ক্যাজুয়াল খালাসি



গল্প

গোলপার্ক, মিস্টার দেবপ্রিয়  বসাক ডেপুটি চীফ ইঞ্জিনিয়ার মেট্রো রেলওয়ে, তার বাড়ি এইখানেই।
মিস্টার বসাকের ড্রইংরুম। বসাক যে সোফাটায় বসে আছেন তার উল্টোদিকের সোফায় বসে আছেন মিসেস বসাক। এমন সময় দেব প্রবেশ করলো। দেব চক্রবর্তী এই গল্পের নায়ক।
মিস্টার বসাক, 'এইযে তোমার কথাই ভাবছিলাম কি খবর?'
দেবের অবিন্যস্ত বেশভূষা। মাথার চুলে বারকয়েক আঙুল চালিয়ে বলে,
'ভালো নয় স্যার। আপনি যদি না দেখেন আমার পরিবার টা বাচবে না স্যার। কাকুর বাড়ি হয়ে আসছি, বললেন আপনার সাথে আর একবার দেখা করতে।'
দেবপ্রিয় বাবু বিস্মিত হন, ' কাকু! তুমি মজুমদার দার কথা বলছ? আশ্চর্য! পরক্ষণেই বসাকের চোয়াল দৃঢ় হয় কেমন আছেন তিনি?'
দেব বুঝতে পারেনা বসাকের চোখেমুখে এত কাঠিন্য কেন।
থেমে থেমে বলে, ' ভালো ভালো আছেন।' দেবপ্রিয় বাবুর চোখদুটিতে যুগপৎ রাগ ও বিস্ময় ফুটে ওঠে। মিসেস বসাক স্তম্ভিত!
বলেন, ' তার মানে তুমি বলতে চাও তিন জীবিত !'
দেবপ্রিয় বাবু জিজ্ঞাসা করেন, 'আজকেই দেখা হয়েছিল? '
 দেব অজানা আশঙ্কা নিয়ে বলে, ' হ্যাঁ আজকেইতো। আমি ওনার বাড়িতে প্রায়ই যাই। উনি আমাকে খুব ভালোবাসেন তাই না গেলে...'। মিসেস বসাক জিজ্ঞাসা করেন, 'উনি তোমাদের কেমন আত্মীয়? '
দেব বলে,' কাকা কাকার থেকেও বেশি ইয়ে মানে....।'
মিসেস বসাক স্বগক্তি করে, 'অসহনীয় মিথ্যেবাদী একটা!'
দেবপ্রিয় বাবু হাতের ইশারায় মিসেস কে  থামিয়ে দেন।
বলেন, ' তখন কি করছিলেন তিনি? তোমার সাথে তার কিছু কথা হয়েছে? উত্তর দাও। কি করছিলেন তখন মজুমদার দা?'
দেব অপ্রস্তুত। অনুমান করে চক্রব্যূহে ঢুকে পড়েছে সে। তবুও শেষ লড়াইটা চালিয়ে যায়। বলে, ' মজুমদার বাবুর সাথে আমার দেখা হয়েছিল কথা হয়নি।'
মিস্টার বসাকের চোয়াল একই রকম দৃঢ়। মিথ্যার শেষটা দেখতে চান তিনি।
মিসেস বসাক উপভোগ করছিলেন। বলেন,  'কি করছিলেন তিনি?'
দেব বলে, 'আমি ওনাকে ভেতরের ঘরের দিকেই যেতে দেখেছিলাম। '
বসাক, ' তার আগে বা পরে দেখনি?'
দেব, 'উনি ওনার ভাইয়ের সাথে কথা বলছিলেন। '
মিসেস বসাক, 'অসহ্য একটা মিথ্যেবাদী। এর প্রতি স্নেহ অকারণ।'

মিস্টার বসাক কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বিষন্ন কণ্ঠে বলেন, 'উনি আর নেই। মজুমদার দা গত পরশু মারা গেছেন। যেদিন তোমাকে নিয়ে আমার বাড়িতে এসেছিলেন সেই রাতেই।'

দেবের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। ধরণী দ্বিধা হও আমাকে এই দুঃসহ মুহূর্ত থেকে রক্ষা করো। মাথানিচু কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।গলার স্বর ম্রিয়মান, 'স্যার আমাকে ক্ষমা করুন।'
মিসেস বসাক উত্তেজিত, ' ইউ মিন মাইন্ডেড লায়ার বেরিয়ে যাও এবার এ বাড়ি থেকে।'

দেবপ্রিয় বাবু এখন আর ক্রোধান্বিত নন। তাঁর কণ্ঠে কোমলতা, 'মিথ্যে বললে কেন?'
দেব কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে, ‘আপনার বাড়িতে যেদিন মিস্টার মজুমদারের সাথে এলাম সেই দিনই ওনার সাথে আমার শেষ দেখা। ওনার হার্টের ট্রাবল ছিল। সেদিন উনি কিছুটা অসুস্থ বোধ করছিলেন। একটু যেন ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছিলেন। '
দেবের গলা রুদ্ধ হয়ে আসে।
দেবপ্রিয় বাবু বলেন, 'বলো তারপর কি হল?'

দেবের সেদিনের ঘটনা মনের আয়নায় ভেসে ওঠে। বসাকের বাড়ি থেকে বেরিয়ে গোলপার্ক বাসস্টপেজ  মিনিট পাঁচেক পথ। এতটুকু পথ আসতেই মজুমদার বাবু বেশ হাঁফাতে থাকেন। দেব বলে, 'কাকু আপনি সুস্থ বোধ করছেন না। চলুন পাশের দোকানের টুলটার উপর বসে একটু জিরিয়ে নেবেন।'
মজুমদার বাবু বলেন, 'আরে না না, ঠিক আছে, বয়স হয়েছে হার্টের ট্রাবল টা দুদিন একটু বেশিই হচ্ছে।'
দেব বলে, 'তবে আজ না এলেই হত।'
মজুমদার বাবু বলেন, 'না না, ঠিক আছে। আমার শরীরের থেকেও তোমার চাকরিটা বেশি প্রয়োজন। আজ না এলে হয়তো আর আসাই হতো না। জানো তখন সাউথ ইস্টার্ন রেলে ছিলাম। বসাক সেসময়  আমার আন্ডারে ছিল। আমি ছিলাম এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার। আর ও ছিল অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার। তারপর আমি রিটায়ার করি। এখন ও কতো উন্নতি করেছে। এক্সিকিউটিভ হল। তারপর ডেপুটি চিপ ইঞ্জিনিয়ার। কিছুদিনের মধ্যেই সেক্রেটারি টু জিএম। আর এখন ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার।
আমাকে খুব শ্রদ্ধা করতো। এখনও করে। আমার কথা ও ফেলতে পারবে না। চাকরি তোমার একটা হবেই। মনে  জোর রাখো, ভেঙে পড়লে চলবে না। সময় বলে দেবে তোমাকে কি করতে হবে।
এটা কোন স্টপেজ এলো?'
দেব বলে, 'গাঙ্গুলি বাগান।'
মজুমদার বাবু বলতে থাকেন, 'কতদিন পর বাড়ির বাইরে বার হলাম। চেনা জায়গাও অচেনা মনে হয়।অথচ অফিস যাওয়া আসা এই পথে গাড়ি করে যেতাম।আরে রামগড় তো এসে গেল। তুমি বাড়ি যাবে তো?'
দেব বলে, 'আপনার শরীর ভালো নয়। আপনাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়েই ফিরব।' মজুমদার বাবু বলেন, 'আরে না,আমি ঠিকই আছি। ঠিক চলে যেতে পারবো। ভেবোনা। তুমি আবার কষ্ট করবে কেন! বাস ছেড়ে দেবে যে। তাড়াতাড়ি নেমে পড়ো।'

দেব তড়িঘড়ি নেমে পড়ে, 'আসি কাকু। সাবধানে যাবেন।'  বাস ছাড়তে ছাড়তে মজুমদার বাবু হাত নাড়েন.  ' ' 'তিন চারদিন পরে বসাকের সাথে দেখা কোরো। আমাকে জানিও কতটা কি হলো।'

নিঃশব্দ সময়। বাতাস থমকে গেছে। দেবপ্রিয় বাবু মাথানিচু করে চোখ বন্ধ করে বসে। মিসেস বসাক বাক্য হারা।

দেব নীরবতা ভঙ্গ করে। স্যার আমার একটা চাকরির প্রয়োজন। যদি আপনি ভাবেন উনি আমার নিতান্তই অনাত্মীয়, কোন ঘনিষ্ঠ পরিচয় নেই। সেই ভেবে আপনি যদি চাকরি না দেন তাই আমি মিথ্যে বলেছি। বোঝাতে চেয়েছি উনি আমার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়, ওনার বাড়িতে আমি প্রায়ই যাই। কিন্তু স্বপ্নেও ভাবিনি এত বড় একটা মর্মান্তিক সত্যি আমার মিথ্যে কে এইভাবে বিদ্রুপ করবে, ঘৃণা করবে। স্যার, একটা মিথ্যেবাদী কে আপনি নিশ্চয়ই চাকরি দেবেন না। চলি স্যার। যদি পারেন ক্ষমা করে দেবেন। '
দেব দরজার পথে পা বাড়ায়।

দেবপ্রিয় বাবু এতক্ষন স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেবের কথা শুনছিলেন। দেব দরজার দিকে পা বাড়াতে গম্ভীর উদাস গলায় ডাকলেন, 'শোন। আমার কাছে মজুমদার দাদার শেষ ইচ্ছে কি ছিলো তুমি জান? উনি বলেছিলেন, "বসাক এই ছেলেটা একটা চাকরি পাক। চাকরিটা ওর খুব প্রয়োজন।" সেটাই ওনার জীবনের শেষ রাত, যে রাতে উনি তোমার সাথে এ বাড়িতে এসেছিলেন ।'
দেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে, 'ভগবান, আমাকে ক্ষমাকরো।'।
মিস্টার বসাক বলেন, 'মজুমদারদার শেষ ইচ্ছে তোমার একটা চাকরি। আমি অবশ্যই তোমার জন্য চেষ্টা  করব। আগামী সপ্তাহে অফিসে দেখা করো।'

দেব চাকরি একটা পেলো। ডেপুটি চিফ ইঞ্জিনিয়ার (সিভিল) সয়েল সেলের  আন্ডারে ক্যাজুয়াল খালাসি দেব। সহকর্মীদের সাথে আলাপ হলো। আপাদমস্তক বিনয়ী ভদ্র চেহারার দেবকে দেখে সবারই ভালো লাগলো। ওরা কেউ কেউ দেবকে হাসতে হাসতে দেবের সাথে করমর্দন করে বলল, 'আজ থেকে তুমি হলে শিক্ষিত গভর্নমেন্টের কুলি।'

দেব তখন বিএসসি পাশ করে এ.এম. আই. ই পরছে সুতরাং এই বিশেষণটা দেব এর ক্ষেত্রে বেমানান ছিল না। সহ কর্মীদের মধ্যে ভানু রবি খোকন অঞ্জন ছাড়া চৌধুরী বাহাদুর অনিল সুরেশ আরও অনেকে শিক্ষায় দীক্ষায় স্বভাব চরিত্রে যাকে বলে ইনবর্ন লেবার।

প্রথম দিনে দেবের ডিউটি পড়ল ভবানীপুর কানাড়া ব্যাংক সাইটে। মেট্রো রেলের মহা কর্মযজ্ঞ চলছে। সেটা ১৯৮১ সাল। ওধারটায় সবে দশ ফুট মাটি কাটা হয়েছে। মাটি কাটছে মজুরের দল। এধারে মাটি কাটা শেষ হয়ে বক্সের রড বাইন্ডিং হচ্ছে। হিপ্ পয়েন্টে  মেজারমেন্ট করতে গেলে উপরকার সেকেন্ড স্টারে উঠতে হবে। এখানে মাটি কাটা হয়েছে পঞ্চাশ ফুট। এর জন্য চল্লিশ  ফুট লম্বা অ্যালুমিনিয়াম ল্যাডার আসে হাজরা অফিস থেকে। বয়ে নিয়ে আসে ভানু রবি চৌধুরী অনিল এরা এবং আজ থেকে দেব। ওরা  খালাসিরা।

সাইট ইনচার্জ, ইন্সপেক্টর অফ ওয়ার্ক বি কে কর্মকার। মোটা ভুড়ি নিয়ে আই. ও. ডব্লিউ কর্মকার তেমন কাজের ধকল সহ্য করতে পারে না। শরু একখানা লোহার রড ধরে ডায়াফ্রাগাম ওয়াল ধরে ধরে এই বিম থেকে ওবিমে যাওয়া আসা ওর পক্ষে খুব বিপৎসংকুল ও সেটা বোঝে। আর বোঝে বলেই ওর এই খামতিটা খালাসিদের উপর মুখ ঝামটা দিয়ে তাদের মেহনত দিয়ে পুষিয়ে নেয়। সময় সময় যে বেগরবাই হয় না তানয়।

এইতো সেদিন, খোকনকে ধমক দিতেই নিজের বিপদ ডেকে এনেছিল। তিরিশ ফুট গভীর টানেলের যে অংশটায় হিপপয়েন্ট বসে ছিল সেখানে বর্ষার জল জমে প্যাচপ্যাচে কাদা আবর্জনা দুর্গন্ধ ভরা। কর্মকার উপরে বসে চেঁচায়, 'ও ম্যান উতরো। '
খোকন রাগত স্বরে বলে, ' শালা কি আমাকে বলছে! শুয়োরের বাচ্চা ভদ্রভাবে কথা বলতে জানেনা! কর্মকার আবার চেঁচায়, 'কি হল কাঁচা কার্তিক সেঁজে দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে নিচে নাম।'
খোকনও গলা ছেড়ে চেঁচায়, 'সুপারভাইজার স্পটে না থাকলে কোনো কাজ হবে না। নিচে নাম শালা। মোটা টাকা মাইনে নিচ্ছ আর উপরে বসে চেঁচাচ্ছ?'
রাগে কর্মকারের মুখ লাল হয়ে গেছে, 'শালা হারামী তোর চাকরি খাবো। পেটে লাথি মারবো। ভাতে মারবো।
খোকন উত্তেজিত। দ্রুত পায়ে উঠে এসে মুখোমুখি সোজা হয়ে দাড়ায় কর্মকারের। সাপটে ধরে জামার কলার। চোখে ওর আহত সাপের দৃষ্টি। বলে, 'কি বললি খুব বার বেড়েছো। তোমার শরীরে মানুষের চামড়া আর আমাদের চামড়ারাটা কি গন্ডারের?'
পাশেই ছিল একটা ফলের দোকান।সেখান থেকে একটা চাকু তুলে নিয়ে নিজের হাত চিরে দেয়। বলে, 'দেখ শালা, তোর রক্ত আর আমারদের রক্ত কি আলাদা? বল বল?'
      
সাইটে উপস্থিত অন্যান্য মজুরেরা ছুটে আসে। উত্তেজিত খোকনকে সরিয়ে নিয়ে যায়। কর্মকার ফুঁসতে থাকে।
' আচ্ছা আমার নাম বিকে কর্মকার। এমন অনেক দেখেছি। দেখে নেব ।'
দেব বলে, 'দোষটা আপনার। খোকন আপনার বাড়ির চাকর নয়। মনে রাখবেন প্রত্যেককেরই একটা মান সন্মান আছে। কেন আপনি মুখ খারাপ করছেন? আপনার একটা পদমর্যাদা আছে, সেটা গালাগাল দিয়ে বোঝাবার দরকার ছিলনা!'
কর্মকার ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে দেবের দিকে তাকায়, 'ওহো প্রথম দিনেই নেতা হয়ে গিয়েছো? দাড়াও তোমারও ব্যবস্থা হচ্ছে। যাও যাও নিজের কাজ করো। ড্রামটাতে জল ভরে কানাড়া ব্যাংকের ওয়াটার লেভেল টা চেক করো।
ভানু, পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থেকো না। ডিমক পয়েন্ট রিডিং টা দেখে নাও। কাজ হয়ে গেলে রিডিংটা আমাকে দিয়ে যাবে।
এই চৌধুরী, একটা চা নিয়ে এসো ।শালা মেজাজটা খিঁচে দিল!'

মাটি কাটছে মজুরের দল। ওরা ঠিকাদার শ্রমিক। বিকে কর্মকার ইনস্পেক্টর অফ ওয়ার্কস মাঝে মাঝে অফ ডিউটিতে সাইটে ভিজিট করেন। ভাবখানা এমন যেন কাজ অন্তপ্রাণ। এমনই  একদিন।
'নূতন বুঝি। মেয়েটাতো বেশ  টইটুম্বুর রে কচি। এই কচি উর নাম কিরে?'
কচি, ' কুনটা?'
সব মহিলা শ্রমিকের উপর এক ঝলক চোখ বুলিয়ে নেয় কচি।
কর্মকার, 'আরে ওই যে নতুন বটে। '
কচির চটুল চোখের নাচন ছলাৎ ছলাৎ করে উঠে। বলে, 'উতো গুলাবি আছে। হেঃ হেঃ হিঃ হিঃ, তোর মনে ধরচে বাবু? তোর মনের উথাল পাতাল টের পাইছি। উতো কালুর ভালোবাসা আছে। উকে ছাড়। মুই যামু আজ রেতে।'
কর্মকার শয়তানের হাসি হাসে, 'কালুর ভালোবাসা!  হেঃ হেঃ হেঃ, ছ্যা ছ্যা। একটা শাড়ি কিনে দেবার মুরোদ নাই বেটার। ওতো লজ্জা ঢাকতে নাড়ছে! এই কচি একবার কালুকে ডাকতো।'

কচি খাদের দিকে তাকিয়ে উবুহাটু হয়ে বসে চেঁচায়, 'এই কালু কালুরে, ওপরে উঠে আয়। সাইটবাবু ডাকতাছে।'
সাইটবাবুর ডাক বলে কথা। কালু জোয়ান ছেলে। দুই মিনিটেই তরতর করে ওপরে উঠে আসে।
     
ওকে এখন মৃগয়ার মিঠুন চক্রবর্তী দেখতে লাগছে। পেশীবহুল ঘর্মাক্ত শরীর।কর্মকার ভেবে পায়না পান্তা ভাত আর কাঁচা লঙ্কা খেয়ে এমন পেশীবহুল চেহারা হয় কি করে !
'বাবু আমায় ডাকতাছেন? '
কর্মকার কানের সামনে মুখ নিয়ে এসে ফিস ফিস করে বলে, 'মজুরির উপর পাঁচশ টাকা বেশি দিবো, আজ রেতে গুলাবিকে, বুঝলি খুশি করতে পারলে তোকে হেড মজুর বানিয়ে দিবো।'
কর্মকার চোখের চটুল ইসারা করে।
কালু কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে, 'বাবু গুলাবি আমার জান আছো। ওর দিকে নজর দিসনা।'
'ধুর শালা জান ধুয়ে কি জল খাবি! তোর গুলাবি তোরই থাকবে। এক ঘন্টা পরেই তো ছেড়ে দিব। যা বললাম মনে থাকে যেন।'
কর্মকার রাগত অঙ্গ ভঙ্গি করে চলে যায়।

কচি শরীরের ঢেউ তুলে এগিয়ে আসে, 'হিহিহি মরেছে ইঁদুর বেচারা। এখন বোঝনা কেনে আমাগোও  নাগর ছিল গো। বুকফাটা চিৎকার করছি, মুখ দিয়া কথা সরেনাই। একশটা টাকা দিয়া ইজ্জত কিইনা নিছে। মনে নাই সে রেতের কথা, যে রেতে আমারে ফুসলাইয়া বাবুর ঘরে  ছাইড়া দিয়া আইলি? বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়াইয়া তো কুকুরের মত পাহারা দিতাছিলি। আজ রাতে কচির জায়গায় গুলাবি। তুই পোষা কুত্তা হইয়া দরজায় দাঁড়ায় থাক।হেঃ হেঃ হাঃ হাঃ।' কচি বেনুনী দোলাতে দোলাতে নিচে নেমে যায়।

বেশিদিনের ঘটনা নয়। কালুর মনেপড়ে, কচি, পিয়াসা, ফুলি, কামিনী, ওদের সবাইকে ফুসলিয়ে একে একে ছেড়ে দিয়ে এসেছে বাবুর ঘরে। বিনিময়ে মজুরি বেড়েছে পঞ্চাশ টাকা। পঞ্চাশ থেকে একশ টাকা। আবার থোক পাঁচশ  টাকাও রাত পিছু পেয়েছে। লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু! তখন কি কালু জানতো গুলাবি, তার ভালোবাসা  গুলাবিকেও একদিন এভাবেই ছেড়ে দিয়ে আসতে হবে বাবুর ঘরে!

এযেন বনের রাজা সিংহ। প্রতিদিন একটা করে পশু তার খাদ্য হিসেবে চাই।

কালু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে, 'হে ভগবান কেন যে ওরা আমাদের বাঁচতে দিতে চায় না ! গুলাবি আমারে ক্ষমা করিস। গরিবদের সতীত্ব থাকতে নাই রে ! '

দেবের চাকরি জীবনের অভিজ্ঞতা এমন ভাবেই শুরু হল। যতদিন যায় প্রায় ভুলতে বসেছিল শিক্ষার যথার্থ প্রয়োগ টা কি এবং কেমন। কাজের নাকি কোনো ছোটবড় ভেদাভেদ নেই। তবে কেনো এতো অপমান বঞ্চনা? শিক্ষিত হয়েও অশিক্ষার বোঝা বয়ে বেড়ানোর দুঃসহ জ্বালা! কৃতদাস প্রথা কাহিনীগুলো যেন চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠত। সে এক অসহনীয় যন্ত্রণা।

ক্যাজুয়াল চাকরি। নো ওয়ার্ক নো পে। কামাই না থাকলে মাস শেষে সর্বসাকুল্যে দুশো চল্লিশ টাকা। তাতে পাচজনের মুখের ভাত জোটেনা। তাই অফিস ফেরত একটা টিউশনি করে দেব।

অদ্বিতীয়া এবার স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা দেবে। দেব ওর সাইন্সের শিক্ষক। বিপর্য্যস্ত জীবনে ও ছিল একমাত্র বসন্তের হাওয়া।

ময়না পাখির খাঁচায় দোলদেয় অদ্বিতীয়া। পাখিকে কথা বলা শেখায়। পাখি কথা বলে।
অদ্বিতীয়া, 'বল কথা বল বলনা? '
ময়না পাখি কথা বলে, 'কে এলো কে এলো? '
অদ্বিতীয়া, 'ধুর ছাই, বল অনি মাস্টার এসেছে। 'পাখি, 'মাস্টার.....মাস্টার। অনি মাস্টার এসেছে।'
অনিন্দিতা আনন্দে হাততালি দেয়।
দেব দোতালায় পড়ার ঘরের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে শুনছিল। খুব ভাল লাগছিল ওর।
'বাঃ বেশ চিনেছে তো !
অদ্বিতীয়া, 'ওমা, আপনি! ' লজ্জা পেয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায়।
অদ্বিতীয়ার মা রান্নাঘর থেকে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে বেরিয়ে আসে।
'দেখেছ মেয়ের কান্ড, মাস্টার এসেছেন বসতে না বলে পালিয়ে গে ! যান আপনি উপড়ে যান। ও ওর পড়ার ঘরেতেই আছে।'
দেব উপড়ে যায়। অদ্বিতীয়া মুখ নিচু করে বসেছিল। লজ্জা মাখা মুখ তুলে তাকাল।
দেব, ' কি হলো? '
'আপনি শুনেছেন। '
'কি শুনেছি?'
'কিছু না যান। ওমা! একি দেখি দেখি কেমন যেন শুকনো দেখাচ্ছে মুখটা। জ্বর হয়েছিল খুব জ্বর? টেম্পারেচার কত উঠেছিল? '
দেব, 'আমার কিছু হয়নি তো! সত্যি আমার কিছু হয়নি। '
অদ্বিতীয় রাগ করে।  তবে তিনদিন আসেননি কেন? আমি ভাবছিলাম! 'অভিমানের দুটি ঠোঁট ফুলে উঠে।'
দেব বলে, 'ধানবাদ গিয়েছিলাম,অফিসের কাজে। হটাৎই যেতে হলো।'

দেব মনে মনে ভাবে, ধানবাদ অফিসের কাজ! অদ্বিতীয়া তুমি জাননা, তুমি ভাবছ কি না কি, বোধহয় বিরাট কিছু। তোমাকে কি করে বোঝাই আমি একজন ক্যাজুয়াল খালাসি। '

ইনক্লাইনোমিটার প্রেসার সেল বসবে টালিগঞ্জ সাইটে ডায়াফ্রাম ওয়ালে। সেই জন্য প্রয়োজনীয় মেশিন গুলোর খুঁটিনাটি বোঝানোর জন্য ধানবাদ রিসার্চ সেন্টারে ট্রেনিং নেওয়ার জন্য মনোনীত হলো অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার মিস্টার দাস এবং আই ও ডব্লু বিকে কর্মকার। সাইট ইনচার্জ বি কে কর্মকারের রাগটা দেবের উপর একটু বেশি ছিল। তাই প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি গুলো বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য দেবকে আর ভানুকে যোগ্য বলে মনে করল। সিনিয়র রিসার্চ  অ্যাসিস্ট্যান্ট রায়বাবুর কিছুটা সহানুভূতি ছিলো দেবের উপর।
'না না দেব পারবেনা। পড়াশুনা জানা ভদ্র ছেলে। অতো ভারী মাল, এত দুর বয়ে নিয়ে যাওয়া....কর্মকার আপনি চৌধুরী বা বাহাদুর কে নিয়ে যান। দেবকে দিয়ে ওসব কাজ হবে না।'
                   
কর্মকারের ভ্রু-কুঞ্চিত হয়। কিন্তু সিনিয়র রায়ের উপর বিরক্তি প্রকাশ না করে হাস্য মুখে বলে,' স্যার, এদের নিয়েই আমাকে সাইটে কাজ করতে হয়। এভাবে প্রশ্রয় পেলে আরও মাথায় উঠে যাবে। এরা নিজেরা কাজ করতে চায়না, উপরন্তু অন্য লেবারদের কাজ না করার জন্যে প্ররোচিত করে। এদের বোঝাতে হবে, তুমি খালাসি, এইটেই তোমাদের কাজ। তা না হলে ফরনাথিং এসব ইউজলেস স্টাফ রাখার কোনো মানেই হয়না। আপনি অমত করবেননা। 'রায় বাবু আর কথা বাড়ননি।

এলো সেই নির্ধারিত দিন। গো টু ধানবাদ।
সকাল আটটার মধ্যেই ইডেন গার্ডেন্স মেট্রো সয়েল সেলে হাজির গ্রুপ অফ্ ধানবাদ।

কর্মকার, 'দেব, ভানু দেখে নাও। এই বাক্স দুটোতে আটটা প্রেসার সেল আছে। দুজনে দুটো বাক্সের দায়িত্ব নেবে।'
ভানু, 'ওরে বাবা এ যে ভীষণ ভারী !'
দেব, 'এই মাল বইবার জন্য আরও দুজন লোক বুক করা দরকার ছিল।'
কর্মকার, 'শুরুতেই এই,তারপর হয়তো বলবে আপনিও কাঁধ লাগান।'
ভানু, ' তাতে আপনার জাত যাবে না!'
কর্মকার, 'বকবক করো না। নাও কাঁধে তোলো। চাঁদপুর লঞ্চঘাট এ নিয়ে যাও। ওখান থেকে লঞ্চে হাওড়া। সেখান থেকে প্লাটফর্ম পযর্ন্ত নিয়ে  যেতে বেশি সময় লাগবে না। দাস সাহেব এক্ষুনি আসবেন।'

ঠিক এমন সময় দাস সাহেবের গাড়ি এসে থামল। তড়িঘড়ি চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন।
'কর্মকার, সব ঠিক আছে তো?  এই দুজন যাচ্ছে? ভালো আমি স্টেশনে যাচ্ছি। আপনি মালগুলো গাইড করে আনুন।'
দেব শশব্যস্তে বলে উঠল, 'স্যার মালগুলো আপনার গাড়িতে নেওয়া যেতে পারে?'
মিঃ দাস বিরক্ত হন, 'ওঃ সিলি! মালগুলোর জায়গা হলেও গাড়িতে তোমাদের জায়গা তো হচ্ছেনা। স্টেশানে পৌছে মাল গুলো কি আমি বয়ে নিয়ে যাব! '
মিঃ দাসের গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বেড়িয়ে যায়।

দেব ভানু অনেক কষ্ট করে বাক্স দুটো বয়ে নিয়ে চলে। লঞ্চে করে কোনরকমে হাওড়া  ফেরি ঘাটে এসে পৌঁছায়।  ভানু, ' কাঁধ ছিঁড়ে যাচ্ছে রে।'
দেব, ' খালাসির কাঁধের চামড়া গন্ডারের হওয়া উচিত ছিল।'
ভানু, ' দেব, প্লাটফর্ম পযর্ন্ত  আর বয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।'

হাওড়া স্টেশন চত্বরে কুলিদের ভীড়। কোলাহল। একজন লাল জমা পড়া কুলি  এগিয়ে এলো।
'বাবু  তিরিশ রুপিয়া দেগা তো সামাল ট্রেন মে উঠা দেগা।'
দেব বলে, 'আমরাও কুলিরে। সরকারি কুলি। লাও মাল উঠাও। মিলেগা তিরিশ রুপিয়া।'
কর্মকার, 'এটা কি হলো?'
ভানু, 'একজন সরকারী কুলি আর একজন বেসরকারী কুলিকে হুকুম করলো। আপনি সরকারী চাকর আরেকজন অধস্তন সরকারী চাকরকে যেমন হুকুম করেন ঠিক তেমনি হলো।'
কর্মকার, 'বেয়াদব। আরে আরে এই ভানু কুলিটাকে কে ফলো করো। ভিড়ে মিশে গেল যে, খুঁজে পাওয়া দায় হবে।'
দেব, 'ঐ তো দাস সাহেব দাঁড়িয়ে আছে। আউর থোরাসা আগে। ঠিক  হ্যায়, এখানেই নামাও।'
ভানু ব্যস্ত সমস্ত হয়ে বলে ওঠে, 'নামিও না, নামিও না। ওইতো ট্রেন প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে। একেবারে ট্রেনের কামরায় সান্টিং করে দাও।'
কুলি, ' আউর পাঁচ রুপিয়া লাগবে বাবু।'
ভানু, জরুর মিলবে।'
মিস্টার দাস বিরক্তি প্রকাশ করে, 'তোমাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কেন? বেড়াবার জন্য? এই কুলি মাল রাখো। দেব, ভানু গো...গো.. ইউ হ্যাভ বাউন্ড টু ক্যারি দিস লাগেজ।'

ট্রেন হুইসেল দেয়। মিঃ দাস শশব্যস্ত হয়ে ট্রেনের কামরায় উঠে পড়ে। কর্মকার তাকে অনুসরণ করে।

এসি টু টায়ার। আরাম করে সিটে গা এলিয়ে দিল দুজনে। পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ হাতের ঘাম মুছল। কর্মকার পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বার করলো। একটা মিস্টার দাস কে দিল। আরেকটা নিজে ধরালো। নির্ধারিত সময়ে গাড়ি ছাড়লো।

কর্মকার বেশিক্ষন চুপকরে থাকতে পারেনা। কেমন যেন একটা উসখুস ভাব সব সময়।
দাস বাবু জিজ্ঞাসা করেন, ' কিছু বলবেন?'
কর্মকার, 'দেখলেন স্যার, ছেলেদুটো কেমন বেয়ারা! বলছিলাম না একদিন, ঐ দেবের কথাইতো বলছিলাম। দু কলম পড়াশুনা করেছে তাতেই দেমাক দেখায়। লেবারদের মগজ ধোলাই করছে স্যার। সবাই ওর কথায় ওঠে বসে। অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের  তোয়াক্কাই করেনা। দেখলেন তো স্যার পকেটের পয়সা খরচ করে কুলি দিয়ে মাল আনিয়ে আপনাকে কেমন অপমান করলো?'
মিঃ দাস সন্মতি সূচক মাথা নাড়েন। বলেন, 'ফিরে এসে আপনি অফিসে আমার সাথে দেখা করবেন। ওর ব্যাপারে যা যা অভিযোগ আছে আমাকে লিখিত জানাবেন।'
কর্মকার আহ্লাদিত হয়। বিগলিত কন্ঠে বলে, 'ঠিক আছে, ঠিক আছে, অবশ্যই স্যার। '

এক সপ্তাহ ট্রেনিং শেষে দেব, ভানু ওরা ধানবাদ থেকে ফিরে এলো। কর্মকারের দুর্ব্যবহারের মাত্রাটা আরো বাড়তে থাকলো ওদের উপর। ইনবর্ন হ্যাভিচুয়েটেড লেবারদের পক্ষেও যে কাজ করা সম্ভব ছিল না, বেছে বেছে সেই অমানুষিক পরিশ্রমের কাজ গুলো দেব দের মতো পড়াশোনা জানা ছেলেদের বিয়ে করানো হতো।

কর্মকার, 'ভানু, দেব তোমরা দুজনে যাও। রাসবিহারী এভিনিউ সাইট অফিস থেকে অগার গুলো নিয়ে এসো। কুড়ি মিটার বোরিং আজকেই কমপ্লিট করতে হবে।'
দেব, 'অতগুলো মাল আনতে হবে! মাত্র দুজনে হবে না। আরো লোক দিন।'
কর্মকার, 'খুব হবে। একবারে না হয় দুবার যাবে। সময় নষ্ট করো না। নিজেকে খালাসি বলে ভাবো। লাটসাহেব বলে নয় ! '
দেব, 'অফিসের ম্যাটাডোরটা আনলেই পারতেন? কাজটা খুব তাড়াতাড়ি হয়ে যেত।'
ভানু,' অফিসের ম্যাটাডোর গিয়েছে সাহেবের বাজার করে আনতে। এইতো অবস্থা। চল শালা, খানকির খাতায় যখন নাম লিখিয়েছি..... গোবরের আবার এপিঠ-ওপিঠ। উফ্ শালা এত্তা গরম আমার বাবার লাইফে কোনদিন পড়েনি! জামা তো ভিজে চপ্ চপ্ করছে রে। আরে দেব, তুই তো একেবারে উদোম হয়ে গেলি রে?'
দেব গম্ভীর ভাবে বলে, ' কুলিরা যখন কাজ করে গায়ের জামা থাকে না রে।'
ভানু, ' তুই এমন কথা বলিস না মাইরি, আমরা কুলিদের থেকে একটু উঁচু না ! '
দেব, ' হু তা হবে, সরকারি কুলি। '

কর্মকার এতক্ষন একটু দূর থেকে বাঁকা চোখে ওদেরকে দেখছিল। এইবার পায়ে পায়ে এগিয়ে এলো। ' কি গুজগুজ ফুসফুস হচ্ছে! গল্প করলেই হবে কাজটা কে করবে? '
দেব, 'এক হাঁটু জল ভেঙে দু কাঁধে অগার নিয়ে এইতো সবে এলাম। একটু বিশ্রাম করে নেই।'
ভানু, ' সবে সিগারেটটা ধরা লুম।'
কর্মকার, 'আরকি আমার মাথা কিনেছো! তোমরা বসে বসে হাওয়া খাবে, অগার ঘুরাবো কি আমি? জবাবদিহি করবে দাস সাহেবকে। আমি রিপোর্ট করব তোমাদের নামে।'
দেব, 'চল। সাহেবদের কাছে গিয়ে আবার চুকলি কাটবে। ভানু রবি খোকন বিমল এদিকে আয় হাত লাগা।'

ওরা অগার ঘুরায় আর সুর করে ধুয়ো তোলে।
'হেইও মারো হেইও। প্রচন্ড রোদ হেইও। তাড়াতাড়ি করো হেইও। হারামি কর্মকার হেইও।'
কর্মকার, 'এই হচ্ছেটা কি? চুপ। কত মিটার হল?'
দেব, 'দু মিটার।'
কর্মকার, 'থামলে কেন, হাত ঘুরাও।'
ভানু, 'আর যাবেনা।পাথর পড়েছে।'
কর্মকার, 'খোকন শাবল চালাও।পাথর ভাঙ্গো।'
খোকন, 'শাবল চালাবো কি করে, শাবলের লেন্থ এক মিটার।'
কর্মকার, তোলো অগার। হু মনে হয় এই জায়গাটায় আর পাথর পরবে না। হ্যাঁ, এইখানেই করো।'
খোকন, ' গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে হুকুম চালাচ্ছে। পিঠে লোহার শিক গরম করে ছ্যাকা দিতে হয়। '

এমন সময় একটা অ্যাম্বাসাডার মোড়ের মাথায় জ্যামে আটকে পড়ে। হর্নের আওয়াজ, কোলাহল, খালাসিদের হেইও মারো হেইও মারো চিৎকার, লোহার  বিমের টুং টাং আওয়াজ সব মিলিয়ে বিশাল কর্মযজ্ঞ।

খোকন, 'গুরু অ্যাম্বাসেডরে ললিপপ। এই দিকেই চেয়ে। '
ভানু ফুর্তিতে গান ধরে,
"ওয়াং ওয়াং ওয়াং ওয়াং
পরেছে লাল শাড়ি
যাবে সে কোন বাড়ি
দেখবে যে সেই মজে যাবে। আহা,
কি দারুন দেখতে...।"
দেব, ' তোদের জোকার বলে ভাবছেরে। ওদিকে তাকাসনে। আমরা হলাম গিয়ে আঙ্গুর ফল টক গোত্রের জীব '।

লেবাররা আবার ধুয়ো তোলে, '
হেইও মারো হেইও
ছয় মিটার গিয়ে হচ্ছে এবার সাত
কর্মকার বড় বাড় বেড়েছে
দেখেছে সাপের পা পাঁচ।'
দেব খেয়াল করেনি গাড়ির মধ্যে ওর ছাত্রী অদ্বিতীয়া, অদ্বিতীয়ার মা আর ভাই বসে। ওরা সকলেই স্তম্ভিত। এমন একটা দৃশ্য দেখার জন্য কারো চোখে প্রস্তুত ছিলনা। অনুর মা বিস্ময় কন্ঠে বলে, ' অরু তোর মাস্টারমশাই না!'
ছটকু, অদ্বিতীয়ার ভাই চেঁচিয়ে ওঠে, 'মাস্টারমশাই... ও মাস্টারমশাই..।' অদ্বিতীয়া, 'ছটকু। মা-ভাইকে চেচাতে বারণ করো। ড্রাঢইভার, গাড়ি এখানে থামালে কেন?  ড্রাইভার, ' দিদিমনি, এইতো জ্যাম এতক্ষণে ছাড়লো।'

অদ্বিতীয়া মনে মনে ভাবে এত কষ্ট করে সারাটা দিন। এত অমানুষিক পরিশ্রম মানুষের সহ্য হয়। কোনদিন বলে নি। কাউকে বুঝতেও দেয়নি। দেখে বুঝতাম ক্লান্ত লাগত!
অরুর মা, 'এতো মজুরের কাজ! ছিঃ তোর মাস্টার এই কাজ করে? লোকে জানলে বলবে কি! আগে জানলে এই স্ট্যাটাসের একটা ছেলেকে... আমার মেয়ের মাস্টার ভাবতেই...!' চোখ মুখে ঘৃণা ফুটে ওঠে।
অরু, 'কিন্তু মা যে ছেলে তোমার এত প্রিয় ছিল আজ হঠাৎ অকারন তার প্রতি এত ঘৃণা?'
 মা, 'বলিস কি অরু অকারনে! তুই নিজের চোখে দেখেও?'
অরু, থাক মা। আর কথা বলোনা। তোমাদের স্নেহ-মমতা ভালোবাসা এত ঠুনকো! কাজের তো কোনো ছোট বড় জাত নেই মা! আজ ওযে শিক্ষিত ছেলে হয়েও একজন লেবারের কাজ করছে এতে ওর প্রতি সবার সহানুভূতি থাকা উচিত। আজকের দিনের অলস বেকার ছেলেদের আদর্শ আমার মাস্টার। ওর প্রতি শ্রদ্ধায় আমার মন আজ ভরে গেলো মা। যদি ধিক্কার দিতে হয়, দাও আমাদের সমাজ ব্যবস্থাকে, যেখানে শিক্ষার কোন দাম নেই। দোষ দাও তোমাদের মেকি অহমিকাকে। ওকে নয়।'

টলিগঞ্জ সাইটে  ইনক্লাইনোমিটার প্রেসার সেল বসছে। ওপেন সাইটে যাতে কেবিলগুলো চুরি না যায় সেই জন্য তিন শিফটে তিনজন চৌকিদার শিফটিং ডিউটি দেবে সাব্যস্ত হলো। আর একজন রেস্ট কিপার।ভানু, দেব,খোকন ও রবি এই চারজনকে টালিগঞ্জ সাইটে ট্রান্সফার করা হলো। নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে চারজন খালাসি হয়ে গেল চৌকিদার। হেড অফিস ইডেন গার্ডেন্স থেকে টালিগঞ্জ আট কিলোমিটারের বেশি। মাসের শেষে এসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার মিস্টার দাস কে খালাসিদের ক্লেম করা মোটা টাকার টি এ বিলে সই করতে হয়। বি কে কর্মকারের মন খচখচ করে। খালাসিদের এই আর্থিক স্বচ্ছলতা ওর মনঃপুত নয়। তাই সে প্রস্তাব দেয় এই চারজন খালাসির হেড অফিস টালিগঞ্জ করে দেওয়া হোক। অতঃপর তাই হলো।এই চারজন খালাসির টি. এ এবং ও.টি বন্ধ।

কর্মকারের হাতে কলকাঠি। অ্যাটেনডেন্ট রেজিস্টার মেনটেন করে সে। ইনচার্জ বিকে কর্মকারের হেড অফিস কিন্তুু টালিগঞ্জ নয়,ওর হেড অফিস ইডেন গার্ডেন সাইট অফিস রয়ে গেল। অর্থাৎ মাসে ছাব্বিশ টা দিনই মোটা টাকার টি. এ ওর পকেট বেশ ভারী করে। ক্ষমতার অপব্যবহার এমনি করে দিনে দিনে এমনই বাড়তে থাকে।

এমনই এক দিনের ঘটনা। মিস্টার দাস এসেছেন সাইট ইন্সপেকশনে। ঘর্মাক্ত কলেবর।  পিছনে শশব্যস্ত  কর্মকার। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেবের দিকে নজর পড়তেই ডাকলো, 'এই ছেলে এক গ্লাস খাবার জল এনে দাও। গ্লাস টা ভালো করে ধুয়ে নেবে।'
দেব জল এনে দিল। গ্লাসটা হাতে পেতেই উন্মত্তের মতো ক্রোধের চিৎকার করে ওঠে মিস্টার দাস। 'ইউ ব্লাডি এই জল মানুষ খেতে পারে? গ্লাসটা পর্যন্ত মাজোনি....!'
      
কর্মকার তাড়াতাড়ি ড্যামেজ কন্ট্রোলে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। 'দাড়িয়ে হা করে দেখছো কি? ট্রাম ডিপোর সামনে টিউবয়েল থেকে জল নিয়ে এসো।যাও তাড়াতাড়ি। সব দেখছেন তো স্যার। বলছিলাম না একটা ইডিয়েট। হাতে আবার মডার্ন ফিজিক্স নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। লোকদেখানো জিনিসগুলো ভালই রপ্ত করেছ দেখছি! অতই যদি মেরিটোরিয়াস তবে খালাসি হলে কেন বাবা?  আবার দাঁড়িয়ে থাকে! যাও জল নিয়ে এসো। আসবার পথে দুটো চা বলে আসবে।'
দেব, 'স্যার আমরা এই জলই খাই। এই রোদের মধ্যে হাফ কিলোমিটার হেঁটে গিয়ে আপনার জন্য জল আনতে পারব না স্যার।'
দাস সাহেব, 'কি বললে তোমার স্পর্ধা তো কম নয়! তুমি আমার মুখের উপর না বল?'
কর্মকার, ' দেখছেন দেখছেন স্যার! '
দেব, ' খালাসি থেকে হলাম চৌকিদার, বেয়াড়া হলাম কবে?'
দাস সাহেব,' কর্মকার আজ থেকে একে শুধু নাইটে বুক করে দাও সামনের পুরো শীতটা ও এখানেই ডিউটি করবে।'
দেব জল শুদ্ধ গ্লাসটা মিস্টার দাসের সামনে সশব্দে আছড়ে ফেলে। ঝনঝন শব্দে গ্লাসটা ভেঙ্গে কাচগুলো ছড়িয়ে পড়ে। দেবের মুখ রক্তবর্ণ ধারণ করে। দাঁতে দাঁত চেপে চোয়াল শক্ত করে বলে, 'আমি আপনার বাড়ির চাকর নই।'
দাস সাহেব, 'কর্মকার চার্জশিট তৈরি করো। আমি এব্যাপারে চীফ ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের সাথে কথা বলছি। কাল রাত থেকেই ওকে এখানে পোস্টিং করুন। যতদিন কোন অ্যাকশন না হয় ও কন্টিনিউ নাইট করবে। ডিউটিতে কোন গাফিলতি হলে রিপোর্ট করবেন।'

শীতের রাত দেড়টা বাজে। মসজিদের চাতালে চার-পাঁচজন গাঁজাখোরের ঠেক বসেছে। অসভ্য শব্দ করে পরস্পরের সাথে তারা কথা বলছে। মসজিদ সংলগ্ন বিরাট বট গাছ থেকে মাঝেমধ্যে পাখিদের ডানার ঝটপট শব্দ শোনা যাচ্ছে। একটা পেঁচা থেকে থেকেই বিশ্রীভাবে ডেকে উঠছে। এমন সময় দেব সেখানে এলো।আজকে থেকে ওর এখানে নাইট ডিউটি।

গ্যাজা ঠেকের ছেলেরা পায়ের শব্দে সচকিত হয়ে উঠলো। 'কেরে ও সরকারি বাবু! গভমেন্টের কুলি। এস এস বসো। এ কি চাকরি নিয়েছো বাবু! তোমাদের মত ভদ্রলোকদের এত রাতে এখানে মানায়?'
দেব, 'প্রচন্ড ঠান্ডা। শীতে জমে যাচ্ছি। উফ্ মশা গুলো পিছু ছাড়ছে না। এখানে একটু বসবো? শরীর আর দিচ্ছে  না।'
ক্যাবলা, 'এই বিমলে, মাল আর আছে? দু ঢোক দে না বাবুকে। শরীরটা চাঙ্গা হবে।
বিমলে, 'হতে পারে দু ঢোক। তলানিতে এসে ঠেকেছে। এই নে বাবু।'
দেব এসবে অভ্যস্ত নয়। বিনয়ের সাথে বলে ওঠে, 'আরে না না থাক।'
হিরে কলকেটা এগিয়ে দেয়, 'বাবার প্রসাদ চলবে?'জয় বাবা ভোলেনাথ....।' গাজার
কলকেতে হুস হুস করে টান মারে।
কেবলা, 'আমরা হলাম গিয়ে ছ্যাচরা। টুকটাক চুরি-ছিনতাই করি। তুমি কেমন চৌকিদার বাবু, ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার ! শেল্টার দিলুম আবার আমাদের পিছনে কাঠি দিওনা যেন। নাও ঐ ধারটায় শুয়ে পড়ো। ওরে বাবা, তোমার গা জে গরম! বেশ জ্বর। নাও আমার কম্বল টা নাও। মাথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ো দেখি।
দেব, 'না না তোমার গায়ে যে কিছু নেই।'
বিমলে, 'আমাদের আয়রন বডি।শীত আসুক বা বর্ষা। ভদ্রলোকের মত নেতিয়ে পরিনা। নাও তুমি ঘুমাও।
দেব, 'ঘুমিয়ে পড়লে চলবে না। কেবল গুলো চুরি গেলে কর্মকার বলির পাঠা করবে। আবার চোর ধরতে গেলে বাঘার দল ফুটুস করে ছেড়ে দেবে।'

দূরে চাপাস্বরে কিছু কথাবার্তা শোনা যায়। কিছু লোক কসরত করে ঢালাই করার লোহার রড একটা ম্যাটাডরে তুলছে। সবমিলিয়ে নিশুতি রাতের একটা নিষিদ্ধ শব্দের গুঞ্জন যেন বলে, এদিকে কেউ এসো না। দেব জ্বর গায়ে টলতে টলতে এগিয়ে যায়। ক্যাবলার জোর করে মুখে ঠুসে দেওয়া তলানি মালটা অনভ্যস্ত পেটে শরীরটাকে ভালোই আবিষ্ট করেছে।
'এই কৌন হ্যায়? আমি সরকারি চৌকিদার। আনঅফিসিয়ালি অ্যাপয়েন্টেড ফর চৌকিদার বাই শুয়োরের বাচ্চা কর্মকার।'
বাঘার দল হো হো করে হেসে ওঠে। ন্যাপা কালো মেশিনটা সুদর্শন চক্রের মতো ঘোরাতে ঘোরাতে এগিয়ে আসে।
'এই শালা চোপ্।  চুপচাপ দেখে যা। কথা বলা ভুলে যা। মনে কর তুই বোবা কালা হাদা। আমার নাম ন্যাপা।রাইট হ্যান্ড অফ বাঘা। মনে রাখিস।'
বাঘা দাঁত বার করে হাসতে থাকে। দেবের থুতনিটা ধরে  নাড়িয়ে দেয়। ' নে বোতলটা ধর। তোকে গিফট দিলুম। টেনে নিয়ে শুয়ে পড়।
দেব, ' ক্যাজুয়াল চাকরি। আমার চাকরিটা যাবে। কর্মকার আমাকে ইনভলভ করবে।'
বাঘা, 'এ শালা পাঠা আছে। তুই একা কি করবি রে? এ সাইট কোম্পানির সিকুরিটি দেখে। ওদের মাসোহারা দেই থার্টি থাউজেন্ড। তোকে শালা পুতুল বানিয়ে কষ্ট পাওয়াচ্ছে শুধু শুধু এত্তা শীতে! শালা কর্মকার তোর কষ্টটা এনজয় করছে। লেখাপড়া শিখে পেটের দায়ে... মায়ায় ফেলে দিলি মাইরি। '

ম্যাটাডোর স্টার্ট দিয়ে চলে যায়। দেবের মনে হয় ওর থেকে বাঘার প্রফেশনটা অনেক বেশি সম্মানের। বেশ একটা রাজা রাজা ভাব আছে। এবার ডাক পড়ল খোদ ডেপুটি চিফ ইন্জিনিয়ার মিঃ মৈত্রর ঘরে। দেব ধীর পায়ে ঢুকলো মিস্টার মৈত্রর চেম্বারে। মিস মৈত্রর অন্যদিকে চেয়ারে বসা বিকে কর্মকার।মিস্টার মৈত্র একটা টাইপ করা কাগজ দু আঙ্গুলে তুলে ধরে বললেন, ' এটা কি জানো? চার্জশিট। এই কাগজ টা তে আমি এখন সই করবো। তারপর এটা যাবে চিফ ইঞ্জিনিয়ার মিস্টার নারায়ণ সাহেবের হাত ঘুরে জিএমের কাছে। তারপর বুঝতে পারছ তোমার চাকরি আর থাকেছেনা। তোমার কিছু বলার আছে? '
দেব, 'আমার কথা কে শুনবে!'
মৈত্র, 'মানে? '
দেব, 'কর্মক্ষেত্রে আমার অভিবাবকরা বিশেষ বিশেষ বিশেষন সহ কর্ত্যব্যে সমস্ত রকম অবহেলা ও অসহযোগিতা, তৎসহ সুপিরিয়র কে অপমান ও তাদের প্রতি অনাস্থা প্রদান দেখিয়েছেন। এই গুরুতর অভিযোগের বিরুদ্ধে একটা ক্যাজুয়াল খালাসির বক্তব্য কে শুনবে?'
মৈত্র, 'পড়াশুনা কতদূর?'
দেব, ' বিএসসি পাস করে এ এম আই ই পড়ছি।'
মৈত্র বিস্মিত হন। নিজের মনে স্বগক্তি করেন, 'এ এম আই ই পরছো! তোমার ডেজিগনেশন খালাসি। খালাসির কাজ কি জানো?' দেব, 'জেনে গিয়েছি স্যার।'
মৈত্র, ' তুমি জেনে শুনেই এই কাজে ঢুকেছ। তবে তোমাকে নিয়ে এত প্রবলেম কেন?'
  
কর্মকার, ' স্যার প্রবলেম বলতে প্রবলেম! টিপিক্যাল বিচ্ছু স্যার।'
মিস্টার মৈত্র হাতের ইশারায় কর্মকারকে থামিয়ে দেন, 'ভাষার প্রয়োগে সংযত হন কর্মকার বাবু। আসল কথাটা বলুন।'
কর্মকার, 'কোনো কাজ হয়না স্যার ওকে দিয়ে,মানে করেনা স্যার। আত্মমর্যাদাবোধ প্রচুর। উনি খালাসি অ্যাসোসিয়েশনের  আত্মমর্যাদাবোধ জাগ্রত করছেন। উস্কানি দিচ্ছেন আর কি! এখন ওর দেখাদেখি অন্যান্য বজ্জাত খালাসি গুলো মুখের উপর কথা বলে। শুধু কি তাই, ওই খোকন ছোরা সেদিন আমাকে বলে কিনা, মেরে খাদে ফেলে দেবে। এত সাহস পায় ওই ছোকরার জন্য।'
মৈত্র, 'দেব এর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞাসা করেন, 'এই অভিযোগগুলো সত্যি? '
দেব, 'স্যার যিনি আমাকে দোষী সাব্যস্ত করেছেন তার ভাষার প্রয়োগটা তো দেখলেন। অত্যন্ত নিম্ন রুচির ভাষায় আমাকে এবং আমাদেরকে প্ররোচিত করা হয়েছে অসংখ্য বার। তাছাড়া একাধিকবার ক্ষমতার অপব্যবহার ঘটিয়েছেন আমার উপর। যার কারণে আজ আমি আপনার সামনে বিপর্যস্ত এক আসামি।' কর্মকার লাফিয়ে ওঠে, 'ব্লাডি... স্কাউন্ড্রেল। '
দেব, 'স্যার, আপনার চোখ আপনার অনুভূতি নিশ্চয়ই আপনার প্রশ্নের উত্তর খুঁজে নিয়েছে। আমার আর কিছু বলার নেই। '
মৈত্র, ' ইউ মে গো নাউ।'

মিস্টার মৈত্র এবার ঘুরে বসেন কর্মকারের দিকে। মৈত্র, 'মিস্টার কর্মকার, ছেলেটি শিক্ষিত ওকে দিয়ে নাইটে  চৌকিদারি অথবা কুলির কাজ না করিয়ে এমন কাজ দিন যাতে ওর শিক্ষাকে কাজে লাগাতে পারেন।'
কর্মকার যেন আর্তনাদ করে ওঠে, 'তা কি করে সম্ভব স্যার ওর অ্যাপয়নমেন্ট খালাসিতে!'
 মৈত্র, 'সুনীল সরকার ছেলেটির ডেজিগনেশন কি?'
-  ' খালাসি স্যার।'
-  ' অঞ্জন গঙ্গুলি '?
- ' খালাসি স্যার। '
 - ' বাহাদুর? '
 - ' ফিটার স্যার।'
 - ' আর সুরেশ?'
 - ' স্কিল খালাসি স্যার।'
মিস্টার মৈত্র, ' শুনুন সুনীল, অঞ্জন কাল থেকে ওদের সাইটে পাঠাবেন। দেব যে কাজগুলো করতে চাইত না সে কাজগুলো ওদের দিয়ে করাবেন।'
কর্মকার, ' সুনীল, অঞ্জন  গ্রাজুয়েট স্যার।'
মৈত্র, ' দেব ও গ্রাজুয়েট। এ এম আই ই পড়ছে।'
কর্মকার, 'কিন্তু স্যার সুনীল ডিজিএমের লোক। ডিজিএম একটু বিশেষ নজর রাখতে বলেছেন। বুঝতেই পারছেন স্যার।'
মৈত্র, ' হু বুঝলাম। অঞ্জন কার ছেলে?'
কর্মকার, 'স্যার, চিফ্ সাহেবের আত্মীয়।'
মৈত্র, 'বুঝলাম সেই জন্যই ছেলে দুটিকে বসিয়ে রেখে পাখার হাওয়া খাচ্ছেন! বাহাদুর ফিটার হয়ে অফিসে বসে কি করছে? একটি মাত্র ফিটার তাকে সাইটে না পাঠিয়ে..., অফিসে ফিটারের কি কাজ থাকতে পারে? সুরেশ স্কিল খালাসি হয়েও অফিসে বসে থাকে কেন?'
কর্মকার কিন্তু কিন্তু করে মাথা চুলকায়। 'স্যার মানে... মানে... ইয়ে...।'
 মৈত্র, ' কিছু একটা বলুন ওরা অমুক সাহেব তমুক সাহেবের ছেলে? '
মৈত্র সাহেব উত্তেজিত। কর্মকার কিন্তু কিন্তু করে মাথা চুলকায়।
কর্মকার, 'কি বলবো স্যার ব্যাপারটা এস আর এ সয়েল রায় বাবুর।'
মৈত্র, 'পরিষ্কার করে বলুন?' কর্মকার, 'বাহাদুরকে অফিসে রাখা হয়েছে চা করে দেওয়া। টিফিন আনা এসবের জন্য।  আর সুরেশ বিকেল পাঁচটার বর্ধমান লোকালে  রায় বাবুর জন্য জায়গা রাখতে বেলা তিনটের সময় চলে যায়। রায় বাবু তাই ওদেরকে সাইটে না পাঠাতে বলেছেন।'
মৈত্র, 'বাহ্ চমৎকার, চার্জশিট তো আপনাদেরই দেওয়া উচিত। হ্যাঁ, শুনুন দেবের বিরুদ্ধে অভিযোগের চিঠিটা আমি ছিড়ে ফেললাম। ওকে আমি আর একটা সুযোগ দিতে চাই। কাল থেকে ল্যাবরেটরি অ্যাসিস্ট্যান্ট এর কাজটা দেব করবে। প্রমোটেড সুপারভাইজার চ্যাটার্জীকে দিয়ে তো কোনো কাজই হয় না। টেন পাশ বিদ্যা  থেকেও নেই। বিল্ডিং ড্রয়িং গুলো দেবকে দিয়ে করিয়ে নেবেন। হ্যাঁ ও পারবে। ছেলেটি এ. এম. আই. ই পড়েছে। সেভেন্টি পার্সেন্ট মার্কস পেয়ে ড্রইং সাবজেক্ট টায় পাস করেছে। আমি লক্ষ্য রাখবো। ডু ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড মিস্টার কর্মকার?'
কর্মকার বেজার মুখে হাসি আনার চেষ্টা করে বলে, ইয়েস... ইয়েস..... ইয়েস স্যার।'

মৈত্র সাহেবের আন্তরিক অনুগ্রহে সেদিন থেকেই দেবকে ল্যাবরেটরী অ্যাসিস্ট্যান্ট পদের দায়িত্ব দেওয়া হলো। যদিও খাতায়-কলমে দেব তখনও ক্যাজুয়াল খালাসি।

একদিন মৈত্র সাহেবক দেব কে ডেকে পাঠালেন।
মৈত্র, ' গুড নিউজ দেব। তোমার যোগ্যতা প্রমাণিত। ল্যাবরেটরি অ্যাসিস্ট্যান্ট পদের জন্য জি.এম অনুমতি দিয়েছেন। আমি তোমার নাম সুপারিশ করেছিলাম। আশা করা যায় বছরখানেকের মধ্যেই পদটা স্থায়ী হবে।'

দেব আপ্লুত, অভিভূত। মৈত্র সাহেবের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলে, 'স্যার পৃথিবীটা কত সুন্দর লাগছে। আপনি না থাকলে আজও হয়তো....। '
মিস্টার মৈত্র, 'না না আমি কিছু নই। তুমি তোমার যোগ্যতার প্রাথমিক পুরস্কার পেয়েছো। আরো যেতে হবে অনেকটা পথ। এ.এম..আই.ই কমপ্লিট করো। আমি আছি তোমার জন্য। ওকে উইশ ইউ গুড লাক।'
দেব, ' থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।'
মৈত্র, ' আরে আরে একি করো, না না পা ছুঁতে হবে না। ঠিক আছে ঠিক আছে। মন দিয়ে কাজ করো। আরও বড় হও।'
দেব, 'স্যার, আজ আমার ভগবান দর্শন হল। ভগবান কে একটা প্রণাম করব না।'

****** সমাপ্ত *******

কল্পদেব চক্রবর্তী : কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন