চল্লিশ পেরোলেই চালশে




প্রতিবেদন


"আজকে যে খুব জলজ্যান্ত-অ্যালবামে ঠাঁই পাবে কাল সে.......বাক্যহীনের চোখে চশমা----চল্লিশ পেরোলেই চালশে"॥

সুমনের এই গান টা শুনলে এক বিষণ্ণতা গ্রাস করে দেখতে দেখতে পেরিয়ে এলাম চল্লিশটা বসন্তপুরোনো বন্ধুদের দেখি আর ওদের আয়নায় নিজেকে দেখিআমাদের সবারই পাক ধরেছে চুলেযারা আমাদের থেকে আরেকটু বড় অর্থাৎ মিড ফর্টি তাদের চুল দাড়ি সবকিছুই সাদা হয়েছেএদের দেখি আর এক অব্যক্ত কষ্ট গলার কাছে দলা পাকিয়ে ওঠেকী অপরিসীম এদের জীবন যন্ত্রনা আসুন-আমরা - যারা চল্লিশে পা দিয়েছি কিংবা চল্লিশের বিপদসঙ্কুল পথ ধরে যে পুরুষেরা পঞ্চাশের আরো দুর্গম পথের দিকে যাত্রা করছেন তাদের সামাজিক, পারিবারিক ও অর্থনৈতিক অবস্থাটা একটু জানা যাক

খুব অপ্রিয় হলেও একথা সত্যি যে আজকের অসংখ্য মহিলা চাকুরিরতা অথবা ব্যাবসায়ী হলেও সংসারের ব্রেড আর্নিং এর দায়িত্ব কিন্তু মূলত পুরুষটিরইসংসার ও সন্তান প্রতিপালনের জন্য একটি মেয়ে দুম করে চাকরি ছেড়ে দিতে পারে কিন্তু পুরুষটি পারেনাএটাই ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতিএখন এই মাঝবয়সী পুরুষটির কর্মক্ষেত্র টি কেমন? মনে রাখতে হবে চল্লিশ পেরোনো পুরুষটি কিন্তু পঁচিশের তরুণটির মত যখন তখন তার কর্মস্থল পরিবর্তন করতে পারছেননাএইসময় তার কাজের জায়গায় একটা স্থিতি এসেছে, একটা শিকড় গজিয়েছেসেইসঙ্গে এসেছে বেশ কিছুটা একঘেয়েমিযারা দমাদ্দম প্রোমোশন পেয়ে অনেক উঁচু তে উঠে গেছেন তাদের কে শিকারি নেকড়ে বাঘের মত তাড়া করে বেড়াচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত স্ট্রেসনিজের চাকরিকে টিঁকিয়ে রাখার প্রাণান্তকর মহাসংগ্রামউপরমহলের অমানুষিক চাপ তো আছেই সেইসঙ্গে আছে সাবর্ডিনেট দের চূড়ান্ত অসহযোগিতালোকটি কী অসহায় ভাবুনতার আশেপাশের মানুষ রা কেউই 'আসলে' তাকে পছন্দ করেনাএই নিঃসীম কষ্টের মাঝে মানুষটি নিদারুন একাকীত্বে ভুগতে থাকে

আবার অন্যদিকে যারা হয়তো চাকরি তে প্রোমোশন পেলোনা-তারা ভুগতে থাকে আইডেন্টিটি ক্রাইসিসেএ এক ভয়ংকর মানসিক রোগ যা একটি মানুষ কে কুরে কুরে খেতে থাকেঘন কালো এক হতাশার অন্ধকারে সে ডুবে যেতে থাকে ক্রমশমুশকিল হোলো এই দুই শ্রেনীর পুরুষ ই মনের গভীর দুঃখের ও অসহায়তার কথা সর্বসমক্ষে প্রকাশ করতে পারেননাতারা মনে করেন সেটা ডিসক্রেডিটএ যেন অন্যের কাছে(এমনকি স্ত্রী র কাছেও) নিজেকেই ছোটো করা

সকাল আটটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত কর্মস্থলে নিজের সমস্ত এনার্জি টুকু নিংড়ে দিয়ে চল্লিশোর্ধ পুরুষটি বাড়ি ফিরলেনএইবার শুরু হোলো স্ত্রী র অনুযোগস্বামীটি যে নিতান্ত ফাঁকি মেরে সংসারে টিঁকে আছে এই অপ্রিয় সত্যিটি বারে বারে বলে পুরুষটির মন কে আরো রক্তাক্ত করে দেয় বেশিরভাগ স্ত্রী ৯০% পুরুষ তার পেশাগত হ্যাজার্ডস এর কথা স্ত্রীর কাছে মন খুলে বলতে পারেননা (বরঞ্চ যারা স্বনিযুক্তি ব্যাবসা করেন তারা যদি তাদের স্ত্রী দের ব্যাবসাতে ইনভলভড করেন সেক্ষেত্রে অজান্তেই তারা বন্ধু হয়ে যানসমস্যাগুলো শেয়ার করতে পারেন)

সন্তানকে সময় না দিতে পারার জন্য সন্তানও বাবার কাছে আড়ষ্ঠ হয়ে যায়মা ই হয়ে ওঠে তার বন্ধুবাবা, র সঙ্গে সন্তানের তৈরি হয় এক অনতিক্রম দূরত্বঅধিকাংশ মা ই ব্যাপারটাকে দুর্দান্ত এনজয় করেন এবং কোনো সময় তুমুল ঝগড়াঝাঁটির মুহূর্তে স্ত্রী তার স্বামীকে খুব নির্মম ভাবে তা মনে করিয়ে দেনসন্তানের থেকে দূরে সরে যাওয়া পুরুষটি ভুগতে থাকে চরম আত্মগ্লানি তে ও চূড়ান্ত অপরাধবোধেপুরুষটির মনের মধ্যে অতি ধীর গতিতে বাসা বাঁধতে থাকে অবসাদের মারণ রোগ

ঠিক এই সময়ই স্ট্রেস ও ডিপ্রেশনের হাত ধরে চল্লিশ পেরোনো পুরুষটির শরীরে বাসা বাঁধে ওবেসিটিযার পোষাকি নাম হল-ডিস প্রোপোরশনেট ফ্যাট ডিস্ট্রিবিউশন অফ দ্য বডিপেটের চারধারে ফ্যাট ডিপোসিশন হয়ে পেট টা ক্রমশ ফুলে যেতে থাকেআজকের অধিকাংশ চল্লিশোর্ধ পুরুষ ডায়াবিটিকবেয়াল্লিশ বছরেই জীবনে প্রথম মাইল্ড হার্ট অ্যাটাক অথবা মাইল্ড সেরিব্রাল অ্যাটাকের দুষ্টু মিষ্টি স্বাদ পেয়ে যাচ্ছেন বহু পুরুষট্রাইগ্লিসারাইড, হাইপ্রেশার, লিপিডপ্রোফাইল অথবা থাইরয়েড, ইউরিন ইনফেকশন, ইমপোটেন্সি কিংবা কোলেস্টেরল কাবু করে ফেলছে অসংখ্য পুরুষকে

এর প্রধান কারন হল পুরুষরা কিছুতেই তাদের স্ট্রেসকে কমাতে পারছেননাচারজন বিবাহিতা মহিলা যখন একসঙ্গে আড্ডা মারেন তখন তারা মনের সুখে স্বামীদের নিন্দা করে বেশ খানিকটা হাল্কা হয়ে যানস্বামীর সাথে তাদের প্রাত্যহিক কলহের কথা কী নির্দ্বিধায় মেয়েরা নিজেদের মধ্যে শেয়ার করেন!(এখনকার ৯০% শাশুড়িই অত্যন্ত সাপোর্টিভ বলে এবং বেশিরভাগ সংসার ই শাশুড়িহীন বলে শাশুড়ি নিন্দা টা এখন আর সেভাবে হয়না)অথচ চারজন বিবাহিত চল্লিশোর্ধ পুরুষের আড্ডার বিষয় অবধারিত ভাবেই অফিস পলিটিক্স(চারজন কলিগ যখন আড্ডা দিচ্ছেন)অথবা রাজ্য রাজনীতি অথবা স্পোর্টসবাড়িতে যতই লাঠালাঠি হোক না কেন পুরুষ রা আড়ালে তাদের স্ত্রী দের অকুন্ঠ প্রশংসা করেনপুরুষ দের এ এক অদ্ভুত সাইকোলজিএদিকে দশবছর একসাথে থাকবার পর ৯০% স্ত্রী ই কিন্তু স্বামীর খারাপ টাই দেখেনপুরুষটির মনের মধ্যে জমা হতে থাকে পুঞ্জিভূত অভিমান

এই চূড়ান্ত কষ্ট ও অসহায়তা থেকেই জন্ম নিচ্ছে মিড ফর্টি ক্রাইসিস বা বাংলায় বললে-পুরুষ বন্ধ্যাত্বমধ্যচল্লিশের পুরুষটি এবার এই যন্ত্রনা থেকে মুক্তির উপায় খুঁজছেনঅনেকেই আশ্রয় খুঁজছেন মদ অথবা সিগারেটে, হয়ে পড়ছেন নেশার দাসবহু পুরুষ জড়িয়ে পড়ছেন পরকীয়া সম্পর্কেএই সম্পর্ক কিন্তু প্যাশনেট শারীরিক সম্পর্ক নয়একটা আশ্রয় ও নিবিড় বন্ধুত্বের সম্পর্কযে সম্পর্ক তার হতাশ মনকে গরমকালের সন্ধ্যেবেলার শীতল বাতাসের মত আদর করবে, যে সম্পর্ক শীতের দুপুরের উথলে ওঠা রোদের মতই কবোষ্ণ হয়ে দূর করবে তার মনের শৈত্য

আমাকে পেশাগত কারণে ডাক্তারদের সঙ্গে এইধরনের অজস্র বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে হয়সাইকিয়াট্রিষ্ট রা বলছেন-দিন কে দিন তাদের চেম্বারে ভয়াবহ রকম ভাবে বেড়ে চলেছে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত চাকুরিরত চল্লিশোর্ধ পুরুষ দের ভিড় যা এক ভয়ঙ্কর অশুভ সংকেত ইদানীং সারা পৃথিবী জুড়ে তৈরি হয়েছে এক ভয়ংকর মানসিক রোগ, নাম মনডে ম্যানিয়াকরবিবার সন্ধ্যের পর থেকেই পুরুষ রা অস্থির হয়ে পড়ছেন, খারাপ ব্যবহার করছেন স্ত্রী,  সন্তানের সঙ্গেসোমবার দিন টা তাদের কাছে আতঙ্ক, র দিনএই সোমবার,  র দুশ্চিন্তা পুরুষ কে মানসিক ভাবে অসুস্থ করে তুলছে

এরই মাঝে পরকীয়া প্রেমের গোপনীয়তা স্ত্রী ও টিনএজার সন্তানের কাছে ফাঁস হয়ে গিয়ে ডিপ্রেশনের অতল গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছেন বহু মিডফর্টি পুরুষএক্ষেত্রে মিডফর্টি মহিলারাও বড্ড অসহায়তাঁদের অসহায়তা হয়ত পুরুষদের থেকেও বেশি

বিজ্ঞানীরা স্ট্রেস কমানোর বিভিন্ন নিদান দিয়েছেনতার একটি হল নেচারের সংস্পর্শে থাকাদুদিনের ছুটিতে হুট করে সমুদ্র অথবা পাহাড়ের কাছে যাওয়াস্বামী স্ত্রী র শারীরিক ঘনিষ্ঠতা অত্যন্ত স্ট্রেস রিলিভার এবং শারীরিক ঘনিষ্ঠতা মানেই কিন্তু ইন্টারকোর্স নয়পরস্পর কে শুধু ছুঁয়ে থাকাও অনেকখানি কাজ দেয়

বিজ্ঞানীরা বলছেন-ভোরে উঠুনএকসঙ্গে অনেকটা হাঁটুনএকসঙ্গে দুজনে মিলে ওয়ার্ক আউট করুনএকসঙ্গে জিমে যানওয়ার্কআউটে পরস্পরকে সাহায্য করুনআপনাদের শরীর থেকে নিসৃত হবে ডোপামিন ও এন্ডরফিন নামক দুটি ফিলগুড হরমোনযা ভয়ঙ্কর সেক্স ড্রাইভ ও স্ট্রেস রিলিভার সাইকোলজিষ্ট রা বলছেন-পরিবার বা কর্মক্ষেত্রের চাহিদা কে দায়িত্ব হিসাবে না দেখে প্রাপ্তি হিসেবে দেখুননিজের ডেলি রুটিন কে ফ্লেক্সিবেল করুনচিকিৎসকেরা মহিলাদের বারবার সতর্ক করছেন-ন্যাগিং নয় বরং সহানুভূতিশীল হোন স্বামীর প্রতি

সুমনের একটি গান দিয়ে শুরু করেছিলামশেষ করবো ঐ গানটি দিয়েইগানটির মাঝের একটি লাইন হল-"আজকে যে দলবেঁধে দীঘা যায়/নিরালা সফরে যাবে কাল সে....../সফর সঙ্গী শুধু চশমা/চল্লিশ পেরোলেই চালশে"বড় নির্মম সত্য এই লাইনগুলিসেই হুল্লোড়বাজ ছেলেটা চল্লিশের কোঠায় এসে মৃতপ্রায়, অসহায়, নতজানু হয়ে যায়নিরালা সফরে একান্ত আপন ঐ চশমাটিকে আশ্রয় করে তার সঙ্গীহীন একা বেঁচে থাকা

সুমন একেবারে শেষ লাইনে কিন্তু রিভল্ট করেছেনলিখছেন--"অথবা যে আজ নিঃশব্দ/ সশব্দে ফেটে যাবে কাল সে...../চোখ থেকে খুলে নিয়ে চশমা/মন থেকে মুছে দিয়ে চালশে/....কাল সে"

চল্লিশ পেরিয়ে যাওয়া অসহায় , প্রতিদিন একটু একটু করে মরে যেতে থাকা পুরুষ দের এবার বোধহয় সশব্দে ফেটে পড়ার সময় এসেছে॥

অয়ন দাস: কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন