অতলান্ত মানবপ্রেমই হল কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাব্যের মুল অভিজ্ঞান



বিবিধ


বিশ শতকের ত্রিশের দশকের কবিদের ব্যাক্তি ভাবালুতার জগৎ থেকে সরে এসে এক ভিন্ন স্বরের বার্তা নিয়ে বাংলা কবিতায় আবির্ভূত হয়েছিলেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। তাঁর এই স্বরের তীক্ষ্ণতা এতটাই তীব্র যে পাঠক কে বাধ্য করলেন তার কবিতায় চোখ ফেরাতে। কাব্য জীবনের শুরু থেকেই তিনি ছিলেন অত্যন্ত স্পষ্ট সহজ ও সত্য উচ্চারণে দীপ্ত। তীব্র অনুভূতি ও অভিজ্ঞতার জারক রস থেকে তুলে আনা জীবন বোধ তিনি তার লেখায় জীবন্ত করে তুললেন। ফলে তাঁর কবিতা হয়ে উঠলো শাণিত এবং স্বতন্ত্র।কবিতায় এলো নতুন একটি স্বর যা সমকালীন কবিদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।যে স্বরে  জেগে উঠলো ব্যক্তি নয়, সমষ্টি। দল নয় ,মানুষ।পাঠকও বরণ করে নিতে বাধ্য হলেন এই কবিকে। অগ্রজ ও কবিরা, বিশেষ করে কাজী নজরুল ইসলাম, বুদ্ধদেব বসু প্রমুখ যে সাম্যবাদের ধ্বনি তাঁদের লেখায় তুলে এনেছিলেন তা ছিল ভাবালুতায় আচ্ছন্ন, অস্পষ্ট। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় প্রথম তাকে প্রতিষ্ঠা দিলেন দৃঢ় ও স্পষ্ট উচ্চারণে। তাই প্রাবন্ধিক অশ্রুকুমার সিকদার মনে করেন পদাতিক কবির এই আবির্ভাব ঐতিহাসিক। তাঁর কথায়, "এই প্রথম একজন কবি রাজনৈতিক দলের মতবাদ পুরোপুরি মেনে নিয়ে, সেই মতবাদে দীক্ষিত হয়ে, দলভুক্ত রাজনীতির প্রতিনিধি হিসেবে বাংলায় কবিতা লিখলেন। সাম্যবাদের ছাপ বাংলা কবিতায় অবশ্য আগেই পড়েছিল; নজরুল অগ্নিবীণা বাজিয়েছিলেন, ফ্যাসিবিরোধী আন্দোলনের সময় বুদ্ধদেব বসুর মতো একান্ত প্রেমের কবি ও লিখেছিলেন 'বৃহন্নলা, ছিন্ন করো ছদ্মবেশ'- কিন্তু সেই সব ক্ষেত্রে সাম্যবাদ একটা ভাবালুতাপূর্ণ অনুষঙ্গ জাগিয়েছিল মাত্র। আর সেই সাম্যবাদের অস্তিত্ব লেনিনের রচনায় ছিল না। ছিল কবিদের কল্পনায়, মানবিক সহানুভূতিতে বিমুখ বিশ্ব বিষয়ে কবিদের বিরূপতায়। এই অবস্থায় 'পদাতিক' হাতে নিয়ে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের প্রবেশ ঐতিহাসিক।"

অশ্রুবাবুর এই মূল্যায়নকে মাথায় রেখেও বলতে দ্বিধা নেই, কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় আদ্যন্ত একজন মানব প্রেমিক কবি। কারণ তিনি কবিতার থেকে মানুষকে সর্বাগ্রে স্থান দিয়েছেন পাশাপাশি, আরো বলা যায়  তাঁর কবিতায় যতই সমাজ মনস্কতা, সাম্যবাদ, সমষ্টি ভাবনা, থাকুক না কেন তিনি কিন্তু সবার আগে জায়গা করে দিয়েছেন মানুষকে, মানুষের প্রতি ভালোবাসাকে। প্রাবন্ধিক অশ্রুকুমার সিকদার মনে করেন, " আসল কথা, সুভাষ মুখোপাধ্যায় যে জাতের কবি তারা মানুষের চেয়ে কবিতাকে বেশি দাম দিতে নারাজ।" আর মানুষের প্রতি এই ভালোবাসা, প্রেম তাঁকে তথাকথিত প্রেম, প্রকৃতি থেকে ছিন্ন করে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে যন্ত্রণা ক্লিষ্ট  মানুষের কাছে। বাধ্য করেছে সমগ্র মানুষের মুক্তির জন্য কবিতাকে হাতিয়ার করে তুলতে। তাই বুদ্ধদেব বসু বলেছেন- "...তাঁর মুক্তি কামনা একলার জন্য নয় কোন বিধাতা নির্বাচিত মনীষী সম্প্রদায়ের জন্য নয়, কোন বিধাতা নির্বাচিত মনীষী সম্প্রদায়ের জন্য নয়,সমগ্র মনুষ্য সমাজের জন্য।" সুতরাং, কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাব্য প্রবাহে সমগ্র মানুষের মুক্তির আড়ালে মূলত বন্দিত হয়েছে মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসা। যা তাকে মানবপ্রেমী কবি হিসাবে চিহ্নিত করে দেয় চিরকাল।

নদিয়ার কৃষ্ণনগরে ১৯১৯  সালের ১২ ফেব্রুয়ারি  কবির জন্ম। বাবার বদলির চাকরির জন্য তাকে বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়েছে কলকাতায় পড়াকালীন কবি কালিদাস রায়কে যেমন শিক্ষক হিসেবে পেয়েছেন, তেমনি বন্ধু হিসেবে পেয়েছেন বহু গুণী মানুষকে। অগ্রজ  কবি বন্ধু সমর সেন -এর মাধ্যমে পেয়েছিলেন 'হ্যান্ড বুক অফ মার্কসিজম' বইটি। এই বইটি পড়ার পর তার দীক্ষা লাভ ঘটলো সাম্যবাদী ভাবনায়। দিনবদলের স্বপ্ন নিয়ে বাংলা কবিতায় কলম ধরলেন। মার্কসীয় রাজনীতির সক্রিয় কর্মী হলেও তিনি কবিতায় তুলে আনলেন মানুষের কথাকে, দলকে নয়।অনেকে তাঁকে রাজনৈতিক কবি বলে চিহ্নিত করলেও তা সত্য নয়। বরং তাঁর কবিতা মূল্যায়ন করলে যেটা উঠে আসে তা হল, তিনি মানুষের কবি, মানবতার কবি। 'পদাতিক' থেকে শুরু করে তার পরবর্তী কাব্যগুলিতে যা স্পষ্ট রূপে প্রতীয়মান। ফলে তাঁর কবিতা যেন মানব কল্যাণের জন্য চরম আত্মবিশ্বাসে ভরপুর এক শানিত হাতিয়ার। কবি তথাকথিত প্রেম, প্রকৃতিকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে গাইলেন মানুষের মুক্তির গান। 'পদাতিক' কাব্যের 'মে দিনের কবিতা'-য় তাই তাঁর স্পষ্ট উচ্চারণ-


"প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য

ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা

চোখে আর স্বপ্নের নেই নীল মদ্য

কাঠফাটা রোদ সেঁকে চামড়া।


চিমনির মুখে শোনো সাইরেন শঙ্খ

গান গায় হাতুড়ি ও কাস্তে

তিল তিল মরণেও জীবন অসংখ্য

জীবনকে চায় ভালবাসতে।"

কাব্য জীবনের শুরুতেই এভাবে বলার সাহস তিনি যে দেখাতে পেরেছিলেন তা গড়ে উঠেছিল তাঁর সাম্য বোধ ও সাম্যবাদী চেতনার  আদর্শে গড়ে ওঠা কবি মানসের জন্য।

জীবনের প্রতি এই ভালবাসাই কবির পাথেয়।অনেক সমালোচক এই কবিতাগুলিতে নান্দনিক দিকের অভাব লক্ষ্য করেছেন।অনেকাংশে তা সত্যি হলেও কাব্য জীবনের পথ চলার শুরুতে এরকম দ্বিধাহীন আত্মবিশ্বাসী উচ্চারণ একজন দক্ষ কবির সত্তাকে চিনিয়ে দেয়। আমার মনে হয়  এরকম দীপ্ত আত্মবিশ্বাসে ভরপুর উচ্চারণ কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় অর্জন করেছেন চল্লিশের উত্তাল সময়ের প্রেক্ষিত থেকে। সেই সঙ্গে সাম্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গিও তাঁকে শাণিত করেছিল।ফলে, সব মিলে সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে তৈরি করেছিল  মানুষের কবি তথা মানবপ্রেমিক কবি হিসাবে। আর তার কবিসত্তার এই উদ্ভাসকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন স্বয়ং বুদ্ধদেব বসু। তাঁর কথায়, "অভিনন্দন তাঁকে জানাবো, কিন্তু তা শুধু এই কারণে নয় যে তাঁর কবিতা অভিনব। যদিও তার অভিনবত্ব পদে পদেই চমক লাগায়।তাঁর সম্বন্ধে সবচেয়ে বড় কথা এই যে মাত্র কয়েকটি কবিতা লিখে তিনি নি:সংশয়ে  প্রমাণ করেছেন যে তিনি শক্তিমান; যেকোনো আদর্শেই না বিচার করি, মন দিয়ে পড়লে তাঁর কাব্যের স্বার্থকতা  স্বীকার করতেই হয়।তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'পদাতিক' আমার এ কথার সাক্ষ্য দেবে।"

নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের মুক্তি প্রার্থনায় ছিল 'পদাতিক' কাব্যের লক্ষ্য। ফলে এই কাব্যে সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের অত্যাচারে লাঞ্ছিত মানুষের প্রতি যে ভালোবাসা ধরা পড়েছে তার প্রকাশও ছিল তীক্ষ্ণ। কিন্তু এর পরের দিকের কাব্য গুলিতে সেই ধার অনেকটা মন্থর হয়েছে। বরং সেখানে অনেক বেশি প্রকাশ পাচ্ছে কবির অভিজ্ঞতার গভীরতা।ফলে, এ সময়ে কবির কবিতায় মানুষের প্রতি গভীর প্রেমের পাশাপাশি দেশ বন্দনা, সমকালীন সময়ের (মন্বন্তর সহ অন্যান্য ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাত) দংশন, সর্বোপরি  মানবতা তাঁর কবিতার শরীরে জায়গা করে নিয়েছে। এ সময়ে বিপর্যস্ত জীবনের ঘুর্নিপাকে কবি কখনো কখনো বিচলিত হয়েছেন ঠিকই, কিন্তু ভাবনার জগতে আত্মপ্রত্যয় থেকেছেন। আবেগ এখানে সংযত। ব্যাপকতর জীবনের পরিপ্রেক্ষিতে খুঁটিনাটি ঘটনা ও বাইরের পৃথিবীর দিকে কবির দৃষ্টি নিবন্ধ। তাই এ সময়ের কবিতা সহজ, সরল দৈনন্দিন জীবনের কথায় সমৃদ্ধ। 'চিরকুট', 'অগ্নিকোণ' কাব্যের কবিতায় 'পদাতিক' পর্বের ছাপ কিছুটা থাকলেও 'ফুল ফুটুক', ' যত দূরেই যাই', 'কাল মধুমাস' প্রভৃতি কাব্যগুলি কবির প্রাত্যহিক জীবন ছবির প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে  কাব্যিক ছোঁয়ায়।একটা গল্প বলার প্রতি ঝোঁক লক্ষনীয় কবিতাগুলোতে। সেই সঙ্গে চিত্রকল্পের অভিনব ব্যবহার ও গদ্যের আঙ্গিকে কথা বলার রীতি রপ্ত করেছেন কবি এ সময়।আর, এই প্রবণতা তাঁকে অনেক বেশি মানবতাবাদী করে তুলেছে এবং মানুষের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা ও ভালোবাসা ক্রমে তীব্রতর হয়েছে –

 ( ১)

"যাদের রক্তে উড়ছে আকাশে

মিলের ধোঁয়া

মুষ্ঠিমেয়ের খেয়ালেই এই

ভরা ভুবনে

তাদের ভোলা" (এখানে)


(২)

"জলায় এবার ভালো ধান হবে

বলতে বলতে পুকুরে গা ধুয়ে

এ বাড়ির বউ এলো আলো হাতে

সারাটা উঠোন জুড়ে

অন্ধকার নাচাতে নাচাতে।(আরও একটা দিন)


( ৩)

“মার হাতে ছেঁড়া শাড়িটা এগিয়ে দেয়

লজ্জাকে মাথায় মনি করা ছোট্ট একটি জীবন- কদিন আগেও

শানের উপর যে হামা দিত!" ( ড্যাং ড্যাং করে)


 (৪)

"হামাগুড়ি দেয়

ব্যথা পেলে কাঁদে,

পড়ে গেলে ঠেলে উঠে ফের,

ছোট ছোট দুটো মুঠো দিয়ে বাঁধে

স্বাদ আহ্লাদ আমাদের।"( শুধু ভাঙা নয়)

এ রকম অজস্র উদ্ধৃতি তুলে ধরা যায় কবির মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা ও ভালোবাসার প্রমাণ স্বরূপ। ইমেজের পর ইমেজ সাজিয়ে এবং কাব্যশৈলীর কুশলতায় কবি এ পর্বে তাঁর মানবিক ভাবনায় উজ্জল। যা তাঁকে একটা উত্তরণের পথে এগিয়ে দেয়। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের এই কাব্য উত্তরণে বিষয় হিসাবে এসেছে দেশকালের পাশাপাশি  আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সমস্যা। বিশেষত আফ্রিকার মানুষের লড়াই ও সংকট কবিকে সর্বদা তাড়িত করেছে। আফ্রিকার কালো মানুষদের প্রতি গভীর ভালোবাসার স্পর্শ পাই তার 'মেজাজ' কবিতার শেষে বৌমার কথায় -


"ও মা, বউমা বেশ  ডগ মগ হয়ে বলছে :

'কি নাম দেবো জানো?

আফ্রিকা

কালো মানুষেরা কি কান্ডই না করছে সেখানে'।"

এ কথা বলবার অপেক্ষা রাখে না যে, আফ্রিকার মানুষদের প্রতি এই ভালোবাসা আসলে কবির বিশ্বমানবতা বোধের বহিঃপ্রকাশ। যা তাঁর সমাজমনস্ক ভাবধারার অন্তরালে চির জায়মান ছিল।ফলে, তা কখনো দেশ মাতার প্রতি গভীর ভালবাসায় প্রকাশিত,কখনোবা তা আন্তর্জাতিকতার ছোঁয়ায় ব্যাপ্ত।তাই দেশের প্রতি গভীর ভালোবাসায় কবি যখন বলেন-


"মুখ বন্ধ করে

অক্লান্ত হাতে-

হে জননী,

আমরা ভালোবাসার কথা বলে যাব।।" (জননী জন্মভূমি)

এই ভালবাসাই প্রকৃতই মানুষের প্রতি কবির গভীর অতলান্ত প্রেমের প্রকাশ।

মানবপ্রেমের এই গভীর উপলব্ধিই কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় চিরকাল নিভৃতে বহন করেছেন। যা তাঁর বিভিন্ন কাব্যে আলাদা আলাদা রুপে  মর্মরিত হয়ে আছে।কোথাও তার সরাসরি উচ্চকন্ঠে প্রতিবাদ হয়ে, আবার কোথাওবা ব্যঙ্গ, ব্যঞ্জনার সুচারু উপস্থাপনায়। ফলে, বাংলা কবিতায় তিনি যতই সাম্যবাদী, সমাজমনস্ক ,রাজনৈতিক প্রভৃতি কবি অভিধায় ভূষিত হয়ে থাকুন না কেন আসলে এসবের অন্তরালে ফল্গুধারার মত চির জায়মান মানবপ্রেমই তাঁর কাব্যের বৈশিষ্ট্য।কারণ তাঁর জীবন দর্শন-ই হল- " নতুন পৃথিবী ,অজস্র সুখ ,সীমাহীন ভালোবাসা।"

তাজিমুর রহমান: কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন