প্রতিবেদন
ফেলুদাকে
নিয়ে লিখতে বসলাম। কিন্তু তাঁকে নিয়ে লেখার পরিমাণের তো সত্যিই কোনও লেখাজোখা নেই।
আবার একটা?
প্রদোষ
চন্দ্র মিত্র নামের এই বাঙালি গোয়েন্দাপ্রবর যে তর্কসাপেক্ষে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও
আলোচিত রহস্যসন্ধানী চরিত্র, বিশেষত এর সব বয়েসী পাঠক এবং ফ্যানবেস থাকার জন্য, সেটা তো আর মিথ্যে নয়!
প্রথম প্রকাশের পর ৫০ বছর পেরনো এই মানুষটিকে নিয়ে অসংখ্যবার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়
এবং বইতে লেখা,
বিচার
বিশ্লেষণ হয়েছে,
হচ্ছে।
তাহলে আবার নতুন করে কেন? আসলে ফেলুদা বাংলা সাহিত্যে এমন একটা চরিত্র যাকে নিয়ে
আমাদের চর্চা,
কৌতূহল, ভাবনার শেষ নেই, আক্ষরিক অর্থে তিনি
কালজয়ী এক সৃষ্টি মহান স্রষ্টা সত্যজিৎ রায়ের। মুহূর্তে মনটা ফিরে যায় কৈশোরের সেই
সব দিনের নস্টালজিয়ায়, যখন
একের পর এক টানটান রহস্যে ফেলু মিত্তিরের মগজাস্ত্রের কারসাজি দেখে বুঁদ হয়ে যেতাম
। তাঁর স্রষ্টার বর্ণনার খুঁটিনাটি এতটাই জীবন্ত যে ফেলুদাকে রক্তমাংসের একজন
মানুষ ছাড়া অন্য কিছু মনে হয়নি কখনও।
৬
ফুট ২ ইঞ্চি লম্বা,৪২
ইঞ্চি ছাতির এই সুদর্শন সুঠাম চেহারার প্রখর বুদ্ধিমান বাঙালি পুরুষ যে কোন
স্বপ্নের নায়ককে হার মানাতে পারেন। স্যার আর্থার কোনান ডয়েল রচিত প্রায় মিথের
পর্যায়ে যাওয়া গোয়েন্দা চরিত্র শার্লক হোমসকে মনে মনে গুরু বলে মেনে তাঁর
রহস্যসন্ধানে আগ্রহ। ছোটবেলায় পিতৃ-মাতৃহারা ফেলু কাকা কাকিমার কাছে মানুষ,খুড়তুতো ভাই তপেশ রঞ্জন
[ প্রথম কাহিনী ফেলুদার গোয়েন্দাগিরিতে অবশ্য মাসতুতো ভাই বলা হয়েছিল, সেটাও পরে অন্য একটি
গল্পে তোপসের ভুল বলে রসিকতা করা হয়] তার ছায়াসঙ্গী ও সহকারীও বটে। ফেলুদার সব
কাহিনী তার জবানিতেই লেখা। আমরা বরং তপেশ বা তোপসের কথা থেকেই বিভিন্ন গল্প থেকে
পাওয়া ফেলুদার সম্বন্ধে কিছু আকর্ষণীয় তথ্যের প্রতি আলোকপাত করি, যার সাহায্যে মানুষটাকে
আরেকটু কাছ থেকে চিনে নেওয়া যায়।
ফেলুদার
খাদ্যাভ্যাস, পোশাক, অভ্যাস
ফেলুদা
বাঙালি খাবারের ভক্ত। দুপুরে ভাতের সঙ্গে সোনা মুগের ডাল, দই, পাঁপড় ভাজা, কড়া পাকের সন্দেশ, বর্ষাকালে খিচুড়ি আর
ডিম ভাজা,
স্ন্যাক্সে
ডালমুট চানাচুর,
রাত্রে
রুটি। সাধারণ ছিমছাম আহার পছন্দ। তবে
ফেলুদার গল্পের বিশেষত্ব কোন না কোন নতুন জায়গায় বেড়াতে গিয়ে সেখানে রহস্যে জড়িয়ে
পড়া; তাই সেসব ক্ষেত্রে
স্থানীয় বিশেষ কোন খাবার থাকলে অবশ্যই তা
চেখে দেখতে ছাড়েন না এই গোয়েন্দা প্রবর। একটাই নেশা,সেটা সিগারেট,তাও চারমিনার
ব্র্যান্ডের। এখনকার সময় হলে হয়তো ফেলুদার মত একজন ইউথ আইকনকে চেন স্মোকার হিসেবে
দেখাতে একটু হলেও ভাবতেন সত্যজিৎ রায়। তবে সে সময়টা আলাদা ছিল। নিয়মিত সকালে
যোগাভ্যাস করে ফেলুদা,আগে
অবশ্য এক্সারসাইজ করত প্রত্যহ আধঘণ্টা করে। বাড়িতে থাকলে পাজামা-পাঞ্জাবি পরে
বেশির ভাগ,তবে বাইরে গেলে শার্ট
ট্রাউজারস-ই তাকে বেশি দেখতে অভ্যস্ত আমরা। জিন্সের প্যান্ট পছন্দ করে। ধুতি
পাঞ্জাবিও পরতে দেখা গেছে কখনও সখনও।
জ্ঞান,আগ্রহের অঞ্চল,প্রতিভা
বহু
বিষয়ে আগ্রহ এবং জানার সর্বগ্রাসী ক্ষুধা ফেলুদার চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য যা
তার পেশাতেও কাজে লেগেছে বারবার। গাছ চেনার ব্যপারে যে কোন উদ্ভিদবিদকেও হার
মানাতে পারে,
কুকুরের
জাত নিখুঁত ভাবে চিনে বলতে পারে, বাংলা ইংরেজি দুই ভাষারই টাইপোগ্রাফি মানে হরফের বিষয়ে
অগাধ জ্ঞান,
শুধু তাই
নয় শব্দের ইতিহাস নিয়েও বেশ পড়াশোনা আছে। সঙ্গীতে বিশেষ আগ্রহী, রাগ রাগিনীর সব নাম
মুখস্থ,
স্বরলিপি
অনুযায়ী হারমোনিয়াম ধরে গান গাইতেও দেখা গেছে ফেলুদাকে। খেলাধুলোতেও সমান দড়, ক্রিকেটে বিশ্ববিদ্যালয়
স্তরে সফল,
রাইফেল
শুটিং-এও পুরস্কার বিজয়ী, আর তাস, দাবার মত অন্তত ১০০টা ইনডোর গেমস-এ পারদর্শী। পেন্সিল
স্কেচ করতে পারে ভাল, বিশেষ
করে কাউকে দেখেই পোর্ট্রেট করার বিরল ক্ষমতা আছে ফেলুদার। (সত্যজিৎ রায়ের পোরট্রেট
ও স্কেচ আঁকার অলৌকিক দক্ষতার কথা মনে এল নাকি?) এক সময় ম্যাজিক চর্চা করত বলে
সে ব্যপারেও অনেক জ্ঞান। স্ট্যাম্প জমানোর শখ ও ছিল কম বয়েসে। তবে এতকিছুর পরেও
কোন তথ্য বা বিষয়ে কিছু অজানা থাকলে ফেলুদার মুস্কিল আসান হলেন সিধুজ্যেঠা।
তৎকালীন চলমান উইকিপিডিয়া। তিনিও অতি প্রখর মস্তিষ্কের মানুষ, তবে নিজে সমস্যার
সমাধান করার বদলে প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্রটিকে সাহায্য করাতেই বেশি আগ্রহী ছিলেন
বরাবর।
সিনেমায়,বেতারে,কমিক্সে,অনুবাদে
ফেলুদার
গল্পগুলোর মধ্যে এমন নাটকীয়তা আছে যে তাকে নিয়ে কমিকস,বেতার নাটক বা চলচ্চিত্র হওয়াটা
খুবই স্বাভাবিক। সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় সোনার কেল্লা ছিল প্রথম ছবি যাতে ফেলুদার
পরবর্তী প্রায় সব অভিযানের অন্যতম সঙ্গী রহস্য রোমাঞ্চ লেখক লালমোহন গাঙ্গুলী ওরফে
জটায়ুর আবির্ভাব।তারপর জয় বাবা ফেলুনাথ সত্যজিতের পরিচালনায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
অভিনীত ফেলুদার দ্বিতীয় ছবি। পরে হিন্দিতে দূরদর্শনের জন্য টেলি সিরিজ হিসেবে
সত্যজিৎ পুত্র সন্দীপ রায় যত কাণ্ড
কাঠমান্ডুতে অবলম্বনে হিন্দিতে বানান কিসসা কাঠমান্ডু কা, তাতে ফেলুদার চরিত্রে অভিনয়
করেন শশী কাপুর। তারও পরে সন্দীপবাবু
বাংলা টেলিভিশন ও বড় পর্দার জন্য বেশ কিছু ফেলুদা গল্পের চিত্রনাট্যরূপ দেন এবং
এখনও সেগুলি উপহার দিয়ে যাচ্ছেন ফেলুদাপ্রেমী আপামর দর্শককে। এ সময়ে ফেলুদা চরিত্রে
অভিনয় করেন সব্যসাচী চক্রবর্তী এবং বর্তমানে করছেন আবীর চট্টোপাধ্যায়।সর্বশেষ
ফেলুদা ছবি ডবল ফেলুদায় অবশ্য স্বমহিমায় ফিরে এসেছেন সব্যসাচীবাবু আরও একবার। ৫০
বছর পূর্তিতে ফেলুদা প্রেমীদের জন্য এ যেন স্পেশ্যাল উপহার! সাম্প্রতিককালে ওয়েব
সিরিজে দেখা গেছে ফেলু মিত্তিরের নয়া অবতার। পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় অভিনীত সেই
ফেলুদা অবশ্য অনেকটাই আধুনিক এবং টেক স্যাভি। বাংলাদেশেও একটি ফেলুদা চলচ্চিত্র
বানানো হয়েছে সাম্প্রতিককালে। অপ্সরা থিয়েটারের মামলার নাট্যরূপও মঞ্চস্থ হয়েছে
কলকাতায়।
বেতারে
মূলত রেডিও মির্চিতে সানডে সাস্পেন্স বিভাগে প্রচারিত হয়েছে বেশ কিছু
ফেলুদাকাহিনী। সব্যসাচী চক্রবর্তীর পরিচিত কণ্ঠে এখানেও ফেলুদা বাজিমাত করেছে
জনপ্রিয়তায়। তবে তার আগে বিগ এফ এমেও সন্দীপ রায় কিছু ফেলুদাকাহিনীর বেতার রূপ
পরিচালনা করেছিলেন। আর যেটা হয়তো এখন অনেকে জানলে অবাক হবেন,বেতার মাধ্যমে তার
প্রথম আবির্ভাব ঘটেছিল স্বয়ং স্রষ্টা সত্যজিতের হাত ধরেই,সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কণ্ঠে
বাক্স রহস্য গল্পে ফেলুদার কেরামতি শোনা যায় ‘আকাশবাণী’তে। বিবিসি ওয়ার্ল্ড কেন্দ্র
থেকে ফেলুদার গল্পের ইংরেজি অনুবাদের বেতার রূপ শোনা যায় ২০০৭ সালে,যাতে ফেলুদার হয়ে কণ্ঠ
দেন বলিউড অভিনেতা রাহুল বোস।
ফেলুদা
জ্বরের আরেক রূপ ফেলুদা কমিক্স,বাংলায় অভিজিৎ
চট্টোপাধ্যায় এবং ইংরাজীতে তাপস গুহর অলঙ্করণে ফেলুদার চিত্রকাহিনীও নতুন
প্রজন্মের কাছে সমান জনপ্রিয় হয়েছে। টেলিগ্রাফ সংবাদপত্রে ফেলুদা কমিকস ধারাবাহিক
ভাবে প্রকাশিত হবার পর পেঙ্গুইন বুকসের মত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রকাশনীও
প্রকাশ করেছে ফেলুদার ইংরেজী অনুবাদ এবং কমিকস। আনন্দমেলায় অভিজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের
চিত্রনাট্য ও জল রঙের অলঙ্করণে ফেলুদা
কমিক্স এখনও প্রকাশিত হয়ে চলেছে। শুধু
কমিক্সেই নয়,
সন্দেশ
পত্রিকায় একদা প্রকাশিত কবীর সুমনের লেখা ‘ফেলুদার গান’ পরে এইচ এম ভি দ্বারা
প্রকাশিত মিউজিক অ্যালবামে শোনা যায় অঞ্জন দত্ত, নচিকেতা ও কবীর সুমনের কন্ঠে।
দেখতে
দেখতে
ফেলুদার
যে ইলাস্ট্রেশন পাওয়া যায় তাঁর নিজের রেখায়,সেটা আসলে কার মত দেখতে? সত্যজিৎ নাকি তাঁর প্রিয় অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
যাকে পরবর্তীতে ফেলুদার নামভূমিকায় অভিনয় করতে হয়, তা নিয়ে মতভেদ আছে। তবে একটা
কথা এ প্রসঙ্গে না বললেই নয় তা হল ফেলুদার এই বহুমুখী প্রতিভার একটা জলজ্যান্ত রূপ
কিন্তু স্রষ্টা সত্যজিৎ রায় নিজেও। তাই অনেকের মতে ফেলু আসলে স্রষ্টার স্বয়ং
প্রতিরূপ। তার চরিত্রের মধ্যে থাকা আপাত গাম্ভীর্য আর ব্যক্তিত্বের আড়ালে প্রগাঢ়
রসবোধ,কুসংস্কার বিরোধী
যুক্তিবাদী মন,সবটাই সত্যজিতের একান্ত
নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গীর ফটোকপি বললে ভুল বলা হয়না।
প্রজন্মের
পর প্রজন্ম পেরিয়ে মাত্র ৩৫টা ফেলুদা কাহিনী আর ১৯৯২ সালে স্রষ্টার আকস্মিক
প্রয়াণে অসম্পূর্ণ ৪টি কাহিনী কিভাবে ম্যাজিক মায়ায় আচ্ছন্ন করে রেখেছে গোটা
বাঙালি জাতিকে এমনকি বাংলার সীমানা পেরিয়ে বাকি বিশ্বের দরবারের কিভাবে আছড়ে পড়েছে
ফেলুদা জোয়ার ভাবলে সত্যি অবাক হতে হয়। হয়তো ছায়াছবিতে এখন ফেলুদাকে সেলফোন
ব্যবহার করতে দেখা যায়, ইংরেজি কমিক্সের জিন্স টি শার্ট পরা ফেলুদা তার মগজাস্ত্রের নির্ভরতা কমিয়ে অনেক বেশি
মডার্ন অ্যাকশন হিরো, তবু
আমরা এই আশা নিয়ে থাকতেই পারি যে যুগ বদলালেও যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ফেলুদার
বিশ্বায়নে মূল চরিত্রটির রস ও আবেদন অটুট থাকবে। 'সন্ধ্যা শশী বন্ধু' অমর হয়ে থাকবেন তাঁর
গুণমুগ্ধ পাঠকদের মাঝে।
সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী: কপিরাইট
লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন