আমার লেখালেখি


                     
বিবিধ রচনা


ছোট থেকেই আমার ভেতর লেখা জমা হত। তখন তো জানতাম না যে, পরবর্তীকালে আমি হাতে কলম তুলে নেব! খুব ছোট থেকে একটু নিঃসঙ্গ হয়ে বড় হয়েছি। বাড়িতে সঙ্গী ছিল একমাত্র বই। বাবার বদলীর চাকরি ছিল। খুব কমই বাড়িতে আসতেন, মা আমি জন্মানোর পরেই নতুন করে পড়াশুনো শুরু করেছিলেন। আমি আর বোন থাকতাম কাজের লোকের কাছে। সারাদিন আমরা নিজের মনে খেলা করতাম। আমার বোন আর আমি খুব ভালো বন্ধু ছিলাম। অক্ষরজ্ঞান হবার পরেই মোটামুটি সারাদিনের কথা ডায়েরিতে লিখতাম। ডায়েরিতে পাতা শেষ হয়ে গেলে লিখতাম খাতাতে। আমাদের সরকারি আবাসনে বড় বড় লোহার শিক দেয়া জানলা ছিল। কার্নিশটা সিমেন্ট দিয়ে বাধানো। আমাদের দক্ষিণ খোলা শোবার ঘরে দুটো জানলা ছিল। বাড়ির উল্টোদিকে ছিল একটা বিরাট দেবদারু গাছ। সারাদিন গাছটার সঙ্গে আমি কত যে কথা বলতাম! হাজার হাজার গল্প ভিড় করে আসত মনে, এবং আমি নিজেই সেই গল্পের চরিত্র হয়ে যেতাম। দেবদারু গাছের সামনের জানলাটার নাম দিয়েছিলাম দুঃখের জানলা। কারণ ওখানে পাতার আড়াল থেকে রোদ এসে কেমন একটা আলো আঁধারি তৈরি করত। মন খারাপ হলে নিয়ম করে ওখানে বসতাম। মনে হয় রোজ বিকেলবেলার মন খারাপটা আমি বেশ উপভোগ করতাম। আরও একটা যে জানলা ছিল, সেখান থেকে দূরে একটা বিরাট বাগান দেখা যেত। সেখানে সকালের রোদ লম্বা হয়ে এসে পড়ত, তাই সেই জানলার নাম রেখেছিলাম সুখের জানলা। নানা রকম অদ্ভুত নাম দিতে আমার জুড়ি ছিল না। কাতলা মাছের পেটির নরম তৈলাক্ত অংশকে বলতাম হাতির মাংস, আর অম্বল হলে, চোয়া ঢেকুরের নাম দিয়েছিলাম গন্ধপচা ঢেকুর!

বাড়িতে নানা ধরণের বই খুব একটা ছিল না, তবে পুজো সংখ্যা বেশ কয়েকটা কেনা হত, ছোটদের এবং বড়দের। আমাকে বাধা দেবার কেউ ছিল না, বলে ছোট থেকেই সবরকম বইই পড়তাম। দেবসাহিত্য কুটীরের বাধানো মোটা মোটা ছোটদের জন্য বইগুলো মণিহারা, অপরূপা খুব প্রিয় ছিল। আরও কিছু বই জন্মদিনে উপহার পেতাম। সারা বছর ধরে বই উপহার পাবার জন্য মুখিয়ে থাকতাম। খুব প্রিয় বই ছিল চাঁদের পাহাড়। ডায়েরিতে শঙ্কর আর আলভারেজের অভিযানগুলোকে বিস্তৃত করে নতুনভাবে লিখতাম। মনে আছে কপালকুণ্ডলা পড়ে প্রভাবিত হয়ে সাধুভাষায় একটা বড়গল্প লিখেছিলাম। অবিশ্বাস্য হলেও তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি! এইসব লেখা লিখতে কেউ বলেনি। ভেতর থেকে উঠে আসতো। ক্লাস ফোরে 'অধিকার' নামের একটা গল্প লিখেছিলাম, স্কুলের খাতায়। সেই 2গল্পে খুবই গুরু গম্ভীর বিষয়ের উল্লেখ আছে। আমাদের সারদা মিশন স্কুলের মাতাজী সেই গল্প ক্লাসের সবাইকে পড়ে শুনিয়েছিলেন। সেই গল্পটা সংক্ষেপে বলি, তাহলে বোঝা যাবে চিন্তা ভাবনার পর্যায়টা।

একটি পরিবারে এক ভদ্রলোকের দুটি ছেলেমেয়ে। তিনি একটি কারখানাতে কাজ করেন। একদিন কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে লোকটার কাজ চলে গেল। বাচ্চাদুটোর নাম কিছু একটা দিয়েছিলাম, মনে হয় রিঙ্কু ও পিঙ্কু। বাচ্চাদুটোর মায়ের একদিন খুব শক্ত অসুখ হল, এবং তিনি মারা গেলেন। মা মারা যেতে বাচ্চাদুটো খুব কাঁদত। তাদের বাবা কাজের সন্ধানে দূরে চলে যেত রোজ। অনেক রাতে ফিরে আসত। এরপর একদিন তাদের সব জমানো টাকা ফুরিয়ে গেল। আত্মীয়রাও তাদের কেউ সাহায্য করল না। তখন একদিন খিদের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে লোকটা ঠিক করল ছেলেমেয়েদের নিয়ে আত্মহত্যা করবে। সেইমত তারা একটা বিরাট বাড়ির ছাদ থেকে ঝাঁপ দিতে গেল, কিন্তু তাদের সকলকে পুলিশ দেখতে পেয়ে ধরে নিয়ে গেল। বলল, আত্মহত্যা করা অপরাধ। তখন লোকটা বলল, তারা সকলে যখন না খেতে পেয়ে মরে যাচ্ছিল, তখন কেন পুলিশ তাদের ধরেনি? কেন বাধা দেয়নি? তাদের বাঁচার অধিকার যদি না থাকে, তবে মরবার অধিকার কেন থাকবে না?

এরপর পরের বছর হাইস্কুলে স্কুল ম্যাগাজিনে আমার একটা গল্প ছাপা হয়। আমি তখন জুলভের্নের এর অদ্রীশবাবুর অনুবাদ পড়ে একেবারে আত্মহারা হয়ে গেছি। ও হ্যাঁ, আমাকে এত বই এরপর সরবরাহ করে গেছিলেন আমার এক কাকাবাবু। তিনি তাঁর স্কুলের লাইব্রেরী থেকে আমার জন্য বই এনে দিতেন। রাশি রাশি বই তাঁর সৌজন্যেই পড়ে ফেলেছিলাম। কালো হীরে, টোয়েন্টি থাউজাণ্ড লীগস আণ্ডডার দ্য সী, পৃথিবী থেকে চাঁদে ইত্যাদি পড়েই চলেছিলাম। আমি তখন বরানগর রাজকুমারী মেমোরিয়াল গার্লস স্কুলে পড়ি। ক্লাস ফাইভে আমার প্রথম গল্প প্রকাশিত হল স্কুল ম্যাগাজিনে। এ এমন কিছু বড় ব্যাপার নয় অনেকেরই এমন হয়ে থাকে। তবে প্লটের অভিনবত্ব আজও মনে আছে। গল্পের নাম ছিল 'আশ্চর্য জগত'। লিখেছিলাম আমি এক আশ্চর্য পৃথিবীতে এসেছি। জাহাজ ডুবে গেছে এবং আমি একটা নতুন দ্বীপে এসেছি। (মনে হয় জুলভের্নের প্রভাব, তবে তারপর সম্পূর্ণ নিজস্বতা আছে!) সেই জগত এক সুবিশাল বৃক্ষময় জগত। গাছেরা কেউ মাটিতে আটকে নেই বরং তারা চলাফেরা করতে পারছে, এবং তারা মানুষদের চাষ করছে। তালগাছ আমগাছকে নিজের চাষের খেত দেখিয়ে বলছে এখানে পাঁচ বিঘে জমিতে আমি শ্যামলা মানুষ আর পাঁচ বিঘেতে কালো মানুষের চাষ করেছি। তারপর নানা অদ্ভুত ঘটনার শেষে জানা যায় আমি সবটাই স্বপ্ন দেখছিলাম। মনে আছে এই গল্প নিয়েও ক্লাসে অনেক আলোচনা হয়েছিল।

ছোটবেলায় যখন যা পড়তাম তখন তার ভেতর থেকে গল্প বেরিয়ে আসত আপনা থেকে, এবং সেটা একদম স্বকীয় হয়ে উঠত। বড় হয়ে পড়ার চাপে লেখালেখি ভুলে গেলাম। তবে গল্পের বই পড়া  এবং সেই সঙ্গে ঐতিহাসিক নানা চরিত্রকে চিঠি লিখতাম। ভালো লাগত বিবেকানন্দ আর সুভাষ চন্দ্র বসুকে। ওঁদের কত যে চিঠি লিখেছি তার ঠিক নেই। সব সময় কেমন একটা নিজস্ব কল্পনার জগতে ডুবে থাকতাম। কখনও ভাবিনি লেখালেখিকে সিরিয়াসলি নেব। লেখালেখি তখন কিছুটা আমার কাছে সময় কাটানোর আর মন ভরানোর বিষয় ছিল।

এরপর জীবনের অনেকগুলো পাতা দ্রুত সরে গেল। মা মারা গেলেন। তার কিছুদিনের মধ্যে বাবাও। ধীরে ধীরে জীবনের অনেকগুলো বছর কেটে গেল। প্রাপ্তির ভাঁড়ারে খেদ ছিল, মনে হচ্ছিল আমার জীবনের অনেক স্বপ্ন অধরাই থেকে গেল। মনের শূন্যতায় আবার লেখাগুলো আমার কাছে ফিরে এল। প্রথম গল্প স্মার্ট ফোন ছাপা হল নিজস্ব পত্রিকায় ২০১৫ সালের মার্চ মাসে। ক্লাস ইলেভেনের পর আবার লিখলাম গল্প। গল্পটি পড়ে অনেকেই তাদের ভালো লাগা জানিয়েছেন। উৎসাহ পেলাম। শুরু হল পথ চলা। বাংলা সাহিত্যের বিপুল সাগরে আমার ছোট্ট তরীখানা ভাসিয়েছি। পথ চলার এখনও অনেক বাকি।  

নন্দিতা মিশ্র চক্রবর্তী: কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন