সাহিত্য সৃষ্টির সলিলধারা বিকাশে ভাষার প্রয়োজনীয়তা



বিবিধ রচনা



      পথ ছিঁড়ে উঠে আসে হাওয়া; আমাদের
        সময় হয়েছে,শোনো সময় হয়েছে
        শোনো,সমস্ত সময়
        কেন হয় না আপামরে ভালবাসা?
        কেন এর পরে
        পারি না মিলিয়ে যেতে ঠাসবুনুনের
        মতো সঠিক জীবনে?
        ঘুম, জেগে ওঠা,ঘুম,অবিরল
        ঢেউ এসে পড়ে।'

        সময়ের টানে ঢেউ আসে,ভালবাসা মিলিয়ে নিতে হয়,ভালবাসার শব্দ বুনুন দিয়ে। আছে একটা,স্পষ্ট বোঝা যায় টান দিলে উপুড় হয়ে এসে পড়ে হাতের কাছে। তাই আমরা এখনও পাগল হয়ে যায়নি,পাগলামি ভাল,কিন্তু নিজেকে শেয়ানা ভাবা ভাল নয়,প্রেম অন্ধকারে একা মনে হয়। তবুও যতদিন আছে ততদিন এবেলা ওবেলা কাছে বসে থাকি। বসে থাকতে হয় মনের মাধুরী মিশিয়ে বিহারে পাড়ি দিতে থাকা মাস্তুলের দিকে।

        ভাষা,সাহিত্যের সুসলিলধারা স্বতোস্বনী দরিয়ার  ঢেউ হয়ে সাহিত্যতরিকে পরিপূর্ণ করে। আদিম যুগে বনে বাদাড়ে,ঘন জঙ্গলে বসবাস করার সময়ে জীবজন্তু ও আদিম জনজাতি মানুষের ভাব বিনিময়ের নিমিত্তে ভাষার উৎপত্তি। শব্দ থেকে ইঙ্গিত,ধ্বনি থেকে পরিচিতি,জ্ঞান থেকে যে শব্দতরঙ্গ প্রবাহিত হয়ে থাকে,তার অনুরণন,কম্পাঙ্ক থেকে তরল স্রোতের মতো নির্গত হতে থাকে ইঙ্গিতবাহী শব্দ দ্যোতনা,খিদে পেলে খেতে চাওয়া,অনুভবে কান্না আসা,আনন্দ-বিষাদে উচ্ছ্বাস প্রকাশ যার মাধ্যমে বাগ্ময়তা প্রতিধ্বনিত হয়ে ওঠে।

       পৃথিবীর দেশে দেশে স্বকীয় ভাষার দ্বারা সম্পৃক্ত জনজীবন। বেদনা-বিঁধুর জোৎস্নার আকাশ তরিতে যে ভালবাসার গান ভেসে ওঠে,সেই ভালবাসার স্রোত ক্রমশ মনের চৌহদ্দি ভেদ করে স্বপ্নের মায়া ভুবন ছাড়িয়ে প্রত্যাশার সিঁড়ি বেয়ে উর্ধ্বে  গমণ করে। সেই এক অনাবিল সরলতা আর স্বাচ্ছন্দ্য জীবনকে পুলকিত ও আলোকিত করে মনের গরিমার সংমিশ্রণে।  

       কোথায় -- জন্মভূমি শুভ বঙ্গদেশ
       তব ক্ষেত্রে শস্য রূপে বিরাজে ধনেশ।

ভালবাসার ভূমি -- মায়ের দুগ্ধ ফেনিল সদৃশ,সম্পৃক্ত হৃদয়ের রসে,সরসিত ক্ষেত্রভৃমি,জন্মভূমি,সবার কাছে প্রিয়,আপনজন একান্ত ভালবাসার পবিত্র স্থান। ঠিক যেন মনের কথা জড়িয়ে থাকা,শব্দে উচ্চারণে,উচ্চারিত শব্দের আঙিনায় নিকানো শুভ্রতা স্বরূপ,ঝরে পড়ে মনের কণ্ঠনালী থেকে,সে তো ভাষা,আপন সন্তান তুল্য ভাষা। বহুদেশে বহু ভাষা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে,নানান কৃষ্টি,নানা সংস্কৃতি,হরেক কালচার,বিভিন্নতা ও বৈচিত্র্যময়তা মুগ্ধ করে,কিন্তু কেউ কারও প্রতি হিংসে করে না। কেউ কাউকে ছোট বড়,উচ্চ নিম্ন মনে করে না

   হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হল পার করো আমারে'আকুতিপূর্ণ ভজনা,আত্মনাদ মুখর শব্দ ব্যঞ্জনা পরস্পরকে বিমুগ্ধ করে। পরস্পর বিরোধীতা নেই,ঠিক একসূরে বাঁধা সহস্রটি মনের মতো একতানে। তবুও আমাদের ভাবতে হয়,আমার মাতৃজননীকে কি রক্ষা করতে পারব,মায়ের মুখনিঃসৃত বাণীকে কি সম্মান দিয়ে ধরে রাখতে পারব। চিত্ত আমাদের ভয় শূন্য হলেও কখনও কখনও শির উর্ধ্বে তুলে ধরে রাখতে অসমর্থ হয়ে যাই,কষ্ট লাগে,শিরোঘাত আমাদের বিমর্ষ করে,কবি তখন সাহস জুগিয়ে থাকে -- মনের সহর্ষ আনন্দ বেলার ক্ষণে শুনতে পাওয়া যায় কবির কণ্ঠে –

        মোদের গরব মোদের আশা
        আ মরি বাংলা ভাষা ।

চর্ষাভাষার পথ বেয়ে বাঙালির চৌকাঠে পৌঁছে যায় বাংলা ভাষা,চর্চার ভুসুকু বাঙালি ও আব্দুল হাকিম মাতৃভাষার স্বাভিমান প্রকাশ করে। রামনিধি গুপ্ত (১৭৪১--১৮৩১) যখন গেয় বাকের কবি হিসেবে খ্যাতির চুঁড়োয় তখনও ছাপাখানা মুখ খোলেনি। তিনি সেদিনে সগর্বে বলেছেন –

          নানান দেশে নানান ভাষা ।
          বিনে স্বদেশীয় ভাষা পুরে কি আশা।।

প্রশ্নটা আমাদের সেখানেই,সাহিত্যের ভাণ্ডারে বাংলা ভাষা এক অন্যতম,সংস্কৃতের সমতুল্য। যা পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার মধ্যে এক অনন্য বৃহত্তর ভাষা,যে ভাষা ক্রমাগত আমাদের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে,ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে বসেছে। স্বদেশীয় ভাষার কদর ভুলে পরদেশী ভাষার প্রতি আকর্ষণ দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। জর্জ বার্নাড শ বলেছেন যে, ' England and America are two countries separated by the same language.' তিনি ভাষা সংস্কারের লক্ষ্যে বিশেষ জোর দিয়েছিলেন। ভাষাকে সুরেলা,সাবলীল,সুশীল ও গতিময় করে তুলতে অভিধান রচিত হয়,সঠিক ক্ষেত্রভৃমিকে নির্দিষ্ট বিতংসবিদ্ধ করে তুলতে এবং উৎপাদিত শস্য নির্মুক্ত যাতে থাকে। ফলে ভাষার একটা গতিরেখ লক্ষ করা যায়।

         বহুদেশের বহু ভাষা,তাদের নিজ নিজ মাতৃভাষার মাধ্যমে আদান প্রদান,শিক্ষা সংস্কৃতি,আচার অনুষ্ঠান,শিল্পকলা বিভিন্ন পদ্ধতিতে পালিত হয়ে থাকে। তাই ভাষার অপরিহার্য ব্যবহার অস্বীকার করার পথ নেই,তাই ভাষার চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষ তার নিজস্ব মতামত প্রয়োগ জন্য আত্মবলিদান দিতে প্রস্তুত,সেই দৃষ্টান্ত আমাদের আছে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন পৃথিবীর মানুষকে,জাগ্রত বিবেককে নাড়া দিতে থাকে,তাকে পরম যত্নে রাখতে চায়। ভাব বিনিময়ের কড়ি হিসেবে ব্যবহার করে এবং নিত্য প্রয়োজন ও চাহিদা পূরণে ব্যবহৃত হতে থাকে। কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে যে,তবে কেন ভাষার জন্য প্রাণ দিতে হয়েছে? কোন জিঘাংসা রক্তনদী বইয়ে দিতে পারে? কেন আমাদের একুশে ফেব্রুয়ারীকে প্রতি বছর স্মরণ করতে হয়? অনেকগুলো না, না প্রশ্ন যখন মাথার উপর উড়ে বেড়ায়,তখন মনে হয়,প্রাণের চেয়ে ভাষার মূল্য অধিক,সার্থকতা এখানেই।

সালাম,রফিক,বরকত,জব্বারকে স্মরণ করা নয়,এখানে ভালবাসার স্মৃতিসৌধ কে সুউচ্চে তুলে ধরা,মহান হতে নয়,মহত্ত্বের পরিচয় দিতে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা আমরা পেয়েছি সেই মহারণের পর,রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়ে,এখানেই বাঙালির সার্থকতা।

     মাটি আমাদের শিক্ষা দেয়,শিক্ষকের ভূমিকা পালন করে। আজও দেখি বাতাসে বিষ,নদীতে গরল,ওষধিতে মৃত্যুরস মেশানো,তখন মাটি মা মনে পড়ে,সেই মাটির
    
    যে মাটিতে শিউরে ওঠে ঘাস
        যার পরে ঐ মন্ত্র পড়ে দক্ষিণা বাতাস

এই ঘর,এই মাটি তাকে প্রাণ দেয়,ভাষা সেই প্রাণের ধারা বহন করে চলেছে অনন্তকাল। প্রকৃতির একটা নিজস্ব ভাষা আছে,প্রাকৃতিক ভাষার স্থাপত্যকেই পরিচিত পরিবেশ সঞ্চারিত করে, নিশ্বাস প্রশ্বাস দ্বারা তরঙ্গিত কাব্য সৃষ্টি করে। তথ্য প্রযুক্তির এক নব আবিষ্কার এসে ভাষার নতুনত্ব বৃদ্ধি করে তুলছে। বিখ্যাত পাঠবিদ পিটার শিলিংসবার্গ "ফ্রম গুটেনবার্গ টু গুগল "বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করে দিগন্ত খুলে ধরে। আমরা মনে করি যে,ভাষার প্রথম ও প্রধান প্রয়োগ কিন্তু লেখা বা পড়ায় নয়,বলা ও শোনাতে। বহুসমাজ ছিল ও আছে,যেখানে কোনও লেখ্য ভাষা কোনদিনও সৃষ্টি হয়নি,কিন্তু যুগ যুগ ধরে মৌখিক ভাষা চলে আসছে এবং সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে। সেই ধারার অংশ হিসেবে নেটওয়ার্ক সিস্টেম আমাদের মুদ্রিত ধারাকে ব্যাহত করে।

      কেউ ভোলে,কেউ ভোলেনা এই দুই সত্ত্বাকে নিয়েই আমাদের একুশ পালন করতে হবে। একুশের কবিতা গেয়ে ওঠে আকাশে বাতাসে শালবনির শীর্ষে।
        
   একুশ আমার টগবগানো
          রক্তে ভেজা ধান
         একুশ আমার পদ্মা-মেঘনা
            ভাটিয়ালি গান ।'

একুশ আমাদের প্রতিবাদের ভাষা। একুশ প্রাণের বিসর্জনের থেকে ফিরে পাওয়া অমূল্য রতন। একুশ দামাল আগুন, ঝড়ের মাতন। এই শিমুল পলাশ ফোটার দিনে নতুন করে সালাম, রফিক, বরকতদের জন্য প্রাণের সুবাস,মিষ্টি আলো ছড়িয়ে দিয়ে একুশেরগান গেয়ে ওঠে পল্লবীত বৃক্ষরাজি,মেঠো পথের পথিক,অহল্যা উষর ভূমির জনজাতি সম্প্রদায় । না আমরা আর হারব না, ভালবাসার হাতিয়ার নিয়ে এগিয়ে যাব ভাষাসাগরে,ভাষার নৌবহর নিয়ে। তবেই হবে আমাদের সত্যিকারের ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা জানানো,লোক দেখানোর আচার অনুষ্ঠান করে মাতামাতি করার জন্য নয়,সত্যিকারে ভালোবাসা জানাতে ।

কবিতা এগিয়ে চলে ভাষার সলিলখাত ধরে,Thinks are neither happy or sad,  they simply multiply, a spoon like besides a cup, a mat is spread out by a stool. এভাবে ভাষা আমাদের বিভেদরেখাকে টেনে এনে ছিঁড়ে একাকার করে দেবে। হিন্দি কবি কেদারনাথ বলেছেন,'My soul is bleeding and things are being reborn from my blood. প্রত্যেক জাতির নিজেদের ভাষা আছে,তাদের ভাষাকেও আমাদের মর্যাদা দিতে হবে,ভুলে গেলে চলবে না যে সেটা তাদের মাতৃভাষা। মায়ের চেয়ে বড় কেউ নয় । শেষে বলি,
জননি বঙ্গভাষা, এ জীবনে
চাহি না অর্থ, চাহি না মান
যদি তুমি দাও তোমার ও দুটি
অমল-কমল-চরণে স্থান।

নাসির ওয়াদেন:কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন