ভ্রমণকাহিনী
ঘোর
বর্ষায় পাড়ার বাজার কিংবা দূরের গয়াকাশি যেখানে যাই না কেন ছাতা বগলদাবা করে যেতে
হবে। অতএব ছাতাটার এখানে ওখানে টুকিটাকি সারানো হল।ছোট সুটকেসটারও স্বাস্থ্য
পরীক্ষা করা হল. রাতের মুম্বাই মেলে চড়ে ভোরে গয়া স্টেশনে নামলাম। আমরা দলে তেরোজন
সবাই আত্মীয়স্বজন। তার মধ্যে শিশু ও বৃদ্ধবৃদ্ধারাও আছেন। অটো ভাড়া করে বেশ দূরে
বোধগয়ায় চলে এলাম। গয়া মানেই হিন্দু বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের ত্র্যহস্পর্শলাগা স্থান।
প্রথম দিন বিষ্ণুপাদ মন্দির দর্শণ করলাম। সারা ভারতবর্ষে হিন্দু মন্দিরগুলির যা যা
চরিত্রবৈশিষ্ট্য থাকা দরকার এখানেও তার ব্যতিক্রম ছিল না। অর্থাৎ সেই লোহার
প্যাঁচানো রেলিং দিয়ে ঘেরা পথ। আর ঘন্টা তিনেক সেই লাইনে জল ও ফুলভরা ঘটি নিয়ে
ধীরে ধীরে মন্দিরের গর্ভগৃহের দিকে এগিয়ে
যাওয়া। হোটেল থেকেই পুরোহিত স্থির করে নেওয়া ভালো। তার নির্দেশে পূজা দিতে হবে।
প্রধানমন্দির সংলগ্ন আরো দশরকম দেবতার মন্দির আছে। পুজো দেওয়া শেষ হলে ছবি তোলার
পর্ব শুরু হবে জানা কথা।
এখানে
ভ্যানগুলো ঝকঝকে সুন্দর ভাড়া বেশি।আর অটোগুলি লঝঝড়ে পুরনো ভাড়া একটু কম।শাকুরা
হাউস নামের যে হোটেলে উঠেছি সেটির মালিক জাপানি ভদ্রমহিলা। হোটেলটি পরিষ্কার খুব
আর রুচিসম্মত। প্রত্যেকটি ঘরে দক্ষ চিত্রশিল্পীর আঁকা ছবি রয়েছে।আমার ঘরের ছবিটা
ছিল লেসবিয়ান নারীদের নিয়ে। অন্যগুলি নরনারীর রহস্যময় রোমান্টিকতায় ভরা।ছবি গুলি
ঠিক ধ্রুপদী ভারতীয় নয়। একটি ঘরে ময়ূরের পালক ছিল দেয়ালে।আমি ছবি তুলে নিলাম।
শান্ত নির্জন পরিবেশ। আমরাই অহেতুক চেঁচামিচি করছিলাম।এমনিতেই আমরা খুব নয়েজি।
হোটেলের আন্ডারগ্রাউন্ডে রসোইঘর ও রেষ্টুরেন্ট। নিরামিষ ভোজনালয়। পাশেই একটি
মনাস্ট্রি। সেখানে বৌদ্ধ ছাড়া অন্য জাতির লোকেরা থাকতে পারে না। খুব সুন্দর ভাবগম্ভীর
পরিবেশ।
নেট
এর কল্যানে গয়া সম্পর্কিত যাবতীয় ইতিহাস পড়েই রেখেছিলা। দুপুরে খুব চড়া রোদ। তার
মধ্যে সিঁড়ি ভেঙে পিন্ডি দেবার পাহাড়ে উঠতে রাজি হল না। দেখা পেলাম ফল্গু নদীর।
সীতার অন্যরূপ এই ফল্গু নদী। রামায়ণে ফল্গু নদীর স্রোত স্তিমিত হয়ে যাওয়া নিয়ে
সীতাদেবীর রাজা দশরথকে বালিপিন্ড দেবার গল্প আছে। সীতার অভিশাপে ফল্গু নদী একমাত্র
গয়াতেই ক্ষীণস্রোতা আর অন্তর্বাহী। চিকচিকে বালিকাদাভরা ফল্গু নদীতে পা ডোবালাম।
অনেক দূর পর্যন্ত নদীর শুধু হাঁটুডোবা জল। একটু আচমন করলাম। শীতল জল ছেড়ে উঠতে মন
চাইছিল না। ফল্গুনদী এর পরেও আমাদের যাত্রা পথে পড়েছে। এর কোথাও বালুচর কোথাও গভীর
জল।
মঙ্গলাগৌরী
মন্দির শক্তিপীঠ। মায়ের বামস্তন পড়েছিল
এখানে। গর্ভগৃহে ঢোকামাত্র পুরোহিতের ' একাওন
একাওন' চিৎকারে ঘাবড়ে গেলাম। মনোমতো টাকা না
পাওয়ায় সামান্যতম সংস্কৃত মন্ত্র উচ্চারণ করতে রাজি নন । 'আগে বঢ়িয়ে '
বলে
পরের জনের ডালা টেনে নিলেন। আমি ডালা উপুড়
করে দিয়ে বেরিয়ে এলাম। খুব ব্যস্ততা আর ভিড়। মনমেজাজ খিঁচড়ে গেল। কি আর করা। মনকে
সান্ত্বনা দিলাম এই ভেবে যে জীবিকা নির্বাহের জন্য এই রুক্ষ কদর্য অশান্ত অসুষ্ঠ পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
অটোচালক
যিনি স্টেশন থেকে নিয়ে এসেছিলেন তার সঙ্গেই সাইট সিইংএর ব্যবস্থা হয়েছিল। ওনার
একটা উপলব্ধিসঞ্জাত কথা মনে থেকে যাবে--- সব ধরম মিলকর হাম ইঁহা রহতে। হোটেলে
চায়ের অর্ডার করতে কমলালেবু রঙা মিষ্টি চা এল।লিকার । জিজ্ঞাসা করা হয় নি চা পাতা
জাপান থেকেই আনানো কি না। শাকুরা হাউসের পাশেই মনাস্ট্রি । সকাল সন্ধ্যা মাইক
ব্যবহার করে স্তোত্রপাঠ চলে। একমাত্র বুদ্ধধর্মাবলম্বী ছাড়া ওখানে কারো থাকার
ছাড়পত্র নেই।
বর্ষায়
বিহার সবুজসম্পূর্ণা। পুরোপুরি সবুজ ব্যাঙ হয়ে প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যেতে ইচ্ছে
করছিল।পরের দিন চলো নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ঝমঝমে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে। ধ্বংসাবশেষ কে
বলেছে! নালন্দার পাথরে পা রেখেই শিউরে উঠলাম জ্ঞানীগুণীদের কি বিশাল নেবুলা
আকাশগঙ্গার সমাবেশ এখানে একসময়ে ছিল। শ্রীজ্ঞান অতীশের উত্তরীয়ের সৌরভ পেলাম কি!
যাই
হোক গাইড নিতেই হবে এখানে। গাইড শিবকুমার খুব দরদ দিয়ে বর্ণনা করলেন মৌর্যযুগ
গুপ্তযুগ হর্ষবর্ধনযুগ আর বাংলার পাল রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতার ইতিহাস। নালন্দা এত
অল্পসময়ের মধ্যে দেখলে অতৃপ্তি থেকে যায়। বহুযুগ ধরে রাজনৈতিক নানা উত্থানপতনের
সঙ্গে নালন্দার ভাগ্য জড়িয়ে আছে। বৈদেশিক আক্রমণে বিধ্বস্ত। উপরন্তু রয়েছে হিন্দু
ও বৌদ্ধধর্মের মধ্যে সংঘাতের চিহ্ন। পথচলতি কোনো বিহারী রমণীর দিকে তাকিয়ে থাকে
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক উপন্যাসের নায়িকা ভেবে নিয়েছি। এতোটাই
সক্রিয় ছিল বিস্ময়বোধ। অত্যন্ত প্রাচীন হয়েও অত্যন্ত আধুনিক এই নালন্দা
বিশ্ববিদ্যালয়। তাও আমরা জানতে পারি
চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাং এর বর্ণনা থেকে।ন্যায় শাস্ত্র, ব্যাকরণ, দর্শন , ভেষজ বিদ্যা ইত্যাদি
পঠনপাঠন চলত। গুপ্তরাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এর স্বর্ণ যুগ তৈরি হয়। বিদেশ থেকে
ছাত্ররা জ্ঞানলাভের জন্য আসত। এতো বিশাল ছাত্রাবাস মাইলের পর মাইল ভাবাই যায় না।
এর বিস্ময়কর স্থাপত্য এত কম সময়ে দেখে সম্যক উপলব্ধি করা যায় না। মনে হল দিনের
পর দিন এখানে থাকলে ভালো হতো। এইসব পাথরের সঙ্গে অনেক কথা বলা বাকি আছে আমার। এখন
এটি বিশ্ব পুরাতাত্ত্বিক ঐতিহ্য বিভাগে স্থান পেয়েছে। এর রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থা
একেবারে প্রথম শ্রেণীর। সবুজায়নে মনোরম পরিবেশ এর। অসম্ভব পরিষ্কার চারদিক।
প্রচুর দর্শক সমাগম। বৈদেশিক ভ্রমণকারীদের বিশালাকৃতি ক্যামেরা ট্রাইপড আর চোস্ত
ইংরেজি বলা গাইডদের আনাগোনা চোখে পড়ে। অনেক শিক্ষিত পর্যটক নিজেরাই খুঁজে খুঁজে
বুঝে নিচ্ছে।
পাশের
সংগ্রহশালায় গেলাম। বুদ্ধ ও প্রজ্ঞাপারমিতার কতো সুন্দর সুন্দর মূর্তি। কি অপূর্ব
পাথরের কাঠের উপর কারুকার্য, পোড়ামাটির শিল্প!
শস্য মজুত করার বিশালকায় কলসি ,
পোড়া
কালো চাল, দশম শতাব্দির ক্ষয়ে
যাওয়া একখানি খড়ম, রাজদন্ড, তখনকার দিনের ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ভোলবার
নয়। কিন্তু কোথাও কোনো অস্ত্রপাতি চোখে পড়ল না , যেমনটা দেখা যাবে রাজস্থানের মহল প্রাসাদে ঘুরতে গেলে। কোথায়
ছাত্রাবাস, সেখানে আলো হাওয়া বাতাস চলাচল কেমনভাবে করত তার ব্যবস্থা
সব বুঝিয়ে দিলেন গাইড। তবে রাহুল
সাংকৃত্যায়নের নাম উনি শোনেন নি জানালেন। রাহুল সাংকৃত্যায়ন বৌদ্ধ ধর্মের আধুনিক
তম জ্ঞানী বুদ্ধিজীবী মানুষ। কোথাও হয়তো আজকের যুগের অতীশ দীপঙ্কর।কোথায় বসে
শিক্ষক পাঠ দিতেন আর ধর্ম মহাসম্মেলন ও
উৎসব ইত্যাদি হত তাও বোঝালেন। প্রাচীন সভ্যতার ধারক এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা
হল। স্থানীয় মানুষজন শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে খাবলে খুবলে কাঠ পাথর লোহা মাটির
দ্রব্যাদি সব তুলে নিয়ে গেছে। মুসলিম আক্রমণকারিদের কথা তো ছেড়েই দিলাম।
নালন্দার পাথরের গায়ে পরম মমতায় হাত বুলিয়ে কিছু অনুভব করার চেষ্টা করলাম।
বক্তিয়ার খিলজির পুড়িয়ে দেওয়া গ্ৰন্থাগার থেকে এখনো পোড়া গন্ধ বেরিয়ে চলেছে।
বই পোড়ানো আর সভ্যতা ধ্বংস করার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। বুদ্ধদেবের দন্ডায়মান
ও পদ্মাসনে বসা অনেক মূর্তি সংগ্ৰহালয়ে রয়েছে। ভূমিস্পর্শমুদ্রা, ধ্যানমুদ্রা, ভৈরবমুদ্রা ইত্যাদি বিভিন্ন রকমের মুদ্রা অঙ্গুলী দ্বারা তৈরী
করা নানা মূর্তি দেখলাম। এ ছাড়া অমিতাভ, করুণা, বজ্র
ইত্যাদি নানা নামের বুদ্ধমূর্তি রয়েছে। রয়েছে মৌর্য যুগের প্রজ্ঞাপারমিতা
মূর্তি। এটি একটি মাতৃমূর্তি যা বোধিসত্ত্ব লাভের জন্য মহাযানী বৌদ্ধধর্মের
সারাৎসার জ্ঞানস্বরূপ মর্যাদা পেয়ে আসছে। সেই জীবন ও যুগটিকে প্রাণে মনে ধরার
আন্তরিক চেষ্টা করলাম। বৈদেশিক আক্রমণে ধ্বংস প্রাপ্ত নালন্দার দিকে তাকিয়ে গভীর
দীর্ঘশ্বাস ছাড়া ছাড়া আর কিছু করার ছিল না। পরবর্তী কালে কবি রবীন্দ্রনাথ
শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে পরাধীন ভারতবর্ষের মুখ
উজ্জ্বল করেছেন এ আমাদের সান্ত্বনা,
প্রাপ্তি, আশ্রয়স্থল আর সমগ্ৰ বাঙালির গৌরব।
নালন্দার
চারপাশের সবুজ প্রকৃতি এখন পাহারাদার। ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ। সত্যি খুব যত্ন করে বুকে
আঁকড়ে রেখেছে তাকে বিহার সরকার। বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী এই স্থানটিকে সামনে থেকে দেখে ছোটবেলার ইতিহাস মুখস্থ করার দিন
গুলো মনে পড়ে গেল। দেখে নেওয়া হল রাজগিরের বিশ্ব শান্তি স্তুপ। হেঁটে ওঠা যায়
আবার রোপওয়ে করেও যাওয়া যায়। প্রবীণ নাগরিক আমরা। রোপওয়ে সম্বল।রোপোয়েতে উঠে সবাই
শিশুদের মতো নির্মল আনন্দ পেলাম। জাপানি
মন্দির। সোনালি রংএর বুদ্ধমূর্তি খোদিত গায়ে। শ্বেত পাথরের চত্বর। মনোরম উদ্যান
বেষ্টিত। মনের বিশ্রামস্থল। ঢং ... ঢং... করে থেমে থেমে ঢাক বাজছে দূষণমুক্ত
অঞ্চল। বাঁদর হনুমানরা আমাদেরকে থোড়াই কেয়ার করছে। পথের দুধারে স্থানীয়
দোকানদারদের পসার। কেনা কাটা চলছে। বৃষ্টি একটু ধরেছে কি আবার....শ্যামগম্ভীর
সরসা..কেক বিস্কিট ফল মিষ্টি নিয়ে এসি বাসে যাত্রা আমাদের। ভাত রুটির লাঞ্চ আজ হবে
না মনে হয় । সবুজ ভিজে পাহাড় কোথাও ন্যাড়া ভিজে পাহাড়। পাহাড় শ্রেণী সব ধ্যানী
মহাদেব যেন। হয়তো ঊমার স্পর্শের আশায় দিন গুনছে। নজর করলে বোঝা যাবে পাহাড় কেটে
কেটে ফাঁকা করে দেওয়া হচ্ছে কোথাও। কতো কতো মানুষ এসেছে। কতো গরীব গুরবো আদিবাসী
মানুষদেরকে দেখলাম ভ্রমণ করতে এসেছে। বিশ্ব শান্তি স্তূপে বুদ্ধদেবের অনন্তশয়ান
মূর্তি আছে। অমিতাভ বুদ্ধ মূর্তি আছে। শুকনো ফলপ্রসাদ দেওয়া হচ্ছে। মগধ রাজগৃহের
সমৃদ্ধশালী অতীত জীবনটাকে মনে মনে স্মরণ করলাম।
পথে
পড়বে জরাসন্ধের সোনে কা ভান্ডার নামের একটি পাহাড়। বোবা পাহাড়ের গায়ে ঐতিহাসিক
কথারা লেপ্টে আছে।ভান্ডার তো লুট হয়ে গেছে কবে মনে হয়। জরাসন্ধ মহাভারতের সময়কার
অত্যন্ত শক্তিশালী রাজা, কৃষ্ণের যথার্থ
প্রতিদ্বন্দী।তবে জরাসন্ধ ছিলেন অত্যন্ত অত্যাচারী ও লুটেরা রাজা। মুস্কিল ছিল
তাকে সৈন্যটৈন্য নিয়ে সম্যক সমরে হারানো। এই পাহাড়ের অনেক শ্রেণিবিন্যাস আছে।
রাজগীরের অন্তর্ভুক্ত এই অঞ্চলটি একসময় রাজা বিম্বিসারের অধীনে ছিল। একটি গুহা
যার গায়ে প্রাচীন লিপি আছে। ঐ লিপির পাঠোদ্ধার এখনো সম্ভব হয় নি। তাহলেই নাকি
সোনার ভান্ডার করায়ত্ত হবে। তবে কোথায় সঠিকভাবে কি ছিল আজ আর খুঁজে পাওয়া যায়
না। লোককথার উপরে নির্ভরতা রাখাই ভালো। তাই সেখানে পাহারাদার নিয়োজিত আছে যুগ যুগ
ধরে। মৌর্য যুগে খোদিত বিষ্ণু মূর্তি আছে দেয়ালে।
পথে
পড়ল দশরথ মাঞ্ঝির খণিত পাহাড়। দশরথ মাঞ্ঝির জীবনী আর নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকির ও রাধিকা
আপ্তের সিনেমা আর অভিনয় নিয়ে এক প্রস্থ হৈ চৈ করা হল। নিজের স্ত্রীকে পাহাড়ের
প্রতিবন্ধকতার দরুন বিনা চিকিৎসায় মারা
যেতে দেখে সারাজীবন ধরে লড়াই করে ,
পাহাড়
খুঁড়ে রাস্তা বানিয়ে ফেলেছিল। দশরথ মাঞ্ঝি আজ বিখ্যাত। রাস্তায় প্রবেশের মুখটা
বিহার সরকার সাজিয়ে রেখেছে। ওখানে বাস হল্ট করবে না। ড্রাইভার সাহেব নিজেই তো
গাইড। তিনিই বলে উঠলেন রাস্তাটা দেখিয়ে। ড্রাইভার যখন আমাদের সঙ্গে কথা বলছিলেন
তখন খড়িবোলি হিন্দিতে আর হেল্পার বা স্থানীয়দের সঙ্গে বলছিলেন মাগধী ডাইয়ালেক্টে। সপ্তধারা
উষ্ণ প্রস্রবণ। লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দিরের পাশেই। রাজগিরের বৈভব পাহাড়ের নিচে এই
সপ্তধারা উষ্ণ প্রস্রবণ।লাইন দিয়ে গোটা চল্লিশেক অপাহিজ মানুষের দল বসে আছে থালা
পেতে। আমার কর্তা খুচরো পয়সার ওজনদার থলি নিয়ে বেরোন। তিনি যখন পয়সা দিচ্ছিলেন আমি
নিকড়িয়াদের দুয়েকটা স্ন্যাপ নিলাম। তাতেই মন্তব্য ছুঁড়ে দিল একজন তখন --- পয়সা
দিচ্ছে না ফটো তুলছে কি বাহার ! উষ্ণ প্রস্রবণে বড্ডো ভিড়। আমাদের কেউই স্নান করতে
রাজি হল না। ফুল ফল পাতা পড়ে চত্বরটা যার পর নাই ময়লা হয়ে আছে। যে কোন সময়ে পা
পিছলে আছাড় খাওয়ার সম্ভাবনা।
এরপর
আমরা একটা হোটেলে দ্বিপ্রাহরিক ভোজন করলাম। এখানে আমিষ আহারও পাওয়া যাচ্ছিল।
বিহারে
এইসব স্থানে নিরলস পাহাড় কাটা চলতে থাকে। কেটে কেটে অনেক বড়ো ঢিপির মতো পাহাড়
উড়িয়ে দিয়েছে। এতে করে মনে হল ইকোসিস্টেম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তবুও অফুরান সবুজ
প্রকৃতি চোখ জুড়িয়ে দিচ্ছিল।
এইদিন
পাওয়াপুরি মন্দির শেষ দ্রষ্টব্য স্থান। বাংলার রাজা ধর্মপাল এটি তৈরি করিয়েছিলেন।
চব্বিশতম জৈন তীর্থংকর ছিলেন পাওয়াপুরি। মূল মন্দিরটি পদ্ম সরোবরের মাঝে। এখন তো
পদ্ম ফোঁটার সময়। কিন্তু সরোবরের
পদ্ম তেমন ফোটে নি। এছাড়া রাস্তার এপারে
ওপারের জমিতে নতুন জৈনমন্দির তৈরির কাজ চলছে। পাওয়াপুরি মন্দির সাদারংয়ের মার্বেল পাথরের মন্দির। শান্ত পরিবেশ। দিঘিতে
জলতিতিরদের উত্তেজনাময় শিকারধরা চলছিল। সেসব দৃশ্য খানিকটা ভিডিও করলাম। আমরা সে তুলনায় শান্ত ও অবসর সময় উদযাপন
করছিলাম। বাইরে একটা মোষের হয়তো শরীরে কোথাও ব্যথা হচ্ছিল সে গা ঝাঁকি দিয়ে শিং
নাড়িয়ে ছুটছিল আমি তো ভয়ে দৌড়ে বাসে উঠে পড়লাম।এটুকুই যা হাসির হিল্লোল তুলে দিল
আমাদের দলে।
বোধগয়ার
মহাবোধি মন্দিরে প্রবেশের আগে মোবাইল জুতো ক্যামেরা ইত্যাদি জমা রাখতে হয় বাইরের একটি ঘরে। সূর্যের মতোই
উজ্জল সুন্দর বৌদ্ধমূর্তি। সোনা রঙ। এটিও পালরাজারা তৈরি করিয়েছিলেন। কোলকাতার
পার্শনাথ জৈন মন্দিরের মতো এখানে মাছভরা পুকুর আছে ।ওটাকে পদ্মপুকুর বলা হয়।
বুদ্ধদেবের চরণ অঙ্কিত স্থান আছে। তাদের
খাওয়াবার জন্য মুড়ির প্যাকেটও বিক্রি হচ্ছে রাস্তায়। বোধিবৃক্ষের ছায়ায়
বৌদ্ধসাধুরা মন্ত্র পাঠ করছেন। বাতাসে পাতা উড়ে পড়লে মানুষ তা কুড়িয়ে নিচ্ছে নিজের
কাছে রাখবে বলে। কোনো কারণ ছাড়াই মনে মনে
গুন গুন করে যাচ্ছি বুদ্ধং স্মরনং গচ্ছামি। ধর্মং স্মরনং গচ্ছামি। সঙ্ঘং স্মরনং
গচ্ছামি। মন্দির জুড়ে বেশ কড়া পাহারা। এসময়ে ঝেঁপে এল বৃষ্টি। শেডের তলায় দাঁড়িয়ে
গেলাম সবাই। জাতক আখ্যানের চরিত্ররা এখানে যেন ঘোরাফেরা করছে। হয়তো অজীবকের সঙ্গে
দেখা হয়ে যাবে। পালি ভাষায় কিংবা অপভ্রংশ ভাষায় ভদ্দে সুখিন ভবতু টবতু কিছু
একটা বলে উঠবে। খুব ছোট্ট ভ্রমণ আমাদের। সুজাতার গ্ৰাম দেখতে ইচ্ছে হলেও যাবার
উপায় নেই। বুদ্ধদেবকে নিয়ে বিশাল সমারোহ। এখানে সুজাতা কোথাও নেই। বৃষ্টি ভেজা
হাওয়ায় তবু পেলাম সেই পায়েসের ঘ্রাণ। প্রচুর বিদেশি ট্যুরিস্টের সমাগম। একি
লাবণ্যে পূর্ণপ্রাণ প্রাণেশ হে.... জানি বুদ্ধদেব নাস্তিক ছিলেন। এই মহান মানবটিকে
এখন তো মনে মনে প্রণাম করা ছাড়া গতি নেই। দূর থেকে তার কল্পিত মূর্তিকে শ্রদ্ধা
জানালাম। ষোড়শ মহাজনপদের আম্রপালিই বা কেমন আছে? শুধু কোনো হোটেলের নাম আম্রপালি দেখলে বুকটা ধক করে ওঠে।
বিকেলে
বোধগয়া সংলগ্ন জাপানি ভুটানি সিংহলি বার্মিজ থাই চাইনীজ তাইওয়ান ইত্যাদি প্যাগোডা
আর মনাস্ট্রি দেখে বেড়ালাম। প্যাগোডা রীতিতে তৈরী অনেক মন্দির। সঙ্গে লাগোয়া
বিদ্যালয়ও আছে। একটি ছাত্রের সঙ্গে আলাপ করলাম মানে সেই ছেলেটিই যেচে কথা বলল। ও
জানতে চাইছিল আমি শ্রীলঙ্কা থেকে এসেছি কিনা। এখানে যত শ্রীলঙ্কার পর্যটক দেখলাম
সবাই সাদা রঙের পোশাক পরেছেন তা সে শর্টস্কার্ট
হোক আর লং স্কার্ট হোক। ছেলেটি আরো জানায় যে হিন্দু বৌদ্ধ জৈন খ্রিস্টান
সব ধর্মের বাচ্চারা এই বৌদ্ধ বিদ্যালয়ে
পড়াশোনা করে।যে যার নিজের দেশের শিল্প ও স্থাপত্য কলানুযায়ী মনাস্ট্রি গড়ে
তুলেছে। অদ্ভুত সৌন্দর্য চেতনায় মন আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে। বিশালাকার বৌদ্ধ মূর্তি
আছে একটি যা কিনা ৮০ ফুট লম্বা। ধ্যানমুদ্রায় অবস্থান করছেন বুদ্ধদেব। অসম্ভব
সুন্দর দেখতে। মনাস্ট্রির ভিতর ছাত্ররা সন্ধ্যায় প্রার্থণা করতে বসেছে। বই খুলে
স্তব পড়ছে। দেয়ালে দেয়ালে বুদ্ধের জীবনের ছবি। কোথাও ড্রাগন ইত্যাদি আঁকা আছে।
পিতলের প্রদীপ জ্বলছে। সর্বত্র ফুল ফল গাছে হাত না দেবার আবেদন লেখা। আর নীরবতা
বজায় রাখার নির্দেশ। তবে দানপাত্র বসানো আছে কোথাও কোথাও। জাপানি ও চৈনিক
শিল্পরীতির আল্পনা ও ছবি সব। অভূতপূর্ব মানসিক শান্তি মিলবে এখানে। গৈরিক পোশাকের
সাধু সন্ন্যাসীরা তাদের চৈনিক আদলের মুখ
নিয়ে সর্বত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাঝে মাঝে সব মনোরম আর মায়াবী লাগছিল। বিকেল
পাঁচটার মধ্যে কোনো কোনো মন্দির দরজা বন্ধ করে দেয়। কতোরকমের বুদ্ধমূর্তি আর তাদের
উদ্ভাস... সবই বেশ নিরালা শান্ত সুমহান ভাব সমন্বিত। অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করছে আমি
শ্রীলংকা থেকে এসেছি কিনা। আসলে শ্রীলংকার অনেক মহিলা সাদা পোশাক পরিহিত আর আমিও
সাদা পোশাক পরে আছি।
কোনো
মঠে বৌদ্ধ ছাত্ররা কঠিন নিয়ম শৃংখলার মধ্যে ধ্যান ও পঠন পাঠন করে চলেছে। আমাদের শহরতান্ত্রিক নিত্য খুন ধর্ষণের জীবন থেকে ওরা অনেক দূরের এক
গ্ৰহে বাস করে যেন। এ এক অন্য গ্যালাক্সি। রাত আট্টা বাজলেই দোকানপাট মোটামুটি
ঝাঁপতাড়া নামিয়ে দেয়। গাড়ি চলাচল কমে আসে এই অঞ্চলে। প্রচুর গরু মোষ ঘরে ঘরে পালিত
হচ্ছে। রাস্তায় অবারিত ঘুরে বেড়াচ্ছে। পরের দিন সকালে বাজারে গিয়ে লিট্টিচোখা
খেলাম।আহা লিট্টি চোখা কোলকাতার উত্তরে হেদোর মোড়ে খেয়েছি অনেক বার ধনেপাতার
চাটনি দিয়ে। এখানে আলুর তরকারি দিয়ে মাখামাখা করে দিল। বাজারে যেমন হয় আর কি
ষাঁড় ও গরু ঘুরে বেড়াচ্ছে। পটোলের মতো বড় সাইজের কুন্দ্রি যা কিনা আসলে তেলাকুচা
ফল , যাকে লক্ষ্য করে প্রাচীন যুগের কবিরা
বলতেন প্রিয়ার ঠোঁটের মতো পাকা ও লাল অর্থাৎ প্রিয়া ছিল পক্ববিম্বাধরোষ্ঠী , তাই কিনলাম। আর দেশি তাঁতির তৈরি খাপি
চাদর বিছানায় পাতার সংগ্রহে এল। অন্যান্যরাও অনেক কিছু কিনল। ফেরার পালা। হোটেলের
জাপানি মালিক কথায় কথায় জিজ্ঞাসা করলেন আপনারা হিন্দু হয়ে কেন মহাবোধি টেম্পল
দেখতে এলেন। ভালো লাগল? ভালো লাগাটা এককথায়
বোঝানো যায় না। বললাম বুদ্ধ বুদ্ধ হয়ে ওঠার আগে তো হিন্দু ছিলেন। শাক্য বংশ
ক্ষত্রিয় বংশ। বুদ্ধের সংস্পর্শে না এলে সেটা তো হিন্দুদের নিজেদেরই অপূর্ণতা।
এখানে প্রচুর জাপানির দেখা মেলে। এরা স্বামী স্ত্রী হোটেল চালাচ্ছে। ছবি তোলা হল
একসাথে। যুবতি মেয়েটি হাসল। সে হাসিতে উষ্ণতা।
ফেরার
পথে রাত এগারোটায় চম্বল এক্সপ্রেস। চম্বল নামটা শুনলেই দস্যুরানি ফুলনদেবীর কথা
মনে পড়ে যায়। এমনিতে বিহারের উপর দিয়ে রাতে ট্রেন যাবে মানে বেশ ভয়ের ব্যাপার।
চুরি ডাকাতি মাওবাদী কতো কি যে আছে। গয়া স্টেশন- অঞ্চল থেকে মিঠাই প্যাড়া নিলাম।
সত্যিকারের প্যাড়া। কোলকাতায় কালীমন্দির সংলগ্ন পাতলা ছোট্ট প্যাড়া নয়। মোষের
দুধ থেকে তৈরি। একটা ঝাঁঝা গন্ধ আছে। রাস্তার দুপাশে প্রচুর প্যাড়ামিস্টান্নর
দোকান, অনেকটা বাংলার জয়নগরের দোকানের মত।
বাড়ি খালি হাতে ফেরা যায় না। পথে অটো হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল। চালক নিজেই মিনিট পনের
ধরে চেষ্টা করে সারাল। আধা অন্ধকার রাস্তা ও সমগ্ৰ অঞ্চল। বেশ ভয়ের ব্যাপার ছিল।
আমাদের প্রথম দলটি আগেই পৌঁছে গেছে স্টেশনে। তারা ঘন ঘন ফোন করে খবর নিচ্ছে।আমরা
সারাক্ষণ মোবাইল আর টর্চ জ্বেলে চালককে সাহায্য করে যাচ্ছি। খুব কম গাড়ি যাওয়া
আসা করছে এই রাস্তায়। আমাদের গাড়ি ঠিক না হলে স্টেশন থেকে গাড়ি আনাতে হত। যাই
হোক শেষ পর্যন্ত সব ভালোয় ভালোয় মিটল।
দেবযানী বসু: কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন