ভাস্কোর কাছে পুজোর ছুটিতে-




ভ্রমণকাহিনী


||১০/১০/১৩ - বৃহষ্পতিবার||

আজ ষষ্ঠী। সকাল ছ'টা সাড়েছ'টা নাগাদ শেয়ালদা মেন সেকশনের সামনের চাতালে আকাশ বাতাস ফাটিয়ে নাচতে নাচতে ঢাক বাজাচ্ছে একদল ঢাকি। যেমন অদ্ভুত বাজনার মাদকতা, তেমনই সুন্দর নাচের ভঙ্গি। শেয়ালদা ট্যাক্সিস্ট্যান্ড থেকে আমি আর ঋতু একটা ট্যাক্সি ধরলাম, হাওড়া যাবো। সকাল সাড়ে আটটার হাওড়া পুণে দুরন্ত এক্সপ্রেসের ফার্স্ট-এসির একটা ক্যুপ শুধু আমাদের চারজনের। আমি, ঋতু, আমার বাল্যবন্ধু শুভ্র আর তার স্ত্রী সৌমীর।  ঝকঝকে চকচকে নিস্তব্ধ ক্যুপে শুধু এসির মৃদু আওয়াজ ছাড়া অন্য কোনো শব্দই নেই। দরজা ভেজিয়ে দিয়ে ঋতু একটা মোটা শারদীয়া খুলে জানলার ধারে বসলো। উল্টোদিকের সিটে শুভ্রর হাতে রুবিককিউব আর সৌমীর কানে ইয়ারফোন। আমি আপার বার্থে উঠে, কম্বলমুড়ি দিয়ে শোয়ার আগে ওদের বলে দিলাম - ওয়েলকাম ড্রিঙ্ক থেকে শুরু করে, ব্রেকফাস্ট লাঞ্চ হাইটি ইভনিং-স্যাক্স ডিনার, যা খুশি দিক, আমাকে ডেকোনা, আমি আজ সারাদিন মোবাইল বন্ধ করে ঘুমোবো। মাঝে মাঝে এভাবে সারাটা দিন ঘুমোতে বেশ লাগে। দিনভর কখনো হাল্কা দুলুনি, কখনো একটু জোরে, কখনো আবার বন্ধ হয়ে যায়। সারাদিন আবছা অন্ধকারে একটা ঘোরের মধ্যে থাকা। একদম সন্ধ্যেবেলা ঘুম থেকে উঠবো। একটু কিছু খেয়ে আবার সারারাত ঘুম। পশ্চিমবঙ্গ ঝাড়খণ্ড ছত্তিশগড় মধ্যপ্রদেশ ছুঁয়ে ট্রেন ঢুকবে মহারাষ্ট্র। ঋতু শুভ্র আর সৌমী সারাদিন রাত ধরে ভারতবর্ষের রাজ্য দেখুক। আমি সারা দিনরাত ঘুমোতে ঘুমোতে পরদিন সকালে পৌঁছে যাবো পুণে। সেখানে থাকে আমার আর শুভ্রর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ আরেক বাল্যবন্ধু সত্য আর তার স্ত্রী নেহা। আমি সত্য আর শুভ্র যেমন সেই স্কুল থেকেই অভিন্ন হৃদয়ের বন্ধু, বিয়ের পর এই ঋতু সৌমী আর নেহারও তেমনই ঘনিষ্ঠতা।

||১১/১০/১৩ - শুক্রবার||

সকাল সাড়ে এগারোটা নাগাদ পুণে জাংশনের বাইরেই সত্য তার গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অবিবাহিত জীবনে দীর্ঘদিন আমি কাটিয়েছি পুণেতে। এ আমার বড় চেনা শহর। এখানে আমার প্রচুর বন্ধু, অনেক বান্ধবী। গাড়িতে সত্যর পাশে আমি, পেছনের সিটে শুভ্র সৌমী আর ঋতু। প্রাকবিবাহ জীবনে আমার দুরন্ত দিনগুলোর বহু স্মৃতিবিজড়িত ব্লু-নাইল রেস্টুর‍্যান্ট, বার-বি-কিউ নেশনস্, এস.জি.এস মল, সিটি-প্রাইড, ফানটাইম মাল্টিপ্লেক্স, দোরাবজীর বিশাল দোতলা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের সামনে দিয়ে, দু'ধারে গাছ-ছাওয়া মসৃণ চওড়া রাস্তা ধরে কোরেগাঁও পার্ক হয়ে চলে এলাম কল্যাণী নগরে, সত্যর ফ্ল্যাটে।

আজ সপ্তমীর দুপুরে আমরা খুব হাল্কা খাবার খাবো - শুধু ডাল আলুভাজা আর ভাত। কারণ সন্ধ্যেবেলা আমরা ছ'জন পুজোয় বসবো। পুজোর উপচার, ফিসফ্রাই, চিকেন সসেজ্, পোর্ক সালামি, চিজ্ বল, আর আলুভাজা। সাথে অনুপান, সত্য আর শুভ্রর হুইস্কি, আমার ঋতুর আর সৌমীর ভদকা, নেহার ব্রিজার্ড। রাতে রুমাল রুটির সাথে সত্যর নিজের হাতে বানানো মাটন রেজালা আর নিরামিষাশী নেহার জন্য বাটার-পনির। তারপর অনেক রাত অবধি গল্পগুজব আড্ডা হাসিঠাট্টা, নাচ গান, হৈচৈ... কেন যে জীবনের প্রতিটা দিন এমন হয় না!

||১২/১০/১৩ - শনিবার||

মহাষ্টমীর সকাল। বেশ বেলায় ঘুম থেকে উঠে দেখি সত্য ময়দা মাখছে পাতলা নরম ফুলকো ফুলকো লুচি ভাজবে বলে। তার সাথে থাকবে বেগুনভাজা, সাদা আলুর চচ্চড়ি আর সরু সরু কাঁচা লঙ্কা। সত্য যেমন ফোটোগ্রাফি, গাড়িচালানো, রান্নাবান্না আর নেহাকে সমানভাবে ভালোবাসে, আমিও তেমনই সত্যর হাতের রান্না আর ঋতুকে সমানভাবে ভালোবাসি। আজ আমরা সারাদিন পুণের পুজো দেখে বেড়াবো। ঋতু সৌমী আর শুভ্রকে প্রবাসী বাঙালীদের পুজো দেখানোর জন্য, জলখাবারের পরই সেজেগুজে উঠে পড়লাম সত্যর গাড়িতে।

প্রথম যাবো বিমান নগরের একটি সোসাইটিতে। এখানে তো পাড়ায় পাড়ায় পুজো নয় - পাড়ার বদলে সোসাইটি। তাই প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঘোরার বদলে আমরা ঘুরবো কমপ্লেক্স থেকে কমপ্লেক্সে। তিনটে সোসাইটিতে আমাদের নিমন্ত্রণ। একটি আমার পূর্বপরিচিত আর দুটি সত্যর। সেখান থেকে সন্ধ্যেবেলায় যাবো আমার অতি প্রিয় একটি রেস্টুর‍্যান্টে - 'আঙ্কল'স চাইনিজ্'। অনেকদিন আগেই আমি ওখানকার শেফকে নোবেল প্রাইজ দিয়ে গিয়েছিলাম সাংহাই প্রন, পিকিং চিলিফিস আর চিকেন বার্ন্ট গার্লিক নুডলস্ - এর জন্য। 

আজ আর গভীর রাত অবধি কড়া পানীয় হাতে নাচ গান আড্ডা মারা যাবে না, তাড়াতাড়ি শুতে হবে।
কারণ কাল খুব ভোরেই আমরা ছ'জনে পুণে থেকে ডেকান কুইন চেপে চলে যাবো মায়া নগরী - মুম্বইতে।

||১৩/১০/১৩ - রবিবার||

আজ মহানবমী। এখন সকাল সাতটা। মিনিট পনেরো বাদেই আমাদের ট্রেন ছাড়বে। আমরা এসি চেয়ারকারে বসে আমুল কুল খাচ্ছি। আমি সত্য আর নেহা জানি, ট্রেন ছাড়ার পরই এ রাস্তার সৌন্দর্যে চমকে উঠবে ঋতু সৌমী আর শুভ্র। আমি এও জানি, পুণে ছাড়ার কিছুক্ষণ পর, লোনাভলা খাণ্ডলা আসার আগেই, ঋতু আমার হাত ধরে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াবে। আমারই মতো সেও কালো কাচ মোড়া জানলার থেকেও খোলা দরজা বা জানলাই বেশি পছন্দ করে। সৌমী শুভ্র ঋতু দু'চোখ ভরে জীবনে প্রথমবার দেখবে পশ্চিমঘাট পর্বতমালার সৌন্দর্য। ওদের অবাক করে সহ্যাদ্রির গা বেয়ে, একের পর এক অন্ধকার টানেলের ভেতর দিয়ে ছুটে যাবে ডেকান কুইন, কিম্বা বিরাট উঁচু কোনো ন্যাড়া ব্রিজের ওপর দিয়ে - অনেক নিচে পাহাড়ের কোলে পড়ে থাকবে ছোট্ট গ্রাম। আমরা হু হু করে পেরিয়ে যাবো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ছোটো ছোটো স্টেশনের নিচু প্ল্যাটফর্ম, খোলা লেভেল ক্রশিং-এর গায়ে লতানে গাছে সাজানো রেলের স্টাফের গুমটি ঘর। আমাদের দেখে হাত নাড়বে পাহাড়ের গায়ে ভেড়া চরানো ছোটো বাচ্চা। এসব দেখতে দেখতে ঘন্টা তিনেক বাদে আমরা পৌঁছে যাবো মুম্বই সি.এস.টি.এম।

মুম্বই ছত্রপতি শিবাজী টারমিনালের তিনতলায় একটা ট্রিপল-বেডেড রেলওয়ে রিটায়ারিং রুম বুক করা আছে আমাদের ছ'জনের নামে। সাহেবী আমলের সে বিশাল ঘর দেখে আমরা অবাক। সামান্য ভাড়ায় এতো বড়ো বিলাসবহুল ঘর, অভাবনীয়! সেখানে বাথরুমে বাথটাবের ওপরেও এ.সি! শয়নকক্ষ আর স্নানাগারের মাঝে পোষাক বদলাবার ঘরটার সোফাতেই তো দু'জন পাশাপাশি শুয়ে পড়তে পারে!

মুম্বই শহরের সব কটি দ্রষ্টব্য একদিনে দেখা সম্ভব নয়, আমরা দেখবোও না। আমরা কেবল দু'টো জায়গায় যাবো। দুপুরে যাবো বিখ্যাত রেস্টুর‍্যান্ট 'পারসিয়ান দরবার'-এ পারস্যের খাবার খেতে আর রাতে 'বড়ে মিঁঞা' - সেখানে মোঘলাই খাবার আবার কাবাব। মাঝের সময়টা কাটাবো জুহু বিচে। আরব সাগরে সূর্য ডুবে গেলে মেরিন ড্রাইভের আলো জ্বলে উঠবে - রাতের অন্ধকারে আরব সাগরের কালো জলের পাশে টিপটিপ করবে কুইন্স নেকলেস। আর আমরা ফিরে আসবো মুম্বই সি.এস.টি.এমে। ফ্রেশ হয়ে রিটায়ারিং রুম ছেড়ে দিয়ে রাত এগারোটায় উঠবো কোঙ্কণ কন্যা এক্সপ্রেসের ফার্স্ট এসিতে।

||১৪/১০/১৩ - সোমবার||

ভোর পাঁচটা বাজে। কোঙ্কণ কন্যা এক্সপ্রেস দাঁড়িয়ে আছে একটা ছোট্ট স্টেশনে। স্টেশনের নাম চিপ্লুম। ভারতবর্ষের পশ্চিমদিকে ভোরের আলো ফোটে বেশ দেরিতে। অক্টোবর মাসে পাঁচটার সময়েও ঘুটঘুটে অন্ধকার। আমি আর শুভ্র আমাদের কম্পার্টমেন্টের টিকিট চেকারের সাথে স্টেশনে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছি। চেকারটির সাথে আমাদের বন্ধুত্ব হয়েছে গত রাতে। আমাদের ছ'জনের দু'টো ক্যুপে সিট পড়লেও ট্রেনে উঠে আমরা সারাটা রাত কাটিয়ে দিয়েছি একটা ক্যুপেতেই। আমাদের রাতভোর আড্ডা দেখে চেকার অবাক। সত্য নেহা সৌমী ঋতু শুয়েছে শেষ রাতে। তবু ওদের একটু বাদেই ডেকে দেবো।

বর্ষার পর, এই শরৎকালে যখন কোঙ্কণ উপকূল সবুজে মুড়ে থাকে, যখন পাহাড়ি ঝর্ণাগুলো মোটা তোড়ে পাহাড়ের খাঁজ থেকে উপচে পড়ে তখন কোঙ্কণ রেলওয়েতে ভোরবেলা সূর্যোদয়ের সময় যারা ঘুমিয়ে কাটায়, তারা বাকি জীবনটা নিজেদেরও ক্ষমা করতে পারেনা। দার্জিলিঙের টয়ট্রেন, কালকা থেকে সিমলার রেলমোটোর কিম্বা শিবালিক ডিলাক্স, লামডিং তিনসুখিয়া হয়ে গৌহাটি-লেডো ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস, লালকুঁয়া থেকে হলদুয়ানি হয়ে কাঠগোদাম - ইন্ডিয়ান রেলওয়ের এসব ট্র‍্যাক যদি হয় পূর্ণ যুবতী, আটানব্বই সালের ছাব্বিশে জানুয়ারী চালু হওয়া, মহারাষ্ট্র গোয়া আর কর্ণাটকের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের শহরগুলোর ছুঁয়ে যাওয়া কোঙ্কণ উপকূলের রেলপথ যেন সদ্য যৌবনপ্রাপ্তা। আমরা সবসময়েই নদীর উপমা দিই নারীর সাথে, নারীর তুলনা করি কবিতার সাথে, কবিতাকে বলি স্বপ্নের মতো, স্বপ্নকে বলি সুন্দর। তুলসীদাসজী, শ্রীরামচন্দ্রের মুখের সৌন্দর্য বর্ণনার উপমায় অনেক ভাবনাচিন্তা করে চন্দ্র সূর্য পদ্ম কোনো কিছুতেই খুশি না হয়ে শেষে বলেছিলেন, শ্রীরামচন্দ্রের মুখ শ্রীরামচন্দ্রের মুখের মতোই সুন্দর। ঠিক তেমনই, কোঙ্কণ উপকূলও কোঙ্কণ উপকূলের মতোই সুন্দর।

আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথে ঝর্ণার জলে কোঙ্কণ কন্যা স্নান করতে করতে কখনো কোনো টানেলে ঢুকে পড়ে, কখনো টানেল থেকে বেরিয়ে পাহাড়ি লতাপাতায় নিজের গা ঘষে। নীল আকাশে সাদা মেঘ ভাসছে, চারধারে সবুজে মোড়া পাহাড়ের ঢাল। মাঝে মাঝে আমাদের কোঙ্কণ কন্যা দাঁড়াচ্ছে সুদৃশ্য স্টেশনে - রত্নাগিরি, কঙ্কাভলি, সিন্ধুদূর্গ। ভারতবর্ষের রেলস্টেশনও এতো সুন্দর হয়! আমার খুব হিংসা হয় এসব স্টেশনের স্টেশন ম্যানেজারদের। আজ আমাদের ব্রেকফাস্ট - চিকেন স্যান্ডুইচের সাথে কফি আর নেহার ভেজ স্যান্ডুইচ।

ট্রেন সাওন্তওয়াড়ি রোড ছাড়লো। আমরাও মহারাষ্ট্র ছেড়ে গোয়ায় ঢুকলাম। আমরা নামবো থিভিমে।
থিভিম স্টেশন থেকে গোয়ার ক্যান্ডোলিম বীচ মাত্র আধঘন্টা। আর ক্যান্ডোলিম বীচের সামনেই আমাদের ফ্ল্যাট।

শুভ্রর কোনো এক পরিচিত বলেছিলো, গোয়ায় নাকি দু'চারদিনের জন্যও ফ্ল্যাট ভাড়া পাওয়া যায়। ফুললি-ফার্নিশড এসি ফ্ল্যাটে ফ্রীজ মাইক্রোওয়েভ ছাড়াও কিচেনে হাঁড়ি কড়া গ্যাস মিক্সি সবই থাকে ইচ্ছে মতো রান্না করার জন্য। এ খবরে আমরা হাতে স্বর্গ পেয়ে একটা থ্রী বি এইচ কে ফ্ল্যাট বুক করেছিলাম চারদিনের জন্য। আমাদের তো এরকম ফ্ল্যাটই লাগবে, যেখানে আমরা ড্রইংরুমে আসর সাজিয়ে হৈ-হল্লা করবো, ইচ্ছে হলে সত্য একটু রান্না-বান্না করবে, পানাহারের সময় শুভ্র হয়তো বেসুরো গলায় গেয়ে উঠবে, তাতে আমি বেতালা পায়ে নেচে উঠবো, আর সেসবে হেসে গড়িয়ে পড়বে ঋতু নেহা আর সৌমী। এসব মজা কি হোটেলের আলাদা আলাদা তিনটে ঘরে হয়? আমাদের ছ'জনকে সামলাবার জন্য ফ্ল্যাটের তলায় আছেন কেয়ারটেকার কাম কুক কাম ফ্ল্যাটের মালিক, নরম তুলতুলে চেহারায় থপথপিয়ে হাঁটা বছর ষাট পঁয়ষট্টির ভিক্টোরিয়া।

ফ্ল্যাটে মালপত্র রেখে, ভিক্টোরিয়ার চুমু টুমু খেয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের একটা গাড়ির দরকার। আমরা মোটা মোটা চাকাওয়ালা গাঢ় সবুজ রঙের একটা হুড খোলা জীপ পছন্দ করেছি।  আমাদের তো ড্রাইভার লাগবে না। আমাদের ড্রাইভার সাহেব সত্যর পাশের সিটটা ঋতু নেহা আর সৌমী বুক করে নিয়েছে। ওরাই ওখানে পালা করে বসবে। আমি আর শুভ্র দুঃখ দুঃখ মুখে ওদের সাথে একটা রেস্টুর‍্যান্টে লাঞ্চ করতে ঢুকলাম। 

আমি খেতে বসলেই, আমাদের দলের সবাই আমার আমিষ পদের জন্য যতটা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে আমি তারচেয়েও বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ি নেহার নিরামিশ পদের খোঁজে। আমি ঋতু সত্য শুভ্র সৌমী দিব্যি নানানরকমের খাবার ভাগাভাগি করে স্বাদ নিতে পারি, কিন্তু সে বেচারি মাছ-মাংসে ভাগ বসাতে পারেনা। বাধ্য হয়েই তাকে সেই আলু মাশরুম আর পনিরের মধ্যে ঘোরাফেরা করতে হয়।

এর আগে হাঁস মুরগি, গরু ভেড়া, ছাগল শুয়োর, সাপ কচ্ছপ, সব চেখে আমার ধারণা সাদা ভাতের সাথে বড় আলু দেওয়া খাসির মাংসের বাংলা ঝোলের কোনো বিকল্প নেই। এবার আমি ঠিক করেছি, ওরা যা খুশি খায় খাক, গোয়ায় দিনকয়েক আমি সামুদ্রিক প্রাণীর ওপরই থাকবো। হাঙর তিমি যদি নাও পাই, আমি কাঁকড়া চিংড়ি আর অক্টোপাসের জ্ঞাতি-গুষ্টিই ওড়াবো।

আজ আর সন্ধ্যে বেলা কোথাও বেরোবো না। ফ্ল্যাটের বারান্দা থেকেই ক্যান্ডোলিম বীচ দেখা যাচ্ছে। ড্রইং রুমে ঋতু সৌমী আর নেহা গান চালিয়ে নাচছে। হাতে বিয়ারের ক্যান নিয়ে কতক্ষণ নাচ চলবে জানিনা। মেঝেতে একটা প্লেটে কাজুবাদাম রয়েছে। নাচতে নাচতে লাথি মেরে প্লেট না ভেঙ্গে ফ্যালে। শুভ্র আর আমি ভদকার বোতলের সামনে বসে সত্যর জন্য অপেক্ষা করছি। সত্য কিসব মশলা টশলা মাখিয়ে ভয়ঙ্কর বড় বড় কালো রঙের পম্ফ্রেট মাছ ভাজছে। আজ রাতে আমরা ভিক্টোরিয়ার কাছে খাবো। অর্ডার দিয়েছি, স্টিমড রাইস উইথ মেল্টেড বাটার অ্যান্ড সল্টেড স্ম্যাশড্ পোট্যাটো উইথ গ্রীন চিলি। মানে কাঁচালঙ্কা দিয়ে মাখন আলুভাতে আর ভাত। সৌমী ভিক্টোরিয়াকে বলেছে আলুভাতেটা চিলিফ্লেক্স দিয়ে মাখতে। আমি বসে আছি ভিক্টোরিয়াকে আলুভাতে মাখায় নোবেল দেবো বলে।

||১৫/১০/১৩ - মঙ্গলবার||

সকালে ঘুম থেকে উঠে শুভ্রর কাছে শুনলাম, গত রাতে খাওয়াদাওয়ার করে শুতে যাওয়ার আগে অবধি ভিক্টোরিয়া বেশ কিছুক্ষণ বিস্ফারিত চোখে, আমার আর সত্যর গলা জড়িয়ে 'ওয়ানা বি মাই ছম্মক চল্লো..ওও..ওওও..' নাচ দেখে নিজেও নাচ শুরু করেছিলো। অবশ্য আমার ঠিক মনে পড়লো না। আমি কিচেনে ঢুকে গেলাম, ব্ল্যাক কফি বানাবো। সবাই ফ্রেশ হলেই বেরিয়ে পড়বো। ব্রেকফাস্ট থেকে ডিনার আজ সারাটা দিন বাইরে।

পশ্চিমবঙ্গের পুঁচকে একটা জেলার মতো রাজ্য, তার আবার দুটো জেলা - উত্তর গোয়া আর দক্ষিণ গোয়া। দু'দিনেই ঘুরে নেবো দুটো জেলার গ্রাম শহর আর বীচগুলো। একদিন জলকেলি - সকাল থেকে সন্ধ্যে অবধি যতরকম ওয়াটার স্পোর্টস আছে, আরেকটাদিন কাটাবো আমাদের ফ্ল্যাটের সামনের ক্যান্ডোলিম বীচে। গতকাল দুপুর থেকেই দেখেছি, ক্যান্ডোলিম বীচটা বেশ ফাঁকা, নির্জন - হৈচৈ ঝুটঝামেলা নেই। আমরা একটু নিরিবিলিতেই হৈচৈ করতে পছন্দ করি।

||১৯/১০/১৩ শনিবার||

ভোর চারটে নাগাদ পুণে নেমেছি। গতকাল বিকেল তিনটেয় ভাস্কো দা গামা থেকে গোয়া এক্সপ্রেস ধরেছিলাম। ক্যাসেল রক স্টেশনটা ছাড়ার পরই ট্রেন থেকে গোয়া কর্ণাটক বর্ডারের দুধসাগর জলপ্রপাত দেখে মাথা ঘুরে গেল। বিশাল বড় পাহাড়ের হাজার হাজার ফুট ওপর থেকে ঝরঝর করে জল পড়ছে আর তার পাশ দিয়ে পাহাড়ের গা দিয়ে যাচ্ছে গোয়া এক্সপ্রেস। আমরা ছ'জনই একে অপরকে জাপ্টে ধরে দরজার কাছে দাঁড়িয়েছিলাম। হুড়মুড়িয়ে জল ঢুকে আমাদের স্নান করিয়ে দিলো।

ঋতু আর সৌমী এখন ব্যাগ গোছাচ্ছে। আজ বিকেলে পুণে হাওড়া দুরন্ত ধরবো। আমি আর শুভ্র, সত্যর ফ্ল্যাটের বারান্দায় বসে সিগারেট খাচ্ছি। সত্য আর নেহা শুকনো মুখে ঘুরছে। একটু বাদেই ওদের গমগমে ফ্ল্যাটটা ফাঁকা হয়ে যাবে। আমি এখনো কেমন একটা ঘোরের মধ্যে আছি।

দিনগুলো কেমন স্বপ্নের মতো কাটলো। নারকেল গাছে ছাওয়া গোয়ার গ্রাম। পর্তুগীজ শৈলীর বাড়িঘর আর ঝকঝকে চকচকে রাস্তা দিয়ে সাজানো গোয়ার শহর। আমরা সকাল থেকে রাত জীপ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি একেকটা শহর আর গ্রাম। ছোটোখাটো রেস্টুর‍্যান্টে দাঁড়িয়ে সীফুড খাচ্ছি - অক্টোপাসের শুঁড়গুলো রিং রিং করে কেটে মচমচে ভাজা, আস্ত অক্টোপাস গ্রিল করা, অক্টোপাসের তুতোভাই স্কুইড - মোমোর মতো আকৃতির সাদা নরম তলতলে জিনিসের ভেতরে মশলাদার পুর ভরে ভাপানো। পাবে ঢুকে চেয়ে নিচ্ছি নানান রকম ওয়াইন। কখনো আইসক্রিম পার্লারের সামনে গাড়ি রেখে ডাবলস্কুপ বা ট্রিপল্ স্কুপ নিচ্ছি। শান্ত বিকেলে কোনো চার্চের মাঠে বসছি, পাশেই সমুদ্র। কিম্বা কোনো গ্রামের কাজু বাগানের ভেতর হাঁটছি, নারকেল গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে রোদ আসছে। বাগানের পাশেই হয়তো মালিক থাকেন - বৃদ্ধ গোয়ানীজ্ দম্পতী বাড়িতে ডেকে ফ্রুটকেক খাওয়াচ্ছেন। আমরা জীপ থেকে বোতোল নামাতে গেলে হাসতে হাসতে আমাদের হাতে ফেনির গেলাস ধরিয়ে দিচ্ছেন।

বিশাল বড় দূর্গ, গভীর পরিখা, বিরাট উঁচু পাঁচিল, মোটা মোটা দেওয়াল - বড় বড় সিঁড়িতে বসে আমরা গল্প করছি। আমরা ছাদে দাঁড়িয়ে দেখছি দূর্গের তলায় আছড়ে পড়ছে আরব সাগর। ভোর বেলা বীচের পাশে বসে আছি। একজন বিরাট বড় হুইল দিয়ে মাছ ধরছেন - অনেক টানাটানির পর আশ্চর্য বড়সড় একটা শঙ্কর মাছ তুলে মাছটার গায়ে হাতবুলিয়েই তাকে ছুঁড়ে দিলেন সমুদ্রে। দু'জন ঢেউ পেরিয়ে শান্ত সমুদ্রে গিয়ে সাঁতার কাটছেন। একজন বৃদ্ধা শিশুর মতো বালির দূর্গ বানাচ্ছেন -এঁরা সবাই রাশিয়ান। রাশিয়ানরা অ্যাতো ঘন ঘন গোয়ায় আসেন এখানে বেশিরভাগ দোকানের নাম, হোটেল রেস্টুর‍্যান্টের মেন্যুকার্ড রাশিয়ান ভাষায় লেখা থাকে। শুনলাম, রাশিয়ান পরিবাররা তিনচার মাসের জন্য ফ্ল্যাট ভাড়া নেন।

হু হু হু হু করে সাংঘাতিক জোরে একটা স্পীডবোট যাচ্ছে। তার গায়ে একটা প্যারাস্যুট লাগানো। আমি আর ঋতু সমুদ্রের ওপর প্যারাসুটে ভাসছি। অনেক উঁচু থেকে আস্তে আস্তে প্যারাসুটটা আমাদের দু'জনকে নিয়ে জলে তলিয়ে গেল। স্পীডবোটটা এখনো ওই স্পীডেই যাচ্ছে আর আমরা দু'জন সমুদ্রে প্যারাসেলিং করছি। ভীষণ মজা লাগছে। বেশ কিছুক্ষণ পর আমরা বোটে উঠে পড়লাম, এখন সত্য আর নেহা প্যারাসুটে ভাসছে। ওরাও জল থেকে বোটে উঠে এলো। এবার শুভ্র আর সৌমীর পালা। আরব সাগরে তলিয়ে যাচ্ছি। আমরা ছ'জনেই লাইফ জ্যাকেট পরে কলার ভেলার মতো লম্বা একটা টিউবে উঠেছিলাম। টিউবটা একটা দড়ি দিয়ে বোটের সাথে বাঁধা। বোটটা বেশ অনেকটা নিয়ে গিয়ে হঠাৎ ব্রেক কষলো। আমাদের টিউবটাও উল্টে গেল। আমাদের প্রত্যেকের সাথে দড়ি বাঁধা আছে। তাও আমরা আরব সাগরে তলিয়ে যাচ্ছি। লাইফ জ্যাকেট পরা আছে বলে কিছুক্ষণ পরেই ভেসে উঠলাম। আমরা চিৎকার করে হাসছি। আমরা ওয়াটার স্কুটারে বসে আছি। অ্যাতো স্পীডে জলের ওপর দিয়ে যাওয়া যায়? আমাদের গায়ে জলের ছিটে লাগছে। ছটা স্কুটার পাশাপাশি যাচ্ছে। শোঁ শোঁ করে কানে হাওয়া আসছে আমরা কিচ্ছু শুনতে পাচ্ছিনা। বিশাল একটা ঢেউ আসছে, জানিনা স্কুটার উল্টে যাবে কিনা... একটা দোলা দিয়ে ঢেউটা চলে গেল। ঢেউয়ের ওপর স্কুটার চালাতে দারুণ লাগে।

একেকটা বীচের একেকরকম সৌন্দর্য। এইটুকু জায়গায় অ্যাতো বৈচিত্র! কোথাও লালচে খয়েরি কাঁকর ছাওয়া বীচে বড় বড় পাথর ছড়ানো, তাতে আছড়ে পড়ছে সমুদ্রের ঢেউ। কোথাও সবুজ পাহাড়ের ঢাল মিশে গেছে সমুদ্রের সাথে। কোথাও রুপালি বালি চিকচিকে সৈকত ছুঁয়ে আছে শান্ত সাগর। ঝোপঝাড় জঙ্গল ভর্তি কোনো কোনো ভার্জিন বীচে বালির ওপর নকশা কেটে হারিয়ে যাচ্ছে লাল সবুজ কালো আর সাদার ওপর হলুদ ডোরাকাটা মোটা মোটা কাঁকড়া। কোনো বীচ জনমানব শূন্য আবার কোনো কোনো বীচে সারি দিয়ে শুয়ে আছে রৌদ্রস্নাতা রমনী, খেলে বেড়েচ্ছে শিশু, পানীয় হাতে বসে আছে বৃদ্ধ বৃদ্ধা থেকে তরুণ তরুণী। পোষাক পরিচ্ছদ সত্যিই বড় আপেক্ষিক। এখানে যেন গা ঢেকে ঘুরতেই লজ্জা করে - সবাই তাকিয়ে দেখে। ভাবা যায়, কনের সাজে কেউ ইন্টারভিউ দিতে বসেছে? আমাদের পরিচিত তিনটে মেয়েকে দেখলেও অবাক লাগে! এরাই দু'দিন আগে গয়নাগাটি, শাড়ি টাড়ি পরে পুজোর প্যান্ডেলে ভোগ খাচ্ছিলো? এখন তারা সারা শরীরে রোদ মেখে সমুদ্রের পাড়ে আধশোয়া হয়ে, নীল সবুজ লাল কালো নানা রকম রঙিন পানীয়ে চুমুক দেয়!

সন্ধ্যেবেলা অন্ধকার সমুদ্রে ঝলমলে প্রমোদতরীর ডেকে উদ্দাম গান বাজনা হচ্ছে। প্রত্যেকের মুখচোখ চকচক করছে জুয়া খেলার মজায়। হাতে হাতে ঘুরছে দামী ওয়াইন। ব্যুফে কাউন্টারে কতগুলো পদ ছিলো, আমি গুণে শেষ করতে পারিনি। অবশ্য নিরামিশের আয়োজনও ছিলো। অনেকেই তো নেহার মতো, মাছ মাংস পছন্দ করেনা। আমরা ছ'জন একসাথে জলের ওপর ঝলমলে সন্ধ্যে কাটালাম।

ফেরার আগেরদিন রাতে আমরা যখন ভিক্টোরিয়াকে ডিনারের নিমন্ত্রণ করলাম, তিনি আনন্দে আত্মহারা। লিপস্টিক লাগাতে লাগাতে বারবার ঋতু নেহা আর সৌমীকে জিজ্ঞেস করছেন, তাঁকে কেমন লাগছে। গাড়িতে সত্যর পাশে বসে তিনি গোয়ানীজ্ গান গাইছিলেন। কি জানি সেরাতে তাঁর চোখ চিকচিক করছিলো কেন, কড়া পানীয়ের জন্য নাকি তাঁকে কেউ সেভাবে নিমন্ত্রণ করে রেস্টুর‍্যান্টে নিয়ে যায় না বলে? জানিনা।

আমাদের ছ'জনের উদ্দাম আনন্দের গোয়া, উচ্ছল গোয়া, ঝকঝকে শহুরে গোয়া, শান্ত গ্রাম্য গোয়া, দূর্গ গীর্জা আর খাদ্য পানীয়ে ভরা গোয়া, বিলাসবহুল গোয়া....ছোটোবেলায় যখন বেড়িয়ে ফিরতাম, বেশ কদিন ধরে এমন একটা মন খারাপ ভাব থাকতো। পুজোর লম্বা ছুটি শেষ। আগামীকাল রাতে পৌঁছে যাবো বাড়ি। ইচ্ছে করেই আমরা ফ্লাইটের টিকিট কাটিনি। সারাদিন রাত ট্রেনে বসে মাঠঘাট দেখতে দেখতে ভারতবর্ষের এমাথা থেকে ওমাথায় যাওয়া বা নিশ্চিন্তে সারাদিন ঘুমোনোর মজা প্লেনে নেই। প্লেনটা কেমন যেন কাঠ কাঠ কেজো ব্যাপার, হুশ করে ফুরিয়ে যায়। 

এখন বিকেল তিনটে। সত্য আর নেহা আমাদের চারজনকে পুণে হাওড়া দুরন্ত এক্সপ্রেসে তুলতে এসেছে। নেহার চোখ ছলছল করছে। ঋতু আর সৌমীর মুখও থমথমে। শুভ্র গোমড়া মুখে রং মেলানো রুবিককিউবটার রংগুলো এলোমেলো করে দিচ্ছে। আমি আবার আপার বার্থে উঠে শোয়ার তোড়জোর করছি। সত্য জিজ্ঞেস করলো - আবার আসবি তো ভাই? আমি কম্বল সরিয়ে বললাম, না! আমি একই জায়গায় ঘুরিনা। এবার তোরা দু'জন আসবি, আমাদের চারজনের কাছে। আমরা ছ'জন এরপর ভালুকপং যাবো। বমডিলা। তাওয়াং মন্সট্রি। অরুণাচলপ্রদেশ। আসবি তো ভাই?  আমার সাথে হেসে উঠেছিলো, সত্য শুভ্র সৌমী আর ঋতু।


ঋষেণ ভট্টাচার্য্য: কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন