জানালা ও অন্যান্য কবিতা








কবিতা

জানালা 

ঘর বানাচ্ছ, বানাও
মনে করে দুটো জানালা বানাতে ভুলো না।

একটা জানালা দিয়ে ছেলে যাতে উড়ে যেতে পারে
রামধনুর রং মাখতে পারে সারা গায়ে
মেঘের ভেলায় চেপে ভেসে যেতে পারে যেখানে খুশি,
আর অন্য জানালা দিয়ে পা টিপে টিপে এসে
যাতে শুয়ে পড়তে পারে বিছানায়।

ঘর বানাচ্ছ, বানাও
মনে করে দুটো জানালা বানিও।

একটা জানালা দিয়ে এসে
ছেলেকে যাতে বকাঝকা করতে পারো
কষাতে পারো দু'-একটা চড়চাপড়,
আর অন্য জানালা দিয়ে এসে
ঘুমন্ত ছেলের কপালে যাতে চুমু খেতে পারো।

ঘর বানাচ্ছ,বানাও
মনে করে দুটো জানালা বানাতে ভুলো না
আর হ্যাঁ, সেই জানালায় যেন গরাদের কোনও
                                                ছায়া না থাকে...






দেখা

তা হলে কি চৈতন্যদেব এদেরই দেখেছিলেন!

সন্ধে হয়ে গেছে অনেকক্ষণ
ফিরতে ইচ্ছে করছিল না।
পেছনে কপিলমুণির আশ্রম
সামনে ধুধু নিকষ কালো অন্ধকার।
তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ নজরে পড়ল---
পুতুলের মতো সার সার মেয়ে দুধ-সাদা ঘাঘরা কামিজ পরে
হাত ধরাধরি করে নাচতে নাচতে পাড়ে উঠে আসছে।
এরা কারা!
গাল টিপে খুব আদর করতে ইচ্ছে করল তাদের।
একটু হলেই এগিয়ে যাচ্ছিলাম আর কী
আর ঠিক তখনই মনে পড়ল শ্রীচৈতন্যদেবের কথা।
তিনি নাকি এক ঘোরের মধ্যে সোজা নেমে গিয়েছিলেন সমুদ্রে
অতল গহ্বর থেকে আর মাথা তোলেননি।

তা হলে কি চৈতন্যদেব এদেরই দেখেছিলেন!







ক্ষোভে আর শোকে

থমকে গিয়েছে সব আজকে হঠাৎ
হয়েছে সকাল,তবু উঠছে না সূর্য
বাতাসও গুম মেরে বসে আছে ঘরে
বৃষ্টিকে বুকে নিয়ে মেঘ থমথমে।

টিভিতে খবর দেখে ক্ষোভে আর শোকে
ফুটছে না বেল,জুঁই,টগর,মালতি
নদীতেও খেলছে না তিরতিরে ঢেউ
পাখিরা ঝিমিয়ে আছে এ ডালে ও ডালে।

রাজনীতি এ রকম! এত ভয়াবহ!
দোয়ায়নি গোরু কেউ,লেপেনি উঠোন
উনুন জ্বালেনি কেউ,কাটেনি আনাজ
শিশুরা যায়নি মাঠে,পুকুরে নামেনি।

ঘেন্নায় ফিরিয়ে মুখ সব সরে গেছে
প্ল্যাকার্ড-ব্যানার নেই,মিছিল-টিছিল
সুনসান পথঘাট, জ্বলছে না চিতা
বুকের গভীরে জ্বলে কুশপুত্তলিকা।







একই

বাবার কাছে কোনও দিন সাদা শাড়ি
কোনও দিন জংলা ছাপা
আবার কোনও দিন হাওয়ায় ওড়া আঁচল আসত।
ওরা আসার আগেই আমাকে আর দিদিকে
বাবা বসিয়ে দিয়ে আসতেন গলির মুখে,একটা রকে।
বলতেন,যে-গাড়িগুলো যাবে সেগুলোর নম্বর লিখে রাখ তো দেখি।
আমরা লিখতাম।
পরে নিজেরাই মিলিয়ে মিলিয়ে দেখতাম কার ক'টা বাদ গেছে
বাদ গেলেই কানমলা
আর যে লিখত,সে পেত কখনও কাগজের উড়োজাহাজ
কখনও ঘটি চানাচুর।
আমি রোজ রোজ কানমলা খেতাম।
সতর্ক হতে হতে যখন বুঝলাম
দিদি আসলে ওগুলো পাওয়ার জন্য মিথ্যে মিথ্যে নম্বর টুকে রাখে
বাবাকে বললাম।
বাবা চালু করলেন নতুন খেলা।
বললেন,বসে বসে লোক দ্যাখ,
দেখবি,এত মানুষ,তার ওইটুকু একটা মুখ
তবু কী অদ্ভুত! কারও সঙ্গে কারও মিল নেই।
যদি কখনও একই রকম দুটো মুখ দেখতে পাস
দ্বিতীয় জনের নাম-ঠিকানা লিখে রাখিস
বকুলের দানা দিয়ে শিস-বাঁশি বানিয়ে দেব।

বাবার কাছে কোনও দিন সাদা শাড়ি
কোনও দিন জংলা ছাপা
আবার কোনও দিন হাওয়ায় ওড়া আঁচল আসত,
মা তাই চলে গিয়েছিলেন মামার বাড়ি।

আমরা একই রকমের আর একটা মুখ খুঁজতাম।
তখন মেলাতে পারিনি
এখন বুঝতে পারি,সাদা শাড়ি,জংলা ছাপা
আর হাওয়ায় ওড়া আঁচলের মুখগুলো আসলে একই
হুবহু এক।







বিয়েবাড়ি

বিয়েবাড়িটা মাতিয়ে রেখেছিল সে।
ভীষণ ছটফটে,মিশুকে
কিছুক্ষণের মধ্যেই জেনে নিলাম তার বাড়ি,স্কুল
গানের স্কুল,এমনকী কোথায় টিউশনি নেয়,তাও।

ক্লাস নাইনে পড়ে
দল বেঁধে বেঁধে সব মেয়েরা চলে যাচ্ছে,সে কোথায়!
উলটো ফুটে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম
বন্ধ হয়ে গেল স্কুলের ফটক।
আধ ঘণ্টা আগেই বাণীচক্রের সামনে আমি হাজির
রবিবার ওর গানের ক্লাস
কিন্তু তিনটে তো বেজে গেছে
তবে কি ওর কোনও অসুখ-বিসুখ হল!
যেখানে ও টিউশনি নেয়
সেই গলির মুখে ঘোরাঘুরি করলাম ক'টা দিন
এত অন্ধকার কিচ্ছু দেখা গেল না।
ওর হাতে তো একটা মোবাইল ছিল!
ওহোঃ, কেন যে নম্বরটা নিলাম না
না-হয় একটু হ্যাংলাই ভাবত!

'দিন পরে আবার একটা বিয়ে
এবং সেখানেও যথারীতি সে।
প্রথমেই বললাম,আগে আপনার নম্বরটা দিন তো...
উত্তাল ঢেউ শান্ত হয়ে গেল। মৃদুস্বরে বলল---
বিয়েবাড়ি ছাড়া আপনি বুঝি আমাকে চিনতে পারেন না,না?






চারাগুলো কখন

একটু ঝোড়ো হাওয়াতেও কখনও-সখনও উড়ে যেত ছাউনি
ঘর ধুলোয় ধুলোময় হয়ে উঠত
ক্যালেন্ডার অনবরত আছাড় খেত দেয়ালে
বালতির জলে ভাসত সর
বৃষ্টিতে ভিজে একশা হত সব
বাচ্চাদের নিয়ে তক্তাপোশের তলায় মাথা গুঁজত রতি
জলের তোড়ে ভেসে যেত দু'-একটা সদ্যপোঁতা চারা
আমি ঘন ঘন আকাশের দিকে তাকাতাম
ভাবতাম, রাহুলটা যদি বড় হত!

শুধু রাহুল নয়, ওরা সব ক'টা ভাই-বোনই এখন বড় হয়ে গেছে
এত বড় যে এ ঘরে আর ধরেনি
যে যার মতো দূরে গিয়ে,গেড়েছে শিকড়।

এখনও ঝোড়ো হাওয়া ছুটোছুটি করে,ঝাপটা মারে তুফান
আমরা দুই বুড়োবুড়ি খাটে ''হয়ে বসে থাকি আশঙ্কায়,
ছাউনি তেমনই থাকে,উড়ে যায় না কোনও খড়কুটোও।

ভিটের সীমানা জুড়ে রাহুলরা বুঝে বুক পেতে হয়েছে প্রহরী?
দাওয়ায় বেরিয়ে দেখি,চারাগুলো কখন গাছ হয়ে গেছে!


সিদ্ধার্থ সিংহ: কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন