কাজী নজরুল ইসলামের বিস্ময়কর সংগীত প্রতিভা




প্রতিবেদন


রাজদ্রোহমুলক কবিতা লেখার কারণে মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে জেলে গিয়ে ঊনচল্লিশ দিন অনশন ব্রত পালন করে কাজী নজরুল ইসলাম বাংলার ছেলেমেয়েদের নয়নের মণি হয়ে উঠেছিলেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এই নবীন কবিকে তাঁর 'বসন্ত' নাটক উৎসর্গ করেছিলেন। বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের বিস্ময়কর সংগীত প্রতিভার উল্লেখ করতে গেলে স্বীকার করতে হয় রবীন্দ্রনাথের পর তিনিই সুরস্রষ্টা হিসেবে আপামর বাঙালির হৃদয় জয় করে নিয়েছিলেন। রবীন্দ্রসংগীতের পর নজরুলগীতি ছন্দের লালিত্যে, সুরের বৈচিত্রে, ভাবের গভীরতায় এবং প্রবল প্রাণোচ্ছাসে পরিপূর্ণ এক অভিনব সংগীতধারা যা হৃদয়কে ছুঁয়ে যায় বারে বারে। সংগীতের প্রতিটি বিভাগে  নজরুল অসাধারণ সৃজন প্রতিভা এবং গভীর জ্ঞানের পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর গানগুলি কোন সম্প্রদায়ের গন্ডীর মধ্যে আবদ্ধ থাকেনি, গাওয়ার ব্যাপারে কোনো সীমাবদ্ধতা নেই বরং প্রধান গুন হল সার্বজনীনতা। শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রতি নজরুলের অনুরাগ সর্বজনবিদিত। ক্লাসিকাল ও উচ্চাঙ্গসংগীত মানুষের মনে যে অভিনব রস সৃষ্টি করতে পারে তা নজরুলের গানগুলিতে আমরা দেখতে পাই।  বাল্যবয়সে লেটো গানের দলে গান রচনা ও সুর দেওয়ার অভিজ্ঞতা পরবর্তীকালে তাঁর সংগীত জগৎকে ঋদ্ধ করেছে।কীর্তন, ঝুমুর, বাউল, স্ট্রীট সিঙ্গার ও গ্রামের লোকশিল্পীদের কাছ থেকে তিনি অনায়াসে সুর তুলে নিতেন। এত সুরের সন্ধান তিনি পেয়েছিলেন উস্তাদ দবির খান, উস্তাদ কাদের বক্স, উস্তাদ জমিরুদ্দিন খান এদের সান্নিধ্যে। উত্তর ভারতীয় টপ্পা, গজল,কাওয়ালি,খেয়াল, ঠুংরি, লোকগীতির প্রতি নজরুলের প্রবল অনুরাগ তাকে রাগ-রাগিনীর জগতে স্বচ্ছন্দে বিহার করতে এবং নব নব সুর সৃষ্টিতে সাহায্য করেছে। রবীন্দ্রনাথ, রজনীকান্ত, দ্বিজেন্দ্রলালের স্বদেশী গান ভারতবাসীকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করেছিল। যে কোন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে  সংগীত গণজাগরণের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করে থাকে, উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে। নজরুল স্বদেশীগানে নতুন একটি মাত্র যোগ করেছিলেন যা হল শিকল ভাঙার গান। বিপ্লবীদের মনের কথা গণসংগীত রূপে প্রকাশ হয়েছে, যেমন--  ১)  শিকল পরা ছল মোদের এ শিকল পরা ছল,  ২) দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার । ৩) আমরা শক্তি আমরা বল আমরা ছাত্রদল। ৪) জাগো নারী বহ্নিশিখা।   শ্রমিক কৃষক পার্টি গঠনে তিনি বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন, আদর্শের নিরিখে তিনি সাম্যবাদী ছিলেন। 'ওড়াও ওড়াও লাল নিশান'। তিনি গণসংগীতের পথিকৃৎ ছিলেন।

নজরুল ইসলাম সংগীতে অসাধারণ চিত্রকল্প, সুরজ্ঞান ও কল্পনাশক্তির পরিচয় দিয়েছেন। ইসলামী গানের প্রদর্শক নজরুল হিন্দুদের ভক্তিগীতি, কীর্তন, শ্যামাসঙ্গীত, শাস্ত্রীয় সংগীত, লোকগীতি, পারস্যের গজল, মধ্যপ্রাচ্চের রুক্ষ মরুপ্রদেশের লঘু ছন্দ সুর, প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপপুঞ্জের লোকসঙ্গীতকে বাংলা ভাষার শ্যামলিমায় নতুন সুর ও রাগ সঞ্চয়ে অসামান্য মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। নজরুলের রাগভিত্তিক গানগুলি এবং বিভিন্ন  রাগের মিশ্রিত গানগুলি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় তিনি নতুন রাগ সৃষ্টি করেছেন:- ১) মিশ্রিত রাগের গান ২) প্রচলিত রাগাশ্রয়ী গান  ৩) অপ্রচলিত রাগ উদ্ধার  ৪) দুই বাংলা ও বিভিন্ন রাজ্যের সুর সঞ্চয়ন  ৫) বিদেশি গানের বাংলায় রূপান্তর ইত্যাদি অসামান্য প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। প্রচলিত রাগাশ্রয়ী গানগুলো সঙ্গীতে শিক্ষিত নয় এমন শ্রোতাদেরও মুগ্ধ করত, যেমন ভীমপল্লশ্রী- 'বিদায় সন্ধ্যা আসিল ওই' , ছায়ানট- 'শূন্য এ বুকে পাখি মোর আয়' ,  মেঘ- ' শ্যামতন্বী আমি মেঘবরণা' , মধুমাধবী সারং- ' চৈতালি চাঁদনী রাতে' ,  আশাবরী - 'আমার দেওয়া ব্যথা ভোল' মিশ্রিত রাগের গানগুলি বাংলার সংগীত ভান্ডারকে ঐশ্বর্যমন্ডিত করেছে , যেমন - সিন্ধু ভৈরবীর মিশ্রণে 'সই ভালো করে বিনোদবেণী বাঁধিয়া দে',  বেহাগ- বসন্ত- ' ভরিয়া পরান শুনিতেছি গান', ইমন-মালবশ্রী- 'যবে তুলসীতলায় প্রিয় সন্ধ্যাবেলায় ',  সপ্তসুর ( মেঘ- বসন্ত- শ্রীপঞ্চমী- ভৈরব- নটনারায়ন- হিন্দোল- মালকোষ )- 'তোরা সব জয়ধ্বনি কর'

সংগীতাচার্য  সুরেশ চক্রবর্তীর সহযোগিতায় ১৯৩৯ সালে নজরুল আকাশবাণীতে 'হারামনি' নামে একটি অনুষ্ঠান করতেন। হারানো ও বিস্মৃত রাগ উদ্ধার করে নতুন করে কথা বসিয়ে তিনি অনেক লুপ্তসুর উদ্ধার করেছিলেন। যেমন আহির ভৈরব --'অরুনকান্তি কেগো যোগী ভিখারী', সিংহেন্দ্র মধ্যমা- ' পরদেশী মেঘ যাওরে ফিরে', সাজগিরি- 'তুষার মৌলি জাগো গিরিরাজ',  কর্ণাটি সামন্ত- ' কাবেরী নদী জলে কেগো বালিকা', দেবগান্ধার-'খেলে নন্দের আঙিনায় আনন্দ দুলাল', নীলাম্বরী- 'নীলাম্বরী শাড়ী পরি নীল যমুনায় কে যায়'

হিন্দিতে প্রচলিত লক্ষনগীতকে বাংলায় 'লক্ষনগীতি' রূপে চালু করে তিনি গান রচনা করেছিলেন। সংগীতবিজ্ঞানে অসাধারণ ব্যুৎপত্তি থাকার কারণে নিজের প্রতিভায় নজরুল ১৮ টি নতুন রাগ সৃষ্টি করে নাম দিয়েছিলেন 'নবরাগ' । যেমন ১) দোলনচাঁপা ২) বনকুন্তলা  ৩)উদাসী ভৈরব  ৪) অরুণ রঞ্জনী  ৫) দেবযানী  ৬)সন্ধামালতী  ৭)অরুণ ভৈরব  ৮)আশা ভৈরব  ৯)শিবানী ভৈরব ১০) রুদ্র ভৈরব। ১১) বেণুকা  ১২) মীনাক্ষী   ১৩) যোগিনী  ১৪) শঙ্করী ১৫) নির্ঝরিণী  ১৬)রূপমঞ্জরী  ১৭) রক্ত হংস সারং  ১৮) শিব সরস্বতী।

প্রেমসংগীত, পল্লীসংগীত, ধর্মসংগীত থেকে আধুনিক সংগীতে নজরুল অপূর্ব সুরমূর্ছনার ধ্বজা উড়িয়েছিলেন আপন প্রতিভার জোরে। ভক্তিসংগীত অর্থাৎ শ্যামাসংগীত, কীর্তনাঙ্গ গান,ভজন, পদাবলী, ইসলামী গানে তিনি ভাব-ভক্তি-সুরের গভীরতায় সকল ধর্মের মানুষের মর্মে পৌঁছে গিয়েছিলেন। তাঁর রচিত শ্যামাসংগীতের সংখ্যা- ২৪৪, যেমন- 'মহাকালের কোলে এসে গৌরী হলো মহাকালী',  'কালোমেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন',  'বল রে জবা বল- কোন সাধনায় পেলি তুই শ্যামা মায়ের চরণ তল'

পদাবলী কীর্তনে- ' যা সখি যা তোরা গোকুলে ফিরে' ,  ', নন্দকুমার বিনে সই', 'শ্যামসুন্দর গিরিধারী'  ইত্যাদি। তাঁর সংগীত শুনে মনে হবে রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলায় তিনি বিভোর, কখনও ঘোর শাক্ত, কখনও নিষ্ঠাবান ইসলামের উপাসক। ইসলামী গান নামে নতুন সংগীতের ধারা প্রবর্তন করেছিলেন- 'বক্ষে আমার কাবার ছবি' , 'মহরমের চাঁদ এলো ঐ কাঁদাতে ফের দুনিয়ায় ', 'রমজানের এই রোজার শেষে ', 'আমিনা দুলাল এস মদিনায় '। প্রায় দুশোর মতো গান রচনা করলেও মৌলবী মোল্লারা তাকে কাফের বলে চিহ্নিত করেছিলেন। লালন ফকিরের গানের যেমন সংকীর্ণতা, সীমাবদ্ধতা নেই, নজরুলের গানেও হিন্দু- মুসলমানকে একসূত্রে বেঁধে সুরের পথে তিনি মুক্তির সন্ধান দিয়েছিলেন।

প্রেমরসে পরিপূর্ণ এক ধরণের কাব্যসংগীতকে পারস্যদেশে গজল-গান বলা হয়। পারস্য ও ভারতের মেলবন্ধনে এই গজল-গান  মধ্যভারতে  সীমাবদ্ধ ছিল। নজরুল এই গজলকে রাগনির্ভর ঠুংরী দাদরা সহযোগে বাঙালি মানসিকতায় নতুন রূপ প্রদান করেছিলেন। যেমন- 'না মিটিতে সাধ মোর নিশি পোহায়'- ভৈরবী ঠুংরি,      ' বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুলশাখাতে দিসনে দোল আজি' - ভৈরবী,   'মুসাফির মোছ রে আঁখি জল'- বাঁরোয়া মিশ্র,   'সুনয়না আর চেয়োনা এ নয়ন পানে' - বাগেশ্রী পিলু কাহারবা।

লোকগীতি তাঁর কথায় ও সুরে অপূর্ব গীতধারায় রূপান্তরিত হয়েছে। ' আমার গহীন গাঙের নদী'; 'আমার সাম্পান যাত্রী না লয়- ভাঙা আমার্ তরী ' , 'কুঁচবরন কন্যারে তোর মেঘবরন কেশ', 'নদীর নাম সই অঞ্জনা'  ইত্যাদি সংখ্যাতীত গানে স্থানীয় ভাঙা সুরের সাথে ঝুমুর, সাঁওতালী,ভাটিয়ালি, বাউল, ভাওয়াইয়া সুরের মিশ্রণে নতুন রসসৃষ্টি সুরসৃষ্টি করেছেন। বারাণসীর কাজরী ও লাউনীর সঙ্গে বাংলা গান মিশিয়েছেন-- ' গাহিয়া এসো গোপ ললনা'

রবীন্দ্রনাথের ধারা অনুসরণ করে বিদেশী সুর-সংযোজন করে বাংলা গানকে অতি মধুর রূপ দিয়েছেন। কিউবান সুরে- 'দূর দ্বীপবাসিনী চিনি তোমারে চিনি' , মিশরীয় সুরে-'মোমের পুতুল মোমের দেশের মেয়ে নেচে যায়' , আরবী সুরে- 'শুকনো পাতার নূপুর পায়ে নাচিছে ঘূর্ণী বায়' ,  ইউরোপীয় অর্কেস্ট্রার সুরে -'খেলিছে জলদেবী সুনীল সাগর জলে'

হাসির  গানেও  তিনি জনপ্রিয়, প্রায় শতাধিক হাসির গান রচনা করেছেন- 'আজকে হইব মোর বিয়া, কালকে আইব বউ লইয়া' , 'দাদা বলতো কিসের ভাবনা'। বহু হিন্দি ও উর্দু গানেও তিনি সুর দিয়েছেন। অন্ততঃ ৩২ টি গানের প্রথম কলির কথা জানা যায়। তিনি প্রায় চার হাজার গান রচনা করেছেন, তিন হাজার পাঁচশো বিভিন্ন সুর ও স্বাদের গান পাওয়া যায়। তাঁর গান যুব জগতেও অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। নিজের গলাটি আধ ভাঙা হলেও প্রাণপ্রাচুর্য ও হৃদয়াবেগে ভরপুর গানগুলি সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনতো। তিনি অনেকগুলি তালও সৃষ্টি করেছেন। প্রিয়া, মন্দাকিনি, স্বাগতা, মঞ্জুভাষিনী,মণিমালা, নবনন্দন। নজরুল জীবন্ত সেতু হয়ে বলিষ্ঠ কণ্ঠে গেয়েছিলেন- ' হিন্দু না ওরা মুসলিম-- জিজ্ঞাসে কোন জন---'

১৮৯৯ সালের ২৫ শে মে , বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে এক ঝড়জলের রাতে দরিদ্র পরিবারে যে শিশুটি ভূমিষ্ঠ হয়েছিল, সেই দুখু মিয়া বা তারা খ্যাপা মাত্র আট বছর বয়সে বাবাকে হারিয়ে কাকা কাজী বজলে করিমের হাত ধরে লেটো গানের দলে যোগদান করেছিলেন। নয় বছর বয়সে গান গেয়ে, পালা রচনা করে অর্থ উপার্জন করতেন, তিনি ' ব্যাঙাচি কবি' উপাধি পেয়েছিলেন। তারপর নানা পেশা অতিক্রম করে সমাজসচেতক, কবি, গায়ক, গীতিকার, সুরকার কাজী নজরুল ইসলাম ১৯৪২ সাল পর্যন্ত তাঁর আশ্চর্য প্রতিভার স্ফুরণ ঘটিয়ে হঠাৎ অসুস্থ ও নির্বাক, জীবন্মৃত হয়ে ১৯৭৬ সালে তিনি অনন্তলোকে যাত্রা করেন। তাঁকে অনন্তকোটি প্রণাম জানাই।

অমৃতা খেটোঅমৃতা খেটো: কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত





কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন