অন্তরালে



গল্প

এক

আজ ঝিলম স্কুল থেকে ফিরল কেমন মনমরা হয়ে। মা বলল,‘কী হয়েছে রে? মনখারাপ? বন্ধুরা কিছু বলেছে?’ঝিলম মাথা নাড়ল খুব শান্তভাবে। তারপর স্কুলের জামাকাপড় খুলে খাবার টেবিলে বসে চুপচাপ খেয়ে যেতে লাগল। তমসা একটু অবাকই হল মেয়েকে দেখে। অন্য দিন কত গল্প করে জানো মাম্মা,আজ ম্যাম এই বলেছেন,কোনওদিন বলে ‘শ্রেয়সী আজ এই বলল।মা তো ভীষণ রেগে বলে এবারে একটু থামবে,জামাকাপড় খোলা নেই,পায়ের মোজাটা অবধি খোলা নেই, সেই কখন স্কুল থেকে ফিরেছে,সারাদিন শুধু বকবক বকবক।কিন্তু আজ এমন কী হল? এরকম তো হওয়ার কথা নয়। এত চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে,হঠাৎ হলটা কী? তমসা কোনও কথা বলল না। ভাবল,থাক একটা দিন ওর মতো। মনখারাপ হলে একার মতো একা ছেড়ে দেওয়া উচিত,নিজের সঙ্গে নিজেকে। মন ভাল হলে ঠিক বলবে সব কথা। সেদিন তাই চুপচাপই কাটল। কিন্তু পরের দিন স্কুল থেকে ফিরে মুখটা খুবই করুণ করে বলল,‘জানো মাম্মা,রাজন্যার স্টেপমাদার আসবে।

চমকে উঠল তমসা, ‘মানে! ওর মা নেই?’
ছিল, কিন্তু এখন নেই।
আহা রে! কী হয়েছিল রে? কবে মারা গেলেন?’
ধেৎ, কী যে বলো! মারা যাবে কেন?’
তা হলে?’
ওর মা চলে গেছে।
কোথায়?’
মনে হয় ওর দিদার বাড়ি। জানো মা, ওর মা খুব খারাপ।
কে বলেছে?’
ওর বাবা ওকে বলেছে।
ছিঃ, এইভাবে বলতে আছে?’
আমি কী জানি? ও নিজেই তো বলল,আমার বাবা খুব ভাল,মা ভাল নয়।
এভাবে বলবে না তো!
ঝিলম ভাবে,আমি আর কী বললাম। রাজন্যা যা বলেছে তাই তো বলেছি। তমসাও ভাবতে থাকে, স্কুলে গিয়ে আরও কত কী যে শুনবে।

দুই

বেশ কিছুদিন পর স্কুল থেকে ফিরে এসে খেতে খেতে ঝিলম বলল,‘জানো মা,রাজন্যা আজ কী খুশি!
কেন?’
ওর স্টেপমাদার ওর জন্যে কী সুন্দর গিফট পাঠিয়েছে।
ও আচ্ছা।
এর মধ্যেই চলে আসবে ওর স্টেপমাদার।
ও আচ্ছা।
সঙ্গে স্টেপব্রাদারও আসবে।
স্টেপব্রাদার!
হ্যাঁ, ও কী খুশি মাম্মা! ভাইয়ের সঙ্গে খেলতে পারবে।
ভালই তো, ওর মায়ের খবর কী রে?’
কোন মা? আসল না নকল?’
এ বাবা এসব কী ভাষা! মা আবার আসল-নকল হয় নাকি?’
না। মানে, আগের মা, না এখনকার মা? মানে পুরনো মা,না নতুন মা?’
অ্যাই চুপ কর তো! খেয়ে বিশ্রাম করে পড়তে বসবি চল।
শোনো না মাম্মা, রাজন্যা সুন্দর করে মেহেন্দি পরবে বলেছে ওর বাবার বিয়েতে।
কী?’
হ্যাঁ, কীভাবে সাজবে, কী ড্রেস পরবে আজ সব বলছিল।
স্কুলে এইসব সাজের গল্প হয় বুঝি?’
সে তো রিসেস টাইমে।
অন্য কোনও গল্প নেই তোর, ঝিলম? আজ লাইব্রেরিতে গিয়েছিলিস?’
তমসা বিষয়টা অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার পরও,মনে মনে নিজে কিন্তু বেশ উতলা হয়ে পড়ল রাজন্যা নামক ওই ছোট্ট মেয়েটির জন্য। নিজের দেশ আর এই দেশের মানুষগুলো একটা প্রজন্মেই এমন পালটে যেতে পারে!

তিন

মাম্মা, চলে এসেছে ওর নতুন মা। কী ভাল জানো, খুব ভালবাসে ওকে।
আর ওর মায়ের খবর কী রে?’
আসল মা?’
কী আসল আর নকল বলছিস? মা তো মা-ই। কী খবর ওঁর জানিস কিছু?’এবার বেশ উত্তেজিত হয়েই কথাটা বলল তমসা।
সেই মায়ের কথা তো আর বলে না রাজন্যা। তবে অনেকদিন আগে বলেছিল, বাবা নাকি সেই মায়ের কথা উচ্চারণ করতে বারণ করেছে।
ও আচ্ছা।
জানো মাম্মা, ওর নতুন মা ওকে বিউটি পার্লারে নিয়ে গিয়েছিল। কী সুন্দর লাগছে ওকে দেখতে।
ভালই তো। সবাই ভাল আছে শুনলে মনটাও ভাল লাগে।
ওর স্টেপব্রাদারও খুব ভাল। একসঙ্গে খেলে। ওর নতুন মা ওকে খুব ভালবাসে।
কী যে নতুন মা-পুরনো মা, নকল মা-আসল মা শুরু করলি। পড়াশোনা কখন করবি?’
এই যে এবারে পড়ব।

চার

ঝিলম এখন খুব ব্যস্ত পড়াশোনা নিয়ে। বেশ কিছুটা সময় কীভাবে যে কেটে গেছে। তমসাও নিজের সংসারধর্ম পালনে ব্যস্ত। এরই মধ্যে ঝিলম একদিন স্কুল থেকে ফিরে জানাল যে,আজ সারাদিন রাজন্যা স্কুলে কেঁদেছে। কারও সঙ্গেই তেমন কথা বলছিল না। তমসার হৃদয়ের অন্তরালে ভেসে উঠল রাজন্যা নামের ওই ছোট্ট মেয়েটির মুখ। বড় অসহায় লাগছিল কেন কি জানি। সব কিছু জেনেও কেমন যেন হাত-পা বাঁধা। মেয়েটিকে দেখার জন্যে মনটা কেমন ব্যাকুল হয়ে উঠল। তাই হঠাৎ বেশ আবেগের সঙ্গে বলে উঠল,‘একদিন ওকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে এলে হয় না? ওকে আমি খুব আদর করতাম।

ওর বাবা ওকে আসতে দিলে তো! আসতে দেবেই না,অ্যায়াম শিওর।
ওর মন খারাপ কেন? কেন রাজন্যা আজ স্কুলে কেঁদেছে?’
রাজন্যার বাবা ওর নতুন মা আর ওই স্টেপ ব্রাদারের সঙ্গে এক ঘরে ঘুমোয়, যেখানে ওর মা আর ও ঘুমোত, সঙ্গে বাবাও থাকত। শেষের দিকে অবশ্য এ ঘরে ও আর ওর মা ঘুমোত। বাবা পাশের ঘরে ঘুমোত।

তমসার হৃদয়ের অন্তস্তলে কে যেন ভীষণভাবে ধাক্কা দিল। ঝিলম বলে যাচ্ছে একের পর এক কাহিনীমাঝরাতে বাবা-মায়ের কী বীভৎস ঝগড়া, কোনওদিন মারপিট। তারপর থেকে বাবা পাশের ঘরে শুতে লাগল নিয়ম করে। বাবা-মায়ের মধ্যে কথা হত না নিয়ম করে। শেষের দিকে রাজন্যাই মাধ্যম হল। এর পর কী যে হল,মা চলে গেল বাড়ি ছেড়ে। মাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। শেষে মাকে পাওয়া গেলেও,বাবা-মায়ের পক্ষে আর নাকি একসঙ্গে থাকা সম্ভব নয়। বাবা অনেক মিথ্যে গল্প সাজিয়ে দিল রাজন্যার কাছে। বোঝানো হল,মা কতটা খারাপ। পরে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বাবার শেখানো কথাগুলো বলে গেল একনাগাড়ে। শেষে বাবার কাছেই থাকবে রাজন্যা এই সিদ্ধান্তের কথা বিচারক জানিয়ে দিলেন।

জানো মাম্মা, পাশের ঘরে ও একা ঘুমোয়। ওর আসল মার জন্যে কাঁদে। ওর বাবার সামনে কাঁদলে তো ওর বাবা ওকে মারবে। ওর মা কী ভাল ছিল!
মা কি কখনও খারাপ হয় সোনা?’
ওর বাবা-ই তো ওকে প্রতিদিন বলে ওর মা খুব খারাপ।
রাজন্যা ওর মায়ের সঙ্গে থাকে না কেন?’
তা তো বলেনি।
তমসা ভাবল,রাজন্যার যা বয়স তাতে ওর মায়ের কাছেই থাকা উচিত। তবে কি ওর মা-ই ওকে কাছে রাখল না,এ-ও সম্ভব?
জানো মাম্মা, ও খুব রোগা। টিফিনে শুধু বিস্কুট আনে। লুচি, পরোটা খেতে খুব ভালবাসে।
ঠিক আছে আমি ওকে রোজ লুচি, পরোটা বানিয়ে দেব, তুমি ওকে দেবে।
ওকে মাম্মা।

পাঁচ

প্রতিদিনের কাজের মধ্যে কেমন যেন একটা মুখ এসে ধরা পড়ে তমসার হৃদয়ের অন্তরালে। ঝিলমের মতো ওকেও যদি ভালবাসা যেত,নিজের করে পাওয়া যেত। এই বয়সে মাকে খুবই প্রয়োজন মেয়েদের। যেমন,একটা বয়সের পর ছেলেদের আদর্শ হয় বাবা। বাবাকেই তারা অনুকরণ করে প্রতিটি মুহূর্তে। ঠিক তখনই তমসার মনে পড়ল ইমনের মুখটা। সামান্য একটা বিষয় নিয়ে শুভ্রদা আর অঙ্গনাদির বিচ্ছেদ। ইমনকে নিয়ে অঙ্গনাদি চলে গিয়েছিল ওর বাপের বাড়ি। নিজে স্কুলে চাকরি করত,সেই কারণে একটু বেশিই অহঙ্কারী ছিল অঙ্গনাদি। শুভ্রদা অনেক বুঝিয়েছিল,অন্তত ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে একসঙ্গে থাকার কথা বারবার বুঝিয়ে,শেষে ব্যর্থ হয়ে ডিভোর্স পেপারে সাইন করেছিল। কিন্তু অদ্ভুত এক পাষাণ হৃদয় অঙ্গনাদি বিচারকের শেষ আর্জি বা আইনের কোনও নিয়মই মানেনি। ছোট্ট ইমনকে কোনওদিনই দেখা করতে দেওয়া হয়নি শুভ্ৰদার সঙ্গে। বাবার সম্পর্কে এমন সব তথ্য সাজিয়েছিল অঙ্গনাদি ছোট্ট একটি শিশুহৃদয়ে,যে বাবার নাম শুনলেই ইমন আঁতকে উঠত।

তমসারা অনেক চেষ্টা করেছিল। অঙ্গনাদিকে বুঝিয়েও ছিল বাবা-ছেলের সম্পর্কটা যেন নষ্ট না করে। তাদের ব্যক্তিগত জীবনে নিজেদের সিদ্ধান্তের দায় তারা নিজেরা নিলেও,ছোট্ট শিশুর মধ্যে যেন তার দাগ না পড়ে। কিন্তু কোনও কাজ হয়নি,উলটে যারাই বোঝাতে গিয়েছিলতাদেরই চূড়ান্ত অপমান করেছিল অঙ্গনাদি। আজ সেই ইমন সতেরো বছরে পা রাখতে রাখতেই নানারকম নেশায় আসক্ত। বাবাকে না পাওয়ার যন্ত্রণা ও একা ভোগ করেছে। মায়ের কড়া শাসনকে উপেক্ষা করে ইমনের পক্ষে সম্ভব হয়নি বাবার ডাকে সাড়া দেওয়া। উলটে বাস স্ট্যান্ডে বাবাকে দেখলে ভয়ে দৌড়ে পালিয়েছে মায়ের কাছে। তারপর থেকে শুভ্রদা আর কোনওদিন ছেলেকে দেখতে যায়নি। নিজের কষ্ট নিজেই বয়ে বেড়িয়েছে। অন্য দিকে ছোট্ট ইমন ধীরে ধীরে বড় হয়েছে মিথ্যে কিছু তথ্যের ভিত্তিতে। এরপর মিশে গেছে হৃদয়হীন পরিবেশে নিজেকে মুক্ত করতে, তবুও অঙ্গনাদি নিজের জেদে অচল। আসলে ইমন, রাজন্যা,ওরা বড় একা। একা-একাই বড় হয়,একাকিত্বই ওদের একমাত্র সঙ্গী।

ছয়

প্রত্যেক দিনের টুকরো টুকরো ঘটনাগুলো যেন ঝিলমের মধ্যে দিয়ে তমসার হৃদয়ের প্রাঙ্গণে এসে ধরা পড়ে। সেই হৃদয়বিদারক ঘটনাগুলিই যেন রাজন্যাকে ধীরে ধীরে তমসার খুব কাছে পৌঁছে দেয় প্রতিনিয়ত। আর অন্যান্য দিনের মতো সেদিনও এসে ঝিলম জানাল রাজন্যার গল্পের কথা।

মা, ম্যাম ওর সঙ্গে মিশতে বারণ করেছেন।
কেন?’
ও নাকি আজকাল খুব খারাপ হয়ে গেছে।
যাঃ, এসব বলতে নেই।
ম্যাম বলেছেন।
এ কেমন ম্যাম! তুমি কথা বলবে। কক্ষনও ওর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবে না,’মনে মনে গজরাতে লাগল তমসা। এঁরা কী করে শিক্ষকতা করেন কে জানে! শিক্ষক হওয়ার কোনও যোগ্যতাই নেই।

ছোট্ট রাজন্যও তো এখন ধীরে ধীরে বয়সের সন্ধিক্ষণে। এই সময় তো মেয়েদের শারীরিক,মানসিক, সব কিছু পরিবর্তনের পথে। কারও একটু আগে,কারও একটু পরে। ঝিলম সেদিন স্নানঘরে গিয়ে চিৎকার করে মাম্মাবলতেই তমসার বুকটা কেঁপে উঠেছিল,তবে কী... যা ভাবা তাই, ঝিলম দাঁড়িয়ে আছে স্নানঘরে,আর সারা মুখে একরাশ বিস্ময়। কিচ্ছু হবে না সোনা,’ বলে তমসা মেয়েকে জড়িয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিল,যতটা সহজভাবে,সুন্দরভাবে মা হিসেবে বোঝানো যায় ঠিক সেভাবেই। সবে চার-পাঁচ মাস হল ব্যাপারটার সঙ্গে পরিচিত ঝিলম। তমসা কখনও এটা করতে নেই,ওটা করতে নেইএসব পুরনো মানসিকতায় না থেকে বন্ধুর মতো যতটা সহজভাবে বোঝানো যায়,তাই বুঝিয়েছিল। একটা ক্লাস সিক্সে পড়া মেয়েকে এর চেয়ে কী-ই বা বেশি বলা যায়! ঝিলম আর তমসা সেদিন থেকে যেন আরও অনেক কাছাকাছি হল অন্তরের দিক থেকে। মেয়ের হঠাৎ করে বড় হওয়াকে তমসা অবাক চোখে দেখতে লাগল। একটু কি তাড়াতাড়িই বড় হয়ে গেল ঝিলম! সেদিনের ছোট্ট ঝিলম এখনও তো মানসিকভাবে একেবারে শিশু! কিন্তু রাজন্যা? ওকে ভালবেসে,আদর করে ওর এই নতুন মা বুঝিয়ে দেবেন তো! ইস,একটু বেশিই ভাবছে তমসা- নিজেকে নিজেই শাসন করল। কিন্তু মন তা শুনলে তো!

সাত

মা, আজ রাজন্যা বলছিল, “আমার পাশে তুই বসবি। তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।”’
ঠিকই তো, ওকে ভালবেসো।
ও বলছিল কেউ নাকি ওর সঙ্গে কথা বলে না, আমি ছাড়া।
তুমি বলবে, ম্যাম বারণ করলেও বলবে। ওর কত কষ্ট বলো তো?’
আমি বুঝি, মাম্মা। আমারও মাঝে মাঝে ওর জন্যে খুব মনখারাপ করে।

আট

মাম্মা, রাজন্যা আজ কী সুন্দর সোয়াবিন এনেছিল!
বাঃ।
সোয়াবিন আর ব্রেড।
খুব ভাল। এই তো নতুন মা করে দিয়েছেন।
ঝিলম হাসতে হাসতে বলল,‘মাম্মা, তুমিও নতুন মা,পুরনো মা বলো।
ঝিলমের কথা শুনে তমসা বলল,‘কী আর করব বলো। তোমার কথা শুনতে শুনতে কানটা শিখে নিয়েছে। যাই বলো,কাউকে খারাপ বলতে নেই,সবাইকে ভালবাসতে হয়।
ও তো নিজে বানিয়েছে।
ও রান্না করে নাকি?’
হ্যাঁ মাম্মা, ওর রান্না ও নিজে করে।
কী!
হ্যাঁ, নতুন মা ওকে দিয়েই তরকারি কাটায়। ওর আঙুল একদিন কেটে গিয়েছিল, আমি দেখেছি তো। ও তো ঘরের কাজ করে, পড়ার সময়ই পায় না। তাই তো রেজাল্ট এত খারাপ করেছে। সেই জন্যে প্রিন্সিপাল পেরেন্টস কল করেছিল একদিন। সেইদিন বাড়িতে গিয়ে ওর বাবা কী মারটাই না মেরেছিল।
আমি আর পারছি না শুনতে।
জানো মাম্মা, একদিন ও কাঁদতে কাঁদতে আমায় বলেছিল, আমার বাবা আমার সঙ্গে যা ব্যবহার করে, তোর বাবা তা কোনওদিন করেনি, আমি জানি।
কী হয়েছে? কী করেছে ওর বাবা?’চমকে ওঠে তমসা।
রাজন্যার বাবা একদিন রেগে গিয়ে ওকে ঘরে ডেকে মেঝেতে থুতু ফেলতে বলে।
কী!
হ্যাঁ মাম্মা, তারপর সেই থুতু ওকে চাটতে বলে।
কী! তমসা আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে।
তাই দেখে ঝিলম বলে,‘এই শেষ,আর তোমায় কিছু বলব না।

নয়

সিকিম বেড়াতে গিয়েছিল তমসারা। এই তিনদিন হল বাড়ি ফিরেছে। ছুটির আমেজ কাটিয়ে ঝিলম আজ স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি। তমসা বারবার বলেছে ঝিলমকে অত বড় চকোলেট স্কুলে না নিয়ে যেতে। আসলে সিকিম থেকে অত সুন্দর একটা চকোলেট এনেছে ঝিলম,সেটা স্কুলে নিয়ে যাওয়ার খুব শখ। মায়ের বারণ উপেক্ষা করে ঝিলম সেই চকোলেট স্কুলে নিয়ে যাবেই। স্কুল থেকে ফিরে ঝিলম চেঁচাতে শুরু করে। তমসা চমকে উঠল মেয়ের এমন রূপ দেখে।

সর্বনাশ হয়ে গেছে আজ, মাম্মা।
কী হয়েছে?’
রাজন্য একটা চোর!
মানে!
আমার ব্যাগ থেকে ওই অত বড় চকোলেট পুরো গায়েব। মেঘনাও কম নয়। সবার ব্যাগ সার্চ করতে শুরু করল। তারপর সেটা উদ্ধার করল। রাজন্যার ব্যাগ থেকে।
এ মা! তা তুই পরে ওকে দিয়েছিস তো?’
কী দেব!
চকোলেট।
তুমি কী মাম্মা! ও একটা চোর,ওকে আবার দেব চকোলেট?’
ছিঃ ঝিলম, তোমার থেকে তো এটা আশা করিনি।
কী?’
এভাবে চোর বলবে না, ও তোমার বন্ধু।
চোরকে চোর বলব না?’
না, বলবে না।
তা হলে কী বলব?’
বলবে যে, আমার কনসেন্ট ছাড়া আমার চকোলেট নিয়েছে বা আমার ব্যাগে হাত দিয়েছে।
সারা স্কুল জেনে গেছে ও একটা চোর। আর ওর সঙ্গে কথাই বলব না। জানো, ও কত খারাপ ভাষা ইউজ করে? কত খারাপ আলোচনা করে।
কেন বোঝে না সোনা ওর কত কষ্ট। মা থেকেও নেই। বাবা থেকেও নেই। ওর নিজের কোনও ভাই, বোন নেই। ওর কথা শেয়ার করার কেউ নেই।
সে যাই হোক। তা বলে ও চুরি করবে?’
ওর কোথাও হয়তো একটা কষ্ট আছে সোনা। যার জন্যেই ও এত ক্ষিপ্ত। এই যে না বলে এর ওর ব্যাগ ধরছে, এটাও এক ধরনের রোগ। আর ওর যন্ত্রণার কারণ আমি বা তুমি কিছুটা হলেও বুঝতে পারছি। রাজন্যার ভেতরে একটা বিরাট শূন্যতা আছে ঝিলম।
তা, আমি কী করব?’
তুমি ওর সঙ্গে ভাল ব্যবহার করবে। ওকে ভালবাসবে। ওর একজন ভাল বন্ধু দরকার ঝিলম। আর তুমি চেষ্টা করলেই সেটা করতে পারো।
ঠিক আছে, মাম্মা।

দশ

বেশ কিছুটা সময় কেটে গেছে। পড়াশোনা,ইউনিট টেস্ট,গান-বাজনা ইত্যাদির মধ্যে ঝিলম আর তমসার দিনগুলো কেমনভাবে যেন জড়িয়ে গেছে। তারই মধ্যে ঝিলমের ছোটপিসি,ছেলে যুবরাজ বেশ কিছুদিন হইহই করে কাটিয়ে গেল। বাড়িতে যেন উৎসবের হাট। রাজন্যাও যেন ওদের আলোচনা থেকে অনেক দূরে। একদিন শুধু ঝিলম বলেছিল রাজন্য স্কুলে আসছে না। আসলে পিসির ছেলে যুবরাজকে নিয়ে সে তখন এত ব্যস্ত যে,স্কুলে প্রেজেন্ট থাকলেও স্কুলের গল্পে স্পিকটি নট। যাই হোক, কিছুদিন পর আবার সেই জীবন। আবার সেই ছন্দে ফেরা। যুবরাজও মায়ের সঙ্গে আবার তার নিজের জায়গায়,নিজের বাড়িতে।

রোজকার মতো সেদিনও ঝিলম স্কুলে গেল,কিন্তু বাড়িতে এসে আবার সেই প্রথম দিনের মতো চুপচাপ। তমসা আবার সেই ছন্দেই মেয়েকে ছেড়ে দিল ওর মতো করে,সময়ের হাতে। সময় মানুষকে অনেক কিছু দেয়। ঝিলমও ওর নিজস্ব ছন্দে মাকে হঠাৎ বলে উঠল,‘জানো মাম্মা,সবাই বলছে রাজন্যা মেন্টাল...
ধেৎ, কী যে বলিস!
সত্যি বলছি মা। ম্যামরা আলোচনা করছিলেন। ও কেমনভাবে যেন আজকাল কথা বলে। অস্বাভাবিক আচরণ করে। মাঝে মাঝে ভীষণ রেগে যায়। তখন চোখ-মুখ কেমন করে,হাত-পা ছোড়ে,হাতের কাছে যা পায় তাই ছুড়ে মারে। একা একাই হাসে,একা একাই মাঝে মাঝে কাঁদে। পড়া মনে রাখতে পারে না। ও বলছিল মায়ের জন্যে ওর খুব কষ্ট হয়,ও বলছিল ওর কেউ নেই, ও বলছিল এই পৃথিবীতে ও খুব একা,ও বলছিল ওর খুব ভয় করে, ও বলছিল.........

মণিজিঞ্জির সান্যাল:কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন