বিভ্রাটের সাথে বেনারস উপভোগ


 
ভ্রমণকাহিনী
                             
আজ ত্রয়োদশীদুর্গাপুজোর রেশ এখনও কাটেনি,তার মধ্যে বেনারস ঘুরতে যাচ্ছি। তাই সকাল থেকে খুব ব্যস্ত,বাড়ির কাজ তো আছেই তার উপর সকলের গোছগাছ করা,যাত্রা পথে প্রয়োজনীয় খাবার তৈরী ...এমন সব নানান কাজ। আমরা চারজন,ছেলে,মা আর আমরা দুই স্বামীস্ত্রী,দুর্গাপুর থেকেই ট্রেন,সময়মত রেডী হয়ে যথাসময়ে আমরা ট্রেনে বসলাম,তখন রাত প্রায় দশ'টা। সকলে খাওয়া সেরে যে যার সিটে শুয়ে পড়লাম। ট্রেন যেই বিহার ঢুকলো প্রথম ‘বিভ্রাট (বিপদ)’ গুটি গুটি পায়ে আগত। দেখি কিছু কিছু মানুষ আমদের কামড়াতে উঠে আমাদেরই সিটে বসতে লাগলো প্রথমটা বুঝলাম না কি হলো! তারপর জানলাম বিহার,ইউপি'তে না'কি এমন হওয়াটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। জেনারেল কামড়ার টিকিট কেটে দিব্যি সব স্লিপারে চড়ে যায়। বিহারীদের আজ একটা বিশেষ পুজো আছে তাই আজকের ভীড়  আরও বেশী। টিটি পর্যন্ত তাদের কিছু বলে না। আর বলবেই বা কে? টিটির'তো টিকি পর্যন্ত দেখতে পেলাম না। সকাল হতে হতে আমি ছাড়া আমার সিটে আরও দু'জন বসে,উঠতে বললে পাত্তাই দিচ্ছে নাখুব রাগ হলো,শুধু তাই নয় নীচে চাদর পেতে অনেকে বসে,কিছু বললেই বলছে ওদের আজ একটা বিশেষ পুজো আছে,একটু মানিয়ে নিতে। অবাক হলাম এখানে কি কোনও সিস্টেম নাই! ঢের হয়েছে,এই লাইনে ট্রেনে যেতে হলে আর জীবনে স্লিপারে আসবো না। নিজের সিটে নিজে হাত পা ছড়িয়ে শুতে বসতেও পারব না! এর থেকে বেশী ভাড়া দিয়ে বরং থ্রি টায়ার কামড়া নিলে অনেক ভালো হতোহুটহাট করে এভাবে যে কেউ উঠতে'ত পারবে না। কি বলবো! খুব কষ্ট করেই পৌঁছালাম বারাণসী তখন প্রায় বেলা বারোটা। ষ্টেশনে নামতেই অটোচালকরা ঘিরে ধরলো। একটা অটোতে উঠলাম,এখানকার রাস্তা ভীষণ জ্যাম। প্রায় চল্লিশ মিনিট চলার পর আমদের নিয়ে গেলো হরিশচন্দ্র ঘাটের এক ঝাঁ-চকচকে হোটেলে,সেখানেই আমরা উঠলাম। বেশ বেলা হয়েছে আর এখানে ভীষণ রোদ-গরম,অক্টোবর মাস অথচ মে জুন মাসের মতো গরম লাগছে। শীতকাল এখানে ভ্রমণের জন্য সঠিক সময়। ট্রেনের ক্লান্তি আর রোদে গরমে যা কষ্ট পেয়েছি! হোটেলে সবাই ফ্রেশ হয়ে খেয়েদেয়ে এ.সি. চালিয়ে গভীর ঘুমের রাজ্যে পাড়ি দিলাম...

আজ প্রথম দিন,বিকেলে হোটেলের ছেলেটা আমদের গঙ্গাঘাটে পৌঁছে দিলো,হোটেল থেকে মিনিট পাঁচেকের রাস্তা। গঙ্গাতীরের প্রায় শতাধিক ঘাট এখানকার বিশেষ আকর্ষণ। গঙ্গার ঘাটের ধারে রয়েছে মন্দির,হাভেলিরাজপ্রাসাদ ও সাধুসন্তদের আশ্রম। দেখলামসবাই নৌকা করে গঙ্গাঘাট বিহার করছে।আধুনিক মটর যন্ত্রে চালিত নৌকামাথা পিছু আড়াই'  টাকা করে ভাড়া,এক একটাতে পঁচিশ ত্রিশ জন করে চাপাচ্ছে। আমরাও সেই রকম একটা নৌকাতে চাপলামগঙ্গাতে নৌকা করে ঘোরাতার উপর ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা গঙ্গার হাওয়া মনটা বেশ উৎফুল্ল বোধ করছিএই নৌকাতে একজন গাইড আছেন যিনি হিন্দি ভাষায় প্রতি ঘাট সম্বন্ধে আমাদের নানান তথ্য দিচ্ছেন। প্রথমে দেখলাম হরিশচন্দ্র ঘাট-এখানে মৃত মানুষদের শবদাহ করা হয়সবাই বিশ্বাস করে এখানে শেষকৃত্য সম্পন্ন হলে সে সোজা স্বর্গ ধামে যাত্রা করে,বারবার মানব জন্ম গ্রহণ করতে হয় না। নারদ ঘাট,এই ঘাটে কেউ স্নান করে না,কথিত আছে এখানে স্বামী-স্ত্রী একসাথে স্নান করলে তাদের না'কি বিচ্ছেদ অনিবার্য। অহল্যা বাঈ ঘাট,রাজা মানসিংহের ভৃত্য  তার মা রত্না বাঈ কে এই মন্দির নির্মান করে উপহার দিয়ে বলেছিলেন যে সে মায়ের ঋণ শোধ করলো। ছেলের এই অহংকারে মা মনে খুব দুঃখ পায় তার ফলে ওই মন্দিরের চূড়া না'কি কাত হয়ে হেলে গেছে। আশ্চর্য সত্যিই আজও সেই চূড়া ওইভাবেই কাত হয়ে আছে

মণিকর্ণিকা ঘাট,এইখানে মা দুর্গার কর্ণফুল পরে যায় তখন তা খুঁজে ফিরিয়ে আনার ভার পরে মহাদেবের উপর। তাই এই ঘাটের নাম মণিকর্ণিকা ঘাট। এখানে টিলা করে করে প্রচুর কাঠ সাজানো আছে,মৃতদেহ সৎকার করার উদ্দেশ্যে। এখানে সৎকার করলে তার মোক্ষ লাভ হয়প্রায় সবসময় এখানে চিতা জ্বলছেঅসী ঘাট,পৌরাণিক কালে মা দুর্গা যুদ্ধে জয়লাভ করার পর এইখানে বিশ্রাম করেন ও ফেরার সময় তার অস্ত্র ফেলে যানসেই অস্ত্র মাটিতে পরে সৃষ্টি হয় অসী নদী,এই অসী নদী আর গঙ্গা নদীর মিলন স্থান হলো অসী ঘাট

দশাশ্বমেধ ঘাট সব থেকে বিখ্যাত ও প্রাচীনঘাট। দশাশ্বমেধ কথার অর্থ দশটা ঘোড়ার বলিদান। কিংবদন্তি অনুসারে স্বয়ং ব্রহ্মা নির্বাসিত শিবকে ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে দশাশ্বমেধ যজ্ঞ করেন তাই এই জায়গার নাম দশাশ্বমেধ ঘাট। এই ঘাটের সন্ধ্যা আরতি সব থেকে আকর্ষণীয়,মাইকে গঙ্গাস্তোত্র পাঠপাঁচ পুরোহিত পিতলের বড় বড় প্রদীপ ঘুরিয়ে একযোগে শঙ্খধ্বনিতে আরতি করেন। নৌকো থেকে ঘাটের সিঁড়ি,মন্দিরের চাতাল,সর্বত্র লোকে লোকারণ্যঝলসাচ্ছে মোবাইল-ক্যামেরার ফ্ল্যাশ মুহুর্মুহু। সন্ধ্যার এই গঙ্গা-আরতি বারাণসীর নতুন রিচুয়াল। এক পবিত্র সুখকর দৃশ্য। চন্দনের সুগন্ধে আমদের মন ভক্তি ও শ্রদ্ধায় ভরে গেলো তুলসী ঘাট,এই ঘাটে সূর্য মন্দির আছে। সকলের বিশ্বাস সন্তানহীন মহিলারা এই ঘাটে স্নান করে পুজো করলে তাদের সন্তান প্রাপ্তি হয়। তুলসী দাসের নাম অনুসারে এই ঘাটের নাম হয়

প্রয়াগ ঘাট,মারাঠি সম্রাট বালাজী বাজিরাও এই ঘাট নির্মান করেনএছাড়া আরও কয়েকটি ঘাট দর্শন করলাম কর্ণাটক ঘাট,বিজয়নগর ঘাট,কেদারা ঘাট,মানস সরোবর ঘাটদ্বারভাঙা ঘাট ইত্যাদিআমরা এতটাই আনন্দে বিভোর ছিলাম যে খেয়াল করিনি ‘বিভ্রাট মহাশয়' এক নতুন বিপত্তি নিয়ে আবার আমদের সামনে দণ্ডায়মান। নৌকা আমদের হরিশচন্দ্র ঘাট থেকে তুললেও নামিয়েছে দশাশ্বমেধ ঘাটে। ঘাট গুলো আলোতে জ্বল জ্বল করছে,তারউপর বিশেষ করে এই ঘাটে বসে রকমারি দোকান। দোকানে টুকিটাকি কেনা,পেট পুরে খাওয়া...এসবে এতটাই মশগুল ছিলাম যে সেটা কেউ খেয়ালই করিনি .. । অনেক পরে খেয়াল করলাম,হরিশচন্দ্র ঘাটের বদলে আমদের দশাশ্বমেধ ঘাটে নামিয়ে দিয়েছে। এদিকে তখন লোকজন অনেক কমে গেছে। বেশ রাত হয়েছে, প্রায় ন’টা। তারউপর কোনও অটো পেলাম না, ফেরার উপায়...! খুব ভয় পেয়ে গেলাম অজানা জায়গা,রাত বাড়ছে.... । শেষে আমার মাথায় এক বুদ্ধি এলো,আমি দেখেছিলাম নৌকা বিভিন্ন ঘাট হয়ে সোজা এই ঘাটে এসেছিলো,তাই ঠিক করলাম যদি নদীর তীরের ঘাট গুলোর ধার দিয়ে সোজা হাঁটতে থাকি তবে'ত ঠিক আবার সেই ঘাটে পৌঁছে যেতে পারবযেমন ভাবা তেমনি কাজ। সবাই মিলে হাঁটতে শুরু করলাম...একটা ঘাট আর একটা ঘাটের সাথে যুক্ত,প্রতি ঘাট সিমেন্ট দিয়ে সুন্দর করে বাঁধানো,ঝলমলে আলো,লোকজন খুব সীমিতগঙ্গার ধার দিয়ে হেঁটে চলা যেন গঙ্গার হাত ধরে একসাথে চলেছি...,দুচোখ ভরে দেখছি তার জ্যোৎস্নাতে উপচে পড়া রূপ। শীতল হাওয়ার খুনসুটি ....খুব ভালো লাগছিল...এক অনন্য অনুভূতি ...॥ এমন উপভোগ বা কয়জন পাই ?..বেশ কিছুটা যাবার পর দেখি ওখানকার এক ঝালমুড়িওয়ালা একই রাস্তা ধরে ঝালমুড়ি বিক্রি করতে করতে যাচ্ছে। তার কাছে ঝালমুড়ি নিলাম,কথা বলে জানতে পারলাম সেও হরিশচন্দ্র ঘাটে যাচ্ছে আর এটাই ওখানে যাবার শর্টকাট রাস্তা। নিশ্চিত হলাম আমরা ঠিক রাস্তাই আছিএবার আমরা তাকে অনুসরণ করে হাঁটতে লাগলাম...পৌঁছে গেলাম হরিশচন্দ্র ঘাট। এখানে এতো গলি গলি রাস্তা... যেন গোলকধাঁধাঁ...! ঘাট থেকে হোটেল যাবো কি! রাস্তাই ঠিক করতে পারছি না! শেষে কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করে কিছুক্ষণের মধ্যে হোটেল পৌঁছালাম তখন রাত প্রায় দশটা...... ।


দ্বিতীয় দিনএকটা প্রাইভেট গাড়ি ভাড়া করে খুব সকালেই ঐতিহাসিক বেনারস শহর দেখতে বেড়ালাম ...। পুরো শহরটা দেখতে প্রায় একটা দিন লেগে যায় ...। প্রথমে গেলাম সারনাথ স্তূপএক পবিত্র ঐতিহাসিক জায়গা,বুদ্ধদেব সিদ্ধিলাভ করার পর প্রথম এখানেই তাঁর পাঁচজন শিষ্যকে উপদেশ দেন,তারপর তিনি গোটা বিশ্ব ভ্রমণ করেনজায়গাটা খুব সুন্দর করে সাজানোবড় বড় স্ট্যাচুর মাধ্যমে দেখানো হয়েছে বুদ্ধদেব তাঁর পাঁচ শিষ্যকে উপদেশ দিচ্ছেন। বিরাট ভব্য মন্দিরের ভিতরে বুদ্ধদেব জ্ঞান মুদ্রাতে বিশাল স্বর্ণজ্জ্বল সৌম্য মূর্তি,মন্দিরের নিস্তব্ধতা জায়গাটাকে আরও পবিত্র করে তুলেছে। সুন্দর এই  জায়গাটার পরিদর্শনে মন আনন্দে আপ্লুত ...। এখানকার সংগ্রহালয়ে সেই যুগের বিভিন্ন বস্তুর সাথে কুষাণ যুগ,গুপ্ত যুগের অনেক জিনিস পরম যত্নে রাখা আছেরামনগর কেল্লা,লাল বেলে পাথরে তৈরী বিশাল বড় কেল্লা,কেল্লার সামনে উঠানে রঙ করা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন দুটো বিরাট কামান রাখা আছে। কেল্লার ভিতরে সেই যুগের স্বর্ণরৌপ্য খচিত রাজপাল্কি,সোনা রূপোর জরি দিয়ে তৈরী রাজ পোষাক,সেই যুগের বেশকিছু গাড়ি,বিভিন্ন ধরণের তলোয়ার যার বাঁটে সোনা রুপোর সূক্ষ কাজ,পুরোনো দিনের বন্দুক,হাতির দাঁতের সূক্ষ কাজ করা দুর্লভ চোখ ধাঁধানো বিভিন্ন বস্তু দেখলাম। আর একটা খুব সুন্দর জিনিস দেখলাম  ..... । দুর্গা মন্দির, আঠারো দশকে এক বাঙালী রানী এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন, কথিত আছে মা দুর্গা স্বয়ং এখানে প্রকটিত হয়। পাশেই একটা বর্গাকার কুয়ো আছে যা দুর্গা কুণ্ড নামে পরিচিত । নবরাত্রিতে এখানে বিরাট উৎসব হয় ।

তুলসী মানস মন্দির,আধুনিক যুগের এই মন্দির শান্তির প্রতীক। শ্বেত পাথর দিয়ে তৈরী,দেওয়াল জুড়ে রামচরিত মানসের লেখা পঙক্তি মুগ্ধ করে সকলকেমন্দিরে রাম,লক্ষণসীতা মাতার মুর্তির  সাথে হনুমানজীমহাদেবমা অন্নপূর্ণাতুলসী দাস সকলে বিরাজিত। এখানে বসে তুলসী দাস তার বিখ্যাত রচনা রাম চরিত মানস রচনা করেন দেখলাম বিখ্যাত বিশ্ব হিন্দু বিশ্ববিদ্যায়। ভারত কলা মন্দির,হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাঙ্গণে অবস্থিত এক বিশাল চিত্রশালা। তারপত্র,কাপড়,কাগজ,হাতির দাঁত দিয়ে বারো'শ থেকে বিংশ শতকের বিভিন্ন লৌহ চিত্র প্রদর্শিত। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানে অধ্যক্ষ ছিলেন। সংকটমোচন হনুমান মন্দিরএই মন্দির খুব জাগ্রত। সবাই বিশ্বাস করে এই মন্দিরে হনুমানজীর দর্শনে সমস্ত রকম বাধাবিঘ্ন দূর হয় । 

ভারত মাতা মন্দির,১৯১৮সালে যখন ইংরেজদের তাড়াতে ভারতবাসী দৃঢ় সংকল্প তখন বিপ্লবীরা এই মন্দির নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। সুপ্রসাদ গুপ্ত এই মন্দির নির্মান করেন। এখানে ভারতমাতার ছবির সাথে আছে ভারতবর্ষের বিরাট মানচিত্র। উত্তর থেকে দক্ষিণ,পূর্ব থেকে পশ্চিম,সাগর, মহাসাগর, পাহাড়, পর্বত, বরফে ঢাকা পাহাড়চূড়া সব খুব সুন্দর ভাবে সাজিয়ে বানানো হয়েছে এই মানচিত্রসত্যিই অবিভূত...। দেশমাতার গর্বে মনটা গদগদ হয়ে উঠল, মনে মনে বললাম ভারত মাতার জয়...। কিছু জার্মান এই মন্দির দর্শনে এসেছে,তাদের সাথে কিছু সেলফি তুললাম। ওরাও আমাদের ক্যামেরা বন্দী করলো

হোটেল ফিরতে ফিরতে দুপুর গড়িয়ে গেলো বিকেলে কাশির গলি গুলো ঘুরে ঘুরে দেখলাম,কতো গলি এমন গলি আর কোথাও আছে বলে জানিনা,সব একরকম দেখতেযেন গোলকধাঁধা। সন্ধায় আবার আরতি দেখতে গেলাম,তবে এবারে আর কোনো ভুল হয়নিসুন্দর ভাবে দর্শন করে হোটেল ফিরলাম ।

তৃতীয় দিন..., আজ বিশ্বনাথ মন্দির যাত্রামন্দিরের ১৫.৫ মিটার উচুঁ চূড়াটি সোনায় মোড়া। বিশ্বে বারো জ্যোতিলিঙ্গের মধ্যে ইহা একটি,যার দর্শন মাত্র সব পাপ থেকে মোক্ষ লাভ করা যায়আজ সকালে বাবা বিশ্বনাথের এই বিখ্যাত মন্দিরে পুজো দিতে যাব। ট্রেনে একজন বলে দিয়েছিলো,হোটেলের কোনও লোকের সঙ্গে যাবেন না, তাদের ঠিক করা ব্রাহ্মণ দিয়ে পুজো না করিয়ে দেখবেন মন্দিরের অফিস আছে,সেখানে কুপন কেটে ওদের ব্রাহ্মণ দিয়ে শিবের রুদ্র অভিষেক করাবেন খুব ভালো লাগবে। কপালে আছে,’বিভ্রাটের উপদ্রব' খণ্ডন করবো উপায় কি! হোটেলের একজন আমাদের বললো আমার সাথে চলুন সুন্দর করে পুজো দিয়ে আসবেন,না বলা সত্ত্বেও একরকম জোর করে আমদের মন্দির নিয়ে গেলো। ওনার ঠিক করা ব্রাহ্মণ দু'শ টাকা নিয়ে কিছু ফুল ফল দুধ দিয়ে লাইনে দাঁড় করিয়ে দিলো,ভক্তিভরে পুজো করলাম। কিন্তু রুদ্রাভিষেক হলোনা, ওই ব্রাহ্মণ বললোএই পুজোতে অনেক জিনিস লাগে ওসব আপনারা আনতে পারবেন না। মনটা একটু খুঁত খুঁত করতে লাগলো। মন্দির থেকে বেরিয়ে যাবার রাস্তায় হটাৎ চোখে পড়লো মন্দিরের অফিস! খুশীতে মনটা ভরে গেলো,সেখানে গিয়ে জানতে পারলাম ওখানে পাঁচশ টাকার কুপন কেটে বাবা বিশ্বনাথের রুদ্র অভিষেক করানো হয়,সব জিনিসের যোগান তারাই করে দেবে। খুশীতে আর ভক্তিতে মন ভরে গেলো। একটা বড় পাত্রে দুধ, আর একটা বড় থালাতে দই,হলুদ, মধু, চন্দন, ঘি আরও প্রায় ষোলো রকমের জিনিস ওরাই সব জোগাড় করে সাজিয়ে হাতে ধাগা বেঁধে মন্ত্র উচ্চারণের মাধ্যমে রুদ্রাভিষেক হলোখুব সুন্দর এই পুজো পদ্ধতিমন শ্রদ্ধা-ভক্তি তৃপ্তিতে পরিপূর্ণ হলোআসলে মন থেকে চেয়েছিলাম বাবার রুদ্রঅভিষেক করতে তাই বাবাই আমার সব ব্যবস্থা করে দিলো। একটা লাভও হলো দুই দুই বার বাবার পুজো ও দর্শন হলো।

এরপর মন্দির থেকে অটো করে খুব কাছাকাছির মধ্যে  বেশ কিছু মন্দির ঘুরে ঘুরে দেখলাম। তার মধ্যে তীলেশ্বর মন্দির বেশ অবাক করলো। বিশাল মোটা বড় শিবলিঙ্গ,দুই হাতে জড়িয়ে ধরা যাবে নালম্বাতে প্রায় আমার বুক পর্যন্ত। বহু যুগ আগে আপনাআপনি মাটি ভেদ করে বেরিয়ে আসে এই লিঙ্গ,তারপর থেকে প্রতিদিন এক তিল করে বৃদ্ধি পেতো। লম্বা ও চওড়া দুইদিকে ধীরে ধীরে বিশাল আকার ধারণ করছিল,তাই দেখে তখনকার রাজা হাত জোড় করে তীলেশ্বর বাবার কাছে প্রার্থনা করেছিলেন  ‘প্রতিদিন এক তিল করে বাবা যেন বর্ধিত না হন, তা'না হলে স্নান করানোলিঙ্গের মাথায় ফুল বেলপাতা দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়বে। 'সেই থেকে বাবার বৃদ্ধি বন্ধ হয়। বাবাকে দুহাতে জড়িয়ে নত মস্তকে ভক্তিভরে প্রণাম করলাম।

চিন্তামণি গণেশ মন্দির,এই মন্দির খুব জাগ্রতসিদ্ধিদাতা গনেশের দর্শনে দূর হয় সকল চিন্তা গেলাম হরিশচন্দ্র শশ্মান ঘাট ঘুরে দেখতে। আমদের হোটেলের খুব কাছে। এখানে রাজা হরিশচন্দ্রের মা তারামতীর মন্দিররহতাশ্ব মন্দির ও এক শিব মন্দিরও আছে। এখানে শব দাহ হচ্ছে প্রায় সবসময়। ইলেকট্রিক চুল্লি আছে কিন্তু ব্যবহার তেমন হয় না। বেশ কিছুক্ষণ সময় এখানে কাটালাম। এখানকার একটা ঘটনা দেখে অবাক হলাম,এক বৃদ্ধের মৃত দেহ পাথরে বেঁধে মাঝ গঙ্গাতে নিয়ে গিয়ে সলিলসমাধি দেওয়া হলোবর্তমানে গঙ্গা দূষণ ক্রমশ বাড়ছে এখানকার মানুষ যদি এমন অসচেতন ও নির্বিকার হয় তবে গঙ্গাকে দূষণ মুক্ত করা অসম্ভব!

আজ,বাড়ি ফেরার দিনখুব ভালো ভাবে সারাটা দিন কাটলোসব কিছু সুন্দর দর্শন হলো,সন্ধ্যেতে ট্রেন,ভালোই ভালোই পৌঁছাতে চাই। আর বিভ্রাট নয়। স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়লো ছ'টাতে,কিছুটা যাবার পর বুঝলাম সেই ‘বিভ্রাট সর্বনেশে' আমদের সাথে ট্রেনেও উপস্থিত। প্রতি ষ্টেশনের এক দেড় কিলোমিটার আগেই ট্রেন দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে,কখনো আধা ঘন্টা,এক ঘন্টা কখনো আবার তার থেকেও বেশী সময়। জানতে চাইলে বলছে লাইন জ্যাম। উফ অসহ্য ...! তারউপর আমাদের সিটে সেই এক দু'জন করে বসে পড়েছে,মহা বিরক্তি...! তবে আগের বারের তুলনায় এবারে কম ভীড়। দুর্গাপুরে পৌঁছানোর কথা ভোরে আর আমাদের ট্রেন লেট করতে করতে পৌঁছাল সেই সন্ধ্যে সাড়ে ছ'টা ....। বারো ঘন্টা দেরীতে

‘বিভ্রাট বাবু'আমাদের মাঝে মাঝে যা ভুগিয়েছে তা কম ঝঞ্ঝাটের ছিলো না তবুও আমাদের উৎসাহতে এতটুকু ভাঁটা ফেলতে পারেনি। বেনারসের সব জায়গা দারুণ উপভোগ করেছি। ভ্রমণ ও দর্শন দুইই খুব সুন্দর ও মনঃপূত হয়েছে  ....। সবই বাবা বিশ্বনাথের আশীর্বাদ.....।

রমা দত্ত : কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন