রম্যরচনা
মর্ণিং
ওয়াক সেরে রোজ একটা আড্ডা হয়। রেস্ট, সঙ্গে
চা। সুবিরবাবু অধ্যাপক বলে সবাইকে যেন ছাত্র মনে করেন। অযাচিত জ্ঞান বিতরণ করা তার
অভ্যাস। কিন্তু আজ কি হল কে জানে তার মুখে রা-টি নেই। একেবারে চুপ। চোখে-মুখে একটা
আতঙ্ক। আমার চোখ এড়ায় নি। জিজ্ঞেস করলাম ‘কি হল সুবিরবাবু আজ চুপচাপ কেন’? জিজ্ঞাসা করতেই কেমন চমকে উঠে দাঁড়িয়ে পরলেন। ‘আমি চলি’। সন্দেহ বেড়ে গেল। চেপে ধরে বসালাম। ‘কি ব্যপার বলুন তো’। --‘এখন আমি চলি’। আবার চলে যেতে উদ্যত
হলেন। আমি একটু জোরের সাথেই বললাম ‘কি এত তাড়া মশাই, পড়ান তো কলেজে। মাঝে মধ্যে না গেলেও
চলে। ফাঁকিবাজির চাকরি’। অগত্যা বসলেন।
সুবিরবাবু
করুণ স্বরে বললেন ‘কাল আমার খুব বিপদ
গেছে’ বলেই চুপ হয়ে গেলেন। আমি
সাহস দিয়ে বললাম ‘আরে কি হয়েছে বলবেন
তো, আমি দুঁদে উকিল। ভয়ের কি আছে। আপনার
কোনো চিন্তা নেই, বলুন কি হয়েছে কাল’? সুবিরবাবু
আস্বস্ত হলেন। বলতে শুরু করলেন ‘
কাল
মেট্রো স্টেশন থেকে বাইরে বেড়িয়ে দেখলাম নয়-দশ বছরের একটি বালিকা হাত পেতে ভিক্ষে
চাইছে। একটু অন্ধকারের দিকে। আগেও দেখেছি ক’দিন।
আমি
হেসে বললাম ‘আরে মশাই, কলকাতা শহরে এ রকম সব জায়গাতেই দেখা
যায়। এ আর নতুন জিনিষ কি দেখলেন। যাদের অভাব, তারা ভিক্ষে ছাড়া আর কি করবে বলুন? আপনি ভাল চাকুরে, মাস-কাবারে
মোটা মাইনে ঘরে তোলেন। ঘরে সুন্দরী স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে- বেশ তো আছেন।
খাচ্ছেন দাচ্ছেন সোফায় বসে পা নাচাচ্ছেন। কে ভিক্ষে করছে, কে রিক্সা টানছে, কে
চোলাই বেচছে, কে চোলাই খাচ্ছে তাতে
আপনার কি এলো-গেল। আপনি ভাল গাড়ি চড়ুন, অন-লাইনে
ভাল খাবার এনে খান। ছেলে-মেয়েদের ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ান। সন্ধ্যের পর বাড়ি ফিরে
দার্জিলিং ফ্লেবারের চা খান। টিভি দেখুন। ছাত্র পড়ান। মাল কামান। ব্যাস’।
সুবিরবাবু
প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষ ছিলেন। গাছপালা, পুকুর, ধানক্ষেত দেখেছেন, আর যা দেখেছেন তা হল কঠোর দারিদ্র।
বাবা-মা নিরক্ষর ছিলেন। নিজেদের এক চিলতে ভিটে, তাতে খড়ের ছাউনিতে এক ঘরে গোটা সংসার। নিজেদের জমি-জমা ছিল না।
মা, বাবা পরের জমিতে জন-মজুর খাটতেন।
মহাজনের শোষণ দেখেছেন। দুবেলা খাবার জুটত না। রাতে কুপির আলোতে লেখাপড়া দু’ভায়ের। সুবির লেখাপড়ায় ভাল ছিল বলে
স্কুলে মাইনে লাগতো না। ফুল-ফ্রি। ম্যাট্রিকের পর কলেজ। যেতে হত- দু’ক্রোশ দূরে, সাইকেলে। ফিরে টিউশনি। স্ট্রাগেল। সেখান থেকে ইউনিভার্সিটি, কলকাতা। চেনা নেই-জানা নেই। সামান্য
পুঁজি নিয়ে ঈশ্বর ভরসায় চলে এলেন মহানগরী কলকাতায়। উঠলেন মদন মিস্ত্রি লেনের ঘুপচি
এক মেস বাড়িতে। অল্প পয়সায়। হেটে যেতেন-আসতেন ইউনিভার্সিটিতে। ধীরে ধীরে জুটে গেল
কয়েকটা টিউশনি। বাড়ি-বাড়ি ঘুরে পড়ানো। কোন মতে দু’বেলা আহার জুটে যেত। ইউনিভার্সিটি থেকে পাশ করার পর ছোট-খাটো
চাকরি জুটে যেতে লাগলো। পরে ছাত্রীর বাবার কল্যানে কলেজে পড়ানোর চাকরিটা পেয়ে
গেলেন।
তার
ভাই ম্যাট্রিকের পর আর এগোতে পারে নি। গ্রামেই গোলদাড়ি দোকান দিয়ে বসলো। গ্রামে
বেচাকেনা কম। যাও হয়- ধারবাকি। আদায় হয় না। মার যায় টাকা। তবু চলতে লাগলো খুড়িয়ে
খুড়িয়ে। চাকরি জুটলো না।
সুবিরবাবু
গ্রামে ফেরেন নি। বাবা-মায়ের খবর নিতেন না, সব সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়েছেন, কেবল দু’একটা চিঠির জবাব
ছাড়া। তার ভাই তিনবার এসেছিল দাদার সাথে দেখা করতে। ক্রমান্বয়ে তার বাবা ও মায়ের
মৃত্যুকালীন চিকিৎসার জন্য কিছু সাহায্য। শূন্য হাতে ফিরতে হয়েছে। তবে শ্রদ্ধ-শান্তির
সময় গিয়েছিলেন সুবির বাবু। গ্রামের লোকেরা তাকে দূর থেকে দেখেছে। সমীহ করতো। এই
গন্ডগ্রামের ছেলে কলকাতার অত বড় কলেজে পড়ায়। ভেরি গুড বয়।
আর
একবার তার ভাই এসেছিল। সন্তান প্রসবের সময় ভাইয়ের স্ত্রী মারা যায়। গ্রামের এক
গরীব মহিলা তাকে স্তন দিয়ে বাঁচিয়ে তোলার দায়িত্ব নিতে রাজি হয়। কিন্তু বিনিময়ে
মাসোহারা টাকা দিতে হবে। এদিকে তার ব্যবসা মন্দ। মাস-মাস টাকা দেওয়া তার পক্ষে
সম্ভব নয়। দাদা যদি কিছু সাহায্য করে। কিন্তু এসব ঘটনা বরেনকে টলাতে পারে নি। সাফ
জবাব দিয়ে দিয়েছে।
কলেজে
চাকরির পর মেসবাড়ি থেকে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে চলে গেলেন কালীঘাটের কাছে এক-কামরা
ফ্ল্যাটে। হিসেব কষে প্রেম করলেন ঐ কলেজেরই এক শিক্ষিকার সঙ্গে। বিয়ের পর দু’জনের রোজগারে ফুলে ফেপে উঠলো ব্যাঙ্ক
ব্যালান্স। তারপর ছাত্র পড়ানো তো ছিলই। শ্বশুরবাড়ির কাছাকাছি একটা ফ্ল্যাট কিনলেন
ব্যাঙ্ক লোন নিয়ে। তার স্ত্রী স্বামীর গ্রামের বাড়ি যান নি কখনো। গল্প শুনে তার
ইচ্ছে হয়নি দেখার।
যে
সুবিরবাবু হতদরিদ্র বাবা-মাকে সাহায্য তো দূরের কথা দেখতে পর্যন্ত যান নি। নিজের
পরিবার ও শ্বশুরবাড়ি ছাড়া পাড়া-পড়শীর বিপদে আপদে পাশে দাড়াননি কখনো, তার কিনা আজ এক বালিকাকে ভিক্ষা করতে
দেখে মন কেঁদে উঠেছে! ভিক্ষুক মেয়েটির হাতে দশ টাকার একটি নোট দিয়ে বলেছে ‘আর কখনো ভিক্ষে করবি না। স্কুলে গিয়ে
পড়াশুনো কর’। ব্যপারটা
আমার কাছে বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হল।
আমি
লোক চড়িয়ে খাই, লোক চিনি। স্বার্থপর
সুবিরবাবুকে তো হাড়ে হাড়ে চিনি। দান-ধ্যান তার ধাতে নেই। শুধু টাকা কামাবার গল্প
শুনি। স্ত্রীর সুউচ্চ প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ধনী পিতার একমাত্র মেয়ে। শ্বশুরবাড়িতে
বিঘত পূরু মাখামাখি। শ্বশুর-শ্বাশুড়ি চোখ বুজলেই কেল্লা-ফতে, কয়েক কোটি টাকার সম্পত্ত্বি হস্তগত
করবেন। টাকার হিসেব ছাড়া তার চরিত্রে আর সব শূন্য।
আমি
একটু উস্কে দিয়ে বললাম ‘মেয়েটাকে পুষ্যি নিয়ে
নিন না। বাড়িতে থাকবে। মেয়ের মত। আপনার ছেলে-মেয়েদের সাথে পড়াশুনো করে বড় হবে।
একটা মহৎ কাজ হবে’।
আমাকে
থামিয়ে নিয়ে দিয়ে বললেন ‘আপনি কি যে বলেন
কালীবাবু, আমি তো ভাবছিলাম বাড়ি
নিয়ে রাখব, ফাই-ফরমাস খাটবে।
মেয়েটা হয়তো অনাথ হবে। কয়েকদিন ধরে স্ত্রী মাঝে মাঝে বলছে ‘আর পারছি না, এবার শুধু ঠিকে ঝি দিয়ে চলছে না- একজন সর্বক্ষণের কাজের মেয়ে
দেখ’। তাই ভাবলাম যদি
কনভিন্স করাতে পারি’।
আমার
হিসেব মিলে গেল। সেই বলো একটা বিনি পয়সায় কাজের মেয়ে যদি পাওয়া যায় তার ছক। বললাম ‘সেই বলুন, আমি ভাবলাম আপনার তো দয়ার শরীর----।
সুবিরবাবু
বললেন ‘দূর মশাই, পুষ্যি নিতে যাব কোন দুঃখে। আমার ছেলে-মেয়ে কি কম পরেছে?
আমি
বললাম ‘একেবারে ধরে নিয়ে বাড়ি এলেই পারতেন’।
সুবিরবাবু
বললেন ‘সেই চেষ্টাই তো করছিলাম। দশ টাকা দিয়ে
লোভ দেখালাম। যদি আমার সাথে ভেড়াতে পারি। কি বলব মশাই হাঠাৎ দেখি আমার পিছনে এক
কুৎসিত মহিলা এসে হেড়ে গলায় সেই বালিকাকে বলল ‘কত দিয়েছে রে’?
মেয়েটা
নোটটা দেখালো। তারপর সরল ভাবে বললো ‘আমাকে
ইস্কুলে পড়তে বললো’। ওই
মহিলা হেড়ে গলায় আমাকে বললো ‘পড়ে কি হবে দাদা, মেয়েকে দেখে অনেক বাবুরই মায়া হয়। দিনে
ধরুন শ’দেড়েক রোজগার হয়। ইস্কুলে গেলে এই
টাকাটা কি আপনি দেবেন? পেট চলবে কি করে?’
সুবিরবাবু
বলে চলেছেন ‘কি বলব মশাই ঐ
মহিলাকে দেখে আর তার গলার স্বর শুনে তো আমি ভয় পেয়ে গেলাম’।
আমি
ফোড়ণ কাটলাম ‘সত্যিই তো আপনি
প্রতিদিন দেড়শো টাকা খামোকা দিতে যাবেন কেন?
সুবিরবাবু
বললেন ‘আপনিই বলুন কি অন্যায় আবদার। আবার বলে
কিনা মাসে পাঁচ হাজার দিন- মেয়েটার পেটও চলবে পড়াশুনোও চলবে। আর যদি মেয়েকে কিনতে
চান, সেও দিতে পারি। একেবারে ব্যাবসাদারের মত
বললো ‘দশ লাখ দিয়ে নিয়ে যান। তবে হ্যা বাড়িতে
নিয়ে গিয়ে ঝিয়ের কাজ করানো চলবে না। লেখাপড়া শেখাতে হবে’।
আমি
বললাম ‘মামা বাড়ির আবদার নাকি’?
সুবিরবাবু
বললেন ‘আমি তো এইসব কথা শুনে তখন পালাই পালাই।
কিন্তু ঐ বাজখাই মহিলা কিছুতেই ছাড়ে না।
রেটটা একটু কম-সম করে দেব। মেয়েকে হেকে বললো ‘উঠে পর, এই বাবুর সাথে চলে
যা। চলুন আমিও যাই আপনার সাথে –
বাড়িটা
চিনে আসি। টাকাটা কবে নাগাদ দিতে পারবেন? মেয়েটা
একটা চটের উপর বসেছিল। মায়ের কথা শুনে উঠে দাঁড়িয়ে চট গুটিয়ে বগলে নিল। মেয়েটা সরল
মনে বলল ‘বাবুকে কি বলে ডাকবো? আমার তো বাবা নেই, বাবা বলেই ডাকবো’।
আমি
সুবিরবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে হো হো করে হেসে উঠলাম। তার মুখ শুকিয়ে পাঙ্গশু। বললাম ‘শেষমেষ কত টাকায় রফা হল’?
সুবিরবাবু
বললেন ‘ আরে মশাই দান করতে গিয়ে যে এ ভাবে ফেসে
যাব কে জানতো। তখন ভেগে পরতে পারলে বাঁচি। মহিলাকে বলালাম ‘আমি ভেবে দেখি। অত টাকাতো আমার কাছে নেই, এখন যাই। মহিলা বললো ‘এক সঙ্গে টাকা দিতে হবে না, মামা-মাসে এক লাখ করে দিলেই চলবে। আপনি
খুব দানী লোক, আমার এত বড় উপকার
করলেন’। আমি কথা না বাড়িয়ে
বাড়ির দিকে পা বাড়ালাম। ওরাও আমার পিছে পিছে আসতে লাগলো। শেষে আমি বিরক্ত হয়ে
বললুম ‘এখন যাও তোমরা। আমি তোমাদের কোন টাকা
দেব না। তোমার মেয়েকে তুমি যা ইচ্ছে কর’। মহিলা এবার নিজের মূর্ত্তি ধারণ করলো। চেচামেচি করে লোক জড়ো
করে ফেললো, গালিগালাজ করতে লাগলো
‘শালা, পকেটে পয়সা নেই আমার মেয়েকে কিনতে এসেছে। ঢ্যামনা কোথাকার’। লোকজন জড়ো হয়ে মহিলার
দলে যোগ দিল ‘বলেন কি! এই কলকাতার
বুকে শিশু বিক্রি? জনতা তেড়ে এলো আমার
দিকে। আমি ভয় পেয়ে থরথর করে কাঁপছি। হাত জোড় করে সবাইকে বোঝাবার চেষ্টা করলাম।
কিন্তু কে শোনে কার কথা’।
আমি
বললাম ‘বলেন কি মশাই! শিশু কেনা-বেচার কেস!
পুলিশে ধরলে তো আঠারো ঘা’। তারপর
কমসে-কম সাত বছর জেলের ঘানি। সঙ্গে যদি একটু সেক্স জুড়ে দেয় তবে তো সোনায় সোহাগা।
যাবজ্জীবন’। সুবিরবাবু
খুব উত্তেজিত। বললেন ভীড়ে মধ্যে থেকে এক ডাকাবুকো ছোকরা এসে আমার কলার ধরে শাসালো ‘পুলিশ ডাকবো? শালা কেলিয়ে খাল খিচে নেব’। ওই কুৎসিত মহিলা লাগাতর গালাগাল দিয়ে
চলেছে, সে ভাষা উচ্চারণ করার মত নয়। এবার টাকার
ডিমান্ড করে বসলো। ‘আমার অনেক ক্ষতি করে
দিয়েছে। এক্ষুনি পাঁচ হাজার টাকা না দিলে ছাড়বো না ব্যটাকে’। পাবলিক সঙ্গে সঙ্গে
সায় দিয়ে বললো ‘ছাড়ুন মশাই পাঁচ
হাজার, নইলে ধোলাই। গরীব মানুষকে টাকার লোভ
দেখিয়ে শিশু কেনবার মতলব বার করে দেব’।
আমি
হাত জোড় করে সবার কাছে ক্ষমা চাইলাম ‘আমার
ঘাট হয়েছে। এবার আমাকে ছেড়ে দিন। বাড়ি যাব’। এক ক্রিমিনাল টাইপের লোক (ওই দলেরও হতে
পারে) আমাকে শাসিয়ে বললো ‘মাল ছাড় আগে, তবে ছাড়বো’। আমি বললাম ‘এত টাকা এখন আমার কাছে নেই, দেখছি কত আছে। এই বলে পকেট থেকে মানি ব্যাগ হাতড়ে হাজার দুয়েক
পেলাম। সেটা মহিলার হাতে দিয়ে হাত জোড় করে বললাম ‘এবার আমাকে ছেড়ে দিন’। খপ করে আমার হাত থেকে টাকাটা নিয়ে নিল। ফোকোটিয়ায় দু হাজার
হাতে পেয়ে মহিলা একটু নরম হল। বললো ‘যা, এবারের মত ছেড়ে দিলাম’। ‘দেখলাম আস্তে আস্তে ভীড় পাতলা হয়ে গেল।
বিদ্ধস্ত আমি মাথা নীচু করে বাড়ির দিকে হাটা দিলাম’।
উদয় চক্রবর্ত্তী:কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন