গল্প
এক
এই
যে লেখা বেরোনোর উৎকণ্ঠা মরণ ফাঁদের মত চেপে বসে তখনি আকুলি বিকুলি লাগে। যবে থেকে
অন্তর্জালে লেখা শুরু করেছে জীবন আরই ওষ্ঠাগত বিতানের। অসংঘটিত লিখিয়ে হলেও
বিতান বেঁচে আছে লেখার জোড়াসাঁকো আঁকড়ে | একটা চাকরী জুটিয়েছিল
বটে আবহাওয়া দপ্তরে | অবজারভেশনে বসে মাথায়
চলত অজস্র শব্দের প্রতিঘাত | কাকভোরে বেরিয়ে যানজট
পেরিয়ে নিত্য যাওয়া আসার মধ্যেও যত্নে জমানো ছিল অক্ষরের অধ্যায়| শরীর যেখানে বিদ্রোহ করেছে ক্লান্তির নিশান হাতে, পাখির ঠোঁটের মত সংসারের ফর্দ প্রতিবাদী হয়ে তছনছ করেছে
চিন্তার মায়াজাল | অবিরাম জীবনের যাত্রাপথে হলাহল আর
নিশ্চিদ্র আঁধার পেরতে পেরতেও বিতান জ্বালিয়ে রেখেছিল কবিতার হ্যাজাকবাতি|
তখনও
অনলাইন ম্যাগাজিন, ফেসবুকের লেখালিখি নেই | প্রকাশমাধ্যম বলতে হাতে লিখে যত্নের খামে একখানি সম্পাদকের
নামের অমায়িক চিঠিসমেত পাঠিয়ে দেওয়া খবরের কাগজ কিম্বা পত্রিকার আপিসে| ক্লান্তিহীন আদরে আখর সাজান সাদা পাতার গায়ে, একটু একটু করে ফুটিয়ে তোলা অনুভবের নকশা, যেন মেহেন্দি পড়াচ্ছে সযতনে। হাতের লেখাটা যাতে ভাল হয় তাই ধরে
ধরে লিখত, সেই ফাঁকে ভাবনার অবকাশও যেন বেড়ে যেত।
এক একটা শব্দচয়নে সতর্কতা। কাটাকুটি যত কম থাকে লেখায় | দ্বন্ধমুক্ত নিটোল ভাবনার গর্ভজাত সেই লেখার শেষে আলাদা
প্রাপ্তি এক! সস্তা ডাকের দোদুল্যমানতা পেরিয়ে সেইসব লেখা পৌঁছল কিনা সে আর এক
চিন্তা | কুরিয়ার করা, অনলাইন ট্র্যাকিং এইসব গালভরা আতিশয্য কোথায় আর ? মনোনীত হল কিনা দপ্তরে ফোন করলে হয়ত জানা যেত , কিন্তু অমনোনয়নের লজ্জাও মিশে থাকতে পারত সেই উত্তরে | তাই ছাপা কিম্বা না ছাপা হওয়ার জন্য দীর্ঘকাল প্রতীক্ষাই শ্রেয়
মনে হত বিতানের।
সে এমনিতেও তেমন তাড়াহুড়ো করে কোন স্থির লক্ষ্যে পৌঁছনোর জন্য কলম চালায়নি কোনদিন | কোন সম্পাদক জানাত, কেউ আবার জানাতনা।
মনোনয়নের খবরটুকুও বিলাসিতা তখন। তবুও প্রতিটি প্রকাশের দিন ম্যাগাজিন আর কাগজ
কেনার ছুতো করে সেই যে দোকানে ঘুরে বেড়ান, শুরু থেকে শেষ ঘেঁটে
দেখে নিয়ে লেখা না বেরলে মনখারাপ করে ফিরে আসা দোকানদারের বিরক্তি সয়ে.....কিসব
ছেলেখেলার মুহুর্তগুল সব |
তিরিশ
ছুঁইছুঁই সময়কাল তখন | কুটিরপ্রাঙ্গনে
মন্দাররাজিসম ডাকবাক্সে এল একদিন একটি নামী পত্রিকার সৌজন্য সংখ্যা | সঙ্গে পাঁচশ টাকার চেক |
বোনের
বিয়ে নিয়ে বড্ড ব্যস্ত ছিল বিতান | তার টহলদারি করা হয়নি
দোকানে দোকানে সেই কটাদিন ছাপান লেখার খোঁজে |
মায়ের
চোখের আলো তখন পুরোই নিভে গেছে | বাবা মারা গেছেন | ভাই দুটি সরকারী চাকরি পেয়ে ছড়িয়ে গেছে দূরে | বিয়ে উপলক্ষ্যেই অনেকদিন পর বাড়িতে অনেক লোক | অষ্টমঙ্গলার সন্ধ্যের গোলটেবিলে সবাই মিলে বসে পড়া হয়েছিল
কবিতাটি | তাদের স্যাঁতলা পড়া দোতলা বাড়িটির
আনাচেকানাচে তখন সাঁঝবাতি জ্বেলে আছে অমিত্রাক্ষরে লেখা দিনযামিনীর অশ্রু গান হাসি
| বোনের সদ্যবিবাহিত বরের সামনে কেমন যেন
কন্যাপক্ষের ভীরুতা চলে গিয়ে গরিমার আনাগোনা |
মায়ের
চোখ থেকে গালের ঢাল বেয়ে ভারসাম্য হারিয়ে গড়িয়ে আসছে সুখাশ্রু | কলেজ পাশ দেওয়া বোনটি গর্বে তাকাচ্ছে আই এ এস বরের দিকে | উফ | এক মুহূর্তে মনে
হচ্ছিল পৃথিবীর সব গর্বের আলো পুঞ্জীভূত আজ এই মনোহর বোস বাইলেনে |
তারপর
বহুদিন বহুবার এসেছে এইসব মনোনয়নের খবর | যদিও অত মায়াবী আর
হয়নি প্রথমবারের মত | আবার হারিয়েও গেছে
কিছু জমা করা লেখা , যারা ছাপা হয়নি | বিতানের অগোছালো হাত সবটুকু জমিয়ে রাখতে পারেনি | সেইসব গুছিয়ে রাখার
টোপ দিয়ে মায়ের আবদার আসত |
-“এবার তোর একটা বিয়ে করা দরকার বাবু | আমি চলে গেলে কে দেখবে তোকে? এত
লেখালিখি যত্ন করে জমিয়ে রাখারও তো একটা লোক চাই” |
-“আমি কি খোকা? আর অমিতাদি আছে দেখভালের জন্য | আমার
লেখা রইল সঙ্গে | আবার কি? এই
যে রোজ ভাবি চাকরি ছেড়ে দিয়ে শুধুই লিখব , তা তোমার ভাল লাগেনা
বল ? দায় চাপাতে চাও”?
তর্ক
জুড়ে দেয় বিতানের মা , “সব মেয়ে বোঝা হয়না
মোটেই | কেউ কেউ দায়িত্ব নিতেও জানে”|
দুই
এক
নির্মেদ গ্রীষ্মদুপুর | পুড়ে যাচ্ছে আশপাশ | মা এখন কথামৃত হাতে আধশোয়া খাটে| বিতান
ছুটির এইরকম দিনে লিখতে থাকে অনেক | অমিতাদি ঘনঘন চা দেয় | এত চা পানের জন্য আধ ধমকও দেয় চায়ের সঙ্গী হিসেবে বিস্কুটের
সাথে | ঘন লিকারের এক কাপ চা | এইটা পেলে বিতানের মনে হয় মহাকাব্য লিখে ফেলবে একদিন | মায়ের দূরের সম্পর্কের আত্মীয়া অমিতাদি | কচি বয়েসে বিধবা | নামেই দিদি , বয়েসে মায়ের সাথে এমনকিছু তফাত নেই | মা ওর সম্পর্কে মাসি হয় |
বিতানকে
ছেলের মতই ভালবাসে | বাবা চলে যাওয়ার পর দেশেরবাড়ি থেকে
এসেছিল মায়ের সঙ্গী হতে | বৈধব্যের ভাগ
বাটোয়ারা হলে বিষাদ আলগা হয় খানিক হয়ত | সেই রয়ে গেল এখানেই | চিরকাল অন্যের বাড়িতে আগাছার মত উদ্বাস্তু জীবন কাটিয়েছে সে | যে সংসারের স্বাদ, কর্তৃত্বের দাবী
আজন্ম পায়নি তাই যেন পেল এখানে এসে | পেখম মেলে দিয়ে
গুছিয়ে সাজাচ্ছে সবটুকু | সবদিকে নজর | মা নিশ্চিন্ত এমন কাউকে পেয়ে | বিতান
খুশি দায়মুক্তি নিয়ে | পরিপূরক হলে চাহিদা, সেইখানে দ্বন্দ্ব আসেনা |
মিলমিশের
সংসার হয়েছে তাদের তিনটি প্রাণীর | সত্যি বলতে কি বিয়ে
করতে ভয় লাগে বিতানের | এই যে নিস্তরঙ্গ চলছে
জীবন , সবটুকু হাতের নাগালে , বিবাদহীন সাজানো ঘরোয়া একফালি বাগান | তাতে আবার কি দরকার এক নতুন ফুলগাছ রোপণ করার ? অকারণ শোভাবর্ধনের কোন আকুলতা তার নেই | বরং নতুন মেয়েটির আগমনে এই দুই বৃদ্ধার মতিগতি কেমন হবে সেই
দোলাচল তাকে ভীত করে মাঝেমাঝে | তারচেয়ে এই ভাল |
কলিংবেল
বাজল হটাত | অসময়ে | বিতানই
উঠতে যাচ্ছিল | অমিতাদি বারান্দা পেরিয়ে যেতে যেতে বলল, “আমি যাচ্ছি নিচে | এই সময়ে উটকো
ফেরিওয়ালা আসে | তুই পারবিনা ওদের সামলাতে” |
তা
বটে | সামলাতে পারেনা বিতান | অনুরোধ | উপরোধ | তারচেয়ে এড়িয়ে চলাই শ্রেয় তার কাছে | অন্যের সঙ্গে দ্বৈরথে নিজেকে প্রতিষ্ঠার জন্য যে জোর দরকার হয়
সেইটে দিয়ে হয়ত ভগবান পাঠাননি তাকে |
-“একটা মেয়ে তোকে খুঁজছে” | অমিতাদি ফিরে এসেছে |
চকিত
লাগে বিতানের | কত বনলতাসেনবিহীন কৈশোর, নীরানিঃস্ব যৌবন ফুরোল হেলায় | আজ
মধ্য তিরিশে এ কোন সন্ধানের খোঁজ এল তার কাছে ?
-“কোথা থেকে এসেছে কিছু বলল”?
-“না ,
বলল
তোর সাথেই দরকার | বাড়িতে থাকলে একটু ডেকে দিতে | জরুরি”|
তারমানে
অভিভাবকসুলভ জিজ্ঞাসাবাদ চালিয়েছে অমিতাদি |
সদুত্তর
না পেয়েই এসেছে বিতানের কাছে|
-“বসিয়েছ নাকি”?
-“বসাবনা? ফ্যান
চালিয়ে জল দিয়ে এলাম” |
-“যদি চোর হয়”?
অমিতাদি
হেসে ফেলে | কত চোর ছ্যাঁচড়কে দেখে বাল্যবিধবা থেকে
আজ বুড়ি হলুম তা তো জাননা বাপধন | এই চোখদুটো অন্তর
পড়তে পারে |
বিতান
হেসে ফেলে জামা গলাল গেঞ্জির ওপর | পাজামাটা ঠিক করে
নিয়ে নিচে গেল |
একটি
মাঝারি গায়ের রঙের হলদেটে শাড়ি পড়া মেয়ে | ছোট কাজলটানা চোখ | খাড়াই নাকে লেগে আছে একচিলতে নাকচাবি | কানে হালকা ঝোলা দুল | এদিক ওদিক দেখছে | ফুটকি ফুটকি শিশিরের মত ঘাম জমা হয়ে আছে চওড়া কপালে | ডানহাতে কালো ব্যান্ডের ঘড়ি | আর
কিছুটি নেই তেমন অঙ্গভূষণে |
বিতান
আসতেই ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ায় |
নমস্কারের
পালা শেষ করে কথা শুরু করে মেয়েটি | নাম বেদান্তিকা | একটা আলগা সরের মত সপ্রতিভতা লেগে আছে বচনে , ভঙ্গিতে | একটি নামী প্রকাশনার
তরফ থেকে আগমন হয়েছে তার |
-“আমাদের প্রকাশক হরগোপাল মাইতি আপনাকে
কদিন ধরেই ফোন করছিলেন” |
মনে
পড়ে বিতানের | ল্যান্ডলাইনে গোলমাল | কমপ্লেন করা হয়েছে , কিন্তু গড়িমসি চলছে
টেলিফোন কোম্পানির দিক থেকে | মোবাইল ব্যবহার করেনা
সে |
-“তাই উনি আমায় পাঠালেন একবার আপনার সাথে
প্রাথমিক কথা বলার জন্য | যদি আপনি আগ্রহী হোন
তবেই আমরা এগোব” | আবার বলল বেদান্তিকা |
প্রস্তাবটি
বেশ অভিনব |
মূলত
কবিতার লোক বিতান | তাই ছাপা হয় পত্রপত্রিকায় | ইতিমধ্যে তার দুটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত এবং বেশ জনপ্রিয় | গদ্য যে কখনো লেখেনা এমনটা নয় | তবে
অধিকাংশই প্রবন্ধ | তাও ফরমায়েশি কোন বিশেষ উপলক্ষ্য নিয়ে | কিন্তু এই মেয়েটির কর্মসংস্থা চায় সে বেশ কিছু ছোটগল্প লিখুক | ‘কবির গল্প’ নামে একটি সিরিজ করছে
তারা | সেই সিরিজে একটি নাম বিতান বসু |
দীপমালাদি, পাঞ্চালদা, রুকসার ইত্যাদি
সমযুগীয় অনেকে লিখছে জানাল বেদান্তিকা | এদের প্রায় সবার
সাথেই মৌখিক আলাপ আছে বিতানের কিছু সাহিত্যসভা আর পুরস্কারগ্রহণের মঞ্চের সুবাদে | তবুও নতুনের আহ্বানে চটজলদি ভেসে পড়া বিতানের স্বভাববিরুদ্ধ | সে একটু স্থবির গোছের মানুষ | চলার
বাঁক অহরহ বদলে ফেলায় অভ্যস্ত নয় | এমনকি তার লেখাতেও
পরীক্ষানিরীক্ষার একটু অভাব আছে সমালোচকগণ বলে থাকেন | কটাদিন সময় চেয়ে নেয় বিতান | একটি
ফোন নম্বর রেখে যায় বেদান্তিকা | মতামত জানানোর জন্য |
তিন
গদ্যের
সেই যে শুরু তাতে অভাবনীয় সাড়া পেয়েছিল বিতান |
সে
এক হটাত প্রাপ্তির অনাবিল ধারায় সুখস্নান |
আজকাল
তো এমন দাঁড়িয়েছে কিছু পুজোসংখ্যার জন্য ছোটগল্পের আবদার আসে | বিতানও অবাক | চিরকাল সে জেনে এসেছে
ছন্দের অভিধান | যদিও পাঠক হিসেবে গল্প উপন্যাসই বেশি
ভাল লাগে পড়তে | গদ্যে তার প্রিয় সাহিত্যিক বর্ষীয়ান
রবিকান্ত মিত্র | অন্যের কবিতা বরং খুব বেশি পড়েনা বিতান | যদি মুগ্ধতা নিয়ে ফেলে অনুকরণের সহজ পথ | পদ্যের আড়ালে এত গভীরে গদ্যের শিকড় ছড়িয়ে ফেলেছিল মন তা সত্যি
বুঝতে পারেনি বিতান, যদিনা বেদান্তিকা আর মাইতিবাবু এত ভরসা দিতেন |
আজকাল
আর একটি নেশাও চেপে বসেছে তাকে | অন্তর্জালের সাহিত্য | বেদান্তিকা তেমন একটি ফেসবুক পেজ চালায় | প্রায় পাঁচলক্ষ ফলোয়ার সেটির | কিছু
বছর আগে অব্দিও এসব জানতনা বিতান | তবে আজকাল সবাই টাইপ
করা লেখা পছন্দ করে | প্রথম প্রথম
কম্পিউটার ইন্টারনেট আসার পর ধাতস্থ হতে অসুবিধে হত বটে | কিন্তু এখন তাতেই বড় আরাম অনুভব করে | শুধু খটাখট কি-বোর্ড চালিয়ে দাও, ভুলচুক
হলে সঙ্গে সঙ্গে ডিলিট। ভুলের কোন দাগ রইলনা কোথাও। নিজের কাছেই আজকাল ভ্রান্তির
হিসেব থাকেনা।
সেইসব
কলমের দিনরাতগুল কুয়াশার ভোরের মতই হারিয়ে গেল। এখন শুধু ধোঁয়াশা কেমন। ধুপধাপ
লিখে ফেলা, পাঠিয়ে দাও মাউসের একটা ক্লিকে। আলাদা
করে নথিবদ্ধ করার দরকার নেই কিচ্ছুটি | সব হিসেব রয়ে যাচ্ছে
আপনা থেকেই | তারপর অন্তর্জালের সাহিত্য পাতাগুলি আরো
মজার | লেখা পাঠাও | তারপর চব্বিশ ঘণ্টা কাটারও ধৈর্য নেই। মনোনীত হল কিনা, কবে পোস্ট হবে সবই ফাস্টফুডের মত এক্ষুনি চাই। লেখক হিসেবে এই
অস্থিরতা বিতানকে জর্জরিত করে, কিন্তু মায়াজাল কেটে
পালাবার পথ নেই। বিতান কিছু কিছু লেখা পাঠিয়ে এখন নেশায় পড়ে গেছে |
অনেকে
বলেন ভার্চুয়াল দুনিয়ায় লেখার কৌলীন্য নেই,
অনেকেই
লেখেন। পাঠকরাই লেখক | কষ্টিপাথরে যাচাই
হয়না | কিছু কিছু লেখা তো সত্যি হাস্যকর লাগে
বড় | বিতানের মত মোটামুটি নামকরা লেখক তেমন
কাউকে আর দেখেনা অবশ্য এইসব পেজে লিখতে | বাকি যারা লেখে তারা
বেশিরভাগ সাধারণ সামাজিক মানুষ, পুরোদস্তুর লিখিয়ে নয়
| কেউ স্কুলের টিচার , কেউ আটপৌরে গৃহবধূ | কেউবা অবসরপ্রাপ্ত
বৃদ্ধ | এমন অনেকেই |
বেদান্তিকা
বলে, “এদের লেখা হয়তো এমনিতে ছাপা হতনা কোথাও | এঁরা কেউ কালজয়ী লিখবে বলেও লেখেন না | একটু যদি প্রকাশ পাওয়া যায় , অসুবিধে
কি ? শুধু তো সাগর নয়, কিছু পুকুরেও তরঙ্গ ওঠে তো কখনো | এই যে লাইক আর কমেন্ট পান এই লেখকরা , হয়ত যারা সেসব দিচ্ছেন তাঁরাও কেউ সাহিত্যবোদ্ধা নন প্রবল, তবুও ক্ষতি কি”?
বিতানের
যেটা সবচেয়ে চোখে পড়ে অন্তর্জালীন লেখায়, তা হল আইডিয়া চুরি
যাওয়া। এত লোক আছেন, নজর করা মুশকিল। বাঁধনগুলো কম বলে সুযোগ
বেশি প্রতারণার | লেখনির ধাঁচ নকল করা কঠিন, কিন্তু অন্যের মূল ভাবনাকে নিজের করে নিতে আর কতক্ষণ লাগে?
তবে
সত্যি কি ভাবনা চুরি যায় সাহিত্যে ? অনেকগুল চিন্তাশীল
মানুষ যখন একই সামাজিক প্রেক্ষাপট নিয়ে ভাবতে বসেন সেটা যে মিশে যাবে একে অন্যের
সাথে, এটাই কি স্বাভাবিক নয়? একে চুরি বলা হয়ত অনুচিত। বিতান ভাবে মাঝেমাঝে |
এরমধ্যেই
ফেসবুকে বেশ কিছু লেখা জমে গেছে তার | একজন উঠতি প্রকাশক
সেগুলো ছাপানোয় বেশ আগ্রহী | দেখা যাক |
তৃতীয়
গল্পসমগ্রটা প্রকাশ পেল সদ্য, যুগদর্পণ পুরস্কারে
নির্বাচিত হল প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই | রবিকান্তদার সাথে
সামনাসামনি দেখা হয়েছিল সেই মঞ্চেই | কত প্রশংসা করলেন
রবিকান্তদা ! যার লেখা গদ্য গোগ্রাসে পড়ে বিতান, তাঁর
সামনে দাঁড়িয়ে আবিষ্ট লাগে, বাক্যি সরেনা। বিতান
অনুভব করছিল কেবল সন্ধ্যেটাকে | পুরষ্কারপ্রাপ্তির
বক্তব্য রাখতে গিয়েও বারবার সেই মুগ্ধতা উজাড় করে বলেছিল |
অমিতাদি
চেয়েছিল রবিকান্তদা আর উনার স্ত্রী সরমাদিকে ডাকতে ওদের বাড়িতে। বিতানের গড়িমসি।
অত বড় মানুষকে ডেকে এনে অভ্যর্থনা করতে ভয় করে | সংকোচের
একটা অদৃশ্য মায়া জড়িয়ে রাখে ওকে | এই যে বেদান্তিকার
প্রতিও একটা টান জমাট বাঁধছে অন্তরে , তাও তো মেলে দিতে
পারেনা ঠিক| মনে হয় সেই বুঝে নিক যদি পারে |
চার
ল্যান্ডলাইনটা
বাজছিল অনেকক্ষণ | অমিতাদি কোথায় কে জানে? ফোনটা তাকেই ধরতে হল |
চাকরিটা
ছেড়ে দেওয়ার পর থেকে আলস্য গভীর আরো বিতানের |
লেখার
টেবলেই কাটে বেশিটা | শারীরবৃত্তীয় কাজ আর
খাওয়ার টেবল ছাড়া কিছুর জন্যেই উঠতে ইচ্ছে করেনা তেমন |
রবিকান্তদা
ফোন করেছেন |
-“তুমি খুব ব্যস্ত বিতান” ?
দু’চার কথা হল এদিক ওদিক। বিতান বুঝতে পারছে রবিকান্তদা অন্য কিছু
বলতে চাইছেন। ইতস্তত করছেন।
আমেরিকার
ভিসানীতি অব্দি আনতাবড়ি আলোচনা শেষ করে তবে আসল কথায় এলেন রবিকান্তদা।
-“আমি কি একটু আসতে পারি তোমার কাছে”?
হৃদয়ে
নাড়া বিতানের | ঈশ্বর যদি মন্দিরে আসবেন কিনা জানতে চান
ঠিক কি উত্তর দিতে হয় জানেনা বিতান | এই যে আজ সে কাব্যের
মায়াপথের সমান্তরাল গদ্যের ধানজমিতে লাঙ্গল দেওয় , তার
বীজ তো ছড়িয়ে দিয়েছিল রবিকান্তদার সাহিত্যমুখর পঠনের দিনগুলো | এই ঋণমাখা বিতানের কাছে তিনি যে অনেককিছু চাইতে পারেন আরো |
-“অবশ্যই | আপনি
চাইলে আমি আপনার কাছেও যেতে পারি” |
-“না ,
আমিই
আসব | আজ বিকেল পাঁচটা নাগাদ যদি যাই”?
-“আসুন রবিকান্তদা | যদি ভরসা দেন তবে বলি কি রাতের আহারটা সেরে গেলেন নাহয় এখানে? সরমাদিকেও সাথে আনেন যদি?
আমি
অনেকদিন থেকে ভাবছিলাম......”
-“হবেখন আরেকদিন | আজ একাই গপ্প করে আসি”
|
-“তাই হোক | অপেক্ষায়
থাকব” | ঠিকানা ইত্যাদি বুঝিয়ে ফোন রেখে দেয়
বিতান |
ঠিক
পাঁচটা বাজার মিনিট খানেকের মধ্যেই দরজায় বেল |
ত্রস্ত
হয়ে দোর খোলে বিতান | দীঘল মানুষটি দাঁড়িয়ে
আছে স্মিতমুখে | সেই ধবধবে ধুতি পাঞ্জাবী | মেঘমন্দ্র স্বর |
-“আসতে পারি”?
বিতান
প্রণাম করে পায়ে হাত দিয়ে | “আসুন রবিকান্তদা” |
অমিতাদি
আর মা দেখা করে গেছে এসে | আয়োজন অনেক ছিল | কিন্তু এককাপ চা আর কিছু বাড়িতে বানানো মুড়ির মোয়া ছাড়া আর
কিছুটি খেলেন না রবিকান্ত |
বিতান
অনুভব করছেন কিছু বলার তাগিদা আছে উনার | অবশ্য অমন হটাত ফোন পেয়ে
সেটা না মনে হওয়ার কারণ কিছু নেই | সেই বালিগঞ্জ থেকে
উত্তরে ছুটে এসেছেন নাগরিক রাস্তার জটলা পেরিয়ে | উনার
তো নিজের গাড়িও নেই |
অবশেষে
কথা এগোলেন রবিকান্তদা নিজেই |
তারপর
বলে চললেন নাগাড়ে।
-“জান বিতান আমরা তো আগের যুগের মানুষ।
খুব রক্ষণশীল | এই যে তুমি চমৎকার পদ্য লিখতে লিখতে
হটাত গদ্যলিখিয়ে হয়ে গেলে তাও মন থেকে মেনে নিতে কষ্ট হয়েছিল বেশ | ছোটগল্পের ওই বিদ্যুতের মত চমক আনার জন্য কত রাত গড়িয়ে ভোর
ছুঁয়ে ফেলেছি সেসব এত অনায়াস বুঝি? আসলে হয়ত খানিক
ঈর্ষাও | আমাদের তো যুগ ফুরিয়ে এসেছে | পুরনো ভারী আসবাবের মত নামটা ব্যবহার হয় মাঝেমাঝে | কেউ তেমন আমাদের নতুন লেখা পড়তে চায়না আর | যা পুরনো বিখ্যাত সৃষ্টি তাই ঘুরেফিরে পাক খায় বাজারে”|
বিতান
আশ্চর্য চমকে আহত , স্থম্ভিত | তার উর্বর কল্পনাতেও এই আলাপচারিতার জন্য প্রস্তুত ছিলনা সে |
-“আমার গদ্যের মুখ্য প্রেরণা আপনি রবিকান্তদা”....ঠোঁটের আলতো উদ্ভাসে এটুকুই বলতে পারে বিতান |
-“দাঁড়াও আমায় শেষ করতে দাও | তুমি আবার অন্তর্জালেও লিখছ আজকাল | আমাদের সময়ে তো পাঠকের ভালবাসার কোন সংখ্যা হতনা। এখন তোমরা ক’হাজার কিম্বা ক’লক্ষ লাইক এল তা দিয়ে
চিনতে পারো নিজের মাপকাঠি। সেই আমার একদিন শখ হল তোমার রাজ্য ঘুরে দেখব। কি বলব
ভাই, এ তো আশ্চর্য মোহ! প্রতিযোগীতা, প্রশংসা সবই কেমন খোলাখুলি। এই লাইক, এই কমেন্ট দিয়ে পাঠক মুহূর্তে বিচারের ফলাফল দিচ্ছেন। আমাদের
সময়ে এত ডিরেক্ট কিছু ছিলনা তো। পাঠকের চিঠি আমার কিম্বা প্রকাশকের ঠিকানায় আসতে
বহুদিন পার হয়ে যেত। তাই বড় লোভ হল। নিজের নাম লুকিয়ে ‘প্রাণভোমরা’ ছদ্মনামে একটি গল্প
লিখলাম খুব জনপ্রিয় ফেসবুক পেজটিতে। তুমি যেখানে নিয়মিত লেখ | পেজ থেকে জানাল , একজন লেখক নাকি ওই
টপিকে আগেই লিখে ফেলেছে, প্রায় একই রকম একটি
গল্প। তাই আমার গল্পটা নিতে পারবেন না উনারা”।
নীরব
বিতান। ঘটনাটা তারও অচেনা নয়! ঝুমবৃষ্টি পেজের অ্যাডমিন বারিকদা তাকে বলেছিল বটে
এরকম কিছু একটা।
আবার
বলছেন রবিকান্ত |
-“পেজের গল্পগুল তন্নতন্ন করে খুঁজে সেই
গল্পটি পেলুম ভাই। বিশ্বাস কর, তিরিশ বছরের লেখক
জীবনে অত হিংসে কাউকে করিনি। একলাখি লাইকের সেই গল্পটার লেখক আমায় পায়ে হাত দিয়ে
প্রণাম করল যেদিন যুগদর্পণ পুরস্কার মঞ্চে,
অপরাধবোধ
হল খুব”।
বিতানের
এখন সচকিত হিন্দি ছবির ক্লাইম্যাক্স দশা |
সেই
‘প্রাণভোমরা’ নামের লেখক, যার পাঠানো গল্পটা
নাকি প্রায় পুরোটাই মিলে গেছিল বিতানের ঝুমবৃষ্টি পেজের সবচেয়ে পপুলার গল্পটার
সাথে, তার আসল নাম তাহলে বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক
রবিকান্ত মিত্র ?
-“এই দাদাটিকে মাপ কর ভাই। তুমি অনেক
শক্তিশালী আর বহুমুখী লেখনী নিয়ে জন্মেছ। লেখার অবহেলা করনা কোনদিন। আজ খালি তোমার
কাছে স্বীকারোক্তির জন্য ছুটে এসেছি | কবে আছি কবে নেই | এই ভার আর বইতে পারছেনা বৃদ্ধ হৃদয়” |
বিতানের
চোখ কড়কড় করছিল। বুকে পাথুরে চাপ।
চাঁদের
প্রচ্ছায়া জলে লুকোনো রয়ে যায় , অজান্তেই |
-“এ আমার গুরুদক্ষিণা জানবেন
রবিকান্তদা....যদি অবর্ণনীয় গর্বের কোন মুহুর্তে আপনার প্রতিলিপি হতেও পারি, এই তুচ্ছ লেখনী পূর্ণ আমার”|
আবেগে
জর্জরিত হয়ে বলে বিতান |
রবিকান্তর
প্রাচীন অথচ লিখিয়ে হাতদুটো যত্নে মুঠোয় ভরে নেয় সে | পারস্পরিক ছোঁয়ায় বালার্কের মত নিষ্কলঙ্ক আর সহজ হয়ে ওঠে জীবন , উদীয়মান আর অস্তগামীর।|
ঋতুপর্ণা ভট্টাচার্য: কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন