a lot of this glazed ware. Those again were being thrown. So, we
made a complaint, and they had to be recorded. You would not expect glazed ware
in a Vaishnav temple. Procedurally, there was violation of an ethical code.
Q.
Did the ASI date the bones?
Ans.
No, they did not.
Q.
Would it help to have a foreign team of archaeologists excavate the site?
Ans.
As far as foreign archeologists are concerned, they know it is a political
issue and they would not want to get entangled in it. If they wish to do any
other archeological work in India, they would not want that to be jeopardised.
And it is a political issue, it is clear to everyone.
Q.
Isn't six months very short for this kind of excavation?
Ans.
As far as the ASI, and the archeologists of the ASI are concerned, they really
are now no longer considered to have any kind of expertise. They haven't kept
up to date with the latest methods, the recent theoretical developments, and
they really just see it as more as an administrative job than as an academic
discipline.
(Source
:
https://www.huffingtonpost.in/2018/12/04/there-is-no-evidence-of-a-temple-under-the-babri-masjid-asi-lied-to-the-country-say
)
বাবরি
মসজিদের নীচে মন্দির ছিল কি ছিল না সিদ্ধান্ত অমীমাংসিতই থাকবে হয়তো। সুপ্রিমকোর্ট
মন্দির নির্মাণের অনুমোদন দেবে কি না সময়ই বলবে। কিন্তু যাঁরা বলেছিলেন মসজিদের নীচে
মন্দির না মিললে বাবরি মসজিদ পুনর্নিমাণ করে দেবেন, তাঁরা কী ভাবছেন? পারবেন পুনর্নিমাণ
করে দিতে? ৪০০ বছরের প্রাচীনত্ব এবং ঐতিহ্য কি ফিরিয়ে আনা সম্ভব?
তথ্যসূত্র :
(১) ইতিহাসের ইতিহাস -- গোলাম আহমেদ মোর্তজা, (২) বাজেয়াপ্ত ইতিহাস -- গোলাম আহমেদ
মোর্তজা, (৩) চেপে রাখা ইতিহাস -- গোলাম আহমেদ মোর্তজা, (৪) ভারতজনের ইতিহাস – বিনয়
ঘোষ, (৫) ভারতবর্ষের ইতিহাস – রোমিলা থাপার, (৬) ভারতবর্ষ ও ইসলাম – সুরজিৎ দাশগুপ্ত,
(৭) জিহাদ – কে খান (৮) ইসলামের ভারত অভিযান – কঙ্কর সিংহ (৯) মোগল সাম্রাজ্যের সোনালী
অধ্যায় -- সাহাদত হোসেন খান (১০) বাবরি মসজিদ অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যত – আব্দুস সামাদ
চৌধুরী (১১) ভারতের মুসলিম শাসনের ইতিহাস – ড. মুহাম্মদ ইনাম-উল হক (১২) বাবর – প্রিমিকুল
কাডিরোড (১৩) বাবরের আত্মকথা – শচীন্দ্রলাল রায় (১৪) বাবরনামা – প্রেমময় দাসগুপ্ত
(১৫) বাবরনামায় ভরতকথা – শচীন্দ্রলাল রায়।
অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়: কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন