ভ্রমণকাহিনী
এক
শীতকাল
এলেই কানাডার কথা মনে পড়ে।মনে শুধু পড়েই
না,চার
বছর আগের কথা,মনে হয় কালই ঘটেছে,আমার
তো পাঁচ মাসের সেই কানাডাবাসের প্রতিটা দিন প্রতিটা মুহূর্তের কথাই মনের মধ্যে
জ্বলজ্বল করছে। সেই অর্থে বিদেশ বলতে যা বোঝায়,আমি একবারই
গিয়েছি,আর সে যাওয়াও পছন্দের নয়,প্রয়োজনের
বাটন প্রেস করে। কিন্তু প্রয়োজন পছন্দে পরিণত হতে দেরি হয়নি। বিভিন্ন ব্যথাজনিত
সমস্যা নিয়ে এত বড়ো একটা যাত্রাপথ একা কিভাবে সামলাব তা নিয়ে অবশ্য সংশয় ছিল
অনেকেরই।আসলে লোকজনের দোষ নেই,কলকাতায় পর্যন্ত একা ট্রামে
বাসে চলাফেরার অভ্যেস বহুদিনই যার নেই,সে একা লটবহর নিয়ে
কিভাবে এতখানি পথ পাড়ি দেবে,সে এক প্রশ্ন বইকি।কনফিডেন্ট
ছিলাম একা আমি,কারণ,আমি অত
ভাবিইনি।কারণ আমার এত ভাবার স্বভাবই নয়।ভেবে তো আসলে কিছুই হয়না।মানুষ একরকম ভাবে,হয় আর একরকম।পৃথিবীর এটাই নিয়ম।
তো
যাই হোক,ফ্লাইটের একটা সুবিধে থাকে,চাইলে হুইলচেয়ার পাওয়া
যায়।আর সেটা শুধু গ্রন্থিসমস্যায় জর্জরিত লোকেদের হাঁটার সমস্যা লাঘবই করেনা,তা বিভিন্ন এয়ারপোর্টে গিয়ে কোথায় যাব কি কিরব কোনদিকে প্লেন দাঁড়াবে
ইত্যাদি প্রভৃতি সমস্যারও নিশ্চিত সমাধান,এ তো নিয়মিত
হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী যাত্রীরা জানেন।আমাকে অবশ্য বলা হয়েছিল আমেরিকান ডলার রাখতে,হুইলচেয়ার বহনকারীদের দেবার জন্য,কিন্তু কার্যত
কাউকেই কিছু দেবার সুযোগই ছিলনা।যিনি রেখে যান,পরে এসে আর
একজন নিয়ে যান।কাকে কি দেব ভাবার আগেই প্লেনের পেটের মধ্যে সুড়ুৎ করে ঢুকে
যাওয়া।কলকাতা থেকে ড্রাগন এয়ারের একটা ছোট
বিমানে হংকংয়ে এসে কানেকটিং ফ্লাইট ক্যাথে প্যাসিফিকের, হংকং
থেকে সোজা টরন্টোর পিয়ার্সন এয়ারপোর্ট। হংকংয়ে পৌঁছে দেখি ফোনে চার্জ নেই,আর চার্জার পয়েন্ট হলো ইউরোপিয়ান মডেলের।আমাদের চার্জার সেখানে
ঢুকবেনা।এবার খবরাখবর দিই কি করে!একেই একা বেরিয়েছি পথে,সবাই
টেনশনে কাঁপছে।
এয়ারপোর্টে
গোটা চারেক কম্পিউটার। হাতে দু ঘন্টা
মতো সময়।ভাবলাম, দেখি ফেসবুক
লগইন হয় কিনা।তো,সেখানে দেখি চীনা ভাষায় সব কিছু।একটি চাইনিজ
মেয়ে ফেসবুকে ব্যস্ত,তারই শরণাপন্ন হলাম।
সব
জায়গায় মানুষ কিভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়,তা তখন থেকেই বোঝার শুরু।আমাদের এ দেশেও
হয়ত করে লোকজন এই সাহায্যটুকু।আমার অভিজ্ঞতা কম। মেয়েটি আমায় ইংরেজি মোডে
কম্পিউটার এনে দিয়ে নিজে উঠে চলে গেল।দিব্যি ফেসবুকে লগইন করে মেয়েকে আর বরকে
ইনবক্সে জানালাম আমার তৎকালীন স্থিতি ।এখানে তখনও সকাল হয়নি।মেয়ের টরন্টোয় সম্ভবত
রাত তখন। ফেসবুক টাইমলাইনেও একখানা বার্তা দেওয়া থাকল,আমি
রাস্তায় বেরিয়েই হারিয়ে যাব,এমন একটি অনাস্থা মনে মনে যারা
পোষণ করেছিলেন,সেই সব শুভাকাঙ্ক্ষীর জন্য।
যথাসময়ে
দ্বিতীয় হুইলচেয়ার বহনকারী এসে প্লেনের পেটে ঢুকিয়ে দিয়ে গেলেন।আসন ছিল সাইডের,যাকে বলে আইল
সিট,চীনা বিমানসেবিকারা আমন্ত্রণ জানালেন,পাশাপাশি দুটি সিটের একটিতে এক
বিদেশিনী।একা বিমানযাত্রা।থ্রিলিং ইনডিড।মাটি ছেড়ে শুরুতেই আমার নিজস্ব কাজকারবার
শুরু হল,এক গ্লাস জল টাল সামলাতে না পেরে ফেলে দিলাম সেই বিদেশিনী
ভদ্রমহিলার চাদরে।কেলেঙ্কারির আর বাকি কি রইল!
জানিনা
এঁরা কি দিয়ে তৈরি হন।কিছু বলা তো দূরস্থান,বিরক্তিতে ভুরুটুকুও কুঁচকে গেলনা।সেই
পরিস্থিতিতে উনি কিছু বললে আমি অন্তত দোষ স্বীকার করেও শান্তি পেতাম।নিঃশব্দ
ক্ষমার একটা মুশকিল যে,নিজের ভুল স্বীকার করারও পরিসর থাকেনা,আর নিজেকেই মরমে মরে যেতে হয়। ভদ্রমহিলা চাদরটা চেয়ারের একপাশে কিভাবে যেন
একটুখানি মেলে দিলেন। কোনোরকমে একটা'সরি'বললাম,উনি মুখে একটু হাসির ভাব এনে যেমন বই পড়ছিলেন
পড়তে থাকলেন। কোথাও যাওয়ার প্রধান শর্ত যে
সাবধানতা,সেই শিক্ষা গেঁথে গেল মনের মধ্যে।
দুই
উনিশ ঘন্টা প্লেনে যাঁরা কাটিয়েছেন, তাঁরা জানেন
অনন্তকাল মানে কি।লাভের মধ্যে এই,নিজস্ব টিভি মনিটরে সিনেমা
আর গান থাকে প্রচুর,যা নিশ্চিন্ত মনে উপভোগ করা যায়।আমি বেশ
কিছু ইংরেজি গান শুনে আবার পরে শুনব মনস্থ
করে ফেললাম।শুধু গানগুলোর প্রথম লাইন মনে রাখাটাই চ্যালেঞ্জ। শরদিন্দু
বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটা লেখায় পড়েছিলাম,অপেক্ষা যত
দীর্ঘকালীনই হোক,এক সময় তা শেষ হতে বাধ্য।টরন্টো পৌঁছলাম যখন,ওখানে তখন প্রায় দুপুর । মেয়েকে এয়ারপোর্টে আসতে বারণ করেছি,বেচারি নিজেই কয়েক মাস মাত্র গিয়েছে,তখনও তেমন সব
কিছুতে অভ্যস্ত হয়নি,আর দিনটা ছিল শুক্রবার, ওর অফিসও ছুটি নয়।ওয়ার্ক- ফ্রম- হোম হলেও করতে হবে।আমি এয়ারপোর্ট থেকে ওর
বাড়ি যে সশরীরে পৌঁছব তা নিয়ে ও সন্দিহান থাকলেও আমি নই।
হুইলচেয়ারের
দৌলতে ইমিগ্রেশনও সহজতর।এমনিতে ফেরার টিকিট সঙ্গে থাকলে কোনো সমস্যা কানাডায় নেই।আমার
শুধু ভয় ছিল ওদের উচ্চারণ যদি বুঝতে না পারি।সেসব দেখি দরকারই হলো না,হুইলচেয়ার
বহনকারী নিগ্রো ভদ্রমহিলা অনায়াসে সব সামলে দিলেন।একটা জায়গায় লাগেজগুলোও নামানো
ছিল ,ওঁরা জিজ্ঞেস করলেন পোর্টার লাগবে কিনা।পোর্টার নিতেই
লাগেজ ক্যাবে পৌঁছে দিল তারা।বিনিময়মূল্য দশ ক্যানাডিয়ান ডলার। ক্যাবচালক একজন
ক্যানাডিয়ান। বিদেশী দেখেই সম্ভবত আমার সঙ্গে গল্প জুড়ে দিলেন।কান সজাগ রেখে
প্রশ্নের যথাসম্ভব উত্তর দিতে দিতে পঁয়তাল্লিশ মিনিটের পথ পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম
মেয়ের ব্লোর স্ট্রিটের স্টুডিও
অ্যাপার্টমেন্টে। হ্যাঁ,আশ্চর্যের বিষয় পৌঁছেই গেলাম
শেষাবধি। কোনো কিছু না হারিয়ে নিজেও হারিয়ে না গিয়ে জীবনেও একা কলকাতা থেকে
কাকদ্বীপেও না যাওয়া এক ঘরকুনো বঙ্গললনা পৌঁছেই গেল অনায়াসে একা কলকাতা থেকে
কানাডার গন্তব্যস্থলে। থ্রিলিং ইনডিড।
অক্টোবরের
কানাডা,তাপমাত্রা মাইনাসে, ক্যাব থেকে নামতেই হাওয়া কাকে
বলে টের পাওয়া গেল।মেয়ে বেচারি নীচে এসে ঠাণ্ডায় দাঁড়িয়ে, ঢুকতে
তো হবে কোড নাম্বার দিয়ে।পঁচিশ তলার বিল্ডিং,আট তলায় ওর
ফ্ল্যাট। গোটা চারেক লিফট,সাজানো গোছানো ল্যান্ডিং পেরিয়ে
লিফটের মধ্যে সেঁধিয়ে গেলাম দুজনে।
ঘরে
ঢুকে কী শান্তি। মেয়ে বলল,মা রান্না করে রেখেছি,খাও তুমি।
উফ!
ভাবা যায়! কলকাতায় যে মেয়ে বাড়ির কিচেনের পথেই কখনো হাঁটেনি,রান্না তো অনেক
দূরের কথা,সেই মেয়ে বাড়ি থেকে যাবার সাত মাস পরেই বলছে,মা,রান্না করে রেখেছি। এও কি শোনার কথা ছিল? কিচেনে গিয়ে দেখি,একটা বড়োসড়ো পাত্রে মোটামুটি গোটা
পনেরো পিস রুই মাছ ঝোলের মধ্যে সেঁধিয়ে আছে।সেই সঙ্গে রাখা আছে ফুলকপি ভাজা আর
ভাত।
"এই
এত মাছ কি জন্য রে?"
"আমি
একসঙ্গেই অনেক দিনের রান্না করি তো!আর তুমি আসবে বলে একটু বেশিই করে রাখলাম।"
একসঙ্গে
অনেক দিনের মানে এই এত!
আমার
তো চক্ষু ছানাবড়া । ভাবলাম,যে কদিন আছি,প্রতিদিন রান্না করব আলাদা আলাদা আইটেম,একসঙ্গে এতদিনের রান্নার এই সেশনের কিছুদিনের জন্য যবনিকাপাত হোক।
খেয়ে
নিয়ে চোখে ঘুম নেমে এল।জেটল্যাগ যাবে কোথায়।আমার জন্য মেয়ে কিনে রেখেছে একটা
সিঙ্গল বেড,আমি মাটিতে বসতে পারিনা,তাই।ওখানে নবীন চাকুরেরা
অনসাইটে গিয়ে সবাই মেঝেতে ম্যাট্রেস পেতেই শোয়,মেয়েও তাই,পাশেই ল্যাপটপ থাকে,দরকার পড়লেই রাতে উঠে সাপোর্ট
দিতে সুবিধে হয়।
ধপাস
করে খাটে শুয়ে কমফর্টার চাপা দিয়েই চোখ বুজে এল।বাইরে যতই মাইনাসে পৌঁছে যাক তাপমাত্রা, ভিতরে তো রুমহিটারের আরাম।ঘরের
ভিতরটা কলকাতার অক্টোবর না কানাডার,তা বোঝার কোনো উপায় নেই। মেয়ের
গল্প আর থামছেনা। এত দিনের এত কথা কি আর স্কাইপে হয়! সামনাসামনি কতদিন বাদে গল্পের
স্বাদ! ছড়ানো ছিটোনো জিনিসপত্র। টুকটাক গোছাচ্ছি। মেয়ের তো খুশির সীমা
নেই।রান্নাঘরের চৌহদ্দি মাড়াতে হবেনা আগামী কিছু মাস,খুশির
এটাই কারণ।মনে পড়ছে,আমার বিয়ের ঠিক পরপর মা বাবা গিয়েছেন
পুণায় আমার নতুন সংসারে, আর আমিও দারুণ খুশি,কদিন রান্নাঘরের মধ্যে সেঁধোতে হবেনা,কারণ মা আছেন।
যুগে যুগে মায়েরা এভাবেই সন্তানের খুশির কারণ হয়ে যান,সন্তান
তা মুখে স্বীকার করুক আর নাই করুক,মনের মধ্যে কোথাও একটা ছাপ
রেখে যায় এই স্মৃতি।
আমার
ল্যাপটপ লাগানো হলো অনেক কষ্টে অন্য ল্যাপটপের প্লাগ জুড়ে।চার্জিং পয়েন্ট যে
আলাদা।এদিকে ল্যাপটপ ছাড়া ফেসবুক হবে কি করে?মেয়ের ল্যাপটপে অভ্র নেই,ওসব ডাউনলোড করা আবার ঝামেলা।তাছাড়া ওর নিজের কাজ থাকে। তখন ফোনের মডেল
এতটাও উন্নত নয়। লেখা যায়,তবে সময় লাগে প্রচুর।অভ্রও নেই
সেখানে।ফোনের নিজস্ব বাংলা ফন্টই ভরসা।
ইতিমধ্যে
প্ল্যান হচ্ছে,সেই রবিবারেই নায়াগ্রা যাওয়া হবে।অক্টোবরের শেষ প্রায়,এরপর নায়াগ্রায় বরফ জমলেই সব মাটি।সে তো আর হতে দেওয়া যায়না।
"মা,দেখো,পরশুই কিন্তু।পারবে তো?তুমি তো সারাদিন ঢুলছ।"
নায়াগ্রা!সে
তো স্বপ্নযাত্রা!
পৃথিবীর
কোন সুখস্বপ্ন সফল করার জন্য মানুষ দ্বিতীয়বার ভাবে!
পারব
কি পারব না সে প্রশ্নই তখন অবান্তর।
এক
সপ্তাহ পর কি হয় না হয়। রবিবারেই নায়াগ্রা যাওয়া স্থির হলো।
তিন
জেটল্যাগ
কাটানো সত্যিই মুশকিল।মধ্যে একটাই দিন শনিবার,একটু বাজার করাও দরকার,রান্নাও করে রাখতে হবে,পরদিন সকালে বেরোনো,ফিরতে ফিরতে রাত হতে পারে।ডিনারটা রেডি রাখা দরকার আগে থেকে।ঘুরে এসে কতটা
শক্তি অবশিষ্ট থাকবে জানা নেই। সবই তো একা হাতে করা,কোনো
সাহায্যকারী কেউ তো সবজি কেটে দিতে,বাসন মাজতে আসবেনা।
পরদিন
সকাল সকাল রেডি হয়ে বেরোলাম।যদ্দূর মনে পড়ছে,সাবওয়ে অর্থাৎ মেট্রো ধরে গেলাম নায়াগ্রা
যাবার বাসস্ট্যান্ডে।মেয়ের এক বন্ধুর আসার কথা ছিল,সে কোনো
কারণে আসতে পারেনি। বাস জার্নিটা কতক্ষণের ছিল সেটা ঠিক মনে নেই।কিন্তু সেটা শেষ
হতে সে এক বিপত্তি।নায়াগ্রা অবধি হাঁটতে হবে,বেশি নয়,মিনিট দশেক।কিন্তু সেটাই আমার নড়বড়ে হাঁটুর পক্ষে অনেক। মেয়ে তো রেগেই
অস্থির।উফ তোমাকে নিয়ে কোথাও যাওয়াই তো যায়না।ভাল্লাগেনা। এখানে কি সব জায়গায়
ট্যাক্সি পাওয়া যায় নাকি?যায়না যাবেনা করেও ট্যাক্সি একখান মিলল শেষ পর্যন্ত।যাক বাঁচোয়া।
পাঁচ মিনিটও লাগল না গন্তব্যে পৌঁছে যেতে।
পৌঁছলাম নায়াগ্রা ফলসের বিশাল চৌহদ্দির গেটে।
উত্তর
আমেরিকার নায়াগ্রা নদীর উপর মূলত তিনটি পাশাপাশি অবস্থিত ভিন্ন জলপ্রপাত নিয়ে এই
নায়াগ্রা জলপ্রপাত । তিনটি জলপ্রপাতের
নাম: হর্স্ শু ফল্স বা কানাডা ফল্স, আমেরিকান ফল্স এবং ব্রাইডাল ভিল ফল্স।
হর্স্ শু ফল্স এর আকার ঘোড়ার খুরের মতো। Onguiaahra শব্দ থেকে
নায়াগ্রা কথাটির উৎপত্তি যার অর্থ জলরাশির বজ্রধ্বনি।
সে
এক মহা সমারোহ বটে। একটা প্রাকৃতিক সম্পদকে কিভাবে সংরক্ষণ করতে হয়,কিভাবে তা পর্যটনকে
পরিপুষ্ট করার কাজে লাগাতে হয়,অনেক কিছুর মতো এসবও ওদের কাছে
শিখতে হয়।একটি প্রপাত বই তো নয়। তার
মনোহারিত্বকে জগতের কাছে তুলে ধরার
কত না আয়োজন করে রেখেছে দুটি দেশ। একদিক থেকে আমেরিকা,অন্য দিক থেকে কানাডা।প্রপাতের সৌন্দর্য আর বৈভবকে সামনাসামনি দেখানোর জন্য দু দিক থেকে বোটের
ব্যবস্থা। আমেরিকার সেই প্রয়াসের
নাম Maid of the Mist,কানাডার Hornblower
Niagra Cruises.টিকিট কেটে উঠতে হবে বোটে,যাত্রীদের জন্য রাখা আছে
থরে থরে রেনকোট। আমেরিকার বোটের রেনকোট নীল,কানাডার গোলাপি।
দুদিক থেকে ছুটে আসছে সারি সারি নৌকো। যাত্রীরা অবগাহন করছে সেই পৃথিবীবিখ্যাত
জলধারায়। উদ্দাম জলের গর্জনে গায়ে কাঁটা দিচ্ছে সবার। নৌকোর যাত্রীরা যেন বলতে চায়,আলোকের এই ঝর্নাধারায় ধুইয়ে দাও..
এসব
মুহূর্তকে ধরে রাখা চাই।অথচ ফোন তো ভিজে নষ্ট হয়ে যাবে। আগেই যা হোক কিছু খিচিক
হলো। রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছি,মেয়ের এটা দু নম্বর ভিজিট,আমার
প্রথম। গোটা কুড়ি মিনিটের ট্রিপ,জলপ্রপাতের ঠিক নীচে পৌঁছে
তো নিজেরাই ভিজে টইটুম্বুর,আর খিচিকের ব্যাপার নেই। মোবাইল
খোলসে ভরে ব্যাগের ভিতরে। তখন অবশ্য ছবি তোলার চেয়ে দু চোখে প্রাণভরে দেখাই ভালো
সেই শ্বেতশুভ্র বৈভবকে। দু দেশের বোটের
যাত্রীর দল একে অপরকে চিয়ার করছে,সেও এক দেখার মতো ব্যাপার। হু
হু করে নামছে ধারাজল,গর্জনে কিচ্ছু শোনা যাচ্ছেনা,কিছু একটা প্রত্যক্ষ করছি যা দেখলে জীবন
সার্থক। বোট ঘুরল। ফিরছে। ফিরলাম আমরাও। গোলাপি রেনকোট খুলে রেখে বোট থেকে
নেমে এলাম। আরো কিছু কিছু দেখার জিনিস ছিল,তার জন্য মনে হয়
অন্য কিছু টিকিট ইত্যাদি কাটতে হতো। আমরা সেসবের দিকে আর যাইনি। এদিক ওদিক ঘুরছি
হেঁটে হেঁটে। রেস্তোরাঁ আছে,সেখানেই খাওয়া হলো। রৌদ্রোজ্বল
দিন,ফোটোসেশন তো চলছে,চলবে।
সেদিন
সত্যিই নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে হলো। খারাপও লাগছিল,আমি একাই এই দৃশ্য দেখার সুযোগ
পেলাম,আর একজন বেচারা কলকাতায় নিজের কাজকম্ম সংসার সব একাই
সামলাচ্ছে। এত দিনের জন্য তার আসাও সম্ভব নয়,আবার মেয়ে চায়
মা থাকুক কয়েকটা মাস তার কাছে। এমন দিন তো দেখলামই মেয়ের দৌলতে। এমন সৌভাগ্যই বা
কজনের হয়? নায়াগ্রা থেকে ফিরেও ঘোরের মধ্যে ছিলাম। মনে
হচ্ছিল বারবার সেই কথা যা বঙ্কিম নবকুমারের মুখ দিয়ে বলিয়েছিলেন, আহা,কী দেখিলাম! জন্ম জন্মান্তরেও ভুলিব না।
চার
দেখার
জায়গা তো কতই টরন্টোয়,কিন্তু যাবার সময় তো সেই এক শনি আর রবি। অন্যদিন তো মেয়ের অফিস। সেটা
অবশ্য আক্ষরিক অর্থেই ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে,জানলা দিয়ে দেখলে
উল্টো দিকের ঝাঁ চকচকে বহুতলটাই ওদের অফিস। আমি যাওয়ার পর রোজই লাঞ্চে বাড়ি আসে,আমি তার আগে রান্নাবান্না করে রাখি। অফিসের অধিকাংশ বাঙালিরাই ওদের বিল্ডিং এই থাকে। আমি গিয়েছি বলে এ
ফ্ল্যাটে ও ফ্ল্যাটে ডাকাডাকি,খাওয়াদাওয়া,পারস্পরিক নেমন্তন্ন এসব তো চলছেই। যাওয়ার কদিনের মধ্যেই একটি বাঙালি
পরিবারে বাচ্চার অন্নপ্রাশন,মহিলামহল সবাই দেখি ওই ঠাণ্ডায়
শাড়ি পরেই গিয়েছে পার্টিতে।আসলে অনেকদিন যারা রয়েছে গাড়ি আছে মোটামুটি সবার,গাড়ি ছাড়া সাবওয়েতে অত ঠাণ্ডায় শাড়ি পরলে জমেই যেতাম। মেনুতেও পুরোপুরি
বাঙালিয়ানা। বিরিয়ানি পোলাও মিষ্টি কোনোটাই দুর্লভ নয় দেখা গেল। বেশ পারিবারিক আবহ,এর বাচ্চাকে ও সামলাচ্ছে,যেমন পারিবারিক অনুষ্ঠানে
হয়।
তবে
সব পরিবারের মতো এখানেও দেখলাম এর অনেকটাই বাহ্য। ভিতরে ভিতরে এর উপর রাগ,ওর উন্নতিতে
হতাশা,তার প্রমোশনে মুখ অন্ধকার,এসবও
যে রয়েছে ফল্গুধারার মতো,তা তো ধীরে ধীরে বেশ মালুম হলো। ব্যাপারটা হলো,দশজন বাঙালি
একত্রিত হবে আর কূটকচাল,পারস্পরিক নিন্দেমন্দ খেয়োখেয়ি বাদ
থাকবে তা তো আর হয়না। সেখানেও তাই কলিগদের মধ্যে গলাগলির পাশাপাশি দলাদলিও আছে জোরকদমে। গিয়েছি অনেকের বাড়িতেই। বিদেশে গেলে একটা
ব্যাপার দেখি,ছেলেরা কাজ করে,রান্নাবান্না
করে বেশিরভাগ পরিবারে। আমি যে পরিবারে খুব
যেতাম,সেখানে ছেলেটি অফিস যাবার আগে বাচ্চা সামলাত,তারপর বৌ বাচ্চার দায়িত্ব নিত,রান্নাবান্না করার সময়
পেত না। অফিস থেকে এসে ছেলেটি রোজ রান্না করত। তার রান্নার হাতটিও তেমনি খাসা। কোন
রান্নাটা সে জানেনা! রকমারি মাছ মাংসের পদ,বিরিয়ানি, তন্দুর । সব বাড়িতে ওখানে ওভেনের
সঙ্গে তন্দুর থাকে। সেখানে কেক পেস্ট্রি সবই হয় জবরদস্ত। কত কিছু যে খাইয়েছে ওরা।
কোথায় আমার খাওয়ানোর কথা। আমায় কিছু করতে দিত না।বলত, আন্টি,তুমি চলে এসো,আমরা একসঙ্গে এখানেই খাব।
মেয়েরই
কলিগ অর্ঘ্য নামে ছেলেটি,ওদের সঙ্গে মেলামেশা ছিল বেশ,আমাকে তো খুবই খাতির
করত। মেয়েকে বলেছিল,আন্টি সারাদিন কি করে সময় কাটায়,তুই বলবি আমাদের ফ্ল্যাটে চলে আসতে।হৈমন্তী আছে,আন্টির
একা লাগবে না।আমার মেয়ে তো শুনে হেসেই কুটিপাটি। বলে,আমার মা
একা? মা আমার চেয়ে বেশি ফেসবুক করে। সারাক্ষণ ফেসবুক হোয়াটস
অ্যাপ,বাবার সঙ্গে স্কাইপে কথা,দিদাকে
ফোন,এসব নিয়ে মা তুমুল বিজি।আর লেখালেখি আছে, মা একদমই সময় পায়না বরং।
অর্ঘ্যদের
বাড়ি সন্ধেবেলা মাঝেমাঝেই যেতাম। ওদের
বাচ্চাটা যে কী মিষ্টি আর দুষ্টু। সামলাতে ওরা হিমসিম খেত। ওর বৌ বাচ্চা হবার পর
নিজের চাকরিবাকরি ছেড়ে চলে গিয়েছিল এখানে একা বাচ্চার ঝক্কি নেবেনা বলে। গিয়ে অবধি
আবার হতাশায় ভুগত। বলত,ফিরে গিয়ে আমি পিছিয়ে যাব। আমার কেরিয়ারটা নষ্ট হয়ে গেল।
আসলে
এই সমস্যাটা অনসাইট যাওয়া ছেলেদের স্ত্রীদের ক্ষেত্রে প্রবল। সাময়িকভাবে অনসাইট তো
যেতেই হয় অনেককে,আর কিছুদিন ওখানে থাকলেই ব্যাঙ্কব্যালেন্স তো বেশ ভালোই পরিপুষ্ট হয়,এতে তো কোনো সন্দেহ নেই। তাই কেউই সুযোগ পেলে ছাড়েনা। সকলের স্ত্রী তো
আইটি সেক্টরে থাকেনা,কিংবা থাকলেও তাদের প্রজক্টের অনসাইট
একই দেশে হয়না সবসময়,হলেও সুযোগ থাকেনা সকলের জন্য। অথচ
বিয়ের পর আলাদা থাকলে তো সংসারের মূল বিষয়টাই নড়বড়ে হয়ে যায়। ফলে সংসার
বাঁচাতে কোপটা পড়ে বৌদের ঘাড়ে। তারা প্রথম
প্রথম বিদেশের মোহে সব ছেড়ে দিয়ে চলেও যায়,কিন্তু গিয়ে আবার
হতাশায় ভোগে। অনেক মেয়েই তো কেরিয়ারিস্ট হয় আজকাল। অনেকেই তাই বিদেশে গিয়ে সেটল
করে। কানাডায় পি.আর.পাওয়া শক্তও নয়।ফলে দুজনেই চাকরি করতে পারে। আর বাচ্চাদের
শিক্ষা স্কুলিং সবটাই ওখানে নির্ঝঞ্ঝাট। একবার থাকতে শুরু করলে দেশে ফেরার ইচ্ছে
আর হয়না অনেকেরই। সেক্ষেত্রে আবার দেশে মা
বাবার গোঁসা। সবটা মিলে সমস্যা জটিল হতে থাকে।
যাওয়ার
কদিন পরেই আমার জন্মদিন। মেয়ে বলল,তোমার জন্মদিনে অর্ঘ্যদা হৈমন্তীদিকে
ডাকি? বললাম,ঠিক আছে,চিকেন টিকেন যা হোক নিয়ে আয়। প্রথম প্রথম ওই বাজার করত। সাবওয়ের পাশেই
লঙ্গোস মল। সবই পাওয়া যায়,মাছ আর মাটন ছাড়া। ওখানে তো কেউ
বয়ে বয়ে জিনিস আনেনা,শপিং এর জন্য ট্রলি ব্যাগ থাকে,শপিং কার্ট বলে।ও টাই ঠেলে নিয়ে যাওয়া আর ভর্তি করে নিয়ে আসা। কোনো কষ্ট
নেই। রাস্তাতে সব জায়গায় স্লোপ। সেখান দিয়ে কার্ট হুইলচেয়ার প্র্যাম সবই যাচ্ছে
অনায়াসে।
সেবারের
জন্মদিন পালন হলো মেয়ের কাছে। বিল্ডিং এর নীচের তলাতেই স্টোর,সেখানে মোম কেক
সবই পাওয়া যায়।সব আনা হলো। অর্ঘ্যরা আনল ওয়াইন। আমি বললাম,আমি
কিন্তু খাবনা। মাথা ঘোরে আমার। মেয়ে বলল,দূর,এ তোমার ওই পাতি হুইস্কি নয়। ওয়াইন খাও একটু। ভাল্লাগবে। আমরাও তো অল্পই
খাব সবাই। জন্মদিন তো প্রতিবারই আসে। এমন জন্মদিন আর কি আসবে কখনো?
পাঁচ
ওখানে
যাওয়ার কদিন পরেই কলকাতা থেকে কানাডায় গিয়েছিলেন মেয়ের এক বন্ধুর মা আর বাবা। মেয়ে
আর তার সেই বন্ধুর স্কুল কলেজ ইয়ার সব এক হলেও সেই সময় কেউ কাউকে চিনত না,পরে কলকাতায়
অফিস কলিগ থাকার সময় বন্ধুত্ব হয়,সেও মাস কয়েক আগেই অনসাইটে
এসেছে,তার অফিস আর বাসস্থান কিচেনার শহরে। প্রধানত আমেরিকা
বেড়াবার উদ্দেশ্যেই পাড়ি দিয়েছিলেন ছেলেটির মা বাবা,যাবার
আগে একদিনের জন্য তাঁরা টরন্টোয় এসে সারাদিন আমাদের সঙ্গে থাকবেন শুনলাম। সেই
অনুযায়ী প্ল্যান প্রোগ্রাম করা হলো,ভাবা হলো টরন্টোর বিখ্যাত
সি এন টাওয়ার আর তার উল্টোদিকের অ্যাকোয়ারিয়াম দেখতে যাওয়া হবে।আমারও দেখা হয়নি,আর দুজনে মিলে বেড়াতে যাওয়ার চেয়ে
সঙ্গী হিসেবে অন্য কাউকে পেলে তো ভালোই হয়।
ওঁরা
এলেন,সারাদিন একসঙ্গে বেড়ানোও হলো।
সারাজীবন একই শহরে থাকা সত্ত্বেও যাদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ আলাপ পরিচয় কস্মিনকালেও
হয়না,তারাই বিদেশে গিয়ে একে অপরের অতিথি,কখনো সফরসঙ্গী হয়ে যায়।
অ্যাকোয়ারিয়ামটি বস্তুতই দর্শনীয়। শুধু তো মাছ নয়,কত রকমের
জানা অজানা জলজ প্রাণীকে যে কি মনোগ্রাহী ভাবে সংরক্ষণ করে রাখা,তা না দেখলে বিশ্বাসই করা যায়না। তবে হাঁটতে হয় অনেকটাই। ভিতরে সুড়ঙ্গ মতো
বানানো,দু পাশে সারি সারি অ্যাকোয়ারিয়ামে ঘুরে বেড়াচ্ছে
রঙিন প্রাণীর দল। পৃথিবীতে জলের উপর যত না প্রাণীর বাস,জলের নীচে তার
চেয়ে অনেক বেশি প্রাণী বসবাস করে এমনটাই পড়েছি ছোটবেলায়। সি এন টাওয়ারের চূড়ায় উঠে নীচে তাকাতে গেলে
ফাঁকা একটা জায়গায় দাঁড়াতে হয়,এক মিনিটের মধ্যে হাওয়ায় উড়ে যাওয়ার উপক্রম। সেখানে আবার একটা
কাচের মেঝে,নীচের দিকে তাকালে মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়া বিচিত্র
নয়।সারাদিন ঘুরে বেড়িয়ে ফোটোসেশন,খাওয়াদাওয়া করে ফিরলাম।
ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা সন্ধ্যের বাসে আমেরিকায় যাবার জন্য রওনা দিলেন,ছেলে ফিরল কিচেনারে।বলা বাহুল্য,ওঁরা কলকাতা
থেকে দুই দেশেরই ভিসা করিয়ে
এনেছিলেন।কানাডায় অবশ্য আমেরিকার ভিসা পাওয়া খুবই সহজ,আর
অনেকেই আমেরিকায় ঘুরে আসার সুযোগটা নষ্ট করেনা ।
কানাডায়
প্রচুর ভারতীয়,তার মধ্যে বাঙালিও অনেক।শপিং মলে গিয়ে বাংলায় হাঁকডাক কথোপকথন শুনে কতবার
চমকে গিয়েছি।প্রচুর বাঙালি ওখানে সেটলড। মেয়ের সাউথ পয়েন্টে ক্লাসমেট ছিল অভিষেক ,তার মায়ের সঙ্গে কত গল্প করেছি স্কুল ছুটির সময় মেয়েকে আনতে
গিয়ে।তারা বহুদিন যাবৎ
টরন্টোবাসী।অভিষেকের সঙ্গে মেয়ের যোগাযোগ হয়েছে আগেই। আমি যাব ওরা জানত। একবার
শুনলাম ওরা আমাদের নিমন্ত্রণ করেছে আগামী
রবিবার।
একেবারে
উল্টো প্রান্তে অভিষেকরা থাকে,সেই মিসিসাগার দিকে। ওখানে নিজেদের বাড়ি বানাতে গেলে
ডাউনটাউনে সচরাচর সম্ভব হয়না,সাধারণত তা মূল শহর ছাড়িয়েই হয়।
রবিবার বেরিয়ে দেখা গেল সেদিন ওইদিককার ট্রেন বন্ধ।কেলেঙ্কারি। এদিকে ওরা রান্নাবান্না
করবে,না যেতে পারলে খুবই খারাপ হবে। টরন্টোয় যাতায়াতের জন্য
সবাই এতটাই সাবওয়ে নির্ভর যে সেটা বন্ধ থাকা মানে ঘোর বিপদ। তখন বাসের কথা ভাবা হলো। টরন্টোর বাস সার্ভিস অবশ্য
খুবই ভালো,তেমনি বাসগুলোও। ওঠার ধাপ একেবারে রাস্তা থেকে।
বাসে উঠতে কোনো কষ্ট নেই আমার মতো ঘায়েল হাঁটুর লোকেরও।
বাস
থেকে নেমে অভিষেকের গাড়িতে গেলাম ওদের বাড়ি। বৈশাখীর সঙ্গে আলাপ তো ছিলই,কিন্তু ওরা
বিদেশে গিয়ে সেটল করার পর আর দেখা হয়নি। বৈশাখী দেখি একই রকম আছে।চার্মিং,স্লিম,সুন্দর। এতটুকু পরিবর্তন নেই। কী সুন্দর
মেইনটেইন করে রেখেছে নিজেকে। আগেও সুন্দর ছিল,পরেও সুন্দর।
আসলে ফ্রি হ্যান্ড এক্সেরসাইজ ওখানে সবাই করে,জিমেও যাওয়ার
অভ্যেস সবার। নিজেদের আজীবন ফিট রাখার
জন্য নানা প্রচেষ্টায় কোনো খামতি নেই ক্যানাডিয়ানদের। ভারতীয়রা গিয়েও এগুলো শিখে
নেয়,যারা ওখানে সেটল করে।
বৈশাখী
কত রকমের রান্নাবান্না করেছে তার শেষ নেই। এসেছে বৈশাখীর হবু পুত্রবধূ বাঁধন। তারাও বহুদিন ধরে টরন্টোর
বাসিন্দা।ওর মা বাবার আদি বাড়ি বাংলাদেশে। বাঁধনের বাংলা কথায় পুরোপুরি বাঙাল
টান।অথচ ইংরেজি বলে ক্যানাডিয়ান অ্যাকসেন্টে। বাংলা গানও গায়। বেশ বড়ো আর সুন্দর
বাড়ি,যেমন হয় ওখানকার বাড়িগুলো। নীচে মানে আন্ডারগ্রাউন্ডেও ঘর আছে,জিম আছে,আর তেমনি সাজানোগোছানো সবটাই। যেখানে সব কাজ নিজেদের করতে হয়,সেখানে এত
পারিপাট্য অতটাও সহজ কিনা জানিনা,তবে ওখানে সবার বাড়িঘরই খুব
পরিপাটি। সারাদিন ধরে খাওয়াদাওয়া গান টান পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন সব হলো,বিকেলে ওদের সঙ্গে
গেলাম কাছেই ভারত সেবাশ্রমে। ফেরার সময় অভিষেকরা আমাদের বাড়ি অবধি পৌঁছে দিল
গাড়িতে, বাঁধন গাড়ি ড্রাইভ করল। আমি ওখানে থাকাকালীনই ওদের
বিয়ে হয়, বিয়েটা অবশ্য কলকাতাতেই হয়েছিল।
কানাডায়
একটা বিষয় কি,ঠাণ্ডা আবহাওয়ার জন্যই সম্ভবত,কোনো কাজে ক্লান্তি
আসেনা।নইলে এই যে অতগুলো মাস ধরে একা হাতে সব কাজ করে এলাম,মেয়ে
মধ্যে মধ্যে ভ্যাকুয়াম ক্লিনিংটা করে দিত,বাদবাকি সবই তো
একা হাতে সামলেছি,কখনো এতটুকুও পরিশ্রান্ত লাগেনি।কিচেনে
অবশ্য হট ওয়াটারের সুবিধে ছিল,কিন্তু কাজ তো তাতে কম
হয়নি।বাড়ির কাছে নো ফ্রিলস মার্কেটিং
সেন্টার হবার পর বাজারেও যেতাম মেয়ের সঙ্গে। সে বাজারও সত্যি বলতে দেখার
মতো। সবজির রঙ দেখলেই মনে হবে ব্যাগ বোঝাই করে কিনে ফেলি।কত রকমারি যে সবজি,অর্ধেকের নামই জানিনা।বাঁধাকপি টাইপেরই চার পাঁচ রকমের সবজি। স্যালাড
জাতীয় আনাজ তো থরে থরে সাজানো। পনীর,চিংড়ি এগুলোও নো ফ্রিলসে
পাওয়া যায়।আর সব রকমের খাবারদাবার। কাঁচা
লঙ্কা অবশ্য পেতাম না। তার জন্য ভারতীয় বাজার আম্বালে যেতে হতো।চাল ডাল চিনি নুন
সর্ষের তেল এসবও আম্বাল থেকে আনতে হতো। আমি সেই বাজারে যাইনি কখনো। কিন্তু বেরিয়ে
বাজার করে ফিরে আনাজ কেটে রেঁধেবেড়ে লেখালেখি ফেসবুক সব করার পরেও ওখানকার সবজির
মতোই তরতাজা থাকতে পেরেছিলাম। সম্ভবত
জলহাওয়ার গুণে।
ছয়
সুইমিং
পুল আর জিম। সব বহুতলে থাকবেই থাকবে। সেসব সার্ভিস চার্জ বাড়িভাড়ার মধ্যেই ধরে
নেওয়া। কাজ থেকে ফিরে সকলেই প্রায় জিমে যায়। বাড়ির মধ্যেই ফিটনেস ধরে রাখার উপায়
থাকলে তা কাজে না লাগানো তো বোকামি। প্রায়
সব বাড়িতেই একটা প্যাটিও বলে জায়গা থাকে,অনেকটা টেরাসের মতো। তবে মুশকিল একটাই,আর সেটা হচ্ছে ঠাণ্ডা। এত ঠাণ্ডায় খোলা জায়গায় বসে থাকা বা আড্ডা দেওয়া
কোনোটাই সম্ভব হয়না। সুইমিং পুলের পাশেই প্যাটিও শুনে প্রথম যখন গেলাম, দেখি প্যাটিওতে পুরু বরফ জমে রয়েছে।বরফ ঢাকা ছাদ! ব্যাপারটা ভাবতে গেলে
দুর্দান্ত। কিন্তু উপভোগের পথ প্রায় বন্ধ। তার মধ্যেও আমাদের ফোটোসেশন দেখে পুলের
ভিতর থেকে কাচের দরজা দিয়ে লোকজন আমাদের দেখছে।
কেউ কাউকে হাঁ করে দেখেনা যে দেশে, সেখানেও আমাদের
আজব আচরণ দেখে লোকজন অবাক না হয়ে পারেনি।
তবে
সত্যিই কেউ কারো প্রতি অহেতুক কৌতূহলী নয়
ও দেশে। যে যার নিজের মতো নিজের কাজ নিয়ে থাকে,আবার তার মানে এই নয় যে কারো অসুবিধা
দেখলে মুখ ঘুরিয়ে চলে যাবে। আমাদের যেমন মানুষের সামান্য কিছু অসঙ্গতি দেখলেও চোখ
দিয়ে গিলে খাবার স্বভাব। অথচ কেউ রাস্তায় পড়ে থাকলে না দেখার ভান করে চলে যাই।ওরা
ঠিক উল্টো। কারও প্রয়োজন না থাকলে তাকে
কেউ বিরক্ত করবেনা।অথচ শপিং মলে অনেকক্ষণ হাঁটার পর ব্যথায় খানিক খোঁড়াতে
দেখেই চার পাঁচজন ছুটে এসে জেনুইন উৎকন্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করছে আমার কোনো সাহায্য
প্রয়োজন কিনা। লোকজন কিন্তু বিবেকহীন নিরাবেগ স্বার্থপর নয়। সৌজন্যবোধও ওদের
অদ্ভুত। আমাদের যেমন স্বভাবই তাড়া থাকলে একে অপরকে টুক করে ধাক্কা মেরে চলে যাওয়া।
লাইন মানেই কে আগে দাঁড়িয়েছে কে পরে এসেছে তাই নিয়ে তর্কাতর্কি। কেউ কারো জন্য
আমরা জায়গা সাধারণত ছেড়ে দিইনা। অথচ ওখানে সাবওয়ের মধ্যে ঢোকার গেটে প্রতিদিন
দেখতাম যিনি আগে পৌঁছেছেন, তিনি গেট খুলে দাঁড়িয়ে আছেন,যেহেতু আমি সিঁড়ি দিয়ে নামছি। আমি গেলে তবে উনি যাবেন। সবসময় অন্যদের আগে
যেতে দেওয়াই ওখানকার নিয়ম।কখনো এর ব্যত্যয় হতে দেখিনি। এসব দেখে নিজেই লজ্জিত হয়ে
ভেবেছি তাড়াতাড়ি নেমে যাই,উনি আমার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন। ভালো
কাজ আসলে ভালোর জন্ম দেয়।অন্যকে দেখে মানুষ শেখে।
ট্রেনে
কিছু আসন থাকে স্পেশালি এবলড অর্থাৎ প্রতিবন্ধীদের জন্য,সেখানে কেউ
বসেনা,সিট না থাকলেও।মেট্রোয় দু চারবার কাপলদের হামি খেতে
দেখেছি,কেউ তাকায় না,আমার অনভ্যস্ত
চোখ(আমি কলকাতায় মেট্রো চড়িনি)বলে একটু থমকেছি ঠিকই,কিন্তু
পরক্ষণেই চোখ সরিয়ে নিয়েছি, কারণ দেখার কোনো কারণ নেই।
প্রকাশ্যে প্রেমে বাধা নেই বলেই প্রকাশ্যে কাউকে বেলেল্লাপনা করতে আমার পাঁচ মাসের
প্রবাস জীবনে দেখিনি। অথচ এখানে সামান্য হামি নিয়ে মেট্রো এবং মেট্রোপলিস তোলপাড়
হয়ে গেল। প্রকাশ্যে হামি খাওয়া অ্যালাউ করলেই নাকি দেশটা জাহান্নমে যাবে,এমন কথাও শোনা গিয়েছে। মেট্রোদাদুরা টরন্টোয় একবার ঘুরে এলে এত কাণ্ড ঘটত
না সম্ভবত।
ভারতীয়
আচার আচরণ নিয়ে এখানে লোকজনের খুব দম্ভ,অথচ আচরণ আর ভদ্রতা শিখতে হয় ওদের কাছে। মানুষের
ব্যক্তিস্বাধীনতার মূল্য দিতে জানে ওরা,আর তাই নিজেদের কি
করা উচিত তা ওদের কাছে স্পষ্ট। পোষ্য ওরাও রাখে,আমরাও রাখি।
কিন্তু পোষ্য রাখার নিয়ম ওরা যেভাবে মানে,আমরা মানিনা। এখানে
কারো বাড়িতে কুকুর থাকলে তাকে প্রপার ট্রেনিং কম লোকই দেয়। ট্রেনিং মানে বল মুখে
নিয়ে ছোঁড়া বা ছুঁড়ে দেওয়া বল তুলে আনা নয়।ট্রেনিং মানে অতিথিদের সঙ্গে আচরণ।
লিফটে প্রায় প্রতিদিনই সারমেয়দের মুখোমুখি হতাম,তারা লিফটের
কোনায় সরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। গায়ের কাছে এসে ঘেউ ঘেউ করার ব্যাপারই নেই।এখানে
কারো বাড়িতে কুকুর থাকলে অতিথিদের দেখলে তারা অনেকসময় ঘাড়ের উপর উঠে আসে।আমি কুকুর
ভালোবাসি বলেই অন্যেরাও তাদের বিষয়ে সাবলীল স্বচ্ছন্দ হবেই,এমনটা
তো নাও হতে পারে। কিন্তু এখানে সে সব খুব কম লোকই বোঝে আর মানে।বাড়িটায় পোষ্যের
সংখ্যা ছিল প্রচুর,কিন্তু কোনোদিন কারো গলার আওয়াজ শুনিনি।
ব্যক্তিগত পোষ্য যদি অন্যের অসুবিধা বা বিরক্তির কারণ হয় তবে ওখানে তা শাস্তিযোগ্য
অপরাধ। পোষ্যদের জন্য নিয়মকানুনও অনেক। এমনিতেই ট্রেন্ড ছাড়া কোনো পোষ্যই কেউ
রাখতে পারবেনা। কেউ পোষ্য নিলে সেন্টার থেকে মাসে মাসে এসে রিভিউ করা হয়,তার প্রতি যত্ন ঠিকভাবে হচ্ছে কিনা দেখার জন্য। প্রতিটা পোষ্যের বডিতে চিপ
লাগানো থাকে।যদি হারিয়ে যায় তবে সেই চিপের মাধ্যমে তাকে খুঁজে আনা যায়।
সাত
বিদেশে
মানুষ অনায়াসে বন্ধুবৎসল হয়ে ওঠে। মা বাবাকে ছেড়ে গিয়ে প্রথমে তো বন্ধুরাই ভরসা।
মজার ব্যাপার, অধিকাংশই যাবার পরে বন্ধু,যারা আগে থেকে কেউ কাউকে
চেনেনা। ব্লোর স্ট্রিটের বাড়িটায় এমনই সব ছেলেপিলের দল। তাদের মধ্যে অর্পণ বলে
একটি ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে চেয়ার কিনতে গিয়েছিল মেয়ে,আমার জন্য।
ওখানে ফার্নিচার নিজেদের গিয়ে আনতে হয়।নইলে ডেলিভারির চার্জ প্রচুর।খাট কিনে আনলে
সেই খাট নিজেদেরই যন্ত্রপাতি দিয়ে লাগাতে হয়।কেউ এসে ইনস্টল করে যায়না।প্রত্যেকেই
এরা নিজেরা সব কাজ পারে সেই কারণেই।সেল্ফ হেল্প। নিজের সব কাজ নিজেকেই করতে
হবে।এভাবেই ছোট থেকে শেখে সবাই।আর স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে ওঠে। সেই অর্পণ বিয়ে করার পর
ওর বৌ ওখানে গেলে ওর সঙ্গেও খুব বন্ধুত্ব হয় সঞ্চারীর।
একটি
রুমে তিনটি ছেলে থাকত। আমি যাবার পরই তারা গিয়েছিল।তাদের মধ্যে শশাঙ্কর সঙ্গে
প্রথম দেখা ইটন সেন্টারে শপিং মলে,গিয়েই অচেনা ছেলেটি "কাকীমা চলো
তোমাদের ছবি তুলে দিই",এসব বলে জমিয়ে নিল।কিছুদিন পরে
প্লাবনের আসার কথা। ইতিমধ্যে আমার একটা চশমার ডাঁটি
ভেঙে গেছে।আছে আর একটিমাত্র। মেয়ে বলল বাবাইকে বলো চশমা বানিয়ে প্লাবনকে দিয়ে আসতে
।আসলে তখনও অত ওখানকার দোকানপাট হালহকিকত জানা হয়নি। এদিকে পাওয়ার ছাড়া চশমা
কিভাবে হবে।ভাগ্যিস আসার আগেই চোখ দেখিয়ে পাওয়ার নিয়ে চশমা বানিয়েছিলাম,আমার বর দোকানে
গিয়ে ডেট বলে টলে সেসব খুঁজে বের করিয়ে চশমা বানিয়ে ফুলবাগানে প্লাবনের বাড়িতে
দিয়ে এল। যথাসময়ে প্লাবনের কাছে পেয়েও গেলাম সেটা।এই প্লাবনকে কিন্তু মেয়েও
আগে চিনত না,শুধু
জেনেছিল প্লাবন বলে একজন আসছে কলকাতা থেকে। মধ্যিখানে আমার একটা দরকারি ওষুধ
ফুরিয়ে গেল। আসলে কম আনা হয়েছিল ভুল করে। অনিন্দ্য বলে একটি ছেলেকে দিয়ে সেই ওষুধও
আনানো গেল। দেশে এই সব অযাচিত সাহায্য টাহায্য ফট করে কারো কাছে চাওয়া যায়না।
যাদের ঘনিষ্ঠ বলে জানি তাদেরও এগুলো বলতে সঙ্কোচ হয়।বিদেশে পরও আপন,বলা যায় পরই আপন।আমি চলে আসার পর এই ছেলেগুলোই আমার মেয়ের শুধু বন্ধুই হয়ে
ওঠেনি,তারা অধিকাংশ শনি রবিবার ওকেই ডেকে নিত আর রেঁধেবেড়ে
খাওয়াত।একবার এদের সঙ্গে কিচেনার গেলাম ওদের আর এক বন্ধুর বাড়ি। আমার তখন ফেরার
সময় হয়ে এসেছে।ওরা তাই আমাকেও জোর করে নিয়ে গেল।মোট চারজন ছেলে, আমার মেয়ে আর আমি দুদিন থাকলাম সেখানে, আমাকে ওরা
কিচেনেই যেতে দেয়নি।আমি জানিনা কলকাতায় বাড়িতে তারা রান্নাবান্না করে কিনা,কিন্তু রান্না ঘরের কাজ সবেতেই
দেখলাম ওরা পটু।শুধুমাত্র মা বাবার অতিরিক্ত আদরের গন্ধ গা থেকে ঝেড়ে ফেলে প্রকৃত
মানুষ হয়ে ওঠার জন্যই যে ছেলেমেয়েদের বাড়ি ছেড়ে কিছুদিন দেশান্তরে থাকা উচিত,
এ কথা অনুধাবন করেছি ও দেশে গিয়ে।
পুরোনো
বন্ধু অভিষেক আর ওর বৌ বাঁধনের সঙ্গে এতটাই বন্ধুত্ব হয়েছিল সঞ্চারীর যে একটা গোটা
পুজো ওদের বাড়িতে ও কাটাল,বাঁধন ওর নিজের শাড়ি পরিয়ে ওকে মণ্ডপে নিয়ে গেল।আন্তরিকতা না থাকলে এগুলো
হয়না। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই প্রবাসকালীন বন্ধুত্ব দেশে ফিরলে ক্ষীণ হতে থাকে,এটাও ঘটনা।ওখানকার লাইফস্টাইলটাও থাকেনা,বন্ধুত্বও।বন্ধু
ওর সবই প্রায় বাঙালি।মুন বলে একটি মেয়ে নতুন বিয়ের পর গেছে , সেও আমার মেয়ের সঙ্গে সাউথ পয়েন্টে পড়ত,তার বর আমার
মেয়ের কলিগ।ওদের সঙ্গে একদিন গেলাম ক্যাসা লোমায়। অরিজিনাল গথিক স্টাইলের একটি
উদ্যানসমৃদ্ধ ম্যানসন আছে মিডটাউন টরন্টো,অন্টারিও কানাডায়,সেটির নামই ক্যাসা লোমা,যা
পরবর্তীকালে ঐতিহাসিক মিউজিয়াম হয়েছে।এই মুন নামের মেয়েটিও আমাদের একদিন নেমন্তন্ন
করে খাইয়েছিল।রান্নার হাতটি এরও সোনা দিয়ে বাঁধানো। বিদেশে গেলে গুণেরও সম্যক
চর্চা হয়।আমার মেয়ে ওখানকারই ওয়েস্টার্ন গানের প্রতিযোগিতায় সেমিফাইনালে পৌঁছে
গিয়েছিল।বিদেশী প্রতিযোগীদের সঙ্গে সমানে কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে তার এই সফলতা মোটেই
সামান্য ছিল না।
আট
আসলে
সঙ্গীতই তো সেই অপাপবিদ্ধ রঙ যা দেশ কাল ভাষা ধর্ম অতিক্রম করে মানুষের মনকে
রাঙিয়ে তোলে। অন্য দেশে গিয়ে মাতৃভাষা ছাড়া অন্য ভাষায় গান গেয়ে পরপর দু বছর
সেমিফাইনালের ছাড়পত্র পেয়ে সঞ্চারী সে কথা
প্রমাণ করেছিল।টরন্টো আর সঙ্গীত ,দুটিই আমার চেতনায় অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত হয়ে রয়েছে।
ওখানে শুধু ও ই নয়,আমারও সামান্য কিছু কারাওকে রেকর্ডিং এর
হাতেখড়ি, ওর কিনে রাখা ইয়েতি মাইক্রোফোনে।বহুদিন তেমনভাবে
রেওয়াজ ছিল না,ফাঁকা বাড়িতে অবসরে গলা নিয়ে খানিক দলাইমলাই
চলল। গীতবিতান স্বরবিতান কিছুই নিয়ে যাইনি,রেকর্ড করতে গেলে
একটু প্রস্তুতি তো লাগে। তবে গুগল থাকতে পৃথিবীতে কিছুই তো দুর্লভ নয়। কারাওকে ট্র্যাক ছিল মোবাইলে,আর ওখানে
সুবিধে ছিল এই যে,নিশ্চিন্তে গান রেকর্ডিং করা যায়, মধ্যিখানে মূর্তিমান রসভঙ্গের মতো ডোরবেল বেজে উঠবেনা,কারণ ওখানে না জানিয়ে বাড়িতে আসার
কেউ নেই,কাজের মাসিদের দফায় দফায় আসার বালাই নেই,চোদ্দবার কাউকে চা দেবার নেই, কুরিয়ারও ডেলিভারির
জিনিস নীচের অফিসে দিয়ে যায়, আর সবথেকে সুবিধার, দরজায় কোনো বেল নেই।ওখানে শুধুই নকিং দ্য ডোর। ল্যান্ডফোনও নেই যে বেজে উঠে পিলে চমকে দেবে।
একটাই শুধু মুশকিল, কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর ফায়ার ব্রিগেডের
গাড়ি যায় বিকট ভাবে ঘন্টি বাজাতে বাজাতে।কিছু কিছু গানের রেকর্ডিং এ সেই আগুন
গাড়ির বিরক্তিকর ঘন্টির আওয়াজ শুনতে পাওয়া গেছে।
কিন্তু
সেটা ছাড়া নির্ঝঞ্ঝাটে গান রেকর্ড করার এতখানি নিশ্চিন্ত অবসর আমি পরে আর কখনো
পাইনি। এইভাবে ধরে রাখা গেছে আমার কিছু প্যাশন,যা হয়ত ওখানে না গেলে কখনোই আর সম্ভব ছিল
না।প্রতিটি প্রাপ্তির একটা উপযোগী পরিবেশ পরিস্থিতি থাকে যে উপহার জীবন কখনো হাতে
তুলে দিয়ে দেয়। বুদ্ধি করে তা গ্রহণ করতে হয়। গান গাওয়ার পরবর্তী এডিটিংগুলো
সঞ্চারী করে দিয়েছিল, যা আমার নিজের সাধ্য ছিল না।
গান
বাজনা যারা করে,কানাডা তাদের পক্ষে একটি অন্যতম আদর্শ দেশ বলে আমার মনে হয়। শুধু মিউজিকই
বা বলি কেন,পাশ্চাত্যের অনেক দেশের মতোই কানাডাতেও স্কুলে
নিজের ইচ্ছেমতো বিষয় বেছে নেওয়ার এবং পরবর্তী কালে সেই ঐচ্ছিক বিষয় নিয়ে চর্চা
করার পুরোপুরি সুবিধে রয়েছে বলেই শুনেছি। এ শোনায় জল মেশানো থাকতে পারে,কিন্তু এখনকার অনেক সিঙ্গার,যারা ইউ টিউবে গান গেয়ে পরে খ্যাতি পেয়েছেন এবং সেই খ্যাতি ধরে রেখেছেন,তাঁদের মধ্যে অনেকেই কানাডার বাসিন্দা বলে জানি।আমার মেয়ে যখন
প্রতিযোগিতায় গিয়েছে,তখন ওর কাছেও বিভিন্ন প্রতিযোগীর
ব্যাকগ্রাউন্ড শুনে আমার এই ধারণাই বলবৎ থেকেছে যে আমাদের দেশের মতো সকলকে জ্যাক অফ অল ট্রেডস আর
মাস্টার অফ নান হতে হবে এমন কোনো বাধ্যতা সেখানে নেই। বস্তুতই উন্নত এবং ধনী দেশ
বলেই হয়ত খানিকটা। তবে কারণ যাই হোক,গানবাজনাই হবে জীবিকা,অন্য কিছুই নয়,এরকম সিদ্ধান্ত ওখানকার
সঙ্গীতানুরাগীরা হামেশাই নিয়ে থাকেন ।নাচ
গান অন্যান্য শিল্পকলা নিয়ে নিজেকে মগ্ন রাখার সুযোগ ওসব দেশে আছে আর
শিল্পানুরাগীদের পক্ষে এর চেয়ে সুখের কথা আর যে কিছু হতে পারে না তা হয়ত বোঝেন
আমাদের এখানকার প্রতিভাবান বঞ্চিত
মিউজিসিয়ানরা। সত্যি কথা বলতে কি,চাকরি কিংবা ব্যবসা
আর গানবাজনা ইত্যাদি একসঙ্গে চালানো খুবই
কঠিন,অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা হয়না।আর হওয়াতে গেলে হয় চাকরির
ক্ষেত্রে উচ্চাশা ভুলে যেতে হয়,বা কোনো পৃষ্ঠপোষক বানিয়ে
রাখার প্রয়াসে ব্যস্ত থাকতে হয়। গানবাজনার প্রতি সত্যিকারের সুবিচার করতে গেলে চাকরিবাকরি করাই
যায়না।অনেকেই মিউজিক করব ভেবে চাকরি ছেড়ে দেয়। কিন্তু সেক্ষেত্রে কতগুলো বছর হয়ত
ডিগ্রি অর্জনের জন্য অযথা নষ্ট হয়ে যায়।
কানাডার
মতো দেশে এই বাছাইকরণ অনেক আগেই হয়ে যায়।লোকজন যারা মিউজিক করতে চায় তারা মিউজিকই করে।আর সেই কারণেই সেটা
করতে পারে কারণ সব জবের মতো মিউজিকেও প্রচুর সুযোগ তাদের জন্য অপেক্ষা করে
আছে।প্যাশন এবং প্রফেশন,এই দুটোর মধ্যে অহরহ বিরোধ লেগে থাকেনা তাদের।ফলে সবটাই খুব শান্তিতে করা
যায়।
আমাদের
ভারতের সঙ্গে তুলনীয় নয় পরিস্থিতিটা,এদেশ যেহেতু জনসংখ্যার চাপে পিষ্ট। এখানে
তাই সবকিছুই সমস্যাসংকুল। কানাডার সঙ্গে কি আর আমাদের কোনো দিক দিয়েই তাই তুলনা
চলে!আমাদের দেশের তুলনা কি চলে সেই দেশের সঙ্গে,যে দেশে
অপরাধ এবং অপরাধীর অভাবে জেলখানাগুলো মাছি তাড়ায়! তুলনা কি কখনো হয় সে দেশের সঙ্গে
যে দেশে গভীর রাত্রে শুনশান রাস্তা দিয়ে
একা হেঁটে কিভাবে ফিরবে সে প্রশ্ন সেখানকার মেয়েদের মনে কখনোই উদয়
হয়না! ভারত কি আর কখনো তুল্যমূল্য দাঁড়িপাল্লায় পাশাপাশি বসাতে পারবে সেই দেশকে যে
দেশে মাত্র এক পাতার খবরের কাগজ বের হয় যাতে ক্রাইম সংক্রান্ত কোনো খবর প্রায়
থাকেনা বললেই চলে!
না,তুলনা হয়না।সব ভালোটুকু পাওয়ার জন্য এই দেশবাসীকে তাই আগামী জন্মের
জন্য অপেক্ষা করতে হয়।
নয়
কানাডার
রাস্তায়,সাবওয়ে অর্থাৎ মেট্রো স্টেশনে,গান গাইতে দেখেছি
কতজনকে।এঁরা সবাই খুব ভালো গান করেন।তাদের ডলার দিয়ে যায় লোকজন মন চাইলে।অর্থের
প্রয়োজন তাঁদের আছে,এমন গায়কদের আমাদের দেশে আমরা সম্মান
দিইনা।ওঁদের দেশে যাঁরা সড়কে গান গেয়ে অর্থ চান,তাঁদের
পোশাকপরিচ্ছদ এ দেশ থেকে যাওয়া ভারতীয় চাকুরেদের লজ্জা দিতেই পারে।আর কোথাও কোনো
অসম্মান অপমান নেই,তাঁরা গাইছেন,শ্রোতা
কখনো কেউ থাকে,কখনো থাকেনা।পাশ দিয়ে নিরুৎসাহী মানুষ নিজের
মতো হেঁটে যাচ্ছে,কেউ বিরক্ত হচ্ছে না।সব কাজের একটা নিজস্ব
মূল্য দেয় ওখানে সবাই।
প্রকৃতিও
কতখানি বৈচিত্র্যময়,
ভাবা যায়না।যাওয়ার পর ডিসেম্বর মাসে হারবার পয়েন্টে গিয়েছি,অন্টারিও লেক তখন নীল জলে ঢেউ তুলছে।কাজামা শিপ রাইড তখন অবশ্য বন্ধ
ছিল।সামারে এই কাজামা শিপ সার্ভিস সবাই খুব উপভোগ করে,প্রধানত
ট্যুরিস্টরা।ডিসেম্বরে আস্তে আস্তে বরফ হতে থাকে জলস্তর।সেবার তুষারপাত হয়েছে
অনেকটা দেরি করে,কিন্তু শিপ বন্ধ নিয়মানুযায়ীই। ফেব্রুয়ারিতে গিয়েই দেখি লেকের জল পুরোপুরি
বরফ।সেখান দিয়ে হাঁটা যায় অনায়াসে।বরফ জমা জল দেখে সেই ছোটবেলায় পড়া যীশুর
সমুদ্রের উপর দিয়ে হেঁটে আসার কথা মনে পড়ল।দেবত্বের ধারণাটুকু সরিয়ে রাখলে এরকম
বরফ জমা সাগরের উপর দিয়ে যে কোনো ব্যক্তিই হেঁটে নিশ্চিন্তে পারাপার করতে পারে।
বরফের
সময় ওখানে স্কেটিং এর ব্যবস্থা।স্কেটিং ক্লাব রয়েছে,বহু লোকজন সেখানে স্কেটিং করতে
যায়।দু মাসের ব্যবধানে জলের এমন আশ্চর্য
পরিবর্তন দেখার জন্য কোথাও যাবার দরকার নেই।আসলে আমরা তো জানি বরফ মানেই
পাহাড়।সমতলে বরফ তো আর দেখা যায়না এখানে।তাই সমতলে বছরব্যাপী বরফ দেখলে বেশ মজা
লাগে।
আসার
কিছুদিন আগে গেলাম টরন্টো ইউনিভার্সিটিতে।ভারি সুন্দর স্থাপত্য,ছোট ছোট
ক্যাম্পাস ছড়ানোছিটোনো।টরন্টোয় শুনি স্কুলে বাচ্চাদের শিক্ষা যতখানি নিখরচায় হয়,উচ্চশিক্ষা ঠিক ততটাই ব্যয়বহুল।
আসার
আগে একদিন গেলাম রেস্টুরেন্ট ৩৬০ তে।এটি রিভলবিং রেস্তোরাঁ। সি এন টাওয়ারের উপরে
মৃদুমন্দ গতিতে ঘুরে চলা রেস্তোরাঁর নীচে তাকানোটাই সে এক অভিজ্ঞতা। আরো অনেক
জায়গায় যাওয়া যেত হয়ত,কিন্তু কানাডায় যে কোনো জায়গায় গেলে খুব হাঁটতে হয়।আমি সেটাতেই একেবারে
পটু নই। টরন্টো জু টাও দেখার মতোএকটি চিড়িয়াখানা। পশুপাখির মেইন্টেনেন্স,চিড়িয়াখানার মেইনটেনেন্সও দারুণ,যেরকমটা হওয়া
উচিত।আমি হাঁটার ভয়ে সেখানে যাবার সাহস পাইনি,যদিও কেন যাইনি
ভেবে আফসোস হয়।আফসোস হয় অরোরা বোরিয়ালিস দেখিনি বলে,যা নাকি একবার
দেখলেই চক্ষু সার্থক বলে শুনি।
তবু,যতটুকু দেখেছি
পাঁচ মাসের প্রবাস জীবনে,তাতে সত্যি সত্যিই আফসোসের কোনো
জায়গা থাকাই উচিত নয়।গতবছরের ঘটনা আমি মনে করে যেখানে বলতে পারব না,সেখানে টরন্টোবাসের প্রতিটি ঘটনা,প্রতিটি দিনের
রোজনামচাই আমি স্মৃতি থেকে বলে দিতে পারি,বসবাস কতখানি মনের
মধ্যে চারিয়ে গেলে সেটা সম্ভব!
ফিরে
আসার জন্য মন তখন ব্যাকুল হয়েছিল ঠিকই,ঘর সংসার দায়িত্ব কর্তব্যের অনেকটাই ফেলে
গিয়েছিলাম বলে।এ তো জীবনের স্বাভাবিক ঘটনা।জানিনা,আর কখনো এই
সুযোগ,এইভাবে মেয়ের একার সংসারে একা মায়ের স্বাধীন বিচরণের অবকাশ
তার ভবিষ্যতের সম্ভাব্য অথবা অসম্ভাব্য প্রবাস জীবনে কখনো পাবো কিনা,তবে যেটুকু দেখেছি,যতটুকু পেয়েছি,সেই পাথেয় নিয়ে চলে যাবে আমার বাকি জীবনটুকু।
কাজরী বসু: কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন