শারদ আহ্বান



বিবিধ



দ্বিধাবিভক্ত শাপলাঝিল,জড়িয়ে আসছে শরৎ। কড়িবর্গার দেহ,উলুধ্বনি দাও কার বরণের শ্রী রেখে পদ্মহাতে? ও ধারাস্নানের স্থিতধী শ্যামল মন, বল্গাহারা কাশের দোলায় ওই চলে যায় কস্তাপাড়। আহ্বানের মাত্রায় বুঝি লাগে ক্রমান্বয়ে যজ্ঞের সমিধ। এসো কৃষ্ণবর্ণ তেজ, বর্ষামঙ্গল শেষে। ধানের সার আলতো সরিয়ে আলতানূপুর দুপুর নেচে যায় ফিঙের পালক ধরে। ময়ূর দেখনি কেউ? সবজেটে নীল,গাঢ় নীল, কালচে ছিট,চিরকুমারের সাথে;চেয়ে নেবার থাকে উদ্দাম কৌমার্য। লাল ধুলোর আস্তরণে চাপা মোহরঝাঁপি তুলে সম্পত্তির ঘনত্ব বুঝে নেওয়া যায় যদি,এমনভাবে পিঁজে গেছে কেন তাদের কলমিলতা বসন? আলগোছ মরীচিকা,সেখান দিয়েই ত্রস্ত পায়ে আকাশী মেয়ের আনাগোনা। আলাদা ভাবে তার নাম করে না কেউ। আড়াল করা থাকে তার ঋতুমতী চাদর,পঞ্চপ্রদীপের নিচে। বেহাল তারারা খসে যেতে যেতে দিয়ে যায় আলোকবর্ষীয় দূরত্বের নীহারিকাপুঞ্জ। এমন সময় সৃষ্টি হোক নীলপদ্মের সরোবর। মায়ামন অলকরাশি আলুলায়িত ঘুরে ফেরে কন্যাকুমারিকা। ডাক দিয়ে উঠি, বেহায়ার বেয়াদব ঝর্ণা, এভাবে বয়ে যাওয়া নিষিদ্ধ। রূপোলী মেঘের সাথে নিষিদ্ধ সংকরে মিশে যাওয়া বন্য বালিকা হেসে ওঠে, বলে ফিসফিস, আমি শিউলিধারা।

ও শিউলিধারা, তোর বুকের মাঝে ও কিসের ছলাতছল?
আমার বুক দেখছ অসভ্য চোখ?
শিউলিধারা, তোর বুকের ভেতর ওই চলেছে রাজবজরা, কোথায় পেলি?
রাজবজরা বুঝলে কেমন করে? সে তো রানির বজরা।
তাহলে বল তোর বুকের মাঝে কিসের ঢেউ?
পুরুষগন্ধের ঢেউ, একটু একটু বিকিয়ে যাবার ঢেউ,দেখো তুলকালাম! আমি নষ্ট ভ্রষ্ট রাস্তাখাগি।

কোঁচড় নেই। ওড়না হরির লুট। গুপ্তকক্ষে বেঁধে রাখা লালচে চাঁদ,অমৃতসফেদ হাঁসের ডানায় লুকিয়ে রাখি অনন্ত পাঁকের কথা। কুটিকুটি করে আমার যে শক্তি ছিঁড়ে দেওয়া ছিল ন্যায়,সেই সকল জড়ো করে রেখেছি মূষিকের তৎপরতায়। ভরসাহীন আশ্রয়হীন মড়কের কালে,নারীখাদক বারংবার আঘাত করেছে,ঢাল হয়েছি বহু নাভিচক্র, যোনিশঙ্খ,পদ্মগন্ধ বুকের। দুই ভ্রুয়ের ধনুকের জ্যা টেনে পরিয়েছি দৃষ্টিশর। এগিয়ে এসেছ পুরুষসিংহ,চন্দ্রঘণ্টার আদেশ মান্য করেছো,বলেছি বলীয়ান হও, তুমিও আমার সন্তান। যে চুল টেনে ধরেছিলে আক্রোশে অসুরদল,মৃত্যু পেয়েছ তাদের বিষচুম্বনে। আমি পরশু, আমি খড়গ, আমি বজ্র, আমিই ত্রিশূল... বারে বারে ফিরি কৃত্তিবাস প্রিয়ার বরে। অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাই, যুগান্তরের অন্ধকার ঠেলে সাঁতরে পার হই নষ্টজন্মের কাল, কোলে তুলে নেয় অকালবোধনের ঈশ্বরী।

আবার চুরমার করে ফেলি তোমার ব্রহ্মচর্য, নয়নতারার বেড়া ভেঙে ঢুকে পড়ে অনিদ্রার সুখ। বিনিদ্র যাপন, নকশিকাঁথার বুলবুলি, ঊষালগ্নে নেমে যেও গলা জলে, পিতৃপুরুষের তৃষ্ণার্ত ঠোঁট ভিজিয়ে দেবার ফাঁকে অন্তত তাকিয়ে ভেবো, ওই কোণায় স্তব্ধ তেষ্টার দলের নাম মাতৃনারী রাখা যায় কিনা। বরং ফিরে এসো, আঁজলা ভরে ওদের দিয়ে আসি দুই বিন্দু তৃপ্তি। জমিয়ে রাঁধি, সাজিয়ে রাখি বরণডালা। কোলহারানো শিশুদের সুখা গলায় পড়ুক অমৃতধারা,ধোঁয়াটে শহরপ্রান্তে দুলে ওঠা কাশের সাগরের তরঙ্গে মাতামাতি করে দেখি আদরের অমরাবতী।

ষোড়শী হয়ে যাই, হয়ে যাই প্রস্তর যুগীয় নৃপনন্দিনী। নগ্ন দেহে উঠে আসে বল্কল। আগুন জ্বালাই ক্রমাগত। নগরোপান্ত জ্বলে উঠলে প্রাসাদের দেওয়ালে ফুটে ওঠে দেবী। নদী পর্বত অনাবৃত করে মৃদু স্বরে বলে ওঠে রাজকন্যে, “রূপং দেহি”; মৃদু হাসেন দেবী, “তথাস্তু!অন্ধকারের প্রাণী রূপ চেটে যায়, জ্বলে ওঠে পবিত্র শিখা। শান্ত কণ্ঠে রাজদুহিতা উচ্চারণ করে, “জয়ং দেহি!প্রশান্ত উচ্চারণের শীতলতায় কেঁপে ওঠেন উগ্রচণ্ডা, “তথাস্তু!ভয়ঙ্কর মুখব্যাদান করে অন্ধকার গিলে খেতে থাকি। একে একে সত্য, দ্বাপর, ত্রেতা চলে গেলে নেমে আসি জিন্স-টপ কালে। কলির কোলে সাময়িক গচ্ছিত রাখি শত নাগসম এলোচুল।

চিঠির পাট উঠে গেলে মৃতবৎসার মতো পড়ে থাকে শুভ বিজয়ার ঢল। প্রতি বছরের ইলিশের হাহাকারের মাঝেও উমার সধবার পাত। ও উমা, ওই ওরা বিধবা, ওদের আলাদা পাত। উমা,তুমি সিঁদুরে গরবিনী, ওদের বুঝি লাল অপছন্দ? ও উমা, তোমার ভরা সংসার, বিজয়ার প্রণামেও দেখো ভাঙা টুটাফুটা হেঁশেলের ছবি। এ এক আনন্দযজ্ঞ পার্বতী, কত পোশাক,কত স্বাদের আহ্লাদ... ওদিকে শুকনো বুকের বোঁটা চুষতে থাকা বোঝা কোলে পৃথিবীর আবর্জনা। এসব ভাবে না রাজকন্যে, তুমি আশ্বিন মাসে শুক্লপক্ষে সেজে ওঠো ফলবতী বৃক্ষ।

অগোছালো অলকানন্দা, তোমাতে এক ডুব দিয়ে আসি হরিতকী হই। পতিতপাবনী গঙ্গা,তোমাতে ডুব দিয়ে হই চন্দনকাঠ। পিষে বার হোক নির্যাস। বন্য কৃষ্ণসার হরিণের পথে ফেলে রাখা থাকে ডুবসাঁতারের লজ্জা। ঘাসে ঘাসে মাখানো থাকে সে লজ্জার রক্তিম আভা। মিশে যায় গোধূলিতে চরাচর জুড়ে। লক্ষ্মী প্যাঁচার দর্শনতত্ত্ব বিচার করে বদ্ধ কামরার পেয়াদা। সে কখন উড়ে যায় রাতের মায়ায়,ছক কেটে বলে যায় ক্লান্ত সারস। বৃহৎ সভার মাঝে চাক্ষুষ করি মানস সরোবর। পদ্মপাতায় মুড়ে রাখা থাকে সুরভিত স্নেহ।

আবার এসো মা। ও ত্রিপুরসুন্দরী,শুনলে? আবার এসো কিন্তু। চুপি চুপি তোমাকে কত কথা বলি,কিন্তু দোষ দিই না কোনও। ওই যে জোছনা মাখা মহীপাল ওরাওঁয়ের গ্রাম,তার পদ্মদীঘিতে মহীপাল লিখে রাখে ষোড়শীর নাম। ষোড়শী তুলসিতলায় সন্ধ্যা বাতি জ্বালে। রাজপথে গজিয়ে ওঠে বিকিকিনির রণাঙ্গন।

বিকিয়ে যায় মৃণালিনী,অয়ন্তিকা,শ্রমণা। বিকিয়েযায় কুন্তল,সন্দীপন,ঋতুরাজ। দেদার বিকোয় সস্তার জামা,ছাতা,হরেক মাল। এগিয়ে যেতে যেতে বিভ্রান্ত শিকারি,আওয়াজ দেবে গো,চাঁদমালা? আওয়াজ দেবে ডাকের সাজ? বড়ো পিসির রঙ্গন গাছ হাসে,সাবেকি আলপনায় বসে মঙ্গলঘট। আউলাবাউলা বাতাস, তোমার ছোঁয়ায় সাবেকি একটু হিম আর নেই। ঢাকের ওপর নেচে ওঠে পালকের গৌরব। সাবেকি কাঁসা,বনেদী রূপো,ভোগের বাহার। ষোড়শী খোঁজে নীলকণ্ঠের পালক। আবার এসো ভুবনেশ্বরী।     

পৃথা রায় চৌধুরী: কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন