প্রতিবেদন
আন্তর্জাতিক
মাতৃভাষা দিবসের আবহে ভাষা নিয়ে চর্চা
অব্যাহত থাকবে এটাই স্বাভাবিক। বিভিন্ন
দৃষ্টিকোণে এই আলোচনা প্রবাহিত। প্রতিটি
ভাষা আগ্রাসন থেকে মুক্ত হয়ে নিজ স্বাতন্ত্র্যে তার অস্তিত্ব বজায় রেখে চলবে এটা প্রাথমিক
চাওয়।l কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এটাও বোঝার বিষয় যে
আজকের এই যোগাযোগের যুগে একটি ভাষা অন্য সকল ভাষা থেকে সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্ত থাকবে
এমন চাওয়াটা ঠিক ন। একটি ভাষা সেই ভাষায়
যাঁরা কথা বলেন তাঁদের জীবন যাপনের ধরন ও সংস্কৃতির ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। দুটি ভাষার, দুটি সংস্কৃতির যখন সহাবস্থান হয়, তখন ঐ দুটি ভাষা পরস্পরের দ্বারা প্রভাবিত হয়। ঐ দুটি সংস্কৃতির মধ্যে পার্থক্যের
জায়গাগুলিতে ব্যবহৃত শব্দাবলী পরস্পরের ভাষায় সঞ্চারিত হ। ভাষার ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানে এর সমর্থন
মেলে। এর ফলে উভয় ভাষাই সমৃদ্ধ হয়। ভাষা আগ্রাসনের সঙ্গে
এই বিষয়টিকে গুলিয়ে ফেলা ঠিক নয়। আগ্রাসনের
ক্ষেত্রে যেটা হয়, একটি বিজয়ী জাতি বিজিত
জাতির ভাষাকে গিলে খেতে চায়। বিজিত
জাতির ভাষাকে জীবনযাপনের সর্বক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় করে দিয়ে বিজয়ী জাতি এটা করে। প্রথমে তারা যেটা করে, বিজিত দেশে সরকারি ভাষা হিসাবে নিজেদের
ভাষা অর্থাৎ বিজয়ী জাতির ভাষা বলবৎ কর।l ফলে বিজিত জাতির ভাষা গুরুত্ব হারায়। এর পরে শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে বিজয়ী
জাতির ভাষাকে আনা হয়। মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার
পথে অন্তরায় সৃষ্টি করা হয়।l সুকৌশলে
এমন একটি আবহ সৃষ্টি করা হয় যেখানে বিজিত জাতির নতুন প্রজন্ম মনে করে, বিজয়ী জাতির ভাষা না শিখলে জীবন জীবিকার
ক্ষেত্রে তারা সমস্যায় পড়বে। ফলে
বিজয়ী জাতির ভাষা শিখতে, সেই ভাষায় পারদর্শী
হতে তারা বাধ্য হয়। তাদের মাতৃভাষা
গুরুত্ব হারাতে হারাতে বিলুপ্তির পথে যায়। পরবর্তীতে ভাষা থেকে আগ্রাসন সংস্কৃতির
পথেও এগো।l বিজয়ী জাতির সংস্কৃতি, তাদের সাহিত্য, নৃত্যকলা, সঙ্গীত বিজিত জাতি
আত্মস্থ করতে শুরু কর।l মায়ের ভাষা, মায়ের সংস্কৃতি বিপন্ন হয়ে বিলুপ্ত হতে
শুরু করে। এটা হলো আগ্রাসন, সন্ত্রাস। যুগে যুগে দেশে দেশে
এইভাবে বহু ভাষা বিজয়ী জাতির আগ্রাসন ও সন্ত্রাসের শিকার হয়ে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
কিন্তু
ভাষার সঞ্চারণ এর থেকে ভিন্ন। দুটি বা ততোধিক ভাষা ও সংস্কৃতি
পাশাপাশি বসবাসের ফলে সঞ্চারণের দ্বারা সমৃদ্ধ হয়। উপকৃত হয়। ইংরাজি ভাষা তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। চলার পথে খৃষ্টপূর্বাব্দ থেকে - রোমান, এ্যাংলো স্যাক্সন, স্ক্যান্ডেভিয়ান, নর্মান, উপনিবেশবাদ - সব যুগে ইংরাজি ভাষা যে যে জাতি ও ভাষা-সংস্কৃতির
সংস্পর্শে এসেছে, সেই সেই ভাষা থেকে
প্রচুর প্রচুর শব্দাবলী ইংরাজি ভাষায় প্রবেশ করেছে। ইংরাজ জাতি খোলা মনে এগুলিকে নিজ ভাষায়
জায়গা করে দিয়েছে. কোনো ছুতমার্গ তাদের
বিভ্রান্ত করে নি। এই পথেই আজ ইংরাজি
ভাষা পৃথিবীর সমৃদ্ধতম ভাষাগুলির মধ্যে অন্যতম। অন্য বহু ভাষার ক্ষেত্রেও এই একই কথা
প্রযোজ্য। সঞ্চারণের মধ্যে দিয়ে ভাষাগুলি উপকৃত
হয়েছে। তাদের শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয়েছে, অলঙ্কার, রূপকের ব্যবহারে মাধুর্য এসেছে। আমাদের মাতৃভাষা বাংলার ক্ষেত্রেও ঐ একই
কথা প্রযোজ্য। বহু বিদেশী শব্দের সম্ভারে বাংলা ভাষা
সমৃদ্ধ।
কোনো
ভাষাই ষোলো আনা খাঁটি নয়। আমাদের বাংলা
ভাষাও ইংরেজি, পোর্তুগিজ, আরবি, ফার্সী ইত্যাদি ভাষা থেকে বহু শব্দ সংগ্রহ করেছে। আজ সেগুলো
আমাদের কাছে পরিচিত। এগুলো যে বরাবর আমাদের শব্দভাণ্ডারে ছিল না - ব্যাপারটা অনেক সময় আমরা খেয়াল করি না।
পঞ্চদশ
শতাব্দীর শেষভাগে পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো-ডা-গামা ভারতবর্ষে আসেন। পর্তুগিজ বণিকরা বাংলা দেশের সঙ্গে
ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করেন। এই যোগাযোগের ফলে বেশ কিছু পর্তুগিজ শব্দ বাংলা
কথাবার্তায় স্থায়ীভাবে যুক্ত হয়। আলমারি, আলকাতরা, সাবান, গামলা, সায়া, ফিতে, বালতি, বোতল, বোতাম, ইস্তিরি, প্রভৃতি শব্দ - সবই পর্তুগিজ ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় এসেছে।
শুধু শব্দ নয়, পর্তুগিজরা এনেছিলেন
বহু নতুন ফল - যেমন, আতা, আনারস, পেঁপে, পেয়ারা, সান্তারা ইত্যাদি। এই শব্দগুলি বাংলা ভাষায় এল। শুধু সান্তারা ফলটির নাম এদেশে কমলালেবু
হয়ে গেল। ফুলকপি, বাঁধাকপির মত উপাদেয়
সব্জি - তাও এই পর্তুগিজদের কল্যাণে। আর পাঁউরুটি।
পর্তুগিজ ভাষায় 'অও' শব্দের অর্থ রুটি, বাঙালীরা কথাটাকে পোক্ত করে তার সঙ্গে
আবার রুটি কথাটা যোগ করেছেন। পর্তুগিজরা ঘরবাড়ি তৈরি করার অনেক শব্দই
আমাদের শব্দভান্ডারে যোগ করেছেন। যেমন, পেরেক. কামরা, বরগা, জানলা, ইস্পাত, মিস্ত্রি ইত্যাদি। এন্তার, নিলাম, মার্কা - এগুলোও
পর্তুগিজ শব্দ। অনেকের মুদ্রাদোষ আছে কথায় কথায় 'মাইরি' বলা, এই বদভ্যাসটিও পর্তুগিজদের অবদান।
১১৯৩
খ্রীষ্টাব্দে মহম্মদ ঘোরি ভারতে মুসলিম রাজত্ব স্থাপন করেন। তার কিছু পর থেকে বাংলা
দেশে মুসলিম রাজত্ব আরম্ভ হয়। ইংরেজদের বাংলা অধিকারের আগে পর্যন্ত মোটামুটি ত্রয়োদশ শতক থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত
মুসলমানরা বাংলা দেশে রাজত্ব করেন। এই সময়ে রাজকার্যে ফারসি ভাষা ব্যবহার করা হত।
ফলে বহু আরবি ও ফারসি শব্দ বাঙালীদের কথাবার্তায় স্থান পেতে শুরু করে। রবিশস্য-এর 'রবি'-র অর্থ আরবি ভাষায় বসন্তকাল। রবিশস্য হল বসন্তকালে কাটা হওয়া
শস্।l গম, যব, কলাই ইত্যাদি।
প্রশংসাসূচক শব্দ 'খাসা' আরবি শব্দ। খেতাব, হুজুর, আমির, নফর, নায়েব, হাজিরা, ফয়সলা, কলম, বই, দোয়াত, মালিক - এগুলো আরবি শব্দ। ফারসি শব্দের উদাহারণ - বাজার, কাগজ, খাতা, জমি, চাকরি, খরচ, আয়না, জামা, শাল, রুমাল, মোজা, উর্দু, তুর্কি, হিন্দু, মুসলমান। আমদানি
ফারসি, কিন্তু রপ্তানি ফারসি নয় - আরবি। সেইরকম
সাহেব হল আরবি, কিন্তু বিবি হল
ফারসি! আইন আদালত সংক্রান্ত বহু শব্দই আরবি ও ফারসি থেকে ধার করা।
শুধু
শব্দ নিয়েছি তাই নয়, তার সঙ্গে প্রত্যয়
যোগ করে শব্দগুলোকে আরও আপন করে নিয়েছি। আরবি শব্দ ওকালত, তার সঙ্গে 'তি' প্রত্যয় যোগ করে করা হয়েছে ওকালতি। সেই
রকম জজ থেকে জজিয়তি। স্ত্রীলিঙ্গ করার জন্য আনি বা নি প্রত্যয় যোগ করা হয়েছে।
ফারসি চাকর থেকে এসেছে চাকরানি। শুভ বা সৌন্দর্যবাচক 'সু' উপসর্গ যোগ করে ফারসি
শব্দ নজর হয়েছে সুনজর, আরবি শব্দ খবর হয়েছে
সুখবর।
ইংরেজদের
রাজত্বে আমদানী হয়েছে বহু ইংরেজি শব্দ - যেগুলির সঙ্গে আমরা অনেকেই পরিচিত। তবে
শব্দের উচ্চারণ আমরা কিছুটা পাল্টেছি। ইংরেজি 'টিকেট' না বলে আমরা বলি
টিকিট, 'স্টুল' না বলে টুল,
'টাইল' না বলে টালি। ডাক্তার, নম্বর, হাসপাতাল, বাক্স, বুরুশ - এগুলো সবই ইংরেজি থেকে ধার করা
শব্দ।
যদি
মনে করা হয়, পরাধীন থাকার কারণে
বিদেশী শব্দগুলিকে বাংলা ভাষায় স্থান দিতে আমরা বাধ্য হয়েছি, সেটা মোটেই সঠিক অবস্থান হবে না, এবং এই সমস্ত শব্দের খাঁটি বাংলা
প্রতিশব্দ তৈরি করতে যদি আমরা মগজ খাটাই, সেটাও
কোনো কাজের কাজ হবে না। সহাবস্থানের
কারণে পৃথিবীর সমস্ত সমৃদ্ধ ভাষা যেভাবে অন্য ভাষা থেকে শব্দ গ্রহণ করে সমৃদ্ধ
হয়েছে, বাংলা ভাষাও তাই করেছে। এই প্রক্রিয়া এখনো চলমান l আজও নতুন নতুন শব্দ একের পর এক বাংলা
ভাষায় স্থান করে নিচ্ছে। এই ঋণ শব্দাবলীকে (Loan Words) স্বাগত করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। এতে বাংলা ভাষার উপকারই হবে ।
শব্দ
এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় আসছে, শুধু তাই নয়। ভিন্ন ভাষার দুটি শব্দ মিলিত হয়ে একটি
শব্দ বা শব্দগুচ্ছ তৈরি করছে। সংস্কৃতির
অঙ্গ হয়ে পড়ছে। এগুলি ব্যবহার করতে করতে আমরা অভ্যস্ত
হয়ে পড়ছি। ভাষার অপরিহার্য অংশ বলে মনে করছি। ইংরাজি ভাষায় motel - (motor+ hotel), smog - (smoke+fog) এমন উদাহরণ। বাংলাভাষায় এমন একটি
শব্দগুচ্ছ একুশে ফেব্রুয়ারি। একুশ
তো বাংল।l ফেব্রুয়ারি ইংরাজি। কিন্তু এই শব্দগুচ্ছ আমাদের প্রতিটি
বাঙালির হৃদয়ে গেঁথে আছে। এটি
সঞ্চারণ, আগ্রাসন ন।l দুটি সংস্কৃতির সহাবস্থানের স্বাভাবিক
ফলশ্রুতি।
আগ্রাসন
ও সঞ্চারণের পার্থক্যটা বুঝতে হবে। কূপমণ্ডুকতা, ছুতমার্গ ভাষার প্রসারণের পথে বাধাস্বরূ।
যাদব চৌধুরী: কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন