প্রবন্ধ
আলীপুর
বোমা ষড়যন্ত্র মামলা। ফাঁসির রায় শোনার পর, বন্ধু সত্যানন্দকে বললো, 'লীলাকে গিয়ে বলিস্
এই জন্মে তো তার সাথে দেখা হলোনা। পরের জন্মে স্বাধীন ভারতে নিশ্চই একসাথে ঘর করা যাবে'
মামলার
রায়
১৯০৮ সালের
মে মাসে গ্রেফতার, ১৯০৯ সালের মে মাসে রায়, ১৭ জন বেকসুর খালাস, ১০ জনের যাবত জীবন
দ্বীপান্তর ও সম্পতি বাজেয়াপ্ত, ৩ জনের ১০ বৎসরের দ্বীপান্তর, ২ জনেরর ৭ বৎসর দ্বিপান্তর।
বারীন্দ্র ও উল্লাসকর দত্তের হলো ফাঁসির আদেশ। এজলাসে সবাই নিশ্চুপ। উল্লাসকর সেই নিরবতা
ভেঙ্গে বলে উঠলেন, 'Thank you very much, বাঁচার দায় থেকে বাঁচা গেলো'। হাত করজোড় করে
গেয়ে উঠলেন, 'সার্থক জন্ম আমার জন্মেছি এই দেশে'। এজলাসের সবার চোখে জল, রবীন্দ্রনাথের
গানের কি শক্তি, গাইছে ফাঁসির রায় পাওয়া সদ্য
একজন দেশপ্রেমিক। কুমিল্লা তালপুকুর পাড় থেকে মা মুক্তাবেশী রায় শুনতে গিয়েছিলেন, সাথে ছিলো লীলার বড়বোন শোভনা। 'চিন্তা করিস্ না পলু আমি
আপিল করবো' ছেলেকে ডাক নামেই ডাকতেন মুক্তাবেশী। উল্লাসকর আপিলের জন্য রাজী নয়, মা
ও মামার অনুরোধে সম্মত হলেন। ৬ মাস পর রায় হলো। বারীন্দ্র ও উল্লাসকরের যাবৎজীবন দ্বিপান্তর।
পাতার
ছাতা
সরাইলের
কালিকচ্ছ (ব্রাক্ষণবাড়িয়া) নিজ বাড়িতে ১৮৮৫ সালে, উল্লাসের জন্ম। দ্বিজদাশ দত্তের ঘরে।
নানা অাচার্য মহারাজ আনন্দ স্বামী পূর্ব বাংলায় ব্রাহ্ম সমাজের জনক। কুমিল্লায় ব্রাহ্ম
সমাজ প্রচারে, গুরুদয়াল সিংহ, দ্বিজদাশ দত্ত ও উকিল রজনী নাথের ভূমিকাই মুখ্য। দ্বিজদাশ
দত্ত, ১৮৮১ সালে কুমিল্লা জিলা স্কুলের হেড মাস্টার। তিনি স্বদেশী আন্দোলনের আগেই স্বদেশী,
মান কচুর পাতার ছাতা মাথায় দিয়ে বৃষ্টির দিনে স্কুলে যেতেন। তালপুকুরের পূর্ব পাড়ে,
ব্রাহ্ম মন্দিরের বিপরীত পাশেই বাড়ি। ত্রিপুরার জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট, হেড মাস্টার সাহেবের,
স্বদেশী কাজকর্মে নাখোশ হয়ে উপরে চিঠি লিখেন, এই স্বদেশীকে কোন একটা অখ্যাত স্কুলে
বদলির জন্য। Mr.Croff ছিলেন এডুকেশন ডিরেক্টর, তিনি দ্বিজদাশ দত্তের মেধা ও চিন্তাধারা
সম্পর্কে অবিহিত। Mr. Croff তাকে প্রমোশন দিয়ে কলিকাতা 'বেথুম স্কুল এন্ড কলেজের' লেকচারার
করে পাঠিয়ে দেন। সেখান থেকে সরকারী বৃত্তি পেয়ে, বিলাত চলে যান, এগ্রিকালচার ইঞ্জিনিয়ারিং
উচ্চতর শিক্ষালাভ করে শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে, কৃষি বিভাগে প্রফেসার পদে যোগদেন।
স্বরাজ
১৯০৫ সালের
বঙ্গভঙ্গ ছিলো একটা টার্নিং পয়েন্ট। লর্ড কার্জনের এই ঘোষনার এবং কার্যকরের পর, বাংলায়
সশস্র সংগ্রামের বিকাশ ঘটে। এক ঘোষনায়, লর্ড কার্জন বলেছিলেন, 'মুসলমানদের হৃতগৌরব
পনুরুদ্ধারের এর জন্য পূর্ব বাংলা গঠন করাটাই তার লক্ষ্য'। ১৯০৬ সালে কংগ্রের সভায়
স্বরাজ' কথাটি গৃহীহ হয়। তিনটি ধারায় চলতে থাকলো আন্দোলন। নরম পন্থীরা বুঝলো, ঔপনেবেশিক
স্বায়ত্তশাসন, চরম পন্থীরা বুঝলো স্বাধীনতা, উগ্র পন্থীরা বুঝলো সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে
সর্বাত্বক বর্জন এবং সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন।
বিষয় রসায়ন
উল্লাসের
বড় হওয়া কলকাতায়, মেধাবী, নাম যেমন উল্লাস কজেও তেমনি। বাঁশি ও বেহেলা বাজানো, গানের
গলাও দারুণ, দীর্ঘদেহী। এন্ট্রাস পাশ করে, প্রেসিডেন্সিতে ভর্তি হয়েছে। অধ্যাপক বিপিনচন্দ্রে
রসায়ন ক্লাশটা তার বেশী ভাল লাগে। বিপিনচন্দ্র, সিলেট বাড়ি জমিদার ঘরের ছেলে, কলকাতায়
পড়তে এসে, ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষিত হন, তাই বাড়ি থেকে ত্যাজ্য, সাথে পাশের গ্রামের, জমিদারের
ছেলে, ডা. সুন্দরীমোহন দাশও ত্যাজ্য তাঁরা 'সুকিয়া ষ্ট্রিটে' থাকেন।
রবীন্দ্রনাথ
মিনার্ভায়
রবীন্দ্রনাথ ঠকুরের বক্তৃতা, বিকাল ৫ টায়। সবাই স্বদেশী পোষাক পড়ে যাবে। উল্লাসকর দলপতি,
সাথে সত্যানান্দ, মানিক লাল, যদুগোপাল ও রাধাকৃষ্ণ। মিনার্ভা ভরে গেছে, কিন্তু ঢুকতে
হবে, গেটে ভলান্টিয়ার সাথে মারামারি, এ'দিকে সত্যানন্দকে ঘোড়সাওয়ার পুলিশ দিলো বেদম
প্রহার, উল্লাসকর সেই পুলিশকে ঘোড়া থেকেধ ফেলে দিলো, ভলান্টিয়ারদের কিল, ঘুষি মেরে
আহত করলে, পুলিশ উল্লাসকে গ্রেফতার করেন। পথে বেদম লাঠিপেটা করেন, সেই রাতেই, আধ্যপক
বিপিনচন্দ্র ও ডা.দিজেন্দ্রনাথ মৈত্র, ৫০০ টাকা বেলবন্ড দিয়ে থানা থেকে নিয়ে আসেন।
প্রথম
দেখা
সেইদিন
উল্লাসের শিবপুর যাওয়া হলো না। সুন্দরীকাকার সুকিয়া স্ট্রিটের বাড়িতে চলে আসেন। বিপিনচন্দ্রের
মেঝো মেয়ে লীলা রাতে উল্লাসের পিঠে, লাঠিপেটার
আঘাতে মলম লাগিয়ে দিলো, লীলার বয়স তখোন ১৫/১৬, লীলার সাথে উল্লাসের, সেদিনই প্রথম দেখা।
স্বরাজ
বঙ্গভঙ্গ
আন্দলোনকে কেন্দ্র করে, সারা বাংলায় গড়ে উঠে বিভিন্ন সংঘটন, ঢাকায় 'অনুশীলন', ময়মনসিংহে
সুহৃদ' ও সাধনা', ফরিদপুরে ব্রত। জেলায় জেলায় ঢাকা অনুশীলন সমিতির শাখা ছড়িয়ে পরে,
কলিকাতায় অনুশীলন সমিতি ভেঙ্গে 'যুৃগান্তর' নামে একটি উপদল গঠিত হয়।
মেধা ও
মনন
পাঠ্যবইয়ে
মন নেই, শিখছেন রবীন্দ্র সংগীত। বঙ্কিম চন্দ্রের 'অনুশীলন ও ধর্মতত্ব', কার্লিয়ের
'Heroes and Hero Warshi, পিটার-ক্রোপোটনিকের 'Memories of a Revolutionists'In
Russian and French Prison. এসব পড়ে উল্লাসের জীবন বোধ বদলে গেলো। দেশকে মুক্ত করতে
হলে, চরমপন্থী হতে হবে।
আবার রসায়ন
সেইসময়
স্বদেশী আন্দোলনের চরম পন্থীদের, মূল হাতিয়ার ছিলো, পিস্তল, রিভলবার বাংগালীরাই প্রথম
বোমার অনুপ্রবেশ ঘটায়। যুগান্তরের সদস্যরা -এর মুল হোতা, আগেই নিয়েছেন অনুশীলন, অরিবিন্দ
ঘোষ এর উদ্যোক্তা। এই সমিতি, হেমচন্দ্র কানণগো নামে এক জনকে বিদেশে পাঠানো হয় বোমা
বানানোর দিক্ষা নিতে। তিনি সুইজারল্যান্ড, লন্ডনে ব্যর্থ হয়ে প্যারিসে আসেন, সেখানে
ফরাসী সমাজতান্ত্রিক দলের নেতাদের কাছে দীক্ষা নিয়ে ১৯০৮ সালে কলিকাতায় ফিরে আসেন।হেমচন্দ্র
নির্মিত প্রথম বোমাটি বইবোমা, কিংসফোর্ডকে পাঠনো হয়েছিলো, যা বিস্ফোরিত হয়নি। তারপর,
৫ জনকে নিয়ে তৈরী করেন বোমা তৈরীর কারখানা। উল্লাসের রসায়ন ক্লাশটাই ভালোলাগে, এক্সপ্লোসিভ
বানানোর বিভিন্ন পর্যায় গুলো রপ্তকরেছেন কলেজেই, একজন দক্ষ বোমার কারিগর হয়ে উঠলেন।
ফিরে এলেন হেমচন্দ্র, যোগদিলেন হেমচন্দ্রের সাথে।
প্রতিবাদ
মাদারীপুর
এক স্কুলে বাচ্চারা 'বন্দে মাতরম' গান গাওয়ার অপরাধে, পূর্ব বাংলার ছোট লাট, ব্যমফিল্ড
ফুলারের নির্দেশে ছোট ছোট বাচ্চাদের চাবুক মারার খবরটা, গণ মাধ্যমে ছড়িয়ে পরে, শিক্ষক
কালীপ্রসন্ন দাশকে পুলিশ লাঞ্ছিত করেছে। নিজে শিক্ষকের ছেলে, ব্যাগের মাঝে পুরনো চটি
জুতা নিয়ে কলেজে আসেন, সাথে যুগান্তরের বন্ধুরা। ব্যাগ থেকে চটিজুতা নিয়ে, স্বদেশী
আন্দোলন বিরোধী প্রফেসার রাসেলের গালে ও পিঠে, উল্লাসকর বন্দেমাতরম' বলে প্রহার করেন,
সেদিনই চুকে গেলো কলকাতা প্রেসিডেন্সি তে পড়ার পাঠ। পিতা দ্বিজদাশ দত্ত, পলুর আচরণে
উদ্বিগ্ন। বিলেত পাঠিয়ে দেবার আয়োজন চলছে। কোথায় বেনিয়াদের বিদায় করবো, আমি যাবো ওখানে
পড়তে? বিপিনচন্দ্র সমাধান করে দিলেন, বোম্বে 'ভিক্টোরিয়া জুবলি ইনিষ্টিটিউটে' টেক্সটাইল
ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে পাঠিয়ে দিলেন, উল্লাসকরকে।
লীলাকে
ছেড়ে উল্লাসকর চলে এলেন বোম্বে, সেখানে উল্লাসের মন ভালোনেই। লীলার বড়বোন শোভনার সাথে
বিয়ে হয়েছে, উল্লাসকরের কাজিনের, এখন নিকট আত্মীয়, কলিকাতায় সুকিন স্ট্রিটে, বিপিনচন্দ্রর
বাড়ির ছাদে, নিয়মিত বসে গানের আড্ডা। রবীন্দ্রনাথ
বঙ্গভঙ্গের পর লিখে যাচ্ছেন, স্বদেশী গান। উল্লাসের সব গানই কন্ঠস্থ, শোভনা ও লীলার
সাথে, বাড়ির ছাদের আড্ডাটা ভীষণ টানছে। নিয়মিত বোম্বেতে পাচ্ছেন, যুগান্তরের খবর। কলকাতায়
স্বদেশীদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ, মন পরে আছে কলকাতা স্বদেশীদের সাথে, পুলিশের অত্যাচার
বেড়েই চলছে। এদিকে কংগ্রেস নেতারা ইংরেজদের তোয়াজ নিয়ে ব্যস্ত। এসব উল্লাসের ভালোলাগছে
না।
প্রথম
বিস্ফোরণ
বারীন
বাবুর অনুরোধে, বিভুতি চক্রবর্তী ১০ দিনের মাথায় ভারতে প্রথম বোমা তৈরী করলেন। ২৭,
কানাইলাল লেন, যুগান্তর অফিসে এসে জমা হলো সেই বোমা। বোম্বে বসে এতো সব জানার পর। একদিন
আবর সাগরে সব ফেলে দিয়ে, উল্লাসকর কলকাতার ট্রেনে উঠে গেলেন। শরীর ভালো না, ইনফেকটিভ
হেপাটাইসিসে ভুগছেন। শিবপুর চলে এলেন, পিতার লাইব্রেরীতে কেমেস্ট্রি বইয়ে ঠাসা। নাইট্রোগ্লিসারিন
হলো বোমার আসল উপাদান, যা দিয়ে, এলফড নোভেল
ডিনামাইট বানিয়ে ছিলেন। সেখানেই গড়ে তুলেন প্রথম গবেষণাগার, বনিয়ে ফেললেন বোমা। প্রথমেই
খবর দিলেন সত্যানন্দকে, বাড়ির পাশে মাঠে ফাটিয়ে দেখিয়ে দিলেন, সত্যানন্দ অভিভুত হয়ে
নিয়ে এলেন, মুরারিপুকুর থেকে বারীনকে, শিবপুরে।
আশ্রম
বারীন
নিজবাড়ি, ৩২ মুরারিপুকুরে, খুলেছেন আশ্রম, সবাই জানে সেখানে ধর্ম শিক্ষার ক্লাশ হয়।
অসলে আশ্রমের আড়ালে ছিলো, একটি বিপ্লবীদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। উল্লাসকরকে নিয়ে আসেন
এবং এক্সপ্লোসিভ বিভাগের দায়িত্ব অর্পণ করেন, সময়টা ছিলো ১৯০৭ সাল। শিবপুর আর মুরারিপুকুরের
যোগাযোগটা বেড়ে গেলো। একদিন শিবপুরে, সুখসাগরের অসতর্কতাবশত একটি বোমা বিস্ফোরিত হলে,
উল্লাসের আর শিবপুর থাকা সম্তব হলো না। চলে এলেন স্থায়ী ভাবে মুরারিপুকুর। বোমাতে পেরেক,
লোহার টুকরা দিয়ে স্পিন্টার বানিয়ে ফেললো, ১৭ দিনের মধ্যো মাইন বানিয়ে, সবাইকে অবাক
করে দিলো। সব প্রস্তুতি সম্পন্ন, এবার এ্যটাাক।
নারায়ণগড়
সবাই উচ্ছাসিত,
মাইন দিয়ে ট্রেন উড়িয়ে দেয়া যাবে। প্রথম টার্গেট, এন্ডু ফ্রেজারকে হত্যা। ঠিক হলো মানকুন্ডতে
মাইনটি পোঁতা হবে। মাইন পোঁতা হলো সেই রাতে ট্রেন এলো না। ফ্রেজার ত্রান কার্যে ঔরিষ্যায়
চলে গেছেন। এবার খবর পাকা, খড়গপুরের কাছে নারায়ণগড়ে, একটি নির্জন জায়গায় মাইন পোঁতা
হলো। বিস্ফোরণে রেলের ইঞ্জিন উড়ে গেলেও বগির কিছুই হয়নি। সারা ভারত তোলপাড়। খবর রটলো,
রাশিয়া থেকে আগত কমিউনিস্টদের কাজ এটা, সময়টা ছিলো ১৯০৭ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষদিকে।
নারায়ণগড়ের ঘটনায় পর, পুলিশের তৎপরতা বেড়ে গেলো। অনেক গোপন আস্তানার খবর, গোয়েন্দা
বিভাগের কাছে উন্মোচিত হলো। হৃষিকেশ বললো চলো দেশ ভ্রমনে বেরিয়েপড়ি, কলিকাতা এখন আমাদের
জন্য কিছুদিন নিরাপদ নয়।
ঘটনা প্রবাহ
১৯০৮ সাল,
পুলিশের তল্লাশি। স্বদেশী, স্বরাজ, অসহযোগ, এসবের আনেক গোপন খবর, আস্তানা, গোয়েন্দা বিভাগের কাছে ধরা পড়ছে। যুগান্তরের সবাই এখানের মাল ওখানে
সরিয়ে চলছে। আবার আঘাত হানতে হবে, বেনিয়াদের ভিত কাঁপিয়ে দিতে হবে। নেপাল থেকে ফিরে,
ভবানীপুর, রাশা রোড, স্কসট লেন, হ্যারিসেন রোড ও শ্যামবাজার থেকে সব নিয়ে, চলে গেলেন
দেওঘরের অনতিদূর রায়নিতে। ১০ টাকা মাসির ভাড়ায়, 'শীলা।।।। লজ' ভাড়া নিয়ে উল্লাসকর নিবিষ্ট
মনে, বোমা বানাচ্ছে। জায়গাটা উল্লাসের ভালোলেগে গেলো, নিয়মিত যোগব্যয়াম করেন। ঘর ভর্তি কেমিকেল, তিনটি বোমা বাানিয়ে ফলেছেন,
পরীক্ষার জন্যে দূরে পাহাড়ে একটি বোমা ফাটালেন, এতে উল্লাসকর আহত হলেন, প্রফুল্ল চক্রবর্তী
মারা গেলেন। দেওঘরের পাঠ চুকে গেলো, আবার কলিকাতা। হেমচন্দ্র দাশ কাননগোঁ, প্যারিস
থেকে বিস্ফোরকের উপর উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়ে ফিরে এসেছেন। ভবানীপুরে, উল্লাসকর, সত্যানন্দ,
কানাইলাল, নিরাপদকে নিয়ে, হেমচন্দ্রের দাশ চালাচ্ছেন, বোমা প্রশিক্ষণ ও তৈরী কেন্দ্রের।
ক্ষুদিরাম
ভারতের
সর্বকনিষ্ঠ বিপ্লবী ১৯০২ সালে, মেদেনিপুরে একটি বিপ্লবী সংগঠনের সাথে য়ুক্ত হন, সেই
দলের নেতা হেমচন্দ দাশ কাননগোঁ ও সত্যেন্দ্রনাথ
বসু। ১৬ বৎসর বয়সে ক্ষুদিরাম যুগান্তরের সক্রীয় কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েন। মুজাফ্ফরপুর
জেলা জজকে এ্যাটাকের দায়িত্ব পরে, ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকীর উপর। ক্ষুদিরাম ৩২, মুরারিপুকুর
উল্লাসকরের কাছ থেকে, রিভলবার ও বোমা সংগ্রহ করেন, মুজাফ্ফরপুর হামলার জন্য, সাথে সাতদিনের
প্রশিক্ষণ।
মায়ের
কথা
উল্লাসকরের
মায়ের কথা মনে হলো, ২৭ এপ্রিল ১৯০৮সালে, শিবপুর থেকে ছুটে এলেন কুমিল্লায়, মায়ের কাছে,
শোভনা ও লীলা তখন কুমিল্লায়। এত প্রিয় কুমিল্লা, উল্লাসের সেদিন ভালো লাগছে না। মন
পড়ে আছে, মেদিনীপুর, ক্ষুদিরামের কাছে, পিতা মাতা নেই অনাথ, ১৭ বৎসরের যুবকের হাতে
তুলে দিয়ে এসেছেন বোমা, রিভলভার, কি জানি কি হয়? ২ দিনের মাথায়, কুমিল্লা ছেড়ে আবার
কলিকাতা চলে যান।
রাত তখন
সাড়ে আটটা
১৯০৮ সালের
৩০ এপ্রিল, মুজাফ্ফরপুর শহরে জেলা জজ কিংসফোর্ড সাহেবের বাংলায় ক্ষুদিরাম, বোমা নিক্ষেপ
করেন। রাত তখন সাড়ে আটটা। এতে জজ সাহেব মরেন নি, মরেছেন, মিসেস ও মিস্ কেনেডি। রেল
স্টেশনে ক্ষুদিরাম গ্রেফতার। ২রা মে, প্রফুল্ল সুইসাইড করেন। এই মামলায় ক্ষুদিরামের
ফাঁসি হয়।
গ্রেফতার
ক্ষুদিরামের
ঘটনা সারা ভারতবর্ষ কাঁপিয়ে দিলো। ৩০ এপ্রিল সন্ধ্যায় কলিকাতা এসে পৌঁছলো উল্লাসকর।
১৯০৮ সালে ২ রা মে ব্রিটিশ পুলিশ, সন্দেহজনক সব জায়গায় তল্লাসি চালায়। ৩২,মুরারিপুকুর,
হ্যারিসন রোড, নবশক্তি পত্রিকা অফিস, গ্রে স্ট্রিট, গোপীমোহন দত্ত লেন সহ সব জায়গায়।
উদ্ধার করলো বোমা ও মাইন বানানোর উপাদান, অনেক
আগ্নেয়াস্র কেমিকেল, বিপ্লবী পুস্তক। মুরারিপুকুর থেকে উল্লাসকর সহ ১৪ জনকে আটক করা
হয়। এবং বিভিন্ন জায়গা থেকে অনেক বিপ্লবীদের গ্রেফতার করা হয়।
রায় হলো,
'আলীপুর ষড়যন্ত মামলার'
দিপান্তর
হুগলী
নদীর মোহনা থেকে ৬০০ মাইল দূরে, বঙ্গোপসাগরে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ। ইংরেজ শাসন আমলে,
এটা ছিলো জেলখানা। বিদ্রোহী, ডাকাত, ব্রিটিশ বিরোধী হলেই, আন্দমান সেলুলার জেলে। আন্দামান
নামটাই একটা আতংক। সেখানে কয়েদীদের উপর চলে, অমানুষিক নির্যাতন। পাথর ভাঙ্গা, ঘানিটানা,
জল উঠানো, রাস্তা বানানো সব কাজ। কিন্তু মিলতো না, পরিমিত আহার। পুরোটা দ্বীপপুঞ্জ
একটা কারাগার।
২০ দিন
পর
আপিলে
উল্লাসকর ও বারীন্দ্রের ফাঁসির বদলে, দ্বিপান্তর হয়। রায়ের ২০ দিনের পরই উল্লাসকর পাড়ি
দিলো বঙ্গোপসাগর। আর কোনদিন ফেরা হবে না, সে এখন আন্দামানে, দ্বীপান্তর। উল্লাসকরকে
দিয়ে সব অমানুষিক কাজ গুলোই করিয়ে নিলো, কারা কতৃপক্ষ। দিনে দিনে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে
ফেলেন, সেখানেই শুনেন ১৯১১ সালে, বঙ্গভঙ্গ রদ হয়েছে, সত্যানান্দ চিঠি লিখে জানায় সবার
খবরা খবর। কোন কাজ ভালো লাগছে না, মাঝে মাঝে জ্ঞান হারাণ, মানসিক স্বাস্থ্য ভালো নয়।
খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। বসলো মেডিকেল বোর্ড, ডাক্তার উল্লাসকরকে কলা খেতে দিলেন,
উল্লাসকর নির্বিকার কলা খেয়ে, কলার খোসা চিবিয়ে খেয়ে ফেলেন।
মাদ্রাজ
মেডিকেল
বোর্ডের সিদ্ধান্তে, উল্লাসকরকে মাদ্রাজের মানসিক নিবাসে পাঠনো হলো। সেখানে কাটলো ছয়টি
বৎসর। পিতা দ্বিজদাশ ও মা মুক্তাবেশী, মাদ্রাজে ১৯১৯ সালে, ছেলের সাথে দেখা করেন। এবং
লেখালেখি করে, উল্লাসের মানসিক ও স্বাস্থ্য বিবেচনায় করে আপিল করেন। ২০ বৎসরের সাজা
১২ বৎসর খেটে, ১৯২০ সালে, ব্রিটিশ সরকার,
'ভারতরক্ষা আইনে' সব চরমপন্থিদের সেলুলার জেল
থেকে মুক্তি দেন।
কলিকাতায়
হ্যারিসন রোডে ঘিয়ের ব্যবসা করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে, নিজগ্রাম কুমিল্লা কালিকচ্ছে চলে
আসেন। সপ্তাহে একদিন সরাইল থানায় রিপোর্ট করতে হয়।
Twelve
years of prison of life
কালিকচ্ছে
বন্ধুদের অনুরোধে লিখেন সেই নির্মম কাহিনী। বইটি ইংরাজি ভাষায় অনুদিত হলে, আবার পুলিশের
নজরে আসেন।
১৯৩১ সালে,
কুমিল্লা নবাব ফয়জুন্নেসা গার্লস স্কুলের দুইছাত্রী, শান্তি ঘোষ ও সুনিতি চৌধুরী, উল্লাসকরের
সাথে দেখা করতে আসে। উল্লাসকর তিতাস নদীর পাড়ে দিনযাপন করছেন, দেশের প্রকৃতির সাথে।
আপনাকে প্রনাম করতে এসেছি, আমরা সহসাই, স্টিভেন্সকে হত্যা করবো। উল্লাসকর স্বাধীনতাকামী
দুইটি মেয়েকে দেখে, ১২ বৎসর জেল জীবনের, অনেক কষ্টই ভুলে গেলেন।
অরণি
বিকেলে
অরণিকে নিয়ে বেড়োতে বের হলাম, মহুয়া গাছটা পেরিয়ে হাতের ডানে ফয়জুন্নেসা স্কুল, অরণি সেখানেই পড়ে।ম চলো আজ এ'দিকটায়
যাই, তালপুকুর পাড় ঘুরে বাগিচাগাঁও হয়ে বাসায় ফিরবো। চলো মন্দ হবে না, এ'দিকটায় অনেকদিন
যাওয়া হয় না। 'মতিন মটর ওয়ার্কস' গ্যারেজ পার হয়ে ডানে স্কুল, কোণায় একটা এ্যলমুনিয়ামের
কারখানা 'কুমিল্লা এ্যলমুনিয়াম ফ্যাক্টরি', মিউনিসিপ্যলটির পানির কলের উত্তরে, পুরনো
একটা দালান বাড়ি, দেখেই বুঝাযার বনেদী।
অরণি,
জানো এটা কার বাড়ি?
এটাতো
একটা কারখানা, হাড়ি পাতিল বানায়, রোজই দেখি,
বাড়ি হতে যাবে কেন, হাঁস মার্কা এ্যলমুনিয়াম ফ্যাক্টরি।
এটাই বিপ্লবী
উল্লাসকর দত্তের বাড়ি। ক্ষুদিরাম যার কাছ থেকে বোমা ও রিভলবার ও প্রশিক্ষণ নিয়েছিলো।
তোমাদের
স্কুলের, শান্তি ও সুনিতি, ম্যাজিস্ট্রেট কে হত্যার আগে, উল্লাসকরের গ্রামের বাড়ি,
কালিকচ্ছে প্রনাম করতে গিয়েছিলো।
আরণি বিস্ময়ের
সাথে আমার কথাগুলি শুনছিলো, হাঁটতে হাঁটতে আমরা, ইতিহাসের সেইদিন গুলিতে ফিরে গিয়েছি।
আমরা তখন
এদেশে, নূতন ইতিহাস রচনা করছি।
লীলা
লীলা এখন
বিলাতে, কৃষি বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করছে, পোস্ট গ্রেজুয়েশন। ভাই নিরঞ্জন বিলাত থেকে ফিরে
এসেছেন। কিছুদিন পর লীলাও এসেছে, বোম্বাই এসে কৃষি বিভাগে শিক্ষকতা করেন।
মাদ্রাজ
মানসিক হাসপাতালে থাকাকালীন সময়ে, উল্লাসকরকে কোন চিঠিপত্র, নিউজ পেপার দেয়া হতো না,
সরকারী নির্দেশে। সুখসাগর চিঠি লিখে, এসব খবরা খবর নিয়মিত, কুমিল্লায় উল্লাসকরকে জানাতেন, লীলা এখন বোম্বেতে, সামরিক কর্মকর্তা নৃপেন
বসুর সাথে বিয়ে হয়েছে। দারুণ আঘাত পেলেন, ১২ বৎসর, জেলে ছিলাম বিয়ে করেনি, যখন আমার
ছিলো অনিশ্চত জীবন, এখন এমন কি হলো, লীলার বিয়ে করতে হলো। নিরঞ্জন লীলাকে বলেছে,
'You
have bitrated Uallas.'
লীলার
সবকয়টা চিঠি নিয়ে, একদিন বোম্বাই এসে লীলার মুখমুখি।
'এ বিয়ে
আমি মানি না'
সব কয়টা
চিঠি আগুনে পুড়ে, ছাইগুলি ধুতির আঁচলে গিটঠু দিয়ে ফিরে এলেন কালিকচ্ছ, মা বাবা তখন
কুমিল্লায়। আবার চিঠি এলো লীলা, লন্ডন ঘুরে এসেছে, নৃপেন বসু দেহত্যাগ করেছেন। লীলা ভীষণ অসুস্থ, পক্ষাঘাতগ্রস্ত
শরীরের নিম্নাংশ সম্পুর্ন অবস। তাহলে কি লীলা বিয়ের আগেই অসুস্থ ছিলো? এসব কথা লীলা
কখনো চিঠিতে জানায়নি। উল্লাসের উৎকন্ঠায় দিন কাটাচ্ছে। এ'দিকে দেশে দুর্ভিক্ষ, ১৯৪৬
সালের ১৬ অক্টোবর, রায়ট। উল্লাসের বিশ্বাস, এই দাঙ্গা সৃষ্টি করা হয়েছে, হিন্দু, মুসলমানের
ক্ষমতার ভাগাভাগির স্বার্থে।
দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে। মিত্রশক্তি জয় হয়েছে। উপনিবেশ দেশ গুলোকে স্বাধীনতা দেবার স্বদিচ্ছা
হলো, ১৯০ বৎসর পর। ১৯৪৭ সালে দেশভাগ।
১৯০৫ সালে
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন করে কত জীবনের আবসান হলো। অথচ দেশটাকে ভাগকরে দিলো, মুসলীম লীগ ও
কংগ্রেসিরা, মন্ত্রী মিনিস্টার, কে কি হবে এই নিয়ে লবিং চলছে। একটা টু শব্দ কেহ করলো
না, দেশটা ভাগকরে দিলো। এই জন্যই কি আমরা, বন্দুক, বোমা, জেল দ্বীপান্তর, ফাঁসি কাষ্ঠে
ঝুলেছি।
যুগান্তরের
বিভুতি, সূর্যসেনের দলের লোকনাথ, অনুশীলনের প্রফুল্ল ঘোষ বড় মন্ত্রীর পদ পেলেন, কংগ্রেস
ও মুসলিম লীগ লুটপাটের জন্য, পাকিস্তান ও হিন্দুস্থানে কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ
করে দিলো। পূর্ব বাংলার কোটি কোটি লোক উদ্বাস্ত। শিয়ালদহ ভরে উঠেছে শরণার্থীতে। উল্লাসকরের
মতো সবাই জন্মভূমি থেকে বিতারিত। লীলা কলিকাতা পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, এদিকে শরণার্থীর
দেখশুনা। ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়, মাসে ২০০ টাকা ভাতা, উল্লাসকরের জন্য বরাদ্দ করলো
'স্বাধীনতা সংগ্রামী পেনশন' উল্লাসকর দত্ত
তা প্রত্যাখ্যান করেন, কারো ভিক্ষা সে নেবে না। এই ভারত আমি চাইনি।
জন্মভূমি
অন্যভূমি
'লীলাকে
গিয়ে বলিস্ এই জন্মেতো আর তার সাথে দেখা হলো না, পরের জন্মে স্বাধীন ভারতে নিশ্চই একসাথে
ঘর বাধা যাবে'।
উল্লাস
লীলাকে বিয়ে করবে, শোভনা বললো ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিও উল্লাস, লীলা ভীষণ অসুস্থ। কোনদিন
তো সেবা করতে পারিনি শোভনা, শুধু কষ্টই দিয়েছি, এখনই লীলার আমাকে বেশী প্রয়োজন। ১৯৪৮
সালে, পিজি হাসপাতাল থেকে লীলাকে কোলেতুলে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ব্রাহ্ম মিশনে প্রেসের
দোতালায় ব্রাহ্ম মতে বিয়ে করলো।
লীলা বলে
তার বিলেতের কথা, উল্লাস বলে ১২ বৎসর জেল জীবনের কথা। লীলার বয়স তখন ৬০, আর উল্লাসের
বয়স ৬৩ পেরুলো। পরের জন্মে নয়, এই জন্মেই ঘর বেধেছিলো, লীলার সাথে উল্লাসকর। তবে জন্মভূমি,
অন্যভূমি হয়ে গেলো।
শেষ
শওকত
আহসান ফারুক: কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত
খুব ভালো হয়েছ। কাজে লাগবে
উত্তরমুছুন