গল্প
পাড়ার
ছেলেদের সাহায্যে ছোটদিদা নীতার ডেডবডিটা সৎকার সমিতির কাঁচের গাড়িতে উঠিয়ে শ্মশান
এর উদ্দেশ্যে যাত্রা করল মণীশ। শেষ তিনমাস মায়ের এই মাসি নীতার দেখাশোনাতেই অফিস শেষের সময়টুকু কেটে যেত মানার। সকাল আটটা থেকে
এই এক কামরার ঘরে নীতা দিদাকে দেখভাল করতো একজন আয়া। মানা অফিস থেকে ফিরে আসলে রাত
আটটায় তার ছুটি। ওকে মানা বলেই ডাকতো বড়োদাদুর বাড়ির সবাই। ওবাড়ীতে
একমাত্র নাতি মানার ছিল খুউব আদর। মামা তো ছিল না নিজের। তাই ওবাড়িটাকে ঠিক মামারবাড়ি
বলা যায় না। যদিও ওবাড়ীতে ভাড়াটিয়া পরাণ মামা ছিল নিজের মামার চেয়েও বেশি। বাড়িটা সবসময়
লোকজনে গমগম করতো একসময়। মাসিদিদা মানাকে ভালোবাসতো খুব। নিজে হাতে ঘরের তৈরি ক্ষীরে বানানো চন্দ্রপুলি খাওয়াতো। মানার প্রিয়
মিষ্টি পুডিং,কার্স্টার্ড বানিয়ে রাখতো আলাদা করে আঁশ, নিরামিষের ছোঁয়াছুঁয়ি বাঁচিয়ে।
আলাদা মিটসেফে জলের পাত্রেএ ভেতরে পুডিং এর বাটিটা রেখে দিলে বেশ ঠান্ডা থাকতো। তখন
তো ঘরে ঘরে এতো ফ্রিজ চালু হয়নি। বড়ো দিদার বড্ডো ছুঁচিবাই এর বাতিক ছিল। সারাদিন এক
জিনিষ সাত বার ধোয়াধুয়ি আর কাচাকাচি ছিল তাঁর বদ অভ্যাস। মানা এতে হাত দিস না,ওটা ধরিস
না, বাসি কাপড়ে দিলি তো ছুঁয়ে! বড়োদিদার এতো
পূজো পাঠের বাতিক ছিল কেন কেজানে, থাক সেসব কথা। কাচাকাচি শেষে রুগ্ন মানুষটা বাকী
সময়ের সারাটাক্ষণ ঠাকুরঘরে পড়ে থাকতো। জগদীশ দাদুর সংসারে দুবেলা কি রান্না হবে,কি
খাওয়া হবে- সবই যেন নীতা দিদার দায়িত্ব। দিদির প্রতি মমতায় নাকি নিজের সংসার না হওয়ার
আক্ষেপে কে জানে কেন সবটাই খুশি মনে হাসিমুখে
সামলাতো এই নীতা। সংসারটা তো কম বড়ো নয়! সেটা সামলানো কি চাট্টিখানি কথা! সংসারে নীতাদিদার
বড়দিদি, জামাইবাবু, তাদের দুই মেয়ে বীণা মীনা, জামাইবাবুর জ্যাঠা জ্যাঠাইমা,সে নিজে
আর তার বাবা মা। আর চালচুলোহীন মালি কাম বাজার সরকার ছিল একজন, সে গোবিন্দদা। ছেলে
বুড়ো সবার সে দাদা। সেও এবাড়িতেই থেকে গেছে বিনা মাইনেতে বাড়ির একজন ঘরের মানুষ হয়ে।
নীতা সকালে
যে সরকারী হরিণঘাটার লোকাল দুধের ডিপোতে বসে, সেখানেই এই গোবিন্দ দুধের বোতল ক্রেট
ইত্যাদি সামলায়, হিসাব রাখে। সেখান থেকেই প্রায় সমবয়সী অনাথ গোবিন্দকে বাড়িতে এনে তোলে
নীতা। মন্দ লোকে যদিও অন্য কথা বলতো। তবে বাড়ির সামনের কেয়ারি করা সুন্দর বাগানটার
প্রশংসা করতে কেউ ভোলে না। জগদীশ ছাড়া প্রায় সমর্থ পুরুষবিহীন এতোগুলো মহিলা আর বয়স্ক
মানুষের বিপদে আপদে গোবিন্দই হয়ে উঠেছিল বড়ো ভরসাস্থল। নীতা এই কথাটা বোঝাতেই জগদীশ
রাজী হয়ে যায়। ডকে জাহাজ বেশি ভিড়লে লেবার সাপ্লাই করা কোম্পানিটার চাপ খুব বাড়ে। তখন
লেবার সামলাতে অনেক সময় জগদীশকে নাইট শিফটে কাজ করতে হয়। নাইট ডিউটিতে রাতে বাড়ি ফেরা
হয় না। বিপদ আপদে তখন গোবিন্দই ভরসা। আর আই
এ ফেল সুপুরুষ জগদীশ নীতার মুখের উপরে বেশি কিছু বলতে পারতো না। তার এই নাইট শিফটে
অনেক বাঁ হাতের আমদানি আর মেয়েবাজির সুবিধা হয়ে যেত। নাহলে রাধা বাগড়া দিত এতোগুলো
অসহায় মানুষকে ফেলে তোমাকে ওভার টাইম করতে যেতে হবে না। ঘ্যান ঘেনে রাধা জগদীশের কাছে
ক্রমশ: বিরক্তিকর হয়ে ঊঠছিল। তার সমস্যাগুলো একমাত্র বোঝে নীতা।
ধূপের
গন্ধ আর খই ছড়ানোর সাথে বোল উঠল বলো হরি হরি বোল। মানার বন্ধুরা হরিধ্বনি দিচ্ছে। স্মৃতির
হাত ধরে যেন সিনেমার মতো সব দেখতে পাচ্ছে মণীশ। মায়ের অকালমৃত্যুর পরে এই ছোটো মাসিদিদাকেই
মায়ের আসনে কখন বসিছে দিয়েছে মণীশ। এই ছোটদিদার জন্য চোখদুটো ঝাপসা হয়ে আসছে। মায়ের
ছোট মাসিকে এই ছোটদিদা ডাকাটা নিজেই শিখিয়েছিল নীতা। বড়দাদু জগদীশবাবু সরাসরি সবার
সামনেই বলতো বুঝলি মানা,এটাই তোর আসল দিদা। তোর বড়দিদাটা তো খালি বুড়োদের মতো পান চিবোয়
আর ঠাকুরঘরে সারাদিন পড়ে থাকে। পোষা মেনী বেড়ালের মতো বড়োদাদুর পায়ে পায়ে ঘুরতো ছোটদিদা।
কখন চা চাই,কখন দাদুর তামাক চাই,কখন স্নানের গরম জল চাই। সব সাথে সাথে,হাতে হাতে রেডি।
সেলাই ফোঁড়াই থেকে রকমারি রান্না, ছোটোখাটো নার্সিং, আঁকা, ঘরের কাজে এক্সপার্ট, এই ছোটদিদা নীতার উপর
দাদুর নির্ভরতা ছিল বড়দিদা রাধার থেকে অনেক বেশি। মূর্খ সুন্দরী ফর্সা নরম সরম রাধার
থেকেও জগদীশের কাছে বি এ পাশ শ্যামলা করিতকর্মা অবিবাহিতা শালীটির আকর্ষণ ছিল বেশি।
বড়োদাদুর
ঘরে বসে একসাথে সান্ধ্য আড্ডা দিত তাস খেলতো পরাণ মামার বাবা নকুড়দাদু। তিনি বলতেন
বাচ্চাটাকে এইসব শেখাচ্ছো কেন ভায়া! আসল দিদা আবার কেমন কথা। না জানি, নীতাই তোমার
সংসারে সর্বেসর্বা তবু...। নকুড় দাদুর কথাটা
শেষ করতে না দিয়েই হা হা করে বিকট শব্দে হেসে উঠতো বড়োদাদু। আরে দাদা, সত্যিটা সবাই
যা জানে সেটা ও জানুক নাহয়। দুদিন পরেই তো সব বুঝবে। ছোটোগিন্নিই তো আমার আসল বউ। টেবিলের অদূরে বড়োদাদুর পায়ের কাছে আদুরী বেড়ালের
মতো বসে আসন বুনতে বুনতে মুচকি মুচকি হাসতো
আর মজা পেত ছোটদিদা।
মা বীণা,
এসে রাগত মুখে মানাকে পড়তে বসার অজুহাতে টানতে টানতে ঘরের বাইরে নিয়ে আসতো। মনার ডাক্তার
ব্যাস্ত বাবা সুবিনয়ের বাড়ি কাছেই, এক পাড়াতেই। ব্যস্ততার কারণে সুবিনয় প্রায় অসামাজিক
প্রাণী। সরকারি হাস পাতাল সেরে নিজের চেম্বার সেরে অনেক রাতে ঘরে ফিরতো সুবিনয়। তখন
বিজের বউ আর বাচ্চাকে তুলে নিয়ে যেত। ছোট্ট মানা ঘুমিয়েই পড়তো, সকালে ঘুম থেকে ওঠার
আগেই তার বাবা কাজে বেরিয়ে পড়তো। মা বাপের আদুরী বীণা ছিল শান্ত নির্বিরোধী মানুষ।
সে সংসারের কোনো কাজ পারতো না, তাই বাপের বাড়িতেই সারাদিন মানাকে নিয়ে কাটিয়ে দিত।
আর ঠোঁটকাটা মীনা ছিল দিদির স্বভাবের বিপরীত।
কখনো কলেজ থেকে ফিরেই ছোটমাসী মীনা চোটপাট
দেখাতো নীতার উপর। কখন ফিরে এসেছি কলেজ থেকে এখানে বসে কি করছো তুমি? কি টিফিন
বানিয়েছ মাসি? গরম করে দাও খাবারটা।আমার খিদে সহ্য হয়না জানোনা? এক্ষুণি মাথা ধরে যাবে।
বাড়ি ফিরেই চিৎকার জুড়ে দিত। এই রাজ্য জয় করে এলেন মহারাণী। সংসার সামলে দুদন্ড সন্ধাবেলা
আমার সামনে এসে বসেছে ছোটগিন্নি, তোদের মা মেয়েদের কারো সহ্য হচ্ছে না? দুদিন পরে তো
শ্বশুরঘর করবি। নিজে ঘরের কাজকর্ম করতে শেখ।
কে পাঠিয়েছে তোকে রাধা! এতোবড়ো সাহস! হুঙ্কার ছাড়তো জগদীশ দাদু। মুখরা ছোটোমাসি মীনা
একমাত্র, ভয় পেত না বাবাকে। তোমাদের লীলা কীর্তন দেখেশুনে আর কোনো জামাই আসবে? নেহাত
দিদিটা প্রেমে বিফল হয়ে সুইসাইড করতে গিয়েছিল, তাকে সুস্থ করতে গিয়ে ওই তালেগোলে ডাক্তার
জামাইটাকে পেয়ে গেছো। বলে দ্রুত ঘর ছেড়ে পালাতো মীনা মাসি। তখন টেবিলে তাস খেলতে খেলতে
দাদু মাটিতে সেলাই নিয়ে বসা ছোটদিদুর কোলের মাঝে একটা পা তুলে পাটা দিদার জংঘায় ডলতে
শুরু করেছে। আর ছোটদিদা নীতা কি হচ্ছে কি দাদাবাবু বলে হেসে গড়িয়ে পড়ছে দাদু জগদীশ
এর গায়ে। ছোটদিদা মানার দিকে তাকালে বিছানায় শুয়ে ঘুমের ভান করে মটকা মেরে পড়ে থাকতো
অতোটুকু ছেলে মণীশ। ভারাক্রান্ত মনে এলোপাথাড়ি কতো স্মৃতি যে ভেসে আসছে আজ। দাদুর বাড়ির
আত্মীয়দের কেউ পাশে নেই এই মাসিদিদার শ্মশানসঙ্গী হওয়ার জন্য। কেবলমাত্র মণীশ-ই পাশে
থেকেছে।
মায়ের
বাবা জগদীশ দাদু ছিলেন খিদিরপুর ডকের বিদেশী সিম লিং নামক জাপানী ক্রেন সংস্থার লোকাল
লিজ নেওয়া কোম্পানির লেবার সুপারভাইজার। উচ্চ বেতনভোগী না হয়েও জাহাজে আসা বিদেশী দ্রব্যগুলো
টানা মাল হয়ে ন্যান্সি মার্কেটে পাঁচ হাত ঘুরে চড়া দামে বিকোতো। জনপ্রিয় হাসিখুশি সুদর্শণ
মানুষটির সামাজিক প্রতিপত্তি ছিল খুব। দুহাতের ইনকাম আর দুটো বাড়ির ভাড়ার টাকায় খুব
ভালোভাবে চলে যেতো তাঁর। লেবার মেনটেন করতেন তাই লোকাল মাস্তান গুন্ডা আর রাজনীতি করা
নেতাদের সাথে দোস্তি ছিল ওঁর। তাদের নেশার টাকা জোগালেও নিজে কোনোদিন নেশা করত না জগদীশ।
তাই সহজেই গুন্ডা মহলে সমীহ আদায় করে নিয়েছিল।
গড়গড়ায় তামাক সেবন, বিদেশী এন্টিক মুর্তি বা সোপিশ কেনাবেচার সাথে ঘরে সাজানো
আর তীব্র নারী আসক্তি এই ছিল তাঁর প্যাশন। প্রচুর দাপট আর প্রতাপ ছিল জগদীশের নিজের
সংসারেও। মণীশ মা বীণার কাছে শুনেছে এই দাদু ছিলেন আসলে দত্তকপুত্র। জদীশবাবুর নি:সন্তান
জ্যেঠা তার ভাই এর অনেকগুলো পুত্রের মধ্যে থেকে জগদীশকেই নিজের ছেলের মর্য্যাদা দিয়ে
দত্তক গ্রহণ করেন। জগদীশবাবুর জ্যেঠিমার বাবার ছিল অগাধ সম্পত্তি। মেয়ে প্রেমলতা দেবীর
নামে নীলাম হওয়া জমিদারির দুটো কলকাতার বাগানবাড়ি
লিখে দিয়েছিল তৎকালীন সিমলার জমিদারদের দেওয়ান রাজনারায়ণবাবু। শ্বশুরঘর কাছেই হওয়ায়
বাবার দেওয়া খিদিরপুরের বাড়িতে স্বামীকে নিয়ে এসে উঠেছিলেন প্রেমলতা। আর গঙ্গার লাগোয়া
হেস্টিং এর পোড়ো বাগানবাড়ির গোটাটাই সংস্কার করে অনেক পরে ভাড়া দিয়ে দিয়েছিল পুত্র
জগদীশ।
জন্মের
কিছুদিন পরেই জগদীশ পাকাপাকিভাবে নিজের বাড়ি বাপ মা ভাইদের ছেড়ে এসে উঠেছিলেন জ্যেঠার
সংসারে। তাই নিজের বাবা মায়ের প্রতি কোনো টান এক্সহিল না তাঁর। বাপসম জ্যাঠাকে এগারো
বছরে হারিয়ে জ্যেঠিমার আদরেই মানুষ হন তিনি। মায়ের স্নেহে মানুষ করা জ্যেঠিমা সেভাবে
শাসন করেননি জগদীশকে। জ্যেঠার কয়লার দোকানে বসতে না দিয়ে জ্যেঠিমা তাঁকে লেখাপড়া শিখিয়ে
মানুষ করতে চান। কিন্তু বিধি বাম। অত্যাধিক আদরে বাঁদর হয়ে যায় জগদীশ। পাঁচ বারের চেষ্টায়
ম্যাট্রিক পাশ করে অবশেষে তিন বারের চেষ্টায় আই এ পাশ করলেই তিনি ছেলের বিয়ে দিয়ে দেন। আর্থিকভাবে অক্ষম হয়ে আসা এক বনেদী
পরিবারের বড়ো মেয়ে শান্তশিষ্ট রাধার সাথে সদ্য
আইএ পাশ,করা জগদীশের বিয়ে হয়ে যায়।
সদ্য সাতাশের
কামুক জগদীশের লক্ষ্য পড়ে তার অবিবাহিতা দুই শ্যালিকার দিকে। শ্বশুরবাড়িতে আসলেই ছুতোনাতায়
মেজোশালী পৃথুলা গীতার বুকে মুখ ঘষে দিত। বোকা গীতা কেঁদে ফেললে তার গায়ে মাথায় সান্ত্বনার
হাতটা যেখানে সেখানে বোলাতে থাকতো। ছাদে দাদাবাবুর চা দিতে এসে অষ্টম শ্রেনীতে পাঠরতা চতুর নীতা এসব দেখে ফেলে। সে নীচে নেমেই মা নীহারিকা
দেবীকে সব জানিয়ে দেয়। নতুন বড়ো জামাই এর কান্ডকারখানা
বুঝে নিয়ে গীতাকে দিদির বিয়ের পাঁচ মাসের ব্যবধানেই বিয়ে দিয়ে দেন তার পিতা শুভঙ্করবাবু।
তড়িঘড়ি রাধার পরেই গীতার বিয়ে দিতেই বাজারে
প্রচুর টাকা ধারদেনা হয়ে যায় কাপড় দোকানী শুভঙ্কর
বাবুর। এদিকে যে বাড়িতে তিনি ছিলেন সেটি ছিল লিজ নেওয়া বাড়ি। সেই লিজের চুক্তি শেষ
হতেই মালিক বাড়িটা বিক্রি করে দিতে চায়। শুভঙ্করের বাকী পাঁচ ভাই আলাদা আলাদা ভাবে
সেই বাড়ি কিনে নেয়। কিন্তু দেনায় হাত খালি তাই সেবাড়ি আর কেনা হয়না শুভঙ্করের। ভাইরা
যদিও বলে তোরা কর্তাগিন্নি আমৃত্যু এখানেই
থাক। তোদের তো আর পুত্র সন্তান নেই তাই তোর
ছোট মেয়ের বিয়ে হয়ে গেলে আর কোনো সমস্যা নেই। সেযুগে মেয়েরা বিয়ের পরে উত্তরাধিকার
সূত্রে পিতার সম্পত্তির দাবীদার হতে পারতো না।
কাঁচা
টাকা হাতে না থাকলেও নীহারিকার বিবাহ সূত্রে পাওয়া প্রায় চল্লিশ ভরির গহনা তখনো মজুত
ছিল। এই গহনা রঙচাপা ছোট মেয়ে নীতার বিয়েতে কাজে লাগবে তাই খরচ করা যাবেনা। বিদেশি
কোম্পানির শেয়ারের কাগজ কিনতেন শুভঙ্করবাবু। সেগুলো তাঁর সম্পদ ছিল। হঠাৎই তাঁর চালু কাপড়ের দোকানটা উঠে গেল এক কর্মচারীর লোভের আগুনে।
তখনকার দিনে নির্দিষ্ট দামে সব বেসরকারী দোকানেই
কিছু কাপড় বিক্রি করা হতো সরকারী বাঁধা রেটে, গরীব মানুষের সুবিধার্থে। সেই কাপড় চড়া
দামে বিক্রি করতে গিয়ে জনগণের হাতে ধরা পড়ে শুভঙ্করবাবুর দোকানের এক কর্মচারী। শুভঙ্করবাবু দুপুরে বিশ্রাম নিতে বাড়িতে
তখন ভাতঘুমে আচ্ছন্ন। এই ঝামেলায় পুলিশ কেস হয়ে যায়। দোকানে তালা পড়ে যায়।
স্কুলের
ম্যাট্রিক পরীক্ষা শেষ করে নীতা তখন আই এতে ভর্তি হবে। পড়াশোনায় ভালো নীতার পড়াশোনার
খরচ কিভাবে চলবে? নীতার পড়া বন্ধ হয়ে যাবার মুখে। নীতা দারস্থ হয় দাদাবাবুর। তুমি একটা
কিছু করো না গো। ততোদিনে সুপুরুষ জগদীশের প্রেমে পড়ে গেছে নীতা। জগদীশ শ্বশুর মশাইকে
নিজের বিশাল ফাঁকা বাড়িতে উঠে আসার প্রস্তাব রাখে। অত্যন্ত ব্যস্ত জগদীশ প্রতিদিন শ্বশুরবাড়ি
আসতে পারেনা। নীতাকে একদিন কাছে না পেলে যেন ঠিক আশ মেটে না। নীতাদের চিলেকোঠার ফাঁকা
ঘরে নীতাকে পড়ানোর অজুহাতে তখন গোপনে উভয় উভয়ের শরীর চিনে নিয়েছে। রাধা যেন মরা মাছ,
আজকাল ঠিকঠাক সাড়াও দেয় না। ওইসব উত্তুঙ্গ সময়ে চুপচাপ গুম মেরে পড়ে থাকে। নীতার শরীর
যেন টাট্টু ঘোড়া। ওতে চড়বার রোমাঞ্চটাই আলাদা। দ্রুত জগদীশের শরীরে তীব্র ঝাঁঝ তুলে
আনে ওর চাপা শীৎকার। বয়সে প্রায় চৌদ্দ বছরের ছোটো নীতাকে তুই তোকারি করে ডাকে জগদীশ।
নীহারিকা আর শুভঙ্কর তখনো ওদের গোপন প্রেমের কিছুই আঁচ পায় না।
নীতাও
বাবাকে অভিযোগ জানায়, আর কতোদিন কাকাদের দয়ায় এবাড়িতে থাকবে? চলো না বাবা আমরা দিদির সাথে গিয়ে থাকি। রুগ্ন দিদিটা আর
অতো বড়ো সংসার টানতে পারে বলো? আমরা গেলে মা আর আমি ওকে হাতে হাতে সাহায্য করতে পারব।
বড়দির ছুঁচিবাই বাতিকে তো বীণা মীনার রাতে কিছু খাবারই জোটেনা। রাতে ওরা দুবোনে বেশিরভাগ
দিন দুধমুড়ি খেয়ে শুতে যায়। সকালে দাদাবাবুর
জ্যেঠিমা আর রান্নারদিদি রান্না সামলায়। রান্নাদিদি তো জ্যেঠিমার সাথে তিন সন্ধ্যায় আফিমের গুলি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। দিদিটা
সকাল সন্ধ্যায় ঠাকুর ঘরে বেশি সময় দেয়। তাই
রাতের রান্নাবাড়ি কোনো মতে সারে। বাচ্চা দুটো ঝাল মশলার রান্না খেতে পারেনা। ওদের জন্য
আঝালা কিছু করবি না? কেমন মা ও? তুমিই বলো মা। নীতা এতোগুলো কথা একসাথে দ্রুত বলে হাঁফাতে থাকে। নীহারিকা তবু্ও জামাই বাড়ি থাকতে মৃদু আপত্তি জানায়। নীতা বলে জানো
মা ছোটোকাকী সেদিন কুয়োপাড়ে জল তোলা নিয়ে আমাকে
কতো কথা শোনালো! জল তুলতে দেরী হতে বলে কিনা, তোরা আমাদের পয়সায় এবাড়িতেও থাকবি
আবার কুয়োপাড়ে তোদের পিছনের লাইনেও দাঁড়াতে হবে! আমার আর এসব কথা শুনতে ভালো লাগেনা
মা। শুভঙ্কর ও সায় দিয়ে বলে ওঠে এখানে আর সন্মান নিয়ে থাকা যাবেনা সেজবউ। সেদিনে কি
অপমানটাই না করলে ওই দুদিনের ছোকরা। বর্ষায় কাঠটা বেড়ে গেছে তাই সদরটা জোরে বন্ধ করতে
গেলে সেদিনের দীপুটা বলে ওঠে, দরজাটা কি ভাঙবে জ্যেঠু সারাতে গেলে তোমার আবার এক পয়সার তো মুরোদ নেই। সেই তো আমাদেরই
দিতে হবে। একটু ধীরেসুস্থে দরজা বন্ধ করতে পারো না!
নীতারা
নিজেদের পৈত্রিক ভিটে বরাবরের মতো ছেড়ে দিয়ে জগদীশের বাড়িতে তল্পিতল্পা নিয়ে উঠে আসে।
সরল রাধা খুশীই হয়। স্কুল পড়ুয়া বীণা মীনা দুইবোন দাদু দিদাকে পেয়ে আনন্দে লাফিয়ে ওঠে।
জগদীশের বিধবা জ্যেঠিমা বনাম পালিকা মা মনে মনে ক্ষুন্ন হলেও ছেলের দাপটে সবটুকু মেনে নেয় হাসিমুখে ঢেকে।
এদের সাথে একসাথে পাকাপাকি বসবাস করতে শুরু করে শুভঙ্কর বাবুর পরিবার। নীতা এখান থেকেই
কলেজে যেতে থাকে। পড়ালেখায় মাথা ভালো নীতা পাশ করে যায় ফটাফট। আই এ পাশ করে বিএ ক্লাসে পড়তে থাকে কলেজে। কলেজে পড়ার সাথে হাতের
কাজ আর সেলাইও শিখতে থাকে। আঁকা আর রান্নার হাত তো নীতার ছোট থেকেই ভালো। সবাই একবাক্যে
প্রশংসা করে। গায়ের রংটা যা চাপা আর রোগাটে গড়ন কিন্তু মাথাভর্তি একঢাল কালো চুল কোমর
ছাপিয়ে নেমেছে। নীতা দাদাবাবুর কোনো দোষ দেখতে পায় না। দিদি তোরই তো যতো দোষ। নাইট
ডিউটিতে যাবে মানুষটা রাতের খাবারটা খেয়ে গেল কিনা দেখবি না? তুই দেখ মুখপুড়ি,সারা
দিনভর আমার সাথে পায়ে পা দিয়ে ঝামেলা করে গেল তার বেলা চোখে দেখতে পাস না? আমি ছুচিবাই,
আমি সন্ন্যাসী- সারাদিন কাচাকুচি আর ঠাকুর নিয়ে পড়ে থাকি। তা থাকি তো থাকি। সারাদিন
কুড়িটা পান খাই, তা খাই তো খাই। খোঁটা দেবে কেন? দুমুঠো তো ভাত খাই। এতো কথা কিসের?
তোরা এতোগুলো মানুষ আছিস তোরা দ্যাখ বাপু। আমায় ক্ষেমা দে। শান্ত দিদিটা যেন আজকাল
বেশি তর্ক করে দাদাবাবুর সাথে। নীতার সাথেও এভাবে কোনোদিন কথা বলতো না,তবে কি দিদি
কিছু সন্দেহ করে আজকাল !
সেদিন
নীতা দিনের বেলা ভিজে কাপড় ছাড়ছিল মায়ের ঘরে। বাবা বাজারে গেছে, মা রান্নাঘরে জ্যেঠিমার
সাথে রান্নায় ব্যস্ত। নীতারা আসবার পরে রান্নার মাসিটাকে ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। মীনা
বীণা স্কুলে। দাদাবাবু ভেজানো দরজা ঠেলে হঠাৎ নীতাকে বাচ্চাদের মতো কোলে উঁচু করে তুলে
ধরেছিল। দাদাবাবু পড়ে পড়ে যাব বলতে গিয়ে আরামে গলাটা বুজে আসে নীতার। ততক্ষণে জগদীশ
ভেজা কাপড় সরিয়ে নীতার নাভিতে তার পুরু ঠোঁট ঘষতে শুরু করে দিয়েছে। পুরোনো দরজার পাল্লাটা ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দে একটু ফাঁক হতেই
দাদাবাবুর কোল থেকে লাফিয়ে নেমে পড়েছিল নীতা। কিন্তু বাইরে এসে কাউকে দেখতে পায়নি।
তার বড়দি কি দেখে ফেলল না মা, কেজানে কে দেখল? যা দ্যাখে দেখুক। আর কতো লুকোবে সবসময়
যা শুরু করেছে দাদাবাবু নীতাকে কাছে পেয়ে। জগদীশের নাইট ডিউটি না থাকলে পায়ের ব্যথায়
রাতে তেল গরম করে মালিশ করবার হুকুম হয় নীতার
উপর। নীতা ভালো তামাক সাজতে পারে। রাতে শোবার আগে দাদাবাবু তামাক খাবে। হাঁক পাড়ে,
আজকাল ছোটোগিন্নী কি হলো আর কতো দেরী? পায়ের ব্যথায় মরে গেলে আসবি? আর তামাকটা গড়গড়াটা সাজবে কে শুনি? নেশা কেটে গেলে
আমার ঘুম আসেনা জানিস না! জগদীশের জ্যেঠিমাও বলে যাও না মা তোমার হাতের তামাক খুব পছন্দ আমার জগার। আর সারাদিন
বেচারা যা পরিশ্রম করে তোমাদের সবার জন্য, যাওনা তেলটা গরম করে নিয়ে যাও তাড়াতাড়ি।
মালিশের নামে দাদাবাবু নীতাকেই মালিশ করতে থাকে। ওঘর থেকে নীতা বেরিয়ে আসলে রান্নাঘর
ধুয়ে মুছে মীনা বীণাকে রাধা জ্যেঠিমার ঘরে ঘুম পাড়িয়ে, তবে ঢোকে জগদীশের
ঘরে। সেরকমই নির্দেশ আছে জগদীশের। আজকাল দাদাবাবুর কড়া আদরগুলো কেমন তীব্র নেশার
মতো অভ্যাস হয়ে গেছে নীতার, শরীর খারাপের সময় যেকটা দিন যায় না ওঘরে মালিশ করতে, বা
দাদাবাবু নাইট ডিউটিতে গেলে তখন সারারাত মায়ের সাথে শুয়ে বিছানাতে এপাশ ওপাশ করতে থাকে।
কিছুতেই ঘুম আসে না। তবু দাদাবাবু যদি একটু নরম সরম ভাবে আঘাত না করে আদর করতো। ভাবে
নীতা। ভালোবাসার এমন পুরুষ কি তার কল্পনায় ছিল কোনোদিন! তবে বিয়েতে রুচি নেই আর। ওবাড়ি
থাকতেই মেয়ের গায়ের রং কালো বলে পাঁচ পাঁচটা সম্বন্ধ বাতিল হয়ে গেছে। আর পাত্রপক্ষের
সামনে বসবে না নীতা। এই তো বেশ আছে,তবু...পুরোপুরি নিজের একজন মানুষ যদি নীতার থাকতো।
চাহিদা পূরণ আর আবদার মেটানো তো এক জিনিষ নয়। সেদিন দাদাবাবু খোলা চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকাতে
ঝাঁকাতে নীতার ঘাড়ে তীব্রভাবে ঠোঁট আর দাঁত বসিয়ে দিল। যতো লাগে নীতার চাপা চিৎকারে দাদাবাবুর কামনা যেন দ্বিগুণ হয়ে ওঠে।
দাগটা ঢাকতে গায়ে কাপড় জড়িয়ে কলেজে গেল সেদিন। নীহারিকা দেবী বলে উঠলেন এই গরমেও গায়ে
আঁচল জড়াস কেন নীতা? মা কি তবে সব বুঝতে পারে? তবে তাকে কিছু বলেনা কেন? বাবাও এবাড়ি
এসে ইস্তক বড়ো চুপচাপ হয়ে গেছে। সকালে বাজারেই বেশী সময় কাটায়। আর সন্ধ্যারাত অবধি
পাড়ার রকে বৃদ্ধদের আড্ডায় তাস পেটাতে যায়। বাড়িতে আর থাকে কতোটুকু!
আত্মীয়ের
দল মেয়ের বিয়ের কথা তুললে শান্ত নীহারিকা এড়িয়ে যেতে থাকে। সেদিন নীহারিকার মেজো মেয়ে
জামাইয়ের সাথে এবাড়িতে বেড়ায়ে এসেছিল গীতার শ্বাশুড়ি আর বড়ো জা। ওরা নীতার একটা সম্বন্ধ
নিয়ে এসেছিল। গা করেনি নীহারিকা। দেখি ওর বাবাকে বলে,কি বলে। সবই আমাদের কপাল, বেয়ান।
নীতার বাবার চালু কাপড়ের দোকানটা তো উঠে গেল। আমাদের তো আর্থিক সঙ্গতি বেশি নেই, কালো মেয়ের জন্য পণ দিতে তো পারব না আর।
জগদীশ যা করে। কথা বলি, দেখি। চোখে জল নিয়ে
পাশ কাটায় নীতার মা। বাড়ি ফিরতে ফিরতে গীতার শ্বাশুড়ি বলে তোমার ছোট বোনটাকে তো ওবাড়ির
দাসী বাঁদী বানিয়ে রেখেছেন তোমার দিদি আর দাদাবাবু। ও মেয়ের বিয়ে কি করে হবে গা? মেয়েটাকে
আমাদের বাড়ি কিছুদিনের জন্য এনে রাখো দেখি। আমাদের পরাণ ঘটককে একবার লাগিয়ে দেখি! গরীব
ঘরের মেয়েদের কি বাপ মায়ে বে দেয় না! সব বুঝেও গীতা না জানার ভান করে নীরব থাকে। স্বামী
বিমলের দিকে তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নেয় গীতা। চতুর বিমল সব বুঝে গেছে, পারলে সেও একটু
শেষপাতের চাটনি খেতে চায়। শালী তো আধা ঘরবালি হয় জানো না নীতুরাণী। মেজো দাদাবাবুটাকেও
একটু দ্যাখো গো। অনেকবার একথা গীতার সামনেই হাত ধরে টেনে বলেছে সে নীতাকে। ভীতু গীতা
সেকথা বলতে পারেনা তার শ্বাশুড়ি মাকে।
বিএ পাশ
করার পরেই দুধের ডিপোর চাকরিটা পেয়ে গেছে নীতা। ভোরে উঠেই হরিণ ঘাটা থেকে আসা দুঢের
বোতল ডিপো থেকে নিয়ে যায় লোকে। কার্ড মিলিয়ে দুধ দিয়ে কার্ডে লিখে দিতে হয়। মাস কাবারিদের
জন্য কার্ড। আবার কেউ বাড়তি দুধ এক্সাইলে অন্য নিয়ম। দুধের ক্রেট মেলাতে সাহায্য করে
গোবিন্দ। মা বাপ মরা দুঃখী ছেলে। গোবিন্দর মামি মামাবাড়ি থেকে খেদিয়ে দেবার পরে এইট
পাশ গোবিন্দ অনেক ঘাট ঘুরে এই কাজটা পেয়েছে। শেয়ালদার মেসে চার বন্ধুর দয়ায় ফ্রিতে মেঝেতে শেয়ারে থাকে। খাই খরচ নিজের। মেসে
দিনেরবেলা একবেলা নিরামিষ ডাল ভাত ছ্যাঁচড়া খায়,কটা পয়সার বিনিময়ে। আর রাতে শুকনো পাউরুটি
নয় মুড়ি। যেদিন যা জোটে। সমবয়েসী সেই গোবিন্দর জন্য বাড়ি থেকে আনা টিফিন দিতে থাকে
নীতা। কোনোদিন বীণা মীনার ইস্কুলের জন্য বানানো টিফিনের থেকে কিছু বেশী লুচি বা কচুরি
বাঁচলে সেগুলো এনে গোবিন্দকে দিয়ে দিত। গোবিন্দর গোগ্রাসে খাওয়া দেখে, মায়া হতো। ধীরে
ধীরে ওর কাছেই সব দুঃখের কাহিনি শুনে নিল।
সেই থেকে কেমন একটা মায়া পড়ে গেছে গোবিন্দটার জন্য। আর নীতাকেও অন্য চোখে দেখতে শুরু
করেছে গোবিন্দ। সংসারের চাপে কারো অসুস্থতায় নীতা একদিন কামাই করলেই গোবিন্দ নীতার
খবর নিতে বাড়িতে চলে আসে। একবার কলকাতায় জগদীশের অনুপস্থিতিতে তার জ্যেঠিমার জোরদার অসুখে সেবা করতে এবাড়িতে চাররাত
থেকে গেল গোবিন্দ। নীতার সাথে হাতে হাতে জ্যেঠিমার সেবা করতে গিয়ে কখন জানি নীতার সাথে
ঘনিষ্ঠ এক প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ল। সমবয়সী গোবিন্দর মিষ্টি ভালোবাসার উত্তাপে নতুনভাবে
নিজেকে আবিষ্কার করে গলে যেতে থাকলো নীতা। পরস্পর পরস্পরের উপরে ক্রমশ নির্ভরশীল হয়ে
উঠতে লাগল। জগদীশের চোখের আড়ালে শুরু হল নীতার নতুন এক প্রণয়পর্ব। জগদীশের মাসে বারোদিন
নাইট ডিউটি পড়লেই এবাড়িতে রাত্রিবাসের ডাক পড়ত গোবিন্দর। গোবিন্দ সবার সাথে মধুর ব্যবহারে
জনপ্রিয় হয়ে গেল এবাড়িতে। জ্যেঠিমার আফিমের গুলি সাপ্লাই করে দিত সে। আবার নীতার মায়ের
দোক্তাপাতা এনে দেওয়া, নীতার বাবার নস্যির জোগান দেওয়া আর রাধার প্রিয় জর্দাটা সঠিক
সময়ে এনে দিতে সিদ্ধহস্ত হয়ে গেল গোবিন্দ। বীণা মীনাও গোবিন্দ দাদার ভক্ত হয়ে উঠল অল্প
দিনেই। এতো সুন্দর ক্যারিকেচার করত গোবিন্দ যে সব্বাই হেসে কুটিপাটি যেত। আর বামুনের
ছেলে হওয়াতে একটু আধটু ঠাকুর পূজো জানতো।বাড়ির প্রতি পূর্ণিমার সত্যনারায়ণ পূজোর দায়িত্ব
রাধা গোবিন্দর হাতে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হলো। সৌখিন জগদীশ বিনা পয়সায় একটা ভালো মালি
কাম কেয়ারট্বকার পেয়ে গিয়ে চুপচাপ সব মানিয়ে নিল। তার গোপন চোরাচালান বিজনেসের মুর্তিগুলো
বাড়ির গুদামে আর বাগানে মজুদ করা আর তার রক্ষাণাবেক্ষণের সম্পূর্ণ দায়িত্ব বিনা মাইনেতে
গোবিন্দর উপর চাপিয়ে দিল। চড়া দাম আর ভালো কাস্টমার পেলেই জাহাজ থেকে পাচার হওয়া চোরাই বিদেশি
মুর্তিগুলো ঝোপ বুঝে গোপন নীলামে বেচে দিত।
ওবাড়ির
ভাড়াটে কাম প্রায় আত্মীয় নকুড় দাদুর ছেলে পরাণ মামা আর সন্ধ্যা মামীর কাছে এইসব কাহিনীর
অনেকটাই শুনেছে সে আর তার বোন তানিয়া। নকুড় দাদুর স্ত্রী গৌরিদিদার মুখেও কিছু গল্প
শুনেছে মনীশ। মা যখন আচমকা স্ট্রোকে মারা যায়
মনীশ তখন ক্লাস এইট আর বোন তানিয়া ক্লাস ওয়ান। ওবাড়িতে ভাড়াটিয়া হলেও গৌরিদিদার সাথে
খুব বন্ধুত্ত্ব ছিল বড়োদিদার। মেয়ে বীনার শোকে যখন রাধা শয্যাশায়ী তখন ওবাড়িতে অনেকটাই
সামলিয়েছে এই গৌরিদিদা। মনীশের বেশ মনে আছে ছোটমাসি মীনার তখন সবে বিয়ে হয়ে একটা ছোট্ট
মেয়ে হয়েছে। হামা দিতে শেখা দুরন্ত বুলাকে নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে মীনা মাসি ব্যস্ত। সকালেই
বাবা সুবিনয় মনীশকে স্কুলবাসে তুলে দিয়ে তানিয়াকে গৌরী দিদার কাছে রেখে হাসপাতালের
ডিউটিতে ছুটতো শেষে চেম্বার সেরে অনেক রাতে মনীশকে বাড়িফিরিয়ে নিয়ে যেত। তানিয়া নিঃসন্তান
সন্ধ্যা মামীর কাছেই রাতে থেকে যেত। এভাবেই দত্তক না নিয়েও তানিয়া পরাণ মামাকে বাবা
আর সন্ধ্যা মাসিকে মা ডাকতে শিখে গেল। আর নিজের বাবাকে বাবু ডাকতে শিখল। ওখানেই থেকে
গেল বোন ওদের কাছে মানুষ হতে লাগল। মনীশ এর স্কুল থেকে ফিরে ওবাড়িতে দেখা করতে যেতে
হতো নীতা দিদার হাতের টিফিন খাবার জন্য। জগদীশ দাদুও বড়োমেয়ে মারা যাবার পর একমাত্র
নাতি মনীশকে একবার না দেখলে অস্থির হয়ে যেত। তানিয়াকেও বড়োদাদু খুব ভালোবাসতো। কিন্ত
ছুতোনাতায় গৌরীদিদা বা সন্ধ্যামামী তানিয়াকে নিজেদের ঘরে নিয়ে যেত। মা মারা যাবার কিছু
কাল পরে মনীশ আর ওবাড়িতে যেতে চাইতো না। বীণা
মারা যাবার তিন বছরের মধ্যেই প্রথমে বড়দিদা
রাধা আর তারপরে তাঁর বাবা ও মা একে একে মারা গেলেন। জগদীশের জ্যেঠিমা অবশ্য তার দুবছর আগেই মারা গিয়েছিলেন। বাড়িটা একেবারে ফাঁকা
হয়ে গেল। রাধাদিদা মারা যেতেই গৌরীদিদা আর ওবাড়িতে থাকতে চাইল না। নকুড় দাদুর একটা
জমি কেনা ছিল বেহালার সখের বাজারে। ওরা সেখানে বাড়ি করে উঠে চলে গেল। তানিয়াও ওদের
সাথে যাবার জেদ ধরলে সুবিনয় কোনো আপত্তি জানাল
না। মনীশের বড়ো জ্যেঠিমা বাড়ির মেয়েকে নিজের
বাড়ি ফিরিয়ে আনতে চাইলেও সেকথা ধোপে টিকল না। শেষমেশ পরাণ মামা তানিয়াকে দত্তক নিয়ে
নিল।
মীনা মাসির
শ্বশুর শ্বাশুড়ির সাথে বনিবনা হচ্ছিল না। প্রাইভেট কোম্পানিতে অল্প মাইনের চাকরি করা
গগণ মেশো পাকাপাকি ভাবে উঠে এল জগদীশের বাড়ি। বুলা বড় হচ্ছে, ওর পড়াশোনা বিয়ের খরচ
সব দুশ্চিন্তার অবসান জগদীশ। তিনি নিজের টাকার অংশ দুই মেয়ের তিন নাতি নাতনিকে লিখে
দিলেন। রাধা মারা যেতে মনের দিক থেকে নয়, শারীরিক ভাবে ভেঙে পড়ল জগদীশ। গ্যাসের চল শুরু হতে জগদীশের কয়লার দোকান উঠে গিয়েছিল। নীতা সেখানে নিজের
সুন্দর হাতের কাজের আর সেলাই ফোঁড়াই এর এগজিবিশন দিত। শেষে বাজার বুঝে ঠাকুরের মুকুট গয়না ও পোষাক তৈরি করে
বিক্রি করছিল। গোবিন্দ আর নীতাদিদা সেটা রমরমিয়ে চালাচ্ছিল। গগণ এসে আগেই গোবিন্দকে
চুরির বদনাম দিয়ে ওইবাড়ি ছাড়তে বাধ্য করল। নীতা দিদার দোকান কেড়ে নিয়ে সেখানে কাপড়ের
ব্যবসা খুলল মীনা। এমন কি নীতার বাবা মা যে প্রচুর সোনা রেখেছিল কালো মেয়ের বিয়ের জন্য
আর কিছু শেয়ারের কাগজ, সেগুলো আগেই হাতিয়েছিল জগদীশ। সোনাগুলো বিক্রি করে, আর ব্যাঙ্কের
কাগজপ্ত্র তার বড়ো নাতি মনীশের নামে আর তানিয়ার নামে করে দিয়েছিল। মনীশকে খুব ভালোবাসতো
নীতা তাই আর আপত্তি করেনি। তানিয়ার নাম ঢোকানো নিয়ে ক্ষুন্ন ছিল। তার দাদাবাবু বুঝিয়েছিল
ছোটগিন্নি আমি তো আছি নাকি? ওদিকে নীতার নাম মুছে দিয়েছিল সব জায়গা থেকে। জগদীশ মারা
যাবার পরে মনীশ আর তানিয়ার দয়ায় হাত চেয়ে বেঁচে থাকলো নীতা। দাদু বেঁচে থাকতেই মীনা
মাসি এবাড়ি চলে আসে। গোবিন্দকে তাড়িয়ে দুদিন ভাত দিয়ে এসেছিল দাদুর ঘরে। নীতাদিদাকে
কিছু দেয়নি, তাই ভাত ফেলে দিয়েছিল দাদু। সেই থেকে নীতা দাদু একসাথে রেঁধে খেতো আর মীনা
মাসিদের হাঁড়ি আলাদা। মাসি বোনঝির ঝগড়ায় কাক চিল বসতো না বাড়িতে। দুঘর ভাড়াটিয়া উঠে
যেতে ফাঁকা বাড়িতে ওদের ঝগড়ায় আর মাত্রাজ্ঞান থাকতো না। দোতলায় দাদুর ঘরে ব্যাঙ্কের
কাগজপত্র বুঝতে এসে লজ্জায় পড়ে যেত ওদের একতলা থেকে উঠে আসা চিৎকারে। দাদুর দিকে আড়
চোখে তাকালে দেখ তো শুয়ে শুয়ে দাসু ওদের ঝগড়াটা উপভোগ করছে।
তুমি মরতে
পারোনা ছোটমাসি,বাবার সাথে তো সারাজীবন ফস্টি নস্টি করে কাটালে। স্বামী স্ত্রীর মতো
জীবন কাটিয়ে আমাদের শান্তশিষ্ট মা টাকে শেষ করে দিয়েছিলে তুমি,তোমার লজ্জা করেনা? আর
গোবিন্দর সাথে লীলাকীর্তন, সেকথা ভেবেছ জানিনা আমরা? মুখ সামলে কথা বল মীনা। তোদের
বাপটা কম কিসে? গৌরিদির হাতের চড় খেয়েও তো সোজা হয়নি। আর ওঘরের বিধবা ভাড়াটিয়া ননীদি
কবার পেট খসিয়েছিল জানিস? মুখ খোলাস না আমার। আর ননীর মেয়েটা তো দাদাবাবুকে দেখলেই
গলা জড়িয়ে ধরতো। ধিঙ্গি মেয়ের আদর খাবার কতো শখ! যেন নিজের বাবা। মা মেয়ে দুজনাই তো
শেষে দাদাবাবুকে নিয়ে লীলা করতো। আরো শুনবি? তোদের মেজো মাসিকে ওনার দস্যিপনার ভয়ে
সাত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিতে হয়েছিল। আর জাহাজে যে কতো বিদেশিনীর সাথে ঢলেছে কে জানে!
মনীশ লজ্জা
পেয়ে তাড়াতাড়ি উঠে পড়তে চাইলে দাদু বলতো, বসো ভাই। লজ্জা কি! পুরুষ মানুষের এগুলো তো
গর্বের জায়গা। না দাদু আজ যাই। টীচার বাড়িতে এসে বসে থাকবে। পালিয়ে বাঁচতো মনীশ। নিজের
বাবা জ্যেঠুকে এমনভাবে দেখেনি কোনোদিন। ওবাড়ির পরিবেশ খুবই ভালো। তাই এই লজ্জাটা যেন
তার নিজেরই মনে হতে থাকল।
চিতার
আগুন জ্বলার আগেই শ্মশানের চুল্লির দরজাটা সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল। মনীশ বর্তমানে ফিরে
এল। রাজীব তপন আর বাবুরা ওকে চা খেতে বাইরে
অপেক্ষা করতে ডাকল। মনীশ উঠে গিয়ে গঙ্গামুখী পাতা একটা খালি বেঞ্চিতে বসে পড়ল। তোরা
যা আমি একটু এখানে একা বসি। ওরা চা খেতে বেরিয়ে গেল। গঙ্গায় ভোরের শোভা সেখতে দেখতে
মনে পড়ল কদিন আগেই গগণ মেশোর সাথে এসেছিল মীনা মাসির পিন্ড ভাসাতে। মীনা মাসির ব্লাড
ক্যান্সার ধরা পড়েচগিল লাস্ট স্টেজে। এক বছরো কাটেনি। সদ্য বিদেশে বিয়ে হওয়া বুলা যখন
স্বামী নিখিলেশের সাথে এসে পৌঁছলো তখন মীনা মাসির বডি তিন দিন ঠান্ডা মর্গে প্রিজার্ভ
করা আছে। গগণ মেসো আর তাকে জড়িয়ে বুলার সেকি
কান্না। তান্যা আর ওর স্বামী প্রীতম অনেক কষ্টে সামলায় ওকে। গগণ মেসোকে নিয়ে বুলা বিদেশে
স্থায়ী হতে সবাই মিলে বাড়িটা প্রোমোটারের হাতে তুলে দিল। মানা আর সুবিনয়ের মৃদু আপত্তি
টিকল না। সুবিনয় আর মনীশ পাড়ার পাশেই একটা এক কামরার ঘরের ব্যবস্থা করে নীতাকে দেখভাল
করতে লাগল। মনীশ নীতাকে নিজের বাড়ি নিয়ে রাখতে চাইলে ওর জ্যেঠিমা আর জ্যেঠু আপত্তি
জানাল। ওই কুলটা মেয়ের গুণপনা পাড়ায় সবাই জানতো। কিছুদিন কিডনির সমস্যায় ভুগছিল নীতা,
এর মাঝেই হঠাৎ হার্ট এটাক। সুবিনয় ডাক্তার হয়েও কিছু করতে পারল না। একটা অধ্যায়ের
শেষ হল। রাজীবরা ওকে ডাকছে। দাহ সমাপ্ত। চল তোর ছোটদিদার পিন্ড আনবি গঙ্গায় ভাসাতে
হবে তো। চোখের জলে ভেসে ভাসিয়ে দিল নীতাদিদার শেষ স্মৃতিটুকু।
চোখের
জল এবার মনীশের বুকের কাঁটা হয়ে বিঁধছে। নীতা দিদাতো জগদীশ দাদুকে নিখাদ ভালোবেসেও
ঠকে গেল। মনীশ কি আর কাউকে কোনোদিন ভালোবাসতে পারবে! আই আই টিতে বিটেক পড়া ঈশানী তো ওর জন্য পাগল। আই বি এম এর ইঞ্জিনিয়র মনীশ,
কি কোনোদিন ওর ভালোভাসার বুকে নিশ্চিন্তে মাথা রাখতে পারবে? গঙ্গার ওপারে তখন ভোরের
নতুন সূর্য উঠতে শুরু করেছে। একি তবে কোনো নতুন দিশার সঙ্কেত?
সমাপ্ত
সুজাতা দে : কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন