গল্প
বাঁশি
বাবা-মা"র একমাত্র সন্তান, তাই বিয়েটা খুব আড়ম্বরপূর্ণভাবেই সম্পন্ন হলো। পলাশের
বাবা মা নেই, একটামাত্র ভাই সে দীর্ঘদিন হলো কানাডায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। আসার কথা
থাকলেও বিয়েতে সে আসতে পারেনি। তবে স্কাইপে সে বাঁশিকে দেখে ভীষণ মুগ্ধ হয়েছে এবং তার
জন্য অনেক দামী উপহারও পাঠিয়ে দিয়েছে। বাঁশিও সে সব পেয়ে খুব খুশি। মধ্যবিত্ত পরিবারে
বেড়ে ওঠা বাঁশির আহামরি কোন চাওয়া পাওয়া কোনদিনই নাই। তাঁর আছে একটা বিলাসী মন। বিলাসবহুল
জীবনের চেয়ে এটাই তাঁর কাছে বেশি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। এভাবেই সে শৈশব কৈশোর পার করে
এখন পূর্ণ যুবতী। ঢাকার মতিঝিল খুবই ব্যস্ততাময় বানিজ্যিক এলাকা। পলাশ এখানে চাকুরির
সুবাদে আসা যাওয়ার সুবিধার্থে এবং প্রচন্ড যানজটের দুর্ভোগ যাতে পোহাতে না হয় সেজন্য
এখানেই তিনরুমের একটা ফ্ল্যাট কিনে বসবাস করে। ঘরে আহামরি কোন আসবাবপত্র না থাকলেও
যা আছে তাতেই রূচিতার ছাপ পাওয়া যায়। রাত প্রায় এগারোটা বাজে। পলাশ বাঁশিকে নিয়ে এখানেই
উঠেছে। অন্য ফ্ল্যাটের পড়শিরাই সুন্দর করে
বিয়ে অনুসঙ্গ যা কিছু লাগে সবই সাজিয়ে দিয়েছে। বারোটায় সবাই যার যার বাসায় চলে যাবার
পর ওরা দুটি মানুষ এখন। পলাশ যদিও খুব শান্ত ও ধীরস্থির স্বভাবের, তবুও বাঁশিকে একান্তে
পেয়ে পরম মমতায় শক্ত করে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বললো, বউ, তুমি আমার সোনা বউ, তোমাকে
আমি এই নামেই ডাকবো, তুমি রাগ করবে না তো?
বাঁশি অবাক চোখে পলাশের দিকে তাকিয়ে সলজ্জ হাসি হেসে বললো, না গো না। বরং আমারও তো
এমনি চাওয়া ছিল, আমি যেন সারাজীবন তোমার সোনা বউ হয়েই থাকতে পারি। পলাশ আনন্দে আপ্লুত
হয়ে বললো, আহা, তাই বুঝি!! তাহলে তো দুজনের
চাওয়া মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। বলেই সে গভীর আবেগে বাঁশিকে নিবিড়তায় আঁকড়ে ধরে আদর
সোহাগের এক ঐশ্বরিক অনুভূতির দরোজা মেলে ধরলো বাঁশির সামনে। বাঁশি সম্মোহনীর মাঝে নিজেকে
সমর্পণ করে পরিতৃপ্তির আস্বাদনে বিভোর হলো। এমনি করেই শুরু হলো ওদের যুগল জীবন।
পলাশ সকাল
নয়টার মধ্যেই নাস্তা সেরে অফিসে চলে যায়। ফেরে সন্ধ্যায়। সারাদিন বাঁশি একাই থাকে।
ওর ছোটোবেলা থেকেই লেখালেখির অভ্যাস। প্রচুর সময় পাওয়ায় মন প্রাণ দিয়ে সে নানান বিষয়
নিয়ে লেখা সৃষ্টি করে। বাস্তবতা, কল্পনা, রোমাঞ্চ, পারিপার্শ্বিক অসংগতি, নিম্নবিত্তের
জীবনকাহিনী, অসহায়দের দুঃখগাথা, ধনীদরিদ্রের আকাশসমান বৈষম্য, কোন কিছুই বাদ যায়না।
ছেলেবেলা
থেকেই সে এসব ভাবনা ভাবে এবং প্রতিবাদী মনকে লালন করে। পলাশ জানতো বাঁশি লেখালেখি করে।
একদিন কথায় কথায় বললো, তুমি তোমার কিছু লেখা দিয়ে পান্ডুলিপি রেডি করো, আমি
দেখবো, পড়বো, আমি লিখতে না পারলেও একজন ভালো পাঠক কিন্তু। ভয় পেয়ো না। আমার পছন্দ হলে বই প্রকাশের ব্যবস্থা
করে দেবো।
বাঁশি
বিস্মিত হয়ে বললো, ওমা, তাই বুঝি!! ঠিক আছে অবশ্যই আমি খুব শীঘ্রই তোমার সমীপে উপস্থাপন
করবো আমার লেখনীর পান্ডুলিপি। এক সপ্তাহের মধ্যেই বাঁশি কবিতা ও ছড়ার দুটি আলাদা পান্ডুলিপি
রেডি করে পলাশের সামনে দিলো। পলাশ খুব গভীরভাবে সেগুলো প্রতিটি পাতা পড়লো তারপর বাঁশিকে
জড়িয়ে ধরে, তুমি আসলেই খাঁটি সোনা, আমার সোনা বউ! এতো সুন্দর লেখো তুমি, আর তোমার এমন
সুন্দর হস্তাক্ষর,, এ যেন মুক্তোঝরানো মুক্তোদানা সোনা বউ, আমি ধন্য, আমি গর্বিত তোমাকে
জীনসাথিরূপে পেয়ে। খুব তাড়াতাড়ি আমি এগুলো প্রকাশের ব্যবস্থা করে দেবো। মনে রেখো, আজ
থেকে আমি তোমার একজন গুণমুগ্ধ ভক্ত পাঠক হয়ে
গেলাম। এটাও বাঁশির কাছে ভীষণ সৌভাগ্যের মনে হলো। কারণ আমাদের মাঝে লেখালেখির যে আলাদা একটা জগত আছে, সেখানেও
নানরকম বৈষম্য বিরাজমান। অনেক পরিবারেই এটাকে
বাঁকা চোখে দেখেন। অনেকেরই মেধা থাকলেও লেখালেখি এগিয়ে নিতে পারেন না পারিপার্শ্বিক
প্রতিবন্ধকতার কারণে। বাঁশি সেদিক দিয়ে ভাগ্যবানই বটে। শিশুবেলা থেকেই এ বিষয়ে মা বাবা ও কাজিনদের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা
পেয়েছে শতভাগ। বাবা মায়ের একটাই দাবী ছিল তাঁকে
এম এ পাশ করতে হবে।
দিনগুলো
কতো দ্রুত চলে যায়। সতেরো বছর পর। বাঁশি ঘুম থেকে উঠে টেবিলে নাস্তা সাজিয়ে বিছানা
ঝাড়ু দিচ্ছিল। হঠাৎ দূর থেকে ভেসে এলো সুমিষ্ট বাঁশির সুর। অবাক হলো সে। এতো সকালে ইট পাথরের এই শহরে এমন মদির সুরে কে বাজায় বাঁশি? আহা, কতো কতোদিন চলে গেছে, সে শোনেনি এই সুর। অথচ
একদিন, ঝাড়ু হাতেই বাঁশি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। সুরটা ক্রমাগত নিকটবর্তী হচ্ছে। বাঁশি
চেষ্টা করছে বাঁশিওয়ালাকে দেখার। দেখলো রোগা পাতলা বাবরি চুলের কালো একটা লোক বাঁশি বাজাতে বাজাতে রাস্তা দিয়ে হেঁটে
যাচ্ছে। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগের মধ্যে আরো অনেকগুলি বাঁশি তাঁর। মনটা উথাল পাথাল করে
উঠলো। পুরনো স্মৃতির পাতায় চোখ চলে গেলো। নাহ, হারায়নি তো কিছুই। মনের পাতায় থরে থরে
সাজানো সব।
পলাশ নাস্তা
শেষ করে অফিসে চলে যেতেই বাঁশি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। অতীতের স্মৃতির পাতা যেন পতাকার
মতো তার সামনে উড়ছে। হায় স্মৃতি। কেন তারে যায়না ভোলা? কোথায় আজ বাবুল, সে তো জানেনা
তাঁর ঠিকানা। বাপের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে প্রতিবেশী এক ভাবীর কাছে জেনেছে, বাঁশির বিয়ের
পরপরই সে গ্রাম ছেড়ে কোথায় চলে গেছে আর ফেরেনি। বাবুলের মা ছেলের শোকে কাঁদতে কাঁদতে
অন্ধ প্রায়। এসব শুনে বাঁশিও নীরবে নিভৃতে
চোখের জল ফেলেছে, কিন্তু করার তো কিছুই নেই
তার। বাবা মায়ের একান্ত ইচ্ছের কাছে সে পরাজিত হয়েছে। তাঁর প্রেমকে বিসর্জন দিয়েছে।
তাছাড়া বাবুল ও জানতো তাঁদের এই প্রেম ভালবাসা
সমাজ পরিবার কোনদিন মেনে নেবে না। তাই বাবুলই বাঁশিকে বুঝিয়েছে, আমি অনেক দূরে চলে
যাবো তবু আমার প্রেমকে কলঙ্কিত হতে দেবো না। খুব জোরে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো বাঁশি। চোখের কোণে জমে উঠলো বিন্দু বিন্দু অশ্রুদানা। হঠাৎ
পাশের ঘর থেকে মা,, ব'লে চিৎকার করে উঠলো জয়িতা। ভেঙে গেল ধ্যান। দ্রুত ঘরে গিয়ে জয়িতাকে
বুকে টেনে নিলো। জয়িতার কান্না শুনে বাঁধনেরও ঘুম ভেঙে গেল, বাঁশি ওদের নিয়ে আবার ডুবে
গেল ব্যস্ততার জলে।
সতেরো
বছর সংসার জীবনে সে জয়িতা ও বাঁধনের মা হয়েছে। নিজেও বাবা মায়ের ইচ্ছে পূরণ করতে বাংলা
সাহিত্যে এম এ করেছে। বাঁধন ক্লাস ফোর এ আর জয়িতা পড়ে ক্লাস ওয়ানে। ঘরকন্নার কাজ সহ
দুই ছেলেমেয়েকে স্কুলে আনা নেয়ার দায়িত্ব বাঁশিকেই করতে হয়। কারণ পলাশ এখন নিজেই একটা
বায়িং হাউজের মালিক। অনেক ব্যস্ততা, মাঝে মাঝে
দেশের বাইরেও যাওয়া লাগে। তবে বাচ্চাদের নিয়ে বাঁশির যাতে বেশি কষ্ট না করতে হয় সেজন্য
সে তাঁকেও আলাদা গাড়ি কিনে দিয়েছে।
পলাশের
বাবা মা নেই বলে শ্বশুর শ্বাশুড়িকে শ্বশুরশ্বাশুড়িকে সে ভীষণ ভক্তি শ্রদ্ধা করে। আশা
করেছিল তাঁরা ঢাকায় এসে তাঁদের সাথেই বসবাস করবেন। তাতে ছেলেমেয়ে দুটোও একান্নবর্তী
পরিবারের কিছুটা আস্বাদ পেতো, বাঁশিরও একটু সাহায্য হতো। কিন্তু তাঁরা নিজদের পৈতৃক
বসত ছেড়ে ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করতে রাজি হননি। শহরের ইট পাথরের সারি সারি অট্টালিকার
ভিড়ে আকাশটাকেও যেন দেখা যায় না। অথচ গ্রামের অপার সৌন্দর্য কতো যে মাধুরিময় ও নান্দনিক
তার সান্নিধ্যে যাঁরা থেকেছেন তাঁরাই বোঝেন। সবুজ গাছগাছালি, হাজারো পাখির কলস্বর,
স্নিগ্ধ শান্ত পরিবেশ চারিদিকে অবারিত খোলা মাঠ ও সীমাহীন নীলাকাশ যেন সবই শিল্পীর
রং তুলিতে আঁকা এক বিমূর্ত ক্যানভাস। বাঁশিও বাবা মায়ের অনুভূতিকে বুঝতে পেরে আর পীড়াপিড়ি
করেনি কারণ বাঁশিরও বেড়ে ওঠা ঐ পরিবেশ এর মাঝেই। তাইতো বাঁশির চোখের পাতায় ও মননের গভীরতায় পুরো একটা গ্রামীণ
পটভূমি আঁকা রয়েছে যা বাঁশিকে মোহাচ্ছন্ন
করে রাখে। সেই পাল তোলা নৌকো ছইয়ের ভেতর একহাত লম্বা ঘোমটা টেনে বসে থাকা নতুন বউয়ের
উদাসী আনমনা দৃষ্টি, শাপলা ও পদ্ম দীঘির অপরূপ সৌন্দর্য, আম জাম, কাঁঠাল ও বট পাকুড়ের
শ্যামল ছায়াতলে বসে সখিদের সাথের সেই বউচি ও পুতুল খেলার অনন্য দিন। কোথায় পাবে আর? মনে
পড়ে আঙিনার পাশের বিশাল বাঁশঝাড়, বেতবন, বেথুল
খাওয়ার সেই উচ্ছ্বসিত মূহুর্তগুলো। নতুন বধূর
মতো জোছনাভরা চাঁদের সেই মিষ্টি লুকোচুরি খেলা দেখার স্মৃতিগুলো বাঁশি খুব মিস করে।
বাঁশি তাঁর মনন, অস্তিত্ব ও অনুভূতির ভেতর ধারণ করে রেখেছে বিস্তৃত সেই মাধুরী বিশ্ব,
যখন যা প্রয়োজন সবই নিতে পারে ইচ্ছেমতো।
আর সেই
যে বাবুল নামের বাঁশরিয়া, যাঁর মোহনীয় সুরের আবর্তে দুলতে দুলতে কতো কতো রাত পুকুরপাড়ের
বড় হাসনাহেনা গাছটার নিচে চুপিচুপি গিয়ে দাঁড়াত। বাবুল বাঁশি বাজাতো কখনো পুকুরপাড়
এর সবুজ ঘাসের উপর বসে, কখনো বা পুকুরের কোনাকুনি দাঁড়িয়ে থাকা বাবলা গাছটার নিচে বসে।
ওর গায়ের রং ছিল ভীষণ কালো, তাই সবাই ওকে কালু বলে ডাকতো। আহা, কেন যে কেমন করে সব
হারিয়ে গেল, কেনই বা হারিয়ে যায়, বাঁশি তার জবাব খুঁজে পায় না। ব্যস্ত নগরীর কর্পোরেট
মূল্যবোধের ভেতর, বাঁশির আটপৌরে মন প্রাণ মেশেনা। তাইতো বাঁশির বিবেচনা বোধ বিবেকের
ভেতর কোন প্রচলিত উচ্চবিলাসীতা নেই। বাঁশি নীরবতার পানপাত্র হাতে ধরে, নিভৃতে পান করে
সত্য ও সঠিক মূল্যবোধের হেমলক। কলম চালায় শক্তিশালী যোদ্ধার মতো। এখানেই তাঁর স্বকীয়তা
বিরাজমান, যা তাঁর অগনিত ভক্ত পাঠকও পছন্দ করে। বাঁশির দুটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করে
দিয়েছে পলাশ তবে ঘনঘন বই প্রকাশ করার ইচ্ছে তাঁর নেই। সমৃদ্ধ লেখা দিয়ে সে ধীরে ধীরেই
পাঠকদের মনে স্থান করে নিতে চায়।
শুক্রবার
পলাশের ছুটি বার। রাতেই বলে রেখেছে আজ ওরা বিকেলে বেড়াতে যাবে। রাতে কোন রেস্টুরেন্টে
খেয়ে বাসায় ফিরবে। বাঁশিও সকাল থেকে সেইমতোই প্রস্তুতি নিচ্ছে। পলাশ ও ছেলেমেয়ে দুটো
বড়ই লক্ষী। খাওয়া দাওয়া নিয়ে ঝামেলা করে না। দেড়টা বাজতেই বাঁশি রান্না শেষ করে সবাইকে
খাইয়ে নিজেও খেয়ে নিলো। তিনটায় বেরোবে ওরা। বাঁশি রাতেই ভেবে রেখেছে শাড়ি পরবে। তাই
যেহেতু প্রকৃতিতে শরতকাল চলছে সে তেমনি নীল সাদার কম্বিনেশন করা একটা শাড়ি পরলো সাথে
ম্যাচিং গহনা। পলাশ শুয়ে শুয়ে চুপিচুপি ওর সাজগোজ দেখছিল। শেষ হতেই ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।
মুখটাকে আলতো করে ছুয়ে দিয়ে কানেকানে বললো, ও সোনা বউ, তোমাকে যে নীল পরির লাগছে। একটা
কাজলের টিপ পরে নাও, নইলে নজর লেগে যাবে যে!!
বাঁশি লজ্জা পেলো। তবু হেসে বললো, সাথে তুমি
থাকতে কে আর নজর দেবে গো। ভয়ে কেউ আমার দিকে তাকাতেই সাহস পাবেনা। বাঁশির কথা শুনে
পলাশ হো হো করে হেসে উঠলো। ঘড়িতে তিনটা দশ বাজতেই বেরিয়ে পড়লো ওরা। ছুটির দিন, তাই
পথে জ্যাম কম। ওরা একঘন্টার মধ্যেই শিশুপার্কে পৌঁছে গেল। শত শত শিশু বাবামায়ের সাথে
এখানে ঘুরতে এসেছে। সারি সারি অনেক শিশু উপযোগী খেলার জিনিসপত্র সাজানো। জয়িতা বললো,
বাবা আমি দোলনায় চড়বো। বাঁধনও তাই। একটা বড় দোলনা খালি থাকায় ওরা সেটাতেই গিয়ে বসলো।
পলাশ ও বাঁশি পাশে দাঁড়িয়ে ওদের দোল দিচ্ছিল। হঠাৎই, বাঁশির অন্তর ভেদ করে ভেসে এলো
একটা তীব্র অথচ সকরুণ সুর। এই সুরটা যে তাঁর দীর্ঘদিনের পরিচিত! সেই বিখ্যাত পল্লিগীতির সুর, "" আমার সোনার ময়না পাখি, কোন দোষেতে
গেলা উইড়ারে, দিয়া মোরে ফাঁকি,,!! "" বাঁশির মনটা এলোমেলো, বুকের ভেতর সুপ্ত
ব্যথার প্রতিধ্বনি, কেমন যেন অস্থির লাগছে সবকিছু। সুরটা বেজেই চলেছে, বিরামহীন,!
পলাশ সেটা
লক্ষ্য করে বললো, কি ব্যাপার, তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে??
---- না
না না - আমি ঠিক আছি। কিছু হয়মি আমার।
বাঁধন
পলাশের হাত ধরে দাঁড়িয়েছিল। একটু আবদারের সুরেই বললো, বাবা, আমাকে একটা বাঁশি কিনে
দাও না! আমার খুব বাঁশি বাজাতে ইচ্ছে করে।
বাঁশি একটু রাগত স্বরে বললো, তুমি বাঁশি দিয়ে
কি করবে!!
পলাশ নরোম
সুরে বললো, দেখো বাঁশি, ছেলেটা তো কখনো চায় না কিছু। এই প্রথম সে সামান্যকিছু চাইল।
না দিলে ওর মনটা ছোট হয়ে যাবে।
বাঁশি
নীরবেই চুপ হয়ে গেল।
চারজন
বাঁশির সুরকে অনুসরণ করে পার্কের পশ্চিম দিকে যেখান থেকে সুর ভেসে আসছিল সেখানে গেল।
মধ্যবয়েসী
মানুষটা আপনমনে বাঁশি বাজাচ্ছে।। তার চারপাশে কিছু ছেলেমেয়েও রয়েছে। সবাই অবাক হয়ে
দেখছে তাঁর বাশি বাজানোর দৃশ্য।
কিছুদূরে
দাঁড়িয়ে থাকা একজন বললো, লোকটা দারুণ বাজায়। কি মিষ্টি সুর ,,
তাঁর এই
কথাটা যেন বাঁশির কানে তীরের মতো এসে বিঁধল।
বাঁশি
খুব কাছাকাছি না গেলেও এমন একটা জায়গায় সে দাঁড়িয়ে আছে, যেখান থেকে বাবুলকে দেখা যায়।
বাবুল বাঁশিকে দেখেই চিনতে পেরেছে। পলাশ আর বাঁধন একেকটা বাঁশি হাতে নিয়ে দেখছিল। দুটো
সুন্দর বাঁশি হাতে নিয়ে বাঁধন বললো, বাবা, আমি এ দুটোই নেবো। তারপর বাঁশিওয়ালার দিকে
তাকিয়ে বললো, বাঁশি মামা, তুমি আমাকে বাজানো শিখিয়ে দেবে?
-- এভাবে
তো শেখানো যায় না মামা, তবু দেখো। বাবুল বাঁধনকে কিছুটা নিয়ম দেখিয়ে দিলো।
--- বাঁশিওয়ালা
এ দুটোর দাম কতো? পলাশের প্রশ্ন,
--- আমি
সখের বসে বাঁশি বাজাাই ও তৈরি করি, বিক্রি করি না।
-- তোমার
জীবিকা নির্বাহ হয় কেমনে?
--আল্লাহর
ইচ্ছে। তিনি যেভাবেই হোক চালিয়ে নেন।
পলাশ এ
কথা শুনে বাঁশি ব'লে জোরে ডাকলো। বাবুল, আহা বাবুলের মনটা যেন ভেঙেচুরে খানখান হয়ে
যাচ্ছে। বাঁশি ধীর পায়ে একটু এগিয়ে আসতেই পলাশ বললো, উনি তো বাঁশি বিক্রি করেন না।
বাঁশি কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। বাঁধনই বললো, ঠিক আছে বাবা, বাঁশি মামাকে আমাদের বাসায়
দাওয়াত দাও। আমাকে শেখাতে পারবে তাহলে। পলাশ পকেট থেকে একটা ভিজিটিং কার্ড বের করে বাবুলের হাতে দিয়ে তাঁদের
বাসায় যেতে বললো। বাঁশিওয়ালা বললো, আচ্ছা যাবো।
বাবুলের
মনের তারগুলো যেন একটা একটা করে ছিঁড়ে যাচ্ছে। এই তো সেই বাঁশি। যে ছিল তাঁর আরাধ্য
দেবী, যার জন্য সে বিবাগী হয়ে ঘর ত্যাগ করে পথে নেমেছে। সতেরো বছর পর তাঁর সাথে এমন
কাকতালীয়ভাবে দেখা হবে স্বপ্নেও ভাবেনি সে। বাঁশিও তেমনি, ভাবেনি কখনো। পলাশ ভাবছে
অপরিচিত একজন মানুষকে বাসায় যেতে বলা কি ঠিক হলো?
কিন্তু ছেলের আবদার রক্ষার জন্য না বলতে পারলো না। ধীরেধীরে সন্ধ্যা নেমেছে।
ওরা ওখান থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠলো। যতক্ষণ গাড়িটা দেখা গেল বাবুল অপলক তাকিয়ে থেকে
তারপর বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। গাড়ির ভেতর এফ এম এ বাজছে কিশোর কুমারের বিখ্যাত
গান, "" কি আশায় বাঁধি খেলাঘর, বেদনার বালচরে ---"!
বাঁশির
মনের ভেতর দ্বিমুখী সুরের ব্যঞ্জনা। বুকের গভীরে তীব্র বেদনাদহন। বেশ তো চলছিল সব।
সতেরো বছর পর আবার কেন তা সমুখে এলো? যৌবনা
জীবনের সেই বাঁশরিয়া ও বাঁশি প্রেম, ভুলে থাকা
স্মৃতিকাহিনীর বিধূর বেদনা যেন মুমূর্ষু রোগীর
মতো কাতরাতে থাকে হৃদয়ের ভেতর। অস্তিত্বের
সভ্যতা নিকুঞ্জবনে এ যেন এক বিমূর্ত সম্মোহনী। সহসা তীব্র শব্দে গাড়িটা থেমে গেল। গাড়ির
দরজাটা খুলে পলাশ হাত বাড়িয়ে দিলো। বললো বাঁশি এসো, আমরা পৌঁছে গেছি। বাঁশি নেমে দাঁড়াতেই
মাথাটা কেমন চক্কর দিয়ে উঠলো। নিজেকে সামলাতে পারলো না। মনে হলো পৃথিবীটা যেন লাটিমের
মতো ঘুরছে। পড়ে যাবার মূহুর্তেই পলাশ ওকে ধরে ফেললো। বাঁধন ও জয়িতার
কান্নার শব্দে আশেপাশের ফ্ল্যাট থেকে দৌড়ে এলো অনেকেই। ধরাধরি করে বাসায় নিয়ে গেলো
সবাই। বাঁশির জ্ঞান ফিরলে বুঝলো সারা শরীর ও চুল ভেজা ভেজা। ডাক্তার ও এসেছে। পাশেই
থাকে। ওদের খুব পরিচিত ও বিশ্বস্ত পারিবারিক ডাক্তার। পলাশ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ডাক্তারের মুখের দিকে তাকালো।
বুঝতে পেরে ডাক্তার বললো, কোন কারনে গভীর দুঃখ পেয়ে ছোট্ট একটা স্ট্রোক করেছে। তবে
শরীরের কোথাও তেমন ক্ষতি হয়নি। কিন্তু ভবিষ্যতে সাবধানে থাকতে হবে।
পলাশের
মনে দ্বন্দ্বদ্বিধার ঝড়। বাঁশির সুর এবং বাঁশরিয়া, কিছু একটা যোগসূত্র আছে এর মধ্যে।
এতো বছর সংসার জীবনে কখনো তো সে এমন দেখেনি বাঁশিকে। বাঁশিওয়ালাকে হয়তো বাঁশি চেনে
জানে। চিন্তা ও ভাবনার টানাপোড়েন নিয়ে পলাশও দোদুল্যমান। বাঁশির এমন অবস্থায় কিছু তো
জানতে চাওয়াও বোকামি হবে। কিছু না বলতে পারার গ্লানিবোধ বাঁশিকেও দংশন করছে বারবার।
আর পলাশ! ঘোর অস্থিরতা নিয়েই সত্যটাকে জানার
জন্য ব্যাকুল প্রতীক্ষার প্রহর গুনতে লাগলো। মনের ভেতর অজস্র প্রশ্নের উঁকিঝুঁকি। কি
বলবে বাঁশি? কি বলতে পারে সে? বাঁশরিয়া তাঁর ঘনিষ্ঠ কেউ? যদি হয় তবে কি করবে সে? বাঁশিকে অবিশ্বাস করবে? না না, তা সে পারবে না। বাঁশি যে তাঁর প্রথম ভালোবাসা!
বাঁশির চোখের কোণে বাঁধভাঙা অশ্রুধারা। পলাশ সস্নেহে তা মুছে দিতে দিতে বলে, তুমি বাঁধন
জয়িতার মা সোনা বউ। জীবনের বাস্তবতাকে মেনে নিতে না পারলে ওদের মানুষ করবে কিভাবে? রাত হয়েছে। চলো ঘুমোতে যাই। বাঁশি নিঃশব্দে উঠে
দাঁড়ায়।
শাহানারা ঝরনা: কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত
শারদীয়া উৎসব এর আনন্দ আর আমার গল্প প্রকাশের আনন্দ
উত্তরমুছুনমনে প্রাণে ভীষণ ভালোলাগার বার্তা এনে দিল। আমাকে এই সমৃদ্ধ
আয়োজনের সাথে রাখার জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই কবিতা উৎসব
পরিবারকে। সবার জন্য আন্তরিক শুভকামনা ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা অফুরান।