তৎকালীন শিক্ষাব্যবস্থার নিরিখে শিক্ষক ডিরোজিওর কবি সত্তা



প্রবন্ধ

আজকের প্রজন্মের ধ্যানধারণার নিরিখে ডিরোজিওর মুল্যায়ন করার জন্য বনিকের মানদণ্ড রাজদণ্ডে পরিনত হওয়ার পর তৎকালীন ভারতবর্ষের শিক্ষাব্যবস্থার পারিপার্শ্বিক পটভূমি বিষয়ে সংক্ষিপ্ত তথ্য জানা প্রয়োজন। তাই ডিরোজিও সম্পর্কে কিছু বলার আগে তৎকালীন শিক্ষাব্যবস্থার একটি নাতিদীর্ঘ ইতিহাস তুলে ধরলাম। অধঃপতিত মোঘল শাসনের দুরবস্থার উন্নতি, জমিদারী কর্তৃত্ব, রাজস্ব ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রন, অসামরিক শাসন প্রতিষ্ঠায় বেশ সময় লেগেছিল ব্রিটিশ সরকারের। এসময় শিক্ষার উন্নতি কল্পে তারা উদাসীনই ছিল। তাছাড়া প্রারম্ভে ইংরেজ সরকার কতক ভয়ে, কতক লোকরঞ্জনার্থে, কতকটা প্রকৃষ্ট রাজনীতিবোধ থেকেই প্রাচীনের প্রতি বিশেষ হস্তক্ষেপ করেন নি। বরং সর্বক্ষেত্রে প্রাচীনকেই রক্ষা করে চলতেন। এরপর শাসনকার্যের সুবিধার জন্য এবং রাজ্যভ্রষ্ট মুসলমানসম্প্রদায়কে খুশী করার উদ্দেশ্যে গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৮১ খ্রীষ্টাব্দে কলকাতায় একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৭৯৩ খ্রীষ্টাব্দে ইষ্ট ইন্ডিয়া কম্পানির সনন্দ পত্র পুনর্গ্রহনের সময় ভারতহিতৈষী চার্লস গ্রান্ট এদেশীয়দের শিক্ষা বিস্তার ও ধর্ম প্রচার এবং প্রবাসী ইংরেজদের ধর্ম ও নীতির উন্নতি বিধান কর্তব্য বলে এক প্রস্তাব উপস্থিত করেন। এই উপলক্ষ্যে তাঁর রচিত ক্ষুদ্র পুস্তিকা প্রমান করে যে বাংলার জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষায় গভর্নমেন্ট বেশ উদাসীন ছিল। তবে একথা সত্যি যে স্বদেশ-বিদেশে ভারতহিতৈষী ব্যক্তিরা ক্ষীণ ও দুর্বলভাবে এদেশীয়দের অজ্ঞানতার অন্ধকার দূর করার বিষয়ে সচেতন হয়েছিলেন। এসময় দেশের কোথাও কোথাও সংস্কৃতচর্চার প্রচলন ছিল। কিন্তু যে জ্ঞানের দ্বারা মনের সমুন্নতি ঘটে, জগৎ ও জীবনকে বুঝতে সহায়ক এমন জ্ঞান দেশে বিদ্যমান ছিল না। এমতাবস্থায় প্রখ্যাত ধর্মপ্রচারক কেরী সাহেব, শিক্ষক মার্শম্যান এবং মুদ্রণে পারদর্শী ওয়ার্ড প্রমুখ ব্যক্তিগণ যাঁরা শ্রীরামপুর ত্রৈয়ী নামে খ্যাত ইংরাজী শিক্ষার উপায় বিধান ও দেশীয় ভাষায় বাইবেল প্রভৃতি গ্রন্থ অনুবাদ করার উদ্দেশ্যে বাংলা ভাষার অনুশীলন শুরু করেন। এই উদ্দেশ্যে কলকাতা থেকে কয়েক ক্রোশ উত্তরবর্তী শ্রীরামপুরে এইসকল বিষয়ে উন্নতি ঘটতে থাকে।

এরপর ১৮শ শতকের শেষ ভাগে যে সব তরুন সিভিলিয়ান এ দেশে আসেন তাদের দেশীয় ভাষায়, ইতিহাসে শিক্ষাদানের জন্য গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলির অনুমতিক্রমে ১৮০০ খ্রীষ্টাব্দের মে মাসে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮০০ থেকে ১৮১৮ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকার, উইলিয়াম কেরী, রামরাম বসু, হরপ্রসাদ রায়, রাজীবলোচন প্রমুখের প্রচেষ্টায় বেশ কিছু গ্রন্থ রচিত হল যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য রাজীবলোচনের ‘কৃষ্ণচন্দ্র চরিত’, কেরী প্রণীত’ বাঙ্গালা ব্যাকরণ’, রামরাম বসু প্রণীত ’প্রতাপাদিত্য চরিত’, ’লিপিমালা’ ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রথম দিকে পর্তুগীজ ধর্মজাযকদের বাংলা ভাষায় রচিত গ্রন্থগুলি ছাপা হয়েছিল রোমান হরফে এবং পরের কিছু সময়র অধিকাংশ রচনা পারসী বহুল ভাষায় রচিত হওয়ায় বেশ দুর্বোধ্য। এরপর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সৌজন্যে একদিকে পরোক্ষভাবে দেশে যেমন বাংলা ভাষার চর্চা চলতে লাগল অপরদিকে কলকাতার সম্ভ্রান্ত গৃহস্থদের মধ্যে নিজ সন্তানদের ইংরাজী শিক্ষা দেওয়ার জন্য প্রবৃত্তি প্রবল হতে লাগল। এই সুযোগে কয়েক জন ফিরিঙ্গী কলকাতার স্থানে স্থানে ইংরাজী স্কুল স্থাপন করলেন। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা দরকার যে এই সময় বাক্য রচনাপ্রনালী এবং ব্যাকরণের দিকে নয় ইংরাজী শব্দ ও তার অর্থ শেখানোর দিকে নজর দেওয়া হত।  যে যত বেশি সংখ্যক ইংরাজী শব্দ ও তার অর্থ কণ্ঠস্থ করতে পারত সে ইংরাজী ভাষায় তত বেশী সুশিক্ষিত বলে খ্যাতি লাভ করত। বিষয়টি সত্যিই বিস্ময়কর। অনেকেরই মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে বাক্যরচনাহীন তথা ব্যাকরণরহিত ইংরাজী শব্দের দ্বারা ইংরাজী শিক্ষিত ব্যক্তিরা কী ভাবে মনের ভাব প্রকাশ করতেন আর ইংরেজরাই বা কি প্রকারে বুঝতেন! এই বিষয়ে নানা বিধ কৌতুকপূর্ণ গল্পও জনসাধারনের মধ্যে প্রচলিত ছিল। তবে এভাবেই যতটা সম্ভব কথাবার্তা হত। ইংরেজরা ভাবে-ভঙ্গিতে, আকারে-ইঙ্গিতে বুঝে নিত এবং সেইসকল কথা তাঁরা সায়াহ্নভোজনের সময় আমোদ প্রমোদের উপকরণ হিসাবে ব্যবহার করতেন।

এভাবেই ১৮১১ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত বিভিন্ন ছোট বড় ঘটনার মধ্য দিয়ে কেটে গেল। ইংরাজী শিক্ষার ধারা বিষয়ে দেশীয় ব্যক্তিদের মনে যখন অনেক নালিশ জমে উঠেছে, সমালোচকেরাও মনে করছেন ইংরাজী শিক্ষার মূল দেশবাসীর চিন্তার জগতে প্রবেশ করতে অসমর্থ, সেইকথারই যেন প্রতিধ্বনি শোনা গেল ১৮১১ খ্রীষ্টাব্দে গভর্নর জেনারেল লর্ড মিন্টোর মন্তব্যে। লর্ড মিন্টো তার মন্তব্যে বলেন যে “It is a common remark that science and literature in a progressive state of decay among the Native of India. From every inquiry which I have been enabled to make on this interesting subject, that remark appears to me but too well-founded. The number of the bearned is not only diminished, but the circle of learning even amongst those who still devote themselves to it, appears to be considerably contracted. The abstract sciences are abandoned, polite literature neglected................. তাঁর কথায় আবার একবার স্পষ্ট হল যে অষ্টাদশ শতকে বাংলার জ্ঞান- বিজ্ঞানের অবনতি ঘটেছিল। তিনি স্পষ্ট বললেন যে গভর্নমেন্টের হস্তক্ষেপ বিনা অচিরেই পাঠ্যপুস্তক এবং উপযুক্ত অধ্যাপকের অভাবে বিদ্যার পুনরুদ্ধার অসম্ভব হয়ে যাবে। লর্ড মিন্টোর মন্তব্য, প্রস্তাব এবং তার ফলে ১৮১৩ খ্রীষ্টাব্দে ইষ্ট ইন্ডিয়া কম্পানির সনন্দ পত্র পুনর্গ্রহনের সময় কোর্ট অব ডিরেক্টর্সের সভ্যগণ ভারতবর্ষীয় গভর্নমেন্টের প্রতি আদেশ জারি করেন যে অন্যূন এক লক্ষ টাকা আলাদা তহবিলে রেখে তা দিয়ে ভারতীয় প্রজাদের বিদ্যার উন্নতি, পণ্ডিতগনের উৎসাহ দান ভারতীয় ব্রিটিশদের মধ্যে জ্ঞান- বিজ্ঞানের প্রবর্তন ও উন্নতি সাধন করতে হবে। এরপর ১৮১৭ খ্রীষ্টাব্দের ২০ শে জানুয়ারি চিৎপুর রোডে গোড়াচাঁদ বসাকের বাড়ীতে হিন্দু কলেজের উদ্বোধন হয়। ক্রমে এই প্রতিষ্ঠানটি ইংরাজী শিক্ষার পীঠস্থান হয়ে ওঠে। শিক্ষা আন্দোলন দুটি দলে বিভক্ত হয়ে যায়। একদল মাতৃভাষাতেই পাশ্চাত্য বিদ্যা শিক্ষার সমর্থক, অন্যদলের মতে পাশ্চাত্য ভাষার সঙ্গে সংস্কৃত ও আরবি সাহিত্য পঠন পাঠন আবশ্যক। এই পারিপার্শ্বিক পটভূমিতে ডিরোজিও ১৮২৮ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ মাসে হিন্দু কলেজে শিক্ষক পদে নিযুক্ত হন।

ইউরোপীয় চিন্তার উল্লেখযোগ্য বাহক তথা ভারতীয় নবজাগরনের অন্যতম পথিকৃৎ হেনরি লুই ভি ভিয়ান ডিরোজিও ক্লাসিক্স-এ পণ্ডিত সংশয়বাদী ও যুক্তিপন্থী ড্রামন্ডের ছাত্র। যে স্বাধীনচিন্তার প্রভাবে ফরাসীবিপ্লবের অভ্যুদয়, সেই স্বাধীন চিন্তা পুর্নমাত্রায় ড্রামন্ডের অন্তরে অধিষ্ঠিত ছিল। ধর্মতলায় তাঁর একটি স্কুল ছিল। কলকাতাবাসী ইংরেজগণ মনে করতেন তাঁর স্কুলে পড়লে ছাত্রদের মধ্যে নাস্তিকতা বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু ডিরোজিওর পোর্তুগীজ পিতা ফ্রান্সিস ও ইংরেজ বংশোদ্ভূতা মা সে ভয় পাননি। তাই বালক ডিরোজিওকে ড্রামন্ডের ধর্মতলার স্কুলে ভর্তি করেন। ড্রামন্ড তাঁর হৃদয়ের ভাব ছাত্রদের হৃদয়ে ঢেলে দিতে পারতেন। তাই তাঁর সংশ্রবেই ডিরোজিওর প্রতিভা ফুটে উঠতে লাগল।

চতুর্দশ বর্ষ বয়ঃক্রম কাল পড়াশুনা শেষ করে ভাগোলপুরে মাসীর বাড়ী যান ডিরোজিও। যদিও ১৮২২ খ্রীষ্টাব্দে তেরো বছর বয়সে প্রথম কবিতা লেখেন তিনি। কিন্তু ভাগোলপুরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মোহিত ডিরোজিও যে লগ্নে লেখনী ধারণ করেন সেই লগ্ন থেকে তাঁর কবিজীবনের প্রকৃত সূচনা।

বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে প্রাচীন কাব্যধারা শেষ হয় ভারতচন্দ্রের তিরোধানের পর। ১৭৬০ খ্রীষ্টাব্দে। এবং নতু্ন যুগের কাব্যধারার সূচনা হয় ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে মধুসূদনের আবির্ভাবের পর। এই দুই কাব্যধারার মধ্যবর্তীকাল কবিওয়ালাদের গানের যুগ। ডঃ সুশীল দে ‘Nineteenth Century Bengali Literature’ গ্রন্থে বলেছেন” The flourishing period of the kabiwala was between 1760 and 1830.” আর সময় হিসাব করলে এই সময় ভারতবর্ষে ইংরাজী শিক্ষার কী করুন অবস্থা ছিল তা পূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে। সেই পারিপার্শ্বিক পটভূমিতে ডিরোজিও প্রথম ভারতীয় কবি যিনি ইংরাজী ভাষায় কবিতা লিখতে শুরু করেছেন। রবীন্দ্রনাথ, কবি নজরুল, জীবনানন্দ কিংবা বায়রণ, মূর প্রমুখ বাংলা কিংবা ইংরাজী কাব্যাকাশের প্রথিতযশা নক্ষত্র তিনি নন ঠিকই, কিন্তু তিনি যে কবিতাগুলি উপহার দিয়েছিলেন সেগুলি তৎকালীন সাহিত্যিকদের মনে নবোপলব্ধির বীজ বপন করতে সক্ষম হয়েছে।

শিক্ষক ডিরোজিওর জ্ঞান বিতরনের পন্থায় যে স্বাধীন চিন্তা, ব্যক্তি চেতনা, আত্ম প্রসার, নৈতিক বোধ, জীবন ও সাহিত্য সম্পর্কে সামগ্রিক রুচির পরিচয় দেয় তা তাঁর সাহিত্য চর্চায়-ও স্পষ্ট। শুধু শিক্ষক নয় কবি হিসাবেও ডিরোজিওর যুগোত্তীর্ণ রুচি তাঁর পাঠকবর্গের মনে নবজাগরনের প্রেরনার সঞ্চার করতে পেরেছে। যদিও তিনি বাইরণ, ক্যাম্বেল, মূর প্রমুখ রোমান্টিক কবিদের অক্ষম অনুগামীরূপে আখ্যাত তথাপি বলা যায় ইংরাজী ভাষার প্রথম ভারতীয় কবি হওয়ার সম্মান তাঁরই প্রাপ্য।

অ্যাংলো ইন্ডিয়ান হয়েও ডিরোজিও নিজেকে ভারতীয় বলেই চিহ্নিত করতেন। এবং তা যে শুধু কথার কথা নয় সেটা তাঁর ‘TO INDIA- MY NATIVE LAND’
My Country! In the days of Glory Past
A beauteous halo circled round thy brow
And worshiped as deity thou wast,
Where is that Glory, where is that reverence now?
Thy eagle pinion is chained down at last,
And grovelling in the lowly dust art thou,
Thy minstrel hath no wreath to weave for thee,
save the sad story of thy misery

কিংবা মাত্র ষোল বছর বয়সে লেখা ‘THE HARP OF INDIA’ কবিতাগুলি পড়লেই বোঝা যায়। পরাধীনতার শৃঙ্খলাবদ্ধ ভারতমাতার যন্ত্রণা একজন অ্যাংলো ইন্ডিয়ানের লেখনীতে এভাবে ধরা পড়ার ঘটনা সত্যিই বিরল। ভাগলপুরে বসবাসকালে তিনি যে সকল কবিতা রচনা করেন তাদের মধ্যে "The Fakir of Janghira" কবিতাটি সুপ্রসিদ্ধ। ভাগলপুরের সন্নিকটে নদী গর্ভস্থিত জঙ্গীরা নামক জঙ্গলের মধ্যস্থিত আশ্রমে এক ফকীর বাস করতেন। তাঁর আশ্রমকে উদ্দেশ্য করেই ডিরোজিও উক্ত কবিতা রচনা করেছেন। এই কবিতা প্রকাশিত হলে তৎকালীন শিক্ষিত ইংরাজী এবং বাঙালী সমাজে ডিরোজিওর কবিত্বখ্যাতি প্রচার হয়।

১৮২৮ খ্রীষ্টাব্দে তিনি কবিতা পুস্তক প্রকাশের উদ্দেশ্যে কলকাতা আসেন। সেই সময় ফরাসী বিপ্লবের ঢেউ ভারতের মাটিতে আছড়ে পড়ে। তৎকালীন শিক্ষকগণেরও গ্রন্থাবলী ফরাসী বিপ্লবের স্বাধীনতা প্রবৃত্তিতে সিক্ত হয়েছিল। ছাত্রগণ ঐ সকল শিক্ষকের সাহচর্যে ঐ সকল গ্রন্থাবলী পড়ে সকল কুসংস্কার, প্রাচীন প্রথা ভাঙার প্রবল আকাঙ্ক্ষা অনুভব করছিলেন।

ঠিক তখনি ১৮২৮ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ মাসে উনিশ বছর বয়সে ডিরোজিও হিন্দু কলেজে শিক্ষক পদে নিযুক্ত হন। তাঁর কথোপকথন ভঙ্গী এবং জ্ঞান বিতরণের পদ্ধতিতে মোহিত ছাত্রদল মরুভুমিতে দিশাহারা তৃষ্ণার্ত পথিক যেমন মরুদ্যানের খোঁজ পেলে উদভ্রান্তের মতো সেদিকেই ছুটে যায়, সেভাবেই ডিরোজিওর সান্নিধ্য লাভের আশায় ছুটে গেল। তিনি একপক্ষ অবলম্বন করে ছাত্রদের অপরপক্ষ অবলম্বন করতে উৎসাহিত করতেন। ছাত্রদের স্বাধীনভাবে তর্ক বিতর্ক করতে দিতেন বলেই ছাত্রদের স্বাধীন চিন্তাশক্তির বিকাশ ঘটতে শুরু করল। তৎকালীন হিন্দু কলেজের কেরানী হরমোহন চট্টোপাধ্যায় লিখে রেখে গেছেন শিষ্যদের সঙ্গে ডিরোজিওর সম্পর্কের কথা, ছাত্রদের মনে ডিরোজিওর প্রভাবের কথা। ডিরোজিওর জীবনচরিত লেখক মিঃ এডোয়ার্ডসের লেখায় আমরা যার উল্লেখ পাই। মিঃ এডোয়ার্ডস লিখছেন,”............though they were without the knowledge or sanction of the authorities yet Mr. Derozio’s disinterested Zeal and devotion in bringing up the student in these subjects was unbounded, and characterized by a love and philanthropy which up to this day, has not been equaled by any teacher either in or out of the service.”

ডিরোজিও ছাত্রদের নিয়ে গড়ে তুললেন অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশান। প্রথম কিছুদিন সভার অধিবেশনের কাজ অন্য জায়গায় হলেও শেষে মানিকতলার একটা বাড়ীতে অধিবেশন হত। সেই সভায় ডিরোজিও সভাপতি আর শিষ্যেরা প্রধান বক্তা। এই অধিবেশন অল্প কিছুদিনের মধ্যেই এত লোকের দৃষ্টি আকর্ষন করল যে এর অধিবেশনে এক একদিন ডেভিড হেয়ার, লর্ড বেন্টিংকের প্রাইভেট সেক্রেটারী Col.Benson, বিশপ কলেজের অধ্যক্ষ Dr. Mills প্রমুখ ব্যক্তিদের উপস্থিত থাকতে দেখা যেত। এই সভার অধিবেশনে সমুদয় নৈতিক ও সামাজিক বিষয়ে স্বাধীন ও অসংকুচিতভাবে বিচার করা হত। ফলে ছাত্রদের মনে স্বাধীন চিন্তা উদ্দীপ্ত হত। তারা অসংকোচে গতানুগতিকতার বিরুদ্ধে আলোচনা করতে সক্ষম হতেন। ডিরোজিওর শিষ্যরা মিলিতভাবে ‘Athenium’ নামে মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করলেন, যার প্রধান কাজই ছিল প্রচলিত হিন্দুধর্মকে আক্রমণ করা। এই পত্রে প্রকাশিত এক ছাত্রের বক্তব্য থেকে তা আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে “If there is anything that we hate from the bottom of our heart, it is Hinduism” . কবিগুরুর কথায়” রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে” ডিরোজিওর ক্ষেত্রে এইকথা ভীষণভাবে প্রযোজ্য। ছাত্রদের সাহচর্য ও শিক্ষকতার অন্তরালে সমান তৎপরতায় চলল সাহিত্য সাধনার কাজ। পারিপার্শ্বিক সমাজ ও জীবন যেভাবে ডিরোজিওকে স্পর্শ করত ঠিক তার প্রতিলিপি তিনি আঁকতেন তাঁর কবিতায় ।

ডঃ গ্রান্ট নামে একজন ইংরেজের প্রকাশিত ‘ইন্ডিয়া গেজেট’-এ ডিরোজিওর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘পোএমস’ প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকাতেই তাঁর আন্যান্য কবিতা এবং প্রবন্ধও প্রকাশিত হত। শোনা যায় জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল ক্যান্টের সমালোচনায় ডিরোজিওর প্রখর ধীশক্তি ও স্বাধীন চিন্তার পরিচয় মেলে।

হিন্দু কলেজে শিক্ষকতাকালীন ডিরোজিও বহু ও ততোধিক কবিতা লেখেন। তাঁর লেখা’To the Pupils of the Hindu College’ কবিতায় তৃপ্ত শিক্ষক সত্তা যেন প্রকাশিত হয়েছে ডিরোজিওর কবিসত্তার আলোকে। ডিরোজিও তাঁর ছাত্রদের মনীষার বিকাশ ঘটাতে পেরে তৃপ্ত ও প্রসন্ন । শিক্ষক ডিরোজিও তাঁর ছাত্রদের মধ্যে যে মুক্তচেতনা ও চিন্তার প্রাচুর্য্যের বীজ বপন করতে চেয়েছিলেন তাতে তিনি সফল হয়েছেন। সেই সাফল্যের তৃপ্তি প্রকাশিত হয়েছে যখন তিনি লিখছেন “What joyance rains upon me, when see/ Fame in the mirror of futurity,/ weaving the chaplets you have yet to gain/ An then I feel I have not lived in vain. (“......যেই দেখি আগামীর আয়নার ভিতর খ্যতি গাঁথে মালাগুচ্ছ- পাওনি যা তাই পাবে তোমরা, এই জন্ম কাটেনি বৃথাই’ বঙ্গানুবাদ ‘বিংশতি কবিতা’ রমাপ্রসাদ দে /মঞ্জুষ দাশগুপ্ত) এখানে বলে রাখি ডিরোজিওর কাব্য এ দেশে প্রথম অনুবাদ করেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তারপর আরো অনেকে যেমন সত্যেন্দ্র নাথ দত্ত, তারপরে পল্লব সেনগুপ্ত ও তারও পরে রমাপ্রসাদ দে /মঞ্জুষ দাশগুপ্ত।

সাহিত্য সময় এবং সমাজের দর্পন। আদি-অন্ত-মধ্য বা আধুনিক যে কোন যুগের কবি সাহিত্যিকদের সৃষ্টি পর্যালোচনা করলে একথার সত্যতা বারবার প্রমানিত। ডিরোজিওর সাহিত্য চর্চাও তার ব্যতিক্রম নয়। কাসর-ঘন্টার শব্দে ,ধূপ-ধুনার গন্ধে ভারতবর্ষের বাতাস মাতাল। একদিকে জ্বলছে সতীর দেহ অন্য দিকে সতীদাহ প্রথা নিবারণের উদ্দেশ্যে রামমোহনের লেখনী থেকে নির্গত হচ্ছে যুক্তিতর্কের বহ্নি। অবশেষে বেন্টিঙ্কের শুভাগমনে সতীদাহের আগুন হল নির্বাপিত। একদিকে নিন্দুকের বাক্যবান অন্যদিকে আনন্দোল্লাসের আবিরে রাঙ্গা হল ভারতবর্ষের মাটি। সেই রং ডিরোজিওর মনকেও রাঙিয়ে তুলল। তিনি রচনা করলেন ‘On the Abolition of Sattee’.এই কবিতায় বেন্টিঙ্কের উদ্দেশ্যে সশ্রদ্ধ চিত্তে তিনি লিখলেন”Bentinck, be thine the everlasting mead,/ The heart’s full homage still is virtue’s claim/ And ‘tis the good man’s ever honoured dead which gives a immortality of fame”। সতীদাহের আগুন নির্বাপিত হল ঠিকই কিন্তু সতীর যন্ত্রণার অবসান হল না তখনো। শুধু নামান্তর হল মাত্র। বৈধব্যের দহন জ্বালায় জ্বলল সতীর অস্তিত্ব। সেই যন্ত্রণা স্পর্শ করল কবি ডিরোজিওর হৃদয়। তিনি ‘Song of the Indian Girl’-এর মত স্পর্শকাতর কবিতা রচনা করলেন।

ডিরোজিওর বড় ভাই পারিপার্শ্বিক বাতারণ তথা সঙ্গদোষে নষ্ট হয়ে যান, ছোটভাই পিতার আদেশে পড়াশুনার উদ্দেশ্যে স্কটল্যান্ডে চলে যান এবং বড় বোনের অকাল মৃত্যু ঘটে তবে ছোট বোনের সঙ্গে ছিল তাঁর আন্তরিক সম্পর্ক। ব্যক্তি ডিরোজিওর কাছে এই সকল সম্পর্কগুলোই ছিল মুল্যবান। আর তাই ‘Sister-in-law’ কিংবা ‘To My Brother in Scotland’ কবিতায় ডিরোজিওর কাছে জাগতিক সম্পর্কের মাহাত্ম্য কতখানি তা সরল সৌন্দর্য্যে প্রতীয়মান।

আন্তরিকভাবে নিপীড়িত মানবাত্মারমুক্তি কামনায় কবি তাঁর ’Freedom to the Slave’ কবিতায় লিখলেন “Blest be the generous hand that breaks/ The chain that tyrant gave/ And, feeling for degraded mans Gives freedom to the slave”। ‘Lines on the Grave Stone’ কবিতাটি ডিরোজিওর সমাধির উপর খোদিত ছিল। যা এখন বিলুপ্তির অন্ধকারে বিলীন। ডিরোজিওর কয়েকটি কবিতার মধ্যে দিয়ে যেমন মৃত্যুচেতনা প্রকাশিত তেমনি মৃত্যু ও তার পরবর্তী জগতের বিষণ্ণতা কবিকে ভাবিয়েছে সেকথাও স্পষ্ট। সেখানকার রহস্য ভেদে অসমর্থ কবি স্বপ্ন দেখেছেন সেই অন্ধকারেও সকাল হবে এবং সকলের ঘুম ভাঙব “Oh that their day might dawn,for they would awake”।

প্রকৃতি বারবার ফিরে এসেছে তাঁর লেখনীতে। প্রকৃতির বিধ্বংসী রূপ কবিকে মহিত করেছে। তিনি রচনা করেছেন ‘A Walk by Moonlight’ কিংবা ‘Mornning after a storm’-এর মত কবিতা। এমনকি মৃত্যুর পর তিনি সমাধিস্থ হতে চেয়েছেন “where the wind sings an everlasting dirge/ And wild wave, in its tremendous rear”।

এইভাবেই Hopeless Grief, The Peotry of Human life, Night,Evening in August, Lines in an Infant,Sonnet, Heaven, choruse of Brahmins, My Dream, Good night, The Poet’s Grave, Romeo and Juliet, Yorick’s Skull, Dust, The Tomb, Going in darkness, A song of the Hindustanee Mistral ইত্যাদি ডিরোজিওর সৃষ্টিগুলির মধ্যে দিয়ে তাঁর দেশপ্রেম বাণী, প্রগাঢ় মানবপ্রেম, বিদ্রোহী সত্তার মুক্তিপ্রয়াস, রোমান্টিক নিরাশা, জীবন ও মৃত্যু সম্পর্কিত তত্ত্বচিন্তা, প্রকৃতির সত্তানুভব, ছাত্রবাৎসল্য ফুটে উঠেছে। ডিরোজিওর সাহিত্যচর্চার পরিপ্রেক্ষিতে বলাই যায় যে তাঁর সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে একদিকে পাঠকবর্গ ব্যক্তি ডিরোজিওর অন্তরের অন্তরতম কোণে যেমন প্রবেশ করতে পারে তেমনি আবার অন্যদিকে তাঁর ভাবাবেগের মধ্যে দিয়ে আন্তরিকভাবে তিনি যে যথার্থই ভারতীয় তাঁর প্রমানও তিনি রেখে যেতে পেরেছেন। এইপ্রসঙ্গে বলে রাখি উল্লিখিত কবিতা কয়টির নাম আমি পেয়েছি বিভিন্ন মাধ্যম থেকে। এবং সেখান থেকেই জানতে পেরেছি তাঁর আরো অনেক কবিতা অসংগৃহীত অবস্থায় আছে।

ডিরোজিওর সাহিত্যচর্চা তথা জীবন চর্যা ১৮৩১ খ্রীষ্টাব্দেই তাঁরই ভাষায় “gone to that narrow cell” । কালবৈশাখীর উন্মত্ত ঝঞ্ঝা তার প্রবল শক্তি উন্মাদনায় এসে সহজ প্রবলতায় যেমন মানুষকে ক্ষণিকের জন্য অভিভূত করে প্রকৃতিকে এলোমেলো করে চলে যায় আর পিছনে রেখে যায় একরাশ ধ্বংসস্তুপ, ডিরোজিও একইভাবে মাত্র বাইশ বছরের স্বল্পায়ুতেই তাঁর স্বচ্ছন্দ ভঙ্গিমায় মানুষের চিরাচরিত চিন্তাভাবনাগুলোকে এলোমেলো করে দিয়ে চলে গেছেন আর রেখে গেছেন একরাশ মুক্তচেতনা তথা স্বাধীনচিন্তাজনিত উপলব্ধি।

১৮৩১ খ্রীষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে কলেজ কমিটির হিন্দু সভ্যগণ ডিরোজিওকে বরখাস্ত করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলেন এবং সেই উদ্দেশ্যে ডিরোজিওর স্বভাবচরিত্র বিষয়ক প্রশ্ন, তাঁর সংশ্রবে ছাত্রদের অপকার হচ্ছে কি না এবং সবশেষে দেশীয় সমাজের তৎকালীন অবস্থার নিরিখে তিনি শিক্ষকরূপে প্রতিষ্ঠিত হলে কলেজের ক্ষতি হবে কিনা-এইরূপ নানান প্রশ্ন তুললেন। অবশেষে অধিকাংশের মতে তাঁকে পদচ্যুত করা হল। সংবাদ পেয়ে তাঁর বিরুদ্ধে করা দোষারোপগুলি দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করে তিনি পদত্যাগ পত্র লেখেন। ডিরোজিও হিন্দু কলেজ ত্যাগ করলেও তাঁর সংস্পর্শে হিন্দু কলেজের ছাত্রগণ ‘ইয়ং বেঙ্গল’ নামে বিস্ময়কর বিদ্রোহাগ্নি জ্বালিয়ে যে ভাবদ্বন্দ্বকে উদ্ভাসিত করেছিল নবযুগের পথ তাতে রেখাঙ্কিত হয়েছিল।

হিন্দু কলেজ ত্যাগের পর যে কয়দিন তিনি বেঁচেছিলেন সেই সময় ‘ইষ্ট ইন্ডিয়া’ নামক একটি দৈনিক সংবাদপত্র প্রকাশ করতেন। ফিরিঙ্গী সমাজের উন্নতিকল্পে খাটতে খাটতে ১৮৩১ খ্রীষ্টাব্দের ১৭ই ডিসেম্বর শনিবার দুরারোগ্য ওলাওঠা রোগে আক্রান্ত হয়ে ছয়দিন বিছানায় শুয়ে থাকেন। এইসময় তাঁর কয়েকজন ছাত্র প্রানপন সেবা করেও তাঁকে ধরে রাখতে পারেননি। যে ফুল ১৮০৯ খ্রীষ্টাব্দের ১৮ই এপ্রিল কলকাতার এন্টালি পদ্মপুকুরে সম্ভ্রান্ত পোর্তুগীজ পিতা ফ্রান্সিসের বাগানে ফুটেছিল ১৮৩১ খ্রীষ্টাব্দের ২৪শে ডিসেম্বর ঝড়ে পড়ল কালের অতলে।

রাজা আসে রাজা যায়, পড়ে থাকে রাজ্যপাট। কালের নিয়মে একদিন তারও হয় অবসান। কিন্তু কীর্তি অমর। তাই আজ মৃত্যুর ১৮৩ বছর পর আমরা এই ইঁদুর দৌড়ের যুগেও কখনো কখনো কোনো না কোনো মুহূর্তে ডিরোজিওকে স্মরণ করি, এখানেই জীবনের কাছে মৃত্যুর পরাজয়।
---------**সমাপ্ত**--------

স্বাগতা ভট্টাচার্য্য: কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন